শব্দহীন প্রণয়কাব্য পর্ব-১০+১১

0
368

#শব্দহীন_প্রণয়কাব্য(দশ)
#Mst.Shah Mira Rahman
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আঠারো থেকে উনিশ বছরের মেয়েদের নিখোঁজ হওয়ার কেস উঠে আসছে সামনে।বছর কয়েক আগেও এরকম কেস প্রায় কতগুলো এসেছিলো।ওই সময়ে কয়েকজন কে আটক করার পর মেয়ে নিখোঁজ হওয়া বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ ভেবে নেয় কেস সলভড। কিন্তু এত বছর পর আবার একই ধরনের কেস আসা শুরু হয়েছে।এবার কেস সিবিআই কে হস্তান্তর করা হয়েছে।ইনভেস্টিগেশন চলছে এখনো।
____
আজ সকালের এক্সিবিশন আছে।ঢাকায় যেতে হবে।হাতে মাঝারি সাইজের ক্যানভাসটা কাগজে মোড়ানো।খুব সাবধানে ওটা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো সকাল।বাড়ির কাউকে সাথে নেয় নি।একটা রিকশা ডেকে উঠে পরল তাতে। এলাকার বাইরে রিকশা আসতেই সামনে একটা গাড়ি নজরে পরল।সকাল রিকশা থামালো। সিদ্ধান্ত এগিয়ে এলো তার দিকে। রিকশার ভাড়া মিটিয়ে সকালের হাত থেকে ক্যানভাসটা এক হাতে নিল।অন্য হাতে সকালকে রিকশা থেকে নামতে সাহায্য করল।তারপর তার হাত ধরে এগিয়ে গেল গাড়ির দিকে।গাড়ির পেছনের দরজা খুলে ক্যানভাসটা রাখল।সকাল ওপরপাশে গিয়ে গাড়ির ফ্রন্ট সিটে বসল। সিদ্ধান্ত ও ড্রাইভিং সিটে এসে বসলো।গাড়ি চলতে শুরু করল।আজ সকালের এক্সিবিশন আছে জেনে তিনদিন আগে থেকে নিজের কাজ গুছিয়ে রেখেছে সে।আজকে নিয়ণের হাতে সব ধরিয়ে সে ছুটে এসেছে সকালের কাছে।তার সাথে সময় কাটানো যাবে এমন একটা সুযোগ ও ছাড়তে নারাজ সে।আজ সারাদিন একসাথে থাকবে ভাবতেই সিদ্ধান্তর মনে ঝড় বইছে।সিদ্ধান্ত তাকালো সকালের দিকে চোখাচোখি হতেই মৃদু হাসল দুজনে। সিদ্ধান্ত এক হাতে সকালের হাত মুঠো করে চুমু খেল। সকাল লজ্জায় অন্যদিকে মুখ ফেরালো।সেদিনের পর আজ আবার তারা দেখা করল।ওই দিন অশান্ত সকাল কে বুকে জড়িয়ে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করেছিল সিদ্ধান্ত।সকাল ওভাবেই সিদ্ধান্তর বুকে ঘুমিয়ে পড়ে। সারারাত সিদ্ধান্তর সাথে মিশে তার বুকে ঘুমানোর কথাটা যতবার সকাল কল্পনা করে ততবারই সে লজ্জায় মিলিয়ে যায়।এত কেন লজ্জা তার?
সিদ্ধান্ত দেখল সকালের লজ্জা।মনে মনে হাসল।এবার সময় এসে গেছে সকালের সকল লজ্জা ভেঙে দেয়ার।আর অপেক্ষা নয়। অপেক্ষা জিনিস অন্তত তার জন্য আর নয়। ওইদিন সকাল কে এত কাছ থেকে দেখে এত কাছে পেয়েও তাকে ছুঁতে না পারাটা যেন তার এতদিনের অপেক্ষাকে নিমেষেই ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।ভেতরে ভেতরে ছটফটানি দিন দিন বাড়ছে।এসব আর সহ্য করার নয়।সিদ্ধান্ত গাড়ি চালাতে চালাতে আবার সকালের দিকে তাকালো।ভ্রু কুঁচকে এলো তার। সকাল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।আজব সিদ্ধান্ত এখানে বসে আছে তো সে বাইরে তাকিয়ে কি দেখছে?তার দিকে তাকালে কি চোখ দুটো ক্ষয় যাবে?
____
দুপুরের দিকে মীরার ফোনে একটা মেসেজ আসে।মীরা তখন রোগী দেখছিল। মেসেজ টোনে ফোন হাতে নিতেই চোখে পড়ে কিছু লেখা,
“বাইরে এসো,আমি অপেক্ষা করছি। একসাথে লাঞ্চ করবো।”
মীরার ঠোঁটে হাসি ফুটলো।সময় দেখল সে।লান্ঞ্চের সময় পার হয়ে গেছে।রোগী দেখতে গিয়ে তার এদিকে খেয়াল ই ছিল না।হাতের পেশেন্টকে দেখে মীরা নিজের কেবিন থেকে বেরোতেই মিনহাজের সাথে দেখা হলো। মিনহাজ তাকে দেখেও চুপচাপ পাশ কাটিয়ে চলে গেল।মীরা দেখল তার যাওয়া।মনে পরল সেদিনের ঘটনা।যেদিন মিনহাজ তাকে তার ফ্লাট অবধি ছেড়ে দিয়েছিল।তার পরের দিন সে দেরি করে এলো হসপিটালে।এসেই মীরার কেবিনে গেল।মীরা দেখল মিনহাজ কে। মিনহাজ সরাসরি জিজ্ঞেস করে বসল,
“কাল যেই গাড়িটা আমাদের পিছু নিচ্ছিল ওটার মালিক আপনার কে হয়?”
হুট করে এমন একটা প্রশ্নে মীরা বেশ অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে,
“কেন?”
“আমি আজ হসপিটালে দেরি এসেছি।”
“তো!”
“হসপিটালে আসার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়ি নিতে গেলে দেখি গাড়ির চারটা চাকাই পাংচার।”
মীরা অবাক হলো‌। পাংচার হলে একটা দুটো চাকা হবে।তাই বলে চারটাই একসাথে!কীভাবে সম্ভব?তাকে প্রশ্ন করতে হলো না মিনহাজ নিজ থেকেই বলল,
“আর আমি সকালে জগিং করতে গিয়ে আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় কালকের সেই গাড়িটাকে দেখেছি।”
মীরা চমকে উঠল।সুলেমান?উনি এসব করেছে?
“আপনার স্বামী বা বয়ফ্রেন্ড যাই হোক না কেন উনাকে বলে দেবেন আমি ছোট বাচ্চা নই যে গাড়ির টায়ার পাংচার করে আমাকে ভয় দেখাচ্ছে।আমাকে সরাসরি বলে দিলেই হয় আপনার অন্য কোথাও রিলেশন আছে তাহলেই তো আর আপনার পিছু পিছু ঘুরছি না আমি।আমি ওতটাও চিপ নই।”
নিজে নিজে কথা বলেই মিনহাজ চলে গেল। মীরার ঠোঁটে হাসি ফুটলো। সুলেমান তাকে নিয়ে পজেসিভ জানে তাই বলে এমন বাচ্চামো কে করে?
সেদিনের কথা মনে করে আজও হাসল মীরা।সময় নেই দেখে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলো হসপিটাল থেকে। সুলেমান গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ফোনে কারো সাথে কথা বলছে।পড়নে অফিস ড্রেস।চোখে সানগ্লাস হাতে ঘড়ি।মীরা মুগ্ধ হলো।এই লোকটা এতো সুদর্শন কেন বুঝে পায় না সে।লোকটা কি জানে না পুরুষ দের এত সুদর্শন হতে নেই।মীরাকে এগিয়ে আসতে দেখে হাতের ফোন রাখল সুলেমান।মৃদু হেসে গাড়ির দরজা খুলে দিল।মীরা বসল।সুলেমান ও ড্রাইভিং সিটে বসে মীরার সিটবেল্ট বেঁধে নিজের সিটবেল্ট বাঁধল। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি চলতে শুরু করল।মীরা অন্যদিকে তাকিয়ে হাসল।লোকটার এই ছোট্ট ছোট্ট যত্নগুলোও তার ভালো লাগে।হৃদয় কাঁপিয়ে দেয়।
কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্টে এসেছে তাঁরা।অর্ডার আসতেই সুলেমান খাওয়া শুরু করল।মীরা খাবার নাড়াচাড়া করছে।তা দেখে সুলেমানের ভ্রু কুঁচকে গেল।
“কি হলো মীরা?খাচ্ছো না কেনো?”
“আমি বাড়ি যেতে চাই।”
সুলেমান চুপ করে গেল। তাকিয়ে রইল মীরার দিকে।তারপর আবার রয়ে সয়ে বলল,
“এখন নয় সময় হলে আমি নিয়ে যাবো।”
“কবে নিয়ে যাবেন? এতদিন নাহয় আমি রাগ করে যাইনি।তবে এখন যখন সব ঠিক হচ্ছে তাহলে গেলে ক্ষতি কি? কতদিন দেখিনা বাবা মা কে। পরিবারের কারো সাথে দেখা হয়না আমার।মা কি আমার ওপর রেগে আছে?আর বাবা? সালমান ভাই সকাল কেউ একবার দেখা করতে এলো না আমার সাথে।আমি কি অনেক বড় অন্যায় করেছি যে এখন ও সবাই আমার ওপর রেগে আছে?যার কারণে আমি যেতে পারবো না আমার বাড়িতে।”
মীরার চোখ ছলছল করছে।সুলেমান দেখল সেই চোখ। বুকের ভেতরটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেল।এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে শান্ত‌ করে ধীর গলায় বলল,
“মীরা পাবলিক প্লেস‌ এটা কান্নাকাটি বন্ধ করো।”
মীরা তাকালো চারিদিকে। মানুষের আনাগোনা বুঝে নিজেকে সামলালো।চুপচাপ খাওয়ায় মন দিল‌। সুলেমানের আর খাওয়া হলো না।একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল মীরার দিকে। রেস্টুরেন্ট থেকে ফেরার সময় গাড়িতেও মীরা কোনো কথা বলল না। সুলেমান হসপিটালের সামনে গাড়ি থামালো।মীরা নেমে যেতে চাইলে হাত ধরে আটকালো তাকে।নিজের কাছে টেনে আনলো।গালে হাত রেখে বলল,
“মীরা,বলেছি তো।সময় হলে আমি নিজেই নিয়ে যাবো।তাহলে এতো মন খারাপ কেন?একটু হাসো মীরা।”
সুলেমানের উদ্ধিগ্নতা দেখে মীরা হেসে দিল। নিষ্পাপ,নির্মল।সুলেমান চেয়ে দেখল সেই হাসি।হৃদয়স্থল শীতলতায় ছেয়ে গেল।মীরার কপালে চুমু দিয়ে শান্ত গলায় বলল,
“অপেক্ষা করো আমার জন্য আমি আসবো রাতে।”
মীরার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো। মুহূর্তেই মন খারাপ সব হুড়হুড় করে পালালো। উৎফুল্ল মনে বলে উঠলো,
“সত্যি!”
“হুম।”
মীরা চট করে সুলেমানের গালে একটা চুমু দিয়ে গাড়ি‌ থেকে নামতে নামতে বলল,
“তাড়াতাড়ি আসবেন।আমি অপেক্ষা করবো আপনার জন্য।”
সুলেমান চেয়ে রইল মীরার যাওয়ার দিকে।মীরা হসপিটালের ভেতর ঢোকার আগে আরো একবার ফিরে তাকালো সুলেমানের দিকে। সুলেমান হাসল। ঠোঁটের কোণে হাসি বজায় রেখেই গাড়ি স্টার্ট দিল।
_____
রাতে প্রায় দশটা।সালমান ঘরে ঢুকে দেখল টেবিলের ওপর বই খুলে চেয়ারে বসে হায়াত আরাম করে ফোন টিপছে। সালমান এগিয়ে গেল সেদিকে।হায়াতের চুল টেনে দিল।হায়াত ব্যথাসূচক শব্দ করে লাফিয়ে উঠল।মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে অগ্নিচোখে সালমানের দিকে চাইল। সালমান চেয়ারে আরাম করে বসে বলল,
“পড়ালেখা ছেড়ে মোবাইল চালানো হচ্ছে। দাঁড়া তোর মোবাইল নেওয়ার ব্যবস্থা করছি আমি।”
“তুমি কে আমার মোবাইল নেওয়ার?”
“আমিই তো সব।”
হায়াত দমে গেল। সালমান হায়াতের দুই হাত টেনে নিজের ঘাড়ে রাখল।চেয়ারে মাথা এলিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলল,
“টিপে দে তো।একটু আরাম করি।”
হায়াত হাত সরিয়ে নিল।
“পারবো না।”
সালমান আবার তার হাত টেনে ঘাড়ে রেখে বলল,
“তুই পারবি না তোর ঘাড় পারবে। মোবাইলের মায়া থাকলে হাত চালা তাড়াতাড়ি।”
হায়াত ফুঁসে উঠলো। কিন্তু কিছু বলল না।ধীরে ধীরে ঘাড় ম্যাসাজ করতে করতে বিড়বিড়ালো,
“শা*লার বা*ন*চো*দ জামাই খালি হুমকি দেয়।”
চট করে চোখ মেলে তাকালো সালমান।মাথা এলিয়ে দেওয়া অবস্থাতেই তাকালো হায়াতের দিকে।
“কি বললি?”
হায়াত চমকে উঠল।চোখে মুখে ভয় দেখা গেল।
“কই কি বলেছি?”
সালমান সোজা হয়ে বসে আবার তাকালো হায়াতের দিকে।
“আমি শুনেছি কি বলেছিস তুই।”
হায়াতের আত্মা শুকিয়ে গেল।দুই পা পিছিয়ে না না করে উঠল,
“না না আমি কিছু বলিনি তোমার কান ভুল শুনেছে।আমি কি কখনো গালি দিতে পারি তুমিই বলো।”
সালমান চোয়াল শক্ত করে উঠে দাঁড়ালো। হায়াত দৌড়ে বেডের ওপর উপর ওঠে অন্যপাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
“এবারের মতো মাফ করে দাও সালমান ভাই।আর জিবনেও এমন কথা বলব না।কসম করে বলছি জিবনে আর গালি দিব না তোমায়।”
সালমান বেডের পাশে এসে দাঁড়াল,
“হায়াত নেমে আয় নয়তো খুব খারাপ হয়ে যাবে বলছি।”
“তোমার বউ আমি তোমার কাছেই তো শিখেছি এসব।তুমি বলো তাই আমারো মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে।আমার কি দোষ?”
হায়াতের মুখে “তোমার বউ” শব্দটা শুনে সালমানের রাগ গায়েব হয়ে গেল।বুকের ভেতরটা শীতলতায় ভরে গেল।তবু মিথ্যে গম্ভিরতা ধরে রেখে বলল,
“হায়াত নেমে আয়।”
“না নামবো না।তুমি মারবে আমায়।”
হায়াতের সহজ স্বীকারোক্তিতে সালমানের হাসি পেল।তবে হাসল না।নিজেও উঠে এলো বেডের ওপর। হায়াত আঁতকে উঠে বেড থেকে নামার আগে তার হাত ধরে ফেলল। নিজের কাছে টেনে কোমড় জড়িয়ে ধরল।
“কে বলেছে মারবো?বউকে মারতে হয়না আদর করলেই সোজা হয়ে যায়।”
হায়াতের পুরো শরীর শিরশির করে উঠলো। গতরাতের দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো। সালমানের আগ্রাসী স্পর্শ হৃদয় কাঁপিয়ে দিল তার।হাত দিয়ে সরানোর চেষ্টা করল সালমান কে সালমান সরল না। হায়াত কে নিজের মাঝে জড়িয়ে নিয়ে তার ঠোঁটের পাশে চুমু খেল।হায়াত কেঁপে উঠলো।সাথে সাথে সালমান হায়াত কে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে তার ঠোঁটের চুম্বন গাঢ় করল।চুষে নিল প্রিয় নারী ঠোঁটের অমৃত সুধা।এমন আক্রমণাত্মক স্পর্শে হায়াত বেকাবু হলো।হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো সালমানের গলা।ঠিক তখনই দরজায় টোকা পড়ল।শুনলো তবু ছাড়লো না সালমান। আবার টোকা পড়ল সাথে ভেসে এলো আয়াতের ডাক।
“সালমান ভাই!”
বিরক্ত হলো সালমান।ঠোঁট ছেড়ে কপালে কপাল ঠেকালো।ঘন শ্বাস আছড়ে পড়ল একে ওপরের ওপর।কিছুক্ষণ পর আবার টোকা পড়তেই সালমান চেঁচিয়ে উঠলো,
“সমস্যা কি বিরক্ত করছিস কেন?”
“বড় আব্বু ডাকছে তোমায় তাড়াতাড়ি যেতে বলল।”
কথাটা বলেই কেটে পরল আয়াত।সালমান তাকালো হায়াতের দিকে।চোখ বন্ধ করে আছে এখনো।
“তোর শশুর আমার রোমান্সের একমাত্র শত্রু হায়াত।”
হায়াত চোখ মেলে তাকালো।চোখে চোখ পরল। সালমান তার কপালে ঠোঁট বুলিয়ে ধীর স্বরে বলল,
“আমার জন্য অপেক্ষা করবি।আমি যাবো আর আসবো।এসে যেন তোকে ঘরে পাই।”
বলেই বেড থেকে নেমে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলো।হায়াত চুপচাপ হাটু মুড়ে বেডের ওপর বসেই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিল।আচ্ছা,সে কি লজ্জা পাচ্ছে?
পার্টি অফিসে ঝামেলা লাগায় বাড়ি ফিরেই আবার বেরিয়ে গেলেন শাহিন মির্জা।তার সাথে সালমান ও গেল।ফিরল প্রায় একটার দিকে। পার্টির ছেলে পেলেরা ঝামেলা করেছে। হাতাহাতি মারামারি ও হয়েছে।সেই ঝামেলা মিটিয়ে আহত ছেলেদের হসপিটালে ভর্তি করিয়ে পরে বাড়ি ফিরেছে সালমান।ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে ঘরে ঢুকতেই গা হিম হয়ে গেল তার।হায়াত ঘুমিয়ে পড়েছে।শোয়ার ধরন এলোমেলো।গায়ে ওড়না নেই।সালোয়ার পায়ের অনেকটা উপরে ওঠা।সালমান দৃষ্টি সরিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল।ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এগিয়ে গেল হায়াতের দিকে।আলগোছে তুলে তাকে ভালো ভাবে শুইয়ে দিল।তারপর বাতি নিভিয়ে নিজে শুয়ে পরল হায়াতের পাশে।পাশ থেকেই দুই হাতে জড়িয়ে ধরল তাকে।হায়াত ঘুমের মাঝেই তার দিকে ফিরে মিশে গেল তার বুকে।সালমানের বুক ধ্বক করে উঠলো।মনে মনে আওড়ালো,
“সত্যিই মেরে ফেলবি নাকি?”
চলবে🌺

#শব্দহীন_প্রণয়কাব্য(এগারো)
#Mst.Shah Mira Rahman
হায়াত কফি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুলেমানের স্টাডি রুমের সামনে।ভেতরে যেতে কেমন সংকোচ লাগছে।আগে এরকম হতো না।এখন হয়।এখন এই লোকটা অন্যকারো স্বামী।অন্যকারো অনুভূতি। হায়াতের চোখ ছলছল করে উঠলো।লোকটা অন্য কারো ভাবতেও বুকের ভেতর ভোঁতা যন্ত্রণা হয়।বড় একটা শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলালো হায়াত। দরজায় টোকা দিয়ে মুখ খুলল,
“আসবো সুলেমান ভাই?”
সুলেমান তাকালো দরজার দিকে।তার হাতে Lord Denning এর লেখা Landmarks in the Law নামক আইনী বই।হায়াতকে দেখে মৃদু হেসে ভেতরে আসার সম্মতি দিল।হায়াত এসে সুলেমানের টেবিলের ওপর কফির মগটা রাখল।
“মা ফিরে নি?”
“না।”
সন্ধ্যা তার কলিগের মেয়ের জন্মদিন পার্টিতে গেছে।সাথে সকাল কেও নিয়ে গেছে।সকাল যাবে না।কার না কার বার্থ ডে পার্টি সে গিয়ে কি করবে? কিন্তু সন্ধ্যা শুনলো না।টেনে টুনে নিয়ে গেল।কোথায় এই বয়সে মেয়ে ঘোরাঘুরি করবে এখানে যাবে ওখানে যাবে আনন্দ করবে তা না এই মেয়ে সারাদিন ঘর ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না।শুধু ইনস্টিটিউট থেকে বাড়ি আর বাড়ি থেকে ইনস্টিটিউট।মায়ের জেদের কাছে হার মেনে শেষ পর্যন্ত সকাল কে ও যেতে হয়েছে তার সাথে।
সুলেমান কিছু বলল না।চুপচাপ আবার বইয়ের দিকে মনোযোগ দিল।হায়াত ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।দেখতে লাগলো সুলেমান কে। সুলেমান বুঝলো হায়াতের দৃষ্টি। তাকালো তার দিকে। হায়াত ভড়কে গেল।চলে আসার জন্য পা বাড়াতেই পিছু ডাকলো সুলেমান।
“এদিকে এসো হায়াত।”
হায়াত চমকালো।তাকালো সুলেমানের দিকে। সুলেমান পাশের চেয়ারটা এগিয়ে দিল।ইশারা করলো বসার জন্য।হায়াত ভয় পেল। সুলেমান কি বকবে তাকে?মনে ভয় নিয়ে সুলেমানের সামনে বসল হায়াত। সুলেমান কিছুক্ষণ দেখল হায়াতের জড়তা।অতঃপর গলায় নমনীয়তা এনে বলল,
“তোমার পোড়াশোনা কেমন চলছে হায়াত?”
“ভালো।”
“অধ্যাপক হতে চাও।”
হায়াত মাথা নাড়ালো।
“তাহলে সেরকম প্রস্তুতি নিতে হবে তোমায়।একজন অধ্যাপক হওয়া সহজ নয়।মাকে দেখেছ?জীবনে অনেক লড়াই করে আজ মা এই পর্যন্ত এসেছে।সবাই তাকে সম্মান করে।শ্রদ্ধা করে।অথচ মানুষটার মাঝে কোনো অহং নেই।হুট করে দেখলে কেউ বলবে না মা একজন ভার্সিটি প্রফেসর। তাই যদি মায়ের মতো হতে চাও তাহলে তোমাকে ও শক্ত হতে হবে।সহজ সহজ বিষয় নিয়ে পড়ে থাকলে জীবনে এগিয়ে যাওয়াটা কঠিন হয়ে যাবে হায়াত।”
হায়াত টলমল চোখে তাকালো সুলেমানের দিকে।সুলেমান দেখল সেই দৃষ্টি।ঠোঁট গোল করে শ্বাস ফেলে আবার বলা শুরু করল,
“হায়াত আমি তোমার অনুভূতি গুলো কে ছোট করছি না।আবেগ বলে উড়িয়েও দেব না।সেই অধিকার আমার নেই।তবে আমার দৃষ্টিতে সকাল আর তোমার মাঝে কোনো ফারাক নেই।আমি তোমার ভালো চাই হায়াত।যেটা ভেবে তুমি কষ্ট পাচ্ছো তা নিছকই একটা মরীচিকা মাত্র। বাস্তবতা মানতে শেখো।আর হ্যা,কখনো নিজের অনুভূতি গুলো নিজের মাঝে রেখে গুমড়ে মরবে না।বরং তা প্রকাশ করবে।নয়তো কেউ আসবে না তোমায় নিজ থেকে বুঝে নিতে।”
“মীরা ভাবী কিছু না বললেও তো আপনি সব বুঝে যান সুলেমান ভাই।তাহলে আমাকে বোঝেননি কেন?”
কথার মাঝেই হুট করে প্রশ্ন করে ফেলল হায়াত। সুলেমান চেয়ে রইল তার দিকে।অতঃপর ভীষন শান্ত কণ্ঠে বলল,
“কারন তুমি মীরা নও।মীরা আমার স্ত্রী আমার দায়িত্ব।তার ভালো মন্দ সব কিছু বুঝে নেওয়ার অধিকার শুধু আমার।”
বাকি কথা শুনলো কি না তা জানা নেই তবে “তুমি মীরা নও” বাক্যটা যেন তার বুকে হুলের মতো ফোটালো।ভোঁতা এক যন্ত্রণায় ছেয়ে গেল শরীর মন।সুলেমান হায়াতের মাথায় হাত রাখলো।
“আশা করি এরপর থেকে যেন এই বিষয়ে তোমার মন খারাপ না থাকে হায়াত।ভাই হিসেবে আমার কাছে তা কষ্টদায়ক।”
হায়াত চুপ করে রইল।
সুলেমানের জন্য কফি নিয়ে মীরা স্টাডি রুমের দিকেই এসেছিল।এসেই এরকম একটা দৃশ্য দেখে থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল।মীরা এখন সাত মাসের গর্ভবতী।ভারী শরীর নিয়ে হাঁটাচলায় বেশ কষ্ট সইতে হয়। তবুও ঘুম থেকে উঠেই রান্নাঘরে ছুটেছিল অনেক দিন পর সুলেমানের জন্য কফি করতে।কিন্তু কফি নিয়ে এসে এরকম কিছু দেখবে ভাবে নি।দৃশ্য টা খুবই স্বাভাবিক।অথচ সে স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারলো।সুলেমানের প্রতি হায়াতের দুর্বলতা আছে এটা জানার পরও যেই মেয়ে সব স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছিল সেই আজ সামান্য এক বিষয়ে আকাশ পাতাল ভেবে বসল।ওখান‌ থেকে চলে আসার জন্য পা বাড়িয়ে ও থেমে গেল।দরজায় কড়াঘাত করে নিজের উপস্থিতি জানান দিল। সুলেমান তাকালো সেদিকে।মীরা কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উঠে এলো তার কাছে,
“তুমি এই অবস্থায় এদিকে আসতে গেলে কেন? তোমার না পেট ব্যথা করছিল?
“কেন এসেছি বলে কি আপনাদের অসুবিধা হয়ে গেছে খুব?”
হায়াত চমকালো।মীরা কি ভুল বুঝছে?কিন্তু সে তো আর আশা রাখে না সুলেমান ভাইয়ের কাছ থেকে।হুটহাট কথা বলতে মন চায় বলেই আসে।নয়তো সে তো খুব একটা কথাও বলে না সুলেমানের সাথে।বাস্তবতা ধীরে ধীরে মেনে নিচ্ছে।
সুলেমান মীরার এমন কথায় কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইল।কিন্তু কিছু বলল না।তাকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিল,
“কে বলল তোমায় আমার জন্য কফি বানাতে?এই অসুস্থ শরীর নিয়েও জেদ করবে তুমি?”
“আনা উচিত হয়নি বুঝি?”
হায়াত বুঝলো এখানে তার থাকা উচিত নয় তাই। সুলেমান কে বলে সে স্টাডি রুম থেকে বেরিয়ে আসে।সুলেমান বুঝলো মীরার মুড সুইং হয়েছে।নয়তো এতো ছোট একটা বিষয়ে মাতামাতি করার মেয়ে মীরা নয়।তাই ওই মুহূর্তে আর কিছু বলল না।মীরার হাত থেকে কফিটা নিয়ে চুমুক দিল।হায়াতের আনা কফিটা অতি অযত্নে অবহেলায় পড়ে রইলো একদিকে।
সুলেমান মীরাকে ধরে রুমে নিয়ে এলো।ঘুম থেকে ওঠার কারনে তার চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে। সুলেমান মীরাকে আয়নার সামনে বসিয়ে চিরুনি দিয়ে মীরার চুল আঁচড়াতে লাগল।মীরা তখন থেকে চুপ করেই ছিল। এবার মুখ খুলল,
“আমি কি সত্যিই শুধু দায়িত্ব আপনার জন্য? দায়িত্বের উপরে আর কিছুই নই?পরিবারের পছন্দে বিয়ে করেছেন তাই তাদের মান রাখার জন্যই এতদিন নিখুঁত ভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন।এতদিনের আপনার এতো যত্ন সব শুধু দায়িত্ব ছিল?কারন আমি আপনার স্ত্রী তাই করতে হবে করেছেন ব্যাস!এইটুকুই?”
সুলেমানের হাত থেমে গেল।মীরার কথাটা বুকের বাঁ পাশের কোথাও একটা চিনচিন ব্যথা ছড়িয়ে দিল।কত সহজেই মীরা তার অনুভূতি গুলো কে দায়িত্ব বলে দিল। সত্যিই কি মীরা এতটাই অবুঝ হয়ে গেল।কই আগে তো এমন ছিল না। প্রেগনেন্সির কয়েকমাস পর থেকেই এমন উল্টা পাল্টা কথা বার্তা বলছে। সুলেমান নিজেকে সামলে আয়নায় মীরার দিকে তাকালো। মীরার প্রেগনেন্সি অনেক ক্রিটিক্যাল পজিশনে আছে।জরায়ুর টিউমার জরায়ুর সাথে সাথে বড় আকার ধারন করছে।এমনকি জরায়ুর মাঝে রক্তক্ষরণ ও দেখা গিয়েছিল। সুলেমান ওই সময় বেশ ভয় পেয়েছিল।আপাতত সুস্থ আছে মীরা।সপ্তাহে সপ্তাহে চেক আপের মাঝে রাখা হয় তাকে।হসপিটাল থেকে সময়ের আগে ছুটি নেওয়া হয়েছে।এ কদিনে মীরাকে চোখে চোখে রাখছে সে। কিছুক্ষণ আগে ও পেট ব্যথা নিয়ে একটু ঘুমিয়েছিল মীরা।তাকে ঘুমোতে দেখে সুলেমান তার স্টাডি রুমে গিয়েছিল।আর তারপরই এমন একটা সিচুয়েশন।এখন যদি সুলেমান কিছু বলে তো মীরা হাইপার হয়ে যাবে। সুলেমান ঘাটালো না চুপচাপ চিরুনি চালালো।মীরা এই সময় বেশ মোটা হয়েছে।গাল গুলো ফুলে গেছে। সুলেমানের ভালো লাগে দেখতে।মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডেলিভারির পর মীরাকে বেশি বেশি খাইয়ে এমনই মোটা বানিয়ে রাখবে। জড়িয়ে ধরতে বেশ আরাম লাগে। সুলেমান হাসল।মৃদু গলায় বলল,
“তোমার চুল গুলো তো বেশ উস্কো খুস্কো।তেল দাওনা কতদিন?”
মীরা কথা বলল না।সুলেমান এবার তাকে পেছন থেকে হালকা জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু দিয়ে বলল,
“তুমি বসো আমি তেল গরম করে আনছি।রাতে ঠান্ডা তেল মাথায় দিলে ঠান্ডা লেগে যাবে।পরে নাহয় তেল দিতে দিতে তোমার সাথে অনেক কথা হবে।”
সুলেমান মীরার তেলের বোতল হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মীরা চেয়ে রইল সেদিকে।নিজের প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে অভিমানের পাহাড় জমালো।
____
তেল গরম করে সুলেমান তা একটা স্টিলের বাটিতে ঢালল।বাটি নিয়ে উপরে আসার সময় অসাবধান বশত তেলতেলে বাটিটি হাত ফসকে পড়ে গেল সিড়ি মাথায়।বাটি পড়ার শব্দে ঘর থেকে মাহিন মির্জা ও শাহানা মির্জা বেরিয়ে এলেন। সুলেমান তাদের দিকে একবার তাকিয়ে নিচ থেকে বাটি তুলে আবার রান্নাঘরের দিকে গেল।গৃহ পরিচারিকা শৈলীকে তাড়াতাড়ি সিঁড়ির তেল গুলো পরিষ্কার করতে বলে নিজে আবার তেল গরম‌‌ করতে লাগল।শৈলী একটা বালতিতে পানি আর হুইল নিয়ে সিড়ির দিকে যেতেই শাহিন মির্জা ও সালমান বাড়ি ফেরে। সন্ধ্যা যেহেতু বাড়িতে নেই।আর সবাই নিজ নিজ ঘরে তাই সে নিজেই পানির বালতি রেখে শাহিন মির্জাকে পানি দেওয়ার জন্য দৌড়ে গেল।
___
মীরা ঘরের ভেতর বসে আপন মনে হেসে হেসে কথা বলছে।আসলে সে নিজের বাচ্চাকে তার বাবার নামে নালিশ দিচ্ছে। কিছুক্ষণ আগের গোমরা মুখটা এখন আর নেই।দৃশ্যটি দেখে হায়াত হাসল।হায়াতকে নিজের ঘরে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিল মীরা।হায়াত কষ্ট পেল তবে তা বুঝতে না দিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
“বড় আব্বু তোমাকে নিচে ডেকেছে ভাবি।কথা বলা জন্য।”
মীরা জবাব দিল না। চুপচাপ উঠে চলে এলো।হায়াত তাকিয়ে রইল সেদিকে।মীরা আনমনে হেঁটে সিঁড়ির কাছে আসতেই পায়ের নিচে তেলতেলে অনুভব করল।নিয়ন্ত্রণ হারালো নিজের গতির। রেলিং ধরার আগেই ভারী শরীর নিয়ে মুখ থুবড়ে পরল।ফ্লোরে গিয়ে ঠেকলো তার উঁচু পেট। ককিয়ে উঠলো সে।যন্ত্রণায় চোখে মুখে অন্ধকার দেখল।সিড়ির শেষ মাথায় হওয়ায় নিজেকে সামলাতে না পেরে দুই তিনটা সিড়ি নিচে এসে পরতেই রেলিং ধরে আটকালো নিজেকে।ততক্ষণে নরক দুয়ারে পৌঁছালো তার যন্ত্রণা।শরীরের নিম্নভাগ হতে রক্তক্ষরণ হলো।বসার ঘরে বসা সবাই হতভম্ব।কিছু সময়ের ব্যবধানে কি হলো কেউই বুঝলনা।যখন বুঝল সালমান দৌড়ে এলো মীরার দিকে। শাহিন মির্জা সহ ধরাধরি করে তাকে হসপিটালে নেওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।এই অবস্থাতেও মীরা আধো অন্ধকার চোখে দেখল বাটি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা সুলেমানকে।তাকে ধরতে পর্যন্ত এলো না।এক মুহুর্তে মীরার মনে হলো এসব কিছু একটা পরিকল্পনা।সুলেমান আর হায়াতের পরিকল্পনা।
সুলেমান তখন ও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে একই জায়গায়।কি ঘটেছে তা এখনো মস্তিষ্ক ধারণ করতে পারেনি।শুধু বুঝছে কষ্ট হচ্ছে তার।আর সেই কষ্টের মাত্রা এতোটাই বেশি যে সুলেমানের মনে হচ্ছে কেউ তার হৃদয় কেটে টুকরো টুকরো করে তাতে লবনের ছিটে দিচ্ছে।আয়াত কাদতে কাদতে দৌড়ে এলো সুলেমানের কাছে।তাকে টানতে টানতে বলল,
“সুলেমান ভাই যাবেন‌ না?ভাবী কষ্ট পাচ্ছে।”
সুলেমান তাকালো আয়াতের দিকে।চোখ দুটো লাল রক্ত বর্ণ ধারণ করেছে।আয়াত ভয় পেয়ে গেল।
____
মীরাকে সাথে সাথে ইমার্জেন্সি অপারেশন রুমে ঢোকানো হলো।বাইরে সবাই চিন্তিত। সিদ্ধান্ত বোনের এমন খবর পেয়ে ছুটে এসেছে তখনই। সন্ধ্যা সকাল ও এসেছে।তখন থেকে কেঁদেই চলেছে তারা।হায়াত কাঁদছে।কি থেকে কি হয়ে গেল।আচ্ছা, মীরার আজ এই দশার জন্য কি কোনোভাবে সে দায়ী।যদি এরকম কিছু হয় তাহলে সে কখনোই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেনা। সুলেমান একপাশে চুপচাপ বসে আছে।মুখ থেকে টু শব্দটি বের করেনি এখন পর্যন্ত চেহারার ভাবমূর্তি ভয়ংকর।
দীর্ঘ কয়েক ঘন্টার পর অপারেশন রুম থেকে ডক্টর বেরিয়ে আসে।মীরা সাত মাসের মৃত সন্তান জন্ম দিয়েছে।মীরার অবস্থা ক্রিটিক্যাল।তাকে রক্ত দেওয়া হচ্ছে।জ্ঞান না ফিরলে কিছুই বলা যাবে না।
মৃত সন্তান কে দেয়া হয় সুলেমানের কোলে।বাড়ির মহিলাদের কান্নার রোল পড়ে যায়। সুলেমান নিজ হাতে কবর দেয় তার সন্তান কে।শান্ত শিষ্ট শক্ত সুলেমান হুট করেই কেঁদে ওঠে তার সন্তানের কবরের সামনে। দোষারোপ করে নিজেকে।আজ তার জন্যই মীরার এই অবস্থা।তার জন্য ই তার সন্তান আজ মৃত। সালমান আগলে নেয় নিজের ভাইকে। শান্ত করায় মাথায় হাত বুলিয়ে।
মীরার জ্ঞান ফিরে একদিন পর।অসুস্থ দুর্বল শরীরে সবার দিকে চোখ বুলায়।আশাহত হয়। কিন্তু কাঁদে না।সুলেমান তখনও আসেনি তার সামনে।সবাই বেরিয়ে যাওয়ার প্রায় বেশ কিছুক্ষণ পর আসে।মাথা নিচু বিধ্বস্ত অবস্থায় মীরার সামনে বসে।মীরা হুহু করে কেঁদে ওঠে। অস্ফুট স্বরে বলে,
“কেন করলেন এমন কেন?”
সুলেমান কথা বলেনা।বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না।
সিজারের বেশকিছু দিন পর মীরার জরায়ুর অপারেশন করা হয়। টিউমার জরায়ুর ভেতরে হওয়ার পুরো জরায়ু কেটে ফেলা দেয়া হয়।মীরা সেদিন সিদ্ধান্ত কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।আবদার করে বসে ভাইয়ের কাছে।
“আমি এখানে থাকতে চাইনা ভাইয়া।দূরে কোথাও চলে যেতে চাই।দম বন্ধ হয়ে আসে আমার।শ্বাস নিতে চাই আমি একটু শ্বাস নিতে চাই।”
সিদ্ধান্ত শোনে বোনের কথা।উত্তর দেয় না।এতদিন মীরা বুশরা বাড়িতে থাকে।সুলেমানের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখে না।ও বাড়ির সবার সাথে দেখা করলেও সুলেমানের সাথে দেখা করে না।এর মাঝে আরো একটা সত্য জানতে পারে সে।তার বাবার কেসের বিপক্ষ দলের উকিল সুলেমান ছিল। অনৈতিক ভাবে তার বাবাকে অপরাধী প্রমাণ করেছে সে।জানার পর সিদ্ধান্ত রাগে ফেটে পড়ে।মীরা‌ অদ্ভুতভাবে চুপ ছিল। সিদ্ধান্ত সুলেমানের ওপর কেস করতে চাইল।কিন্তু মীরা দিল না।যুক্তি হিসেবে শোনালো সে নিজেই একজন উকিল তার ওপর বাবা এমপি। সিদ্ধান্ত পার পাবে না তাদের সাথে। সিদ্ধান্ত শুনলো কিন্তু রাগের বসে আরেকটা সিদ্ধান্ত নিল।ঠিক ভুল বিবেচনা করল না।তবে চোখের সামনে সকালের মুখটা ভেসে উঠলো।সকালের সাথে তার গভীর কোনো সম্পর্ক না থাকলেও মেয়েটার প্রতি তার আলাদা অনুভুতি আছে।যখন মির্জা বাড়িতে যেত বোনের সাথে দেখা করতে তখন দেখতো মেয়েটা প্রায় লুকিয়ে লুকিয়ে দেখত তাকে। সিদ্ধান্তর ভালো লাগতো।মনে মনে পণ নিয়েছিল দুনিয়াদারি ভুলে থাকা মেয়েটিকেই তার দুনিয়া বানাবে সিদ্ধান্ত।।মীরা সুস্থ হতেই তাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হলো।এতদিন সুলেমান সবসময় মীরাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও মীরা সামনাসামনি হয়নি তার।মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তার থেকে।যখন শুনেছে মীরা দেশের বাইরে যাবে তখন কেমন যেন চুপ হয়ে গিয়েছিল সুলেমান।মীরাকে আটকানোর চেষ্টা ও করেনি।সময় দিতে চেয়েছে তাকে নিজেকে সামলানোর।ভেবেছে যখন অভিমান ভাঙবে তখন নিজেই ফিরবে তার কাছে। মীরা বেশিদিন অভিমান করে থাকতে পারবে না তার ওপর।মীরা ফিরেছে ঠিক কিন্তু অনেক দেরী করে।প্রায় আড়াই বছর পর।এত দিনে সুলেমান শুধু ছটফট করেছে মীরার সান্নিধ্য পেতে।তাকে বুকে জড়িয়ে সকল অভিযোগ অভিমান শুষে নিতে।কিন্তু পারেনি।বরং রাতের অন্ধকারে নিজেই অভিযোগের ঝুলি খুলেছে সে মীরার বিরুদ্ধে।মীরা যেদিন ফিরেছে সেদিন ই খবর পায় সুলেমান।দূর থেকে দেখে চোখের তৃষ্ণা মেটায়।কাছে যাওয়ার সাহস পেত না অপরাধ বোধে।তবে এভাবে আর কতদিন?তাই প্রায় পাঁচ মাস পর একদিন নিজে থেকেই যায় সে মীরার সামনে।মেনে নেয় মীরার সকল অভিযোগ।মীরা অবুঝ নয়।যা হয়েছে তা একটা দুর্ঘটনা মাত্র সেটা বুঝতে বেগ পেতে হয়নি তার। কিন্তু তার পরও সে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিল সুলেমান কে।সে যে আর মা হতে পারবে না।বন্ধ্যা সে।এই বন্ধাত্ব নিয়ে কি করে যাবে সুলেমানের সামনে?তবু পেরেছে কি নিজেকে সুলেমানের থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে!
মীরাকে বিদেশে পাঠিয়ে নিজের প্রতিজ্ঞা পূরণেই ওইদিন ছুটে গিয়েছিল সকালের ইনস্টিটিউটের সামনে।কোনো কথা না বলে তাকে সরাসরি এনেছিল কাজি অফিস। সকাল চমকালো।সিদ্ধান্তর প্রতি অনুভুতি থাকলেও এভাবে বিয়ের কথা সে ভাবে নি।কিন্তু যখন সিদ্ধান্ত বলল,সে হারাতে চায়না সকালকে। তখন সকালের কি হলো সে কবুল বললো সিদ্ধান্তর নামে।এই একটাই কারন সিদ্ধান্ত আজও সকালের ওপর তার কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় না।কারন বিয়েটা সে জোড় করে করেছিল সকাল কে। সিদ্ধান্ত ভয় পেয়েছিল সে যখন তার বাবা ভাইয়ের বিরুদ্ধে যাবে সকাল তার থেকে দূরে সরে যাবে।শুধু যেন এরকম কোন পরিস্থিতি না আসে তাই তার এই কদম।।তাকে সময় দিতে চেয়েছিল সে।তার কিছুদিন পর সিদ্ধান্ত রাজনীতি তে নাম লেখায়।বিরুদ্ধাচারণ করে শাহিন মির্জার।ক্ষমতাই যদি সব হয় তো সেও এই ক্ষমতা হাসীল করেই ছাড়বে। এতকিছুর মাঝে সিদ্ধান্তর ধারনা ঠিক ছিল। সকাল যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল তার সাথে।তবে এ বেলায় সে নিশ্চিত ছিল স্ত্রী তার স্বামীর থেকে বেশিদিন দূরে থাকতে পারবে না।আর হয়েছে ও তাই।সকাল ধরা দিয়েছে তার হাতে।তার দুনিয়ায়।
চলবে🌺