#লেবু
২৬
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
নিজের ভেতরকার অনুভূতিগুলো খুব কম মানুষের কাছেই প্রকাশ করে সাবা। সেই কম মানুষের তালিকায় একদিন যে ফাহিমকে জায়গা দিতে হবে, কে জানতো? এছাড়া অবশ্য অন্য কোনো পথ ও নেই সাবার কাছে।
‘পথপদ্ম’ নামের এই এনজিওর একটি এতিমখানা রয়েছে। এখান থেকেই ফাহমিদা বেগম লতিফা নিয়ে গিয়েছিলেন। এছাড়াও আহনাফের জন্মদিন, সাবার জন্মদিন, আহনাফের মৃত্যুদিনে এখানকার বাচ্চাদের খাওয়ান তিনি। সেই সুবাদে এনজিওর কর্মকর্তারা সাবাকে বেশ ভালো করেই চেনে। তারাই এতিমখানার ছাদে ফাহিমের সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
বাড়ি থেকে বের হতেও কম ধকল পোহাতে হয়নি সাবাকে। বাবা-মা ঘুম থেকে ওঠার আগে ভোর বেলাতেই বেরিয়ে গেছে বাড়ি থেকে। বাড়ির বাইরে কড়া পাহাড়ায় জহুরুল। এছাড়াও শাফকাতকে বিশ্বাস নেই। দেখা গেল দূরে দাঁড়িয়ে আছে তার নিয়োগ করা ভিন্ন এক গার্ড।
সেই থাকুক না কেন, তার চোখে ধুলো দেওয়ার জন্যে সাবা লতিফার বেগুনি রঙের বোরখাটা পরেছে। তার এই একটাই বোরখা আছে। একা একা বাইরে গেলে এটাই পরে যায় সে। সে কারণেই বাড়ির সিকিউরিটি গার্ড বা জহুরুল কেউই সন্দেহ করলো না।
ফাহিম সময়মতোই এসে পড়েছে। যে ধরনের সাহায্য সাবা তার কাছ থেকে প্রত্যাশা করছে, তা পেতে হলে তার কাছে কোনোকিছুই গোপন করা উচিত হবে না। হাজার বিরক্তি চেপে রেখে সাবা তাই সবটাই বলল তাকে।
বিয়ের পর থেকে শাফকাতের কন্ট্রোলিং আচরণ, তার ফোন নম্বর ট্র্যাপ করা, তাকে পদে পদে সন্দেহ করা, এমনকি ফাহিমকে নিয়েও সন্দেহ করা – সবটা।
সবটা শুনে ফাহিম উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “আমি আগেই বুঝেছিলাম!”
সাবা ভ্রু কুঁচকে বলল, “কী বুঝেছিলে?”
ফাহিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “যে বিয়েটা করে তুমি ভালো নেই।”
বিরক্তিতে গা জ্বলে গেল সাবার। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে মেয়েদের মন গলানোর অনন্য ক্ষমতা দিয়েছে তাকে প্রকৃতি। তবে বারবার আঘাতপ্রাপ্ত হতে হতে যে মেয়েটার মন পাথরের ন্যায় জমাট বেঁধে গেছে, তার ক্ষেত্রে এই ক্ষমতার কার্যকারিতা শূন্যের কোঠায়।
তাছাড়া সাবা এই বিয়েটা করে যে ভালো নেই, তা আগেভাগে বুঝে ফেলার কোনো কারণ ফাহিমের নেই। সে দেশে ফেরার পর প্রথম যখন তার সঙ্গে দেখা হলো, তখন তো সব ভালোই চলছিল শাফকাতের সঙ্গে। মনটা একটু একটু করে গলতেও শুরু করেছিল তার প্রতি। কী থেকে যে কী হয়ে গেল!
সাবা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “দেখো ফাহিম তুমি যদি মনে করে থাকো এই কথাগুলো বলে আমি তোমার সিম্প্যাথি পেতে চাচ্ছি, তাহলে তুমি ভুল।”
ফাহিম শুকনো ঢোক গিলে আহত গলায় বলল, “না তা মনে করবো কেন?”
ক্ষণিকের নীরবতা ভঙ্গ করে সাবা আবারও বলল, “একটা সত্যি কথা বলো তো ফাহিম? তুমি কি আজও মনে করো, তোমার ড্রা/গ অ্যাডিকশনের কথা ভিসিকে জানিয়ে দিয়ে আমি তোমার ক্ষতি করেছিলাম?”
ফাহিম নরম স্বরে বলল, “না সাবা। তোমাকে তো কাল বললামই। তখন ঠিকই ভেবেছিলাম তুমি আমার ক্ষতি করেছো। কিন্তু এখন বুঝতে পারি তুমি আমার কত বড় উপকার করেছো। তুমি আমার নামে কমপ্লেইন না করলে আমাকে রিহ্যাবে পাঠানোও হতো না, আমার অ্যাডিকশনও ছুটে যেত না। হয়তো আজ আমি অস্ট্রেলিয়ায় এত বড় একটা চাকরি করার বদলে অলিতে-গলিতে নেশা করে পড়ে থাকতাম।”
“তার মানে তুমি বিশ্বাস করো যে আমি তোমার উপকার করেছি।”
“হ্যাঁ করি তো!”
সাবা বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে বলল, “তাহলে একটা কাজ করো। ওই উপকারের বদলে এখন আমার একটা উপকার করো। পারবে?”
ফাহিম দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “অবশ্যই পারবো! তুমি একটা উপকার চাইবে আর আমি তা করবো না?”
সাবা ক্ষীণ স্বরে বলল, “এত জোর দিয়ে বলার কিছু নেই। কী উপকার চাচ্ছি শুনলে তো পিছিয়ে যাবে!”
ফাহিম আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “তুমি বলো তো সাবা! আমি মোটেও পিছিয়ে যাবো না।”
মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সাবা। যতই আশ্বাস সে দিক না কেন, যে ছক সাবা মনে মনে কষেছে তা শোনা মাত্রই নিশ্চিতভাবে দমে পড়বে ফাহিম।
সাবা কৌতুহলের সুরে বলল, “তুমি অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাবে কবে?”
“মাস দুয়েক পর। কেন?”
সাবা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “এই মাস দুয়েকের মধ্যে আমাকে একটা জব খুঁজে দিতে পারবে?”
ফাহিম বিভ্রান্ত গলায় বলল, “কিন্তু সাবা, তোমার তো অনেক ভালো একটা জব আছে।”
সাবা থমথমে গলায় বলল, “দেশের কথা বলছি না তো! অস্ট্রেলিয়ায়!”
ফাহিম চমকে উঠে বলল, “হ্যাঁ?”
সাবা যথেষ্ট স্বাভাবিক গলায় বলল, “হ্যাঁ। আর সেই সাথে ভিসার ব্যবস্থাও করতে হবে। ওখানে গিয়ে জব করার জন্যে কী কী ডকুমেন্ট লাগতে পারে বলো তো?”
ফাহিম তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উল্টো দ্বিগুণ বিস্ময় নিয়ে বলল, “এক সেকেন্ড, এক সেকেন্ড! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না সাবা। অস্ট্রেলিয়ায় জব, ভিসা… এসব দিয়ে কী করবে তুমি?”
সাবা বিরক্ত গলায় বলল, “এসব দিয়ে মানুষ কী করে?”
ফাহিম কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ভীত ভঙ্গিতে বলল, “তুমি পালিয়ে যেতে চাইছো?”
সাবা ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলল, “হ্যাঁ।”
ফাহিমের চোখেমুখে একই সঙ্গে বিস্ময় এবং ভয় দৃশ্যমান হয়ে ফুটে উঠেছে।
ভয়টা কোনমতে চেপে রেখে ফাহিম কম্পিত স্বরে বলল, “কিছু মনে কোরো না সাবা, তোমার মাথা ঠিক আছে।”
সাবা আক্ষেপের সুরে বলল, “জানতাম, এটাই বলবে!”
“রাগ করছো কেন? আমি কি ভুল কিছু বললাম। তোমার হাসবেন্ড, বিজনেস টাইকুন শাফকাত আলম! সে যে কতটা ডেঞ্জারাস তোমার ধারণা আছে।”
সাবা বিরক্ত গলায় বলল, “আমার ধারণা থাকবে না, তো কার থাকবে?”
ফাহিম কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভেবে বলল, “এটা অসম্ভব সাবা। আমার দেশে ফেরার পর তোমার সাথে দুবার দেখা হয়েছে। দুবারই সে টের পেয়ে গেছে। আজও টের পেয়ে যাবে কিনা তার কোনো ঠিক নেই। এই মানুষের চোখের সামনে দিয়ে তুমি অন্য একটা দেশে পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করবে আর সে কিছুই বুঝতে পারবে না?”
সাবা শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “আগের দুবার অসতর্ক ছিলাম তাই টের পেয়ে গেছে। আজ সতর্ক হয়ে দেখা করতে এসেছি, কীভাবে টের পাবে? তাছাড়া আগের দুবার সতর্ক হওয়ার কোনো কারণও ছিল না।”
ফাহিমের চেহারার ওপর থেকে ভয়ের কালো ছায়া এখনো পুরোপুরি কাটেনি। ভুল কিছু সে বলেনি। সাবার এই প্ল্যানটা বাস্তবায়ন নিতান্তই অসম্ভব। তবুও আশা ছেড়ে দিচ্ছে না সাবা। মাঝে মাঝে অসম্ভবও তো সম্ভব হয়!
সাবা গম্ভীর গলায় বলল, “সতর্কতার সাথেই পুরো প্ল্যানটা সাজাতে হবে।”
ফাহিম ভীত ভঙ্গিতে বলল, “শাফকাত আলম যদি জানতে পারে, আমাকে জানে মেরে ফেলবে সাবা।”
সাবা হতাশ গলায় বলল, “ধুর! তোমার মতো ভীতুর কাছে হেল্প চাওয়াটাই আমার ভুল হয়েছে।”
“আহা সাবা তুমি বারবার রাগ করলে কীভাবে হবে?”
“আর তুমি পুরো প্ল্যানটা না শুনে অযথা ভয় পেলে কীভাবে হবে?”
“আচ্ছা। কী প্ল্যান করেছো বলো?”
সাবা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল, “দেখো, শাফকাত প্রায় প্রতি মাসেই বিজনেস ট্যুরে বিদেশে যায়। সপ্তাহখানেক থাকে। এরকম একটা সময়েই আমরা ফ্লাইট নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাবো।”
ফাহিম অবিশ্বাসের সুরে বলল, “আচ্ছা! এদিকে তোমার জব হবে, ভিসা হবে, ফ্লাইটের টিকেট হবে – অথচ সে কিছুই জানতে পারবে না।”
সাবা জোর গলায় বলল, “না পারবে না! কারণ বাড়িতে আমি একটা লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকবো। যে তার হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলাবে, আর না তে না। আমাকে সন্দেহ করার কোনো সুযোগই আমি তাকে দেবো না।”
ফাহিম আবারও চিন্তা-ভাবনায় ডুবে গেল। এবার অবশ্য তাকে দেখে মনে হচ্ছে সাবার কথায় একটু হলেও ভরসা পাচ্ছে সে।
সাবা তাকে সতর্ক করে দেওয়ার জন্যে বলল,
“তোমার যদি এখনো কোনো ভয়-ভীতি থাকে তাহলে জানিয়ে দাও। আমাকে হেল্প করতে হবে না।”
ফাহিম মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, “না, না। তোমার জন্যে এতটুকু ঝুঁকি নিতে পারবো না?”
“ফাহিম শোনো!”
ফাহিম চোখ তুলে তাকালো সাবার দিকে। সাবা যন্ত্রের ন্যায় আবারও তাকে সতর্ক করে দিয়ে বলল, “একটা কথা মনে রেখো, তোমার সাথে আমার কোনো প্রেম নেই। তোমার প্রেমে অন্ধ হয়ে তোমার হাত ধরে আমি আমার হাসবেন্ডকে ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছি না। আমার হাসবেন্ড একজন কন্ট্রোল ফ্রিক, যাকে সহ্য করা আমার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। তার কাছ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে তোমার হেল্প নিচ্ছি কেবল।”
(চলবে)
#লেবু
২৭
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
ড্রিংক করতে করতে ক্ষত-বিক্ষত হাতটা নিয়ে শাফকাত তার নিজস্ব প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটেই ঘুমিয়ে পড়েছিল ভোররাতের দিকে। ঘুম ভাঙ্গলো বেলা বারোটার কিছু পরে। সাবা যে তার কত বড় সর্বনাশ করেছে সে নিজেও জানে না। কড়া নিয়মের বেড়াজালে বসবাস শাফকাতের। রাত এগারোটা নাগাদ ঘুমিয়ে পড়বে। খুব দেরি হলে বারোটা। সকাল ছয়টা নাগাদ উঠে পড়বে। মদ্যপান থেকে তো নিজেকে দূরে রাখবে শত হাত। এই মেয়েটার কারণে এক রাতেই একাধিক নিয়ম ভেঙে চুরমার করে ফেলল সে।
হাতের অবস্থা বেশ খারাপ। রাতে নেশা আর অনুতাপে বুদ হয়ে ছিল বলে শাফকাত টের পায়নি ব্যাথাটা। এখন বেশ টের পাচ্ছে। ক্ষতস্থানে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। একটা মানুষের ডান হাতের তালুতে যদি এত দীর্ঘ একটা ক্ষত থাকে, তবে সে স্বাভাবিক কর্মকান্ড করবে কী করে?
হোটেলে সর্বক্ষণ কয়েকটা মেডিক্যাল টিম প্রস্তুত থাকে। তাদেরই একটা টিমকে ডাকলো শাফকাত। হাতে ড্রেসিং করা হলো, তিনটা সেলাইও লাগলো। এই হাত দিয়ে আপাতত কোনো কাজ করা যাবে না। ক্ষতস্থান আবারও আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে।
হোটেল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো শাফকাত। রাত-ভর ড্রিংক করায় নেশার রেশ এখনো কেটে উঠতে পারেনি। রোদের তীক্ষ্ণতাও তাই সহ্য করতে পারছে না চোখদুটো। চোখে সানগ্লাস পরে ব্যাকসিটে গা এলিয়ে দিলো শাফকাত। যদিও এই মুহূর্তে সে ড্রাংক নয়, তবুও গাড়ি চালাবে না। ড্রাইভার এসে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
শাফকাত গম্ভীর গলায় বলল, “বাসায় চলো!”
আজ তার শিডিউলে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। তবে কোনো কাজই আজ করতে ইচ্ছা করছে না। বিছানায় গা এলিয়ে পড়ে থাকতে ইচ্ছা করছে দিনভর। কী অদ্ভুত ব্যাপার! শাফকাত যে ধরনের কর্মনিষ্ঠ ছেলে, এমন আলস্যের ইচ্ছা তো কোনোদিন জাগে না তার মনে। সব সাবার দোষ! মেয়েটাকে কষ্ট দিয়েই এই বেহাল দশা তার।
পকেট থেকে ফোনটা বের করে শাফকাত ধীর গতিতে ডায়াল করলো তার ম্যানেজার শরীফের নম্বর।
শরীফ ফোনটা রিসিভ করতেই সে থমথমে গলায় বলল, “অফিসে জানিয়ে দাও আজ আমি আসবো না।”
শরীফ ভীত ভঙ্গিতে বলল, “কিন্তু স্যার…”
কিন্তু আজ ‘Beyond Borders’ এর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। মালায়শিয়ার একটা কোম্পানির কাছে বৃহৎ পরিসরে গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানির কথাবার্তা চলছে। এই ডিলটা বাস্তবায়ন হলে কোম্পানির জন্যে বড় একটা মাইলফলক হতে পারে। এই ডিল নিয়েই আজ শাফকাতের সঙ্গে মিটিংয়ের কথা ছিল। ডিলটা পেতে হলে চেয়ারম্যান সাহেবের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা খুবই গুরত্ববহুল। শাফকাত তা বেশ ভালো করেই জানে।
শাফকাত শীতল গলায় বলল, “আমাকে জ্ঞান দিতে আসবে না। যা বলছি তাই করো।”
শরীফ অপরপ্রান্ত থেকে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল, “জি স্যার।”
ফোনটা কেটে আবারও ব্যাকসিটে গা এলিয়ে দিলো চোখদুটো বুজে। চোখ খুললো একেবারে বাড়ির সামনে এসে।
বাড়িতে পা রাখতেই একটা থমথমে হাওয়ার অস্তিত্ব অনুভব করলো শাফকাত। যে হাওয়া পুরো বাড়িটাকে গুমোট করে রেখেছে। বসার ঘরের সোফায় চিন্তিত মুখে বসে আছেন আতিয়া আলম। তার পাশেই শামা। শামার চোখেমুখে চিন্তার সঙ্গে ভয়ের ছায়া।
আতিয়া আলমের হাতে তার মোবাইল। একটু পর পর কাকে যেন ফোন করছেন। কিন্তু অপরপ্রান্ত থেকে ফোন রিসিভ হচ্ছে না বলে আক্ষেপে গা ভাসাচ্ছেন।
শাফকাত তাদের সোফার দিকে এগিয়ে গিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, “কী ব্যাপার মা?”
আতিয়া আলম গোপনে ঢোক গিললেন। নিজের ছেলেকে তিনি ভয় পান না। তবে সাবার প্রসঙ্গ এলেই যে উদ্বেগ ছেলের চোখেমুখে খেলা করে, যে উদ্বেগের বলে গোটা পৃথিবীর সঙ্গে নির্দ্বিধায় লড়াই করার সাহস সে রাখে – আতিয়া আলম সেই উদ্বেগকেই ভয় করেন।
আতিয়া আলম ইতস্তত করে বললেন, “সাবা…”
সেই চিরচেনা উদ্বেগ মুহূর্তেই উড়ে এসে জায়গা দখল করে নিলো শাফকাতের চোখেমুখে।
উদ্বিগ্ন স্বরেই শাফকাত বলল, “কী হয়েছে সাবার?”
“কাল রাতে হুট করে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। এখনও ফেরেনি। ফোনটাও তুলছে না।”
তীব্র শীতল স্রোত বয়ে গেল শাফকাতের গা বেয়ে। হিম করে দিয়ে গেল শরীরের প্রতিটা হাঁড়। কোথায় গেছে সাবা? তাকে ফাঁকি দিয়ে চিরতরে হারিয়ে গেল কোথায়? দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলো শরীরের প্রতিটা কোষ। মস্তিষ্ক নিমিষেই উত্তপ্ত হয়ে উঠলো।
শাফকাত একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল, “মানে কী? বাড়ি থেকে একটা মানুষ রাত-বিরেতে বেরিয়ে যাচ্ছে আর তোমরা কোনো খবরই রাখবে না?”
আতিয়া আলম ছেলেকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বললেন, “আরে বাবা আমি তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। উঠে শুনি সাবা বাড়িতে নেই।”
শাফকাত শান্ত তো হলোই না। উল্টো তার উৎকণ্ঠা বহুগুণ বেড়ে গেল। কাল রাতে সাবাকে ওখানে ফেলে বাড়ি থেকে চলে যাওয়া তার মোটেও উচিত হয়নি। মেয়েটা তো মানসিকভাবে স্বাভাবিকও নেই। যদি কোনো ক্ষতি হয়ে যায় তার?
শাফকাত ফোনটা বের করে সাবার নম্বরে ডায়াল করলো। রিং হচ্ছে, কিন্তু মেয়েটা রিসিভ করছে না।
শাফকাতের অস্থিরতা দেখে শামা বলল, “ভাইয়া তুমি শুধু শুধু রাগ করছো!”
শাফকাত প্রচন্ড এক ধমক দিয়ে বলল, “তোকে কতবার বলবো বড়দের কথার মাঝখানে কথা বলবি না!”
আতিয়া আলম মেয়ের পক্ষ নিয়ে বললেন, “আহ্ শাফকাত! মেয়েটাকে ধমকাচ্ছিস কেন? সাবা তো শামা বলেই বাইরে গেছে।”
ভেতরকার উত্তাপে কয়েক বিন্দু হলেও জল এসে পড়লো যেন। সাবা তার মানে হুট করে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়নি?
শাফকাত শামার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, “তোকে বলে গেছে?”
কিছুক্ষণ আগের ধমকে দমে পড়া শামা গম্ভীর গলায় বলল, “হুঁ।”
“কী বলেছে?”
শামা গাম্ভীর্যটা ধরে রেখেই বলল, “বলেছে বাবা-মায়ের কাছে যাচ্ছে। কী একটা ইমার্জেন্সী যেন হয়েছে।”
শাফকাত বাড়তি কৌতুহল নিয়ে বলল, “কী ইমার্জেন্সী?”
“সেটা তো বলেনি। আমি জিজ্ঞেস করলাম আঙ্কেল-আন্টির শরীর ঠিক আছে কিনা। ভাবি বলল, তেমন কিছু না। অন্য কারণে ডেকেছে।”
বিশ্বাস করতে পারছে না শাফকাত। সে খুব ভালো করেই জানে সাবার ট্রমা তাকে ওই বাড়িতে পা রাখতে দেয় না। কী এমন ইমার্জেন্সী হলো যে সাবা হুট করে ছুটে গেছে সেখানে। তেমন গুরুতর কিছু হলে তো এতক্ষণে খবর চলে আসতো তার কানে।
বিশ্বাস হচ্ছে না মেয়েটাকে। মন বলছে সাবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। না, সে সন্দেহ করছে না সাবাকে। তবে মেয়েটাকে এতদিনে খুব ভালো করেই চিনে গেছে সে। সেজন্যেই এই চিন্তাগুলোকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না।
শামা আবারও বলল, “ভাবি বলে গেছে, সে যে ওই বাড়িতে গেছে এটা যেন তোমাকে জানিয়ে দিই। আমি তো রাতে বেশ কয়েকবার তোমাকে ফোনও করলাম, তুমিই রিসিভ করলে না…”
শামাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে শাফকাত ডায়াল করলো ড্রাইভারের নম্বরে। ব্যস্ত স্বরে বলল, “গাড়ি বের করো!”
শাফকাত ফোন কাটতেই আতিয়া আলম অবাক গলায় বললেন, “তুই এখন ওই বাড়িতে যাবি?”
মায়ের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করলো না শাফকাত। আতিয়া আলম আহত এবং আক্ষেপজড়িত কণ্ঠে বললেন, “দিন দিন বড্ড বেয়াদব হয়ে যাচ্ছিস শাফকাত! প্রশ্নের জবাব দে আমার!”
শাফকাত একরাশ গাম্ভীর্য গলায় জড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ যাবো।”
শাফকাত ঘুরে দাঁড়িয়ে মূল দরজার দিকে পা বাড়াবে, ঠিক তখনই দেখতে পেলো সেই মানুষটাকে – যাকে দেখার জন্যে এত অস্থিরতা, এত উৎকণ্ঠা। সাবাকে দেখেই উত্তপ্ত হৃদয়টা মুহূর্তেই শান্ত হয়ে উঠলো। মেয়েটা সত্যিই জাদু জানে। জাদুর বলেই তো এলোমেলো করে দিয়েছে এই দৃঢ় পুরুষটিকে।
সাবার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালের ওপর পড়েছে। সেদিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। চোখে একরাশ ঘুম। হয়তো তারও ঘুম হয়নি কাল সারা রাত।
শামা তাকে দেখে উৎফুল্ল গলায় বলল, “ভাবি চলে এসেছে!”
সাবা সকলের উদ্বিগ্ন চোখগুলোর দিকে দৃষ্টি একবার নিক্ষেপ করে বলল, “কী হয়েছে?”
“দেখো না ভাবি, তোমাকে বাড়িতে না পেয়ে ভাইয়া সারা বাড়ি মাথায় তুলছে।”
সাবা এবার সরাসরি তাকালো শাফকাতের দিকে। কোনো সংকোচ নেই, কোনো রাগ নেই। ভাবটা এমন যেন কালকের রাতটা কোনোদিন নেমেই আসেনি তাদের জীবনে।
শাফকাতকে উদ্দেশ্য করে সাবা নরম কণ্ঠে বলল, “ওহ্! আমি তো মায়ের কাছে গিয়েছিলাম।”
এই কণ্ঠে যেন আরেকটু গলে গেল পাথরের ন্যায় দৃঢ় শাফকাত। উফ! কেন যে এই মেয়েটাকে বারবার কষ্ট দেয় সে? এবার থেকে কড়া শাসনের মাঝে রাখতে হবে নিজেকে। কিছুতেই কষ্ট দেওয়া যাবে আর মেয়েটাকে।
সাবা শামার। দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমাকে তো বলেও গেলাম শামা। তুমি জানাওনি?”
শামা অভিযোগের সুরে বলল, “জানালাম তো ভাবি। আমার কোনো কথা ভাইয়া শুনতেই চাচ্ছে না!”
আতিয়া আলম উঠে দাঁড়িয়ে চিন্তিত গলায় বললেন, “সব ঠিক আছে তো সাবা? হুট করে অত রাতে চলে গেলে…”
সাবা বিন্দুমাত্র দেরি না করে বলল, “আসলে মা আমাকে নিয়ে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছিল। তাই হঠাৎ আমাকে দেখতে চাচ্ছিল।”
আতিয়া আলম এবং শামার চোখেমুখে বিস্ময় আর উদ্বেগ ফুটে উঠলেও সেসবের লেশমাত্র নেই শাফকাতের মাঝে। তার মাঝে যা সাবা দেখতে পাচ্ছে, তা কেবলই অবিশ্বাস।
কথাটা তাকে বিশ্বাস করানোর জন্যেই সাবা আবারও ধীরে ধীরে বলল, “আসলে ভাইয়া… ভাইয়া চলে যাওয়ার পর মা আমাকে নিয়ে খুব ভয়ে থাকে তো।”
আতিয়া আলম আঁতকে উঠে বললেন, “সে কী? ভাবি এখন ঠিক আছে? দাঁড়াও তো, আমি একটা ফোন করি!”
সাবা তড়িৎ গতিতে বলল, “না, না মা! এখন ফোন করবেন না প্লিজ। সারা রাত ঘুমোয়নি, ডক্টর একটু আগে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম দিয়েছে। এখন ঘুমোচ্ছে।”
“আজকের দিনটা তুমি ভাবির কাছে থেকে গেলেই পারতে সাবা।”
সাবা প্রকাশ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আড়চোখে একবার শাফকাতের দিকে তাকিয়ে আবারও দৃষ্টি শ্বাশুড়ির দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলল, “সেই সুযোগ কি আমার আছে মা? এক রাতের জন্যে মায়ের কাছে গিয়েছি, তাই নিয়ে ইতোমধ্যে আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়ে গেছে। পুরোটা দিন থেকে গেলে না জানি কী হতো!”
নিজের ঘরে এসে দরজাটা বন্ধ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সাবা। জোর বাঁচা বেঁচেছে সে। ভেবেছিল শাফকাত বাড়ি ফেরার আগেই ফিরে আসবে সে। তা আর হলো কই? নতুন মোবাইলটা কিনতে কিনতে দেরি হয়ে গেল। জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া নতুন একটা সিম কিনতে গিয়ে আরও দেরি হয়ে গেল।
সব জায়গায় এভাবে সিম কেনা যায় না। অস্থায়ী কতগুলো দোকান থেকে চড়া দামে কিনতে হয় এগুলো। ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করলো সাবা। মোবাইলটা বন্ধই ছিল। বন্ধ মোবাইলে সিম ঢুকিয়ে আলমারিতে নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে রাখলো। এই মোবাইল বাড়িতে ব্যবহার করা যাবে না। সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করবে এবার সাবা। কিছুতেই ধরা পড়বে না শাফকাতের হাতে।
(চলবে)