লেবু পর্ব-১১+১২

0
7

#লেবু
১১
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

জ্যাজ মিউজিক বাজছে গোটা হল জুড়ে। ক্ষীণ উজ্জ্বল আলোর ছড়াছড়ি চারিপাশে। পারফিউমের ঘ্রাণ, সিগারেটের গন্ধ মিলেমিশে আছে বাতাসে। শাফকাতের সঙ্গে বিয়ের পর থেকে প্রায় বাধ্য হয়েই দুয়েকটা হাই প্রোফাইল পার্টিতে এসেছে সাবা। আজও নেহায়েত বাধ্য হয়েই এসেছে। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই নামী-দামী মুখ। সেলিব্রিটি, বিজনেসম্যান, রাজনীতিবিদের মেলা বসেছে যেন এই পার্টি হলে।

সকলের সামনে সাবার হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে শাফকাত। সামনে যে পড়ছে অতি উচ্ছ্বাস নিয়ে কথা বলছে তাদের সঙ্গে। সবথেকে অদ্ভুত ব্যাপার, শাফকাতের হাতটা ধরে বিন্দুমাত্র অস্বস্তি বোধ হচ্ছে না সাবার। এর আগে মানুষকে দেখানোর খাতিরেই হোক, যতবারই শাফকাত তার হাতটা ধরেছে ততবারই মনে হয়েছে কখন সে ছাড়া পাবে! অথচ আজ সেই প্রশ্ন জাগছেই না মনে। বিচিত্র ভালো লাগার এক ঢেউ খেলে যাচ্ছে মনের মাঝে। অগাধ ভরসা আছে যেন শাফকাতের স্পর্শের মাঝে।

সাবার হাতটা ধরে রেখেই শাফকাত বুড়ো আঙুল ধীরস্থির ভঙ্গিতে বুলিয়ে দিচ্ছে তার হাতের ওপরে। এই এতটুকু কাজ সাবাকে এলোমেলো করে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট। সাবা ভেবেছিল জীবনে প্রেম ভালোবাসার মন মানসিকতা তার মধ্যে থেকে হারিয়ে গেছে। অনুভূতিহীন যন্ত্রমানবী হয়ে গেছে সে। তবে তারই মতো আরেক যন্ত্রমানব এসে কী করে তার মধ্যে প্রাণ ফিরিয়ে আনছে? যে মানুষটাকে সাবা বিন্দুমাত্র সহ্য করতে পারে না, তার প্রতি দিন দিন দুর্বলতা বাড়ছে কেন?

মিনিট দশেকের মাঝেই অধৈর্য হয়ে পড়লো সাবা। অচেনা মানুষকে অহেতুক, “কেমন আছেন? ভালো আছি।” বলা নেহায়েত সহজ কাজ নয়।

সাবা বিরক্ত ভঙ্গিতে নিচু গলায় বলল, “আর কতক্ষণ থাকতে হবে এখানে?”

শাফকাত সাবার থেকে বেশ অনেকখানি লম্বা। তার দিকে ঝুঁকে কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে বলল, “বেশিক্ষণ থাকবো না। একটু পরেই চলে যাবো।”

কেমন জড়সড় হয়ে গেল সাবা। ইদানিং শাফকাত বারবার অজুহাত খুঁজছে তার কাছাকাছি আসার। আর সাবার মনটাও হয়ে উঠেছে বেহায়া-নির্লজ্জ। শাফকাতের এই কাছে আসাগুলো ভালো লাগার প্রবল স্রোতে ভাসিয়ে দেয় তাকে। এই যেমন এই মুহূর্তে দিচ্ছে।

সাবা অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে কোমল গলায় বলল, “কেন করছেন এসব?”

শাফকাত ভ্রু কুঁচকে বলল, “কোন সব?”

সাবা অন্যরকম গলায় বলল, “এই যে আমার হাত ধরে হাঁটছেন, কানে কানে কথা বলছেন। মানুষকে দেখানোর জন্য?”

শাফকাত নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “আমি কাউকে দেখানোর জন্যে কিছু করি না।”

সাবা হঠাৎ খেয়াল করলো কিছুটা দূরে বার কাউন্টারে বসা দুজন নারী হা করে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। দুজনের পরনেই জাঁকজমক পোশাক, মুখে কড়া মেকআপ। দুজনেই পরিচিত মুখ। সিনেমার জগতে নায়িকা হিসেবে বেশ নাম কামিয়েছে তারা।

তাদের এমন তাকিয়ে থাকা দেখে সরে যেতে চাইলো সাবা। কিন্তু শাফকাত তার হাতের পোক্ত বাঁধনে আটকে ফেলল সাবাকে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে শাফকাতও তাকালো তাদের দিকে। তৎক্ষণাৎ ওই দুজন নায়িকা অন্যদিকে ফিরে দিকে।

শাফকাত সূক্ষ্ম হাসি হেসে বলল, “দেখতে দাও। আট বিলিয়ন মানুষের পৃথিবী! কয়জনের চোখ বন্ধ করে রাখবো?”

সাবার বিশ্বাসই হচ্ছে না এই মুহুর্তটা বাস্তব। মনে হচ্ছে যেন স্বপ্নদৃশ্য কোনো। সে আর শাফকাত ঝগড়া না করে স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে। কিংবা বলা ভালো, তাদের এই কথোপকথন স্বাভাবিকেরও উর্ধ্বে।

সাবা শাফকাতের দিকে তাকিয়ে হেঁয়ালির সুরে বলল, “ভুল করলেন শাফকাত আলম।”

শাফকাত বিভ্রান্ত গলায় বলল, “কোন ভুল?”

সাবা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “সুন্দরী নায়িকারা আপনার সঙ্গে কথা বলার, ফ্লার্ট করার সুযোগ খুঁজছে। আর আপনি আমার মতো একটা মেয়ের হাত ধরে হাঁটছেন।”

শাফকাত শান্ত কিন্তু তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “নিজেকে এত আন্ডারয়েস্টিমেট করবে না সাবা। তুমি নিজেও জানো না তুমি কী?”

সাবা একরাশ আগ্রহ নিয়ে বলল, “কী আমি?”

শাফকাত কয়েক মুহূর্ত ভেবেও উত্তরটা খুঁজে পেলো না। আসলেই তো! কী আছে এই মেয়েটার মধ্যে? নিজেকে প্রতিনিয়ত সামলে রাখার চেষ্টা করেও কেন সামলে রাখতে পারছে না শাফকাত? কেন একটু একটু করে দুর্বল হয়ে পড়ছে মেয়েটার প্রতি?

শাফকাত কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে ঘোরলাগা কণ্ঠে বলল, “সেটা তো আমিও জানি না।”

সাবার কী যে হলো! লজ্জা পেয়ে হেসে উঠলো মেয়েটা। তার হাসি দেখে বুকে বড়সর একটা ধাক্কা খেলো শাফকাত। একটা মানুষের হাসি এত সুন্দর হতে পারে? সে হাসলে যেন হেসে ওঠে আশেপাশের সবকিছু। হাসির রেশ ঠোঁট ছাড়িয়ে লেগে থাকে চোখদুটোর মাঝেও। সাবাকে কখনো হাসতে দেখেনি শাফকাত। গম্ভীর-নির্বিকার মেয়েটার প্রতিই তার বরফের মন গলতে শুরু করেছিল। এই হাসিটা যেন তাতে স্ফুলিঙ্গের মতো কাজ করলো। বরফ গলে রীতিমত জল হয়ে গেল।

সাবা ঠোঁট থেকে হাসিটা মুছে ফেলতে যাবে ঠিক তখনই শাফকাত ব্যাকুল সুরে বলল, “প্লিজ! হাসিটা ধরে রাখো। এই প্রথম হাসতে দেখলাম তোমাকে।”

সাবার মনের মাঝে যেন হাজারো প্রজাপতি উড়ে যাচ্ছে। কী হচ্ছে এসব? এই মানুষটাকে তো সে সহ্যই করতে পারে না! তাহলে কেন অসহ্যকর এই মানুষের প্রতি অনুভব হচ্ছে প্রেমে পড়ার মোহনীয় অনুভূতি? সাবা কি তবে প্রেমে পড়ে যাচ্ছে শাফকাতের? এই সর্বনাশটাই হওয়া বাকি ছিল!

জাতীয় সংসদের এমপি নিয়াজুল করিম প্রবেশ করলেন পার্টিতে। তার উপস্থিতিতেই কয়েকজন বিজনেসম্যান আর সাংবাদিক ঘিরে ধরলো তাকে। রাঘববোয়ালদের সঙ্গে সুসম্পর্ক কে না রাখতে চায়? যে নিজেই রাঘববোয়াল সে হয়তো চায় না। নিয়াজ সাহেবকে দেখেও তার দিকে এগিয়ে গেল না শাফকাত। সাবাকে নিয়ে পার্টি হলের শেষ মাথায় থাকা কাউচগুলোর একটায় বসলো।

ঘিরে ধরা মানুষগুলোর সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করে নিয়াজ সাহেব নিজেই এলেন শাফকাতের কাছে। ভদ্রতার খাতিরে উঠে দাঁড়ালো শাফকাত। তার দেখাদেখি সাবাও উঠে দাঁড়ালো। নিয়াজ সাহেব হ্যান্ডশেকের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিলে গম্ভীর মুখে হ্যান্ডশেক করলো শাফকাত।

নিয়াজ সাহেব হাসিখুশি গলায় বললেন, “শাফকাত! কত দিন পর দেখা!”

প্রত্যুত্তরে কিছুই বলল না শাফকাত। কত দিন পর নিয়াজ সাহেবকে দেখে তার মাঝে যে বিন্দুমাত্র উচ্ছ্বাস নেই, তা তার চোখেমুখে স্পষ্ট।

গম্ভীর গলায় সাবাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, “আমার ওয়াইফ, সাবা আমির।”

সাবা ক্ষীণ গলায় বলল, “আসসালামু আলাইকুম।”

নিয়াজ সাহেব বিগলিত গলায় বললেন, “ওয়ালাইকুম আসসালাম। আরে ম্যাডাম আপনাকে কে না চেনে? আপনার রিপোর্টে তো সারা দেশ তোলপাড়!”

চাপা অস্বস্তি বোধ করলো সাবা। নিয়াজ সাহেবের দলের নেতার নাম উল্লেখ করেই তো রিপোর্ট করেছিল সাবা। অস্বস্তির যদিও কিছুই নেই। যা সত্যি তাই বলেছে সাবা রিপোর্টে। একটা মানুষ দিনের পর দিন অন্যায় করে যাবে, আর আশেপাশের কেউ জানতেই পারবে না – তা তো হয় না। কাউকে না কাউকে তো অন্যায়কারীর আসল চেহারাটা টেনে সামনে আনতেই হয়।

নিয়াজ সাহেব বসলেন শাফকাত ও সাবার বিপরীতে থাকা কাউচে। তার পাশে দাঁড়িয়ে দলের কয়েকজন সাঙ্গ-পাঙ্গ। লোকটাকে দেখার পর থেকে শাফকাতের বিরক্তি যেন সকল সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। একে পার্টিতে ইনভাইট কে করেছে? পার্টিতে কাকে ডাকা হচ্ছ না হচ্ছে, এসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায় না শাফকাত। এই দায়িত্ব ইভেন্ট ম্যানেজারের। এখন মনে হচ্ছে ইভেন্ট ম্যানেজারের দায়িত্বচ্যুত না করা পর্যন্ত স্বস্তি নেই।

রাজনীতির সঙ্গে জড়িত মানুষদেরকে বরাবরই এড়িয়ে এসেছে শাফকাত। দেশের সবথেকে বড় বিজনেসম্যান হিসেবে তাদের সঙ্গে যতটুকু যোগাযোগ রক্ষা না করলেই নয়, ততটুকুই যোগাযোগ রেখেছে। তবে সাবার ওপরে হামলার ঘটনার পর থেকে তাদের প্রত এক ধরনের ঘৃণা জন্মে গেছে তার। যদিও হামলার আঁচ সাবার ওপরে পড়তে দেয়নি শাফকাত।

নিয়াজ সাহেব সরল গলায় বললেন “শাফকাত, আমি কিন্তু আজ তোমার কাছে একটা আর্জি নিয়ে এসেছি।”

শাফকাত থমথমে গলায় বলল, “কী আর্জি?”

নিয়াজ সাহেব বাচ্চাদের মতো জেদ ধরে
বললেন, “না বলতে পারবে না কিন্তু।”

শাফকাত নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “আপনার আর্জি পছন্দ না হলে অবশ্যই না বলবো।”

মনে মনে অবাক না হয়ে পারলো না সাবা। বেচারা এমপি সাহেব যেখানেই যান, পাত্তার বন্যা বয়ে যায় তার ওপর দিয়ে। অথচ শাফকাত একবিন্দুও পাত্তা দিচ্ছে না তাকে।

নিয়াজ সাহেব হাসি হাসি গলায় বললেন, “দেখো শাফকাত, আমার বয়স হয়ে যাচ্ছে। আরও দশ বছর আগে অবসর নেওয়ার কথা আমার। তবুও টিকে আছি, জনগণের সেবা করার জন্য। সবকিছুরই তো একটা সীমা আছে। আগামী নির্বাচনে আমি দাঁড়াতে চাচ্ছি না। চাচ্ছি আমার জায়গাটা যোগ্য কাউকে ছেড়ে নিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে।”

শাফকাত তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “আপনি কি আমাকে সেই যোগ্য কেউটা হতে বলছেন?”

নিয়াজ সাহেব প্রশংসার সুরে বলল, “মাশাল্লাহ! কী বুদ্ধি তোমার! এই বুদ্ধির জোরেই তো আমার আসনের জন্যে সবথেকে যোগ্য মানুষটা তুমি।”

সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে উঠলো শাফকাতের ঠোঁটের কোণে। তাকে নিয়ে পলিটিক্স পলিটিক্স খেলার চেষ্টা করছেন নিয়াজ সাহেব। শাফকাতের স্ত্রীয়ের ওপর তাদের দলের নেতা হামলা করার চেষ্টা করেছে। শাফকাত সেই নেতার ওপরে করেছে পাল্টা আক্রমণ। দুপক্ষের কারোরই তেমন কোনো ক্ষতি না হলেও, দলের সঙ্গে তিক্ততার সূচনা ঘটে গেছে দেশের সবথেকে বড় বিজনেসম্যানের। এই তিক্ততা চলতে থাকতে শাফকাতের থেকে দলের ক্ষতিটাই বেশি। তাই তো তাকে এমপির আসন ছেড়ে দিয়ে তিক্ততার নিষ্পত্তি করতে চাচ্ছেন নিয়াজ সাহেব।

শাফকাত তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “নিয়াজ সাহেব, পলিটিক্সের মতো নোংরা খেলা আপনারা খেলবেন। এসবের মধ্যে আমাকে জড়ানোর চিন্তাও করেন কী করে?”

শাফকাতের এমন সোজাসাপ্টা জবাবে রীতিমত থতমত খেয়ে গেলেন নিয়াজ সাহেব। বহুকষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “কিছু মনে করো না শাফকাত। আমাদের দলের নেতা না বুঝে একটা ভুল করে ফেলেছে। ওর ওপর পাল্টা আক্রমণ করাটা কিন্তু পলিটিক্সই।”

শাফকাত শীতল গলায় বলল, “পলিটিক্স না, প্রতিশোধ। যা আমার, তার দিকে কেউ চোখ তুলে তাকানোরও সাহস যদি করে, তবে তাকে আমার হাতেই শেষ হতে হবে।”

সাবা অবাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সেই তখন থেকে তাকিয়ে দেখছে শাফকাতের কর্মকান্ড। মানুষটার সাহস আছে বলতে হবে!

হঠাৎ হোটেলের ম্যানেজার এলো জরুরি কিছু বলতে শাফকাতকে। নিয়াজ সাহেব কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই তাকে থামিয়ে দিয়ে শাফকাত বলল, “Excuse me.”

সাবার পাশে কাউচে বসেই নিচু স্বরে ম্যানেজারের সঙ্গে ব্যবসায়িক আলাপ সারছে শাফকাত। নিয়াজ সাহেব কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। যে কোনো মূল্যেই আজ রাতে শাফকাতকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্যে রাজি করিয়ে ফেলবেন ঠিক করেছিলেন। তবে তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন কতটা একরোখা আর স্পষ্টবাদী শাফকাত।

সাবাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে নিয়াজ সাহেব বিভ্রান্তির হাসি হেসে বললেন, “আপনার রিপোর্ট আমি প্রায়ই দেখি। খুব সুন্দর উপস্থাপনা আপনার।”

সাবা ভদ্রভাবে বলল, “Thank you.”

“আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায়?”

গা জ্বলে গেল সাবার। লোকটা যা করছে ইংরেজি ভাষায় তাকে বলে ‘স্মল টক’। অহেতুক কোনো কারণ ছাড়া জোরপূর্বক একটা মানুষের সঙ্গে কথোপকথন চালিয়ে যাওয়া। সাবার সঙ্গে কোনপ্রকার কথোপকথনে জড়ানোর দরকারই বা কোথায় তার?

তবুও ভদ্রতার খাতিরে উত্তর দিলো সাবা,
“বরিশালে।”

“ও আচ্ছা। আপনার বাবা কী করে?”

“রিটায়ার্ড ম্যাজিস্ট্রেট।”

“বাহ্! আপনারা কয় ভাই-বোন?”

প্রশ্নটা কানে আসতেই চমকে উঠলো শাফকাত। ম্যানেজারের সঙ্গে জরুরি কথোপকথন স্থগিত করে তাকালো সাবার দিকে। মুহূর্তের মেয়েটার চোখমুখ রক্তশূন্য হয়ে উঠেছে, নিঃশ্বাস পড়ছে না তার বন্ধ, চোখদুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করছে।

শাফকাত বিরক্ত গলায় নিয়াজ সাহেবের উদ্দেশ্যে বলল, “ওর কয় ভাই-বোন তাতে আপনার কী? আর কোনো প্রশ্ন খুঁজে পান না?”

নিয়াজ সাহেব ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন যেন। ভাই-বোন নিয়ে প্রশ্ন করায় এতটা রেগে যাওয়ার কী হলো? মানুষের কি ভাই-বোন থাকে না?

নিয়াজ সাহেবের বিস্মিত দৃষ্টি উপেক্ষা করে সাবার হাতটা শক্ত করে ধরে উঠে দাঁড়ালো শাফকাত। তার হাতটা ধরেই পা বাড়ালো দরজার দিকে। সাবা কী করে যে হাঁটছে সে নিজেও জানে না। বিন্দুমাত্র জোর পাচ্ছে না পা দুটোয়।

(চলবে)

#লেবু
১২
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

একটি শিশু প্রথম উচ্চারিত শব্দ সাধারণত কী হয়? মা কিংবা বাবা। তবে সাবার ক্ষেত্রে এমনটা হয়নি। সাড়ে সাত মাস বয়সে ভাঙা ভাঙা গলায় সে উচ্চারণ করেছিল তার জীবনের প্রথম শব্দ, “বা…য়া”। “বায়া” অর্থ ভাইয়া। আহনাফের বয়স যখন এগারো বছর, তখন জন্ম হয় সাবার। যে বয়সটায় তার বন্ধুদের সঙ্গে সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কথা, মাঠে ক্রিকেট ব্যাট হাতে ঘাম ঝরানোর কথা – সেই বয়সটা আহনাফ পাড় করেছে সর্বক্ষণ ছোট বোনের পাশে থেকে।

নিজের শৈশবটা একাই কাটিয়ে দেওয়ার পর হঠাৎ যখন তার জীবনে সাবা এলো, তখন যেন আবারও শিশু হয়ে গেল আহনাফ। সাবা তার জীবন্ত খেলনা। বোনকে হাত ধরে হাঁটতে শিখিয়েছে, পড়তে শিখিয়েছে, কথা বলতে শিখিয়েছে। আত্মীয়-স্বজনরা বলাবলি করতো, ভাগ্য করে এমন ভাই পাওয়া যায়।

সাবাও বিরাট ভক্ত তার ভাইয়ার। ভাইয়া সামনে বসে না থাকলে সে খাবে না। ভাইয়ার স্কুল থেকে ফিরতে একটু দেরি হলেই কেঁদে বাড়ি মাথায় তুলবে। ভাইয়া ফিরে এলেই আবার সব ঠিকঠাক। খিলখিলিয়ে হেসে দু হাত বাড়িয়ে দেবে আহনাফের দিকে। আহনাফও বিনা বাক্য ব্যয়ে তাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে পুরো বাড়ি জুড়ে।

ভাই-বোনের জোরালো এই বন্ধন দেখে ফাহমিদা বেগম মজার ছলে বলতেন, “বোনকে তো এক মুহুর্ত চোখের আড়াল করিস না! বোনের বিয়ে হয়ে গেলে কী করবি?”

আহনাফ সাবার মাথায় হাত বুলিয়ে গম্ভীর গলায় বলতো, “বোনকে বিয়েই দেবো না কখনো।”

একটা ছেলে যে তার বোনকে এতটা ভালোবাসতে পারে, আহনাফকে না দেখে বোঝার উপায় নেই। আমির সাহেবের তখন চিটাগংয়ে পোস্টিং। আহনাফ এইচএসসি পরীক্ষার্থী। নিজেকে ঘর বন্দী করে দিন-রাত এক করে পড়াশোনা করছে।

সাবা তখন ক্লাস থ্রিয়ের ছাত্রী। একই এলাকায় স্কুল হওয়ায় আশেপাশের বেশির ভাগ বাড়িতেই তার বান্ধবীদের বসবাস। বান্ধবীরা রোজ সকালে দল বেঁধে স্কুলে যায়, আবার বাড়ি ফেরার সময়ে দল বেঁধে গল্প করতে করতে ফেরে। ডানপিটে সাবার তখনো বাড়ি থেকে একা বের হওয়ার অনুমতি মেলেনি। বাবা অফিসে যাওয়ার পথে তাকে স্কুলে দিয়ে আসতেন, ছুটির সময়ে মা বাড়িতে নিয়ে আসতেন। এই ছিল রোজকার নিয়ম।

বান্ধবীদের দল বেঁধে স্কুলে যাওয়া নিয়ে সাবার মনে কষ্টের শেষ ছিল না। চিরকালই তার কষ্টগুলোর একটাই স্থায়ী সমাধান, তার ভাইয়া। এবারও বরাবরের মতো ভাইয়ার কাছে আবদার করলো, তাকে যেন বাড়ি থেকে বান্ধবীদের সঙ্গে স্কুলে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে।

আহনাফ কথায় যেন যাদু আছে। যে ফাহমিদা বেগম কখনো মেয়েকে একা ছাড়েন না, মিনিট কয়েকের মধ্যেই ছেলের কথায় রাজি হয়ে গেছেন তিনি। কাঙ্ক্ষিত অনুমতি পেয়ে একরাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে সাবা ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে পরদিনের স্কুলের জন্যে ব্যাগ গুছিয়ে রাখলো।

প্রথম দিন সব ঠিকঠাকই ছিল। এই প্রথম একা ঘর থেকে বেরিয়ে সাবার আত্মবিশ্বাস হয়ে দাঁড়ালো আকাশচুম্বী। বান্ধবীদের সঙ্গে গল্প আর হাসাহাসির ছলে কখন যে বাড়ি পৌঁছে গেল, নিজেরই খেয়াল রইলো না।

বিপত্তি বাঁধলো দ্বিতীয় দিন। সাবার স্কুল ছুটি হয় সাড়ে এগারোটায়। বান্ধবীদের সঙ্গে গল্প করতে করতে পনেরো মিনিট দেরি হতেই পারে। তবে সেদিন এক ঘন্টা পেরিয়ে গেল, সাবার বাড়ি ফেরার নামগন্ধ নেই। ফাহমিদা বেগম দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে স্বামীকে ফোন করলেন। আমির সাহেব অফিস থেকে ছুটে এসে আশেপাশে খোঁজ করলেন, ছুটে গেলেন সাবার স্কুলে। মেয়েটা কোত্থাও নেই।

পরদিন আহনাফের পদার্থবিজ্ঞান ২য় পত্রের পরীক্ষা। বরাবরই পদার্থবিজ্ঞানে সে একটু কাঁচা। তবুও বইপত্র ফেলে রেখে ছুটে গেল বাইরে। দিনভর একটা অটোরিকশা ভাড়া করে খুঁজে বেড়ালো বোনকে।

সাবাকে শেষমেশ পাওয়া গেল প্রায় এক কিলোমিটার দূরের একটা বিরিয়ানির দোকানে। সঙ্গে পাওয়া গেল তার আরও তিন বান্ধবীকে। তারা টাকা জমিয়েছে এই দোকানের বিরিয়ানি খাবে বলে। ঠিকমতো এসেও পড়েছে, তবে ফেরার সময় পথ ভুলে গেছে।

আহনাফের জায়গায় অন্য কোনো ভাই থাকলে সবার আগে প্রচন্ড এক ধমক দিতো সাবাকে। অথবা সজোরে গালে পাঁচ আঙুলের ছাপও ফেলে দিতে পারতো। আহনাফ বলেই হয়তো কোনপ্রকার রাগ দেখালো না। বোনকে ফিরে পেয়েছে, এতেই যেন তার প্রাণ জুড়িয়ে গেল।

সাবার বাকি তিন বান্ধবীকে দায়িত্ব নিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে তাকে চকলেট কিনে দিয়ে কোলে করে যখন বাড়ি ফিরে এলো, ফাহমিদা বেগম মেয়েকে মারাত্মক বকাঝকা শুরু করলেন। আহনাফ সে মুহূর্তেও হাসিমুখে সামলেছে মাকে।

যে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে আহনাফের এত ভয়, সেই পদার্থবিজ্ঞানকেই আপন করে নেয় এইচএসসির পর। এই বিষয়েই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। ততদিনে সাবার স্কুলজীবন শেষ। আমির সাহেবেরও অবসরের বয়স হয়েছে। সপরিবারে তাই ফিরে এলেন ঢাকায়। নিজের বাড়ি করলেন। সাবা নামী একটা কলেজে পড়াশোনার সুযোগ পেলো। আহনাফ ওদিকে একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে জয়েন করলো। পরিবারটা স্বপ্নের মতোই সুখী ছিল সে সময়টায়। এতটাই সুখে ছিল যে তারা ভুলেই গিয়েছিল, সব স্বপ্ন সুখের হয় না। কিছু কিছু স্বপ্ন হয় ভয়ঙ্কর, বিভীষিকাময়।

একেকটা সেমিস্টারের ক্লাস নিতে একেক রকম আনন্দ পেতো আহনাফ। প্রত্যেকটা ক্লাসেই আলাদা আলাদা মুখ। সকলেই আগ্রহ ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। প্রথম প্রথম তো ছাত্র-ছাত্রীদের মুখে “স্যার” ডাক শুনতেও কেমন লজ্জা লাগতো। আসলেই কি সে এতটা যোগ্য?

সময়ের সঙ্গে অবশ্য কেটে যায় অস্বস্তিটা। তিন বছর ধরে একনিষ্ঠতার সাথে চাকরিটা করছে সে। ছোটবেলায় খেলনা গাড়ি খেলতে খেলতে স্বপ্ন দেখেছিল তার নিজেরও একটা গাড়ি হবে। টাকা জমিয়ে সত্যি করেছে সেই স্বপ্নটাকেও। ততদিনে সাবা এইচএসসি পাশ করে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে তার ইউনিভার্সিটিরই জার্নালিজম বিভাগে। দুই ভাই-বোনের আনন্দের কোনো সীমা নেই। দুজনে একসঙ্গে গাড়িতে খুনসুটি করতে করতে ইউনিভার্সিটিতে যায়।

বয়সে বড় হলেও ভাইয়ার কাছে এখনো তো সাবা সেই ছোট্ট বাচ্চাটি। গাড়িতে যেতে যেতে কিছু পছন্দ হলে সাবা বাচ্চাদের মতো বায়না ধরে, আহনাফও হাসি মুখে গাড়ি থামিয়ে বোনকে কিনে দেয় তার পছন্দের বস্তুটি।

সাবা যে সেমিস্টারে ইউনিভার্সিটিতে ঢুকলো, সেই সেমিস্টারের প্রথম ক্লাসেই জীবনটা বদলে যায় আহনাফের। ফার্স্ট ইয়ারদের সঙ্গে প্রথম ক্লাসে সাধারণত আলাপচারিতাই হয়ে থাকে। আহনাফও সেদিন পরিচিত হচ্ছিল তার নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে। হঠাৎ চোখ পড়লো সামনে থেকে দ্বিতীয় সারিতে বসে থাকা একটা মেয়ের দিকে।

মেয়েটা নিষ্পলক তার দিকেই তাকিয়ে আছে। যেন এ জীবনে কোনদিন পলক ফেলেনি সে। কিংবা পলক কী করে ফেলতে হয় তার জানা নেই। যথেষ্ট সুদর্শন যুবক আহনাফ। একটা মেয়ে একবার খেয়াল করে তাকে দেখবে নিশ্চিতভাবে আরেকবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখবে। মেয়েদের এই উৎসুক দৃষ্টিতে অভ্যস্ত সে। তাই কিছু মনে না করে উড়িয়ে দিলো ব্যাপারটা।

পরিচিত হবার সময়ে জানা গেল মেয়েটার নাম ইতি। অবাক করা বিষয় হলো, এর পর থেকে ফার্স্ট সেমিস্টারের সঙ্গে থাকা প্রত্যেকটা ক্লাসেই আহনাফ খেয়াল করে, ইতি বসেছে সামনের সারিতে। ঠিক প্রথম দিনের মতো করেই হা করে চোখ দিয়ে গিলছে তাকে।

আহনাফ বরাবরই শান্ত প্রকৃতির একটা ছেলে। ভেতরে ভেতরে মেয়েটার ওপর রাগ হলেও বাইরে তা প্রকাশ করতে পারতো না। যে ছেলে নিজের বোনকেই কোনোদিন ধমক দেয়নি, সে ছাত্রীর সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলে কী করে?

সাবা ছোটবেলা থেকেই আহনাফের সবথেকে প্রিয় বন্ধু। তাদের ভাই-বোনের সম্পর্কে বন্ধুত্ব সর্বদাই দাঁড়িয়ে ছিল স্বগর্বে। বন্ধুত্বের জায়গা থেকে ইতির বেহায়া দৃষ্টির কথা আহনাফ বলেছিল সাবাকে। সেই থেকে দিনরাত ভাইয়াকে ক্ষেপাতে শুরু করে সাবা।

আহনাফ নতুন একটা শার্ট পড়লেই সাবা মজার ছলে বলবে, “শার্টটা কে দিলো ভাইয়া? ইতি ভাবি না-কি?”

আহনাফ প্রত্যুত্তরে থমথমে গলায় বলে, “তোর সমবয়সী একটা মেয়ে তোর ভাবি কী করে হয় গাধা?”

সাবা সোজাসাপ্টা উত্তরে বলে, “ওমা! তোমার বউ মানেই তো আমার ভাবি। সে বয়সে আমার ছোট হোক বা বড়!”

আহনাফ বোনের কান মলে দেওয়ার জন্যে হাত বাড়াতেই ছুটে যায় সাবা। আহনাফও ছোট তার পিছু পিছু। দুই বড় বাচ্চার কান্ড দেখে দূর থেকে হাসেন ফাহমিদা বেগম এবং আমির সাহেব।

জীবনটা ওই মুহূর্তেও সুন্দর ছিল ব্যাপক। দুশ্চিন্তা বা ভয়ের কোনো জায়গাই ছিল না মনে। মাঝে মাঝে সাবার ইচ্ছে হয়, ঠিক সেই সময়টায় ফিরে গিয়ে সময়টাকে আটকে দিতে। সবই যাতে চলে নিজ নিয়মে, থেমে থাকবে শুধু সময়। অথচ এর চেয়ে অসম্ভব ইচ্ছা আর হয় না। সব থেমে থাকলেও, সময় কী আর থাকে?

প্রথম সেমিস্টার প্রায় শেষের দিকে। ইতির সাহস কেবল আহনাফের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার মাঝে সীমাবদ্ধ রইলো না। একদিন সবগুলো ক্লাস শেষে ফ্যাকাল্টি রুমে বসে কেন যেন আহনাফ ফার্স্ট সেমিস্টারের রেজিষ্টার খাতা খুলল। খুলেই চমকে উঠলো রীতিমত। ভাঁজ করে রাখা একটা নীল রঙের কাগজ। কাগজের সাইজ চিরকুটের সমান। তবে তাতে সম্বোধনযুক্ত এক লাইনের চিঠি।

গোটা গোটা মুক্তার মতো অক্ষরে লেখা,

“আহনাফ স্যার,

আমার দিকে একবার নজর করে তাকালে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়?

ইতি,
বলুন তো কে?”

পরীক্ষার খাতা দেখার সুবাদে ছাত্র-ছাত্রীদের হাতের লেখার সঙ্গে পরিচিত আহনাফ। পরিচিত না হলেও, শেষের নাম নিয়ে যে রহস্য করা হয়েছে তাতেই বোঝা যায় চিঠির মালিক ইতি। নিজের নামটা লিখেও আবার অনুমান করতে বলেছে আহনাফকে।

পরদিন সকালে ইউনিভার্সিটিতে পা রাখতেই আহনাফ ডেকে পাঠালো ইতিকে। ভেবেছিল ধরা পড়া চোরের চোখেমুখে যেমন অপরাধবোধ আর আতঙ্ক লেগে থাকে, ইতির অবস্থা হবে ঠিক তেমন। তবে দেখা গেল তার মধ্যে অপরাধবোধের ছিটেফোঁটাও নেই। উল্টো আত্মবিশ্বাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে।

আহনাফ সেই চিঠিটা ইতির সমানে মেলে ধরে বলল, “এসবের মানে কী ইতি?”

ইতি ভয় না পেয়ে উল্টো সাহসী গলায় বলল, “সেটা তো আপনি বলবেন।”

“মানে?”

ইতি দুষ্টুমির ছলে বলল, “বলুন, আমাকে নজর করে দেখলে কী ক্ষতি হয় আপনার?”

মেয়েটার সাহস দেখে রীতিমত চমকে উঠলো আহনাফ। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে কঠিন গলায় বলল, “তোমার বিরুদ্ধে আমি ব্যবস্থা নিলে তুমি যে এই ইউনিভার্সিটিতে আর পড়তে পারবে না সেটা জানে?”

ইতি রহস্যের হাসি হেসে বলল, “জানি। এটাও জানি যে আপনি এমনটা করবেন না।”

আহনাফ বিরক্ত হয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, “কী চাচ্ছো তুমি?”

“আপনাকে।”

শান্ত-শিষ্ট আহনাফ যে কতবছর পর রেগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করলো সে নিজেও জানে না। রাগ তার চোখেমুখে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। নাকের পাটা লাল বর্ণ ধারণ করেছে। দাঁতে দাঁত চেপে ধরেছে।

তার রাগের এসব লক্ষণ গায়ে না মেখে ইতি বলল, “আপনি কী বোঝেন না? আপনাকে না পেলে আমার জীবনটাই বৃথা হয়ে যাবে।”

ইতির মুখে কখনো “স্যার” ডাক শোনেনি আহনাফ। তাকে আলাদা দৃষ্টিতে পছন্দ করে বলেই হয়তো কখনো এই ডাকে ডাকেনি ইতি।

আহনাফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তোমার মতো বয়সে অনেককিছু না পেলেই জীবনটাকে বৃথা মনে হয়। তোমার মনে হওয়া নিয়ে আমার কিছুই যায় আসে না। ইউনিভার্সিটির ভেতরে এমন দুঃসাহস আর দেখাবে না। ক্ষতিটা তোমারই হবে।”

ইতি বেহায়া গলায় বলল, “তাহলে বাইরে দুঃসাহস দেখানোর সুযোগ করে দিন!”

“মানে?”

“আমার ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করে নিন!”

আহনাফ থমথমে গলায় বলল, “আমি আমার স্টুডেন্টদের সাথে ফ্রেন্ডশিপ করি না।”

সেদিনের পর থেকে সত্যিকারের দুঃসাহস দেখাতে শুরু করলো ইতি। আহনাফ তার ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট একসেপ্ট না করলেও, তার প্রত্যেকটা পোস্টে নিয়ম করে কমেন্ট করতো সে। এদিকে আহনাফের ফ্রেন্ড লিস্টে চৌদ্দ গুষ্টির সমস্ত আত্মীয়-স্বজন রয়েছে। মেয়েটা এমন সব কমেন্ট করে বসতো যে রীতিমত লজ্জায় পড়ে যেতে হতো তাকে।

আহনাফ ছুটির দিনে বাবা-মা আর বোনকে নিয়ে কোনো রেস্টুরেন্টে গেছে। চোখ ঘুরিয়ে দেখবে পাশের টেবিলে বসে আছে ইতি। তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। আহনাফ খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, তাদের বাড়ির উল্টোদিকের বিল্ডিংয়েই থাকে ইতি।

দিনরাত আহনাফের গতিবিধি নজরে রাখে সে। সর্বক্ষণ আশেপাশে কেউ থাকলে, বেহায়া নজর নিক্ষেপ করে রাখলে অস্বস্তিতে গা জ্বলে যাওয়ার কথা। আহনাফের ক্ষেত্রেও হয়েছিল তেমনটাই। তবে কবে যে নিজের অজান্তেই ইতির এসব কর্মকান্ডে সে অভ্যস্ত হয়ে যায়, আহনাফ নিজেও জানে না।

ক্লাসের সবথেকে নিয়মিত মেয়ে ইতি। প্রথম সেমিস্টার থেকেই তার অ্যাটেনডেন্স শতভাগ। তবে একদিন অবাক হয়ে আহনাফ লক্ষ্য করলো, ইতি অনুপস্থিত। সেদিন ফেসবুকেও নেই তার কমেন্টের রোল।

নিজের ওপর নিজেই বিরক্ত হয়ে উঠলো আহনাফ। মেয়েটার অনুপস্থিতিতে তো তার খুশি হওয়ার কথা। অথচ ভেতরে ভেতরে তার হাহাকারের ছড়াছড়ি। সেদিনই প্রথমবারের মতো নিজ থেকে সে ফোন করেছিল ইতির নম্বরে। সম্ভবত সেই ফোন কল থেকেই সূচনা ঘটে আহনাফের সর্বনাশের।

(চলবে)