শখের বালা পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
30

#শখের_বালা (শেষ)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

মা আমার হাতটি ধরে শান্ত গলায় বলে,“তোকে কথা দিতে হবে তুই সারাজীবন ভালো কাজ করবি। কখনো কোন পরিস্থিতিতে তোর বাবার মতো বা তারচেয়ে খারাপ কোন কাজে যুক্ত হবি না। নিজের আম্মাকে ছুঁয়ে এই কথা তুই দিতে পারবি? শুধু এই একটি শর্ত মানলেই আমি তোকে ক্ষমা করে দিবো।”

“আমি কথা দিলাম আম্মা। আমি কখনো কোন খারাপ কাজ করবো না। আর জীবনেও না। যতই তুমি তোমার শখের বালার জন্য কান্না করো না। আমি কখনো আর খারাপ কাজ করবো না।”
আমার থেকে এমন কথা নিয়ে মা খুশি হন। সে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে।তারপর বলে,“আমার কান্না দেখে তোর খুব কষ্ট হচ্ছিলো?”

“হ্যাঁ আম্মা। আমার মনে হচ্ছিলো এখনই গিয়ে তোমার জন্য বালা জোড়া নিয়ে আসি। তবে…।”

“তবে?”
মায়ের এই কথায় মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আমি বললাম,“তারচেয়ে বেশি কষ্ট হয়েছে কাল তুমি আমার দিক দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায়। আম্মা আমার ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছিলো, এক যন্ত্রণা। একদম শেষ হয়ে গিয়েছিলো।”

“আচ্ছা আমি আর কখনো তোর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবো না। তবে এই কথা আমি ততক্ষণ অব্দি রাখবো যতক্ষণ অব্দি তুই ভুল পথে পা না বাড়াবি। যদি এরকম ভুল বা এরচেয়ে কোন ভুল করিস তবে অবশ্যই আমি তোর সঙ্গে চিরদিনের জন্য কথা বলা বন্ধ করে দিবো।”
এই কথা শুনে আমি ভীষণ ভয় পেয়ে যাই। আমি মাকে বুকে জড়িয়ে রেখে কথা দিয়েছি, আমি জীবনে আর কখনো ভুল কাজ করবো না। সেই রাতে আমি মাকে আরও একটি কথা দিয়েছি তাহলো,“আম্মা আমি বড় হয়ে সৎপথে রোজগার করে তোমার জন্য একজোড়া ওমন বালা কিনে নিয়ে আসবো। তখন তুমি আবার মুখ ফিরিয়ে নিবে না তো?”

“না। যদি তুই সৎ পথে আমার জন্য বালা নিয়ে আসিস তবে আমি খুশিমনে সেটা আমার হাতে পড়বো।”
মায়ের এই কথায় আমি ভীষণ খুশি হয়ে যাই। সেই রাত থেকে আমি স্বপ্ন দেখা শুরু করে দিয়েছি। আমি অনেক পরিশ্রম করে টাকা যোগাঢ় করে মায়ের জন্য সেরকম একজোড়া বালা কিনেছি। নিজ হাতে মায়ের হাতে বালাজোড়া পড়িয়ে দিয়েছি। সেই রাতে আমার মা আমাকে কথা দেয়, আমার নিয়ে আসা বালা আমার মা সবসময় হাতে পড়ে থাকবে।

____
এতক্ষণ অব্দি আমার কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনে শাওন। সে হতভম্ব গলায় বলে,“এসব কথা আপনি আমাকে শোনাচ্ছেন কেন?”

“মনে হলো আমার এই জীবন যুদ্ধ তোমাকে শোনাই। তুমি জানো তারপর থেকে আমি লেখাপড়ার পাশাপাশি কাজ করেছি। যখন যেটা পেয়েছি৷ সেখান থেকে কিছু টাকা জমাতাম। সেই জমানো টাকা দিয়ে আমি আমার মায়ের জন্য একজোড়া বালাও কিনেছি।”
আমার এই কথা শুনে শাওন ম্লান হেসে বলে,“বেশ তো। ভালো কাজ করেছেন। আপনার মা নিশ্চয় সেই বালা দেখে খুব খুশি হয়েছে?”

”না। সেই বালা নিয়ে এখনো আমি আমার আম্মার কাছে পৌঁছাতে যে পারিনি।”
আমার এই কথা শুনে শাওন অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। আমি মিষ্টি হেসে বলি,“তুমি চাইলে আমি আমার বালাজোড়া নিয়ে আমার আম্মার কাছে যেতে পারি।”

“আমি চাইলে মানে?”
শাওন কিছু একটা ভেবে ভয় পাচ্ছিলো। তার ভয়টা আমি বুঝতে পেরে বললাম,“আসলে বালা কিনতে গিয়ে আমার সব টাকা শেষ। এখন বাড়ি যাওয়ার ভাড়া নেই৷ তুমি কী আমাকে আমার বাড়ি অব্দি নিয়ে যাবে?”

“এজন্য আপনাকে বাড়ি অব্দি নিয়ে যেতে হবে কেন?
আমি আপনাকে ভাড়া দিয়ে দিচ্ছি আপনি চলে যান।”
শাওন যেন কোন কিছু ভেবে নিশ্চিন্ত হয়। অর্থাৎ তার ভাবনা সঠিক হয়নি। যেই ভাবনায় তার চোখেমুখে ভয় ফুটে উঠেছিলো। সে যা ভাবছিলো তেমনটা যে আমি নই বুঝতে পেরে সে হাফ ছেড়ে বাঁচে। তার মুখের ভয়ও দূর হয়ে যায়। তার কথার জবাবে আমি বললাম,“সম্ভব নয়। আমার আম্মা তাহলে আমার দেওয়া বালাজোড়া পড়বে না। কারণ আমার আম্মা চায় আমি যদি রাস্তায় কারো সাহায্য নেই তবে তাকে আমার বাড়িতে যেন নিয়ে আসি। সে আমার বাড়িতে অন্তত এক গ্লাস পানি পান করুক, খাবার না খেলেও। তবেই আমার আম্মা শান্তি পায়। তাই শুধু তোমার ভাড়া দিয়ে আমার চলবে না গো।
তোমার টাকা আমি তখনই নিতে পারবো যখন তুমি আমার বাড়িতে আমার সঙ্গে যাবে এবং আমার মা তোমাকে যত্ন সহকারে এক গ্লাস পানি দিবে সেটা পান করবো। চাইলে খাবারটাও খেতে পারো।”
এই রাতের অন্ধকারে অচেনা এক ব্যক্তির এমন আবদার শাওনের পছন্দ হলো না। সেই সাথে আমি চোর, ডাকাত ছিনতাইকারী হতে পারি সেই ভয়টাও তার মাঝে কাজ করছে। আমি বুঝতে পেরে ম্লান হেসে বললাম,“ভয় পেও না। আমাকে তুমি সাহায্য করো, তারপর আমি নিজে তোমাকে তোমার বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিবো।”
শাওন রাজি হচ্ছিলো না। তবে আমি আমার কথার দ্বারা তাকে রাজি করালাম। ছোটবেলা থেকে এই একটি গুন আমার বেশ রয়েছে। যেকোন মানুষকে খুব ভালোভাবে মানিয়ে নিতে পারি। অতঃপর শাওন আমার সাথে যাবার জন্য রাজি হয়। রাস্তায় আমি শাওনকে আমার এবং আম্মার অনেক সুন্দর স্মৃতির কথা বললাম। সেই সঙ্গে যখন বললাম,“তোমার মায়ের সঙ্গেও নিশ্চয় তোমার খুব ভালো স্মৃতি রয়েছে?”
এই কথায় শাওন অন্যমনস্ক হয়ে যায়। কারণ সে বাসা থেকে তার মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে বের হয়ে এসেছে। আসলে শাওনের মোবাইলের একটি গেমে আসক্ত হয়ে যায়। যেখানে সে প্রচুর টাকা হারে। সেই নেশায় এতটাই আসক্ত যে টাকার জন্য সে মা বাবার সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া করে। তাদের টাকা চুরি করে। আজ যখন সেই টাকা তার মা দিচ্ছিলো না তখন ঘরে ভাঙচুর করে রাগ করে বের হয়ে এসেছে। হঠাৎ আমার কথায় ছোটবেলায় বাবা, মায়ের সাথে কাটানো সুন্দর মূহুর্তগুলো মনে পড়ে তার।

আমি শাওনকে জুয়া, চুরি সহ বিভিন্ন জিনিসের খারাপ দিক বললাম। সেই সাথে আমাদের জীবনকে আমরাই সুন্দর করতে পারি। কিভাবে পারি, সবই বললাম। শাওন আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো। সে পুরো রাস্তায় আমার কথায় বেশ গুরুত্ব দিয়েছে। সে যে মনোযোগী ছিলো এটা ভেবে আমার খুব ভালো লাগলো। অতঃপর আমরা আমাদের গন্তব্যে চলে আসলাম। গন্তব্যে পৌঁছে শাওন আমার দিকে টাকা এগিয়ে দিয়ে বলে,“নেন ভাড়াটা দিয়ে দিন।”

”তুমিই দাও।”
সেই সাথে কত টাকা দিতে হবে তাও বলে দিলাম আমি। এটা শুনে শাওন অবাক হয়ে বলে,“এটা তো একজনের ভাড়া। আমরা তো দুজন আসলাম।”
আমি কথা বাড়াতে বারণ করলাম। যেই টাকা দেওয়ার কথা বলেছি সেটা দিতে বললাম। শাওন তাই করলো। শাওন অবাক হলো গাড়িওয়ালাও সেই টাকা নিয়েই চলে গেছে। ইতিমধ্যে শাওনের কানে কান্নার শব্দ ভেসে আসে। শাওন আমার দিকে তাকাতে আমি উদ্বিগ্ন গলায় বললাম,“এটা তো আমার আম্মার গলা। আমার আম্মা এভাবে কান্না করছে কেন?”
এই কথা বলে আমি ছুটে আসলাম। আমার পিছনে শাওনও আসে। হঠাৎ আমি থেমে যাই। শাওন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে,“থেমে গেলেন কেন? দেখবেন না, এত ভিড় কিসের, আপনার মা কান্না করছে কেন?”

”আমি জানি সে কেন কান্না করছে। তাই এবার তোমার ভেতরে যাওয়া উচিত।”

”মানে?”
শাওন বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে। আমি তাকে ইশারায় ভিড় ঠেলে ভেতরে যেতে বললাম। শাওন কথা না বাড়িয়ে ভিড় ঠেলে ভেতরে গেল। ভেতরে গিয়ে সে চমকে গেল। সে ভিড়ের মাঝে আমাকে খোঁজার চেষ্টা করলো। এটা বুঝে আমি তার পাশে এসে দাঁড়ালাম। শাওন একবার আমার মুখের দিকে আর একবার আমার মায়ের দিকে তাকালো। তার সামনে আমার মা আমার মৃ ত দেহ বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কান্না করছে। শাওন অবাক হয়ে আমার দিকে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকালে আমি বললাম,“তোমার পকেটে যে বালা জোড়া আছে সেটা আমার মায়ের হাতে দাও। তুমি ওগুলো কিভাবে পেয়েছো সেটা বলার দরকার নাই। শুধু এতটুকু বলবা আমার লা শের পাশে এটা তুমি পেয়ে কুড়িয়ে নিয়েছো। কিন্তু এখন অনুতাপ হওয়ায় দিয়ে যাচ্ছো।”
এই কথা শুনে শাওনের চোখে পানি চলে আসলো। আমি এটা দেখে ম্লান হাসলাম। শাওন আমার কথামতোই কাজ করলো। তার পকেটে থাকা আমার মায়ের জন্য কেনা শখের বালাজোড়া এগিয়ে দেয় মাকে। আমার মা যখন এই বালার কথা শোনে তখন সে বালাজোড়া জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে। তখন শাওন বলে,“এই জোড়া আপনি হাতে পড়লে আপনার ছেলের আত্মা শান্তি পাবে আন্টি।”
শাওনের কথার ভাবার্থ বুঝে মা আমার সঙ্গে কাটানো অতীতের সব স্মৃতি মনে করে বালাজোড়া পড়ে। সেই সঙ্গে এই বালা নিয়ে থাকা সমস্ত স্মৃতি নিয়ে আহাজারি করতে থাকে।

শাওন তার কাজ শেষ করে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। তারপর বলে,“আপনি কী এখন আমায় মে রে ফেলবেন?”

”এই ভয়ে বুঝি বালা ফেরত দিয়েছো?”
শাওন মাথা নাড়িয়ে নাসূচক জবাব দেয়। আমি হাসিমুখে বলি,“শুধু এই কারণে তোমায় ক্ষমা করে দিলাম। তুমি এই বালাজোড়া নিয়ে থাকা আমার স্বপ্ন, আমার আশা, আমার আবেগটা অনুভব করতে পেরেছো। শুধুমাত্র এই কারণে আমি তোমায় ক্ষমা করলাম।”
শাওন অবাক হয়ে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমি শান্ত গলায় বললাম,“জীবন সবাইকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয় না। তোমাকে দিয়েছে সেটা কাজে লাগাও৷ সেই সঙ্গে এমন অপরাধ আর করো না। তুমি হয়তো এই বালাজোড়া বিক্রি করে মোবাইলে সব শেষ করে ফেলতে। তাতে তোমার কিছুই যায় আসতো না। কিন্তু এই বালাজোড়া কিনতে আমার যে কত পরিশ্রম করতে হয়েছে, সেই সঙ্গে এই বালাজোড়ার সঙ্গে জড়ানো আমার স্মৃতি সবকিছু নষ্ট হয়ে যেত। তোমার একটা ভুল এভাবেই কারো স্বপ্ন ভঙ্গের কারণ হতো। এবার তোমাকেই ঠিক করতে হবে, তুমি কারো স্বপ্ন ভঙ্গের কারণ হয়ে এই পৃথিবীতে বাঁচবে নাকি বাবা, মায়ের আদর্শ সন্তান হয়ে তাদের মুখ উজ্জ্বল করে এই সমাজে গর্বের সঙ্গে বাঁচবে।”
এই কথা বলে আমি শাওনের চোখের সামনে দিয়ে ধীরে ধীরে বিলীন হতে শুরু করলাম। শাওন বোধহয় আমাকে আটকানোর চেষ্টা করছিলো। কিন্তু এ যে হওয়ার নয়। আমি একেবারে বিলীন হওয়ার পূর্বে শাওনের চোখে পানি দেখলাম। অনুশোচনার পানি। এই সেই চোখ যে চোখ কোনরকম গ্লানি ছাড়াই আমাকে না দেখে আমার মাথায় একের পর এক ইটের আঘাত করেছিলো। যার চোখ আমার মুখে নয় আমার হাতের বালাজোড়ার দিকে ছিলো। সেই চোখে এখন অনুশোচনার পানি। এটা আমাকে অন্যরকম এক প্রাপ্তি অনুভব করালো। যে প্রাপ্তির শেষে হয়তো জু য়ার মতো গেইমে আসক্ত শাওন টাকার জন্য হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে একজনকে খু ন করে বালা চুরি করে নেওয়ার পর তার ভুল তার অন্যায় বুঝতে পেরে সব আসক্তি ছেড়ে সুপথে ফিরে আসবে।

(সমাপ্ত)