#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
২২.
বসন্তের আগমনী হাওয়ায় গায়ের চামড়ায় রুক্ষতার স্পর্শই বেশি। শীত চলে যাচ্ছে আর হাত পায়ের ত্বক যেন খিঁচিয়ে উঠছে। ত্বকের এই অনুভূতিটা বড্ড বিরক্তিকর লাগে অনুর তারচেয়েও বেশি বিরক্ত লাগছে সোহার কান্ড কারখানা। রাতভর ড্রাইভ করে এসেছে শিশিরদের এলাকায়। তারওপর এখানে এসে একটু রেস্ট নেওয়ার জায়গা নেই বিশেষ করে দুটি মেয়ে যখন একা একা এতদূর আসে তখন তো ভয়েই কোথাও গাড়ি থামিয়ে আরাম করার জো নেই। তারওপর কোথাও কোন রেস্ট হাউজ বা রিসোর্ট, হোটেল কিছুই নেই। ঢাকা থেকে সরাসরি এসেছে শিশিরদের এলাকায় মাঝে বিরতি না নেওয়ায় খুব ভোরে পৌঁছেছে। যার জন্য এখানে আসা তাকেই এখনো জানায়নি সোহা এটা কোন কথা! অনু যখন বলল, “তাড়াতাড়ি তোর শরৎচন্দ্রকে কল দে বল দেখা করতে।”
“না”
“কি না!” অনু কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করলো। সোহা বলল, “আমি পারব না তাকে কিছু বলতে রে অনু ভয় লাগছে খুব।”
ব্যস, এতেই রাগের সীমা রইলো না অনুর। এতোই যখন ভয় লাগছে তো এতটা পথ কেন আমাকে কষ্ট করালি? আবার তো ফিরে যেতে হবে সে খেয়াল কি আছে? আর সবচেয়ে বড় কথা পথেঘাটে যে কোন বিপদ হতে পারে তোর মত সুন্দরীকে নিয়ে যেতে। আর যাইহোক গুন্ডা পান্ডারা আমাকে দেখলে কিছু বলবে না কিন্তু তোকে দেখলেই তো পিছু নেবে আর আমি পারব না নায়িকাকে উদ্ধার করতে। একের পর এক কথা বলে রাগ ঝাড়ছে অনু কিন্তু সোহা! সে তো দুরুদুরু বুকে এখন নিজেকে গালি দিচ্ছে মনে মনে। পুবাকাশে কুসুমরঙা সূর্য তখন চারপাশে মোলায়েম পরশে প্রকৃতিকে জাগাতে ব্যস্ত আর আঁধার লুকিয়ে পড়ছে পাতার ফাঁকে। গাছের ডালে ডালে নানারকম পাখির কলতান শোনা যাচ্ছে। সোহা ফোন হাতে অস্থির হয়ে যাচ্ছে ফোন করবে কি করবে না! মনের আবেগ ঢেউয়ের মত মস্তিষ্কে আলোড়ন তুলতেই সে চলে এলো এতদূর এখন মনে হচ্ছে ঠিক হয়নি এমনটা করা। অনু বিরক্তি আর রাগ একপাশে সরিয়ে আপাতত সমস্যার সল্যুশন খুঁজতে ব্যস্ত৷ বাজারের একপাশে গাড়ি থামিয়ে রেখেছে সে কিন্তু গাড়ি থেকে নামার সাহস তার মত দুর্দান্ত সাহসী মেয়েরও হচ্ছে না এই মুহুর্তে। বারবার মনে হচ্ছে বান্ধবীর পাগলামিতে সায় দেওয়া তার মোটেই উচিত হয়নি। আগেও এভাবে সায় দিয়েই বিপদে পড়ে গিয়েছিল। বছর খানেক আগের কথা তখন সোহা শরতের জন্য একটু একটু পাগল৷ এত বেশি উতলা ছিলো না সেসময় তবুও সোহা চেয়েছিল শরতকে কল দেবে। অনু একটা অচেনা নাম্বার থেকে কথা বলার ব্যবস্থাও করে দিলো। সোহা কল দিতো কিন্তু কথা বলতো না শরত বিরক্ত হয়ে ব্লক করতো৷ একের পর এক ফেসবুক আইডি আর দু তিনটা সিম চেঞ্জ করে এমনভাবেই রোজ বিরক্ত করতো। শরত একদিন থ্রে*ট দিল সে একশন নিবে। অনু ভেবেছিলো কি আর একশন নিবে তারা তো শুধু ফোন করে কিংবা মেসেজ দেয়৷ অথচ শরত করলো ভ*য়ংকর এক কান্ড। সে তার কোন পুলিশ বন্ধুকে দিয়ে সিম কোম্পানিতে যোগাযোগ করে ডিটেইল নিলো এবং শেষ মুহূর্তে অনুর বাবার নামে একটা পুলিশ ওয়ার্নিং গেল হ্যারাসমেন্ট কে*স এর ভয় দেখিয়ে কারণ সিম গুলোর মধ্যে তিনটাই ছিল অনুর বাবার নামে। ভদ্রলোক তো কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছিলেন তার ব্যক্তিগত সিমগুলো থেকে এমনটা কে করেছে! কিন্তু এখন হয়ত শরত বুঝে নিয়েছে কান্ডটা সোহা করেছে। কাল রাত পর্যন্ত ভয় না লাগলেও আজ ভয় হচ্ছে অনুর। আজও না কোন বিপদে পড়ে এই সোহার বাচ্চার জন্য। সময় গড়াচ্ছে সব পাগলামি সোহার ঝিরঝিরে বাসন্তি হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। যে মানুষটাকে দেখার জন্য একটু আগ পর্যন্তও উত্তেজনায় বুক কাঁপছিলো এখন তার মুখোমুখি হওয়ার কথা ভাবতেই হাত পা অসাড় হয়ে আসছে সোহার।
আলতার কাল রাতেও শিশির ভাইয়ের সাথে চ্যাটিং হয়েছে অনেকক্ষণ। ইদানীং তাদের কল, চ্যাট দুটোরই পরিমাণ বেড়েছে খুব৷ তবে কাল রাতের কথার পর আলতার মন খারাপ হয়েছে খুব৷ শিশির কথায় কথায় জানিয়েছে সে হায়ার এডুকেশনের জন্য কানাডা যেতে চায়। আর সেখানে যাওয়া মানে প্রায় দুটো বছর তার সে দেশে কাটবে এরপর দেশে এসে কিছু একটা করবে তবে সেটা অবশ্যই গ্রামে থেকে। আলতা বুঝতে পারে না অনেক বেশি শিক্ষিত হয়ে সে গ্রামে গিয়ে কি করতে পারবে! তবুও যা খুশি করুক তার দেখার বিষয় না তার যা দেখার তা হলো শিশির ভাই বিদেশ যাবে মানে তার থেকে দূর হয়ে যাবে। সে কি করে থাকবে এই শহরে শিশির ভাইকে ছাড়া! ভাবতেই তার দু চোখ ভিজে আষাঢ়, শ্রাবণ হয়ে গিয়েছিল। এত কষ্ট কেন লাগছে রাত থেকে সে বুঝতে পারছে না। সকাল থেকে মন খারাপ করে বসেছিল অনেকটা সময়। কলেজে যাওয়ার সময় হতেই সে তৈরি হয়ে নিলো৷ নাশতা করার মত মুড তার একদমই নেই বলে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে গেল। থেমে থেমে কান্নার একটা ঢোক গলায় এসে আটকে যাচ্ছে। চোখ দুটো আপনাআপনিই জলে টইটম্বুর হয়ে দৃষ্টি ঝাপসা হচ্ছে। কান্না আটকে রাখার চেষ্টায় তার গোলাপি গাল দুটো আর নাকের ডগা রক্তিম হয়ে গেছে। এলোমেলো পা ফেলে সে কলেজ গেইটে পৌঁছুতেই কানে এলো একটা বাক্য, “দোস্ত আমার টমেটো আজ পেকে একদম লাল হয়ে গেছে এক্ষুনি খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।”
আলতার কান ঝা ঝা করে উঠলো কথাটা শুনে। আশপাশের কোন এক কলেজের সুমন নামের এই ছেলেটা আজ প্রায় মাস তিন হবে আলতার পেছনে লেগেছে। শুধু এই ছেলে নয় তার ক্লাসমেট নাহারের ভাই নীরবও আলতাকে পছন্দ করে বলে পেছনে পড়েছে তন্মধ্যে এই সুমন তার লিমিট ক্রস করে ফেলছে। প্রায় প্রত্যেকদিনই কলেজ টাইমে কিংবা ছুটির সময় এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে বিশ্রী বিশ্রি সব ইঙ্গিত দেয় আলতাকে। ভয়ে সে কাউকে কিছু বলতে পারে না। কিন্তু প্রতিদিন এসব বাজে কথা আলতা একদম সইতে পারে না। প্রায়ই ভাবে শিশির ভাইকে বলবে কথাটা আবার ভয় হয় যদি বড় কোন ঝামেলা হয়! আজকাল ফেসবুকের বদৌলতে সে এমন অনেক ঘটনা সম্পর্কে জেনেছে যা শেষতক ভ*য়ংকর কোন রূপ নেয়। সুমন আলতার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে বলল, “তোমার নাকমুখ এমন টসটসে লাগে কেনো গো! আমার একদম চুম্মা দিতে ইচ্ছে করে।
বাক্যটাকে বিশ্রী ভাবে টেনে টেনে বলল সুমন। আলতা দিকবিদিকশুন্য হয়ে দৌঁড়ে গেইটের ভেতর ঢুকে গেল। ক্লাসে গিয়ে ব্যাগ রেখে জোরে জোরে শ্বাস নিলো আলতা তার গলা বুক শুকিয়ে গেছে ভয়ে। তার অবস্থা এমন দেখে ক্লাসের দু তিনজন মেয়ে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলে আলতা কেঁদে ফেলল। অন্যরা মুখে মুখে সান্ত্বনা দিলো কেউ কেউ বলল প্রিন্সিপালকে জানাতে ঘটনাটা৷ কিন্তু নাহার এসে আলতার কাঁধে হাত রেখে বলল, ” রিল্যাক্স আলতা ভয় পেয়ো না। এই সুমনের বাড়াবাড়ি কমানোর ব্যবস্থা আমি এক্ষুনি করছি দাঁড়াও।”
আলতার ভয় কাটেনি উল্টো বেড়ে গেল। কারণ সে গত কয়েক মাসে এইটুকু বুঝে গেছে নাহারের ব্যাকগ্রাউন্ড বেশ উঁচু পর্যায়ের আর নাহারের ভাইও ওই সুমনের চেয়ে ভিন্ন নয়। নাহার তো তার ভাইয়ের স্বার্থে সুমনকে শায়েস্তা করতে চাইছে কিন্তু এসবে আলতা ফেঁসে যাবে নাতো! এক বিপদ দূর করতে অন্য বিপদ ঘাড়ে না চলে আসে! স্বস্তি পাচ্ছে না সে কিছুতেই কান্না পাচ্ছে খুব৷ এই মুহুর্তে তার শুধু মনে পড়ছে শিশির ভাই আর মায়ের মুখটা। দুনিয়ার সকল স্বস্তি তার ওই দুজন মানুষের মাঝেই যেন লুকিয়ে আছে । কান্না করবে না বলেও আবার কাঁদতে লাগলো আলতা ততক্ষণে নাহার ফোনে কাউকে সুমনের ঘটনাটা বলে দিয়েছে৷ ক্লাস শুরু হতেই নাহার বসলো আলতার পাশে। পুরো ক্লাসে গভীর মন দিয়ে ক্লাস করতে চাইলো আলতা কিন্তু আজ কিছুতেই তার মনযোগ স্থির রইলো না। ছুটির পর ভয়ে ভয়ে কলেজ থেকে বের হয়ে গেইটের চারপাশে তাকালো ভয়ে ভয়ে। নাহ এখন সুমন নেই আশেপাশে। হয়ত তার ক্লাস ছুটি হয়নি তাই পৌছায়নি! আলতা দ্রুত এক রিকশা ডেকে চলে গেল।
“নাশতা আমি বানাই নাই আমার অত্ত সময় নাই।” বলেই জয়তুন নাতনিকে নিয়ে বসলেন তার গায়ের কাপড় বদলাতে। শরত হা হয়ে তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে। সে একটু পর দোকানে যাবে আর এখন বলছে নাশতা বানায়নি। এদিকে সকাল থেকে বাড়ির পেছন দিকের একটা মজা পুকুর সাফ করিয়েছে সে আজ লোক নিয়ে। মাছ চাষ করবে বলে সেখানে নিজেও কাজ করেছে। অনেক দিন ধরেই তার মাথায় ঘুরছিল মাছ চাষের ব্যাপারটা কিন্তু নিজেদের পুকুর না থাকায় করতে পারছিলো না। কয়েক দিন আগেই পাশের বাড়ির এক কাকার পুকুরটা নিয়ে কথা হতেই জানতে পারলো তিনি সেটাকে সাথে একটা জমিও বিক্রি করবেন। শরতের হাতে অত টাকা নেই সে তার কাকাকে দিয়ে অনেক বুঝিয়ে পুকুরটা কিনেছে৷ টাকা পয়সার ধারকর্জা তার খুব একটা পছন্দ না তবুও এই মুহুর্তে সুযোগ পেয়ে হাত ছাড়া করতে চাইলো না। আহসানুল্লার থেকেই ধার নিয়ে সামনে আগাচ্ছে। আজ সকালে লোক নিয়ে পুকুরে নেমে তা সাফ করে কচুরিপানা পরিষ্কার করেছে। ঘন্টা দুইয়ের পরিশ্রমের পর এখন গোসল সেরে মায়ের কথা শুনে তার অবস্থা খারাপ৷ খিদেয় পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে আর মা বলে কিনা রান্না করেনি! সে বলল, তাহলে মুড়িটুড়ি কিছু থাকলে দেন খাই।”
“মুড়ি নাই।”
“কাকি নাশতা বানিয়েছে না আমি ও ঘরে খাচ্ছি।” কথাটা বলে বের হতে গেলেই জয়তুন খেঁকিয়ে উঠলো, “শরম করে না তোর, বিয়ার বয়স হইছে বিয়া কইরা বউয়ের হাতে রান্ধাইয়া খা৷ তা না কইরা মা, চাচীরে কাম করাইয়া পেট ভরতে চাস! তোর বয়সের কোন পোলাডা অহনও আবিয়াইত্তা আছে গেরামে?”
জয়তুনের যা ভাষণ শুরু হয়েছে তাতে শরত বুঝে গেল বিয়ে নিয়ে আবারও তার মায়ের মাথা খারাপ হয়েছে৷ কিন্তু এখন এসব কানে নেওয়া সম্ভব নয় তার ফোকাস এই মুহুর্তে মাছ চাষে। শিফার কাছেও আর খাবার চাইলো না শরত। চুপচাপ দোকানের চাবি আর টাকা পয়সা মানিব্যাগে ঢুকিয়ে বাড়ি থেকে বের হলো। হোটেলের নাশতাই আজ কপালে আছে তা বেশ ভালো করেই বোঝা হয়ে গেছে৷ রোদ ঝলমলে সকালটা বিরক্তিতে কাদা হয়ে গেল এই বিয়ের নামে৷ জোর পায়ে হেঁটে বাজারে পৌঁছুতেই তার চোখে পড়লো মেইন রোডের থেকে বায়ে গ্রামের মোড়ে একটা সাদা গাড়ি৷ গ্রামে কারো নিজের গাড়ি নেই। গ্রামের বাইরের কারো গাড়ি ভাবতে ভাবতেই সেদিকে তাকিয়ে রইলো কয়েক সেকেন্ড তারপরই হোটেলের দিকে এগোচ্ছিলো সে। হঠাৎ কি মনে করে আবার গাড়ির জানালায় তাকাতেই তার মনে হলো পরিচিত কোন মুখ দেখলো। তাকে চমকে দিয়ে সত্যিই একটা পরিচিত মানুষ বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে। পরিচিত মুখটার দিকে তাকিয়ে সে আবার চলে যেতে উদ্যত হলো তখনি ডাক পড়লো, প্লিজ যাবেন না।
শরত দাঁড়াতে চাইলো না দেখে গাড়ির ভেতর থেকে অনু চিৎকার করে বলল, “আরে শরৎচন্দ্র একটু দাঁড়াইতে কি সমস্যা!”
শরত দাঁড়ালো ; চোখ ঘুরিয়ে চারপাশে তাকালো। মানুষের তো কমতি নেই বাজার আর রাস্তার দিকে। পরিচিত কেউ দেখলেই তো ঝামেলা বাঁধতে পারে ভেবে তার মেরুদণ্ড শক্ত হলো। সোহা চলে এসেছে একদম মুখোমুখি।
“এখানে কি করছো তেমরা?”
“কাল তো মেসেজ দিলাম আমি আসছি বলে সিন করেননি?”
“কি করতে চাইছো তোমরা বলোতো!”
“আপনি বোঝেননা কি করতে চাই কি চাই আমি?” ভয়ে ভয়ে কথাটা বলেই ফেলল সোহা। শরত গম্ভীর মুখটা আরও গম্ভীর আর চোয়াল শক্ত করে তাকালো সোহার দিকে। তারপরই আশপাশ দেখে বলল, “আমি এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে একটা কথাও বলতে চাচ্ছি না৷”
সোহা মাথা নিচু করে ফেলল কথাটা শুনে। সেও বুঝতে পারছে এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে কথা বলাটা খারাপ দেখাচ্ছে। শরত নিজেই এবার বলল, “আমি তোমাকে আধঘন্টা সময় দিচ্ছি যা বলার বলে বিদায় হবে। অনুকে নিয়ে কলেজ রোডে মিনিট দশেক দূরেই একটা নতুন পার্ক হয়েছে সেখানে গিয়ে পৌঁছাও আমি আসছি।” কথাটা বলতে বলতে শরত মোবাইলে সময় দেখলো। সাড়ে নয়টা বাজে তারমানে পার্ক খোলা পাবে৷ সোহাও আর কিছু না বলে গাড়িতে গিয়ে উঠলো। অনুকে জানালো শরত যা বলেছে। ততক্ষণে শরতও একটু এগিয়ে অটোতে উঠে বসেছে। মিনিট দশ পরেই তারা শরতের বলা জায়গায় পৌঁছে গেছে কিন্তু শরত তখনও পেছনে। আরও কয়েক মিনিট পর শরত এলে তারা পার্কে ঢুকলো। সবুজে ঘেরা পার্কটা বেশ খানিকটা খোলামেলা জায়গা আর মাঝেমাঝে একটা করে খড়ের ছাউনি দেয়া গোল টেবিল৷ শরত গিয়ে একটা টেবিল দেখিয়ে সোহা অনুকে বসতে বলল। তখনও শরতের চোখমুখ ভীষণ কঠোর লাগছিলো তা খেয়াল করে অনু বলল, “তোরা কথা বল আমি একটু চারপাশ ঘুরে দেখি।”
সোহা হাত খামচে ধরলো অনুর তা দেখে শরত বলল, “ওকে টেনে ধরছো কেন কথা তো তোমার বলার ছিল তাই না!”
শরতের কঠিন, শীতল কণ্ঠ শুনে সোহা এবার ভয়ে জমে গেল। তার সকল পাগলামি বসন্তের এই রোদহাওয়ায় ফুড়ুৎ করে পালিয়ে গেল দূরে কোথাও। এই লোকটাকে সে যতোটা ভালোবাসে ঠিক ততোটাই এখন ভয় পাচ্ছে। তার খালা বলে ঠান্ডা মানুষ গরম হলে বিপদ ধেয়ে আসে সাইক্লোন গতিতে। এখন তার শরতকে দেখে তাই মনে হচ্ছে৷ অনু সত্যিই সরে গেছে তাদের সামনে থেকে৷ সে নেট অন করে শিশিরকে ভিডিও কল দেওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু নেটওয়ার্ক এত বাজে যে কল কিছুতেই কানেক্ট হচ্ছে না।
“কথা শুরু করো৷”
” কোন কথা?”
বোকার মত উল্টো প্রশ্ন করলো সোহা৷ তার ভয় লাগছে খুব। শরত আবার বলল, “যে কথা বলতে ঢাকা থেকে রাতভর জার্নি করে একা দুটো মেয়ে এখানে চলে এলে সেই কথা বলো। আচ্ছা তোমাদের পরিবারের মানুষগুলো কেমন তারা কি করে এলাও করলো তোমাদের এভাবে আসাটা?”
শরতের মুখ নিঃসৃত প্রতিটি বাক্য শুনে আরও স্তব্ধ হয়ে গেল সোহা। তার চোখে জল থৈ থৈ যেকোন মুহূর্তে আষাঢ়ে ঢল নামবে। শরত দেখেও তা উপেক্ষা করে আবার বলল, “এত কিসের প্রেম ভালোবাসা আসে তোমার? বয়স কতটুকু হয়েছে? বিশ, বাইশ! জীবনটাতে করার মত এখনো কত কি বাকি আছে বাস্তবতা জানা আর বোঝার অনেক বাকি৷ অনার্সটাও এখনও কমপ্লিট হয়নি মাথায় প্রেম ভালোবাসার ভূত নিয়ে কত দূর একা একা চলে এলে। নিশ্চয়ই রাতভর ড্রাইভ করেছে অনু আর তুমি তার পাশে বসে হয় প্রেম নিয়ে ভেবেছো নয় প্রেম না পেলে কি করবে তা নিয়ে। একবারও কি ভেবেছো হাইওয়েতে কোন কারণে পুলিশ চেকিং কিংবা গাড়ি নষ্ট হলে কি হতো কি করম ফ্যাসাদে পড়তে দুটো মেয়ে! আর তখন হয় সম্ভ্রম হারিয়ে মৃত্যু মুখে যেতে, নয় থানায় গিয়ে পরিবারকে হ্যারাস হওয়ার পথ করে দিতে সমাজের মুখে। আমি ভেবে পাই না এত সাহস তোমরা দেখাও কিসের জোরে!” শেষের কথাটা বলে শরত সিমেন্টে তৈরি টেবিলটাতে আচমকা মুষ্টিবদ্ধ করে ঘুষি মেরে বসল। সোহা আকস্মিক এমন কান্ডে ভয়ে কেঁপে উঠলো৷ অদূরেই অনু ভিডিও কলে শিশিরকে দেখাচ্ছিলো শরত সোহাকে সেখানে অনুও ভয় পেল বুঝি কিছুটা আর ফোনের ওপাশে শিশির ঘাবড়াল৷ তার ভাই কি নিয়ে এমন হাইপার হলো! আর যাইহোক শরত ভাইকে সে এতটা ক্রোধ প্রকাশ করতে কখনোই দেখেনি। তার মনে পড়ে শিউলিকে কলেজে এক ছেলে ডিস্টার্ব করতো বলে ছেলেটাকে এক থাপ্পড়ে দাঁত নড়িয়ে ফেলেছিলো তখনও এমন কঠোর, হিংস্র মুখাবয়ব দেখেনি। অনু দ্রুত সামনে এগিয়ে এলো ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে। ততক্ষণে শরত আবার ধমকে উঠেছে সোহাকে, “সেদিন ভোরে আমি তোমাকে খুব ভালো করেই বুঝিয়ে ছিলাম সোহা তবুও এমন একটা কান্ড কি করে করো? ভালো কথা মগজে ঢোকে না তাই না! আর তুমি অনুর দিকে তাকিয়ে বলল, ” বান্ধবী আ*গুনে ঝাপ দিতে বললে কি সেটাও করবে”
কিসের কথা বলতে এসেছো তোমরা এখানে। কিসের এত ডেস্পারেটনেস বলোতো৷ মুখের ওপর প্রত্যাখান করার পরও কি করে এত প্রেম আসে বলো তো! লজ্জা হওয়া উচিত আমি বারংবার ইগনোর করেছি এতদিনে তো বুঝে যাওয়া উচিত ছিলো আমার মধ্যে কোন ফিলিংস নেই তোমার জন্য।”
“কোন ফিলিংস নেই তাহলে এত শাষণ করছেন কেন? কেন এত উত্তেজিত হলেন আমার পাগলামি করে একা চলে আসাতে!”
মুখ ফুটে সোহা বলেই ফেলল কথাটা। শরত বিষ্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকালো সোহার দিকে। মেয়েটা কি সত্যিই পাগল! তাদের এ পথে আসার কারণে যদি কোন বিপদ ঘটতো তো সরাসরি ফেঁসে যেত শরত৷ তা বোঝাতে চাইলে অনু বলল, “ওহ সেকারণেই বলি এত কেন উত্তেজিত হচ্ছে শরৎচন্দ্র । ফোন বের করে এক্ষুনি ডিলিট করো সোহার করা মেসেজগুলো। আর এই সোহা তুই কার ফেন থেকে মেসেজ পাঠিয়েছিলি সেটাও ডিলিট করা ফোন করে। ” শরত যতোটা উত্তেজিত হয়ে কথা বলছিলো ঠিক ততোটাই অনুও হলো। শরত দু হাত মুঠো করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করলো। সে এমন তো কখনও করে না আজ এমন করলো কেন? সময়টা সকাল হওয়াতেই বুঝি পার্কটাতে খুব একটা লেকের আনাগোনা নেই। এ পাশে শুধু তারা তিনজনই আছে৷ শরত নিজেকে শান্ত রেখে আবারও কিছু বলতে চাইলে অনু তাকে থামিয়ে দিয়ে সোহার হাত টেনে ধরলো, “এ্যাই এখনো বসে আছিস কেন? ওঠ বাড়ি যাব এক্ষুনি আর একবারও যদি ভুল করে তোর মুখে শরতকে নিয়ে কোন কথা শুনি তবে মনে রাখিস আমি অনু গলা টি*পে তোকে হ-ত্যা করব৷ আর হ্যা শরৎচন্দ্র তুমি কোথাও বোধহয় ছ্যাকা খেয়ে বেঁ*কা হয়ে আছো তাই রিয়েল জেম চিনতে পারলে না৷ আমি দোয়া করি তুমি যেন অতিসত্বর আফসোস করো এই হীরার জন্য।”
শরত গরম চোখে অনুর দিকে তাকিয়ে রইলো।
চলবে
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
২৩.
“খিদে থাকলে বোসো না থাকলে চেয়ে চেয়ে দেখো। আমি নাশতা করিনি খিদে নিয়ে আর বসে থাকতে পারবো না।” জলদগম্ভীর কণ্ঠে কথাটা বলে শরত রেস্তোরাঁর একটা ছেলেকে ডেকে বলল তেল ছাড়া পরোটা আর বুটের ডাল, সবজি আর দুটো কাঁচামরিচ দিতে। পার্ক থেকে বের হতেই ঘড়িতে দেখলো সাড়ে দশটা বাজে। এদিকে দোকানের কর্মচারী ছেলে দুটোও কল দিয়েছে কয়েকবার সাথে কাকাও। দোকান বন্ধ দেখেই তারা কল দিচ্ছে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু পেটের খিদে আর গরম মেজাজে আপাতত কোন দিকেই মাথা ঘামাতে চাচ্ছে না তাই অনু, সোহাকে নিয়ে পার্কের পাশেই একটি রেস্তোরায় ঢুকলো। এখানে নতুন পার্ক হওয়াতেই মোটামুটি মানুষের আনাগোনা আছে। শরত ভেতরে ঢুকেই এক টেবিলে বসে তাদের ইশারা করলো বসতে। সোহা এখনো জল ছলছল চোখে মাথা নিচু করে আছে। কথা কোথাও আগায়নি তাদের শুধু শরতের রাগটুকুই যা দেখতে পেল। শরতের অবস্থা দেখেই বোঝা গেলো সে ভীষণ ক্ষুধার্ত৷ এদিকে খিদে তো অনু আর সোহারও পেয়েছে তাই অনু চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ” একজনের নাশতা বললে কেন? আমাদের খিদে পায়নি নাকি!”
“সেটা তো তোমরাই ভালো জানবে।” চকিতে জবাব দিলো শরত। বাঁশের তৈরি ছোট্ট কুটিরের মত রেস্তোরাঁটার চারপাশে অসংখ্য সুপারি গাছে ভরা। রেস্তোরাঁর চারপাশে দেয়াল কম খিঁড়কি জানালাই বেশি আর সে কারণেই ভেতরে বসেও চারপাশটা খুব ভালো চোখে পড়ে। অনু গভীর মনযোগে চারপাশে চোখ বুলিয়ে বলল, “জায়গাটা দারুণ তবে প্রেম করার জন্য খুব একটা ভালো না। সোহা তোর কপাল মন্দ রে বিয়ের পর শরৎচন্দ্রের সাথে প্রেম করতে কোথায় যাবি বল তো! এ এলাকায় ঘোরার জায়গা অনেক আছে কিন্তু একটু চুমুটুমু খাওয়ার আড়াল করা জায়গা নেই।”
নাশতা এখনো টেবিলে আসেনি সবে মাত্র এক গ্লাস পানি মুখে তুলছিলো শরত। অনুর কথা শুনে খালি গলায় বিষম খেয়ে পানি তার নাকে মুখে ওঠে গেল। সোহা এমনিতেই মাথা নত করে বসে কান্না লুকাচ্ছিলো সে কিন্তু অনুর কথা আর শরতের বিষম দেখে আঁতকে উঠল। কোন কিছু না ভেবেই সে চেয়ার ছেড়ে শরতের পিঠে হাত রাখতে যাচ্ছিলো। শরত তৎক্ষনাৎ হিসহিসিয়ে বলল, “কিসব শুরু করলে বলো তো! একটা পাবলিক প্লেসে বসেও আলতু ফালতু কথা বলতে মুখে আটকাচ্ছে না?”
সোহার এবার আর এখানে একদমই বসতে ইচ্ছে করলো। মনটা ভেঙে একদমই খানখান হয়ে গেছে৷ সে অনুর দিকে তাকিয়ে বলল, চল অনু ঢাকা ফিরব।
“এক থাপ্পড় খেলে না মাথা মগজ সব শান্ত হয়ে যাবে। বোসো চুপচাপ একটা কথাও যেন না শুনি।” কথাটা বলে শরত উঠে গেল। এগিয়ে গিয়ে যে ছেলেকে নাশতার অর্ডার দিয়েছিল তাকে বলল তিন প্লেট নাশতা দিতে। মিনিট পাঁচের মাঝে টেবিলে নাশতা এলো। শরত, অনু খাওয়া শুরু করলেও সোহা ছুঁয়েও দেখলো না। শরত খেয়াল করলেও কিছু বলল না। খাওয়া শেষে বিল মিটিয়ে সে প্রথমে কল দিলো তার কাকাকে। আহসান ব্যস্ত ছিল নিজ কাজে। শরতের ফোন পেয়ে স্বস্তি পেল এবার। ফোন রিসিভ করেই বলল, “কোথায় গিয়েছিস বল তো! বাড়িতে নাকি খেয়েও আসিসনি!”
“কাকা আমি একটা দরকারে ঢাকা যাচ্ছি। হুট করেই যাওয়া তাই বাড়িতেও বলতে পারিনি। আমি কাল সকালের মধ্যে ফিরে আসব।”
আহসানকে বুঝিয়ে বলতেই সে যা তবে সময় পেলে আলতাকেও দেখে আসিস।”
“হ্যাঁ কাকা দুজনকেই দেখে আসব।”
কথা শেষ করে শরত তার ওয়ালেট চেক করে নিল। আছে টাকা পয়সা কিছু সমস্যা হবে না দেখে আর দেরি করলো না। অনুকে জিজ্ঞেস করলো গাড়ি ড্রাইভ করার মত এনার্জি আছে কিনা! অনু জানালো সে ফুল এনার্জেটিক অলওয়েজ নো টেনশন৷ ব্যস শরত উঠে পড়লো ড্রাইভার এর পাশের সিটে। তখনো ‘থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো সোহা। সে বুঝতেই পারছে না কি হতে চলেছে। অনু বেশ বুঝে গেল ব্যপারটা সে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো। শরত কয়েক সেকেন্ড সোহার দিকে তাকিয়ে থেকে হাঁক ছাড়লো, “এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন বাড়ি ফেরার ইচ্ছে নেই?”
আরও এক ধমক! এবার আর কান্না কিছুতেই থামলো না সোহার। সে কাঁদতে কাঁদতেই পেছনের সিটে উঠে বসেছে। সূর্যের রঙ কমলা থেকে কাচরঙা হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। সেই রোদ্দুর গাছের পাতা, সবুজ মাঠ কখনোবা নদীর ওপর গা এলিয়ে বসছে শীত শেষের রুক্ষতার মত। রাতের ড্রাইভিংয়ে শরীরের অবস্থা অনুর বেহাল তা বুঝতে পেরেই শরত বলল, “চাইলে ড্রাইভার চেঞ্জ করতে পারো।”
“আর ইউ সিরিয়াস!”
“এত রিয়াকশন দেওয়ার কিছু নেই। আরও বছর আট আগে পড়াশোনা নিয়ে মাথায় দারুণ কিছু ছিল মানে এব্রোড যাওয়ার প্ল্যান সেই সাথে সেখানে গিয়ে পার্ট টাইম জব হিসেবে ড্রাইভিং করব এমন কিছুও কলেজের স্যার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। সেই সূত্র ধরেই কাকার সহযোগিতায় এটা শিখেছিলাম।”
বড্ড উৎসাহ নিয়ে কথাটা বলেই শেষের বাক্যে শরতের মুখটা মলিন হয়ে উঠল। সোহা মন খারাপ ধরে রেখেই চুপচাপ শুনছিলো শরতের কথাগুলো কিন্তু অনু একের পর এক প্রশ্ন করে চলছে।
“তা শেষ পর্যন্ত যাওয়া হলো না কেন?”
“অনেক সমস্যা ছিল তবে মূল সমস্যা ফিনানশিয়াল ক্রাইসিস ছিল। কাকা খুব করে চাইতেন যেন আমার ইচ্ছে পূরণ হয় কিন্তু নিজেই নিজের অবস্থান বুঝে গিয়েছিলাম তাই আর পড়াশোনার জন্য নিজের জেলার বাইরেও যাইনি। এখন অবশ্য আলহামদুলিল্লাহ আমার এবং কাকার যা আছে মিলেমিশে আমরা শিশিরকে দিয়ে আমাদের স্বপ্নপূরণ করব ভাবছি৷ তোমরা তো নিশ্চয়ই জানো শিশির এপ্লাই করেছে দুটো ইউনিভার্সিটিতে। একটা সম্ভবত কানাডা আর অন্যটা…
” লন্ডনে”
সোহা বলল নাকি সুরে। তার কান্না থামলেও এখনো যে কান্নার ঢোক গলায় আটকে আছে বোঝা গেল। আবারও সোহা বলল, “শুধু শিশির না অনু আর এক ফ্রেন্ড হৃদয় ওদের ডিপার্টমেন্ট এর তিনজনই ট্রাই করছে। যার কপাল লাগে আরকি!”
সোহার কথা শুনে শরত ভ্রু কুঁচকে একবার অনুর দিকে তাকালো। তারপরই নিঃশব্দে হাসলো আয়নায় সোহার মুখটা দেখে। গাড়ি রাস্তার পাশে থামিয়ে সিট চেঞ্জ করলো অনু আর শরত। অনেক বছর পর বলে প্রথমে একটু দ্বিধায় ভুগলো শরত তারপর অনুর হেল্প নিয়েই স্টার্ট করলো। মিনিট দশেকের মধ্যে হাত ফ্রী হয়ে এলো শরতের। এখন আর দ্বিধা নেই ড্রাইভিং। টানা ঘন্টা দেড়েক ড্রাইভিং এর পর একটা ফিলিং স্টেশনে গাড়ি থামালো। ওয়েল ট্যাংক ফুল করা হলো, মেয়ে দুজন একটু রাস্তার পাশে হাটাহাটি করল। অনু অবশ্য এক ফাঁকে একটা সিগারেটও খেতে ভুলল না। কয়েক দিন ধরেই সে চেষ্টা করছে সিগারেট খাওয়াটা কমিয়ে দেওয়ার সেই সুবাদেই আজ দিনের এটা প্রথম স্মোক ছিল। শরতকে এক ফাঁকে সিগারেট সেধেছিল অনু শরত মুখের ওপর না করে দিয়েছে। দুজনেই ভেবে নিলো শরত সিগারেট খায় না। গাড়ি পুনরায় চলতে লাগলো আবারও হাইওয়েতে। ভর দুপুর গা জ্বলা বাসন্তি রোদ সেই সাথে বসন্তের মসৃন হাওয়া তিনজনকেই যেন সহজ করে তুলল একে অপরের সফরসঙ্গী হিসেবে। জার্নিটা তাদের একদমই মন্দ হচ্ছে না বৈরী পরিস্থিতিতেও। সোহার মুখটা আজ শরত অনেকবার গভীর মনযোগে লক্ষ্য করেছে। গোলগাল আদলে মোটামুটি টানা দুটি চোখ, পুরু ঠোঁট আর থুতুনির বা দিকে ছোট্ট একটা কালো মিচমিচে তিল। নাকটা খুব সরু নয় তবে চিকন বলে দারুণ লাগে। গায়ের রঙটা মোটামুটি ফর্সাই বলা যায় হতে পারে বিভিন্ন প্রসাধনীর মহত্বে এমনটা হয়েছে আবার নাও হতে পারে। মেয়েটা দেখতে ভালো, পড়াশোনায়ও ভালো তারওপর ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডও চমৎকার এমন একটা মেয়ে কি ভেবে তার জন্য পাগলামি করছে? প্রেম ভালোবাসা কি সময় পার করার মত একটা খেলা! যদি তা না হয় তবে মেয়েটা কেন সবদিক ভাবছে না? শরত তো আর কোনদিন প্রেমের নামে কোন সম্পর্কে জড়াবে না সে সম্পর্ক বলতে এখন শুধু বিয়েটাকেই বোঝে। যেদিন কারো সাথে বাঁধা পড়ার মত অবস্থা হবে সেদিন সরাসরি বিয়ের বন্ধনেই বাঁধা পড়বে। কিন্তু সোহা তো তার বিয়ের জন্য উপযুক্ত নয়। অসম সম্পর্ক সে কখনোই চায় না যেখানে একজনকেও অপমান করার মত কোন ত্রুটি থাকবে৷
আজ সকালেও আলতা কলেজে যাওয়ার পথে আতঙ্কে ছিল সুমনের ভয়ে। কিন্তু সুমন ছিলো না আজ পথে। ভয় ছিল যাওয়ার সময় থাকবে কিন্তু নাহ, ছুটির পরও আজ সুমন কিংবা তার বন্ধুরাও কেউ ছিল না। স্বস্তির শ্বাস ফেলে সে ফিরে গেল নিজ গন্তব্যে। রুমে ফিরে কাপড় বদলে গোসল সারল প্রথমেই। কোচিংয়ে যাবে চারটায় তার আগে খাওয়া আর ঘুমানোর সুযোগ আছে তার। তিন দিন কোচিং তিনদিন টিউশনি একই টাইমে হওয়ায় দুপুরের এই এক টুকরো সময় আলতা প্রতিদিন ঘুমিয়ে কাটায়। এতে তার দুটো সুবিধাও হয় প্রথমটা রাত জেগে পড়া দ্বিতীয়টা পড়ার ফাঁকে শিশিরের সাথে টুকটাক চ্যাট। আজকাল তারা দুজন বাঁধন হারা পাখির মত নিজেদের কল্প রাজ্যে যুগল হয়ে উড়ে বেড়ায়। কথায় কথায় শিশির ভালোবাসা মিশ্রিত অনেক কিছুই বলে শুধু সরাসরি ভালোবাসি কথাটাই বলে না। আলতার অবুঝ আবেগ প্রায়ই বিধ্বস্ত হয়ে উঠে এই একটি শব্দ শুনতে। কিন্তু শিশির ভাই তো শিশির ভাই-ই সেকি অত বোঝে নাকি আলতার মন কি চায়! সে শুধু বোঝে কি করে আলতাকে বকে ধমকে শাষণ করা যায়। গোসল সেরে খাওয়া শেষ করে যথারীতি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিল আলতা। সিনিয়র রুমমেটটি এখনও আসেনি বলে ঘরের দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে সবে বিছানায় গা এলিয়েছিল চোখ বুঁজেছিল। ফোনটা ভাইব্রেশনে হঠাৎ কেঁপে উঠতেই চোখের পাতা মেলল৷ স্ক্রীণে তার আকাঙ্ক্ষিত নামটাই ভাসছে দেখে আকস্মিক বুক ধড়ফড় করে উঠলো। এমন হলো কেন! মানুষটা তো রোজই কল দেয় তবে আজ এমন ভিন্ন অনুভূতি হচ্ছে কেন? পরেই মনে পড়লো আসলে এই অনুভূতিটা ভয়ের মানুষটাকে হারিয়ে ফেলার। সেই যে কাল বলল বিদেশে চলে যাবে পড়াশোনা করতে তারপর থেকেই তো আলতার হুটহাট চোখের পাতা ভিজে উঠছে, মনটা খালি খালি লাগছে। শিশির ভাই বিদেশে গিয়ে পড়ালেখা করলে নিশ্চয়ই অনেক দামী মানুষ হয়ে যাবে! আর সেখানে নিশ্চয়ই অনেক অনেক সুন্দরী বান্ধবীও হবে তার! আবারও মন খারাপ হয়ে গেল আলতার। এদিকে ফোনটা বেজেই চলছে অনবরত সেদিকে খেয়াল হতেই ফোন তুলল সে। রিসিভ করে সালাম দিতেই শিশির ভাই অবাক হওয়া কণ্ঠে প্রশ্ন করল, “ঘুমিয়ে পড়েছিলি!”
“নাহ”
“ওহ জলদি একটু বাইরে আয় তো।”
কথাটা শেষ হতেই কল কাটলো শিশির। আলতা যেভাবে ছিল সেভাবেই বের হলো শুধু ওড়না টেনে মাথা ঢেকে৷ গেইটের কাছে আসতেই দেখলো রাস্তার ওপাশে পায়চারী করছে শিশির। হাতে তার ছোট্ট একটা কাগজের ব্যাগ। এটা মেইন সড়ক না হওয়ায় রিকশা ছাড়া অন্যান্য কোন যানবাহন খুব একটা চোখে পড়ে না তাই আলতা অনায়েসেই রাস্তা পার হয়ে গেল। শিশিরের কাছে পৌঁছুতেই শিশির বলল, “এটা নে।”
“কি এটা?”
“কাচ্চি প্যাকেট।”
“কিন্তু আমি তো লাঞ্চ করে ফেলেছি শিশির ভাই।”
“তো কি হইছে আবার খাবি।”
“পেটে জায়গা নেই।”
“এক থাপ্পড় দিলে জায়গা আপনাআপনি হয়ে যাবে।”
শিশিরের এ কথায় আলতার ভীষণ রাগ হলো। সে চোখ মুখ কুঁচকে বলল, “থাপ্পড় দিলেই কি পেট খালি হয়!”
“তর্ক করছিস কেন? হু! এখন না পারলে পরে খাবি।কোচিংয়ে যাওয়ার আগে।”
আলতা এবার আর এ নিয়ে কথা বলতে চাইলো না। সে জানে শিশির ভাই এখন আর কিছু বললে এই রাস্তায়ই চটাস করে চড় মেরে বসবে। অযথা নিজের বেইজ্জতি কে করতে চায়! কিন্তু হঠাৎই তার মনে পড়লো কাল রাতের কথা৷ সোহা আর অনু নাকি গ্রামে গেছে! সত্যি বলতো এখন শিশিরকে সামনে পেয়ে তার আরও কিছুক্ষণ কথা বলতে ইচ্ছে করছে। পাশাপাশি হাঁটতে ইচ্ছে করছে কিন্তু তা মুখে কি করে বলবে! বসন্তের মাতাল হাওয়ায় এই দুপুর বড় গা এলানো মনে হয় আলতার। কিন্তু শিশির ভাইকে পাশে পেয়ে গা নয় বরং মনটাকেই এলিয়ে দিতে ইচ্ছে হয় শিশির ভাইয়ের পিঠে। কোথাও বসে বলতে ইচ্ছে হয় আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিন না যেমনটা সেই আঁধার রাতে বাসের সিটে বসে দিয়েছিলেন৷ অথচ একটু জড়িয়ে রাখুন নিজের বুকে যেন আমি শুনতে পাই আপনার হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দন। সাহসে কুলোয় না এই কথাগুলো মুখ ফুটে বলার তবুও আলতা চায় বলবে কোন একদিন৷ কোন এক শরত ভোরে শিশির ভেজা কোন সবুজ আঙিনায় বসে আলতা শিশিরকে বলবে তার মনের এই কথাগুলো। সময়টা যদিও আরও দূরে তবুও আলতার বিশ্বাস এমন এক ভোর আসবে তাদের জীবনে। সত্যিই কি আসবে! নাকি এই ইচ্ছে তার এই স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন হয়েই থাকবে!
আলতার মনের শিহরণ কি শিশিরকেও একটু আলোড়িত করল! হয়তো করেছে, হুট করেই শিশির বলল, আজ আর ঘুমাতে হবে না বাতাস আছে খুব সামনে থেকে হেঁটে আসি৷ আলতা তো এমন কিছুই চাইছিলো তাইতো আর কোন রা করেনি। ফুটপাত ধরে হাঁটা ধরলো দুজন৷ শিশিরই মুখ খুলল, “সোহা আর অনু ভাইয়ের কাছে ভীষণ ধমক খেয়েছে।”
আলতা চকিতে তাকালো শিশিরের দিকে। তার পা চলা থেকে গেছে। শরত ভাই আর ধমক! আলতার বিশ্বাস হলো না অন্তত সোহা অনুর নামে তো একদমই নয়। শরত ভাই কখনো তাদেরকেই ধমকায়নি সেখানে ওই দুটো মেয়েকে অসম্ভব! শিশির বুঝলো আলতা কি ভাবছে তাই সে আবার বলল, “ভালোবাসা জিনিসটা আসলে জোর করে হয় না। সোহা ভাইকে ভালোবাসে কিন্তু বুঝতে চাইছে না ভাই তাকে ভালোবাসে না। ভাই এখনো হয়ত মনে মনে অলিকে ভাবে অথবা ভালোবাসা নিয়ে মনের ভেতর রাগ কিংবা ঘৃণা বোধ রাখে৷ ভাই তো আবার বাস্তববাদী মানুষ তাই সোহাদের ফ্যামিলিগত অবস্থান ভেবেও ভাই সোহাকে মানবে না।”
হাঁটতে হাঁটতে কত কথা বলছে শিশির তা ভেবে আলতার ভালো লাগছে। শিশির ভাই তাকে এখন আর একদম ছোট বলে অগ্রাহ্য না করে মনের ভেতর থাকা কথাগুলো শেয়ার করছে। পথের পাশে মাঝে মাঝেই কিছু ফুলগাছ রয়েছে, কোথাও কোথাও বড় কৃষ্ণচূড়া গাছও চোখে পড়ছে। সে গাছের ছায়ায় হাঁটতে হাঁটতে আলতা প্রশ্ন করে বসল, “শরত ভাইয়ের সাথে অনু আপার বিয়ে হলে কেমন লাগবে!”
শিশির থমকালো; পা চলা বন্ধ হলো। সে মুচকি হেঁসে বলল, “এমন কেন বলছিস?”
“আমার আগে মনে হতো অনু আপা শরত ভাইকে পছন্দ করে। ওই যে যখন তখন শরৎচন্দ্র বলে ডাকে আবার আমি শুনেছি শরত ভাইকে প্রথমে ফোন অনু আপাই করেছিলো তোমার ফোন থেকে নাম্বার চুরি করে।”
চোখ দুটো বড় বড় করে শিশির আলতার দিকে তাকালো।
“তুই এত কিছু কি করে জানলি? গোয়েন্দাগিরি করিস আমার বান্ধবীদের পিছনে! আর কি জানিস বল তো জলদি বল।”
কেমন তাড়া দিয়ে ধমকে উঠলো শিশির। আলতার রাগ হয়ে গেল তাই মুখটা বাঁকা করে বলল, সোহা আপাকেও তো দেখলে মনে তো তোমাকে পছন্দ করে।”
“আর তাই তুই সোহাকে দেখলেই বিড়বিড় করে গালি দিতি তাইনা!”
“মোটেই না।”
“এ্যাই উল্টো ফির এখনই রুমে ফিরবি তুই গিয়ে ঘুম দিবি।” বলেই শিশির উল্টেপথে আবার হাঁটতে লাগল। আলতার থেকে মুখ লুকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতেও লাগল সে। ভালোবাসার মানুষটি তবে আগে থেকেই তাকে ভালোবাসে নয়ত জ্বলতো কেন সোহাকে নিয়ে! বসন্তের হাওয়াটা এবার শিশিরের মন, প্রাণ দেহে আনন্দের দোলা দিতে লাগল ঝিরঝিরানি শব্দ তুলে। আলতাকে হোস্টেলে দিয়ে সে চলে গেল নিজের টিউশনিতে। আলতাও নির্দিষ্ট সময়ে কোচিংয়ে গেল তবে যাওয়ার আগে শিশিরের দেওয়া কাচ্চি খেতে ভুলল না। প্যাকেটে যে পরিমাণ ছিল তা নেহাৎ কম নয়। সে সমান ভাগে ভাগ করে নিজে খেয়ে আবার রুমমেট আপুর জন্যও রাখলো। আলতা যখন কোচিং থেকে বের হলো তখন সন্ধ্যা নেমেছে ধরণীতে। ব্যস্ত শহরের ইট পাথরের দালানের ফাঁকে ফাঁকে অন্ধকার জমেছে। পথের পাশের বাতির কৃত্রিম আলোয় তখন ফকফকা ঢাকা শহরের প্রতিটা পথঘাট, বাড়িঘর। কোচিং সেন্টারের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে শিশির সতর্ক নজর ফেলে৷ আলতা বেরিয়ে আসতেই সে এগিয়ে এলো সামনে। দ্রুত একটা রিকশা ডেকে আলতাকে বলল, “উঠে পড়।”
আলতাও কোন প্রশ্ন না করে উঠে বসল রিকশায়। নিজে কোন প্রশ্ন না করে অপেক্ষা করলো শিশিরের। মিনিট কয়েকের ব্যবধানে শিশির মুখ খুলল, ” আমরা বাসস্ট্যান্ডে যাচ্ছি। ভাই আসছে ঢাকায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।”
“শরত ভাই এখানে!”
“হু ওই দুই পাগল একা একা রাতবিরাতে চলে গেল অতদূর। ভাগ্য ভালো বলে বিপদ হয়নি কোন কিন্তু কি গ্যারান্টি তাই সম্ভবত নিজেই এসেছে ওদের সাথে।”
“বাড়িতে কি সবাই জানে?”
“মাথা খা-রা-প! সবাই জানবে কেন? বাড়িতে এসব জানাজানি হলে ভাইকে জেরার মুখে পড়তে হবে। তুই আবার পাকামে করে ফুপুআম্মাকে বলে দিস না যেন!”
“বলব না।”
“গুড”
আরও কিছু সময় পর তারা এসে পৌঁছুলে জায়গামত। শরত একটা টিকিট কাউন্টার এর সামনেই দাঁড়ানো ছিল। সেদূর থেকেই লক্ষ্য করলো শিশিরদের রিকশা, আলতাকে নিয়ে রাস্তা পার হয়ে এ পাশে আসা সবটাই। এই সন্ধ্যের কৃত্রিম রোশনাইয়ের মাঝে ওই দুটি ছেলে মেয়েকে তার হঠাৎ ভীষণ অচেনা মনে হলো। রহস্যময় লাগলো তাদের দুজনকে একসাথে দেখতেই। কোথাও কি একটু ভিন্নতা আছে! কিছু কি পরিবর্তন হয়েছে তাদের মধ্যে নাকি সে ভুল দেখছে?
চলবে
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
২৪.
রাস্তা পার হয়ে শরতের কাছে এসে দাঁড়াতেই শরত শুনতে পেল শিশিরের চাপা গর্জন৷ সে অবাক হয়ে খেয়াল করতেই বুঝতে পারলো আলতাকে ধমকাচ্ছে কোন বিষয় নিয়ে। রাস্তার চারদিক লক্ষ্য করে শরত প্রশ্ন করলো, “কি হয়েছে ওকে ধমকাচ্ছিস কেন?”
“ভাই ওরে আমি কালকে পদার্থবিজ্ঞান এর এক গুরুত্বপূর্ণ সাজেশন পাঠিয়েছি হোয়াটস অ্যাপে। বারবার করে বলে দিয়েছি রাতেই যেন অর্ধেকটা কমপ্লিট করে কিন্তু তিনি এখন বলছেন ঘুমিয়ে পড়ায় পড়তে পারেননি। তার ওপর কলেজে বসেও ও একটু আধটু সময় পায় বাড়ি ফিরেও পায়। কিন্তু সে চোখ পর্যন্ত বুলিয়ে দেখেনি এখন বলছে হোয়াটসঅ্যাপেও খুঁজে পাচ্ছে না৷ মানি সিরিয়াসলি একটা কলেজ পড়ুয়া মেয়ে তার দরকারি জিনিস ডিলিট করে ফেলে বলতে পারে খুঁজে পায় না! মন তো চাচ্ছে এখুনি দুইটা কষে থাপ্পড় লাগাই।”
বলতে বলতেই শিশির চোখ রাঙাচ্ছে, ধমকাচ্ছে আলতাকে। আপনাআপনিই এক দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো শরতের। এই সাপে নেউলে সম্পর্কধারী দুটোকে নিয়ে সে কিনা একটু আগেই অন্য কিছু ভাবছিল! অসম্ভব এ দুটোতে জন্ম থেকেই এক অমীমাংসিত যুদ্ধ চলমান তা বোধহয় আজীবনই থাকবে। সে নিজের ভাবনা ছেড়ে শিশিরকে থামাতে চাইলো, “আচ্ছা থাম, আর বকতে হবে না। তোর কাছে তো নিশ্চয়ই আছে আবারও সেন্ড করিস এবার আর ভুল হবে না ওর তাইনা আলতা!”
আলতাকে ইশারা করতেই সে দ্রুতবেগে মাথা নাড়লো যার অর্থ এবার আর ভুল হবে না। তারপর তিনজনেই হাল হাকীকত জানার পর শরত বলল, “চল কোথাও বসি তিনজনে আজ একসাথে খাই। তারপর আমি রওনা দেব আর হ্যা এটা তোর।”
একটা পলিব্যাগ আলতাকে এগিয়ে দিলো শরত। আলতা হাতে নিয়ে দেখলো নাড়ুর বক্স। সে খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে জানতে চাইলো, “শিফা মামী দিছে তাইনা! আমি বলছিলাম মামীকে নাড়ুর কথা।”
বাড়িতে প্রায় সকলেই জানে আলতা শিফা মামী নাড়ু পছন্দ করে আর এবার মামী বানিয়েছিলও কিন্তু আসার দিন মনে করে সাথে দেওয়া হয়নি। শরত জানে বাড়ি ফিরলেই কাকী, মা আর ফুপুআম্মাও বকবে কেন সে কাউকে না বলে এসেছে। তাই কিছুটা বুদ্ধি করেই নাড়ুর বক্সটা এখন অনুর দেখিয়ে দেওয়া শপ থেকে কিনেছে। ভাগ্যিস কিনেছিল নইলে পিচ্চিটার এমন খুশি দেখা হতো না।
আলতার কথা শুনে শিশির আবার ব্যঙ্গ করে বলল, বলদ কোথাকার বক্স দেখে বোঝেও না ভাই এটা কোন দোকান থেকে কিনে এনেছে।”
“কি ব্যাপার শিশির তুই এখানেও ওকে এত বকিস কেন বলতো! এটা তো আমাদের বাড়ি না। দুজনে বাড়ি ছেড়ে এত দূরে থাকিস বিপদে আপদে দুজনের খেয়াল রাখতে হবে সেখানে তোরা আগের মতই লড়াই করিস!”
“আমি করি না শরত ভাই অযথাই আমাকে বকে সবসময়।”
নালিশ করার মত করে বলল আলতা। তিনজনে মিলে একটা বাসস্ট্যান্ডের কাছেই ছোটোখাটো রেস্টুরেন্টে ঢুকল। রাতের খাবারটা দ্রুতই সেরে শরত বিদায় নিল। আটটার বাসে সে রওনা দিতেই শিশির আগে আলতাকে হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে নিজেও হলে ফিরে গেল। আজ তার সন্ধ্যার লাস্ট টিউশনি মিস করতে হয়েছে এরজন্য কাল এক্সট্রা সময় দিতে হবে। আজ রাতে আর তাদের ফোনালাপ কিংবা চ্যাট কিছুই হলো না। পরের দিন কলেজে যাওয়ার পথে আবারও ভয় মনে এগিয়ে গেল আলতা কিন্তু না তার সৌভাগ্য আজও সুমন পথ আগলে দাঁড়ায়নি। কলেজে ঢুকেই নাহারের সামনে পড়তেই জানা গেল সুমন কেন আর বিরক্ত করছে না আর করবেও না। একদিকে যেমন স্বস্তি মিলল অন্যদিকে তেমন একটা ভয় ঢুকে গেল মনে। নাহারের ভাই আলতার ফোন নম্বর চেয়েছে এদিকে শিশির ভাইয়ের কড়া নিষেধ খুব কাছের কোন বান্ধবীকে ছাড়া কাউকেই যেন ফোন নম্বর না দেয় এমনকি তার সাথে ফোন আছে এ কথাটাও না জানে। আলতা কথা রেখেছিল সে কাউকে বুঝতে দেয়নি তার ফোন আছে তবে পথে একবার শিশিরের সাথে ফোন কথা বলার সময় কোন এক ক্লাসমেট দেখেছিল। সেই থেকে মোটামুটি কয়েকজন জানতে পেরেছে কথাটা। ভ্যাপসা একটা গরম হাওয়া বইছে ক্লাস জুড়ে তাই আলতা একটু হাস ফাঁস করছিল তা চোখে পড়ল কেমিস্ট্রি টিচারের। মোটামুটি ত্রিশের কাছে বয়স ভদ্রলোকের কিন্তু এখনও অবিবাহিত আর স্বভাবে একটু মেয়েলি দোষও আছে। লোকটা ক্লাসের প্রায় প্রতিটি সুন্দরী মেয়ের দিকেই লোলুপ দৃষ্টিতে তাকায়। এতে অনেক স্টুডেন্টই দারুণ মজা পায় কিন্তু তারমধ্যে আবার কিছু স্টুডেন্ট খুবই অস্বস্তি বোধ করে৷ এই যে এখন আলতা একটু নড়েচড়ে উঠতেই লোকটা বাজে নজরে তাকাচ্ছে তার দিকে সেটা দেখেই আলতার গা কাটা দিয়ে উঠল। সে সোজা হয়ে বসে একবার নিজেকে খেয়াল করল। নাহ, হিজাব তার ঠিকঠাকই আছে তবুও মনে হচ্ছে লোকটা তাকে বাজেভাবে দেখে নিচ্ছে।
“কি হয়েছে আয়শা তুমি এমন নড়াচড়া করছো কেন? কোন সমস্যা!”
স্যার প্রশ্ন করলেন আলতাকে। এই ভয়টাই পাচ্ছিলো। লোকটা কথার সুযোগ পেলে একদম সামনে আসবে তারপর টেনে টেনে প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রয়োজনের কথাই বেশি বলবে। ঠিক তাই হলো এখন, স্যার প্রশ্ন করেই এগিয়ে আসছে তার দিকে। বসা থেকে দাঁড়িয়ে আলতা আমতা আমতা করতে লাগল তা দেখে নাহার হুট করে দাঁড়িয়ে বলল, “স্যার আয়শা একটু অসুস্থবোধ করছে। তার এক্ষুনি মাথায় একটু পানি না দিলে অজ্ঞান হয়ে পড়বে। প্লিজ স্যার আমি কি ওকে একটু ওয়াশরুমে নিয়ে যাব?”
ফটাফট কয়েকটা মিথ্যে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেই আলতার বাহু ধরলো। ভাবখানা এমন যেন আলতা এক্ষুনি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবে। স্যারও ভড়কে গেল হঠাৎ এমন অবস্থা দেখে। তিনি সাথে সাথে আলতার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, আসো আসো এদিকে আসো ওয়াশরুমে গিয়ে পানি দাও।”
তৎক্ষনাৎ নাহার একটু ঠেলে আলতাকে বিপরীত দিকে ইশারা করলো। কারণ স্যারের পাশ দিয়ে গেলেই লোকটা গা ছুঁতে চেষ্টা করবে। দুজন বিপরীত দিক থেকে বের হয়ে যাওয়ায় একটু অসন্তোষই হলো স্যার তাদের ওপর। ক্লাস পেরিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকতেই নাহার বলল, “এত মেনিমুখো হয়ে থাকো কেন বলোতো! ওই ব্যাটা এমনিতেই মেয়ে দেখলে লালা ঝরায় আর তোমার মত সুন্দরীর জন্য তো তার রীতিমতো কলিজাখানা ফরফরায়।”
শেষের বাক্যটা নাহার স্যারের উদ্দেশ্যে বলল। আলতা বলতে গেল তার ভয় লাগে স্যারকে কিন্তু বলতে পারলো। মনে হলো ওই স্যারের মতই ভীতি একদিন এই নাহারের জন্যও কাজ করবে আর তা অতিশিগ্রই। কিছুসময় দুজন ওয়াশরুমেই দাঁড়িয়ে ছিল। নাহার ইনিয়েবিনিয়ে ফোন নম্বরের কথা তুলতেই আলতা বলল, ক্লাসে যাই চলো।
শরত ফিরেছে শেষ রাতে। তার কাছে ঘরের চাবি থাকলেও বাইরের গেইট খোলার জন্য কাউকে না কাউকে কল করে জাগাতেই হবে বলে সে আর বাড়ি ফেরেনি। বাজারেই থেকে গেছে নিজের দোকানে। ভাগ্যিস দোকানের চাবিটা তার সাথেই ছিল সেই সাথে শীতও নেই। নইলে রাত কাটানো বেজায় মুশকিল হয়ে পড়ত তার। ভোরে বাজার সরগরম, বাজারের বেশিরভাগ দোকানী দোকানের ঝাপ খুলে রেখেই হোটেলের নাশতায় পেটপূর্তি করে কেউ কেউ আবার চায়ের দোকানে আড্ডায় বসে চা আর পাউরুটিতেও নাশতা সারে। দোকানের মেঝেতে স্বল্প লম্বাটে জায়গাটাতেই শুয়েছিল শরত মাথার নিচে কাঠের ছোটো জলপিঁড়ি পেতে। এটা সচরাচর তার কর্মচারী রুহুল কবে যেন এনে রেখেছিল তাই বালিশের কাজটা এতেই করেছে। এতে ঘুম ঠিকঠাক না হলেও তার ঘাড়ের যে দূরাবস্থা হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। বালিশ পরিমাণ উঁচু হলেও চলতো কিন্তু এর উচ্চতা অধিক হওয়ায় এখন মনে হচ্ছে শরীর থেকে ঘাড়টা আলাদা হয়ে গেছে। শরত উঠে দাঁড়িয়ে আগে শার্ট টেনেটুনে ঠিক করেছে। তারপরই দোকানের ঝাপ তুলে বাইরে তাকাতেই বুঝলো এখনও খুব ভোর। ফোনটাতে একটুও চার্জ না থাকায় সেটা বন্ধ পড়ে আছে। হাত, পা, ঘাড় নেড়ে একটু আড়মোড়া ভেঙে সে চায়ের দোকানে গেল। শরত যে দোকানে ঢুকল সেটা রফিক কাকার দোকান। শরতকে দেখতেই রফিক কাকা বলল, “কি বাজান রাইতে বাড়ি যাও নাই? কালকে দেখলাম দোকান খুলো নাই সব ঠিকঠাক তো!”
“না কাকা কাল ঢাকায় গিয়েছিলাম কাজে তাই ফিরতে ফিরতে শেষ রাত হওয়ায় আর বাড়ি যাইনি দোকানেই ঘুমাইছি।”
“ঢাকা তো শিশির আর নকশির মাইডাও থাহে না!”
“হ্যাঁ কাকা দেখে আসছি তাদেরও। কাকা চা দিয়েন এক কাপ।”৷ বলেই শরত তার দোকানের দিকে তাকালো। দুটি ছেলের মধ্যে একটা এসে গেছে তাকে দেখে এদিকেই আসছে।”
“শরত ভাই কাল মালের লিস্ট করার কথা ছিলো! ”
“ওহ এটা কি করে ভুলে গেলাম৷ কালই তো মাল আনতে যেতাম। তুই নাশতা করে আসছিস? না করলে হোটেল থেকে করে দোকানে গিয়ে বস আমি বাড়ি থেকে ঘুরি আসি তারপরই কাজ ধরছি।”
বিমর্ষ মুখে কথাগুলো বলে সে রফিক কাকার বানানো চা নিলো। চা টুকু শেষ করে আর বসেনি। বাড়ি ফিরে প্রথমেই মায়ের সম্মুখীন হলো শরত। তিনি বিশ্বাস করতে চাইলেন না শরতের কথা। যে ছেলে আজ অবধি এলাকার বাইরে গেলে মাকে জানিয়ে যেত সে ছেলে কি করে একদিন একরাত বাইরে পার করলো মাকে না জানিয়ে। সরাসরি মাকে ফোন করে মিথ্যে জবাব দিতে পারবে না বলেই কাল শুধু কাকাকে ফোন করে বলেছে কাজে যাচ্ছে। কাকা বুঝদার মানুষ তিনি জোরাজোরি করা পছন্দ করেন না আর শরতকে ভরসাও করেন খুব৷ কিন্তু মায়ের মন শুধু ভরসাতে মানতে চায় না৷ শুধু যে জয়তুন সন্দেহ করছে তা না শিফারও একটু অন্য ভাবনা আছে মনে শুধু শিউলিই আর ভাইকে ঘাটায়নি। মায়ের কথা এড়িয়ে গিয়ে সে গোসল সেরে আবার চলে গেল দোকানে। জয়তুনের মনের খচখচানি আর সারাদিনে একটুও কমেনি। এরপর আরও কিছুদিন জয়তুন পেছনে পড়ে রইলেন ছেলের কিন্তু কোন মনঃপুত জবাব তিনি পাননি। দিন দিন শরত আগের চেয়েও বেশি অন্তর্মুখী হয়ে উঠছে তা বাড়ির সকলেই টের পাচ্ছিলো। এদিকে শিউলির মেয়েরও এক মাস পূর্তি হতেই জামিল আর তার পরিবার তাড়া দিচ্ছে তাদের মেয়ে বউ তারা বাড়ি নিতে চায়। আহসানুল্লাহও শরতকে ডেকে বললেন, একটা ছোটো খাটো আয়োজন ছাড়া তো তাদের মেয়ে দেওয়া যায় না শরত।
শরত শুনে বলল, ” হ্যাঁ কাকা মাও বলছে কিছু আয়োজন করা লাগবে আপনি বলেন কেমনে কি করব?”
ভর দুপুর; মাথার ওপর রোদ যেমন চড়াও তেমনি বাতাসেরও কমতি নেই। সেই বাতাসে আবার ভেসে আসছে মুকুলের ঘ্রাণ। এই রোদ্দুরে বাতাসে হাঁটতে হাঁটতেই দোকান থেকে ফিরছিল তারা। আহসান আর শরতের কথার মাঝেই আহসানুল্লাহর ফোনটা বেজে উঠলো সশব্দে। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলেন শিশির কল দিচ্ছে । আহসানুল্লাহ ফোনকল পেয়ে কপাল কুঁচকে কিছু ভাবলেন কয়েক মুহূর্ত। শরত তা খেয়াল করে বলল, কে কল দিলো কাকা?
“শিশির কল দিলো এই সময়!” চিন্তিত শোনালো আহসানের কণ্ঠস্বর। শিশির সবসময় তার মায়ের ফোনেই কল দেয় তাও আবার সকালে কিংবা বিকেল বা রাতে। ভর দুপুরে সে কখনোই দেয়নি বলে কিছুটা বিচলিত হলো আহসান। শরতও বুঝলো কাকার ভাবনা তবুও বলল, কলটা ধরে দেখেন কাকা জরুরি কিছু হতে পারে।
শরতের কথাতেই যেন হুঁশ হলো আহসানের সে কল রিসিভ করতে গেলেই কেটে গেল। এবার নিজেই ব্যাক করতে নিলে পুনরায় বাজলো ফোনটা।
“হ্যালো।”
“আসসালামু আলাইকুম আব্বা।”
শিশির প্রথমেই সালাম দিল তার বাবাকে। আহসান সালামের জবাব দিতেই শিশির জিজ্ঞেস করলো তিনি এখন বাড়িতে কিনা! আহসান জানালো সে আর শরত একন বাড়িই ফিরছে। কিন্তু শিশিরের তো এদিকে আর তর সইছে না কিছুতেই। সে তাই আর অপেক্ষা না করে বলেই ফেলল, “আব্বা আমি যে বিদেশে পড়ার জন্য এপ্লাই করেছি তার রেজাল্ট পেয়ে গেছি। লন্ডনে হয়ে গেছে আর ফান্ডের ব্যাপারটাও আমার জন্য সুবিধার মধ্যেই হচ্ছে।”
শিশিরের কথা শুনতেই আহসানুল্লাহ ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে শরতকে জানালো। ওপাশে শিশিরও বাবাকে একটুখানি সময় দিয়ে পরে বলল, ” আব্বা আরও কিছু ব্যাপার আছে টাকা পয়সার কিন্তু সেটা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু”
শিশির থেমে দম নিলো। সে জানে না তার বাবা রাজী হবে কিনা কারণ তিনি বরারই সাধারণ মানুষ সাধারণ জীবনযাপনে বিশ্বাসী। টাকাপয়সার জন্য কখনো কারো কাছে চাইতে পছন্দ করতেন না আর সাধ্যের বাইরে কিছু পেতেও চাইতেন না। সে বাবার অনুমতি ছাড়াই যে প্রভোস্ট স্যারের হেল্প নিতে রাজী হয়ে গেছে এখন সেটা বলতেই ভয় লাগছে৷ সে জানে বাবা তার এই পড়াশোনার উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য জায়গা-জমি বিক্রি করতে দু’বার ভাববেন না। কিন্তু গ্রামে যে দর জমির তাতে সবটা সম্ভব নয় সেকারণেই সে মুখের সামনে পাওয়া প্রস্তাবটা ঠেলতে পারেনি। শিশির জানে না প্রভোস্ট স্যার বা উনার স্ত্রী এতো কেন সদয় তার প্রতি! তবুও সে ভাবে সে কৃতজ্ঞ থাকবে তাদের প্রতি তবে ঋণ রাখবে না। ছেলের নীরবতাতে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে উঠলো আহসান। তারা বাড়ির গেইটে চলে এসেছে । শিশিরকে জিজ্ঞেস করলেন ‘কিন্তু কি!’
“ব্যাংক, টাকা পয়সার কিছু ব্যাপার আছে যেগুলো হয়ত আমাদের পক্ষে সম্ভব না জোগাড় করাটা আর প্রভোস্ট স্যার নিজ দ্বায়িত্বে সেগুলোতে হেল্প করবেন বলেছেন। স্যারের ওয়াইফও সে আশ্বাস দিয়েছেন। আব্বা আপনি চিন্তা করবেন না এ নিয়ে আমি সব শোধ করে দিব।”
ছেলের কথা শুনে বিষ্ময়ে খেই হারিয়ে ফেললেন আহসান। তিনি এখনও ঠিকঠাক বুঝতে পারছেন না শিশিরের কথা। কিন্তু এখন এ নিয়ে কিছু বলতে চাইলেন না। রাতে কথা হবে বলে কল কাটলেন তা দেখে শরত জানতে চাইলো কি হয়েছে।
“রাতে ধীরেসুস্থে সবটা জেনে তোকে বলছি।”
নিঃসঙ্গতায় ঘেরা গুলশানের ডুপ্লেক্স বাড়িটিকে আজ অনুর কাছে এক অচিনপুরের রাক্ষস বলে মনে হচ্ছে। দিনের এক তৃতীয়াংশ বাড়ির বাইরে কাটিয়ে কিছু আনন্দঘন মুহূর্তে দুই বেস্টফ্রেন্ডের সাথে কাটিয়ে তাকে ফিরতেই হলো একলা নীড়ে। গাড়িটা গ্যারেজে রেখে কিছুসময় সে বিমর্ষতায় বসে রইলো বাড়ির ডান দিকের একট টুকরো বাগানটায়। তাদের বাড়ির সবচেয়ে সুন্দর জায়গা শুধু এই টুকরো বাগানটাই। এখানে থরে থরে সাজানো নানা জাতের দেশী-বিদেশী ফুল, পাতাবাহার এর গাছ সাথে আছে একাংশ জুড়ে খাচাবন্দী বিদেশী কিছু পাখি। পাখিগুলো সারাটা দিন কিচিরমিচির করে বাগানটাকে একদম গ্রাম্য সেই অনুভূতি ফিরিয়ে দেয় যেমনটা তারা উপভোগ করেছিল শিশিরদের বাড়িতে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই কিচিরমিচির ভীষণ বিরক্ত লাগতো অনুর কিন্তু এবার শিশিরদের গ্রামে গিয়ে গাছ-গাছালিতে পাখির কলরব, খোলা আকাশ, বন-বাদাড়, কাশফুলের ক্ষেত, নদীর জল এসবের মাঝে চারটা দিন স্বপ্নের মত কেটেছে। তার ওই চারদিনেই মনে হয়েছে এ জনম তার বৃথা যেত যদি না প্রকৃতির ওই রূপটা দেখে আসত। এ বাগানে কাঠের একটি দোলনা আছে তার মায়ের সৌখিনতার পরিচয় বহন করতে। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বসল সেই দোলনায়। এই তার জীবন! আজকে তার জন্য কত বড় একটা দিন, তার উশৃংখল জীবনের শৃংখল এক ফলাফল আজ সে হাতে পেয়েছে অথচ আজ তার সাথে এই দিনটাকে বিশেষ করার জন্য পাশে নেই মা আর বাবা। কত কত বাবা মা সন্তানের জীবনে এমন কোন দিন দেখার জন্য তীর্থের কাকের মত অপেক্ষায় বসে থাকে আর সে সৌভাগ্যের চরম পেয়েও আজ পাশে কেউ নেই। না ছিলো তো শিশির আর সোহা। এ দুজনের কথা ভাবতেই বুকের চাপ চাপ দুঃখরা উধাও হওয়ার পায়তারা করছিল কি ঠিক সে সময়েই একটা গাড়ি এসে ঢুকলো বাড়িতে। ঘাড় বাঁকিয়ে দেখার সুযোগটাও হলো না অনুর তার আগেই গাড়ির ভেতরের মানুষটা বেরিয়ে এলো ঝড়ের গতিতে। তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে দু বাহু খামচে ধরে দাঁড় করালো অনুকে। সে কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই মানুষটা তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই জোর করে চুমু খেয়ে নিলো। অনু তাকে ঠেলে সরাতে চাইলে মানুষটা তাকে আরো জাপটে ধরলো। তার চুমুর বর্ষণ বাড়তে থাকলে অনু আর সামলাতে পারলো না নিজেকে তাই বাধ্য হয়েই লোকটার পেটের ডান দিকে ঘুষি মেরে বসল।
চলবে
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন )