শিরোনাম পর্ব-০৩

0
102

#শিরোনাম
#পর্বসংখ্যা_০৩
#মুসফিরাত_জান্নাত

“আমাকে ভুল বুঝবেন না বোন।একজন নারী হয়ে অন্য নারীর ঘর ভাঙার কারণ হওয়ার মতো মেয়ে আমি নই।ভাগ্যের দোষে এমনটা হয়ে গিয়েছে।পারলে আমাকে ক্ষমা করবেন বোন।আমি না জেনে আপনার সংসারে প্রবেশ করেছি।আমি নিজে থেকেই আমার অজানার ভুল সংশোধন করে নিবো।কিন্তু যে বিশ্বাসঘাতক জেনেশুনে এমন নিকৃষ্ট কাজ করেছে তাকে কখনো ক্ষমা করবেন না।বিশ্বাসঘাতকদের ক্ষমা করা অর্থ আরেক বিশ্বাসঘাতক জন্মের পথ প্রশস্ত করা।”

জেরিনের হাত ধরে কথাগুলো বলে উপচে বের হওয়া চোখের পানিটুকু হাতের উল্টো পিঠে মুছে ফেললো কনা।দমকা হাওয়ার দাপটে জীবনের সবচেয়ে আনন্দঘন মুহুর্তে সবচেয়ে বাজেভাবে মন ভেঙেছে তার।যার ভার মনে ষোলআনা দাগ কে’টে গিয়েছে।এই দাগ কষ্ট ও ঘৃণায় জর্জরিত।সেগুলো আড়াল করে জেরিনের কাছে এতটুকু মনুষ্যত্ব প্রকাশ করলো সে।
তারপর গটগট করে ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে গেলো।এদিকে তার এমন প্রতিক্রিয়া সবার মাথার উপর দিয়ে গেলো।জুবায়ের, জিনাত বা মনোয়ারা থম মেরে দাঁড়িয়ে দেখলো এসব।বন্ধনের সুত্র ধরে মেয়েটিকে অত্যাচার করতে মনে পোষা কাল সাপ ফণা তুলে যতটুকুও বা জেরিনকে ঘরে আটকে রাখতে চেয়েছিলো।এ মুহুর্তে এসে তাও বিলীন হয়ে গেলো।বড় কিছু অর্জনের জন্য প্রায়শই আমাদের ছোট কিছু ত্যাগ করতে হয়।জেরিনকে কোনো ক্রমেই আর এ সম্পর্কে রাখা যাবে না।কনা মেয়েটা তাদের জন্য অতোটা সুখকর হবে বলে মনে হচ্ছে না।সে আ’গুনের ন্যায় দাউ দাউ করে জ্ব’লছে।এই আ’গুনে ঘি ঢালার কাজ করবে জেরিনের উপস্থিতি।কনার উপস্থিতির জেরে জেরিনকে নয়, বরং দুই সতিন মিলে তাদেরকেই তছনছ করে দিবে বলে বোধ হলো তাদের।জিনাত জুবায়ের-এর দিকে তাকিয় বললো,

“বিষয়টা একদমই ভালো লাগতেছে না ভাইয়া।এখন এসব কেমনে সামলাবে তুমি?”

জুবায়ের নির্বাক।মনোয়ারা মুখ ঘুচে বললেন,

“এমনে পাথর হয়ে থাকলে এখন চলবে?তোর ছোট বউ তো দেখি বড়টার চেয়েও বেশি জ্ব’লছে।বড়টা যদি কাঠ খড়ির আ’গুন হয় তাহলে তোর ছোট বউটাকে সিলিন্ডারে আবদ্ধ গ্যাসের আ’গুন মনে হচ্ছে।ফট করে যেনো বাস্ট হয়ে যাবে।তাহলে ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি।এই দুই আগুন একত্রে আমাদের ভ’ষ্ম করতে উঠে পড়ে লাগবে এখন।কি করবি কিছু ভাবছিস?”

জুবায়ের ক্লান্ত স্বরে বললো,

“আমার কর্ম আমি জানি।গ্যাসের আ’গুন নিভানোর জন্য কোন সুইচ ঘুরাতে হবে তা আমার জানা আছে।কাঠ খড়ির আগুনেও কিভাবে পানি ঢালতে হয় তাও জানা আছে।তোমার ছেলে কাঁচা খেলোয়ার নয়।তোমরা এখন জেরিনকে নিয়ে বাড়ি যাও।রাত হয়ে যাবে।”

“তুই যাবি না?”

মনোয়ারার জিজ্ঞাসু কণ্ঠের বিপরীতে সে শান্ত স্বরে বলে,

“নাহ! আমি কনাদের বাড়ি যাবো।হুট করে এই ধাক্কা সামলাতে না পেরে চেঁতে গিয়েছে সে।তাকে আগে শান্ত করতে হবে।তোমরা চলে যাও।গাড়ি ঠিক করে দিচ্ছি।”

কথাটা বলে জেরিনের দিকে চাইলো সে।জেরিন তখনও অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।কনা চলে যাওয়ার পরও তার যাত্রাপথের পানে সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।কনার থেকে এমন প্রতিক্রিয়া হয়তো সে সত্যিই আশা করেনি।একদমই না।মেয়েটির প্রতি মনে জন্মানো সবটুকু বি’ষ যেনো বিস্ময়ে ঢেকে গিয়েছে।হিসাবটা সে কোনো সমীকরণেই মেলাতে পারছে না।কনাকে সে বুঝে উঠতে পারছে না।বরাবর এমন তৃতীয় পক্ষকে স্বার্থপর, খারাপ মেয়ে হিসেবে দেখে অভ্যস্ত জেরিন।অন্য নারীর ঘরে আ’গুন জ্বালিয়ে তার উত্তাপে নিজে আয়েশ করে যারা বাঁচার আশ্রয় খোঁজে।অথচ এই মেয়ে সম্পূর্ণ তার বিপরীত।সে প্রতারণার শিকার অসহায় নারীকে নয়, বরং প্রতারকেই জ্বালিয়ে দিতে চাচ্ছে?এর উত্তাপটুকু জেরিনকেও শান্তি দিবে কি?নাকি তাকেও অশান্তিতে নিমজ্জিত করবে?জানে না জেরিন।তবে মনে মনে কেবল একটি প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে তার।কনাকে এ অবস্থায় অত মন্দ লাগছে না।তবে এ কেমন তৃতীয় পক্ষের দেখা পেলো সে?এ তৃতীয় পক্ষ তার শত্রুর কাজ করেও শত্রু নয়?

থম মে’রে দাড়িয়ে আছে জেরিন।জুবায়ের দ্বিধান্বিত চোখে তাকে দেখে।কি যেনো ভেবে কণ্ঠ খাদে নামায়।মাকে জিজ্ঞেস করে,

“ওকে এখানে কে আসতে বলেছে?”

মনোয়ারা তপ্ত শ্বাস ছাড়ে।বিরক্ত কণ্ঠে বলে,

“তোর বউকে কারো আসতে বলতে হয় বুঝি?পিঁপড়ের নাক ওর।দেখ গন্ধ শুঁকে কিভাবে কিভাবে চলে এসেছে।”

জুবায়ের নিচের ঠোঁটে হাত দিয়ে চি’মটি কা’টে।দ্বিধান্বিত হয়ে বলে,

“কিন্তু ওর হাতে কাপড়ের ব্যাগ কেনো?”

“যেনো কিছু টের না পায় তাই বাপের বাড়ি পাঠাই দিছিলাম।কিন্তু শেয়ানা মেয়ে বাপের বাড়ি যাওয়ার নাটক করে এখানে আসছে।আমাদের বোকা বানিয়েছে আমাদের বুদ্ধিতেই।শেয়ালের ন্যায় ধূর্ত মহিলা।বিদায় হলে বাঁচি।হুহ!”

শাশুড়ির তিক্ততায় পূর্ণ কথাগুলো শুনতে পায় জেরিন।এতক্ষণ থম মেরে থাকলেও এদের সব কথাই একটু আধটু সে শুনতে পেয়েছে।কিন্তু ঘোরের মধ্যে থাকায় জবাব দেয় নি।অথবা এধরণের লোকেদের কথার জবাব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা মনে করে নি।কিন্তু এবার জবাব দিলো সে।জুবায়ের যখন পরবর্তীতে দ্বিধা করে মাকে বলছিলো,

“জিজ্ঞেস করো তো, কি করবে ও?তোমাদের সাথে বাড়ি যাবে নাকি বাপের বাড়িই চলে যাবে?”

ঠিক তখনই জবাবটা দিলো জেরিন।বিদ্রুপ করে বললো,

“বাহ!এতটুকু ইতস্তত বোধ বজায় আছে দেখছি।আমাকে প্রশ্ন করার কোনো মুখ খুঁজে পাচ্ছো না বুঝি?তা নিজের স্ত্রী বর্তমান থাকতেই তাকে প্রশ্ন করার মুখ হারিয়ে কি খুব সুখ লাগছে প্রতারক?তাছাড়া এমন করতে না তো!”

এ প্রশ্নের কোনো জবাব খুঁজে পায় না জুবায়ের।সে মাথা নত করে নিচু স্বরে বলে,

“আমি কিছুই করিনি।আল্লাহ যা চেয়েছেন তাই হয়েছে।ভাগ্য বিশ্বাস করতে শিখো।না শুকরিপনা বান্দীর মতে কথা বলো না।এতে তোমার কিছুই হয়নি।হবেও না।তোমার সংসার আগের মতোই থাকবে মাথায় রেখো।
বর বিয়ে করলেই পর হয় না।আমিও হবো না।ইসলামে চারটা পর্যন্ত বিয়ে করা জায়েজ আছে।একাধিক বউ নিয়ে সংসার করা যায়।আমি তোমাদের দুজনকে নিয়েই সংসার করবো।বিনিময়ে তিনজনে সন্তান সুখ পাবো।গাড়ি ঠিক করে দিচ্ছি।মায়েদের সাথে বাড়ি গিয়ে ঘুম দাও।মাথা ঠান্ডা হলে বুঝতে পারবে ওই ঘর ওই সংসার তোমারই আছে।তুমি চাইলে কনা ও বাড়িতে কখনোই যাবে না।ও বাড়ি একান্ত তোমার থাকবে।কনার জন্য অন্য বাড়ির ব্যবস্থা করে দিবো।”

জেরিনকে শান্ত করতেই নরম স্বরে কথাগুলো বললো জুবায়ের।জেরিন অবাক হয়ে চেয়ে দেখলো।কত অবলীলায় কথা গুলো বললো সে।যেনো কোথাও কিছুই হয়নি।তার পুরো দুনিয়া লন্ডভন্ড করে এমন শান্ত স্বরে কথা বলছে কি করে পুরুষটি?কি করে পারছে এসব?একটুও কি বুক কাঁপছে না তার?প্রশ্নের পর প্রশ্ন জমে।জেরিন অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে।সে যেনো ভুলেই যায় যে মানুষ বউকে গোপন করে আরেক জায়গায় ঘর পেতে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে সন্তান পর্যন্ত নিতে পারে।তার দ্বারা সব পরিস্থিতিতেই শান্ত মাথায় চলা সম্ভব।তাদের দ্বারা দুনিয়ার সকল নিকৃষ্ট কাজও মুখ বুঁজে করে যাওয়া সম্ভব।তাদের দ্বারা সবই সম্ভব।

তপ্ত শ্বাস ছাড়ে জেরিন।অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে কাতর কথাটা তার উপর ষোলআনা ফলে।সে কাঁদতে ভুলে যায় এদের আচরনে।বরং অস্বাভাবিকভাবে হেসে ওঠে সে বলে,

“ইসলামিক নিয়ম নিজে খুব মানো বুঝি?তা চার বিয়ে করা জায়েজ খুব বড় মুখ করে তো বললে! বউয়ের অনুমতি নিয়ে যে দ্বিতীয় বিয়ে করতে হয়।বিয়ের আগে সেই অনুমতি নাও নি কেনো?গোড়ায় গাছ কেটে উপরে পানি ঢেলে আমাকে এখন ইসলাম শিখাতে আসছো?হাহ!আর রইলো তোমার সংসার!যেখানে বরই ভাগ হয়ে গিয়েছে সেখানে ঘর খা’মচে রেখে কি করবো?তোমাকে সন্তান সুখ দেওয়া সেই বউকে নিয়েই পড়ে থেকো ওই ঘরে।আমার বাম পা-ও ও বাড়িতে ঠাঁই খুঁজবে না।তবে ও বাড়ি আমি আজ যাবোই।আমার পাওনা গুলো বুঝে নেওয়ার আগ অবধি ওই বাড়ি থেকে কেও আমাকে নড়াতে পারবে না।আমার পাওনাটুকু আমি কড়াই গণ্ডায় আদায় করে নিবো।কাবিনের টাকাগুলো জোগার যত্ন করে ফেলো।গাড়ি তোমার ঠিক করতে হবে না।আমি নিজেই যাচ্ছি নিজের পাওনা বুঝে নিতে।তুমি কুকুরের মতো পিছু নিয়ে দেখো।তোমার পেয়ারের বউ তোমাকে সন্তানের অধিকারটুকু দেয় কিনা?সে কি বলে গেলো একটু আগে সেসব শুনেছো নিশ্চয়ই!”

নাসারন্ধ্র দিয়ে বায়ু নির্গত করে ঠোঁটের কোনে বিদ্রুপের হাসি ঝুলালো শেষে।কথাগুলো বলে সেও কনার মতো তাদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলে যায়।মনোয়ারা ও জিনাত ফুঁসে উঠতে নিলে তাদের শান্ত করে জুবায়ের।গরম মাথায় হুটহাট কোনো সিদ্ধান্ত নিতে নেই।জেরিন মাথা গরম করুক গে।কনাও মাথা গরম করুক গে।তারা যত রেগে যাবে তার কার্য তত সহজে সিদ্ধি হবে।দুইজন যত রেগে আগুন হবে তার তত পানি হতে হবে।আগুনকে কেবল পানিই দমাতে পারে।কেবলই পানি।এতে সেই লাভবান হতে পারবে।এমনটা ধারণা করেই চুপ থাকে জুবায়ের।কিন্তু তার এক মন কু গেয়ে বলে আগুনের লাভা নিয়ন্ত্রণহীন হলে তা নেভানোর মতো শক্তি বিপুল পানিরও থাকে না।যদি থাকতো তবে সমুদ্রের বুকে কখনো আগ্নেয়গিরি হতো না।জেরিন ও কনা তার জন্য সেই আগ্নেয়গিরি নয় তো?এতটুকু ভাবনাই শঙ্কিত করে তোলে তাকে।কেঁপে ওঠে বুক।হুট করেই অস্থির হয়ে যায়।

চলবে