লেবু পর্ব-৩১+৩২+৩৩

0
3

#লেবু
৩১
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

নিস্তব্ধ রাস্তায় গাড়ি চলছে। যতদূর চোখ যায়, জনমানবের দেখা মেলে না। রাস্তার ডানপাশে অর্ধনির্মিত কতগুলো বিল্ডিং। বামপাশে কাশবন। গাড়িটা ফাহিমের। মেইন রোডে না-কি আজ প্রচুর যানজট। তাই শর্টকাট হিসেবে এই রাস্তাটা বেছে নেওয়া।

সাবার বুক টিপটিপ করছে। গাড়িতে এসি চলছে, তবুও ঘামছে মেয়েটা। কাঙ্ক্ষিত মুক্ত জীবন কিছুক্ষণের দূরত্বে মাত্র। এই জীবনের আঁচ এখন থেকেই স্পর্শ করছে তাকে। বন্য উচ্ছ্বাসে ভেসে বেড়ানো উচিত তার। উচ্ছ্বাস আছে বটে, তবে সেই সঙ্গে আছে ভয়। দেশ ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে না। আচ্ছা, দেশ ত্যাগ করার পরও কী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে সে? শাফকাত তো সবটাই জানতে পারবে। সাবা কোথায় গেছে, কীভাবে গেছে। আবারও যদি ধরে এনে অদৃশ্য ওই খাঁচায় বন্দী করে ফেলে তাকে?

কোলের ওপরে থাকা লেদারের ব্যাকপ্যাকটা শক্ত করে চেপে ধরলো সাবা। না, না! নেতিবাচক ভাবলেই নেতিবাচক হয়। শাফকাতকে নিয়ে আর ভাববে না সাবা। কিছুতেই না। তার ভাবনায় কেবলই স্থান পাবে, সামনে পড়ে থাকা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।

জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো সাবা। আশেপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাস্তায় কোনো ল্যাম্পপোস্টও নেই। কতক্ষণে তারা এয়ারপোর্টে পৌঁছায় কে জানে!

এভাবে পালিয়ে যেতে তার খারাপ যে লাগছে না তা নয়। মা-বাবাকে কিছুই বলে আসতে পারলো না। শাফকাতের কাছ থেকে বিয়ের পর থেকে মানসিক যন্ত্রণা পেয়ে আসলেও তার শাশুড়ি আর ননদের কাছ থেকে অমায়িক ভালোবাসা পেয়েছে। তাদেরও কিছুই বলা হলো না। প্রাণের প্রিয় বান্ধবী অরুণের সঙ্গে তো যাওয়ার আগে শেষবারের মতো দেখাও করতে পারলো না। অরুণ গেছে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে কক্সবাজারে বেড়াতে। তাকে এসব কিছুই জানায়নি সাবা।

কাছের মানুষগুলোকে দূরে সরিয়ে দিতে হলো শুধু মাত্র ওই একটা মানুষের জন্যে। তার জীবনটাকে এভাবে তছনছ করে দিয়ে কী আনন্দ পেলো শাফকাত?
তছনছ হয়ে গেলেও আবারও নতুন করে গড়ে নেবে সাবা। বিদেশের মাটিতে তার নতুন জীবনে থাকবে ঔজ্জ্বল্যের ছড়াছড়ি!

গাড়িটা হঠাৎ থেমে গেল। ফাহিম কয়েকবার স্টার্ট দেওয়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু গাড়ি স্টার্ট নিলো না।

সাবা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “কী হলো?”

ফাহিম শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “দাঁড়াও নেমে দেখছি।”

ফাহিম গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির হুড ওপরে তুলে কী যেন নাড়াচাড়া করছে। বিরক্তিতে গা জ্বলে গেল সাবার। আগেই ফাহিমকে বলেছিল এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্যে নিজেদের গাড়ি ব্যবহার না করে, সিএনজি বা উবার ব্যবহার করতে।

ফাহিমই জোর দিয়ে বলেছিল, “আমার গাড়ি থাকতে আমরা সিএনজিতে করে এয়ারপোর্টে যাবো?”

ভাবটা এমন যেন এই দুনিয়ায় গাড়ি তার একারই আছে! ফাহিমের ওপর বিরক্ত হতে গিয়েও হতে পারলো না সাবা। অতীতের তিক্ততা ভুলে ছেলেটা যে তার এত বড় উপকার করেছে তাই অনেক।
ফাহিম গাড়ির হুড নামিয়ে রেখে সাবার জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়ে সামান্য ঝুঁকে বলল, “ইঞ্জিনে সমস্যা।”

সাবার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। তার জীবনে পদে পদে কেবল বিপদ! এখান থেকে এয়ারপোর্ট না জানি কতদূরের রাস্তা।

শুকনো ঢোক গিলে সাবা বলল, “এখন?”

ফাহিম ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল , “চলো হাঁটা শুরু করি। সামনে কিছু না কিছু পেয়ে যাবো।”

“আর গাড়ি?”

“বাসায় ড্রাইভারকে জানাচ্ছি, এসে নিয়ে যাবে। ওর কাছেও চাবি আছে।”

সাবা গাড়ি থেকে নামতে নামতে বিরক্ত গলায় বলল, “তোমার গাড়ি নষ্ট হওয়ার আর সময় পেলো না!”

ব্যাকপ্যাকটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিলো সাবা। গয়না-গাটিসহ তার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো এর মধ্যেই রয়েছে। বাড়ি থেকে পুরোনো বসের বাড়িতে যাওয়ার কথা বলে বেরিয়েছে। তার বাড়িতে নিশ্চয়ই স্যুটকেস নিয়ে যাওয়া যায় না।

আফসানা করিমের বাড়িতে সাবা চলেও গিয়েছিল। শাফকাতের নিয়োগ করা ড্রাইভার এবং বডিগার্ডও ছিল সঙ্গে। বাড়ির সামনে নেমে সাবা তাদেরকে কোথাও গিয়ে চা খেয়ে আসার জন্যে বলে। আফসানার ফ্ল্যাটে না গিয়ে বাড়ির গ্যারেজে কতক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে সাবা। তারা চা খেতে চলেও যায়। ওই ফাঁকে ফাহিম চলে আসে বাড়ির সামনে। চোখের পলকে গাড়িতে উঠে যায় সাবা।

কাশবন ঘেঁষে পাশাপাশি হাঁটছে দুজনে। দুহাতে ব্যাকপ্যাকের বেল্ট শক্ত করে চেপে ধরেছে সাবা। অচেনা অদৃশ্য শীতল একটা হাওয়া বয়ে গেল তার শিরদাঁড়া বেয়ে। নিজের মুখটা সে দেখতে পাচ্ছে না ঠিকই, তবে নিশ্চিতভাবে বলতে পারে তার চোখমুখ রক্তশূন্য হয়ে উঠেছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে একটু পর পর।

আচমকা এই ভয়ের দমকা হাওয়া এলো কোত্থেকে? ভয়ের কী-ই বা আছে? একটু পরেই তারা রিকশা বা সিএনজি পেয়ে যাবে। সেটা নিয়ে সোজা এয়ারপোর্ট। মনে মনে নিজেকে নিজেই অভয় দেওয়ার চেষ্টা করলো সাবা।

হয়ত ভয়টা এই থমথমে গুমোট পরিবেশের কারণে। দূরে কয়েকটা কাক কর্কশ সুরে গলা ফাটাচ্ছে। সেই শব্দও এই মুহূর্তে ভীতিকর ঠেকছে সাবার কাছে।

কথা বললে হয়ত অহেতুক এই ভয় কাটবে। নীরবতা ভঙ্গ করে সাবা তাই বলল, “তুমি না বলেছিলে ফ্লাইটের আগে জুয়েলারিগুলো তোমাকে দিতে।”

ফাহিম শীতল গলায় বলল, “আপাতত তোমার কাছেই রাখো। সময় হলে আমি নিয়ে নেবো।”

অবাক লাগলো সাবার। অন্যরকম লাগলো ফাহিমের কণ্ঠস্বর। মনে হলো যেন এই মানুষটার কণ্ঠ আগে কখনো শোনেনি সে, আজই প্রথম শুনছে।

চারপাশে চোখ বোলালো সাবা। বেশ দূরে কয়েকটা দোকানপাট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কোনো মানুষের দেখা মিলছে না। হয়তো ওগুলো বন্ধ।

সাবা চিন্তিত গলায় বলল, “ফাহিম, আমার মনে হয় না এখানে কিছু পাওয়া যাবে। আমরা…”

সাবাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ফাহিম অন্যরকম গলায় বলল, “আচ্ছা সাবা? একটা প্রশ্নের উত্তর দেবে?”

তার প্রশ্নের উত্তর দিলো না সাবা। মস্তিষ্ক অন্য এক চিন্তায় জর্জরিত হয়ে গেল মুহূর্তেই। আবারও অন্যরকম লাগলো ফাহিমের গলাটা। এ যেন তার চেনা মানুষের চেনা কণ্ঠস্বর নয়, অচেনা কারও কণ্ঠ। ফাহিম বেশ দ্রুত হাঁটছে। তার সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যর্থ হচ্ছে সাবা। ফলে কিছুটা পিছিয়ে পড়লো।

ফাহিম হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো। সাবার থেকে কিছুটা দূরে, তার মুখোমুখি। সাবার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। সেও দাঁড়িয়ে পড়লো। হিমবাহের মতো জমে গেল তার সারা শরীর।
দূরের ওই দোকানগুলো থেকে আসা আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছে ফাহিমের মুখটা। তাতেও সাবা দেখলো তার রক্তিম চোখ দুটো।

প্রশ্ন করার অনুমতি না পেয়েও প্রশ্নটা করেই ফেলল ফাহিম, “তুমি তো যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে ছিলে সাবা। ইউনিভার্সিটিতে থাকতে কেমন হিরোর মতো আমাকে ধরেছিলে বাপ রে বাপ! সেই তোমার হঠাৎ কী হয়ে গেল?”

সাবার নিঃশ্বাস আটকে যাওয়ার উপক্রম। বেশ বুঝতে পারছে, ভুল করে ফেলেছে সে। বিরাট বড় ভুল। এখন সে কী করবে? ছুটে পালাবে? কিন্তু তার দেহে যে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই। কেউ যেন আঠা দিয়ে তার পায়ের জুতো দুটো মাটির সঙ্গে লাগিয়ে রেখেছে।

সাবা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “মানে?”

ফাহিম বাঁকা হাসি হেসে বলল, “মানে সেই বুদ্ধিরা সব তোমাকে টাটা বাই বাই বলে কোথায় চলে গেল?”

সাবার মনে হলো ফাহিম তার সঙ্গে মজা করছে, ঠাট্টা করছে, ভয় দেখাচ্ছে। আবার পরমুহূর্তেই মনে হলো, খুব খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে তার সঙ্গে। খুব খারাপ।

ফাহিম এক পা এক পা করে সাবার দিকে এগিয়ে এসে বলল, “বিয়ে হয়েছে এক বছরও হয়নি, মানলাম। কিন্তু যতদিন গেছে, তাতে তোমার বোঝা উচিত ছিল – যার সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়েছে সে কতটা ভয়ংকর, কতটা ক্ষমতাবান। তুমি একটা বাড়তি নিঃশ্বাস ফেললেও খবর চলে যায় শাফকাত আলমের কাছে। আর এদিকে বিদেশে তোমার চাকরি হলো, ভিসা হলো, প্লেনের টিকেট কাটা হলো আর সে কিছুই জানলো না? এটা কী করে হলো?”
কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে সাবার। তবুও প্রাণপণ চেষ্টা করে ক্ষীণ গলায় বলল, “কারণ…”

অস্বাভাবিকভাবে কাঁপতে শুরু করলো তার সারা শরীর। গলা থেকে স্বর বের হবার আর কোনো সুযোগই নেই।

ফাহিম আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “বলো সাবা, ভয়ের কী আছে?”

সাবা কম্পিত স্বরে বলল, “কারণ আমি সতর্ক ছিলাম।”

আচমকা হো হো করে হেসে উঠলো ফাহিম। সে হাসি আত্মা কাঁপিয়ে দিলো সাবার। কেঁপে উঠলো যেন সন্ধ্যার আকাশটাও।

হাসি থামানোর কোন প্রকার চেষ্টা না করে ফাহিম বলল, “তোমার সতর্কতা কী? অন্য বাড়িতে বসে ইন্টারভিউ দেওয়া, নতুন ই-মেইল অ্যাড্রেস দিয়ে বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা? তুমি তো এত বড় সাংবাদিক। তুমিই বলো, এসবে আদৌ কি কোনো কাজ হয়?”

পরপর কয়েকবার ঢোক গিললো সাবা। নিজের নেওয়া সতর্ক পদক্ষেপগুলোর ওপর তার সন্দেহ ছিল বটে। তবে ফাহিম আজ তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার পর সত্যিই মনে হচ্ছে, এসব সতর্কতায় আদৌ কোনো কাজ হয় না।

ফাহিম ঠোঁটে নাটকীয় হাসি টেনে বলল, “সত্যিই যদি তোমার চাকরি হতো, অস্ট্রেলিয়ার পত্রিকা থেকেই খবর চলে আসতো শাফকাত আলমের কাছে। ভিসা হলে অফিস থেকেই খবর পেতো। তোমার ই-মেইল ট্র্যাক করার প্রয়োজন এতে পড়তো না।”

সাবা অস্ফুটস্বরে বলল, “সত্যিই… সত্যিই মানে?”

“তুমি যার কাছে অনলাইনে ইন্টারভিউ দিয়েছো, সে অস্ট্রেলিয়ায় আমার পাশের বাড়িতেই থাকে। লোকটার নাম ডেভ। বেচারাকে দুটো বিয়ারের অফার দিতেই রাজি হয়ে গেল।”

আকাশ থেকে পড়লো সাবা। বিস্ময় তার চোখে মুখে তড়িৎ গতিতে খেলে বেড়াচ্ছে।

বিস্মিত গলায় সাবা বলল, “মানে কী? আমি তো…”

ফাহিম আবারও তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে নাটকীয় হাসিটা বজায় রেখে বলল, “কনফারমেশন লেটার পেয়েছো? ওটা আমিই বানিয়ে এনেছি নীলক্ষেত থেকে।”

সাবা আতঙ্কিত গলায় বলল, “কিন্তু… কিন্তু ভিসা তো মিথ্যা হতে পারে না। আমি নিজে গিয়েছিলাম ইন্টারভিউ দিতে!”

আবারও শুরু হলো আত্মা কাঁপিয়ে তুলবার মতো ফাহিমের সে হাসি। হাসিটা যেন একটু একটু করে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলছে সাবাকে।
তার শরীর থেকে সবটুকু প্রাণ যেন শুষে নিচ্ছে সে হাসি। সাবা আতঙ্কে এত জোড়ে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে রেখেছে যে, রক্তের তামাটে স্বাদে তার গা গুলিয়ে উঠলো।

ফাহিম কোন মতে হাসি থামিয়ে বলল, “তোমার পুরো জীবনটাই মিথ্যা সাবা। তোমার ভিসার অ্যাপ্লিকেশনই করিনি আমি কখনো। তোমার ভিসার জন্যে অ্যাপ্লাই করা হবে আর শাফকাত আলম জানবে না, এটা হতে পারে?”

নিজের চুল নিজেরই ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে সাবার। নিজেকে বড্ড বুদ্ধিমতী মনে করতো সে। আসলে সে বোকার হদ্দ। মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় তার মাথাটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বোধ-বুদ্ধি সব লোপ পেয়েছিল। ফাহিমকে মনে হয়েছিল মুক্তির একমাত্র পথ প্রদর্শক। তাই তো সে যা বলেছে, অন্ধের মতো বিশ্বাস করে গেছে সাবা।

ফাহিম আবারও বলল, “আর যার কাছে ভিসার ইন্টারভিউ দিয়েছে, সে আমার আপন মামা। তাকে বেশি কিছু বুঝিয়ে বলতেও হয়নি, এক বাক্যে রাজি হয়ে গেছে তোমার সঙ্গে ইন্টারভিউয়ের অভিনয় করতে। তোমার ভিসা, প্লেনের টিকেট সবই নকল!”

সাবার চোখ দুটো ঝাপছা হয়ে উঠলো। ফাহিমের বিশ্বাসঘাতকতার জন্যে নয়। নিজের বন্দী দশার কথা ভেবে। মুক্তি আর পাওয়া হলো না তার। ফাহিম তো নির্ঘাত এই গয়নাগুলো নিয়ে পালিয়ে যাবে তাকে নিস্তব্ধ রাস্তায় ফেলে।

ওদিকে সাবা তার ঘরের ড্রেসিং টেবিলে পেপার ওয়েট দিয়ে চাপা দিয়ে এসেছে একটা দুই লাইনের চিরকুট। তার মুক্তোর মতো গোটা গোটা হাতের লেখায় সেখানে লেখা, “আমি বহু দূরে চলে যাচ্ছি। আমাকে খোঁজার চেষ্টা করবেন না প্লিজ।”

নিশ্চয়ই সে চিরকুট বাড়ির কারও হাতে পৌঁছে যাবে। সাবাকে খোঁজার তোড়জোড়ও শুরু হয়ে যাবে। শাফকাতের কানের নির্ঘাত খবর পৌঁছে যাবে। এই পরিস্থিতিতে সে যদি আবারও বাড়িতে ফিরে যায়, তাহলে সবাই জেনে যাবে সাবা পালানোর চেষ্টায় করেছিল। এবার নেহায়েত সত্যিকারের খাঁচায় বন্দী করে রাখবে তাকে শাফকাত।

সাবা বিড়বিড় করে বলল, “কেন করলে এসব ফাহিম?”

ফাহিম তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “কী ভেবেছিলে সাবা? আমি সব ভুলে গেছি?”

চমকে উঠে সাবা তাকালো তার দিকে।

ফাহিম আক্ষেপের সুরে বলল, “নিজের হাতে আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছো তুমি। একবারও হাত কাঁপেনি তোমার। যে আঘাত তুমি আমাকে দিয়েছো তার ঘা আজ পর্যন্ত শুকাতে পারিনি।”

হিরো হওয়ার খুব শখ না তোমার? তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম আমি সাবা! ভালোও বাসতে শুরু করেছিলাম। ভেবেছিলাম আমার বিপদে আর কাউকে না হোক তোমাকে পাশে পাবো। আমার ভালো যদি চাইতেই, তাহলে ঢালাও করে সবাইকে জানাতে না যে আমি ড্রা/গ অ্যাডিক্ট!”

বিস্ময়ে পিলে চমকে উঠলো সাবার। স্বপ্নেও সে ভাবতে পারেনি পুরোনো ঘটনার ঝাঁঝ এখনো অটুট থাকবে ফাহিমের মাঝে। তার মানে শুরু থেকেই সে অভিনয় করে আসছিল? সুযোগ খুঁজছিল সাবাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়ার?

ফাহিম ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “একটা বছর! একটা বছর হারিয়ে গেল আমার জীবন থেকে। ইউনিভার্সিটিতে একটা দিনও আমি শান্তিতে কাটাতে পারিনি। কোনো করিডোর দিয়ে হেঁটে গেলেই মানুষ আমার দিকে আঙুল তাক করে হাসাহাসি করে, বাঁকা চোখে তাকায়। সমাজে কেউ আমাকে সম্মান দেয়নি। যেখানেই যাই, সেখানেই সকলে আমাকে মানুষ মনে করার আগে মনে করে ড্রা/গ অ্যাডিক্ট। দেশে চাকরিও পেলাম না শেষমেশ! সব তোমার কারণে।”

সাবা অস্পষ্ট গলায় বলল, “সেজন্যেই শোধ তুললে?”

স্ফীত হাসি হেসে ফাহিম বলল, “শোধ এখনো তুলিনি তো! এখন তুলবো।”

সাবা আর কিছুই বুঝে ওঠার সুযোগ পেলো না। তার আগেই তার সঙ্গে যা ঘটলো, তা দুঃস্বপ্নে স্থান পাওয়ারও যোগ্য নয়। তড়িৎ গতিতে কোমরে গুঁজে পিস্তল বের করলো ফাহিম। সাবার দিকে তাক করে নিমিষেই গুলি করলো। বিকট শব্দে ভারী হয়ে উঠলো চারপাশ। কাকেরা দ্বিগুণ কর্কশ সুরে ডাকাডাকি শুরু করলো।

চোখের পলকে একটা গুলি লাগলো সাবার বুকের খানিক নিচে। অঝোরে র/ক্ত গড়িয়ে পড়ছে। যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে গুলিবিদ্ধ স্থান চেপে ধরলো সাবা।

তাকে দম নেওয়ার সুযোগ তার দিলো কই ফাহিম? আবারও আরেকটা গুলি এসে লাগলো তার গায়ে। মাটিতে লুটিয়ে পড়লো সাবা। র/ক্ত চারপাশ ভিজে যাচ্ছে। ভিজে যাচ্ছে সাবা নিজেও।

টের পেলো ফাহিম তার কাছে এনে ধীরে সুস্থে কাঁধ থেকে ব্যাকপ্যাকটা ছাড়িয়ে নিলো।

কানের কাঁধে ফিসফিস করে বলল, “Rest in peace, Saba Amir!”

ফাহিমের জুতোর শব্দ এলো সাবার কানে। দৃষ্টি ক্রমেই ঘোলাটে হয়ে গেল। নিঃশ্বাস নিভে যাওয়ার উপক্রম। একটু একটু করে চোখ দুটো বুজে গেল তার।

(চলবে)

#লেবু
৩২
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

দিনটা যে শেষ হবে ভাবতেই পারেনি শাফকাত। ব্যস্ততায় আচ্ছন্ন থাকা সত্ত্বেও দিনটাকে অতিরিক্ত দীর্ঘ বলে মনে হয়েছে তার। এর কারণও অবশ্য অগ্রাহ্য করার মতো নয়। গত রাতে তিন ঘণ্টা মাত্র ঘুমিয়েছে সে। গোটা রাতটা কাটিয়ে দিয়েছে কাঙ্ক্ষিত বিজনেস ডিলের কাগজ-পত্র, পরিসংখ্যান-ফলাফল জহুরি দৃষ্টিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে।

আজ পুরোটা দিন কেটেছে কলকাতার নিউ টাউনে ‘ট্রাভিস ব্যাংক’র অফিসে। ডিলটা ক্লোজ হলে এই ব্যাংকের সাইবার নিরাপত্তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব পাবে শাফকাতের ‘Infinite Safety’।

দিনভর দুপক্ষের মিটিং চললো। একের পর এক প্রজেক্ট উপস্থাপিত হলো প্রজেক্টরে। অবশেষে ডিলটা পেয়েই গেল শাফকাত। ডিল সাইন করেও কোন প্রকার উচ্ছ্বাস তার মাঝে নেই। বরং ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে। এমনটা সচরাচর হয় না। হাজার পরিশ্রমের পরও ক্লান্তি গ্রাস করতে পারে না তাকে। আজ না জানি কী হলো?

হোটেলে ফিরেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো শাফকাত। সবে মিনিট দশেক হয়েছিল ঘুমের রাজ্যে হারিয়েছে সে। হঠাৎ তীক্ষ্ণ একটা শব্দ সেই জগৎ থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনলো তাকে। ফোনের রিংটোনের শব্দ। বিরক্তিতে গা জ্বলে উঠলো শাফকাতের। কেন যে ফোনটা সাইলেন্ট করে ঘুমালো না!

উল্টো করে রাখা ফোন হাতে নিয়েই দেখলো স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে মায়ের নাম। আরেকদফা বিরক্তিতে গা ভাসালো শাফায়েত। আতিয়া আলম এই মুহূর্তে নির্ঘাত “কী করছিস?” “খেয়েছিস?” জাতীয় প্রশ্ন করার জন্যে ফোন করেছেন!

তবুও ফোনটা রিসিভ করলো শাফকাত। ঘুম জড়ানো বিরক্তি মাখা গলায় বলল, “কী ব্যাপার মা?”

আতিয়া আলমের কণ্ঠ শুনে মনে হলো না হালকা ধরনের কোনো প্রশ্ন করার জন্যে ফোন করেছেন তিনি। তার কণ্ঠে একরাশ আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা।

“সর্বনাশ হয়ে গেছে বাবা!”

সতর্ক ভঙ্গিতে তৎক্ষণাৎ উঠে বসলো শাফকাত। ওদিকে কোনো একটা অঘটন যে ঘটেছে বুঝতে তার তীক্ষ্ণ মস্তিষ্কের সময় লাগলো না বিন্দুমাত্র। মায়ের কাছ থেকে ঘটনার বিস্তারিত শুনে পদক্ষেপ নিতে নিতে অনেক দেরি হয়ে যাবে।

বেডসাইড টেবিলে তার বিজনেসের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত আরেকটা ফোন। সেটা হাতে নিয়ে দ্রুত গতিতে খুঁজতে শুরু করলো বাড়ির সিকিউরিটি চিফ আরাফাতের নম্বর।

এদিকে আরেক হাতে ব্যক্তিগত ফোনটা ধরে রেখে চিন্তিত গলায় বলল, “কী হয়েছে মা?”

আতিয়া আলম কম্পিত গলায় বললেন, “সাবা…”

মুহূর্তেই থমকে গেল শাফকাতের চারপাশ। হৃদয়টা স্পন্দিত হতে ভুলে গেল। বুকের মধ্যে নিঃশ্বাস আটকে গেল। আরেকটা ফোন সিকিউরিটি চিফের সঙ্গে যোগাযোগ করতেও ভুলে গেল শাফকাত।

শঙ্কিত কিন্তু দৃঢ় গলায় শাফকাত বলল, “কী হয়েছে সাবার?”

আতিয়া আলম কান্না মাখা গলায় যা জানালেন তা শুনে শাফকাতের পায়ের নিচের মাটি আর মাথার ওপরের আকাশ, সবটাই শূন্যে মিলিয়ে গেল। হৃদয়টা কয়েক দফা বিচিত্র পাকে মোচড় দিয়ে উঠলো।

দুজন টহল পুলিশ এয়ারপোর্টের কাছাকাছি শুনশান এক এলাকায় খুঁজে পেয়েছে সাবাকে। গুলিবিদ্ধ, র/ক্তাক্ত সাবাকে। শাফকাতের কয়েক মুহূর্ত বিশ্বাস হলো না কথাগুলো। হয় সে ঘোরের মধ্যে আছে, না হয় মা ঠাট্টা করছে। সাবাকে কেউ… গুলি করেছে?

মায়ের বর্ণনা অনুযায়ী সাবাকে কল্পনা করার চেষ্টা করলো শাফকাত। নিস্তব্ধ এলাকায় রাস্তার ওপর পড়ে আছে সাবা। তার শরীরের মধ্যে বিঁধে রয়েছে দুটো গুলি। চারপাশ রক্তে ভিজে গেছে।

নিঃশ্বাস আটকে গেল শাফকাত। কল্পনার এই দৃশ্য তাকে মেরে ফেলতে উদ্যত হয়েছে। বাস্তবে সাবাকে ওই অবস্থায় দেখে কী করবে সে? এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না শাফকাতের। সাবাকে কেউ কেন গুলি করবে?

আতিয়া আলম আরও জানালেন তাকে কাছাকাছি একটা হসপিটালে ভর্তি করানো হয়েছে। সাবার সঙ্গে তার মোবাইল ছিল না। হসপিটালের এক নার্স তাকে দেখে চিনে ফেলেছে, সে বাংলার বাতাসের সাংবাদিক। হসপিটাল থেকে অফিসে যোগাযোগ করা হয়, অফিস থেকে বাড়িতে।

শাফকাতের মাথায় হাজারটা প্রশ্নের ঝড় তোলা উচিত। বাড়িত কড়া নিরাপত্তা থাকা সত্ত্বেও সাবা এয়ারপোর্টের কাছাকাছি গেল কী করে? সাবার অপদার্থ বডিগার্ড কোথায় ছিল? তার থেকেও বড় কথা, কে সাবাকে গুলি করলো?

কোনো প্রশ্নই স্পর্শ করতে পারলো না শাফকাতকে। আবারও কতগুলো অস্পষ্ট আবছা দৃশ্য ভেসে উঠলো তার কল্পনায়। সাবাকে কেউ গুলি করছে, র/ক্তে তার গা ভিজে যাচ্ছে, মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে সাবা। শিউরে উঠলো শাফকাত। তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।

শাফকাতের মতো দৃঢ় ব্যক্তিত্বের পুরুষ আজ কম্পিত স্বরে বলল, “মা… সাবা ঠিক আছে তো?”

প্রশ্নটা করতে করতেই গিয়ে দমবন্ধ হয়ে গেল তার। শ্বাস নিতে মারাত্মক কষ্ট হচ্ছে তার। সাবা ঠিক নেই, এ সত্য জানার পর কী করে স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নেয় শাফকাত?

আতিয়া আলমের কাছ থেকে প্রশ্নের উত্তর এলো কয়েক সেকেন্ড পর। এই কয়েক সেকেন্ডও যেন মৃ/ত্যুর মুখোমুখি এনে দাঁড় করালো। সাবার কিছু হয়ে গেল কী করবে শাফকাত? সে তো… আর কিছুই ভাবতে পারলো না শাফকাত। চোখেমুখে অন্ধকার দেখলো রীতিমত।

আতিয়া আলম দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে বললেন, “কিছুই বুঝতে পারছি না বাবা। তুই তাড়াতাড়ি চলে আয়।”

ক্লান্তিরা সব ছুটে পালালো শাফকাতের শরীর থেকে। হিমশীতল এক স্রোত একটু পর পর তার শিরদাঁড়া বেয়ে বয়ে যাচ্ছে। ফোন রেখে নিজেকে ধাতস্থ কয়েক মুহূর্ত সময় লাগলো তার। ভয়ানক রাগে গা জ্বলে ওঠার কথা তার। তার সাবাকে আঘাত করার দুঃসাহস যে করেছে তাকে নিশ্চিন্ত করার জন্যে হাতদুটো নিশপিশ করার কথা তার।

কিন্তু কোনো চিন্তায় তার মস্তিষ্কে জায়গা করে নিতে পারলো না। মস্তিষ্ক কেবল সাবায় আচ্ছন্ন। মেয়েটা ঠিক আছে তো? ওর কি খুব কষ্ট হচ্ছে? নির্ঘাত হচ্ছে! সাবাকে এক পলক দেখার তৃষ্ণায় চোখদুটো টনটন করছে।

শাফকাতের হঠাৎ মনে হলো কেউ যেন ধারালো ছু/রি দিয়ে তার হৃদয়টাকে আক্রমণ কয়েছে। সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কয়েক হাজার টুকরোয় কেটে ফেলেছে। ওই হৃদয়ে তো সাবার স্থায়ী বসবাস। মেয়েটার কিছু হয়ে গেলে সে স্বাভাবিক থাকে কী করে?

এক ঘন্টা আর কয়েকটা ফোন কল পর জরুরি ভিত্তিতে ফ্লাইটের টিকেট জোগাড় করে ফেলল শাফকাত। রাত একটার ফ্লাইট। এখনো তিন ঘন্টার অপেক্ষায়। একেকটা মুহূর্ত যেন একেক বছরের সমান।

আতিয়া আলম ফোন করে জানালেন, সাবার অবস্থা ভালো নয়। তাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ডক্টর বলেছেন, সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে। আবারও মোচড় দিয়ে উঠলো শাফকাতের বুকের ভেতরটা। এই পৃথিবীর সব বিপর্যয়কে মোকাবেলা করতে প্রস্তুত সে। কেবল এই মেয়েটাকে হারানো বাদে।

চোখেমুখে ঘোর অন্ধকার দেখছে শাফকাত। অনুতাপ, আক্ষেপ, রাগ সব একসঙ্গে এসে আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়ে ধরলো তাকে। বিয়ের পর থেকে সাবাকে ডমিনেট করার অনুতাপ, তার আপত্তি সত্ত্বেও তার কর্মকান্ডের ওপরে নজর রাখার অনুতাপ, তার গায়ে হাত তোলার অনুতাপ। সাবাকে নিজের অজান্তেই যে কতটা ভালোবাসে ফেলেছে, তা না জানানোর আক্ষেপ। অনুতাপে-আক্ষেপে একাকার হয়ে গেলেও রাগ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারছে না শাফকাত। যে জানোয়ারই এই কাজ করে থাকুক না, তাকে শাফকাত ছাড়বে না।

শাফকাতের একটা ফোন কলে ঢাকার সেরা সার্জন পৌঁছে গেলেন সাবা যে হসপিটালে আছে। শাফকাতের বাড়ি এবং অফিসের নিরাপত্তায় কাজ করে একাধিক সিকিউরিটি টিম। তাদের মধ্যে সবথেকে দক্ষতাসম্পন্ন
টিমকে কল করে শাফকাত নির্দেশ দিলো হসপিটালের নিরাপত্তা বাড়িয়ে দেওয়ার জন্যে। ওদিকে আরেকটা টিমকে নির্দেশ দেওয়া হলো সাবার ঘর আর পুরোনো অফিসে তার ব্যবহৃত কম্পিউটার-ল্যাপটপ ভালো করে সার্চ করার জন্যে।

ফ্লাইট সময়মতো ছাড়লো ঢাকার উদ্দেশ্যে। শাফকাত ঢাকায় এসে নামলো একটা চৌত্রিশ মিনিটে। বিজনেস ক্লাস টিকেট থাকায় ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা সারতে খুব একটা সময় লাগলো না।

কলকাতা থেকে ঢাকায় পৌঁছাবার সময়টুকু যে শাফকাত কীভাবে পাড় করলো, তার নিজেরও জানা নেই। প্রত্যেকটা নিঃশ্বাসের সঙ্গে একটু একটু করে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠছে। বুকের ওপর কেউ যেন পাথর চেপে ধরে রেখেছে। পাথরটার কারণে স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসে ব্যাঘাত ঘটছে।

হসপিটালে পা রাখতেই থমথমে একটা আবহাওয়ার আভাস পেলো শাফকাত। অপারেশন থিয়েটারের বাইরের হলওয়েতে শঙ্কিত মুখে বসে আছেন আতিয়া আলম। তার চোখদুটো বেয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরছে। তাকে সান্ত্বনা দিতে ব্যস্ত শামা। সাবার বাবা-মাও ইতোমধ্যে এসে পড়েছেন।

সকলকে এড়িয়ে উদ্বিগ্ন পায়ে অপারেশন থিয়েটারের দিকে এগিয়ে গেল শাফকাত। দরজার মধ্যিখানে ছোট্ট কাঁচের জানালা ভেদ করে যে দৃশ্যটা দেখলো, তা সোজা এসে আঘাত করলো তার বুকে। ক্ষ/ত-বিক্ষ/ত করে ফেলল তার হৃদয়টা।

অপারেশন থিয়েটারের বিশাল বেডে আলগোছে পড়ে আছে সাবার ছোট নিথর দেহটা। মুখে অক্সিজেন মাস্ক, শরীরের সঙ্গে না জানি কতগুলো তার জুড়ে দেওয়া।

এ জীবনে নিজেকে কখনো এতটা অসহায় লাগেনি শাফকাতের। পরাজয় তার স্বভাবে নেই। সে যা চায়, তাই চলে আসে তার হাতের মুঠোয়। তবে এই প্রথম সাবাকে হারানোর ভয়ে তার বুক কেঁপে উঠলো।

এই মেয়েটাকে হারাতে পারবে না সে, কোনোভাবেই সেটা সম্ভব নয় তার পক্ষে। সাবাকে হারাতে পারবে না বলেই তো মেয়েটার অনিচ্ছা সত্ত্বেও জোর করে বিয়েটা টিকিয়ে রাখলো এতদিন। নিজেকে সাবার চোখের বিষ বানিয়ে নজরদারি করলো সর্বক্ষণ তার ওপরে।

মেয়েটা এভাবে তার কাছ থেকে চলে যাবে? আজ পর্যন্ত না জানি কত শত কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন সে হয়েছে। তবে ভেঙে পড়েনি কখনো। তবে আজ স্রোতে বিপরীত দিকে বহমান। আজ শাফকাতের মনে হলো এই দৃশ্যটা দেখার থেকে হাসিমুখে মৃ/ত্যুকে আলিঙ্গন করা অধিকতর সহজ।

হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলল শাফকাত। নিজের চোখদুটোকে সে দেখতে পাচ্ছে না ঠিকই, তবে শতভাগ নিশ্চিত সে চোখদুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। এখনো সে জানে না সাবার এই পরিণতি কে করেছে। যেই করুক না কেন, তাকে খুঁজে বের করবে শাফকাত। তা সে মাটির নিচে লুকিয়ে থাকুক, আর সুদূর আকাশে। সাবা এই মুহূর্তে যতটা কষ্ট পাচ্ছে, তার থেকেও হাজারগুণ কষ্ট দেবে তাকে শাফকাত।

ডক্টর আফরোজা বেরিয়ে এলেন অপারেশন থিয়েটার থেকে। তিনিই এই সার্জারিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করছেন।

শাফকাতকে নিষ্প্রভ গলায় তিনি জানালেন, “শরীরে দুটো গুলি লেগেছে। একটা বুকের বেশ উপরের দিকে। কাঁধের কাছাকাছি। সেটা আমরা বের করতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু আরেকটা গুলি নিয়েই দুশ্চিন্তা।”

শাকফাত শুকনো ঢোক গিললো। তার গলা দিয়ে স্বর বের হতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। তবুও বহুকষ্টে বলল, “কেন? কী সমস্যা সেখানে?”

ডক্টর আফরোজা হতাশার সুরে বললেন, “আরেকটা গুলি লেগেছে লাঙ্গসের কাছাকাছি। গুলিটা লাঙ্গসেই লেগেছে কিনা বুঝতে পারছি না। যদি লাঙ্গসে গুলি লেগেই থাকে, তাহলে অনেক রিস্ক আছে।”

শাফকাত কী বলবে ভেবে পেলো না। এতক্ষণ নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছিল, এবার পুরোপুরি নিভে গেল।

“সাবার হার্টবিট খুবই কম। আমাদের হাতে সত্যিই সবটা নেই। আমি বলবো, আপনারা বারবার সৃষ্টিকর্তাকে ডাকুন।”

ডক্টর আফরোজার কথাগুলো শুনে কান্নায় ভেঙে পড়লেন ফাহমিদা বেগম।

কান্নারত গলাতেই তিনি বললেন, “শাফকাত? আমি কি আমার এই বাচ্চাটাকেও হারিয়ে ফেলবো?”

সুপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেললো শাফকাত। সাবাকে হারিয়ে ফেলার ভাবনা মস্তিষ্কে আনলেও যেন নিঃশেষ হয়ে যায় সে।

ফাহিমদা বেগম হলওয়ের বামপাশে থাকা চেয়ারে বসে ছিলেন। শাফকাত হাঁটু গেড়ে তার সামনে বসে পড়ে তার হাতদুটো শক্ত করে চেপে ধরে বলল, “সাবার কিচ্ছু হবে না। কোথাও হারিয়ে যাবে না ও। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি!”

মিনিট কয়েক পর শাফকাতের সামনে এসে দাঁড়ালো সিকিউরিটি এক্সপার্ট জয়া। বাড়িতে সাবার ঘরটা সার্চ করার জন্যে তার অধীনেই একটা টিমকে পাঠিয়েছিল শাফকাত।

জয়া এগিয়ে এসে ভদ্র গলায় বলল, “বস! ম্যামের রুম থেকে এটা পেয়েছি।”

সাবার লেখা সেই চিরকুট বাড়িয়ে দিলো শাফকাতের দিকে।

“আমি বহু দূরে চলে যাচ্ছি। আমাকে খোঁজার চেষ্টা করবেন না প্লিজ।”

কথাগুলো যেন এই মুহূর্তে, এই পরিস্থিতিতে সাবা বলছে। লেখাটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাগের বন্য হওয়া এসে ভাসিয়ে দিলো শাফকাতকে। এক নিমিষে সেই চিরকুট নিজের শক্ত হাতের মুঠোয় পুরে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলল সে।

(চলবে)

#লেবু
৩৩
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

মনটা অসম্ভব বিক্ষিপ্ত, তবুও দৃঢ়তার অভাব নেই শাফকাতের মাঝে। মনটা পড়ে আছে অপারেশন থিয়েটারে, তবুও নিজেকে টেনে নিয়ে এসেছে হসপিটালের এই মিটিং রুমে। সাবার অপারেশন ভয়ানক ক্রিটিক্যাল। দেশের নাম করা হসপিটাল থেকে আরও দুজন সার্জন ছুটে এসেছেন। সঙ্গে এসেছে সার্জারির জন্যে ব্যবহৃত সব থেকে আধুনিক যন্ত্রপাতিও।

অপারেশন থিয়েটারের বেডে পড়ে থাকা সাবার নিথর মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই শাফকাতের সারা শরীরে যেন আগুন ধরে গেল। অভিমান হলো প্রচুর মেয়েটার ওপরে। তার চিরকুট থেকে এটা পরিষ্কার, কোনো না কোনো কারণে বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল সাবা। পৃথিবীর কাছে কারণটা অজানা হলেও, তা জানে শাফকাত। কারণ তো সে নিজেই।

সেই বিয়ের দিন থেকে আজ অবধি তাকে সহ্য করার ক্ষমতা পেলোই না মেয়েটা। শাফকাত না হয় নিজের ভালোবাসাটা প্রকাশ করতে অপরাগ। কিন্তু সাবা তো কত বুদ্ধিমতী! সে একবারের জন্যেও বুঝতে পারবে না শাফকাতের মনের ভেতরটা?
অবশ্য এ ক্ষেত্রে সাবাকে দোষ দেওয়াও নেহায়েত বোকামি। মানুষের মাঝে অলৌকিক কোনো ক্ষমতা নেই। ভালোবাসার কথাটা মুখ ফুটে না বলে উল্টো বেপরোয়া আচরণ করলে, কী করবে বুঝবে সে ভালোবাসার গভীরতা?

বাড়িতে সাবার ক্লজেট ঘেঁটে বেশ কিছু ক্যাশমেমো খুঁজে পেয়েছে জয়া। সবগুলোই গয়না-গাটির দোকানের সাবার বডিগার্ডের কাছ থেকে খবর পেয়েছিল শাফকাত, সে প্রায়ই শপিং মলে গিয়ে দামী-দামী সব গয়না কিনছে। বিষয়টাকে তখন আমলে নেয়নি যে। ভেবেছিল এ আর এমন কী? মেয়েদের কাজই তো শপিং মলে গিয়ে সময় এবং অর্থ অপচয় করা!

কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমলে না নিয়ে বড্ড ভুল করে ফেলেছে শাফকাত। সব মিলিয়ে প্রায় দুই কোটি টাকার গয়না কিনছে সাবা। তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অবশিষ্ট আছে আর মাত্র সত্তর হাজার টাকা। তার মানে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি বেশ আগে থেকেই নেওয়া শুরু করেছিল সাবা।

সিকিউরিটি এক্সপার্টদের আরেকটা টিম গিয়েছিল সাবার পুরোনো অফিসে। সেই টিমের নেতৃত্বে ছিল আরাফাত। এই টিমে ‘Infinite Safety’ র কয়েকজন দক্ষ কর্মীও ছিল। তারা গিয়েছিল মূলত কম্পিউটারগুলো চেক করতে।

এই গভীর রাতে অফিস খুলিয়ে তল্লাশি চালিয়েছে তারা। বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে অফিসে সাবার ব্যবহৃত কম্পিউটার থেকে। সম্পূর্ণ নতুন একটা ই-মেইল দিয়ে অ্যাড্রেস লগ-ইন করেছিল সাবা। যদিও সাবা সেই ই-মেইল অ্যাড্রেস লগ আউট করে রেখেছিল, তবুও সাইবার এক্সপার্টদের তা হ্যাক করতে খুব একটা বেশি সময় লাগেনি।

বিদেশি ই-মেইল অ্যাড্রেস থেকে বেশ কয়েকটা মেইল এসেছে সেখানে। অস্ট্রেলিয়ার ই-ভিসা, সেখানকার এক পত্রিকা থেকে কনফারমেশন লেটার, বাড়ি ভাড়া নেওয়ার নিশ্চয়তাপত্র।

সেই মেইলগুলোই ল্যাপটপে জহুরি দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে শাফকাত। তার সামনে ‘Infinite Safety’ র একজন দক্ষ সাইবার এক্সপার্ট রাজীব। সে-ই এই মেইলগুলো গভীরভাবে নিরীক্ষা করে এনেছে শাফকাতের কাছে।

শাফকাতের পাশে চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছেন ওসি মিরাজ সাহেব। তার এলাকায় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট শাফকাত আলমের স্ত্রীকে গুলি করা হয়েছে, অথচ আসামির কোনো হদিস নেই। ওপর মহল থেকে আসা একের পর এক ফোনে তটস্থ তিনি।

শাফকাত থমথমে গলায় রাজীবকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তুমি বলতে চাচ্ছো এই সব মেইলই ফেক?”

রাজীব জোর গলায় বলল, “জি বস! যে মেইল আইডি থেকে এই মেইলগুলো এসেছে সেগুলো বিদেশি, কিন্তু একটাও অথোরাইজড না।”

শাফকাত আবারও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ল্যাপটপের স্ক্রিনে। ই-ভিসা হুবহু আসলের মতো। সে এত বিদেশে যাতায়াত করে, অথচ সেও প্রথম দৃষ্টিতে ধরতে পারেনি। অবিকল আসলের মতোই মনে হচ্ছে।

শাফকাত ভ্রু কুঁচকে বলল, “তুমি শিওর?”

রাজীব প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল, “Hundred percent sure boss!”

ওসি মিরাজ শুষ্ক কেশে বললেন, “আমার মনে হয় কেউ ম্যাডামকে বোকা বানিয়ে গয়নাগুলো নিয়ে পালিয়েছে।”

রাগে গা জ্বলে গেল শাফকাতের। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “সেটা তো আমিও বুঝতে পারছি। জানা কথা না বলে কে বোকা বানালো সেটা খুঁজে বের করুন!”

শাফকাতের অগ্নিবাক্যে নড়েচড়ে বসলেন ওসি সাহেব। পুলিশ নিজেদের মতো করে ঘটনা তদন্ত করছে। তবে নিজের বিষয়ে অন্যের ওপরে নির্ভরশীল নয় শাফকাত। বিষয়টা যদি হয় সাবা, তাহলে তো একেবারেই নয়। শাফকাতের নিজস্ব সিকিউরিটি টিম আর ‘Infinite Safety’ ছেলেমেয়েরাই যথেষ্ট অপরাধীকে খুঁজে বের করার জন্যে।

শামা এতক্ষণ চিন্তিত ভঙ্গিতে পায়চারি করছিল মিটিং রুম জুড়ে। হঠাৎ ভীত ভঙ্গিতে এসে বসলো শাফকাতের বাম পাশের চেয়ারে।

আতঙ্কিত গলায় বলল, “ভাইয়া? যে ভাবিকে শুট করেছে তার উদ্দেশ্য ছিল তাকে…”

মেরে ফেলা। শামা শেষ করলো না পুরো বাক্যটা। আতঙ্কে গলা শুকিয়ে গেছে তার। তবুও না বলা কথাগুলো বুঝে নিলো তার বুদ্ধিমান ভাই।

শামা আবারও বলল, “যদি সে জেনে যায় ভাবি বেঁচে আছে, তাহলে তো আবারও তার ওপর অ্যাটাক করতে পারে।”

রাগে-তেজে ভেতরে ভেতরে ফুঁসে উঠলো শাফকাত। যদি তাই হয়, সেই জানোয়ার যদি আবারও সাবার ওপরে হামলা চালাবার চেষ্টা করে, তাহলে খুব উপকার হয়। কষ্ট করে তাকে খুঁজে বের করতে হবে না। দেখামাত্র মাটির সঙ্গে পিষে ফেলতে পারবে তাকে শাফকাত।

শাফকাত গম্ভীর গলায় বলল, “তোর ভাবি এখন সেফ। এই হসপিটালে এক মাছি ঢুকতে চাইলেও তাকে আমার পারমিশন নিয়ে ঢুকতে হবে।”

শাফকাতের দৃঢ় বাক্যে চারপাশের থমথমে পরিবেশ যেন আরেকটু থমথমে হয়ে উঠলো।

ওসি মিরাজ কী যেন চিন্তা করে বললেন, “আচ্ছা শাফকাত সাহেব? ম্যাডামের কোনো শত্রু আছে?”

কয়েক মুহূর্তের মধ্যে মস্তিষ্কে জমে থাকা সকল তথ্যগুলো উল্টেপাল্টে দেখলো শাফকাত। সাবার নাড়ি-নক্ষত্র তার জানা। মেয়েটার কোনো শত্রু…

একটা নামে আটকে গেল তার সকল ভাবনা-চিন্তারা। যে ছেলেটার কাছ থেকে বারবার সাবাকে দূরে থাকতে বলেছিল শাফকাত। বারণ করা সত্ত্বেও যে ছেলেটার সঙ্গে দেখা করেছিল সাবা। যে ছেলেটার কারণে দূরত্ব আবারও এসে জায়গা করে নিয়েছে দুজনের মধ্যে।

শাফকাত তড়িৎ গতিতে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলো। সিকিউরিটি টিমের চিফ আরাফাতের নম্বরে ডায়াল করলো। একটা রিং বাজতেই রিসিভ হয়ে গেল ফোনটা।

শাফকাত বরফের ন্যায় হিমশীতল গলায় বলল, “ফাহিম ছেলেটার ওপর নজর রাখো!”

ওসি সাহেব তাজ্জব বনে গেলেন শাফকাতের কর্মকাণ্ডে। এখন পর্যন্ত তার জিজ্ঞেস করা কোনো প্রশ্নের উত্তর তো দিচ্ছেই না, উল্টো নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছে। ভিক্টিমের পরিবার সহযোগিতা না করলে পুলিশ তদন্ত চালিয়ে যাবে কী করে?

শাফকাত উঁচু গলায় ডাকলো, “জয়া?”

জয়া মিটিং রুমের বাইরেই ছিল। ডাক শুনে দ্রুত গতিতে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে বলল, “জি বস?”

“সাবার ফোন তোমার কাছে না? দাও তো!”

জয়া পকেট থেকে সাবার মোবাইলটা বের করে বাড়িয়ে দিলো শাফকাতের কাছে। এই মোবাইলটা সাবা সর্বক্ষণ ব্যবহার করে। শাফকাত যাকে তাকে ট্র্যাক করে খুঁজে বের করতে না পারে, তাই মোবাইলটা বাড়িতেই রেখে গিয়েছিল।

সাবার মোবাইলে প্রবেশপথে প্যাটার্ন লক। মোটেও বিচলিত হলো না শাফকাত। যে মানুষ সাবার ফোন নম্বর ট্র্যাক করতে পারে তার পক্ষে মোবাইল হ্যাক করে এই লকটা জেনে নেওয়া কোনো ব্যাপারই না। নিমিষেই একটা উল্টো ত্রিভুজ এঁকে মোবাইলটা আনলক করলো শাফকাত।

কললিস্ট ঘেঁটে বের করলো ফাহিমের নম্বর। নম্বরটা ওসি সাহেবকে দেখিয়ে বলল, “এই নম্বরটা দ্রুত ট্র্যাক করার ব্যবস্থা করুন। যদিও ট্র্যাক করা যাবে কিনা সন্দেহ!”

ওসি সাহেব অবাক গলায় বললেন, “এটা কার নম্বর?”

শাফকাত অগ্নিকণ্ঠে বলল, “শত্রুর কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন না? এই সেই শত্রু।”

শাফকাত সংক্ষেপে সাবার সঙ্গে ফাহিমের পূর্বের ইতিহাস ওসি সাহেবকে জানাতেই তিনি
তৎপর হয়ে উঠলেন ফাহিমের নম্বর ট্র্যাক করতে।

এদিকে আধ ঘণ্টার মধ্যে জয়া হাজির হলো নতুন তথ্য নিয়ে। সাবার ঘর থেকে আরেকটা মোবাইল পাওয়া গেছে। সেই বাটন মোবাইলটা। সাবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে জিনিসটা খাটের নিচে লুকিয়ে রেখেছিল বলে খুঁজে পেতে এতটা সময় লাগলো। মোবাইলের কল লিস্ট মুছে ফেলা হয়েছে। কোনো নম্বর সেভও করা নেই।

মোবাইলটা তৎক্ষণাৎ শাফকাত পুলিশের হাতে তুলে দিলো না। সে মোটামুটি নিশ্চিত সাবাকে যে গুলি করেছে, তার সঙ্গে সাবা এই মোবাইল দিয়েই যোগাযোগ করতো। মোবাইলটা রাজীবকে বুঝিয়ে দিলো শাফকাত।

গম্ভীর গলায় বলল, “এই মোবাইল থেকে যতগুলো নম্বরে কল করা হয়েছে, সবগুলোর লিস্ট আমার লাগবে। এক ঘন্টার মধ্যে!”

সময় যতই এগোচ্ছে শাফকাতের শরীরের সমস্ত রক্ত টগবগ আরও প্রবল গতিতে টগবগ করে ফুটছে। সাবা ওদিকে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। এদিকে যে মানুষটার কারণে তার এই পরিণতি, তাকে এখনো পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি শাফকাত।

আরাফাত ফোন করে জানালো, ফাহিমকে আজ বিকেলের পর থেকে তার বাড়িতে দেখা যায়নি। ওদিকে পুলিশও তার নম্বর ট্র্যাক করতে ব্যর্থ।

এবার নিশ্চিন্ত হলো শাফকাত। সাবার এই পরিণতির পেছনে ফাহিম ছাড়া আর কেউই দায় নয়। হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ করে লম্বা শ্বাস নিলো শাফকাত। ইতোমধ্যে আবারও তার চোখ দুটো রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।

এই সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতেও অভিমানের দমকা হাওয়া এসে স্পর্শ করলো শাফকাতকে। তার কাছ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে এতটা মরিয়া হয়ে উঠেছিল মেয়েটা? কোন কিছু বিচার-বিবেচনা না করে অন্ধের মতো ফাহিম যা বলে তাই বিশ্বাস করেছে?

এসবের কারণ শুধু মাত্র একটা চড়? একটা চড়ের শাস্তি এত বড়? মেয়েটা কি জানে না, আজ তার কিছু হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে বিলীন হয়ে যাবে শাফকাতের অস্তিত্ব?

(চলবে)