#লেবু
শেষ পর্ব
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
সাবার চোখদুটো বেয়ে অনবরত গড়িয়ে পড়ছে অবাধ্য অশ্রুরা। গত কয়েকদিনে তার মাঝে ফুটে ওঠা সাহসী-দৃঢ় মেয়েটা কোথায় যে হারিয়ে গেল কে জানে? মানুষ যে তীব্র আনন্দেও এতটা ভেঙে পড়তে পারে, সাবাকে না দেখলে তা বোঝার উপায় ছিল না।
ফারহানাকে পুলিশ গ্রেফতারের পরপরই নিজের সব দোষ স্বীকার করেছে সে। তাকে কোর্টে উপস্থাপনের সাথে সাথেই আদালত শাফকাতের জামিন মঞ্জুর করেন। আর কয়েকটা শুনানির পর হয়তো এই মামলা থেকে চিরতরে অব্যাহতি দেওয়া হবে তাকে।
চোখের জল ফেলতে ফেলতেই গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছে সাবা। তার দৃষ্টি কারাগারের মূল দরজার দিকে আবদ্ধ। সেখান থেকেই একটু পর বেরিয়ে আসবে তার কাঙ্ক্ষিত মানুষটা। যাকে দেখার জন্যে হৃদয়টা ব্যকুলভাবে ছটফট করছে। চোখদুটো তৃষ্ণায় ডুবে একাকার।
আর বেশিটা সময় অবশ্য দমবন্ধকর এই অপেক্ষার মাঝে কাটাতে হলো না সাবাকে। তার অপেক্ষা পূর্ণতা পেলো মিনিট দশেক বাদে। কারাগারের মূল দরজা থেকে বেরিয়ে এলো শাফকাত। সে বেরিয়ে আসতেই তার বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তারা ঘিরে ধরলো তাকে। শাফকাত অবশ্য অগ্রাহ্য করলো সকলকে। তারও তৃষ্ণার্ত চোখদুটো যে ব্যস্ত কেবল একটাই মানুষকে খুঁজতে।
সাবার পাদুটো যেন মুহূর্তেই অবশ হয়ে এলো। হৃদস্পন্দন এক লাফে বেড়ে গেলো। এক খন্ড রোদ এসে পড়েছে ছেলেটার মুখের ওপর। এত ঝড়-ঝাপটা পেরিয়েও শাফকাতকে বরাবরের মতোই স্নিগ্ধ লাগছে।
ধীর পায়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে দাঁড়ালো সাবা। শাফকাতের ব্যস্ত চোখদুটো তাকে খুঁজে পেতেই এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটজুড়ে। সেই হাসি এক নিমিষেই অস্থিরতায় জর্জরিত হৃদয়টাকে প্রশান্তিতে জুড়িয়ে দিলো।
শাফকাত ব্যস্ত পায়ে হেঁটে এগিয়ে এলো তার দিকে। অফিসের কর্মকর্তারা তার পিছু নেওয়ার আর সাহস পেলো না। সাবা বরফের মতো জমে গিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা জায়গাতেই। শাফকাত এগিয়ে এসে তার হাতটা ধরলো।
আরও প্রবল গতিতে সাবার দুচোখ বেয়ে সমান তালে গড়িয়ে পড়লো। এই স্পর্শ, এই চাহনির সবটাই তো মিশে রয়েছে তার অস্তিত্বে। এসব ছাড়া এই কয়েকটা দিন কী করে বেঁচে ছিল সাবা, তা কেবল তারই জানা।
শাফকাত মুখে কিছুই বলল না। ইশারায় সাবাকে গাড়িতে উঠে বসতে বলল। সাবাও বাধ্য মেয়ের মতো বিনা বাক্য ব্যয়ে উঠে বসলো গাড়ির ব্যাকসিটে। শাফকাত তার পিছু পিছু গাড়িতে উঠে বসেই ঝড়ের গতিতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে।
সাবার কান্নারা যেন বেগ পেলো আরও একবার। শাফকাতের বুকে লেপ্টে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সাবা। একটা স্বস্তিমাখা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো শাফকাতের বুক থেকে। তার লেবু ঠিক এভাবেই তার বুকে বুকে লেপ্টে না মনে হয় যেন প্রত্যেকবার শ্বাস নেওয়ার পর ফুসফুসের বড় একটা অংশ ফাঁকা রয়ে গেছে। এখন আর তা মনে হচ্ছে না।
অবশেষে দীর্ঘ নীরবতা ভঙ্গ করে শাফকাত সাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে হালকা গলায় বলল, “কাঁদছো কেন লেবু? আমি চলে এসেছি না?”
সাবা তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আর সুযোগ পেলো কই? তার চিন্তা-ভাবনা সব আটকে গেল ওই একটা ডাকে, “লেবু”। একটা সময়ে এই ডাকটাকে মারাত্মক অসহ্য লাগতো সাবার। তবে এই কয়েকটা দিন ওই ডাক ছাড়া বেঁচে থেকে মনে হয়েছে যেন জীবনটাই অর্থহীন।
শাফকাতের বুকে মুখ লুকিয়ে তাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
শাফকাত মৃদু ধমকের সুরে বলল, “এই মেয়ে! এত কান্নাকাটি করলে কিন্তু আবারও চলে যাবো।”
সাবা বাচ্চাদের মতো অভিযোগের সুরে শাফকাতের বুকে মুখ লুকিয়ে রেখেই বলল, “না!”
সাবা তার অবাধ্য অশ্রুদের শাসন করার কোনো চেষ্টা পর্যন্ত করলো না। সবসময় তো আর তাদের শাসন করা যায় না। মাঝে মধ্যে নির্বিঘ্নে বহিঃপ্রকাশের সুযোগ দিতে হয়। কান্না এমনই একটা জিনিস, যা মনের গভীরতম ভাঁজে জমে থাকা অনুভূতিকে শব্দের বেড়াজালে আবদ্ধ না করেই প্রকাশ করতে পারে। সাবার কান্নার মাঝেও প্রকাশ পাচ্ছে তার মনে জমে থাকা আনন্দ আর এতদিন ধরে শাফকাতকে দেখার আকুলতা।
সাবা শাফকাতের বুক থেকে মুখ তুলে চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে না?”
শাফকাত মৃদু হেসে তার দুহাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে দুচোখের জল মুছে দিয়ে বলল, “তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে?”
সাবা আর্দ্র গলায় বলল, “হয়েছে তো। তোমাকে ছাড়া আমি ঘুমাতে পারি?”
শাফকাত হতাশ গলায় বলল, “এই কতগুলো দিন ঘুমাওনি না?”
“হুঁ।”
সাবার মাথার একপাশে চুমু খেয়ে শাফকাত আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “আমার কোনো কষ্ট হয়নি সাবা। আমি জানতাম, আমার লেবু আমাকে ওখানে বেশিদিন থাকতে দেবে না।”
“কীভাবে জানতে?”
“বিশ্বাস থেকে। তুমি জানো না আমি তোমাকে সবথেকে বেশি বিশ্বাস করি?”
আরও একবার শাফকাতকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সাবা। এই দুটো মানুষ বছরখানেক আগেও পাশাপশি থাকলে ঝগড়া বেঁধে যাওয়া ছিল অবশ্যম্ভাবী। অথচ এই দুটো
মানুষই আজ পরস্পরকে জড়িয়ে রাখে অগাধ বিশ্বাস আর সীমাহীন ভালোবাসায়।
“সাবা?”
“হুঁ?”
শাফকাত হঠাৎ অন্যরকম গলায় বলল, “সরি।”
সাবা অবাক গলায় বলল, “কেন?”
শাফকাত অনুতাপমাখা সুরে বলল, “For disappointing you.”
“কিন্তু তোমার তো কোনো দোষ ছিল না শাফকাত।”
শাফকাত তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “দোষ ছিল না তবুও ফেঁসে গেলাম। একেই বলে রিভেঞ্জ অফ নেচার। আরশাদের সাথে কাজটা তো আমি ঠিক করিনি।”
সাবা অবিশ্বাসের সুরে বলল, “তুমি নিজে থেকে বুঝতে পারছো কাজটা ঠিক হয়নি?”
শাফকাত সাবার গালে হাত রেখে বলল, “নিজে থেকে তো বুঝিনি। তুমি বুঝিয়েছো।
এত কান্নাকাটির মাঝে এই প্রথম উজ্জ্বল একটা হাসির রেখা ফুটে উঠলো সাবার ঠোঁটের কোণে। এই শাফকাতকে দেখার জন্যেই তো সেই কবে থেকে উশখুশ করছিল তার মনটা।
সাবা হঠাৎ কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকলো, “শাফকাত?”
“হুঁ?”
কয়েকটা মুহূর্ত চুপ করে থেকে সাবা বলল, “আমার তোমাকে কিছু বলার আছে।”
শাফকাত আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “বলো।”
সাবা কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুললেও শেষমেশ বলল না মনের কথাটা। এড়িয়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “না থাক।”
শাফকাত ভ্রু কুঁচকে বলল, “থাক মানে? এখন তো বলতেই হবে!”
“বলবো তো। পরে বলবো।”
“না এখনই বলতে হবে।”
সাবা হেসে ফেলে বলল, “তোমার ডমিনেন্স আর গেল না, না?”
শাফকাত হালকা গলায় বলল, “কোনোদিন যাবেও না। বলো তো কী বলবে!”
সাবা রহস্যের ভঙ্গিতে বলল, “এখন যাবে।”
শাফকাত কৌতূহলী গলায় বলল, “কেন যাবে?”
“কারণ…”
সাবা পরপর কয়েকবার শুকনো ঢোক করলো। শাফকাতের উদগ্রীব চাহনি তার হৃদস্পন্দন যেন আরেকটু বাড়িয়ে দিলো।
অবশেষে সকল দোনমনো সরিয়ে রেখে গোপন কথাটা সাবা বলেই ফেলল, “তুমি বাবা হবে শাফকাত।”
শাফকাত আকাশ থেকে পড়ে বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলল, “কী?”
শাফকাতের বিস্ময় আরও একবার ভিজিয়ে দিলো সাবার চোখদুটো। সাবা আর্দ্র চোখে উজ্জ্বল একটা হাসির রেখা ঠোঁটে টেনে বলল, “তুমি বাবা হবে।”
শাফকাতের বিস্ময় যেন থামতেই চাইছে না। চোখেমুখে তরঙ্গের ন্যায় খেলে বেড়াচ্ছে সেই বিস্ময়।
সাবাকে জড়িয়ে ধরে শাফকাত উচ্ছ্বাসের ভঙ্গিতে বলল, “এই কথাটা তুমি আমাকে এতক্ষণ পর বললে?
“তুমি খুশি হয়েছো?”
“খুশি হয়েছি মানে? এতটা খুশি আমি কখনোই হইনি।”
•
তিন বছর পর,
রোদের আলোয় ঝলমল করছে বাগানের গাছপালা আর সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম করে কাটা ঘাসগুলো। আকাশটাকে আজ যেন একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। স্বচ্ছ নীল আকাশের গায়ে কেউ যেন সাদা রঙয়ের মেঘ ছড়িয়ে দিয়েছে। সচরাচর দেখা মেলে না এমন আকাশের।
এক খন্ড রোদ এসে পড়েছে সাফার মুখের ওপর। তার ছোট্ট মায়ামাখা মুখটা জুড়ে উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে রোদ। গুটি গুটি পায়ে বাগানজুড়ে ছুটে বেড়াচ্ছে সাফা। বাবাকে ধরাধরিতে হারাতে তার ব্যস্ততার শেষ নেই।
তবে শাফকাত আজ নিজে হেরে গিয়ে মেয়েকে জেতার সুযোগ করে দিলো না। পেছন থেকে ছুটে এসে ধরে ফেলল সাফাকে। হেরে গিয়েও বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই তার। বরং খিলখিল করে হেসে উঠলো বাবাকে জড়িয়ে ধরলো সাফা।
গায়ের নিচে ছায়ায় বেতের সোফার ওপর বসে দূর থেকে দৃশ্যটা দেখছে সাবা। তার মনটা জুড়ে যেন দখিনের হিমেল হাওয়া বয়ে গেল। মেয়েটার এই হাসির শব্দ যেন তাদের নিশ্চুপ ঘরে বয়ে এনেছে অবর্ণনীয় আনন্দ। সাফা আসার আগে শাফকাত আর সাবা কোনোদিন বুঝতেই পারেনি তাদের জীবনে অদৃশ্য এক শূন্যতা ছিল। যতদিনে বুঝতে পেরেছে, ততদিনে পূর্ণতা পেয়েছে সেই শূন্যতা।
শাফকাত মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে কী যেন জিজ্ঞেস করলো তার কানে কানে। সাফা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে জবাব দিলো ফিসফিস করে। কী অদ্ভুত ব্যাপার! এক কালের সেই অনুভূতিহীন-গম্ভীর ছেলেটা কোথায় হারিয়ে গেল? সাফা পৃথিবীতে আসার পর থেকে রোজ রোজ যেন নতুন এক শাফকাতকে দেখছে সাবা।
সাবা কোনোদিনও ভাবতে পারেনি এত সুন্দর একটা ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে তার জন্যে। যে ভবিষ্যতে কোনো অন্ধকার নেই, যন্ত্রণা নেই, তিক্ততা নেই, আছে কেবল ভালোবাসার ছড়াছড়ি।
শাফকাত মেয়েকে কোলে নিয়ে এগিয়ে এসে বসলো সাবার পাশে।
উৎফুল্ল গলায় বলল, “তোমার মেয়ে এইমাত্র আমাকে কী বলল জানো?”
সাবা আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কী?”
শাফকাত সাফল্যের হাসি হেসে বলল, “ও আমাকে সবথেকে বেশি ভালোবাসে।”
সাবা বড় বড় চোখে তাকালো মেয়ের দিকে।
সাফা বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে জোর গলায় বলল, “বাবা তো আমাকে চকলেট দেয়, তুমি দাও না।”
সাবা শাফকাতের দিকে তাকিয়ে ভ্রু ওপরে তুলে বলল, “এই তোমার সিক্রেট? মেয়ের প্রিয় হওয়ার জন্য চকলেটের ঘুষ দেওয়া?”
শাফকাত বাঁকা হাসি হেসে বলল, “এটাকে ঘুষ বলে না লেবু।”
“তাহলে কী বলে?”
“স্ট্র্যাটিজি। যেটা তোমার নেই।”
সাবা ভেংচি কেটে বলল, “লাগবেও না। তুমিই তোমার বাঁদর মেয়ের প্রিয় হয়ে থাকো।”
সাফা ঠোঁট উল্টে অভিযোগের সুরে বলল, “বাবা!”
শাফকাত ব্যস্ত গলায় বলল, “তুমি আমার সামনে আমার মেয়েকে বাঁদর বলছো? এত সাহস তুমি কোথা থেকে পাও লেবু?”
সাফা ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, “তুমি মাকে বকে দাও তো বাবা।”
শাফকাত জোর গলায় বলল, “দিচ্ছি তো। তুই গিয়ে খেল, আমি এক্ষনি মাকে বকে দিচ্ছি।”
সাফা বাবার কোল থেকে নেমে ছুটতে ছুটতে তার খেলনাগুলোর কাছে চলে গেল। শাফকাত এগিয়ে এসে সাবার গা ঘেঁষে বসে এক হাতে জড়িয়ে ধরলো তাকে।
সাবা তীক্ষ্ম গলায় বলল, “কই? বকবে না?”
শাফকাত হালকা গলায় বলল, “আজ আর ইচ্ছা করছে না। তার মানে কিন্তু তুমি বেঁচে গেলে না। কাল মনে করে বকা নিয়ে নিও।”
সাবা হেসে ফেলে মাথা রাখলো শাফকাতের বুকে। শাফকাত আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। দুজনেই স্নিগ্ধ চোখে তাকিয়ে রয়েছে তাদের রাজকন্যার দিকে।
শাফকাত অন্যমনস্ক গলায় বলল, “আমি সবসময় এই জীবনটাই চেয়েছিলাম।”
সাবা তার বুক থেকে মাথা তুলে কৌতূহলী গলায় বলল, “কোন জীবন?”
শাফকাত তার মোহনীয় কণ্ঠে বলল, “লেবুময় জীবন।”
হেসে ফেলল সাবা। তার দেখাদেখি শাফকাতও হেসে ফেলল। সেই হাসির ঔজ্জ্বল্যেই যেন ঝলমল করে উঠলো চারিপাশ।
(সমাপ্ত)