#লেবু
১৯
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
প্রকান্ড মিটিং হলজুড়ে থমথমে হওয়া বয়ে যাচ্ছে। মিটিংয়ের মধ্যমণি শাফকাত। সিনেমার প্রতি প্রবল আগ্রহ থেকেই সে প্রতিষ্ঠা করেছিল প্রযোজনা সংস্থা ‘সিনেব্লাস্ট মিডিয়া’। দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে এক সময়ে একাই রাজত্ব করেছে সিনেব্লাস্ট। একের পর এক ব্যবসা সফল সিনেমা যুক্ত হতে থাকে তাদের তালিকায়। ইন্ডাস্ট্রির নামী-দামী অভিনেতা, পরিচালক সবাই মুখিয়ে থাকে সিনেব্লাস্টের সঙ্গে কাজ করার জন্যে।
ইদানিং আগের মতো সেই আগ্রহটা আর কাজ করে না শাফকাতের। কোম্পানির চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছে যে বেশ কিছুদিন হলো। শাফকাত আগ্রহ হারিয়ে ফেলার পর থেকে সিনেব্লাস্টও যেন হারাতে শুরু করে আগের সেই আধিপত্য। কোম্পানি থেকে বিশাল বাজেটের সিনেমা নির্মাণ হচ্ছে না, বড় বড় তারকারা তাদের সিনেমায় কাজ করছে না। এমন তো না দর্শক হলমুখী নয়। দর্শক তো ঠিকই হলে যাচ্ছে, নিয়মিত সিনেমা দেখছে। তাহলে এক সময়কার সফলতম প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের এই ভরাডুবির কারণ কী?
সিনেব্লাস্টের কোনো কিছু নিয়েই শাফকাত আর মাথা ঘামায় না। তবে গতকাল কোম্পানির অ্যানুয়াল রিপোর্ট প্রকাশের পর আর ধরে রাখতে পারলো না নিজেকে। এবার তার মাথা না ঘামালেই নয়! শাফকাতের সামনে থাকা ল্যাপটপের ভেসে উঠেছে পুরো রিপোর্টটা।
কনফারেন্স টেবিলের একদম প্রথমেই বসে শাফকাত। তার দুদিকে কোম্পানির নানা কর্মকর্তারা। সকলের চোখেমুখেই দুশ্চিন্তার ছাপ। সবথেকে বেশি দুশ্চিন্তায় আছেন সিনেব্লাস্টের সিইও রাশেদ জামান। একটু পর পর রুমাল দিয়ে কপালে জমে থাকা ঘাম মুছছেন।
শাফকাত থমথমে গলায় বলল, “আটত্রিশ পার্সেন্ট?”
থমথমে কণ্ঠে বললেও কথাটার ফাঁক দিয়ে যেন আগুন ঝরে পড়লো। মিটিং রুমে উপস্থিত সকলে টের পেলো সেই আগুনের তীব্রতা।
রাশেদ সাহেব থতমত খেয়ে বলল, “আসলে স্যার…”
শাফকাত তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, “এক্সকিউজ দেওয়ার চেষ্টা করবেন না! কখনো দেখেছেন এই কোম্পানির নেট প্রফিট সত্তর পার্সেন্টের নিচে নামতে?”
রাশেদ সাহেব কম্পিত স্বরে বলল, “না স্যার।”
শাফকাত অগ্নিকণ্ঠে বলল, “এক লাফে তাহলে এতটা নেমে গেল কী করে এবার? আপনাদের হাতে কোম্পানির দায়িত্ব দিয়ে কী ভুল করলাম আমি?”
রাশেদ সাহেব যেন চুপসে গেলেন এবার। কোম্পানির সব বড় বড় সিদ্বান্ত তাকে নিতে হয়। অফিসজুড়ে তার আধিপত্যের শেষ নেই। অথচ শাফকাতের সামনে তাকে এভাবে দমে যেতে দেখে অবাক হয়ে গেলেন বেশির ভাগ কর্মকর্তারা।
সিনেব্লাস্টের মার্কেটিং বিভাগের প্রধান শাওন কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বলল, “স্যার আমি একটা কথা বলতে পারি?”
শাফকাত তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “কী?”
তার কণ্ঠের তীক্ষ্ণতায় শাওন বেচারাও দমে গেল। একবার ভাবলো প্রশ্নটাই করবে না। তবে বহুকষ্টে ভয়টা কাটিয়ে উঠে বলল, “ইদানিং বক্স অফিসে কে ফিল্মসের সিনেমা বেশি চলছে। বড় বড় সেলিব্রিটিরাও তাদের সিনেমায় করার জন্যে মুখিয়ে থাকে। হল মালিকরা কে ফিল্মসের লোগো দেখলেই সিনেমা নিয়ে নেয়।”
শাফকাত ভ্রু কুঁচকে বলল, “কম্পিটিটর তো থাকবেই। তাদের ভয়ে আমরা বিজনেস গুটিয়ে ফেলবো? তাও যদি পুরনো কম্পিটিটর হতো! দশ বছর হতে চলো আমরা ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছি। কে ফিল্মস দুই বছরের মধ্যে কী এমন করে ফেলল যে সবাই তাদের সিনেমা কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছে।”
শাওন শুকনো মুখে বলল, “কিছুই করেনি স্যার। তাদের কাছে ওই একটা নামই আছে, আরশাদ হক। সে প্রোডিউসার বলেই সিনেমাগুলো হিট হচ্ছে।”
রাগে রীতিমত গা জ্বলে গেল শাফকাতের। আরশাদ হক! এই নামটা শুনলেই যেন তার দু কান দিয়ে বাষ্প বের হয়। একটা গোটা জাতি পাগল এই মানুষটার জন্য। আরশাদ নাম কোনো কিছুই সঙ্গে জড়িয়ে থাকলেই হলো! সেই দিকে ছুটে যাবে হাজার হাজার মানুষ। আরশাদ কোনো ব্র্যান্ডের অ্যাম্বাসেডর হলে সেই ব্র্যান্ডের সেল এক লাফে বেড়ে হবে আকাশচুম্বী। আরশাদ কোনো একটা সিনেমায় অভিনয় করলেই সেই সিনেমা হবে ব্লকবাস্টার। কী যে পেয়েছে বাঙালি আরশাদের মাঝে?
শাফকাতের মনে শুরু থেকেই আরশাদের জন্যে এই ঘৃণাটা ছিল না। একটা সময়ে সিনেব্লাস্টের সঙ্গে আরশাদের সম্পর্কটা ছিল অটুট। সিনেব্লাস্টের ব্যানারে বহু ব্যবসাসফল সিনেমায় অভিনয় করেছে আরশাদ। আরশাদের সঙ্গে সিনেব্লাস্টের পথ চলা ‘আয়না’ সিনেমার মধ্য দিয়ে। সিনেমা ব্যাপক ব্যবসা-সফল তো হয়ই, সেই সঙ্গে চারদিকে প্রংশায় ভাসতে থাকে আরশাদ।
‘আয়না’র মধ্য দিয়ে আরশাদের খ্যাতি আরও বাড়তে থাকে। দীর্ঘদিন হলে চলেছিল সিনেমাটি। প্রত্যন্ত গ্রামীণ অঞ্চলেও সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। বিদেশি বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালেও প্রদর্শিত হয় ‘আয়না’।
আরশাদের যেমন লাভ হয়েছিল, লাভটা শাফকাতেরও নেহায়েত কম হয়নি। সিনেমার ব্যবসায় যে এতটা লাভজনক এই সিনেমার মাধ্যমেই জানতে পারে না। আগে সিনেব্লাস্টকে এতটা মনোযোগ না দিলেও, ধীরে ধীরে সিনেমার ব্যবসায়ে তার আগ্রহ বাড়তে থাকে। তার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানেরও সুনামও ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। শুধুমাত্র একটা সিনেমা দিয়েই সিনেব্লাস্ট মিডিয়া হয়ে যায় দেশের প্রথম সারির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান।
আরশাদ এবং শাফকাত প্রায় সমবয়সী হওয়ায় অদৃশ্য একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয় তাদের মাঝে। সাধারণত নায়ক এবং প্রযোজকদের মধ্যে যে গম্ভীর ধরনের একটা সম্পর্ক থাকে, তাদের মাঝে সেটা ছিল না। তাদের আলোচনার মূল বিষয়-বস্তুই ছিল সিনেমা। আরশাদ শাফকাতকে পরামর্শ দেয় কী করে ব্যবসার বিস্তৃতি সৃষ্টি করা যায়। ওদিকে শাফকাত তাকে পরামর্শ দেয় কোন ধরনের সিনেমায় তার অভিনয় করা উচিত।
সিনেব্লাস্ট মিডিয়ার ব্যানারে বছরে অন্তত একটা সিনেমায় আরশাদ অভিনয় করবেই। এটা যেন অলিখিত নিয়ম। আরশাদ এবং সিনেব্লাস্ট এই দুইয়ের সংমিশ্রণ কখনোই খারাপ হতে পারে না, দর্শকরাও ততদিনে বুঝে ফেলল।
শাফকাত চাইতো আরশাদ যেন কেবল তার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সিনেমাতেই অভিনয় করে। আরশাদ সেটা চায়নি। ইন্ডাস্ট্রিতে সকেলর সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা রাখাটা জরুরি। তাছাড়া সিনেব্লাস্টের পাঠানো গল্পগুলোও তার পছন্দ হচ্ছিল না। এই নিয়ে হয়তো ক্ষীণ মনোমালিন্য ভুগছিল শাফকাত।
শেষমেশ ঝামেলা বেঁধেই যায়, যখন আরশাদ ওই যৌথ-প্রযোজনার ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হয়ে চুক্তি বাতিল করে। স্ক্রিপ্ট না পড়ে, রীতিমত শাফকাতের জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে একদিনের মাথায় ওই সিনেমায় সাইন করেছিল আরশাদ। পরবর্তীতে স্ক্রিপ্ট পড়ে জানতে পারে, সিনেমায় বাংলাদেশকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হবে।
পাঠ্যবইয়ের পাতার মতো উদার দেশপ্রেমিক আরশাদ নয়। তবে তার কাঁধে ভারী একটা দায়িত্ব রয়েছে। কোটি মানুষের বিনোদনের জন্যে কাজ করে সে। দেশের বাইরেও মানুষ দেখে তার সিনেমা। সে নিজেই নিজের দেশকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে কী করে? আরশাদ স্ক্রিপ্ট পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সিনেব্লাস্টের অফিসে গিয়ে চুক্তি বাতিল করে দিয়ে আসে।
সিনেমাটা ছিল দুই দেশের যৌথ-প্রযোজনার। অর্থাৎ শাফকাতের বাইরেও বিদেশী একজন প্রযোজক রয়েছে। শাফকাত তাকে কথা দিয়েছিল, বাংলাদের একমাত্র সুপারস্টার আরশাদ হক থাকবে এই সিনেমায়। আরশাদ যেহেতু চুক্তি বাতিল করে দিলো, সুতরাং সিনেমার প্রযোজনা থেকেও সরে দাঁড়ালো ওই বিদেশী প্রযোজক।
রাগে ফেটে পড়লো শাফকাত আলম। এই সিনেমাটা তৈরি হলে দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়তো সিনেব্লাস্ট মিডিয়ার সুখ্যাতি। সেই সঙ্গে আয়ের খাতাও হয়ে উঠলো ভারী। তার সাজানো পরিকল্পনায় পানি ঢেলে দিলো আরশাদ।
সেদিন শাফকাত আরশাদকে ফোন করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “কাজটা ভালো করলে না আরশাদ। ভুলে যেওনা তোমাকে সুপারস্টার কে বানিয়েছে? এত ওপরে উঠেছো আমার সিনেব্লাস্টের কারণেই!”
এই ঘটনার পরেই সিনেব্লাস্টের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্কের ইতি টানে আরশাদ। আর কখনোই তাকে দেখা যায়নি এ অফিসে। এ প্রোডাকশন হাউজের ব্যানারে কাজ করতে। আরশাদ হক স্বীকার করুক বা না-ই করুক তার এই সাফল্যে সিনেব্লাস্টের অবদান অবশ্যই আছে। সাফল্যের চূড়ায় উঠে নিজের শিকড়কেই ভুলে গেছে। সেলিব্রিটিদের স্বভাবটাই এমন। আর সেখানে সে তো সুপারস্টার। অহংকার তো তার থাকবেই!
দুই বছর আগে আরশাদ শুরু করে নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘কে ফিল্মস’। কে ফিল্মসের সূচনার পর থেকেই যেন বক্স অফিসে তার আধিপত্য। প্রতিষ্ঠার প্রথম বছরেই দর্শকের মধ্যে আগ্রহ ছড়িয়েছে তারা। দর্শকও একটা সিনেমার সঙ্গে কে ফিল্মসের নাম দেখলেই ছুটে যাচ্ছে হলে। এর কারণ আর কিছুই না, সিনেমাটার প্রযোজক আরশাদ হক।
আরশাদকে প্রযোজক হিসেবে গণ্য করারও ইচ্ছা নেই শাফকাতের মাঝে। যে মানুষটা ব্যবসা শুরুই করলো মাত্র কয়েক দিন আগে, সে আবার কীসের প্রতিদ্বন্দ্বী? ব্যবসাতেও কোনো কৃতিত্ব নেই আরশাদের। বউকে ব্যবসা পরিচালনার সব দায়িত্ব দিয়ে দিনশেষে সাফল্যের কৃতিত্ব নিজে নিয়ে বেড়াচ্ছে!
শাফকাত গম্ভীর গলায় বলল, “কে ফিল্মসের ভেতরে কী হচ্ছে না হচ্ছে খোঁজ নাও!”
রাশেদ সাহেব ভীত ভঙ্গিতে বললেন, “কিন্তু স্যার… কীভাবে?”
শাফকাত শীতল গলায় বলল, “এটাও আমাকে শিখিয়ে দিতে হবে? সিক্রেট এজেন্ট পাঠাবেন! আর কীভাবে?”
এই ইন্ডাস্ট্রি একটা সময়ে নিম্নমানের সিনেমার দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। সেখান থেকে ইন্ডাস্ট্রিটাকে পুনরুদ্ধার করেছে সিনেব্লাস্ট মিডিয়া। যা শাফকাতের, তা কেবলই তার। যা কেবলই তার, সেটার দিকে অন্য কেউ চোখ তুলে তাকানোর সাহস করলেও তাকে নিঃশেষ করে এসেছে সে। ভবিষ্যতেও ঠিক তাই করবে।
আজ কোনো রিপোর্টের শুট ছিল না সাবার। তবুও অফিসে কাজের শেষ নেই। তার শুট করে রাখা দুটো রিপোর্টের রিভিউ করতে হলো। পরের রিপোর্ট তৈরির জন্য কতগুলো তথ্য খুঁজতে অনেকটা সময় ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করতে হলো। এডিটরের সঙ্গে মিটিংয়ে বসতে হলো।
ক্লান্ত ভঙ্গিতে লিফট থেকে নামলো সাবা। ক্লান্তির সাথে সাথে কিছুটা উচ্ছ্বাস কাজ করছে তার মাঝে। বাড়ি ফেরার পথে অরুণকে তুলে নিয়ে যাবে। বহুদিন পর আজ আবারও বসবে তাদের ক্রাইম নাইটের আসর। সাবা বেশ বুঝতে পারছে তার চারপাশের মানুষগুলো প্রাণপণ চেষ্টা করছে তাকে আগের সাবায় পরিণত করতে। সাবাও প্রাণপণ চাইছে তাদের চেষ্টাটা যেন সফল হয়। একটু একটু করে সেও ফিরে যেতে চেষ্টা করছে স্বাভাবিক জীবনে।
এই যে সাবার মনের ভার খানিকটা হলেও কমে যাওয়া, আবারও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা – তার কেন জানি মনে হয়, এসবের পেছনেই রয়েছে শাফকাতের অবদান। শাফকাত একটু একটু করে তাকে আপন করে নেওয়ার চেষ্টা করছে বলেই হয়তো সাবা দমবন্ধকর জীবনটা থেকে বেরিয়ে আসার সাহস করে উঠতে পারছে।
গ্যারেজে গাড়ির কাছে এসে পৌঁছে আশেপাশে কোথাও তার বডিগার্ড জামশেদকে দেখতে পেলো না।
ফোন করতেই জামশেদ ব্যস্ত গলায় বলল, “ম্যাডাম আমি অফিসের ক্যান্টিনে আসছিলাম চা খাইতে। এক্ষনি আসতেছি।”
সাবা শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “সমস্যা নেই জামশেদ ভাই। চা শেষ করে ধীরেসুস্থে আসুন।”
সাবা গাড়িটা ড্রাইভ করে গ্যারেজ থেকে বার করে অফিসের সামনে এনে অপেক্ষা করছে জামশেদের জন্যে। আচমকা তার জানালার কাছে টোকা পড়লো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে জানালার বাইরে সাবা যে মানুষটাকে দেখলো, তাকে দেখে যারপরনাই চমকে ওঠার কথা। সাবাও চমকে উঠলো, তবে মনে মনে। চমকটা চোখেমুখে প্রকাশ করলো না।
এই মানুষটাকে দেখার জন্যে একটা সময়ে অস্থির হয়ে থাকতো সাবা। দিনভর অপেক্ষা শেষে তাকে দেখার পরই শান্তি পেতো চোখদুটো। অথচ আজ এত বছর পর তাকে দেখে কোনো অনুভূতিই কাজ করলো না সাবার মাঝে। দোষ সাবার অনুভূতিহীনতার নয়, এই মানুষটাই দোষ।
সাবার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে যেত এখন থেকে। সাবা যথেষ্ট ম্যাচিউরড একটা মেয়ে বলেই হয়তো স্বাভাবিক রইলো।
গাড়ির কাঁচ নামিয়ে দিয়ে বলল, “আরে ফাহিম! দেশে কবে ফিরলে তুমি?”
ফাহিম হেসে বলল, “এই তো, কিছুক্ষণ আগে।”
সাবা অবাক গলায় বলল, “কিছুক্ষণ আগে?”
“হ্যাঁ। এয়ারপোর্টে নেমেই সোজা তোমার অফিসের সামনে চলে এলাম।”
“কেন?”
ফাহিম কিছু না ভেবেই বলল, “জানি না। কোনো প্ল্যান ছিল না। হঠাৎই তোমাকে দেখতে ইচ্ছা হলো।”
মনে মনে বিরক্ত না হয়ে পারলো না সাবা। ফাহিমের কি ধারণা সাবা এখনো সেই বিশ বছর বয়সী মেয়েটি আছে? এ ধরনের কথা শুনলেই মোমবাতির মতো গলে পড়বে সে?
বহুকষ্টে বিরক্তিটা চেপে রেখে সাবা স্বাভাবিকভাবে বলল, “ও আচ্ছা। এটা আমার অফিস জানলে কীভাবে?”
ফাহিম আত্মবিশ্বাসী সুরে বলল, “না জানার কী আছে? তোমার রিপোর্ট আমি প্রায়ই দেখি অনলাইনে।”
সাবা চুপ করে রইলো। এত বছর পর ফাহিমের সাথে দেখা হওয়া কোনোভাবেই দাগ কাটতে পারছে না তার মনে।
ফাহিম শুকনো গলায় বলল, “তোমার ভাইয়ার কথা শুনেছি। I’m really sorry about that.”
নিমিষেই ফ্যাকাশে হয়ে গেল সাবার চোখমুখ। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্যে।
ভাইয়ার নিষ্প্রাণ মুখটা দুচোখের সামনে ভেসে ওঠার আগেই নিজেকে সামলে নিলো সাবা। শাফকাতের সেই কথাটা মনে পড়ে গেল।
“তোমাকে আরও স্ট্রং হতে হবে সাবা। এরকম পরিস্থিতি জীবনে আরও বহুবার আসবে। প্রত্যেকবার তোমাকে সামলানোর জন্যে আমি পাশে থাকবো না।”
শাফকাতের কথাটা মনে করেই ভেঙে পড়লো না সাবা। আত্মসংবরণ করে বলল, “It’s okay.”
ফাহিম কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “তোমার কি একটু সময় হবে সাবা? চলো কোথাও গিয়ে কফি খাই!”
সাবা কী বলবে ভেবে না পেয়ে বলল, “আজ আমার তাড়া আছে ফাহিম। আমি তো জানতাম না তুমি আসবে। আর তাছাড়া…”
বাকি কথাটা সে বলে ওঠার আগেই ফাহিম বলল, “জানলেও সময় রাখতে না?”
সাবা সোজাসাপ্টা বলে দিলো, “না। আমার ব্যাপারে সব খবরই যখন রাখো, তখন নিশ্চয়ই এটাও জানো আমি ম্যারিড।”
ফাহিম ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “জানি।”
সাবা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “তোমার সাথে কোথাও বসে কফি খাওয়া এখন আর আমাকে মানায় না।”
ফাহিম আক্ষেপজড়িত কণ্ঠে বলল, “এখনো রাগ করে আছো আমার ওপরে?”
সাবা সহজ গলায় বলল, “না ফাহিম। মানুষ তার ওপরেই রাগ করে যাকে সে আমলে নেয়।”
এতক্ষণে জামশেদ নেমে এসেছে নিচে। সে গাড়ির ব্যাকসিটে উঠে বসতেই সাবা গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল, “লম্বা ফ্লাইট নিয়ে এসেছে। বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও। আমি আসি।”
(চলবে)