#লেবু
৩
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
দীর্ঘ এক মাস অক্লান্ত পরিশ্রম আর অনুসন্ধানের পর সাবা প্রস্তুত করেছে রাজধানীর অস্থায়ী হকারদের নিয়ে একটি রিপোর্ট। এই রিপোর্টের শুট হবে আজ। গোপন ক্যামেরা দিয়ে আগে শুট করা হবে প্রভাবশালীদের অস্থায়ী হকারদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়ার দৃশ্য। এরপর সাবা নিজেই ক্রেতা সেজে ভিন্ন ভিন্ন হকারদের কাছে যাবে। কৌশলে প্রশ্ন করবে।
পুরো রিপোর্টটা করা হবে গোপন ক্যামেরায়। সঙ্গে থাকবে সাবার ভয়েসওভার। দীর্ঘদিন ধরে এই সমস্যাটা নিয়ে রিপোর্ট তৈরির কথা ভাবছে সে। সাধারণ পথচারী হিসেবে এই হকারদের যন্ত্রণায় ফুটপাত ধরে হাঁটতেও হিমশিম খেতে হয়। কারা এতটা প্রশয় দিচ্ছে তাদের? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই রিপোর্টটা শুরু করে সাবা। কেন যেন তার মন বলছে, এই একটা রিপোর্ট ঘুরিয়ে দেবে তার ক্যারিয়ারের মোড়।
ভোর বেলা উঠে রিপোর্টটা লিখতে লিখতে সাবার হঠাৎ মনে হলো, নতুন কয়েকটা শব্দ যোগ করা যেতে পারে রিপোর্টে। যে শব্দগুলো রোজকার জীবনে ব্যবহৃত হয় না। নতুন শব্দ খোঁজার তাগিদেই সাবা দ্রুত পায়ে প্রবেশ করলো শাফকাতের স্টাডি রুমে। সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস শাফকাতের। তার মুখোমুখি হবার প্রস্তুতি নিয়েই স্টাডি রুমে পা রেখেছিল সাবা। কিন্তু পাওয়া গেল না তাকে।
এসি চলছে, মাথার ওপরে ফ্যান ঘুরছে, টেবিলে ল্যাপটপ অন করে রাখা। তার মানে শাফকাত উঠে গেছে, কিন্তু ক্ষণিকের জন্যে এ ঘর থেকে বেরিয়েছে হয়তো। মনে মনে স্বস্তিই পেলো সাবা। যত দ্রুত ডিকশনারি নিয়ে এখান থেকে ফিরতে পারে, ততটাই ভালো তার জন্যে।
বুকশেলফ থেকে ডিকশনারি নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ানোর পথে নিজের অজান্তেই সাবার চোখ পড়লো শাফকাতের অন করে রাখা ল্যাপটপের দিকে। স্ক্রিনে যা দেখলো, তা প্রচন্ড গতিতে তার শিরদাঁড়া প্রকম্পিত করে তোলার জন্যে যথেষ্ট।
একটা অডিও ফাইল পজ করে রাখা। ফাইলের নাম ‘Saba call recording’। লেখাটার পাশে কতগুলো এলোমেলো নম্বর। নম্বরগুলো চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পেলেও তা প্রবেশ করতে ব্যর্থ হলো সাবার মস্তিষ্কে।
একই সঙ্গে হাজারখানেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তার মাথায়। এই সাবা কী সে? না-কি ভিন্ন কোনো সাবার কল রেকর্ডিং বিচরণ করে বেড়াচ্ছে শাফকাতের ল্যাপটপে? এটা কি শাফকাতের সঙ্গে তার কোনো ফোনালাপের রেকর্ডিং? সাবা মনে করার চেষ্টা করলো বিয়ের এতগুলো দিনে তাদের কখনো ফোনে কথা হয়েছে কিনা! মনে করতে পারলো না। তাহলে এটা কীসের রেকর্ডিং?
কৌতুহলে আর বিস্ময়ে রীতিমত কেঁপে উঠছে সাবা। একটু একটু করে এগিয়ে গেল ল্যাপটপের দিকে। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করলো মাউস। একবার মনে হলো, এভাবে কারো ব্যক্তিগত জিনিসে হাত দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। আবার পরমুহূর্তেই মনে হলো, এই ফাইলের সঙ্গে তার নাম জড়িয়ে আছে। তাই ফাইলের ভেতরে কী আছে তাকে খুঁজে বের করতেই হবে।
অডিও প্লে করতেই আরেকদফা চমকে উঠলো সাবা। কানে স্পষ্ট ভেসে আসছে নিজের কণ্ঠস্বর। কাল রাতে বাড়ি ফিরে অফিসের এক ক্যামেরাম্যানকে রিপোর্ট সংক্রান্ত নির্দেশনা দিচ্ছিল সে। সংক্ষিপ্ত সেই কথোপকথনের রেকর্ডিং! সাবা ভেবে পাচ্ছে না এই রেকর্ডিং শাফকাতের ল্যাপটপে এলো কী করে?
অডিও ফাইলটা থেকে বেরিয়ে সম্পূর্ণ ফোল্ডারে চোখ বুলাতেই পিলে চমকে উঠলো সাবার। তার অসংখ্য কল রেকর্ডিংয়ে ভর্তি এই ফাইল। সাবা মস্তিষ্ক যেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। মাথা ঝিমঝিম করছে রীতিমত। তার অজান্তেই তার ফোনালাপগুলো রেকর্ড হচ্ছিল এতদিন? অথচ একবারও টের পেলো না সে?
হঠাৎ কারোর পায়ের শব্দ এসে ঠেকলো তার কর্ণকুহরে। তবুও সতর্ক হয়ে সরে গেল না সাবা। তার বিভ্রান্ত চোখদুটো এখনো আবদ্ধ হয়ে আছে ল্যাপটপ স্ক্রিনের দিকে।
সাবাকে ল্যাপটপের কাছে দেখে মোটেও ঘাবড়ে গেল না শাফকাত। সে জানে, ধরা পড়ে গেছে সে। তবুও তার মাঝে নেই বিন্দুমাত্র ভয়, বিন্দুমাত্র অনুতাপ।
উল্টো মৃদু ধমকের সুরে সাবাকে সে বলল, “এই মেয়ে! আমার ল্যাপটপ নিয়ে কী করছো?”
ধমকে দমে গেল না সাবা। দৃঢ় কন্ঠে বলল, “আমার কল রেকর্ডিং আপনার কাছে এলো কী করে?”
শাফকাত ভাবলেশহীন গলায় বলল, “আমি আগে প্রশ্ন করেছি।”
সাবা রেগে জ্বলে উঠে বলল, “ফাজলামি করছেন আপনি? এসবের মানে কী?”
শাফকাত থমথমে গলায় বলল, “মানে বুঝতে পারছো না? এই আইকিউ নিয়ে সাংবাদিকতা করছো কী করে?”
সাবার সারা গায়ে তীব্র দাবদাহের অনুভূতি। এসির মধ্যেও ঘামতে শুরু করেছে সে। কী করে ভেতরে একটু একটু করে বাড়ন্ত রাগটাকে নিয়ন্ত্রণ করবে নিজেই বুঝতে পারছে না। একে তো নিজের কল রেকর্ডিংয়ের অস্তিত্ব শাফকাতের ল্যাপটপে। তার ওপরে আবার শাফকাত সোজাসুজি উত্তর না দিয়ে হেঁয়ালি করছে!
সাবার অগ্নিদৃষ্টি উপেক্ষা করে হালকা গলায় শাফকাত বলল, “তোমার ফোন ট্র্যাক করা সাবা আমির।”
আকাশ থেকে যেন পড়লো সাবা। তার চোখমুখ রক্তশূণ্য হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। তৎক্ষণাৎ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতেও ব্যর্থ হলো শাফকাতের সামনে। তার চোখেমুখে কেবলই বিস্ময়, কেবলই জমে যাওয়া এক আতঙ্ক।
সাবা নিচু স্বরে বলল, “কবে থেকে?”
শাফকাত নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “যেদিন থেকে এ বাড়িতে আছো।”
সাবা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “How dare you? কোন সাহসে আমার পারমিশন ছাড়া আমার ফোন ট্র্যাক করেছেন আপনি?”
শাফকাত সূক্ষ্ম হাসি হেসে বলল, “তোমার ফোন ট্র্যাক করা যে খুব সাহসের কাজ তা তো জানতাম না।”
সাবার মস্তিষ্ক কাজ করছে না আর। রাগ দেখাতেও যেন ভুলে গেছে সে। শাফকাতের ক্ষমতা যে অনেক এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। সাইবার সিকিউরিটির একটা বিরাট কোম্পানি আছে তার। দেশের নামি-দামী তারকাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে কল লিস্ট, সব কিছুরই সুরক্ষা নিশ্চিত করে তার কোম্পানি। শাফকাতের পক্ষে ফোন ট্র্যাক করা খুব একটা কঠিন কাজ নয়। কিন্তু একটা ব্যাপার সাবা কিছুতেই বুঝতে পারছে না, তার ফোন কেন ট্র্যাক করতে যাবে শাফকাত? তাকে নিয়ে মাথাই বা কেন ঘামাতে যাবে? এমন তো নয় তাদের দুজনের কারো কাজেই এই বিয়ের কোনো গুরুত্ব আছে!
সাবার বিরক্তভরা মুখটা দেখে শাফকাত বলল, “দেখো তুমি বিরক্তিকর হও আর যাই হও, বিয়ে যখন করেছি ফেলে তো দিতে পারি না। আমার একটা দায়িত্ব আছে তোমার প্রতি। তোমার যে বয়স, এই বয়সে মানুষ প্রায়ই ভুল করে বসে। এখন তুমি যদি একটা ভুল করো, সেই দায় তো আমাকেই নিতে হবে। আমি তো শুধু নিজেকে দায়মুক্ত রাখার চেষ্টা করছি।”
আরেকদফা গা জ্বলে গেল সাবার। তবে এবার রাগে নয়, অপমানে। এই বোঝাতে চাইছে লোকটা? সাবা অন্য কোনো ছেলের সাথে প্রেম করে বেড়াচ্ছে কিনা, এটা তদারকি করার জন্যে ফোন ট্র্যাক করেছে সে? সাবাকে দেখে কি এতটাই নিচু মানসিকতার মেয়ে বলে মনে হয়?
সাবা চেঁচিয়ে বলল, “আমার ওপর গোয়েন্দাগিরি করার কোনো অধিকার আপনার নেই। আপনি জানেন আমার ফোন ট্র্যাক করার অপরাধে আমি আপনার নামে কেস করতে পারি?”
শাফকাত শান্ত গলায় বলল, “করো তো তাহলে! আমিও দেখবো কে তোমার কেস নেয়।”
সাবা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, “এই যে প্রতিনিয়ত ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন, খারাপ লাগে না?”
শাফকাত সোজাসাপ্টা উত্তরে জানিয়ে দিলো, “একফোঁটাও না।”
সাবা হুমকির সুরে বলল, “একটা কথা পরিষ্কার জেনে রাখুন শাফকাত আলম, আমি আপনার কেনা গোলাম নই। আমার সঙ্গে যা খুশি তাই আপনি করতে পারেন না।”
“তাই না?”
শাফকাতের হঠাৎ কী যে হলো, এক নিমিষে সাবাকে চেপে ধরলো দেয়ালের সঙ্গে। এতক্ষণ বহুকষ্টে নিজেকে শান্ত রেখেছে শাফকাত। নিজেকে সর্বক্ষণ এভাবেই তো রাখতেই চায়। বিপত্তি বাঁধায় এই মেয়ে। এমন সব কান্ড করে যে মাথাটা বিগড়ে যায় তার।
শাফকাতের এমন কান্ডে রীতিমত হকচকিয়ে গেল সাবা। চোখদুটো বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো শাফকাতের দিকে। সাবার দুহাত নিজের শক্ত হাতের মুঠোয় নিয়ে দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরেছে শাফকাত। তার একেকটা অস্থির নিঃশ্বাস এসে পড়ছে সাবার মুখের ওপরে। শাফকাতের দু চোখ দিয়ে যেন অগ্নি ঝরছে। আর সেই অগ্নিতেই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে সাবা।
সাবা পুড়লো। প্রাণপণ চেষ্টায় নিজেকে শক্ত রেখে বলল, “কী করছেন? ছাড়ুন! ছাড়ুন আমাকে!”
শাফকাত তাকে ছাড়লো তো না-ই, বরং আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরলো। সাবাকে চুপ করানোর জন্যে একটা আঙুল রাখলো তার ঠোঁটের ওপরে। বিয়ের এতগুলো দিনে শাফকাত কখনো এতটা কাছাকাছি আসেনি তার। সাবার যেন আত্মা উড়ে যাওয়ার উপক্রম।
শাফকাত নিচু স্বরে বলল, “হুস! বাড়ির সবার ঘুম ভাঙাতে চাও না-কি?”
শাফকাতের কথা বা কাজ কোনোটাতেই দমে না যাওয়া সাবা, তার স্পর্শে দমে গেল। হৃদস্পন্দন এক লাফে বেড়ে উড়ে গেল আকাশে। সাবা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো, শাফকাতের স্পর্শে তার অস্বস্তি হচ্ছে না। আবার ভালোও লাগছে না।
সাবা দমে যাওয়া কণ্ঠে বলল, “আপনি ছাড়ুন আমাকে।”
শাফকাত তাকে না ছেড়ে তার কানের কাছে ঠোঁট এনে বলল, “তুমি আমার কে?”
পাথরের ন্যায় জমে রইলো সাবা। তার দৃষ্টি মেঝের দিকে আবদ্ধ। কিছুই বলতে পারলো না শাফকাতের প্রশ্নের উত্তরে।
শাফকাত ফিসফিস করে বলল, “বউ তুমি আমার। চাইলে এই মুহূর্তে যা খুশি তাই করতে পারি তোমার সঙ্গে। করবো না-কি?”
সাবাকে দ্রুতই ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল শাফকাতের। কিন্তু ব্যাঘাত ঘটালো তার দীঘল কালো চুল। মেয়েটার চুলগুলো থেকে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ আসছে। ঘ্রাণটা যেন দিশেহারা করে তুলল শাফকাতকে। খুব কাছাকাছি গিয়ে শাফকাত মুখ ডুবিয়ে দিলো সাবার চুলে।
তার এমন কর্মকান্ডে সাবার চক্ষু চড়কগাছ! খুব করে চাইছে এই মুহুর্তে শাফকাতকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে। তবে এক ফোঁটাও জোর পেলো না হাতদুটোতে।
আচমকা হুশ ফিরলো শাফকাতের। নিজেকে পোষ মানিয়ে রাখা সত্বেও এতটা বেপরোয়া নিয়ন্ত্রণহীন কী করে হয়ে উঠতে পারলো সে? সব দোষ এই মেয়েটার। তার সর্বাঙ্গে প্রতিনিয়ত আগুন ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে দায়ী এই মেয়ে।
সাবা ছেড়ে সরে দাঁড়িয়ে শাফকাত বলল, “যখন তখন আমাকে বিরক্ত করবে না। ঘরে যাও।”
শাফকাত ছেড়ে দেওয়ার পরও এক বিন্দু নড়তে পারলো না সাবা। একই ভঙ্গিতে জমে দাঁড়িয়ে রইলো। পরমুহূর্তেই সংবিৎ ফিরে পেয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল স্টাডি রুম।
নিজের ঘরে পা রেখেই দরজা বন্ধ করে সাবা বসে পড়লো মেঝেতে। তীব্র শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তার। সাবা তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়িয়ে বেডসাইড টেবিলের কাছে গেল। ড্রয়ার থেকে ইনহেলার বের করে সেটা মুখের কাছে নিয়ে দুবার চাপলো।
শরীর কিছুটা শান্ত হলেও মন একইভাবে অশান্ত হয়ে গেল। যথেষ্ট সহ্য করেছে সে। আর নয়। শাফকাত যা শুরু করেছে, তাকে বাড়াবাড়ি বললেও কম হবে। তার ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে। তার অনুমতি ছাড়া ফোন ট্র্যাক করছে। হুটহাট কাছে আসার চেষ্টা করছে। এসব তো আর মেনে নেওয়া যায় না।
(চলবে)