#শিরোনাম
#পর্বসংখ্যা_০৪
#মুসফিরাত_জান্নাত
শ্বশুর বাড়িতে নিজের বলে দাবি করা ঘরটাতে ঢুকতেই দিশেহারা হয়ে গেলো জেরিন।এই ঘর আর তার একার নয়।তার নিজের বলতে এই ঘরে আর কোনো অস্তিত্ব নেই।এই ঘরটাও অজান্তে ভাগ হয়ে গিয়েছে।তার বরটারও অজান্তে ভাগ হয়ে গিয়েছে।এই ভাগাভাগির বেদনা সে আর সইতে পারলো না।শক্ত খোলস একাকীত্বের বেড়াজালে উন্মুক্ত হয়ে গেলো।গায়ের সর্বশক্তি হারিয়ে সে ভেঙে পড়লো একেবারে।ঘর ভাঙার সংবাদ জানাতে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় কল দিলো স্বীয় মা’কে।ফোন রিসিভ করে মায়ের কোমল কণ্ঠ শুনতেই কান্নারা ছিটকে এলো।নিজেকে আড়াল করার সকল প্রয়াস ভেঙে সে ভেজা কণ্ঠে বলে উঠলো,
“জানো আম্মু আমিও তোমার কপাল পাইলাম।তুমিও বিয়ের সাত বছরে জামাই হারাইছো।আমিও বিয়ের সাত বছরে এসে জামাই হারাইলাম।প্রকৃতি অতীত টেনে আনলো আম্মু।মায়ের ভাগ্য তার মেয়ের উপর বর্তাইলো।পার্থক্য এটাই আব্বুর মৃ’ত্যুতে তুমি স্বামীহারা হয়েছো।আর সম্পর্কের মৃ’ত্যুতে আমি স্বামীহারা হচ্ছি।”
হুট করে এমন স্তম্ভিত হন মা হেলেনা।তিনি জিজ্ঞেস করেন,
“এগুলা কি বলছিস মা?কি হয়েছে তোর বলতো?জুবায়ের এর সাথে তোর ঝগড়া হইছে?”
প্রশ্নের বিপরীতে কম্পিত গলায় জবাব দিলো সে,
“তোমার মেয়ের জামাই গোপনে আরেকটা বিয়ে করেছে আম্মু।এত সাধ করে তোমার মেয়েকে নিয়ে বাঁধা ঘরে এখন অন্য কারোর রাজত্ব চলবে।এই ঘরে বড় আয়োজন করে সতীন আসবে জানো?তোমার মেয়ের বন্ধ্যাত্বকে উল্লাস করে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আগত সন্তানের সুখ বানী শোনাতে।”
চারিদিকে মাগরিবের আযানের রব রব মুখরতা।মিষ্টি মধুর এই আযানের ধ্বনির সাথে দুনিয়ার সবচেয়ে বাজে কথাটা যেনো ধুয়া হয়ে বাজতে লাগলো।মেয়ের ঘরে সতীনের বাস এর মতো কঠিনতম সংবাদ বোধ হয় একটা মায়ের জন্য দ্বিতীয়টা আর নেই।এই কঠিনতম সংবাদটাই এখন শুনতো হলো হেলেনার।মেয়ের আহাজারিতে বুক ভার হয়ে এলো।পুরো দুনিয়া যেনো ওলট-পালট হয়ে গেলো।দিন দুনিয়ার সবকিছু তিনি ভুলে বসলেন এমন সংবাদে।নামাযের উদ্দেশ্যে ওযু করে ঘরে এসেছিলেন তিনি।এমন সময় মেয়ের ফোনকল পেতেই মন কু গেয়ে উঠেছিলো।কল রিসিভ করতে সত্যি সত্যি একটা দুঃসংবাদ শুনলেন তিনি।যা হতভম্ব করে তুললো ওনাকে।তিনি অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে বসে থাকলেন কিছু সময়।জেরিন আবারও বললো,
“অকালেই তোমার মেয়ের ঘরে ঘুন ধরলো আম্মু।এই ঘুনে ধরা ঠুনঠুনা ঘরে আমি কি করে থাকবো বলো?এ ঘরে তো এখন থেকে সর্বদা রোদের উত্তাপ ও ভেঙে পড়ার আশংকা নিয়ে বাঁচতে হবে।বৃষ্টি এলে জবজবে হয়ে ভিজে থাকতে হবে।মাথার উপরে ছাদ নামটুকু থাকলে কার্যত কোনো ছাদ থাকবে না।এত দুর্ভোগ সয়ে এ ঘরে আমি কেমনে থাকবো বলো?আমি যদি তোমার খুটি ওয়ালা ঘরে চলে আসতে চাই তুমি কি ফিরিয়ে নিবে না আমাকে?”
ক্রন্দনরত কণ্ঠস্বর, এলোমেলো বাক্যগুলো হৃদয়ে ঝড় তুলে দেয় মায়ের।জুবায়ের আরেকটা বিয়ে করেছে এরকম নির্মম সত্যি তিনি নিতে পারছেন না যেনো।তিনি ঘোরের চলে যান।জুবায়ের আরেকটা বিয়ে করেছে এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে ওনার।তিনি প্রমাদ গুনে বলেন,
”জুবায়ের না তোকে ভালোবাসে জেরিন?তাও কেমনে বিয়ে করলো?কেমনে পারলো এটা করতে?”
শোকে কাতর জেরিনের বুকে খচখচ করে লাগে প্রশ্ন গুলো।তপ্ত শ্বাস ছাড়ে সে।আহত কণ্ঠের ধ্বনিতে ব্যাথার স্ফূরণ ঘটিয়ে সে বিলাপ করে জবাব দেয়,
“ও আমায় প্রকৃত ভালোবাসেনি আম্মু।পূর্বে দেওয়া তার সবটুকু ভালেবাসা সে আমার নামে বেঁধে রাখে নি।”
তিক্ত এই সত্যিটা মুখে বললেও মন মানতে নারাজ হলো।দু বাক্যের ভার নিতে না পেরে চোখের জল বাঁধন হারা হলো।জেরিন হু হু করে কেঁদে উঠলো।এই কান্নায় সমুদ্রের উত্থাল ঢেউ বয়ে যায় মায়ের বুকে।বুকটা যেনো দুমড়ে মুচড়ে যায় কন্যার কষ্টের ভারে।তবুও তিনি কাঁদেন না।এতটুকু বিচলিত হন না।অল্প বয়সে বামী হারানো নারী তিনি।এ সমাজ ওনাকে পাথর বানিয়ে দিয়েছে।স্বামীহারা জায়া দুটি ছোট্ট সন্তান নিয়ে সমাজে বাঁচতে গিয়ে কতই না ঘাত প্রতিঘাত সয়েছে।এগুলোই সব পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখতে শিখিয়েছে ওনাকে।তিনি জানেন এ সমাজে নারী নিজে শক্ত না থাকলে তার মাটিতে মিশে যাওয়া অনিবার্য।আর শক্ত থাকলে তাকে পর্যুদস্ত করার চেষ্টা হয় ব্যর্থ।জেরিনকে এটা বোঝাতে হবে ওনার।নিজে পাশে দাঁড়িয়ে থেকে বোঝাতে হবে।কিন্তু কন্যার এমন দুর্দিন দেখে যে পাহাড় তার বুকে ধ্বসে পড়লো তা উপড়ে ফেলে কন্যার সামনে দাঁড়াবেন কি করে সেটাই বুঝতে পারছেন না।নারী হেলেনা কঠোর হলেও মাতৃ হেলেনা কোমল।কঠোরতার পাশাপাশি এই কোমল সত্তাও যে তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।মনে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
জেরিন হাউমাউ করে কাঁদে।বুক ভেসে যায় নোনাজলে।হেলেনা তপ্ত শ্বাস ছাড়েন।গম্ভীর হয়ে বলেন,
“কেঁদো না মা।ও বাড়িতে ভুলেও কেঁদোনা।তুমি যদি ও বাড়ি এভাবে কাঁদো ওদের কর্মের বিজয় হবে।ওরা আর তোমাকে হাসি মুখ চিনতে দিবে না।তোমাকে হাসতে হবে।বুকে পাথর জমিয়ে তোমাকে শক্ত থাকতে হবে।মাকে তুমি দেখোনি কিভাবে সর্বাবস্থায় শক্ত থেকেছে?তুমি আজ রাতটা ওভাবে শক্ত হয়ে থেকে যাও।চোখে চোখ রেখে ওদের ভষ্ম করে দাও।আমি কালই আসছি।তোমার নির্ভার হয়ে।আইনের দ্বারস্থ হবো আমরা।তোমার পাওনাটুকু আদায় করে নিবো।মা পাশে থাকলে মেয়ে দুনিয়া জয় করতে পারে।এটা মাথায় রেখো।”
_________
কয়েক ক্রোশ পথ পেরিয়ে রাতের আঁধারে শ্বশুর বাড়ি ফেরে জুবায়ের।নিজের জীবনের ঘোর অন্ধকার তার চোখে মুখে ছেয়ে আছে।সেই অন্ধকার ফুঁড়ে বাড়ি ঢুকে শ্বশুরের কাছে গিয়ে আশ্রয় নেয় সে।মাথার মাঝে তার অগাধ চিন্তা।সেই চিন্তাটুকু আরও বৃদ্ধি পায় বাড়ির শান্ত আবহ দেখে।সে জিজ্ঞেস করে,
“কনা কোথায় কোথায় আব্বা?”
প্রশ্নটা শুনতেই চমকে ওঠে মোকছেদ,
“কনা কোথায় মানে?ও না তোমার সাথে গেলো?”
শ্বশুরের প্রশ্নে হতভম্ব জুবায়ের আপনমনেই বিড়বিড় করে,
“তারমানে কনা বাড়ি ফেরেনি?”
“না ফেরেনি।কোথায় রেখে এসেছো ওকে?”
জুবায়ের এ কথার জবাব দেওয়ার না।তাদের মাঝে বয়ে যাওয়া ঝড়টুকুর কথাও ওনাকে বলে না।মাস তিনেকের কিছু বেশি সময় গড়ালো মোকছেদ মিয়া হার্টের অপারেশন করেছেন।ওপেন হার্ট সার্জারি।জটিল অপারেশন।চিন্তা পেরেশানির ধকল নেওয়ার মতো শারীরিক মানসিক কোনো অবস্থাই ওনার নেই।কনা জানে এটা।ওনাকে তাই সরাসরি বিষয়টা খুলে বলতে পারে না জুবায়ের।সে হন্তদন্ত করে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মিথ্যে করে বলে,
“বাড়ির মোড়েই নামিয়ে একটু বাজারে গিয়েছিলাম।নতুন সদস্য আসার সুখবর দিতে বেলীদের বাড়ি গিয়ে উঠলো কিনা গিয়ে দেখি।আপনি শান্ত হোন।”
সুকৌশলে কনার গর্ভবতী হওয়ার খবরটা শ্বশুরকে জানায় জুবায়ের।এতে তার পক্ষ লাভেও সুবিধা হবে সাথে মোকছেদ এই আনন্দেই নিশ্চিন্ত মনে থাকতে পারবেন।এই ঝামেলার মাঝে ওনাকে চিন্তায় ফেলে নতুন ঝামেলা পাকানোর অর্থ হয় না।জুবায়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।বাইকের কালো ধোঁয়া রাতের আঁধারে মিলিয়ে দিয়ে ঘ্যাড় ঘ্যাড় শব্দ তুলে পথ ধরে।কিন্তু হতভম্ব জুবায়ের এতটুকু বোঝে না চিন্তায় অকুলান হয়ে কোথায় সে যাচ্ছে?কনা কোথায় থাকতে পারে তাই তো সে জানে না।তাহলে কোথায় খুঁজবে তাকে?
এ মুহুর্তে নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হয় তার।কনা কোথায়?এই রাতের আঁধারে কোথায় হারিয়েছে সে?সেচ্ছায় হারানো ব্যক্তিতে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।তার চেয়েও বেশি চিন্তায় আছে জুবায়ের কনার কোনো ক্ষতি হবে না তো?যদি হয় তবে তার এত সাধের সন্তানের কি হবে?চিন্তায় চিন্তায় দূর্দশা গ্রস্ত ব্যক্তির ন্যায় দিশেহারা হয়ে যায় সে।মোড়ের বাঁক পেরুতে নিয়েই বাঁধিয়ে ফেলে মা’রা’ত্ম’ক দূ’র্ঘট’না।অপজিট থেকে ধেঁয়ে আসা সিএনজির সাথে সংঘর্ষ বেঁধে ছিটকে গিয়ে পড়ে পাশের গভীর খালে।মোটরসাইকেলের একাংশ ভেঙে চু’রমা’র হয়ে যায়।আর সে আস্তেধীরে তলিয়ে যায় অতল পানির গভীরে।চোখের সামনে ঘোর আঁধারে ঢেকে যায়।বলক দিয়ে দিয়ে পানি উপরে উঠতে থাকে।জুবায়ের সেসবের শব্দ শুনতে পায়।এ যেনো জেরিন ও কনার কষ্টের আহাজারি।তার কানের চারপাশে দিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে।প্রিয়দের বেদনার দীর্ঘ শ্বাস শুনতে শুনতে সে তলিয়ে যাচ্ছে মৃ’ত্যুর সন্নিকটে।
জুবায়ের যখন মৃ’ত্যুর কাছে থেকে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে, সেসময়ে কনা আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করছে।তার সাথে প্রতারণার জন্য জুবায়ের এর বিরুদ্ধে কি পদক্ষেপ নেওয়া যায় সে ব্যপারে।
চলবে।