লেবু পর্ব-১৩+১৪

0
4

#লেবু
১৩
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

“আপনি কি সত্যিই আমাকে নিজ থেকে ফোন করেছেন? না-কি আমি স্বপ্ন দেখছি?”

সেদিন আহনাফ ইতিকে ফোন করার পর ঝলমলে কণ্ঠে ঠিক এই কথাটাই বলেছিল সে।

আহনাফ গম্ভীর গলায় বলল, “ঢং রেখে স্বাভাবিকভাবে কথা বলো। ক্লাসে আসোনি কেন আজ?”

ইতি উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে বলল, “দাঁড়ান তো! নিজেকে চিমটি কেটে দেখি সত্যিই আপনি ফোন করেছেন না-কি সবই আমার কল্পনা।”

আহনাফ থমথমে গলায় বলল, “তুমি যদি এই মুহূর্তে ফাজলামি বন্ধ না করো তাহলে আমি ফোন কেটে দেবো।”

ইতি আঁতকে উঠে বলল, “সরি! সরি! ফোন কাটবেন না প্লিজ।”

“কী সমস্যা তোমার?”

“কোনো সমস্যা নেই।”

“ক্লাসে আসছো না কেন তাহলে?”

ইতি হাসিমুখে বলল, “তেমন কিছু না। একশ তিন ডিগ্রি জ্বর নিয়ে বসে আছি।”

মনে মনে বেশ চমকে উঠলো আহনাফ। একশ তিন ডিগ্রি জ্বর নিয়ে একটা মানুষ কীভাবে হাস্যোজ্বল ভঙ্গিতে কথা বলতে পারে? এটা কি আহনাফের কাছ থেকে ফোন কল পাওয়ার আনন্দ না-কি মেয়েটা এমনিতেই এমন পাগলাটে?

আহনাফ ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই ইতি আবারও উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “দেয়ালে পিঠ ঠেকে না গেলে আমি ক্লাস মিস দিই না। চল্লিশ মিনিট সামনাসামনি দেখার সুযোগ হাতছাড়া কোন পাগল করবে?”

আহনাফ শাসনের সুরে বলল, “অযথা ঘোরাঘুরি করে বেরালে জ্বর তো আসবেই।”

ইতি দুষ্টুমির ভঙ্গিতে বলল, “মিস করছেন না-কি আমাকে?”

আহনাফ বিরক্ত গলায় বলল, “তোমাকে মিস করতে যাবো কোন দুঃখে? আমার আর কোনো কাজ নেই?”

ইতি সঙ্গে সঙ্গে অন্যরকম গলায় বলল, “আচ্ছা? তা আপনি কি ক্লাসের সব অ্যাবসেন্ট স্টুডেন্টদের ফোন করে খোঁজখবর নেন?”

নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো আহনাফ। আসলেই তো! যে মেয়েটাকে সে ছাত্রীর থেকে বেশি আর কিছুই মনে করে না, তার একদিনের অনুপস্থিতি এত কেন ভাবাচ্ছে তাকে? ইতির বিরক্ত করা চাহনি, যেখানে সেখানে পিছু নেওয়ার অভাব কেন এমন প্রবলভাবে হাহাকারের সৃষ্টি করছে তার মাঝে?

আহনাফ বুঝতে পারছিল মেয়েটার জন্যে তার মনে আলাদা একটা জায়গা তৈরি হয়ে গেছে। ইতি নিজেই সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে। অন্যান্য দশ জন ছাত্র-ছাত্রীর মতো সাধারণের কাতারে ফেলে তাকে নিয়ে চিন্তা করতে পারে না আহনাফ। মেয়েটা যেন সকলের থেকে একটু আলাদা, একটু বিচিত্র। কিন্তু সেই বৈচিত্র্য কোথায়, এটাই ধরতে পারছিল না আহনাফ।

পরদিন আবারও ক্লাসে ফিরলো ইতি। সবকিছু আগের মতোই স্বাভাবিক। আহনাফও স্বাভাবিক। তবে এই স্বাভাবিকতার মধ্যেই নিজে মাঝে অদ্ভুত এক পরিবর্তন লক্ষ্য করলো সে। ইতির একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকাটা এখন আর বিরক্তিকর বলে মনে হয় না। উল্টো ইতি এক মুহূর্তের জন্যে অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরালে অস্বস্তি লাগে।

ফেসবুকে তার একেকটা পোস্টের নিচে ইতির বেপরোয়া কমেন্টগুলা এখন আর মুছে ফেলে না। পরীক্ষার খাতা দেখা শেষ হয়ে গেলেও ইতির খাতা হাতে নিয়ে বেশ অনেক্ষণ বসে থাকে আহনাফ। ওই খাতায় যে স্পর্শ লেগে আছে মেয়েটার।

আহনাফ বুঝতে পারছিল তার এই অনুভূতিগুলোকে প্রশয় দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। শিক্ষক হিসেবে নিজের অন্যান্য ছাত্রীদের জন্যে তার মনে যে স্নেহের অনুভূতি, ইতির জন্যেও সেই একই অনুভূতির বাইরে ভিন্ন কিছু অনুভব করা উচিত নয়। তবে মন সকলপ্রকার বাঁধা মানতে হয় ব্যর্থ। নিজেকে সংযত করে, সামলে রেখেও কোনো লাভ হয় না। মন ঠিকই দিনশেষে ছুটে যায় পাগলাটে ওই মেয়েটার পানে।

কয়েকটা মাস মনের সঙ্গে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মাঝেই কেটে যায়। এক রাতে আহনাফ তার কয়েকজন বন্ধুদের সঙ্গে গেল নামী-দামী একটা রেস্টুরেন্টে। তার বন্ধুদেরই একজনের জন্মদিন উপলক্ষে রাত বারোটায় কেক কাটা হবে। শুরু হলো বন্ধুদের সঙ্গে তুমুল আড্ডা। আড্ডার এক ফাঁকে আহনাফ অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো দুই টেবিল পাশেই বসে আছে ইতি। বরাবরই মতোই বেহায়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রেখেছে তার দিকে।

ইতিকে দেখেই চমকে উঠলো না আহনাফ। এমন একটা ভাব করলো যেন ইতির এখানে থাকাটাই স্বাভাবিক। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, কেক কাটা পর্ব শেষ করলো। বন্ধুরা যে যার মতো বিদায় নেওয়ার পর গেল সে ইতির কাছে।

আহনাফ ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “যেখানেই যাই, সেখানেই ফলো করো আমাকে। টায়ার্ড লাগে না তোমার?”

ইতি অনুতপ্ত গলায় বলল, “সরি। আসলে আমি কখনোই আপনাকে বিরক্ত করতে চাই না। খেয়াল করেছেন কিনা কে জানে, আপনাকে ফলো করে যেখানে সেখানে চলে গেলেও কখনোই আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসি না আপনার সাথে। দূর থেকে দেখে চলে যাই শুধু। আপনাকে এক নজর দেখতে পেলেই আমার শান্তি!”

আহনাফ ভ্রু কুঁচকে বলল, “এসব বলে কী প্রমাণ করতে চাচ্ছো?”

ইতি নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “কিছুই প্রমাণ করতে চাচ্ছি না। সত্যিটা বললাম শুধু।”

“গাড়িতে ওঠো!”

ইতি অবাক গলায় বলল, “কেন?”

“এত রাতে একা একা বাড়ি ফেরার ইচ্ছা আছে?”

“আমি চলে যেতে পারবো। আপনাকে কষ্ট করে ড্রপ করতে হবে না।”

আহনাফ দৃঢ় গলায় বলল, “কষ্ট কোথায়? দুজনেই তো একই জায়গায় যাবো।”

ইতি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আহনাফের দিকে। যতই সে সর্বক্ষণ আহনাফের পিছু নিয়ে বেড়াক, তাকে কখনো বুঝতে দেয়নি তার বাড়ির উল্টো দিকেই ইতির বসবাস। তাহলে আহনাফ টের পেলো কী করে?

আহনাফ গম্ভীর গলায় বলল, “তুমি যে আমাকে ফলো করতে করতে আমাকে বাড়ির সামনের বিল্ডিংয়ে উঠেছো, এটা আমি জেনে গেছি।”

ইতি ব্যস্ত গলায় বলল, “বিশ্বাস করুন, বাসাটা ভাড়া নেওয়ার আগে আমি জানতাম না উল্টো দিকের বাড়িটা আপনার। এটা শুধুই একটা হ্যাপি কো-ইনসিডেন্ট।”

“হ্যাপি কো-ইনসিডেন্ট?”

ইতি দমে যাওয়া কণ্ঠে বলল, “না মানে, আমার জন্যে হ্যাপি। আপনার জন্যে শুধু কো-ইনসিডেন্ট।”

আহনাফ ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “ওঠো ইতি!”

অবশেষে ইতি বাধ্য মেয়ের মতো উঠে বসলো আহনাফের গাড়িতে।

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আহনাফ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
“এই যে পড়াশোনা বাদ দিয়ে আমার পেছন পেছন ঘুরে বেড়াও, বাবা-মা কিছু বলে না?”

ইতি মলিন হাসি হেসে বলল, “নাহ্! আমার কাছে থাকলে হয়তো অনেক কিছুই বলতো। বাবা বাসা থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিতো,
মা খন্তি দিয়ে দু-চার ঘাও লাগিয়ে দিতো।”

আহনাফ ভাবলো মেয়েটার বাবা-মা বোধ হয় তার থেকে দূরে গ্রামের বাড়িতে থাকে। তাই চাপা কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো “কোথায় থাকে তারা?”

ইতি ক্ষীণ স্বরে বলল, “তা তো জানি না। এতটুকু জানি তারা যেখানে গেছে সেখান থেকে কখনো ফিরে আসবে না।”

বুকের মাঝে বড়সর একটা ধাক্কা খেলো আহনাফ। এমন যন্ত্রণাদায়ক কথাগুলো মেয়েটা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাসিমুখে বলে গেল কী করে? সত্যিই তার মতো পাগলাটে মেয়ে হয় না!

আহনাফ কোমল স্বরে বলল, “I’m so sorry. আমি আসলে জানতাম না।”

ইতি ম্লান কণ্ঠে বলল, “সরি বলতে হবে না। তাদের কথা কেউ মনে করিয়ে দিলে ভালোই লাগে। সচরাচর মনে পড়ে না তো তাদের কথা।”

সেদিন গাড়িতে আহনাফ একটু একটু করে অনেকটাই জানলো ইতিকে। জানলো তার ছবি আঁকার শখের কথা, ঘুরে বেড়ানোর শখের কথা, ঘন্টার পর ঘন্টা চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকার ক্ষমতার কথা। যে মেয়েটাকে এতকাল সে জানতো নাছোড়বান্দা পাগলাটে একটা মেয়ে হিসেবে, নতুন করে তাকে আবিষ্কার করলো আহনাফ। নতুন করে আবারও ভালো লাগা সৃষ্টি হলো তার প্রতি। যে ভালো লাগাকে এবার আর বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলো না আহনাফ। প্রশয় দিয়ে গেল মনের অজান্তেই।

পরের ছুটির দিনেই আহনাফ ডাকলো ইতিকে বুড়িগঙ্গার পাড়ে। বুড়িগঙ্গা ঘুরে বেড়ানোর আদর্শ জায়গা নয়। একদিকে ব্যাগ-পত্র কাঁধে নিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিমায় সকল বয়সী মানুষের লঞ্চে ওঠার দৃশ্য। আরেকদিকে একটু পর পর লঞ্চের ইউসেল আর কালো ধোঁয়া। তবুও নৌকায় চড়ার লোভ সামলাতে না পেরে সেখানেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো আহনাফ। ইতি গাঢ় লাল রঙয়ের একটা শাড়ি পরে পৌঁছে গেল সেখানে। আহনাফের পরনে ঠিক একই সঙ্গের শার্ট। ইতির ভাষায় একেই হয়তো বলে, ‘হ্যাপি কো-ইনসিডেন্ট’।

দুজনে নৌকায় চড়ে বসলো। নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলো ডুবন্ত সূর্যের দিকে। নীরবতার মাঝে যেন একে অপরের ভেতরটা বোঝার চেষ্টা করছে।

অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করে আহনাফ বলল, “ইতি?”

ইতি চোখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “হুঁ?”

আহনাফ লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল, “দুই বছর হয়ে গেল, পাগলামি করে যাচ্ছো আমাকে নিয়ে। আজ যদি সেই পাগলামিগুলোকে আপন করে নিই, তবে কী পাবো?”

ইতির চোখদুটো নিমিষেই ভর্তি হয়ে গেল জলে। যে মেয়েটার মুখে সর্বক্ষণ কথারা ঘুরপাক খায়, আজ সে নির্বাক। কী বলবে ভেবে না পেয়ে বেশ অনেকটা সময় আশ্রুমাখা চোখদুটোতে তাকিয়ে রইলো আহনাফের দিকে।

অবশেষে নিজেকে সামলে নিয়ে চিরচেনা উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, “কী আর পাবেন? আস্ত পাগলটাকেই পাবেন।”

সেদিন, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে দুটো মানুষের জীবন জড়িয়ে গেল একে অপরের সঙ্গে। পরের দুটো বছর আহনাফ ও ইতি ভেসে বেড়ালো ভালোবাসায়। ইতির পাগলপারা ভালোবাসায় বিন্দুমাত্র পরিবর্তন এলো না। ঠিক প্রথম দিনের মতো আজও সে বেহায়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ভালোবাসার মানুষটার দিকে। পার্থক্য শুধু সময়ের। তখন আহনাফ তার কেউ ছিল না, আর আজ আহনাফের পুরোটা জুড়েই কেবল ইতি।

আহনাফ কাউকে জানায়নি তার ভালোবাসার মানুষটার কথা। কেবল তার আদরের ছোট বোন বাদে। আহনাফ ভেবেছিল তার এবং ইতির সম্পর্কের খবর পেয়ে আনন্দে-উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়বে সাবা। আনন্দিত সে হয়েছিল বটে। তবে আনন্দের সাথে সাবাকে ঝেঁকে ধরেছিল একরাশ দুশ্চিন্তা।

দুশ্চিন্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে সাবা বলেছিল, “এখনই কাউকে জানতে দিও না ভাইয়া।”

আহনাফ দৃঢ় গলায় বলল, “দিচ্ছি না তো! তুই খুব ভালো করেই জানিস, প্রেম নিয়ে ঢাক-ঢোল পেটানোর মানুষ আমি না।”

সাবা চিন্তিত গলায় বলল, “কেন গোপনে রাখতে বললাম, বুঝতে পারছো?”

“কেন?”

সাবা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন বলল, “ক্যাম্পাসে ব্যাপারটা জানাজানি হলে সবাই বাজে কথা বলবে। তোমার দিকে আঙুল তুলবে। আমি চাই না কেউ তোমাকে নিয়ে বাজে কথা বলুক!”

সাবার এ কথায় আসলেই চিন্তায় পড়ে আহনাফ। আসলেই তো! ক্যাম্পাসে হুটহাট সে ইতিকে লাইব্রেরিতে ডেকে পাঠায়। সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে তারা যায় ছাদে দেখা করতে। ব্যাপারটা এখনো চোখে পড়েনি কারও। তবে পড়তে কতক্ষণ? কেউ দেখে ফেললেই তো প্রশ্ন তুলতে পারে তার চরিত্রের ওপর। ফ্যাকাল্টির কেউ দেখলে তো ইতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিতে পারে! আহনাফ তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, ক্যাম্পাসে ইতির সঙ্গে দেখা করা একেবারেই বন্ধ করে দেবে।

সাবার পিঠ চাপড়ে দিয়ে আহনাফ বলল, “চিন্তা করিস না। আমাকে নিয়ে কেউ বাজে কথা বলার সুযোগ পাবে না।”

বোনকে দেওয়া কোনো কথাই আহনাফ অপূর্ণ রাখেনি কখনো। কেবল এই কথাটা বাদে।

(চলবে)

#লেবু
১৪
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

ভালোবাসার মানুষেরা না-কি বদলে যায়। পরিস্থিতি তাদের বদলে যেতে বাধ্য করে। তবে নিতান্ত তুচ্ছ পরিস্থিতিও কি পারে ভালোবাসাকে বদলে দিতে? যে পরিস্থিতিতে পড়ে ইতি বদলে গেল, তাকে তুচ্ছই বলা শ্রেয়।
অনার্সের ফাইনাল সেমিস্টারের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। একদিকে অনবরত ক্লাস নিতে নিতে ক্লান্ত আহনাফ। আরেকদিকে তার জন্যে অপেক্ষা করছে পাহাড় সমান খাতা।

ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরেই পরীক্ষার খাতা নিয়ে বসলো আহনাফ। ইতির সঙ্গে রোজ রোজ দেখা করাটাও কমে এসেছে এতদিনে। ক্লাসে যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণই চলে তাদের নীরব কথোপকথন। আহনাফের কম সময় দেওয়া নিয়ে কোনো অভিযোগ ছিল না ইতির। পরীক্ষার এই সময়টায় তো তার পক্ষেও সময় দেওয়া সম্ভব নয় আহনাফকে। বাবা-মা মরা অনাথ একটা মেয়ে ইতি। কোনো বড় ভাই-বোনও নেই যার ছায়া মাথার ওপরে থাকবে। আত্মীয়-স্বজন যারা আছেন, তারাও ইতির দায়িত্ব নিতে নারাজ। তাই তো স্বপ্ন দেখেছিল নিজের পায়ে দাঁড়াবে। নিজের দায়িত্ব নিজেই নেবে। জীবনে যা-ই হয়ে যাক না কেন, স্বপ্নটাকে মরে যেতে দেয়নি ইতি।

পরেরদিনটা ছিল শুক্রবার। ছুটির দিনে একটু বেলা করেই ঘুমোয় আহনাফ। ঘুম থেকে উঠে ফোন হাতে নিতেই দেখে ইতির মিসড কল।

আহনাফ তাকে কল ব্যাক করতেই ইতি প্রথম যে কথাটা বলল সেটা হলো, “কাল কত তারিখ ছিল?”

ইতির এমন স্বভাবের সঙ্গে অপরিচিত নয় আহনাফ। মেয়েটা এমনই হুটহাট ফোন করে কোনপ্রকার সম্ভাষণ ছাড়া আবোল-তাবোল প্রশ্ন করে বসে। তবে সবসময়ই ইতির কণ্ঠে লেগে থাকে চিরচেনা উচ্ছ্বাস। যা আজ অনুপস্থিত।

তবুও আহনাফ উত্তরটা দিয়ে বলল, “তেরো তারিখ। কেন?”

ইতি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “সত্যিই ভুলে গেছ তাহলে? যাক! আমি তো ভাবলাম ভুলে যাওয়ার ভান করেছিলে।”

এতক্ষণে যেন আকাশ ভেঙে পড়লো আহনাফের মাথায়। ইতির জন্মদিনের তারিখটা একেবারেই মাথা থেকে উড়ে গিয়েছিল তার। ইতিও বড় অভিমানী মেয়ে! আহনাফ তার জন্মদিন ভুলে যাওয়ায় একটা বারের জন্যেও কাল ফোন দেয়নি তাকে। নিজ থেকে মনে যখন করিয়েই দিলো, তখন গতকাল মনে করালে কী এমন ক্ষতি হতো?

আহনাফ নরম সুরে বলল, “ইতি! I’m so sorry…”

ইতি অভিমানী গলায় বলল, “না, না ঠিক আছে। এতটুকুর জন্য সরি বলতে হবে না।”

আহনাফ অপরাধীর ন্যায় বলল, “তুমি তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছো কাজের কত চাপ। ইভেন, এখনো পরীক্ষার খাতা সামনে নিয়ে বসে আছি।”

ইতি থমথমে গলায় বলল, “কাজের চাপ তো আগেও ছিল। প্রত্যেক বছর এ সময়ে তোমার খাতা দেখার চাপ বেড়ে যায়। তাই বলে আগে তো কখনো জন্মদিন ভুলে যাওনি আমার।”

বাচ্চাদের মতো আহ্লাদেই গলে পড়ে ইতি। তাকে গলানোর উদ্দেশ্যেই আহনাফ বলল,
“I’m sorry! কী শাস্তি দিতে চাও বলো।”

ইতি কঠিন গলায় বলল, “এসব আহ্লাদের কোনো মানে হয় না আহনাফ।”

এই প্রথম চেনা মানুষটাকে অচেনা লাগলো আহনাফের। যে মানুষটাকে একটা খোলা বইয়ের মতো পড়েছিল আহনাফ, সে যেন আচমকা বদলে গেল। আহনাফের মনে হলো, ভিন্ন কোনো ইতির সঙ্গে কথা বলছে সে।

ইতি আবারও গম্ভীর গলায় বলল, “তুমি হয়তো ভাবছো একটা জন্মদিন ভুলে যাওয়ার জন্য আমি বাচ্চাদের মতো রাগ করছি। জন্মদিনটা আসল কথা নয়। আসল কথা হলো আমাদের এই সম্পর্কে তোমার দিক থেকে কোনো এফোর্ট আর আসছে না। নিজেই এফোর্ট দিয়ে টিকিয়ে রাখছি সম্পর্কটা।”

আহনাফ সেদিনই ঘর থেকে বেরিয়ে একগাদা ফুল, ঝুড়িভর্তি কাঁচের চুড়ি, শরৎচন্দ্রের বই কিনলো আহনাফ। সবই ইতির পছন্দের জিনিস। পছন্দের জিনিসগুলো হাসিমুখেই গ্রহণ করলো। বিলম্বিত জন্মদিন হাসিমুখেই উদযাপন করলো। তবে আহনাফ ঠিকই টের পেলো তার ভেতরকার শীতলতা।

ইতি যে একটু একটু করে বদলে যেতে শুরু করেছে তা বুঝতে আর বাকি রইলো না আহনাফের। তবে এই পরিবর্তনটা ইতিবাচকভাবেই গ্রহণ করতে চেয়েছিল সে। তার মতে, প্রেমের শুরু দিকটায় ইতি ছিল বাচ্চা একটা মেয়ে। প্রাণচাঞ্চল্য আর পাগলামি যার মাঝে ভরপুর।

অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। ইতি পরিণত হতে শুরু করেছে। তার কাছ থেকে নিশ্চয়ই আগেকার মতো পাগলামি আশা করা যায় না। আহনাফ ভেবেছিল সে ইতির ভেতরটা বেশ বোঝে। অথচ সে কি একবারের জন্যেও ভেবেছিল, যে ইতিকে সে বোঝে সে ভেতরে ভেতরে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা মানুষ?

সেবার সেমিস্টার ব্রেকে সকল ফ্যাকাল্টি মেম্বাররা ঠিক করলেন, একসঙ্গে ঢাকার বাইরে ট্যুরে যাবে। লম্বা ছুটির পুরো সময়টাই আহনাফ দিতে চেয়েছিল ইতিকে। তবে সিনিয়র লেকচারাররা এমনভাবে চেপে ধরলেন যে না করতে পারলো না আহনাফ। বাধ্য হয়েই মনের বিরুদ্ধে রওনা করলো বান্দরবানের উদ্দেশ্যে।

ইতির অবশ্য এ নিয়ে কোনো আপত্তি ছিল না। আহনাফ ট্যুরে যাওয়ার আগের দিন তার সঙ্গে দেখা করতে এসে হাসিমুখে বলে, “যাও ঘুরে এসো! মাইন্ড ফ্রেশ হয়ে যাবে।”

বিপত্তি বাঁধলো আহনাফ ট্যুর থেকে ফিরে আসার পর। ফ্যাকাল্টির একজন লেকচারার বান্দরবানের থানচিতে নেমে নিজের মতো আশেপাশের দৃশ্য ধারণ করছেন ভিডিওতে। সেই ভিডিও পরবর্তীতে আপলোড করেন ফেসবুকে। ইতির নজরেও সেই ভিডিও এসে পড়ে। ভিডিওর প্রায় শেষের দিকে দেখা যায়, বেশ দূরে দাঁড়িয়ে আছে তার ইউনিভার্সিটির কাঁকন ম্যাম। কাঁকন ম্যামের ঠিক সামনে আহনাফ। দুজনের মুখেই হাসি। আহনাফ কী যেন বলল, অমনি হেসে গড়িয়ে পড়লেন কাঁকন ম্যাম।

রীতিমত গা জ্বলে যাওয়ার মতো দৃশ্য ইতির জন্যে। তবুও যথেষ্ট শান্ত ভঙ্গিতে ভিডিওটা আহনাফকে দেখিয়ে বলল, “ভালো লাগে কাঁকন ম্যামকে?”

আহনাফ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “একটা মানুষের সঙ্গে কথা বলা মানেই তাকে ভালো লাগা?”

ইতি শীতল গলায় বলল, “কথা তো বলছো না। হাসাহাসি করছো। যাকে ভালো লাগে না তার সঙ্গে হাসাহাসি করা যায়?”

আহনাফ ভ্রু কুঁচকে বলল, “কী বলছো এসব ইতি? মাথা ঠিক আছে তোমার?”

ইতি যেন ধৈর্য হারিয়ে ফেলল এবার। রীতিমত অগ্নিকণ্ঠে বলল, “এখন তো মনে হবেই আমার মাথা ঠিক নেই। নতুন গার্লফ্রেন্ড পেয়ে গেছ না!”

ইতির এই রূপটা আগে কখনো দেখেনি আহনাফ। ভীষণভাবে তাই চমকে উঠলো সে। চোখেমুখে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠলো সেই চমক।
মনে হলো যেন এক পলকে চেনা মানুষটা একেবারে অচেনা হয়ে উঠলো। কাছের মানুষটা সরে গেল বহু দূরে।

আহনাফ তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল, “এসব কী যা তা বলছো তুমি? একসাথে ঘুরতে গিয়ে কাউকে অ্যাভয়েড করা সম্ভব নয়, এটা তুমিও জানো। তার ওপরে মানুষটা আমার কলিগ।”

ইতি আক্ষেপের সুরে বলল, “কাউকেই তোমার পক্ষে অ্যাভয়েড করা সম্ভব নয়, আমি বাদে। সেই কবে থেকে বিয়ের কথা বলে আসছি। প্রত্যেকবার এড়িয়ে গেছ তুমি।”

আহনাফ ভ্রু কুঁচকে বলল, “এখানে আবার বিয়ের কথা আসছে কেন?”

“এই যে! আবারও এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছো তুমি। সত্যি করে বলো তো আহনাফ, তুমি কি সত্যিই আমার ব্যাপারে সিরিয়াস না-কি কেবল ব্যবহার করে যাচ্ছো আমাকে?”

ইতির এই কথাটায় আহনাফের রাগ সকল সীমা ছাড়িয়ে গেল। প্রায় তিন বছর ধরে যে মানুষটা তার ধ্যান-জ্ঞান তার মুখে এমন অপবাদ যে কতটা কষ্টদায়ক তা শুধু আহনাফই বোঝে।

আহনাফ রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বলল, “আধা ঘন্টার মধ্যে রেডি হয়ে বাসা থেকে নেমে এসো।”

ইতি কিছু বলার আগেই ফোনটা কেটে দিলো আহনাফ। মনে মনে যে সিদ্ধান্ত সে নিয়ে ফেলেছে, তা কতটুকু ঠিক কতটুকু ভুল – সেট বোঝার ক্ষমতা ততক্ষণে হারিয়ে ফেলেছিল আহনাফ। তার মনে একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে বারবার। ইতি তার সমন্ধে যে ভুল ধারণা পুষে রেখেছে, তা ভাঙাতে হবে।

আহনাফ নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরে উঁকি দিতেই দেখলো সাবা উৎফুল্ল ভঙ্গিতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধছে।

আহনাফ দরজার কাছে দাঁড়িয়েই বলল, “সাবা বের হচ্ছিস?”

সাবা ভাইয়ার দিকে ফিরে হাসিমুখে বলল, “হ্যাঁ! তোমাকে বলেছিলাম না আজ অরুণের জন্মদিন। আমরা সবাই একসঙ্গে মাওয়া ঘাটে যাচ্ছি সেলিব্রেট করতে।”

আহনাফ শুকনো গলায় বলল, “একটু পরে বের হতে পারবি।”

“কেন?”

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আহনাফ বলল, “আমি ঠিক করেছি ইতিকে বিয়ে করবো।”

সাবা অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো আহনাফের দিকে। যেন ভিনগ্রহের কোনো ভাষায় কথাটা বলল আহনাফ। সে যে এই মুহূর্তে আচমকা এমন কিছু বলে বসবে, ভুলেও কল্পনা করেনি সাবা।

তার বিস্ময়টা আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে আহনাফ বলল, “আজই।”

সাবা বিস্ময়ে খাবি খেয়ে বলল, “আজই?”

“হ্যাঁ।”

আহনাফ ঘরের ভেতরে পা রেখে বিছানার এক পাশে বসলো। তার চোখেমুখে প্রবল ক্লান্তি আর হতাশার ছাপ।

সাবা তার পাশে বসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “বাবা-মাকে জানিয়েছ?”

“না।”

সাবা অস্থির গলায় বলল, “তারা তো ইতির কথা কিছুই জানে না।”

আহনাফ শীতল গলায় বলল, “বিয়ের পর একেবারে জানবে।”

সাবা আবারও বিস্মিত হয়ে বলল, “তুমি তাদের না জানিয়েই বিয়ে করবে?”

আহনাফ চুপ করে রইলো। জীবনের কোনো সমীকরণই মিলছে না এই মুহূর্তে। অথচ সমীকরণগুলো মেলাবে বলে ব্যাকুল হয়ে আছে তার মনটা। সমীকরণ মেলাতে না পারার ক্লান্তিতে জর্জরিত তার মনটা।

সাবা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “এত তাড়াহুড়ো?”

আহনাফ আক্ষেপের সুরে বলল, “ইতি মনে করে আমি ওর থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। ওর ধারণা আমি বদলে যাচ্ছি। আমি যে আগের মতোই আছি, এটা বোঝাতেই বিয়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

সাবা ভীত ভঙ্গিতে বলল, “ভাইয়া রাগের মাথায় এত বড় একট সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না।”

আহনাফ জোর গলায় বলল, “রাগের মাথায় কোথায়? ঠান্ডা মাথাতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

“আর বাবা-মা?”

“আজ না হলেও কোনোদিন না কোনোদিন
তো বিয়েটা করতেই হতো। সেদিনও লুকিয়ে বিয়ে করেই পরে তাদের জানতাম।”

“কেন?”

“কারণ ইতি মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। বাবা-মা নেই, কোনো সোশ্যাল স্ট্যাটাস নেই। এমন একটা মেয়ের সাথে আমার বিয়েতে মা কোনোদিনও রাজি হবে না। তার চেয়ে ভালো বিয়েটা আগে হয়ে যাক, পরে তারা জানবে।”

এই চিন্তাটা সাবার মাথাতেই এসেছিল যখন সে জানতে পেরেছিল তার ভাইয়ের সাথে ইতির সম্পর্কের কথা। আমির সাহেব ও ফাহমিদা বেগম দুই ছেলেমেয়েকেই স্বাধীনভাবে বড় করেছেন। তাদের কোনো সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করেননি কখনো। তবে ছেলেমেয়েদের বিয়ের প্রসঙ্গ এলেই বদলে যায় সেই চিন্তাধারা।

ফাহমিদা বেগম বরাবরই বলেন, সারা দেশ খুঁজে সবথেকে সুন্দরী মেয়েটাকে নিজের ছেলের বউ বানাবেন। যে মেয়ে যোগ্যতায়ও হবে আহনাফের সমান। যে মেয়ের পরিবারের তাদের মতোই সম্মান আছে। সেই অর্থে ইতির তো কিছুই নেই। কী করে এই মেয়েটাকে পছন্দ করবেন ফাহমিদা বেগম?

আপাতত সেই চিন্তা ঝেড়ে ফেলে আহনাফ বলল, “আমি ইতিকে নিয়ে কাজী অফিসে যাচ্ছি। তুই চল, সাক্ষী দিবি!”

কথাটা বলতে বলতেই উঠে দাঁড়ালো আহনাফ। সাবা স্থির হয়ে বসে রইলো ঠিক আগের জায়গাতেই।

সতর্ক কণ্ঠে বলল, “কাজটা ঠিক হচ্ছে না ভাইয়া।”

“ঠিক ভুল জানি না। আপাতত তুই তো আমাকে সাপোর্ট কর!”

সাবা পাশে দাঁড়ালো তার ভাইয়ার। আহনাফ তার আরও কয়েকজন বন্ধুবান্ধবদের খবর দিয়ে ডেকে আনলো। ইতি কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিয়েটা হয়ে গেল তাদের। আহনাফের এমন আকস্মিক সিদ্ধান্তে তার বন্ধু বান্ধবেরা অবাক না হয়ে পারলো না। যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছেলে আহনাফ। রাগের মাথায় হুটহাট সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার মতো মানুষ তো সে নয়।

সবথেকে বেশি অবাক হয়েছিলেন ফাহমিদা বেগম এবং আমির সাহেব। তাদের বাধ্য ছেলে যে তাদের না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলবে, এমনটা হয়তো স্বপ্নেও ভাবেননি তারা। আহনাফের ধারণাই সত্যি হলো। ইতিকে তেমন একটা পছন্দ করলেন না ফাহমিদা বেগম। তবুও নতুন পুত্রবধূর প্রতি অনীহা থেকে ছেলের ওপর অভিমানের পাল্লাই অধিকতর ভারী হলো।

দুটো মানুষ বিয়ে যেহেতু করেই ফেলেছে, বিয়েটা তো আর অস্বীকার করা যায় না। ফাহমিদা বেগম এবং আমির সাহেব অভিমান নিয়েই মেনে নিলেন ইতিকে। আহনাফ বাবা-মায়ের কাছে আরেকদফা ক্ষমা চেয়ে বলল কয়েকটা দিন নিজেদের মতো কাটাতে চায় তারা। ধানমন্ডিতে আহনাফের নামে একটা ফ্ল্যাট আছে। সেই ফ্ল্যাটেই আপাতত উঠতে চাইছে ইতিকে নিয়ে।

ফাহমিদা বেগম ভেবে পেলেন না কী এমন আছে এই মেয়ের মাঝে যে, ছেলে তাদের না জানিয়েই বিয়ে করে ফেলল তাকে। এখন আবার পরিবার থেকে আলাদা হয়ে তার সঙ্গেই থাকতে চাইছে। যা খুশি করুক! একরাশ আক্ষেপ নিয়ে ছেলের এই সিদ্ধান্তেও মত দিলেন ফাহমিদা বেগম।

কাজী অফিস থেকে আহনাফের বাবা-মায়ের মুখোমুখি হওয়া পর্যন্ত পুরোটা সময়ে ভয়ে-সংকোচে তথস্ট হয়ে ছিল ইতি। বেশ বুঝতে পারছিল আহনাফ প্রচন্ড রেগে আছে তার ওপরে। রাগটা যাতে বেড়ে না যায়, তাই কোনপ্রকার কথাও ইতি বলেনি তার সঙ্গে।
প্রথম কথাটা বলল তাদের নিজেদের ফ্ল্যাটে ঢুকে।

ভয়ে ভয়ে ইতি বলল, “তোমার এত রাগ জানতাম না তো।”

আহনাফ গম্ভীর গলায় বলল, “আজ থেকে জেনে রাখো।”

ইতি শুকনো ঢোক গিলে বলল, “এখনও রেগে আছো আমার ওপরে?”

আহনাফ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “হ্যাঁ।”

ইতি ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “আহনাফ বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে হারাতে চাইনি। তোমাকে অন্য কারো সঙ্গে দেখলেই মনে হতো এই বুঝি হারিয়ে ফেলবো।”

আহনাফ অভিমানের সুরে বলল, “এখন তো আর হারিয়ে ফেলার কোনো চান্স নেই। নিশ্চিন্তে থাকো।”

ইতি মলিন কণ্ঠে বলল, “আমার ওপর রাগ করে বিয়েটা করেছো তাই
না?”

“তুমি আমাকে বিশ্বাসই করো না। অবিশ্বাস যাতে না করতে পারো তাই বিয়েটা করেছি।”

ইতি আচমকা আহনাফকে জড়িয়ে ধরে বলল, “অবিশ্বাস করি না আহনাফ। এক ফোঁটাও না। একটু বেশিই ভালোবাসি তো, তাই পাগলামি করি মাঝেমধ্যে।”

পাগলামি! ইতির এই পাগলামিই যে কাল হয়ে দাঁড়াবে আহনাফের জীবনে, কে জানতো!

(চলবে)