#লেবু
৪৩
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
“কোন পুরাতন প্রাণের টানে
ছুটেছে মন, ছুটেছে মন
মাটির পানে
কোন পুরাতন প্রাণের টানে”
ঘরে পা রাখতেই থমকে দাঁড়ালো শাফকাত। মিষ্টি এই গানের সুর সোজা এসে স্পর্শ করলো তার হৃদয়টাকে। কিন্তু এ বাড়িতে তো কেউ গান গায় না। গাইলেও সেই সুর এতটা মসৃণ হয় না। এ যেন গান নয়, হৃদয়টাকে আলোড়িত করে তোলার এক যাদুমন্ত্র।
এক পা এক পা করে ব্যালকনির দিকে এগিয়ে গেল শাফকাত। গানটা সেখান থেকেই ভেসে আসছে। ব্যালকনিতে প্রবেশ করতেই সে দেখতে পেলো ফুল গাছের টবগুলো ঘেঁষে বসে আছে সাবা। আকাশের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই সেই গাইছে এ গান।
মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শাফকাত। একটা মানুষ এত সুন্দর করে গাইতে পারে? তার থেকেও বড় কথা যে মানুষটা এত সুন্দর গান গাইতে পারে, সে সচরাচর গায় না কেন? শাফকাত ভেবেছিল মেয়েটাকে পুরোপুরি চিনে ফেলেছে সে। অথচ তার কতগুলো রূপ যে এখনো অপরিচিত তার কাছে কে জানে?
“চোখ ডুবে যায় নবীন ঘাসে
ভাবনা ভাসে… পুব-বাতাসে
মল্লারগান প্লাবন জাগায়
মনের মধ্যে শ্রাবণ-গানে
গানে…
কোন পুরাতন প্রাণের টানে”
বিস্ময়ের-মুগ্ধতায় অভিভূত হয়ে শাফকাত তাকিয়ে রইলো সাবার দিকে। গান গাওয়ার সময়ে তার চোখ দুটো চকচক করে ওঠে। অব্যক্ত একটা উচ্ছ্বাস ফুটে ওঠে ওই চোখে। সেই উচ্ছ্বাস কেন সবসময় দেখতে পাবে না শাফকাত?
চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো শাফকাতের বুক থেকে। যতই দিন যাচ্ছে, ততই মেয়েটার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে সে। মায়ায় পড়ে যাচ্ছে তার। কিন্তু এই দুর্বলতা বা মায়াকে প্রশ্রয় দেওয়ার আদৌ কি কোনো মানে আছে? সাবা তো আর থাকবে না তার কাছে চিরকাল। যদিও চিরকাল সে ভালো ঠিকই বেসে যাবে। বাসলেই বা কী? সেই ভালোবাসার মূল্য তো আর সাবার কাছে নেই।
মূল্যহীন ভালোবাসার মতো যন্ত্রণাদায়ক বস্তু এই পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। এই ভালোবাসা যে পায় আর যে দেয়, দুজনেই সমান যন্ত্রণার শিকার।
দীর্ঘশ্বাসগুলো গোপন করে শাফকাত এগিয়ে গেলো সাবার কাছে।
প্রশংসার সুরে বলল, “তুমি এত সুন্দর গান গাইতে পারো? আগে কখনো বলোনি তো!”
শাফকাতের উপস্থিতি টের পেয়ে চমকে উঠে তাকালো সাবা। হাসিমুখে বলল, “সুন্দর কোথায়? স্কুলের বিভিন্ন প্রোগ্রামে গাইতাম। ওখান থেকেই অভ্যাস হয়ে গেছে।”
সাবার হাসিটা অদৃশ্য এক সুখের জানান দিচ্ছে শাফকাতের মনে। কাল রাতে যেভাবে তার প্যানিক অ্যাটাক হলো, শাফকাত তো ভেবেছিল তার স্বাভাবিক হতে কম করে হলেও তিন-চার দিন লাগবে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে আজ সকাল থেকেই বেশ স্বাভাবিক সাবা। এমন একটা ভাব যেন কাল রাতে কিছুই হয়নি।
একটা ভেঙে পড়া মানুষের জন্যে সব থেকে কার্যকর বোধ হয় আরেকটা মানুষের স্নেহের কথা, সাহস যোগানোর কথা। মনে গভীরতম থেকে কষ্টের যে কথাগুলো সাবা লুকিয়ে রেখেছিল এতকাল ধরে সেগুলো শাফকাতকে না বললে হয়তো সে নিজেও কখনো জানতে পারতো না তার অনুতাপের মাঝে বেঁচে থাকার কোনো কারণ নেই।
শাফকাত ব্যস্ত গলায় বলল, “ওঠো! হসপিটালে যেতে হবে তো এখন।”
সাবা তার হাতটা শাফকাতের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বাচ্চাদের মতো আবদার করার ভঙ্গিতে বলল, “ওঠান আমাকে।”
শাফকাত ক্ষীণ হাসি হেসে যত্ন নিয়ে টেনে তুলল সাবাকে। ডক্টর প্রতিদিনই বাড়িতে আসছেন চেকআপের জন্যে। তবুও সব চেক আপ তো বাড়িতে করা যায় না। তাছাড়া সাবার কতগুলো টেস্টও করাতে হবে। ইসিজি করাতে হবে। এসবের জন্যেই আজ হসপিটালে যাচ্ছে তারা।
রক্তের স্যাম্পল দেওয়ার সময়ে বা ইসিজি করানোর সময়ে আজ আর ভয় পেলো না সাবা। একা একা সব টেস্টের আনুষ্ঠানিকতা সেরে এলো। কাল এক রাতেই তার ভয় অনেকটা কেটে গেছে।
দিনভর এক গভীর চিন্তায় মগ্ন সাবার মস্তিষ্ক। বারবার একটা প্রশ্নই সে করছে নিজেকে। শাফকাত কী যাদু জানে? না জানলে তার উচ্চারিত একেকটা শব্দ যাদুর মতো সাবার ওপর প্রভাব ফেলে কী করে?
আগে একটা সময়ে ভাইয়ার কথা ভাবলেও তার বুক কেঁপে উঠতো। নিজের বাড়িতে পা রাখতেও ভয় হতো তার। সবকিছু থেকে নিজেকে কেমন গুটিয়ে নিয়েছিল সে।
“তুমি বারবার ভেঙে পড়লে সব থেকে বেশি ডিসঅ্যাপয়েন্টেড কে হবে জানো? তোমার ভাইয়া। সে নিশ্চয়ই কখনো তোমাকে এভাবে দেখতে চায়নি।”
শাফকাতের বলা এই কথাটা তখন যাদুর মতো বদলে দিয়েছিল সাবাকে। আসলেই তো। আহনাফ তো কখনোই চায়নি, তার বোনটা পদে পদে ভেঙে পড়ুক। পৃথিবীর সম্মুখীন হতে ভয় পাক। এখনো নিশ্চয়ই চাইবে না।
শাফকাতের কথা অনুযায়ীই এরপর থেকে আর নিজেকে ভেঙে পড়তে দেয়নি সাবা। শক্ত হাতে সামলেছে নিজেকে। ভাইয়ার কথা যখনি মনে পড়েছে, মনকে বাধ্য করেছে তার ঝুলন্ত প্রাণহীন দেহটার কথা না ভেবে, তার সঙ্গে কাটানো অনিন্দ্য সুন্দর মুহূর্তগুলোর কথা ভাবতে।
সাবা জানে না গত রাতে তার কী হয়েছিল। আহনাফ চলে যাওয়ার পর থেকেই নিজেকে বড্ড গুটিয়ে নিয়েছে সে। মনের কথাগুলো সহসা কাউকে খুলে বলতো না। কিন্তু না জানি কাল কীভাবে কী হলো? শাফকাতকে নিজের সব থেকে ভরসাযোগ্য আশ্রয় বলে মনে হলো। যার কাছে নির্দ্বিধায় বলা যায় মনের কথা। মনে হলো, তার মনের কথাগুলো বোঝার ক্ষমতা যদি কারও থেকে থাকে তা শাফকাতেরই আছে। আসলেও তো তাই।
অপারেশনের পর জ্ঞান ফিরে পাওয়ার দিন থেকে শুরু করে গত রাত অবধি আবছা একটা অপরাধবোধ ঘিরে ধরে রেখেছিল সাবাকে। যে অপরাধবোধ নিঃশ্বাস ফেলতে বাঁধা দিচ্ছিলো প্রতিনিয়ত। একেকটা শ্বাস নেওয়ার সঙ্গে মনে হচ্ছিল একটু একটু করে বিষাক্ত কোনো কিছু জায়গা দখল করে নিচ্ছে তার ফুসফুসে। আজ সেই অপরাধবোধ নেই। মানুষটা সত্যিই যাদু জানে।
হসপিটালে থেকে ফেরার পথে শাফকাত নিজেই ড্রাইভ করবে বলে ঠিক করলো। সাবা বসে আছে প্যাসেঞ্জার সিটে। তার দৃষ্টি জানালার বাইরে বড় বড় বিল্ডিংগুলোর ওপর। কেমন অদ্ভুত লাগছে সাবার। ওই দিনও তো এভাবেই প্যাসেঞ্জার সিটে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। পার্থক্য শুধু সময়ের আর নিরাপত্তার। সেদিন সাবা কতটা বিপদের মুখে ছিল, আর আজ কতটা নিরাপদ!
পথেই সাবার চোখে পড়লো বিশাল একটা আইসক্রিম পার্লার। সুপ্ত একটা ছেলেমানুষি ইচ্ছা জেগে উঠলো মনে।
ইচ্ছা পূরণের তাগিদেই ইতস্তত করে ডাকলো,
“শাফকাত?”
সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠলো শাফকাতের ঠোঁটের কোণে। ধীরেসুস্থে তার নামটা উচ্চারণ করলো সাবা। যেন উচ্চারণে তার প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। আবার অস্পষ্ট একটা যত্নও লুকিয়ে আছে। যেন তার নাম উচ্চারণে কোন প্রকার ভুল না হয়।
শাফকাত হালকা গলায় বলল, “হুঁ?”
“আইসক্রিম খাবো।”
শাফকাতের ঠোঁটের কোণের হাসিটা আরেকটু তীক্ষ্ম আকার ধারণ করলো। কাল রাতের পর থেকে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন সে দেখতে পাচ্ছে সাবার মাঝে। মেকি কাঠিন্যের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখছে না সাবা। যেমনটা এতদিন ধরে করে আসছে। সে যেমন, ঠিক তেমনভাবেই প্রকাশ করছে নিজেকে।
শাফকাত গাড়ি থামিয়ে বলল, “চলো যাই!”
“না ভেতরে যাবো না। কাছেই একটা পার্ক আছে। আপনি আইসক্রিম নিয়ে আসুন, ওখানে বসে খাবো।”
শাফকাত হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বলল, “ভয় পেয়ো না। পেছনেই বডিগার্ডদের গাড়ি।”
শাফকাত দরজা খুলে গাড়ি থেকে নামতে উদ্যত হতেই সাবা বলল, “কোন ফ্লেভারের আইসক্রিম খাবো না জেনেই যাচ্ছেন?”
“বাটারস্কচ।”
“কীভাবে জানলেন?”
শাফকাত অন্যরকম গলায় বলল, “ভুলে গেছো তোমার নাড়ি-নক্ষত্র আমার মুখস্থ?”
শাফকাত নেমে পড়তেই প্রশয়ের একটা হাসি ফুটে উঠলো সাবার ঠোঁটে। শাফকাতের তার অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা, তার পছন্দ-অপছন্দগুলো নির্দ্বিধায় জেনে নেওয়া – কোনো কালেই পছন্দ ছিল না সাবার। তবে আজ এত ভালো লাগলো কেন কে জানে?
সাবার হাতে বাটারস্কচ আর শাফকাতের হাতে মিন্ট চকো চিপ ফ্লেভারের কোন আইসক্রিম। দুজনেই বসে আছে জনমানবশূন্য পার্কের বেঞ্চে। কিছুটা দূরে রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে তাদের বডিগার্ডদের গাড়িটা। বডিগার্ড না থাকলেও অবশ্য সমস্যা হতো না। সাবার পাশে শাফকাত আছে। কেন জানি এই মানুষটা পাশে থাকলে পৃথিবীর কোনো ভয়ই তাকে স্পর্শ করতে পারে না।
সাবা স্মৃতিকাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো পার্কটার দিকে। এক ধারে বিশাল বিশাল কয়েকটা আম গাছ, মেশিন দিয়ে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কাটা ঘাস, কয়েক মিটার পর পরই গাঢ় সবুজ রঙের বেঞ্চ, বেঞ্চের পাশেই একটা করে ল্যাম্পপোস্ট।
পার্কটা একটা আবাসিক এলাকার মধ্যে। সাধারণত পার্কের কাছাকাছিই লেক বা পুকুর জাতীয় কিছু থাকে। এই পার্কের চারদিকেই উঁচু উঁচু বিল্ডিং।
সাবা স্নিগ্ধ গলায় বলল, “এই পার্কটাতে আগে ছোট ছোট বাচ্চারা খেলতে আসতো জানেন!”
“তাই?”
“হুঁ। ওইযে!”
সাবা আঙুল উঁচিয়ে একটু দূরে তাক করলো। তার আঙুল অনুসরণ করে শাফকাতও দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সেদিকে।
সাবা উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল, “ওখানে আগে একটা স্লাইড ছিল। দোলনা-টোলনা আরও কী কী যেন ছিল। বিকেল হলেই বাচ্চাগুলো এসে জড়ো হতো এখানে। কাছেই তো একটা প্রাইমারি স্কুল। ওদের ছুটির পর সোজা এখানে চলে আসতো।”
শাফকাত আগ্রহ নিয়ে বলল, “তুমি এসব জানলে কী করে?”
“আমার ভার্সিটিও তো কাছেই। সময় পেলেই বন্ধুদের সাথে এখানে চলে আসতাম। বাচ্চারা একপাশে খেলতো আমরা আরেকপাশে আড্ডায় মেতে উঠতাম।”
“এখন বাচ্চারা কোথায়?”
সাবা আবার আঙুল তাক করলো পার্কের পাশের একটা ইটের দালানের ওপর। শুকনো গলায় বলল, “ওই বাড়িতে এক বৃদ্ধা থাকে। তার বাচ্চাদের চেঁচামেচি মোটেও ভালো লাগতো না। কয়েকবার তো দেখেছি নিজেই বেরিয়ে এসে ওদের ধমক দিচ্ছে। তবুও কাজ হয়নি। ওরা এখানে প্রতিদিন আসবেই।”
শাফকাত আক্ষেপের সুরে বলল, “তারপর?”
সাবা মলিন কণ্ঠে বলল, “শেষমেশ বৃদ্ধা ওদের স্কুলে কমপ্লেইন করলো। স্কুল থেকেও জানিয়ে দিলো, এখন থেকে ছুটির পর সোজা বাসায় না গেলে ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ব্যস! এর পর থেকে পার্কটাও মরে গেল।”
সাবার চোখে মুখে মলিনতা দীর্ঘস্থায়ী হলো না। বাচ্চাদের খেলতে না পারা নিয়ে আফসোস না করে আবারও আইসক্রিমে মনোযোগী হলো সে। আড়চোখে একটু পর পর তাকে দেখছে শাফকাত। মেয়েটার ভাবভঙ্গি এমন যেন ওই আইসক্রিমের থেকে জরুরি এই পৃথিবীতে আর কিছুই নেই।
শাফকাত হালকা গলায় বলল, “তোমাকে দেখে আজ কী মনে হচ্ছে জানো সাবা?”
সাবা কৌতূহলী গলায় বলল, “কী?”
শাফকাত ঘোরলাগা কণ্ঠে বলল, “তুমি বাচ্চা একটা মেয়ে। পৃথিবীর কোনো কিছু নিয়ে তোমার মাথা ব্যথা নেই।”
সাবা খানিক হেসে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, “আমি এমনই ছিলাম জানেন? নিজের জীবনটা নিয়ে নিজেই কোনোদিন চিন্তা করিনি। ওসব তো বাবার কাজ, ভাইয়ার কাজ। কয়েকদিন আগেও আমার জীবনের সব থেকে বড় দুশ্চিন্তা ছিল, একশ টাকার মধ্যে কয় টাকার কোল্ড ড্রিঙ্কস খাবো আর কয় টাকা রিকশা ভাড়া দেবো।”
আনমনেই হেসে ফেলল সাবা। তবে সেই হাসি স্পর্শ করলো না শাফকাত। সে বুঝতে পারছে হাসির আড়ালে কতটা আক্ষেপ, কতটা যন্ত্রণা লুকিয়ে রেখেছে মেয়েটা।
সাবা দম নিয়ে আবারও বলল, “বাবা আমাকে খুব লিমিটেড পকেট মানি দিতো, গাড়ি দেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না! নিজের মতো করে বড় হতে দিয়েছে আমাকে। জীবনটাকে এনজয় করতে শিখিয়েছে। অথচ, আমার জীবনটাই কেমন হয়ে গেল!”
শাফকাত দৃঢ় গলায় বলল, “সুযোগ কী ফুরিয়ে গেছে? চাইলে এখনো তো জীবনটাকে এনজয় করা যায়।”
সাবা কম্পিত স্বরে বলল, “চাই তো, পারি না। বারবার হেরে যাই। ভেতর থেকে কী যেন একটা এসে আটকে দেয় আমাকে।”
শাফকাত সাহস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “আটকে যাওয়াই তো যাবে না সাবা। নিজের এই নেগেটিভ এনার্জির সাথে নিজেকেই লড়তে হবে। তোমার হয়ে কেউ এই লড়াইটা করে দিতে পারবে না।”
সাবা কী বলবে ভেবে না পেয়ে বলল, “হুঁ।”
বয়ে গেল নীরবতার হাওয়া। শাফকাতের কাছে একটা প্রশ্নের উত্তর এখনো পাওনা রয়ে গেছে সাবার। শাফকাত ভেবে পেলো না সেই উত্তরটা দেওয়ার মোক্ষম সময় এখন কিনা।
অবশেষে ভাবনা-চিন্তা দূরে ঠেলে বলল, “ঠিক এই কারণেই আমি তোমাকে ডিভোর্স দিচ্ছি।”
সাবা চমকে উঠে বলল, “কোন কারণে?”
“এই যে তুমি লাইফটাকে এনজয় করতে পারছো না।”
সাবা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শাফকাতের দিকে।
শাফকাত তাচ্ছিল্যের হাসি গোপন করে বলল,
“তোমার হয়ত এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, ডিভোর্সের কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু লং টার্মে চিন্তা করে দেখো সাবা। একটা সময়ে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে, আমিও ব্যস্ত হয়ে যাবো। এখনকার মতো সবসময় তোমার পাশে থাকবো না। তাছাড়া আমি তো বদলাবো না। তোমার ওপর আমার নজরদারি, কন্ট্রোলিং বিহেভিয়ার আগের মতোই থাকবে। যেটা তুমি সহ্য করতে পারবে না। কী দরকার শুধু শুধু বিয়েটাকে ধরে রেখে?”
সাবা ভেবে পেলো না এর জবাবে কী বলবে। শাফকাতের কথায় যুক্তি থাকলেও সেই যুক্তি মানতে চাইছে না মনটা। যে ডিভোর্সের জন্যে বিয়ের দিন থেকে উদগ্রীব হয়েঅ পেক্ষা করছিল সাবা, সেই ডিভোর্স যখন দ্বারপ্রান্তে, ঠিক তখনই বুকের ভেতরটা অস্বস্তিতে বারবার মোচড় দিয়ে উঠছে কেন? মানুষের মন এত অদ্ভুত কেন?
(চলবে)
#লেবু
৪৪
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
“আপনি সত্যিই আমাকে ডিভোর্স দিবেন?”
সাবার চোখ দুটো দেখে মনে হলো যেন আকাশ থেকে পড়েছে সে। সেদিন পার্কের ওই কথোপকথনের পর বেশ অনেকটা দিন পেরিয়ে গেছে। একটু একটু করে সেরে উঠেছে সাবা। স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করেছে প্রতিনিয়ত। তার মা-বাবা প্রায়ই এ বাড়িতে আসেন মেয়েকে দেখতে। অতীতের তিক্ততা ভুলে তাদের সঙ্গে পূর্বের সেই মিষ্টি সম্পর্কে ফিরে যাচ্ছে সাবা। শাশুড়ির সঙ্গেও আজকাল একটু বেশিই সময় কাটায় সাবা। সন্ধ্যার পর তার সঙ্গে বসে সিরিয়াল দেখতে। যদিও টিভি স্ক্রিনে ভেসে ওঠা একের পর এক দৃশ্য তার মাথার ওপর দিয়ে যায়। তবুও আতিয়া আলমকে সঙ্গ দেওয়ার জন্যে লক্ষ্মী মেয়ের মতো বসে থাকে সে। শামা আর অরুণের সঙ্গেও প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ক্রাইম নাইটের আসরে বসে যায় সাবা। যেটুকু অবসর সময়ে অবশিষ্ট থাকে, তা সাবা কাটায় দেশি-বিদেশি নানান ডকুমেন্টারি দেখে। সাংবাদিকতার ওপর আবারও একটু একটু করে তার আগ্রহ ফিরে আসছে।
শাফকাতের সঙ্গেও তার সম্পর্কে যে শীতলতা জায়গা করে নিয়েছে, এমনটা না। শাফকাত ইদানীং কাজ নিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়লেও দিনে বেশ কয়েকবার সাবাকে ফোন করে খোঁজ-খবর নেয়। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে সাবার সারা দিনে জমে থাকা গল্পগুলো ধৈর্য ধরে শোনে।
এই এতগুলো দিনে ডিভোর্সের প্রসঙ্গ একবারও উঠে আসেনি তাদের কথোপকথনে। সাবা তো ধরেই নিয়েছিল, ওই সময়টায় জেদ করে ডিভোর্সের কথা তুলেছিল শাফকাত। এখন তা ভুলে গেছে।
কাল রাতেও তো ঘুমোতে যাওয়ার আগে কত সুন্দর একটা সময় কাটালো দুজনে। সাবা তার ছোটবেলায় স্কুলে গান গাওয়ার গল্প করছিল, শাফকাত তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আগ্রহ নিয়ে শুনছিল। অথচ তখন কি সাবা ভাবতেও পেরেছিল, আজ সকালে এত বড় একটা ধাক্কা অপেক্ষা করছে তার জন্যে?
শাফকাত অফিসের জন্যে তৈরি হচ্ছিল। সাবা বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে আড়চোখে দেখছিল তার টাই বাঁধা। তৈরি হয়েই শাফকাত ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে একটা কাগজ টেনে ধরিয়ে দিলো সাবার হাতে।
কাগজের ওপর লেখা প্রথম লাইনটা পড়েই গা বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল সাবার।
‘স্বামী কর্তৃক তালাকের হলফনামা’
মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শাফকাত। তার ভেতরটা যে আজ দুমড়ে-মুচড়ে একাকার। ডিভোর্স পেপার আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তবুও রেখে দিয়েছিল নিজের কাছে সযত্নে। সাবাকে হারানোর জন্যে সে প্রস্তুত ছিল না কোনোকালেই। এক মাস ধরে নিজেকে প্রস্তুত করার বৃথা চেষ্টা করলো। তবে সত্যিটা হলো মেয়েটাকে হারিয়ে সে কখনোই ভালো থাকতে পারবে না। বেঁচে থাকবে ঠিকই, তবে চিরকাল বুকের মাঝে বিরাজ করবে সুপ্ত একটা শূন্যতা।
এই কয়েকটা দিনে আরও গভীরভাবে সাবার মায়ায় জড়িয়ে গেছে সে। তার গোসলের পর স্নিগ্ধ মুখটা, হাসতে গিয়ে এক হাতে ঠোঁট লুকানো, ঘুমের মধ্যে কিঞ্চিৎ কেঁপে ওঠা, তার গায়ের সুবাস – সবটাই যেন অস্তিত্বে মিশে গেছে শাফকাতের। নিজের অস্তিত্ব থেকে কোনো ক্রমেই এসব মুছে ফেলতে পারবে না।
অবশ্য মুছে ফেলতে চায়ও না শাফকাত। সাবা হয়ত আজই এ বাড়ি থেকে চলে যাবে। কিন্তু ফেলে আসা এই কয়েকটা দিন তো আর জীবন থেকে মুছে দিয়ে যেতে পারবে না। প্রশান্তিময় সময়টায় সাবা তাকে ছোট ছোট হাজারো সুখস্মৃতি দিয়েছে। যা বয়ে নিয়ে গোটা একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যাবে নির্দ্বিধায়।
সাবাকে ছাড়া শাফকাত কেমন থাকবে, এটা নিয়ে তার বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই। তাকে ছাড়া সাবা ভালো থাকবে, এটাই মুখ্য।
ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে শাফকাত বলল,
“হ্যাঁ। এরকমই তো কথা ছিল।”
সাবা অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে রইলো শাফকাতের দিকে। কয়েক সেকেন্ড পর তার অস্থির চোখ দুটো পড়লো ওই কাগজের ওপর। উল্টেপাল্টে এমনভাবে দেখছে যেন কোনোমতে একটা ভুল খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে ওই কাগজে।
শাফকাত ভেবে পেলো না এই অবিশ্বাস কীসের। মুক্তির আনন্দে অভিভূত হয়ে নাকি শাফকাতের জীবন থেকে ছিন্ন না হওয়ার আকাঙ্ক্ষায়।
শাফকাত কলমটা এগিয়ে দিয়ে বুকে পাথর নিয়ে শীতল গলায় বলল, “সাইন করো সাবা। তোমার কতদিনের স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে! আজ থেকে তুমি মুক্ত! অবশ্য ডিভোর্স কার্যকর হওয়ার জন্য আরও তিন মাস লাগবে। তবুও!”
সাবা কলমটা হাতে তুলে নিলো না। কাগজটার ওপরেই দৃষ্টি আটকে রেখে বলল, “আপনি কি মন থেকে আমাকে ডির্ভোস দিচ্ছেন?”
তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো শাফকাতের ঠোঁটের কোণে। মনের এই ডিভোর্সে সায় না থাকলেও মস্তিষ্কের আছে। আর শাফকাত আলম বরাবরই মস্তিষ্কের নির্দেশ মেনে চলে।
তার ভালোবাসার প্রয়োজন সাবার নেই। সাবার প্রয়োজন ভালো থাকার। ভালো সে কোনোদিনই থাকবে না তার থেকে মুক্তি না পেলে। মস্তিষ্কের এই যুক্তিতেই তো এত বড় সিদ্ধান্তটা নিলো শাফকাত।
শাফকাত ভারী গলায় বলল, “তোমার কি মনে হয়?”
সাবা অস্পষ্ট গলায় বলল, “না।”
শাফকাত ভ্রু ওপরে তুলে বলল, “হুঁ?”
অস্পষ্ট গলাতে বললেও শাফকাত বেশ শুনছে সাবার “না।” তবুও না জানি কেন আবারও তার মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছে হলো ওই একই শব্দটা।
সাবা লম্বা শ্বাস নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“না, আমার মনে হয় না আপনি আমাকে মন থেকে ডিভোর্স দিচ্ছেন।”
শাফকাত তাচ্ছিল্যের বাঁকা হাসি হেসে বলল, “তোমার মনে হওয়াটাই ঠিক। কিন্তু কি আর করা, এক পক্ষ যখন ডিভোর্স চায়…”
কানে অদ্ভুত এক জ্বালাপোড়া শুরু হলো সাবার। চোখ দুটোতে নোনা জল এসে বাসা বেঁধেছে। শাফকাত এটা করতে পারে না তার সঙ্গে! একটা সময়ে ডিভোর্সের জন্যে তুমুল হইচই করেছে সাবা। অতিষ্ঠ করে তোলার চেষ্টা করেছে শাফকাতকে।
ছেলেটা অতিষ্ঠ হয়নি, উল্টো দৃঢ় গলায় জানান দিয়েছে, “তুমি আমার।” তাহলে আজ কেন সে কথা বলছে না শাফকাত? আজ কেন ওই কাগজটার সাইন করতে জোরাজুরি করছে।
সাবা নিজেকে সামলে রাখতে ব্যর্থ হয়ে দু চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে, হৃদয়টাকে প্রকম্পিত করে বলল, “না! আমি ডিভোর্স চাই না। আমি…”
বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেল শাফকাতের চোখ দুটো। এতটুকু বাক্য বলতেই যেন দম ছুটে গেল সাবার। লম্বা লম্বা করে শ্বাস নিচ্ছে আর নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করছে। তবে চোখ দুটো বেয়ে পড়া অশ্রুধারা থামবার কোনো ভাব-লক্ষণ নেই।
সাবা দম নিয়ে আবারও কম্পিত স্বরে বলল,
“আমি সাইন করবো না।”
শাফকাত ভাবলো পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার মতোই আরেকটা বোকামি করছে সাবা। পালিয়ে যাওয়ার আগেও যেমন সুদূর ভবিষ্যতের কথা ভাবেনি, এখনো ভাবছে না। পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত যেমন ছিল তার ক্ষণিকের আবেগের বহিঃপ্রকাশ, এটাও ঠিক তাই।
শাফকাত এবার কিছুটা কঠোর হয়েই বলল,
“মানে কী? এসব কী বাচ্চামি হচ্ছে সাবা? সাইন করো!”
সাবা এবার যেন কান্নায় ভেঙে পড়লো। তার দু চোখ বেয়ে সমান তালে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। লম্বা লম্বা শ্বাস নিচ্ছে সাবা একটু পর পর। কথা বলার উদ্দেশ্যে মুখ খুললেও কান্নার তীব্রতায় তাতেও ব্যর্থ হলো।
অবশেষে কান্নার মাঝেই কোন মতে সাবা বলল, “না প্লিজ। আমাকে ডিভোর্স দিবেন না। বিয়েটা ভেঙে দিবেন না প্লিজ।”
পূর্বের কঠোরতা নিমিষেই শূন্যে মিলিয়ে গেল। সাবার চোখের জল শাফকাতের মাঝে প্রবল উদ্বিগ্নতার সৃষ্টি করলো। কলমটা বিছানায় ফেলে রেখে শাফকাত বেডসাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাস এনে সাবার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “কথায় কথায় কাঁদবে না তো সাবা। পানিটা খাও।”
এক চুমুকে গ্লাসের পুরোটা পানি খেয়ে নিলো সাবা। তবুও থামছে না কান্নার তীব্রতায়। সাবার মতো দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একটা মেয়ে যে এভাবে কাঁদতে পারে, কখনো ভাবতেও পারেনি শাফকাত। তার কান্নার ধরন দেখে মনে হচ্ছে যেন বাচ্চা মেয়ের কাছ থেকে কেউ তার প্রিয় খেলনা কেড়ে নিয়েছে।
শাফকাত খালি গ্লাসটা বেডসাইড টেবিলে রেখে আবারও সাবার মুখোমুখি হয়ে বসে দম নেওয়ারও সুযোগ পেলো না। তার আগেই ঝড়ের গতিতে তার বুকের ওপর আছড়ে পড়লো সাবা। দুহাতে শক্ত করে শাফকাতকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ লুকিয়ে রাখলো।
শাফকাত এতটাই অবাক হলো যে কয়েক মুহূর্তের জন্যে নড়তেই ভুলে গেল। যে এত ভেবেছিল ডিভোর্স লেটার হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যে তাতে সাইন করে দেবে সাবা। তার তীক্ষ্ণ মস্তিষ্কের ধারণা তো সচরাচর উল্টো দিকে বয় না।
সংবিৎ ফিরে পেতেই শাফকাতও জড়িয়ে ধরলো সাবাকে। তবে বিস্ময়ের ঘোর থেকে এখনো পুরোপুরি বের হতে পারেনি সে।
সাবা শাফকাতের বুকে মুখ গুঁজে রেখেই বলল, “প্লিজ আমাকে ডিভোর্স দিবেন না! প্লিজ!”
শাফকাত কোন মতে বিস্ময় কাটিয়ে উঠে সাবার মাথায় হাত রেখে বলল, “যে ডিভোর্সের জন্যে এতদিন মরিয়া হয়ে উঠেছিল এখন সেই ডিভোর্সই চাচ্ছো না?”
সাবা জোর গলায় বলল, “না!”
“কেন? তুমি তো আমাকে সহ্যই করতে পারো না।”
“পারি তো।”
সাবা শাফকাতের বুকের ওপর থেকে মুখ তুলে তাকালো ঠিক তার চোখদুটোর দিকে। দুজনের চোখের মাঝেই অব্যক্ত হাজারো অনুভূতি ফুটে উঠছে। দুজনেই বুঝতে পারছে, একে অপরের অন্তরটা বুঝতে এতকাল তারা কতটা অপরাগ ছিল না।
সাবা ফের আশ্বাস দেওয়ার জন্যে প্রায় ফিসফিস করে বলল, “পারি।”
সাবা আবারও শাফকাতের বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে ফেলল। এতদিন সে মনে করেছিল এই বুকটা তার জন্যে সব থেকে নিরাপদ স্থান। তবে আজ বেশ বুঝতে পারছে। এই বুকটা কেবল নিরাপদই নয়, এই পৃথিবীর সব থেকে প্রশান্তিদায়ক আর আনন্দময় স্থানও বটে।
সাবা লম্বা লম্বা কয়েকটা শ্বাস নিয়ে কান্নামাখা সুরে বলল, “আমি জানি আমি একটা ভুল করে ফেলেছি। অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছি। আমি আপনার কাছ থেকে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। আপনি যা করেন আমার ভালোর জন্যেই তো করেন। আমি…”
শাফকাত শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “তুমি কী?”
সাবা আক্ষেপের সুরে বলল, “আমি বুঝতে পারি না। অনেক বোকা আমি। এতদিন পর এসে বুঝতে পেরেছি যে আপনার মতো করে কেউ আমাকে…”
ভালোবাসবে না? কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারলো না সাবা। শাফকাত তাকে কখনো ভালোবাসি বলেনি বটে, কিন্তু তার ছোট ছোট প্রতিটা কর্মকাণ্ডে তো ওই জিনিসেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
সাবা ভালোবাসার কাছাকাছি শব্দটা খুঁজতে কয়েক মুহূর্ত ব্যয় করে অবশেষে বলল, “আগলে রাখবে না। আমাকে ক্ষমা করে দিন প্লিজ। দরকার হলে আমাকে শাস্তি দিন। যা ইচ্ছা শাস্তি দিন। কিন্তু ডিভোর্স না।”
কয়েক মুহূর্ত অনুভূতিহীন হয়ে রইলো শাফকাত। বিস্ময়ে থ বনে যাওয়ার মতো অনুভূতিহীন। সাবা যে ডিভোর্স না দেওয়ার জন্যে এভাবে অনুরোধ করতে পারে, এ ছিল তার কল্পনারও বাইরে। এসব কী হচ্ছে তার জীবনে? যে মানুষটাকে হারাবে বলে গোটা একটা মাস শোকাচ্ছন্ন হয়ে কাটালো, সেই মানুষটাই কিনা আজ থেকে যাওয়ার জন্যে ছটফট করছে।
সাবাকে ছেড়ে নিজের মুখোমুখি বসালো শাফকাত। দুহাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে সযত্নে মুছে দিলো তার দুচোখের জল। সাবা এখন আর কাঁদছে না ঠিকই, তবে কান্নার প্রভাবে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে।
শাফকাত সাবার একটা গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো, “বেশ! ডিভোর্স চাও না তাহলে?”
“না।”
“তুমি সিওর?”
“হ্যাঁ।”
শাফকাত সতর্ক করে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “ভেবে বলো সাবা। এই হ্যাঁ-এর জন্য আবার সারাজীবন আফসোস না করতে হয়।”
সাবার চোখ দুটো বেয়ে আবারও জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল। এবার তা নিজেই হাতের উল্টো পিঠে মুছে ফেলে দৃঢ় গলায় বলল, “করবো না। বললাম তো আমি সিওর।”
সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠলো শাফকাতের ঠোঁটের কোণে। সে হাসির রেখা এতটাই সূক্ষ্ম যে সাবার চোখেও এড়িয়ে গেল।
শাফকাত অন্যরকম গলায় বলল, “কিন্তু আমি তো এত সহজে মানবো না।”
সাবা ভীত গলায় বলল, “মানে?”
শাফকাত হালকা ভঙ্গিতে বলল, “মানে আমার কিছু শর্ত আছে। তুমি যদি কথা দাও শর্তগুলো পূরণ করবে তাহলেই আমি ডিভোর্স না দেওয়ার কথা ভেবে দেখবো।”
সাবা উদগ্রীব গলায় বলল, “কী শর্ত?”
সাবার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যেন পৃথিবীর যেকোনো শর্ত পূরণে সে সম্মত। কেবল আজীবন তার সম্মুখে বসে থাকা মানুষটার সঙ্গে থেকে যাওয়ার শর্তে।
শাফকাত গাম্ভীর্যপূর্ণ গলায় বলল, “আমি যা বলবো যেভাবে বলবো, সেভাবে তাই করতে হবে।”
সাবা তৎক্ষণাৎ বলল, “করবো।”
আবারও শাফকাতের ঠোঁটের কোণে অবাধ্য হাসিটা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করলো। নিমিষেই সেই হাসিটা চাপা দিয়ে শাফকাত আবারও গম্ভীর গলায় বলল, “আজ থেকে আজীবনের জন্য আমার সাথে এই ঘরে থাকতে হবে।”
সাবা আবারও তড়িৎ গতিতে সম্মতি জানিয়ে বলল, “থাকবো।”
সাবার গালে দৃঢ়ভাবে একটা হাত রেখে অন্যরকম দৃষ্টিতে তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো শাফকাত। সাবা আসা করেছিল আরও একটা শর্ত আসবে শাফকাতের কাছ থেকে। তবে তা এলো না। বরং তাকে বিস্ময়ের চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে দিয়ে, তার চোখ দুটোতে এক পলক গাঢ় নজরে তাকিয়ে, তার ঠোঁট দুটোকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে গেল শাফকাতের ঠোঁট।
শাফকাতের আকস্মিক এ কান্ডে ভয়ে, লজ্জায় বরফের মতো জমে গেল সাবা। তার বরফের ন্যায় শীতল ঠোঁটে যেন আগুন ছড়াচ্ছে শাফকাত। সে তো বেশ জানে, এই উষ্ণতাই এই মুহূর্তে সব থেকে বেশি দরকার সাবার।
কতক্ষণ পর যে সাবাকে শাফকাত ছাড়ালো, সে নিজেও জানে না। সাবার কপালে কপাল ঠেকিয়ে রাখলো। চোখে দুটো বুজে রেখে হাঁপাচ্ছে সাবা। আবারও হাসি ফুটে উঠলো শাফকাতের ঠোঁটের কোণে। এবার আর তাকে ফুটে উঠতে বাঁধা দিলো না।
লজ্জায় সাবার গাল দুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। টকটকে লাল সেই গালে গাঢ় একটা চুমু খেয়ে শাফকাত তার কানের সঙ্গে ঠোঁট মিশিয়ে ফিসফিস করে বলল, “যখন তখন আমার ঠোঁটে এভাবে চুমু খেতে হবে।”
শাফকাত আশা করেছিল আগের দুবারের ন্যায় এবারও
সাবা বাধ্য মেয়ের মতো বলবে, “খাবো।”
কিন্তু বলল না। তাতে অবশ্য কিছুই যায় আসে না। মানুষটা তো আজ থেকে তার। একেবারই তার, গোটা একটা জীবনের জন্যে!
(চলবে)
#লেবু
৪৫
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
রাতে ব্যালকনির হলদেটে লাইটগুলো নেভায় না শাফকাত। ব্যালকনির কাঁচের দরজা ও পর্দার পুরু আবরণ ভেদ করে সেই আলোটা পুরোপুরিভাবে ঘরে পৌঁছাতে না পারলেও, আবছা একটা আলোর আভা তৈরি করেছে। মাঝরাতে সাবার ঘুম ভেঙে গেলে যাতে ভয় তাকে কাবু করতে না পারে, তাই এ ব্যবস্থা। তবে সত্যিটা শাফকাত নিজেও জানে। অন্ধকারে সাবার ভয় নেই। তার ভয়ে অবহেলায়।
অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে একা একা বিছানায় শুয়ে আছে সাবা। কাঁধ পর্যন্ত ব্ল্যাঙ্কেট টেনে চোখ দুটো বুজে গভীর চিন্তায় মগ্ন সে। সাবা ভেবেছিল, যতই তার শরীরটা গুলিবিদ্ধ হোক না কেন, তার প্রতি সকলেই রেগে থাকবে। বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার জন্যে কেউই তাকে ক্ষমা করবে না। শাফকাত হয়ত কখনো দেখতেও চাইবে না তার মুখটা।
এই একাকিত্ব আর অবহেলায় ভয়েই মাঝেমধ্যে ঘুম ভেঙে যায় তার। তবে ঘুম ভেঙে গেলে নড়াচড়া করে না সে। শাফকাতের বাহুডোরে আটকা পড়ে থেকে নিজেকে ধাতস্থ করে। আশ্বাস দেয়, সে একা নয়, অবহেলিত নয়।
নিজের কাছে আজকাল নিজেকেই বড্ড অচেনা লাগে সাবার। যে মানুষটাকে সে কিনা সহ্যই করতে পারে না, যার কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্যে এত আয়োজন – তাকেই কিনা কেঁদেকেটে একাকার হয়ে অনুরোধ করলো ডিভোর্স না দেওয়ার জন্যে?
তবে নিজের এ সিদ্ধান্তে আফসোস নেই বিন্দুমাত্র। যে সিদ্ধান্ত গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে নিয়েছিল তাতে আছে, থাকবে আজীবন। যতই হোক শাফকাত তো তার স্বামী। রাগের মাথায় তার গায়ে হাত তুলে সে মোটেও ভালো কাজ করেনি। তাই বলে, তার গায়ে হাত তোলা নিশ্চয়ই সাবাকে পালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয় না।
সাবা লম্বা সময় ধরে ভাবতো, এই মানুষটাকে সে কোনো দিনও আপন করে নিতে পারবে না। এই মানুষটা আজীবন তার অপছন্দের তালিকাতেই রয়ে যাবে। কিন্তু গত দু মাস ধরে চোখের সামনে যাকে দেখছে, যার বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে, সে মানুষটার সঙ্গে আগেকার ওই গাম্ভীর্য পূর্ণ শাফকাতের কোনোই মিল নেই।
এই মানুষটা একেবারেই আলাদা। যেন একেবারেই তার নিজের। অপারেশনের পর থেকে শাফকাত তার এত এত যত্ন নিচ্ছে বলে এ ধারণা গড়ে ওঠেনি সাবার মাঝে। বরং, সাবার কথাগুলো শোনা, তাকে আশ্বাস দেওয়া, ভয়ের রাতে তাকে দুহাতে আগলে রাখা, মনটা ভার হয়ে থাকলে হাসানোর চেষ্টা করা – এসবেই একটু একটু করে দুর্বল হয়ে পড়ছে সাবা। নতুন করে প্রেমে পড়ে যাচ্ছে সে শাফকাত আলমের।
এই অনুভূতি আরও জোরালো হলো আজ সন্ধ্যায়। আচমকা এলো অরুণের ফোন। সাবা উৎফুল্ল ভঙ্গিতে তাকে সেদিনের ঘটনা বলল। শাফকাত ডিভোর্স পেপার এনে তার হাতে দিলো, আর কেমন নাটকীয় ভঙ্গিতে তাদের ডিভোর্স হতে হতেও হলো না।
অরুণ হঠাৎ কৌতূহলী গলায় বলে ওঠে, “শাফকাত ভাইয়া তোকে ডিভোর্স দিতে চাইলো কেন এটাই মাথায় ঢুকছে না!”
সাবা ইতস্তত করে বলল, “বললাম না? উনি না-কি বদলাবে না, এমনই থাকবে। যেটা আমি সহ্য করতে পারবো না। এসব ভেবেই ডিভোর্স দিতে চেয়েছিল।”
অরুণ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আবারও বলল, “আচ্ছা? ভাইয়া যদি না-ই বদলায়, তাহলে তুই ডিভোর্সে রাজি হলি না কেন? তোর তো বরাবরই তাকে নিয়ে সমস্যা।”
“এখন আর নেই।”
“তাই না-কি?”
সাবা শুকনো গলায় বলল, “হ্যাঁ। আর তাছাড়া বদলাতে হবেই বা কেন? উনি যেমন আছে তেমনই থাক। বদলাতে তো হবে আমাকে। শুরু থেকেই আমি উনাকে বোঝার চেষ্টা করিনি। ভাইয়ার চলে যাওয়া নিয়ে এতটাই ট্রমাটাইজড ছিলাম যে বিয়েটাকে বিয়েই মনে করিনি। ওয়াইফ হিসেবে আমি ব্যর্থ।”
অরুণ জোর গলায় বলল, “এসব কথা বলিস না তো সাবা। সময় তো এখনও ফুরিয়ে যায়নি। অতীতের সব যন্ত্রণা ভুলে গিয়ে সবটা নতুন করে শুরু কর।”
সাবা নিঃশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সেই চেষ্টাই তো করছি।”
“মন থেকে চেষ্টা কর সাবা। এই চেষ্টা তো আগেও একবার করেছিলি।”
সাবা শুকনো গলায় বলল, “সেবার তো…”
সবটা ভেস্তে গেল। তার জীবনে নতুন করে ফিরে এলো ফাহিম। তার এত বড় একটা ক্ষতি করা বাদেও তৈরি করে দিয়ে গেল দুজনের মাঝে পূর্বের থেকেও জোড়ালো, দীর্ঘ এক দেয়াল।
অরুণ তড়িঘড়ি করে বলল, “বাদ দে না! তুই অনেক সুখে থাকবি দেখিস। ভাইয়া তোকে যে পরিমাণ ভালোবাসে!”
সাবা কী যেন বলতে যাচ্ছিল। হঠাৎ তার সমস্ত মনোযোগ আটকে গেল ওই একটা শব্দে। ভালোবাসে? শাফকাত তাকে ভালোবাসা?
সাবার গলা শুকিয়ে গেল মুহূর্তেই। মনে হলো যেন সে পানিশূন্য মরুভূমিতে বন্দী। তৃষ্ণায় তার বুক ফেটে যাচ্ছে।
ঢোক গিলে সাবা বলল, “কী বললি? ভালোবাসে? শাফকাত আমাকে… আমাকে ভালোবাসে?”
অরুণ থমথমে গলায় বলল, “তো আর কাকে ভালোবাসবে?”
সাবা কয়েকটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো অরুণের কথাটা। নিজেকে বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করলো, সে যা বলছে তা ভুল কিছু নয়। কিন্তু বিশ্বাস কিছুতেই হলো না। শাফকাত ভালোবাসবে তাকে?
সাবা অবিশ্বাসের সুরে বলল, “কী যে তুই বলিস অরুণ! উনি আমাকে ভালোবাসবে কেন?”
“কারণ তুই তার বউ! সিম্পল!”
“না, ঠিক আছে। কিন্তু, আমাদের সম্পর্কটা তো আর দশটা স্বামী-স্ত্রীর মতো না।”
অরুণ দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “তাতে কী? বিয়ে শব্দটার একটা জোড় তো আছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি সাবা। তুই যখন আইসিইউতে ছিলি, যখন তোর জ্ঞান ফিরছিল না, তখন ভাইয়ার চোখ দুটোতে সারাক্ষণ একটা উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগ। এক দৃষ্টিতে আইসিউর দরজার দিকে তাকিয়ে থাকতো। তাছাড়া এখনও তোকে কত যত্নে আগলে রাখে। তুই টের পাস না তার ভালোবাসা?”
সাবা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আমি?”
কিছুই সে টের পায় না বললে মস্ত ভুল হবে। শাফকাতের উদ্বিগ্ন চাহনি, আগ্রহ নিয়ে তার কথা শোনা, তার ছোট ছোট আবদারগুলো পূরণ করা, ঘুমের ঘোরে সাবাকে বুকের মাঝে আগলে রাখা – এসবের মাঝেই লুকিয়ে আছে প্রবল এক উষ্ণতা। যে উষ্ণতায় নিজেকে মুড়িয়ে রাখতে চায় সে আজীবন। তবে এই উষ্ণতার নামই কি ভালোবাসা?
সাবা আর কিছুই ভাবতে পারলো না। বিছানা হাতড়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে স্ক্রিন অন করল, সময়টা দেখেই আবার রেখে দিলো। রাত বারোটা আটত্রিশ। শাফকাত সেই যে সাবাকে শুইয়ে দিয়ে স্টাডি রুমে গেল, আর ফেরার নামগন্ধ নেই। এদিকে এতক্ষণ চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারলো না সাবা। চোখ দুটো বুজতেই একটা না একটা অস্পষ্ট চিন্তায় জড়িয়ে যাচ্ছে মস্তিষ্ক।
মিনিট দশেক পর হঠাৎ দরজার শব্দ কানে এলো। অন্ধকারে সাবা তাকে দেখতে পাচ্ছে না ঠিকই, তবে তার উপস্থিতি টের পেতে মোটেও অসুবিধা হলো না। মিন্ট শ্যাম্পু আর কড়া কোলনের গন্ধ নিমিষেই ছড়িয়ে পড়লো সারা ঘরে। সেই সঙ্গে ছড়িয়ে গেল তার চির চেনা সেই উষ্ণতা। শাফকাত এখনো দরজার কাছে। তবুও সেই উষ্ণতা ঝড়ের গতিতে উড়ে এসে স্পর্শ করলো সাবাকে।”
সাবা নড়লো না। আগের ভঙ্গিতেই শুয়ে রইলো। এত রাত অবধি জেগে আছে জানলে শাফকাত আবার রাগ করবে।
শাফকাত বেডসাইড টেবিলে নিজের মোবাইল দুটো রেখে, বিছানায় আধশোয়া হয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে সাবাকে। মৃদু কেঁপে উঠলো সাবা। সেই কম্পন আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে শাফকাত মুখ ডুবিয়ে দিলো তার চুলের মাঝে। এই কয়েক মুহূর্তেই কতগুলো চুমু যে দিলো, তার হিসাব বোধ হয় তার কাছেও নেই।
সাবার তীব্র কম্পন তাকে ধরা পড়ে যেতে বাধ্য করলো। তবে সে জেগে আছে বলে রাগ করলো না শাফকাত। তার কানের কাছে ঠোঁট এনে ফিসফিস করে বলল, “ঘুমাওনি?”
শিউরে উঠলো সাবা। শাফকাতের কণ্ঠ এমনিতেই মাদকের মতো। একবার শুনলে বারবার শুনতে ইচ্ছা হয়। আর সেই কণ্ঠে যখন ফিসফিস করে কথা বলে, তাও আবার এত কাছ থেকে, স্রেফ মূর্ছা যেতে ইচ্ছা করে সাবার।
নিজেকে কোন মতে সামলে সে অস্পষ্ট গলায় বলল, “উঁহুঁ। কোথায় ছিলেন?”
শাফকাত সাবাকে ছেড়ে তার পাশে শুয়ে পড়তে পড়তে বলল, “অফিসের জরুরি একটা কাজ পড়ে গিয়েছিল।”
“ও।”
সাবা সঙ্গে সঙ্গে শাফকাতের দিকে ফিরে নির্দ্বিধায় তার বুকে মাথা রাখলো। এই একটা কাজে তার সকল লজ্জারা ছুটে পালায়। সংকটের দিনগুলোতে এই বুকটাই তো তার সব থেকে বড় আশ্রয় হয়ে ছিল। সাবা চোখ বুজে শুনছে শাফকাতের শান্ত হৃদয়ের ধুকপুক। শাফকাতও সযত্নে জড়িয়ে ধরলো তাকে।”
মৃদু হেসে বলল, “এই বদভ্যাস করে কিন্তু নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনলে সাবা।”
সাবা খুব ভালো করেই জানে কোন বদভ্যাসের কথা শাফকাত বলছে। তার বুকে মাথা রেখে ঘুমানোর অভ্যাস। বদভ্যাস এমন সীমায় পৌঁছেছে যে, তার বুকে মাথা না রেখে ঘুমানোর কথা ভাবাই দুষ্কর। তার বুকে মাথা রাখলেই আবার সব ঠিকঠাক। এই যেমন একটু আগে কিছুতেই ঘুম আসছিল না। কিন্তু এখন সাবার মনে হলো, চারদিক থেকে ঘুমেরা এসে ঘিরে ধরেছে তাকে। এখনই সে তলিয়ে পড়বে ঘুমের রাজ্যে।
সাবা চোখ দুটো বুজে রেখেই বলল, “কীভাবে?”
শাফকাত সাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “যখন আমি দূরে কোথাও যাবো…”
সাবা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “কোথায় যাবেন?”
শাফকাত হালকা গলায় বলল, “না মানে, বিজনেস ট্যুরে তো মাঝেমধ্যেই আমাকে দেশের বাইরে যেতে হয়। তখন কী করবে?”
সাবা জোর গলায় বলল,“তখনও এভাবেই ঘুমাবো। আপনি যেখানেই যাবেন, আমাকে সাথে করে নিয়ে যাবেন।”
সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে উঠলো শাফকাতের ঠোঁটের কোণে।
প্রশংসার সুরে সে বলল, “হুম! এত ইমপ্রুভমেন্ট?”
সাবা ঘুমে আচ্ছন্ন গলায় বলল, “আমাকে সাথে নেবেন না?”
শাফকাত আশ্বাস দিতে নরম স্বরে বলল, “নেবো তো।”
“শাফকাত?”
“হুঁ?”
“আমার আরেকটা একটা কথা রাখবেন?”
“কী কথা?”
সাবা জড়ানো কণ্ঠে বলল, “কাল সারাদিন আমি একটাও ওষুধ খাবো না। আর আপনিও আমাকে কিচ্ছু বলতে পারবেন না।”
শাফকাত হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, “সাবা! একটা স্মার্ট মেয়ে হয়ে তুমি এই কথা কীভাবে বলতে পারো? ওষুধ না খেলে সুস্থ হবে কীভাবে?”
সাবা আলস্যের ভঙ্গিতে বলল, “একদিন ওষুধ না খেলে কী আর হবে? সুস্থ হওয়া একদিন
পিছিয়ে যাবে? যাক!”
মাস কয়েক আগের শাফকাত হলে ঠিক এই পরিস্থিতিতে তর্কে জড়িয়ে যেত সাবার সঙ্গে। মৃদু ধমকও দিয়ে বসতো। তবে সে যে আসলেই বদলে গেছে, এর প্রমাণ স্বরূপ সেসব কিছুই করলো না।
উল্টো শান্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো, “ওষুধে সমস্যাটা কী?”
সাবা লম্বা একটা হাই তুলে বলল, “ওষুধগুলোতে শুধু ঘুম পায়। সকালের ওষুধ খাওয়ার পর দুপুর পর্যন্ত ঝিম মেরে বসে থাকি। দুপুরের ওষুধ খেয়ে তো ঘুমিয়েই পড়ি। আর দেখুন, রাতের ওষুধের পর চোখই খুলে রাখতে পারছি না। কথাগুলো কেমন মাতালদের মতো জড়িয়ে যাচ্ছে।”
শাফকাত হেসে ফেলে বলল, “ঘুমই তো ভালো। যত ঘুমাবে তত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে।”
“কিন্তু আমার আর ঘুমাতে ভালো লাগে না।”
শাফকাত অন্যরকম গলায় বলল, “একবার পুরোপুরি সেরে ওঠো, তারপর যত ইচ্ছা জেগে থেকো। ইনফ্যাক্ট, আমি নিজে এমন ব্যবস্থা করবো যাতে সারারাত একফোঁটাও ঘুমাতে না পারো তুমি।”
চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেল সাবার। ঘুম ঘুম ভাব নিমিষেই উড়ে পালিয়ে গেল। নিজেকে সে দেখতে পাচ্ছে না ঠিকই, তবে নিশ্চিতভাবে বলতে পারে গাল দুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।
আকস্মিক এই নীরবতায় আবারও স্ফীত হেসে উঠলো শাফকাত। আরেকদফা সাবাকে এলোমেলো করে দিয়ে গাঢ় একটা চুমু খেলো তার গালে। সাবা জোরালোভাবে কেঁপে উঠে মুখ লুকিয়ে ফেলল তার বুকে।
কয়েক মুহূর্তের নীরবতার পর শাফকাত হঠাৎ অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলে উঠলো, “I owe you an apology.”
সাবা কৌতূহলী গলায় বলল, “কেন?”
শাফকাত থমথমে গলায় বলল, “সেদিন তোমাকে ওই কথাগুলো বলার জন্য। বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, কিন্তু একটা কথাও আমি মন থেকে বলিনি। নিজেকে সামলাতে না পেরে… I just messed up.”
ঘুমের ঘোর কিংবা শাফকাতের আকস্মিক আদর, সাবা জানে না কীসের ধাক্কায় তার চিন্তারা সব তালগোল পাকিয়ে গেছে। বুঝতেই পারলো না শাফকাত কোন ঘটনার কথা বলছে।
সাবা বিভ্রান্ত গলায় বলল, “বুঝলাম না। কোন দিনের কোন কথার জন্য ক্ষমা চাচ্ছেন?”
“যেদিন ফাহিম তোমার অফিসে এলো, তুমি বাড়ি ফিরলে আর…”
সাবার মনে পড়ে গেল সেদিনের ওই কথাগুলো। শুধু একটা চড় নয়। ওই কথাগুলোও তাকে ওই ভুল সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
ওসব নিয়ে আর মাথা ঘামাল না সাবা। নিতান্তই হালকা গলায় বলল, “ওহ! It’s okay.”
এক সেকেন্ডের মাথায় আবার কী যেন মনে
করে বলল, “না!”
শাফকাত বিস্মিত গলায় বলল, “কী?”
“It’s not okay.”
“মানে?”
সাবা অভিযোগের সুরে বলল, “আপনি বারবার এসব তিক্ত প্রসঙ্গ টেনে আনেন কেন আমাদের মাঝে? যখনই আপনার সঙ্গে একটা ভালো মুহূর্ত কাটানোর চেষ্টা করি, তখনই এসব মনে করিয়ে দিয়ে মনটা খারাপ করে দেন। কেন?”
শাফকাত কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে বলল, “আচ্ছা, সরি! আর মনে করাবো না।”
“প্লিজ করাবেন না। অসহ্য লাগে! এখন থেকে মনে করবেন, গতকালই আমাদের বিয়ে হয়েছে।”
শাফকাত অবাক হয়ে বলল, “গতকাল?”
সাবা সোজাসাপ্টা উত্তরে বলল, “হ্যাঁ। এতদিন তো কেমন দ্বিধার মাঝে ছিলাম। গতকালই তো সব দ্বিধা মিটে গেল। এতদিন আমার মাঝে যতটুকু যা খারাপ দেখেছেন তা আপনি মুছে নিন, আর আপনার খারাপটুকু আমি মুছে নেবো।”
“আর ভালোটুকু?”
“আপন করে নেবো!”
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শাফকাত বলল, “নাহ্! তোমাকে নিয়ে দিনের পর দিন ভুল ধারণা পুষে রেখেছিলাম।”
“তাই না-কি? কী ধারণা করেছিলেন?”
“প্রথম প্রথম মনে করতাম তুমি আস্ত একটা বেয়াদব মেয়ে।”
সাবা আহত ভঙ্গিতে মাথা তুলে তাকালো শাফকাতের দিকে।
তার আহত দৃষ্টিতে এক খণ্ড হাসি নিক্ষেপ করে শাফকাত আবারও বলল, “তারপর মনে হলো তুমি নিতান্তই রোবটিক একটা মেয়ে।”
সাবা আগ্রহ নিয়ে বলল, “আর এখন?”
“এখন মনে হচ্ছে তুমি একেবারেই অন্যরকম। সবার চাইতে আলাদা।”
সাবা গা বেয়ে অন্যরকম একটা হাওয়া বয়ে গেল। উষ্ণতায় ঘেরা জাদুময় এক হাওয়া।
সাবা হঠাৎ আগ্রহ নিয়ে বলল, “আচ্ছা? আপনার বাবাকে যদি আমাকে বিয়ে করার জন্যে আপনাকে বিয়ে না করতেন, তাহলে নিশ্চয়ই নিজে পছন্দ করে বিয়ে করতেন!”
“সম্ভবত।”
“কেমন মেয়ে আপনার পছন্দ?”
শাফকাত কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, “হুম! চিন্তায় ফেলে দিলে।”
সাবা আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে উত্তরের প্রত্যাশায়।
চিন্তাভাবনা শেষে শাফকাত অন্যরকম গলায় বলল, “যে অসম্ভব সুন্দর, যার ভয়ানক তেজ, আমার মুখের ওপর তর্ক করার সাহস যার আছে, আমার বুকে মাথা না রেখে যার ঘুম হয় না। আর…”
“আর?”
“যার নামের শুরু ‘S’ দিয়ে।”
খিলখিল করে হেসে উঠলো সাবা। কে জানতো ঝগড়া আর একে অপরকে সহ্য না করতে পারার অবসান এত সুন্দর হবে?
(চলবে)