শিশিরে ভেজা আলতা পর্ব-২৫+২৬

0
360

#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
২৫.

“এত জোরে কেউ ঘুষি মারে!”

দু হাতে পেট চেপে ধরে দোলনায় বসে বলল তাওহীদ। অনুর হাতে মা-র সে আগেও দু একবার খেয়েছে কিন্তু আজকের ব্যাপারটা বেগতিক ছিল। তাওহীদের আর্তনাদ দেখে একটুও ভাবান্তর হচ্ছে না অনুর বরং এই মুহুর্তে এই লোকের চেহারা দেখতেই মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে।

“এখানে কেন এসেছো?”

“মিষ্টি খেতে কিন্তু মিষ্টির সাথে এমন দুর্দান্ত ব্যথাও যে খেতে হবে বুঝতে পারিনি।”

“তোমার কি লজ্জা করে না এভাবে প্রায়ই চলে আসতে! কেন বুঝতে পারছো না এই বিয়ে হবে না আর কত অপেক্ষা করবে তুমি?”

“যতদিন না তোমার মাথা থেকে ওই ছেলের ভূত নামছে।”

তাওহীদের মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই আরেকটা ঘুষি পড়লো তার মুখে। ডান গালের পাশটাতে এত জোরেই লেগেছে ঘুষিটা যা ভেতরের চোয়াল এমনকি দাঁতও হয়ত নড়িয়ে দিয়েছে। এবার যেন সহ্যসীমা অতিক্রম হয়েছে তার। সে বসা থেকে উঠেই দু গাল চেপে ধরল অনুর। দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “বাড়াবাড়ি করা ভালো নয় অনু। আমার ধৈর্য্য ফুরিয়ে আসছে এবার। আমার বউ তোমাকে হতেই হবে এটা যেমন ঠিক আমায় ছেড়ে ওই ছেলের সাথে চিপকে থাকলে ওই ছেলেকে খুন করব আমি সেটাও ঠিক কথাটা গেঁথে নাও মস্তিষ্কে।”

অনুকে ছেড়ে আর এক সেকেন্ডও না দাঁড়িয়ে চলে গেল তাওহীদ। আজ দুইটা বছর চলছে অনুকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে৷ আংটি বদল করেছে পরিবারের বড়রা অথচ বিয়ের জন্য এখন কেউ মুখ খুলছে না। অনুর উশৃংখল পরিবার কোনদিন মেয়ের ব্যাপারে সিরিয়াস ছিলো না যেদিন থেকে তাওহীদ বুঝতে পারল সেদিন থেকে সে নিজেই তৎপর হলো বিয়ের ব্যাপারে আগাতে৷ কিন্তু অনু বড় জেদী আর বেয়াদব স্বভাবের হওয়ায় তাওহীদের কথায় পাত্তা দিচ্ছে না। তাওহীদ খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে অনু একটি ছেলেকে ভালোবাসে৷ সেই ছেলের খোঁজও জানা তাওহীদের তবুও সে বুঝিয়ে সুঝিয়ে অনুকে নিজের করতে চাইছে৷ কিন্তু সে প্রতিবারই ব্যর্থ তাই এবার অধৈর্য্য হয়েই জোর খাটাতে চাইছিলো। তাওহীদের গাড়িটা বাড়ির বাইরে যেতেই অনু বাড়ির ভেতরে ঢুকলো৷ নিচতলায় গ্যারেজ দোতলায় বিশাল আকারে ড্রয়িং স্পেস, রান্নাঘর আর একটা মিউজিক রুম। তিনতলায় নিজেদের শোবার ঘর, গেস্ট রুম একটা লাইব্রেরী কাম এক্সারসাইজ রুমও আছে। অনু একবার মায়ের রুম, বাবার রুমের দরজায় তাকালো। দুটো রুমই লকড কারণ একজন নিজের এসিস্ট্যান্টকে নিয়ে হলিডে কাটাতে এক সপ্তাহের জন্য নেপাল গেছে অন্যজন নিজের ভার্সিটি লাইফের ফ্রেন্ডদের সাথে রিইউনিয়ন এর নাম করে কক্সবাজার আছে৷ অনু জানে সেখানে তার মম প্রাক্তনের সাথে সময় কাটাতে গেছে। কি অশ্লীল এক জীবন হলো তার! এমনও হয় কারও বাবা মা! কই শিশিরদের বাড়ি গিয়েছিল তার বাবা মায়ের মধ্যে তো এমন কিছু নেই। বরং আঙ্কেলের চোখে আন্টি ছাড়া অন্য কোন নারীর ছায়া আছে বলে মনেই হয়নি৷ শরতের মা বিধবা মহিলা তার কি যৌবণ কাটেনি দ্বিতীয় পুরুষ ছাড়া? শিশিরের মুখেই শুনেছে তার জেঠু তারা ছোট থাকতেই মারা গেছেন এরপরও জেঠি কখনো দ্বিতীয় বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়নি৷ আর আয়শার মা! নকশি সে একা এক সন্তান নিয়ে অল্প বয়সেই জীবনযুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছেন৷ আয়শা বড় হয়ে তার মাকে বাধ্য করেছে বিয়ে করতে নইলে হয়ত তিনিও শরতের মায়ের মত জীবনটা একা কাটিয়ে দিত। তবে তার আধুনিক বাবা মা কেন এমন হলো না! একে অন্যের প্রতি লয়ালটি দেখানোর কেন আগ্রহ পায় না তারা! টাকার নেশা, যৌ*নতার নেশা এসবই কি সব জীবনে? টলমলে পায়ে নিজের ঘরে ঢুকে ধড়াম করে দরজাটা লক করে দিল অনু। এ বাড়িতে কাজের লোকগুলোও ঠিক তাদের মনিবের মত। কাজের মেয়েটা বিবাহিত ড্রাইভারের সাথে আজকাল একটু বেশিই সময় কাটায়। মনিবের নেশায়ই হয়ত পেয়ে বসেছে তাকে। আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না এই বিষাদিত মন নিয়ে। বিছানায় গা এলিয়ে চোখ বুজতেই নিদ্রা ভর করলো চোখের পাতায়। এরপর এক ঘুমেই তার রাতটাই কভার হয়ে গেল। এরই মাঝে তার মাতৃদেবী বুঝি একবার মনে করেছিলেন একমাত্র সন্তানকে তাই ফোনের ওয়ালে চারটা মিসড কল শো হচ্ছে। সকালে বিছানা ছেড়ে ফোনের মিসড কল দেখেও সে কলব্যাক করলো না তার মমকে। কাজের মেয়েটিকে ডেকে কফি আর ডিমের ওমলেট দিতে বলে সে ঢুকলো বাথরুমে। প্রতিদিনকার মত আজকের রুটিন সেই একই। দু ঘন্টা লাইব্রেরিতে তারপর ক্লাস আছে কিনা চেক করে যদি ভাগ্যে থাকে তো ক্লাস করবে অন্যথা ক্যাম্পাসেই এদিক ওদিক ঘোরা কিংবা শিশির সোহার সাথে সময় কাটানো৷ এই একটা ব্যাপার অনুর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ আর তা হলো সর্বাবস্থায় তার পড়াশোনা ঠিক রাখা। শুধু ঘুমের কারণে প্রায়ই সকালের ক্লাসগুলো বাদ যায়। তাতেও নসীব সুপ্রসন্ন শিশিরের কারণে। জীবনে তার এক আনাই সুখ আছে আর সেটা এই পড়াশোনা। নইলে জীবনের সেরা দুটো বন্ধু বান্ধবীই কি করে আসত! বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা শুধু শিশির না অনুরও করার সুযোগ হয়েছে। কাল থেকেই শিশির সেই সুখবরকে ঈদ উৎসবের মত উপভোগ করছে উদযাপন করছে শিশিরের পরিবার। আর সে! তার এই সুখবরটা, তার স্বপ্নের কথাটা শেয়ার করার মত একটা আপন মানুষ নেই। মা-বাবা থাকতেও তার কেউ নেই। থাকার মধ্যে আছে শুধু তাদের দেওয়া কার্ডস, ব্যাংক ফাইল আর খুব দামী একটা গাড়ী যা অনুর পছন্দের। আচ্ছা এই যে তার বিদেশে পড়তে যাওয়ার সুযোগ হলো নিজ যোগ্যতায় সেই আনন্দটা কি এই ব্যাংক, ব্যালেন্স আর গাড়ির সাথে ভাগ করা যাবে!

কিছুদিন পরের ঘটনা; শিশিরে যাওয়া নিয়ে শুধু টাকা পয়সার একটা সমস্যা ছিল আজ সেটা দূর হয়ে গেল। শিশির এখনো যথেষ্ট বুঝদার হয়নি তার প্রমাণই ছিলো প্রভোস্ট স্যারের কাছে থেকে লক্ষ লক্ষ টাকার সহায়তা নেওয়ার সিদ্ধান্তটা। আহসানুল্লাহ ছেলের বিদেশে নিজ যোগ্যতায় পড়াশোনা করার সুযোগ পাওয়ায় ঠিক যতোটা আনন্দ হয়েছিল ঠিক ততোটাই চিন্তিত আর কষ্ট পেয়েছিল শিশিরের সিদ্ধান্তে। প্রভোস্ট রাশেদ আর তার স্ত্রীর সাথে আহসানুল্লাহর পড়াশোনাকালীন একটা সেরা সম্পর্ক ছিল এ কথা যেমন সত্যি সময়ের পরতে সেই বন্ধুত্ব ছাপিয়ে রাশেদর স্ত্রী আহসানের প্রতি ভীষণরকম দূর্বল হয়েছিল এ কথাও তেমন সত্যি। কিন্তু আহসানের পক্ষ থেকে বন্ধুত্বের বাইরে কখনোই কিছু ছিলো না। সে কারণেই পরবর্তীকালে রাশেদের সাথে যোগাযোগ থাকলেও তার স্ত্রীকে সম্পূর্ণ ভুলে যাওয়ার মতই ব্যাপার এখন। আহসান ভেবেছিল জমি বিক্রি করবে কিন্তু সেই টাকায় আর যাইহোক লন্ডনের মত জায়গায় গিয়ে পড়াশোনা চালানো মুশকিল৷ তারওপর সেখানে স্টুডেন্ট জব পাবে কি পাবে না সে বিষয়ে আন্দাজ নেই তাদের৷ বাধ্য হয়েই ঋণ করার চিন্তা করলো আহসান। কিন্তু সকল চিন্তার অবসান ঘটিয়ে দিলো শিফা। বাপের বাড়ির অর্থবিত্তের প্রতি এই প্রথম সে নিজ স্বার্থে নজর দিলো। আহসান চুপচাপ মেনে নিলেন স্ত্রীর পরামর্শ ছেলের কথা ভেবে। শিফা বড় রকমের ধার চাইতেই একদিন বাপের বাড়ি গিয়ে হাজির হলো। বিয়ের প্রায় পঁচিশ বছর পার হলো সে কোনদিন দশটা টাকার সাহায্য নেয়নি বাপের বাড়ির আর এত বছর পর তার হঠাৎ ধারের কথা শুনে ভাই বোন সকলে কষ্ট পেলেন। বড় আদরের ছোট বোন শিফা তাদের। বড় ভাইয়ের কত সাধ ছিল তাকে খুব বড়লোক বাড়িতে বিয়ে দেওয়ার কিন্তু বাবার সিদ্ধান্তের ওপর তখন ভাইয়েরা কিছুই বলতে পারেনি। এতবছর পর বোনের অসহায়তার কথা ভেবে প্রথমে প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন বড় ভাই। পরে অবশ্য বড় বোন আর ছোট ভাইয়ের কথা শুনে রাগ মাটিচাপা দিয়ে আহসানকে ডাকলেন। আজ সময় করে আহসান আর শিফা পৌঁছুতেই দেখলো বাড়িতে বড় বোন আর ভাইয়েরা সবাই উপস্থিত। এমনকি বোন সাথে করে লাখ দুই টাকা এনেছেন। বাকি তিন ভাইও তাদের অবস্থানুযায়ী কয়েক লক্ষ টাকার একটা হিসেব দিলেন যা শিশিরের নামে একাউন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।এতসব কান্ড দেখে আহসানের আজ আবারও মনে হলো তার শিফাকে বিয়ে করা উচিত হয়নি। আজ আবারও পুরনো ক্ষত রগরগে হয়ে উঠলো যা শিফার বড় ভাইয়ের কাছ থেকে পেয়েছিল তবে আজ একটু আনন্দও হলো ছেলের স্বপ্ন পূরণের পেছনের বাঁধা সরে যাওয়ায়। শিফা লক্ষ্য করেছিলেন স্বামীর মুখের মেকি হাসির আড়ালে লুকানো কষ্টটা। সে ভাই বোনদের সাথে টাকা পয়সার আলোচনা শেষ হতেই মিথ্যে বলে আহসানকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো৷ দুপুরের আগেই গিয়েছিল তারা কারণ বড় ভাই বলেছে দুপুরে একসাথে খাবে আজ। বড় ভাইয়ের ঘরে ভালো মন্দ আয়োজনও হয়েছে আজ সব ভাইবোনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু আহসানের এই বিমর্ষ মুখটা দেখার পর শিফার গলা দিয়ে নামবে না এ খাবার। তাই দ্রুত ফিরে আসা৷ বাড়ি ফিরে প্রথমেই শিফা চুলায় ভাত চড়ালো। তা দেখে জয়তুন আশ্চর্য হলেও কিছু না বলে দু বাটিতে দু পদের তরকারি এনে রাখলো শিফার সামনে।

“কি হইছে শিফা।”

“কিছু না ভাবী।”

“আমার লগে কতক্ষণ মিছা কইতে পারবি!”

জয়তুন বললেন জোর দিয়েই। শিফা জানে সত্যিই সে লুকাতে পারবে না। ছলছলে চোখে ভাবীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আজকে কয়েক লাখ টাকার ঋণ হওয়ার কথা ছিল ভাবী। কিন্তু ঋণ হয় নাই কারণ আমার ভাইবোন এমনিতেই দিয়ে দিছে কয়েক লাখ টাকা। আপনার দেবর এই জিনিসটাই সইতে পারতেছে না। তিনি আমার ভাই বোনের এভাবে টাকা দেওয়াটা সহজভাবে নিচ্ছে না হয়ত ভাবছে তারা দান খয়রাত করছে।”

শিফা ঠিকঠাক গুছিয়ে বলতে পারছে না কথাগুলো। তার মনটা খারাপ হয়ে আছে মানুষটার উদাসীনতা দেখে৷ জয়তুনের পছন্দ হলো না শিফার কথা সে মুখ বাঁকিয়েই বলল, “এরা ভাইরা খালি এইসবই জানে। ক্ষমতার বাইরে কিছু করতে এমন আত্মীয়স্বজনের সাহায্য লওয়া লাগে এই নিয়ে এত কষ্ট পাওয়ার কি আছে! বড়লোক শ্বশুরবাড়ি আছে কোন দিনের জন্য?”

দোকান বন্ধ করে মাত্রই বাড়ি এসেছে শরত। মায়ের মুখে এমন কথা শুনে বিরক্ত হলো সে। মুখ খুলছিলো কিছু একটা বলার জন্য কিন্তু ঘর থেকে কাকাকে বের হতে দেখে আর বলল না। এগিয়ে এসে জানতে চাইল ব্যবস্থা কতটুকু হলো? আহসান জানালো হয়ে গেছে সমস্যার সমাধান এখন যা বাকি সেটা শিশিরের দিককার কাজকর্ম। শরত সেটা শুনে আমতা আমতা করে বলল, “কাকা আমি বলেছিলাম আমি কিছু ব্যবস্থা করব। আমি লাখ দেড়েক এর মত ব্যবস্থা করে ফেলেছি আসলে দুই লাখই করতে পারতাম যদি পুকুরের কাজটা আগেই না হাতে নিতাম।”

জয়তুন, শিফা, আহসান তিনজনই যেন চমকে গেল শরতের কথা শুনে। কেমন ভড়কে যাওয়া চোখে সবাই তাকিয়ে রইল তার দিকে। এতে করে অস্বস্তিতে পড়ে শরত বলল, “আমি গোসল করি গিয়ে আম্মা ভাত বাড়েন।”

পরিস্থিতি যতোই প্রতিকূল হোক না কেন সহযোগিতার হাত পেলে সবটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব যেকোন উপায়ে। শিশিরের আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন হুট করেই হাতের মুঠোয় ধরা দিতে লাগল। নিজেকে তার দুনিয়ার সবচেয়ে সৌভাগ্যবান সন্তান বলে মনে হয়। সামান্য স্কুল মাস্টার, মুদি দোকানীর ছেলে হয়ে ইউরোপের কোন খন্ডে পাড়ি জমানোর স্বপ্নটা বড় বেশিই দামী মনে হয়েছিল তার আর আজ সেই স্বপ্ন বড় সস্তায় পূরণ হতে যাচ্ছে মনে হলো। তার জীবনে নির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য আছে, আছে কিছু স্বপ্ন আছে একটা প্রতিজ্ঞা। স্বপ্ন পূরণের জন্য হাতে গুণে দুইটা বছরের মত সময় তাকে পরদেশে ব্যয় করতে হবে ততদিনে সে দূর থেকেই চেষ্টা করবে প্রতিজ্ঞাটা পূরণ করতে। সেই প্রতিজ্ঞা আলতাকে সরব করে তোলার, আত্মবিশ্বাসী আর স্বাবলম্বী করার। আর বাকি রইলো লক্ষ্য সেটা তার গ্রামের জন্য কিছু করতে হবে, বাবা মায়ের জন্য করতে হবে প্রতিটা কাছে দূরের সকলের জন্য কিছু করতে। শিশিরদের গ্রাজুয়েশন এব্রোডে হবে ভাবতেই সোহার কান্না পায়। তার প্রিয়রা চলে যাবে দূর দেশে আর সে একা পরে রইবে চেনা শহরে। এদিকে ভালোবাসার মানুষটার প্রত্যাখান সব দিকেই ভেতর থেকে গুমরে উঠছে সোহা। বাড়িতে আজকাল কারও সাথে কথাও বলা হয় না ঠিকঠাক। মা বাবা চিন্তিত তাকে নিয়ে আর খালা বুদ্ধি দিচ্ছে তাকে বিয়ে দেওয়ার। তাদের ধারণা বিয়ে দিলেই সোহা স্বাভাবিক হয়ে যাবে, আগের মত আবার প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠবে। কিন্তু আদৌ কি এমনটা সম্ভব! যে মন মস্তিষ্কে শরত গেঁথে আছে বেত কাঁটার মত তা উপরে ফেললেও ভেতরে ঘা ঠিকই হয়ে থাকবে। কিশোরী বয়সে সোহা কারো প্রেমে প্রত্ততায় ভোগেনি অথচ কৈশোর পেরিয়ে এতদিনে কারো প্রতি এসেছে সেই প্রমত্ত, উত্তাল আবেগমাখা প্রেম। তার মন বলে এটাই তার জীবনের প্রথম প্রেম যে প্রেম সে কখনো ভুলতে পারবে না সেই সাথে পারবে না ভুলতে মানুষটার প্রত্যাখ্যান৷ মন পবনে তুফান বইতে বইতে তাকে বিধ্বস্ত করে দিচ্ছে এখন। খুব করে মন চাইছে সব ছেড়ে ছুড়ে জোর করে শরতের বুকে গিয়ে পড়ুক। সেই মানুষটা কতদিন তাকে দূরে ঠেলবে! কতদিন উপেক্ষা করবে তাকে? এই প্রশ্নের উত্তর সোহা নিজেই নিজেকে দিয়ে দিল, “যতদিন ওই মানুষ তার প্রাক্তনকে ভুলতে পারবে না ততদিন অন্য কাউকেও আপন করতে পারবে না আর তাকে তো নয়ই।”
মনে পড়ে গেল সেদিনের ঢাকায় ফিরে আসার দিনটার কথা। শরত ড্রাইভ করতে করতে একদম কলেজের লেকচারারের মত করে বলেছিল, “তোমার সাথে কোনভাবেি লোন সম্পর্কে যাওয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে।”

“কেন সম্ভব নয়?” প্রশ্ন ছিলো সোহার। তখন সরু কপালটায় কেমন চিন্তিত ভঙ্গিতে দুটো ভাজ ফেলে, চোখ দুটো সামান্য ছোট করে পথের দৃষ্টি ফেলে চমৎকার ভাবে বলে গেল, “অসম সম্পর্ক আমি কখনোই পছন্দ করি না সোহা। তোমার আমার মধ্যে আর্থিক, পরিবেশগত এবং শিক্ষাগত পার্থক্য কি তা নিশ্চয়ই ভেঙে বোঝানোর দরকার নেই? তোমাকে আমি আগেও একবার বলেছিলাম মনে করে দেখো।”

সত্যিই শরত আরও একবার আরও ভালো করে তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল তাদের মধ্যে কোন সম্পর্ক তৈরি হওয়া অসম্ভব। আজ আবারও সেসব কথা মনে করে দরজা চাপিয়ে কান্না করতে লাগল সোহা। কখন যে তার ঘরে তার প্রিয় দুজন মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে সেদিকেও খেয়াল নেই। যখন টের পেল রুমের মধ্যে সে ছাড়া আরও কেউ আছে তখন ধড়ফড়িয়ে চোখ মেলে সোজা হয়ে বসল বিছানায়।

আলতা ফোনটা একবার টেবিলে রাখছে তো একবার হাতে নিচ্ছে। আজ সারাটা দিন শিশির ভাই তাকে একটা কল কিংবা মেসেজ কিছুই দেয়নি। আজকাল এমনটা বিশেষ হয়না তাই আজকের অনিয়ম মন খারাপ করে দিলো আলতার। এমনিতেই তো আর নাকি কয়েকটা মাস আছে সে তারওপর দু দুটো বছর নাকি আর দেশের মাটিতে পা রাখবে না৷ আচ্ছা এই দু বছরের মাঝেই যদি আলতার কিছু হয়ে যায় শিশির ভাই কি কষ্ট পাবে! তার জন্য শিশির ভাই ছটফট করবে, তাকে পাওয়ার তৃষ্ণায় ধুঁকবে সারাটাক্ষণ এমন স্বার্থপর কিছু চাওয়া আলতার মনে ঘুরপাক খায়৷ আদৌও কি এমন কিছু হবে কখনো! মনে তো হয় না নইলে আজও কেন শিশির ভাই তাকে কেন বলেনি সেসব কথা যেসব কথা একজন প্রেমিক তার প্রেমিকাকে বলে! কই সেদিন তো সে নাহার আর তার প্রেমিকের স্পষ্ট কথপোকথন শুনেছিল৷ ছেলেটা নাহারকে প্রায় সব কথাতেই ভালোবাসি বলেছে, তাকে কাছে পাওয়ার জন্য আকুল আবেদন জানিয়েছে। তাহলে শিশির ভাই কেন তাকে এমনটা বলে না! নাহার তো বলল শিশির ভাই আমাকে ভালোবাসে নইলে অত যত্ন কেন করে আবার শাষণেও কমতি রাখে না। নাহার যখন তার ভাইয়ের হয়ে ফোন নম্বর নিতে চেষ্টা করলো সে কথা শিশির ভাইয়ের কানে যেতেই কত শাষণ করল। আবার সেই বৃষ্টির বিকেলে আমার কাছে ছাতা নেই শুনে নিজে টিউশনি বাদ দিয়ে ছাতা নিয়ে তাকে আনতে গেল। এছাড়াও তো সেই রাতের আঁধারে যত্নে তাকে জড়িয়ে রাখা, সেই কাশফুলের মাঝে তার পা ভর্তি আলতা রাঙানো সেসব কি! বয়স বাড়ছে কিন্তু তার ম্যাচিউরিটি ঠিক কতোটা বাড়ছে কে জানে! এখনও কিনা অন্যের বুঝিয়ে দেওয়া কথাটাকেই সে মাথায় গেঁথে নেয়। শিশির ভাই তাকে ভালেবাসে কিনা তা জানতে হচ্ছে বান্ধবীর অনুমান থেকে। এমনও বুঝি হয় মেয়েরা! আলতা নিজেই নিজের মাথায় ঠোকা মেরে হাতে রাখা বইটাতে মনযোগ দিতে যাচ্ছিল। তখনই কানে এলো মেসেজের টোন৷ ফোন হাতে নিতেই দেখলো শিশিরের মেসেজ, “তোর কি এখানে কোন শাড়ি আছে?”

চলবে

#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
২৬.

সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে মন ছুটছে আলতার। শিশিরের সময়গুলো ফুরিয়ে আসছে দেশের মাটিতে পা রাখার সেই সাথে অনুরও। টাকা পয়সার চিন্তাটা শেষ হয়ে এসেছে আহসানুল্লাহর। এখন কাঁধে শুধু আছে স্ত্রীর ঋণ। সেবার যখন শিফার বাবার বাড়ি গিয়ে টাকার জোগাড় হলো তখন আহসানের কষ্ট হচ্ছিলো এতজনের কাছ থেকে পাওয়া সাহায্য নিতে। তারা হয়ত নিজেদের অঢেল থাকায় বোনের ছেলেকে বিনা হিসেবে অনেকগুলো করে টাকা দিতে যেচে এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু এই দরদামের চড়া বাজারে আহসানের কাছে ব্যপারটা সুখকর ছিলো না। যত দিন গড়াচ্ছিলো ততোই আহসানুল্লাহ মানসিক অশান্তিতে দূর্বল হয়ে পড়ছিলেন। একঘর এক বিছানার সঙ্গী হয়ে শিফার চোখে কিছুই এড়ায়নি বরং দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে সে এই মানুষটার সকল নীতিজ্ঞানের সাথে পরিচিত। তাই না পারতেই একদিন স্বামীর দু হাত জড়িয়ে ধরে অনুরোধ করলো সে যা সিদ্ধান্ত নিবে সেটা যেন মেনে নেয়। আহসান যখন কৌতূহলী হলো সিদ্ধান্ত জানতে তখনই শিফা বলল, বড় ভাই বাবার সম্পত্তি ভাগবন্টন করতে চেয়েছেন। মেজো ভাইয়ের ছেলে দুটো বড় পাজী তারা সম্পত্তির ভাগাভাগি করতে চায় সে হিসেবে বড় ভাই ভাগ করবেন। তাই শিফা নিজের ভাগটুকু নিয়ে শিশিরের জন্য খরচ করলে কেমন হয়! আহসান জবাব দেয়নি প্রথম দফায় তা দেখে শিফা আবারও বলল, “আমার ভাগটুকু আমার হক সেটা আমি আমার সন্তানের জন্য খরচ করতে পারি না! আর আমার ভাগটুকু যদি নিয়ে নেই তাতে অনেক আছে তাই দিয়েই শিশিরের হয়ে যাবে তখন ভাই বোনদের থেকে যা এমনিতে নিয়েছি সেগুলো ফেরত দিতে পারব।”

শিফার কথা শুনে সে ভারমুক্ত হতে পারেনি তবে একটু হলেও দায় মুক্ত হতে পারবে বলে মনে হয়েছে। অন্যের কাছ থেকে সাহায্য নেওয়ার চেয়ে স্ত্রীর সাহায্যটাই বেশি শোভনীয় মনে হয়েছে তার। শেষ পর্যন্ত তাই হলো বাপের বাড়ির ভাগ হাসিমুখেই নিয়ে এলো শিফা আর ভাই বোনের তরফ থেকে পাওয়া অর্থগুলো আবার তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হলো। এতে অবশ্য শিফার বড় বোন আর বড় ভাইটা তার প্রতি অপ্রসন্ন হলো। বড় ভাই এমনিতেই আহসানকে গরীব বলে খুব একটা পছন্দ করতেন না। তারওপর ক্ষোভ ছিলো তার পাঠানো দামী চাকরির অফারগুলোও এককালে পায়ে ঠেলেছে সে এখন আবার তার জন্য শিফা ভাইয়ের টাকা ফেরত দিল! সব মিলিয়ে নতুন করে একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হলো শিফার বড় ভাইয়ের । আর আহসানের দিন কাটছে ভাবনায় কি করে স্ত্রীর ভাগের লাখ লাখ টাকা শোধ করা যায়! শিশির অবশ্য মা -বাবাকে রোজ আশ্বস্ত করছে সে সেখানে ফার্স্ট টার্মের রেজাল্ট দিয়েই নিজের ভালো একটা ব্যবস্থা করে নিবে এদিকে যে ইউনিভার্সিটিতে সে যাচ্ছে সেখানকার প্রফেসরের সাথে তার অনলাইনেই চমৎকার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে সেই সুবাদে সে সাধ্যমত মদদ পাবে। লোকটা তাকে এখন থেকেই বিভিন্ন ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা দিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে অনুর চেয়ে তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন আর সেজন্য শিশির প্রতি ওয়াক্তে উপরওয়ালার শুকরিয়া আদায় করে। অনুর এখনও সেখানে স্টে করার ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোন ব্যবস্থা জানা যায়নি অথচ শিশিরের সে ব্যবস্থাও হয়ে গেছে৷ এখন শুধু তার ফাইনাল একটা ডেটের অপেক্ষা। এদিকে আলতার মনের অবস্থাও তার বোধগম্য হয়ে গেছে ঠিকঠাক। তাইতো যাওয়ার আগেই আলতাকে সরাসরি নিজের মনের কথা জানিয়ে যেতে চায় শিশির সেই সাথে আলতাকে নিজের নামে আজীবনের জন্য বন্দী করতে চায়। মাস কয়েক আগের ঘটনা শিশির আলতাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলো, “তোর কি এখানে কোন শাড়ি আছে?”

আলতা সেদিন প্রশ্ন শুনে অবাক হয়েছিল ভীষণ কিন্তু সাথে উত্তেজনাও ছিল এক ভিন্নরকম। তার কাছে কোন শাড়ি নেই কথাটা বলতে ইচ্ছে করছিলো না তাই সে পাল্টা প্রশ্ন করেছিল, “শাড়ি দিয়ে কি হবে শিশির ভাই?”

শিশির তার উত্তর বুঝি সেই প্রশ্নেই পেয়ে গিয়েছিল। আর কোন প্রশ্ন না করে ফোন কেটে দেয়। সন্ধ্যের মুখে আলতা যখন কোচিং থেকে ফিরছে শিশির এলো সেখানে। হাতে তার একটা শপিং ব্যাগ সেটা আলতাকে দিয়ে বলেছিল, এটা নিয়ে যা।

“এটা কি?”

“একটা শাড়ি; আপাতত তোর কাছে রাখ একদিন পরিস।”

আলতা জানতে চাইলো শাড়ি কেন পরবে! শিশির হেয়ালি করে বলল, “আমার গার্লফ্রেন্ড কে দেখতে নিয়ে যাব তোকে।”

আলতা এরপর আর কোন প্রশ্ন করেনি। সেই শাড়ির পয়াকেট খুলে সে দেখতে পেয়েছিল একটা চমৎকার হাফসিল্ক শাড়ির। শাড়ির রঙটা কি রঙ অনেক চেষ্টা করেও সে যখন বুঝতে পারল না তখন মনে পড়লো নিজেদের গ্রামে দেখা জারুল ফুলের কথা। হ্যসঁ এটা সেই জারুল ফুলের রঙ আর এই রঙটা আলতা বড় পছন্দের। এর একটা ইংলিশ নাম আছে যা আলতার জানা নেই৷ সাথে পেটিকোট আর সাদা ব্লাউজও ছিল৷ কিন্তু ব্লাউজটা একদমই আলতার মাপের নয়। তবুও সে মনে মনে খুব খুশি হয়েছে। প্রিয় মানুষ থেকে পাওয়া সকল জিনিস দুনিয়ার সবচেয়ে মূল্যবান বলেই মনে হয়। আলতারও তেমন মনে হলো শাড়িটাকে অনেকটা সময় এলোমেলোভাবে গায়ে পেঁচিয়ে বসে রইল। মনের ভেতর ভালোলাগার শুয়োপোকারা কুট কুট করে কেটে যাচ্ছিলো তাকে। সেই কামড় সুখের শিরশিরানি দিচ্ছিলো হৃদয় জুড়ে। আলতা নিজেই একদিন কলেজের সেই বান্ধবী নাহারকে নিয়ে নিউমার্কেটে গেল। শিশির জানতে পারেনি সে কথা। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বের হওয়া সেই ছিল আলতার প্রথমবার। সে নাহারের সাহায্যে ব্লাউজ কিনলো, শাড়ির সাথে মিলিয়ে চুড়িও কিনেছিলো কয়েক মুঠো। নাহার তাকে আনন্দ, উৎসাহ নিয়ে চুড়ি আর ব্লাউজ কেনা দেখা প্রশ্ন করে বসলো, “তোমার কি কোন প্রেমিক আছে আলতা?”

“নাতো!”

“মিথ্যে বলছো কেন? এসব তুমি প্রেমিকের জন্যই কিনছো নিশ্চয়ই তার কাছে যাবে।”

নাহারের কথাগুলো খুব বেশিই ঠোঁটকাটা বলে মনে হলেও মন বলল কথা মিথ্যে নয়। শিশির ভাই কি তার প্রেমিক নয়! নাকি তাদের ভেতর কাজিন সম্পর্কের বাইরে ভিন্ন কিছু নেই! যদি নাইবা থাকবে তবে এত পরিবর্তন কেন? ছোট্ট আলতার সাথে যেমনটা আচরণ ছিল এখন আর তেমনটা তো নেই। কিশোরী আলতার সাথে যুবক শিশির ভাইয়ের আচরণে শুধু কাজিন রূপ অধিকার নয় এখন সে প্রেমিকগত অধিকারও ফলায়। রাত বিরাতে কতশত শাষণের নামে কত কি যে বোঝায় আজকাল মানুষটা। পড়াশোনার কথা বলতে বলতেই নিজের মনের চাওয়া পাওয়ার কথাও কি না বলেছে! বলে তো আজকাল কত কথা। এইতো সেদিন চুল কাটিয়ে সোজা এলো আলতার হোস্টেলের সামনে। সোজাসুজি কথা বলা শিশির ভাই সেদিন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে জানতে চাইলো তাকে চুল কাটায় কেমন লাগছে! এবার নাকি একটু ভিন্ন কাট-এ তাকে আজব লাগছে তাই জানতে চায় আলতার কেমন লাগে? শার্ট কিনতেও এখন আলতাকে পাশে চাই তার। সেদিন একটা ঘড়ি কিনবে বলে আলতাকে নিয়ে গেল। ঘড়ির কিছু বুঝতে না পারা আলতাকে জিজ্ঞেস করলো, “কোনটা বেশি মানায় বলতো!”

আলতা জানে না তার ভাবনা ঠিক কি না তবে শিশির ভাই তার ওপর যেভাবে অধিকার খাটায় তা আর এখন শুধু কাজিন বলেই মনে হয় না৷ তার মন বলে বদলে গেছে তাদের সম্পর্ক, মন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে খুব শিগগিরই শিশির ভাই তাকে বলবে মনের কথাগুলো। নাহারের কথার প্রেক্ষিতে সে এবার নিজের দ্বিধা বলে ফেলল। জানিয়ে দিলো শিশির ভাইয়ের সাথে তার সম্পর্ক কেমন সেই সাথে বলল এখনো সরাসরি কিছুই বলেনি তাকে। নাহার সব শুনে হাসলো মলিন মুখে। বুঝে নিলো তার ভাই আর আগাতে পারবে না এই মেয়েটির দিকে। আলতা অপেক্ষার প্রহর গুণছে কবে শিশির ভাই বলবে তাকে এই শাড়িটা তার পরে আসতে! আর তো মাত্র মাসখানেক সময় এরপর তো চলে যাবে সে৷ এত দেরি কেন করছে বলে দিতে কথাটা? আলতা যখন শিশিরের ভাবনায় বিভোর তখন তার ফোনটা বাজল সশব্দে। ফোনের স্ক্রীণে চোখ পড়তেই মুখে ফুটে উঠলো এক চিলতে উজ্জ্বল হাসি। মা ফোন করেছে তাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে ফোন তুলল। অনেকটা সময় নিয়ে মা মেয়ে কথা বলল। আলতার তো এখন আরও একটা জিনিসের অপেক্ষা। নকশির এখন নয় মাস চলছে৷ শরীরের অবস্থাও বেশ ভার তবে কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে আবার ভয়ও হচ্ছে খুব তবুও জহির কাকা সেদিন ফোন করে অভয় দিলেন দ্রুতই সিজারিয়ান অপারেশন করিয়ে নিবে। কিন্তু আফসোস সে তার মাকে ফোলা শরীরে কাছ থেকে দেখতে চেয়েছিল, ধরতে চেয়েছিল কিন্তু কিছুই তার পূরণ হলো না। এই পাথুরে শহরে এসে পড়াশোনায় অন্য এক জগত তৈরি হয়ে গেছে। এখন চাইলেই মায়ের কোলে মাথা পেতে দেওয়ার সুযোগ নেই। শিশির ভাই আজ দু দিন হয় বাড়ি চলে গেছে। আলতার এই শেষ সময়ের পরীক্ষাগুলো না থাকলেও সেও চলে যেত কিছুদিনের জন্য কিন্তু এখন তা সম্ভব নয়৷ সেই যে শীত গেল গ্রামে তারপরের কতগুলো মাস পেরুলো মাকে কাছ থেকে দেখেনা। মায়ের শরীরের যা অবস্থা তাতে মা’ও আসতে পারেনি এতদূর। দেখার মধ্যে আব্বা আসে প্রতি মাসে একবার করে আর শিশির ভাইয়ের দরকারে মামা এসেছিল একদিন৷ মাঝেমধ্যে মনে হয় গ্রামে থাকলেই বুঝি ভালো হত! আবার মনে পড়ে সে গ্রামেই থেকে গেলে হয় জহির কাকার বাড়ি অথবা তার সৎমায়ের সংসারে থাকতে হত। কিন্তু এখন অন্যের ঘরে না থেকেও তার বাবা মা দুজনকেই তার নিজের মনে হচ্ছে । শিশির ভাই তাকে শহরে পড়ার জন্য এমনি এমনি উস্কায়নি আজ তা আলতা ভালো করে বুঝতে পারে।

“আর কতদিন এসব চলবে সোহা?”
সোহার ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কথাটা বলল তার মা। কবে থেকে ভালো ভালো বিয়ের প্রস্তাবগুলো ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে শুধু মেয়েটা রাজী হয়না বলে৷ আজও সোহার ফুপু এক পাত্রপক্ষ পাঠাচ্ছেন ঢাকার স্থানীয় পরিবারের। ছেলে ব্যবসায়ী, বংশ ভালো, ছেলে শিক্ষিত। সোহারা ঢাকায় জন্ম নিলেও তাদের আদি ভিটা ময়মনসিংহের এক গ্রামে। বাবা মা চাইছে মেয়েটাকে শহরেই স্থানীয় কোন পরিবারে স্যাটেল করতে যেন সে তার জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা আবহাওয়াতেই জনম কাটাতে পারে৷ কিন্তু হায়, মেয়ের যে কি হলো আজ বছর দুই হবে বিয়েশাদীর নামই নিচ্ছে না। অনার্সও শেষ হতে বেশিদিন নেই এদিকে তার দুই বেস্টফ্রেন্ড উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছে। মেয়ে তো তেমন কিছুতেও নেই তবুও কেন ঘর সংসার করতে চায় না বুঝে পাননা তিনি। তবে মাস খানেক আগে নিজের বোনের মুখে মেয়ের প্রেম সম্পর্কে কিছু শুনেছিলেন। সোহা জিজ্ঞেসও করেছিলেন কিন্তু মেয়ের পক্ষ থেকে সদুত্তর না পেয়ে তিনি পাত্র দেখায় মন দিয়েছেন। আত্মীয়স্বজনও খুঁজে খুঁজে ভালো ভালো পাত্রের সন্ধান দিয়ে চলছে। অথচ মেয়েটার কি হলো কে জানে! সোহার মা ব্যতিব্যস্ত হয়ে আরো কিছুক্ষণ ডেকে চলে গেলেন। পাত্রপক্ষ আসবে সন্ধ্যায় এখন বাজে বেলা তিনটে। তিনি কিছু বুঝে উঠতে না পেরে অনুকে ফোন দিলেন আসার জন্য৷ অনু আজ শেষবারের মত তাওহীদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল৷ যে করেই হোক আজই নাম কা ওয়াস্তে হওয়া এনগেজমেন্ট এর ব্যপারটার সমাপ্তি টানতে। কিন্তু সোহার আম্মু কল দিয়ে সমস্যা বলতেই সে উঠে গেল তাওহীদের সামনে থেকে।

“তোমার সাথে অন্য একদিন ফাইনাল কথা বলব এবং তোমার আংটিটাও নিয়ে আসব। ” কথাটা বলেই সে তাওহীদের সামনে থেকে চলে গেল আর পেছনে ফেলে গেল ব্যথাতুর দৃষ্টির মানুষটাকে। একটা মানুষ কাউকে ভালবেসে তার অবহেলা কতদিন সহ্য করতে পারে! তাওহীদ জানে না সে কথা শুধু বুঝতে পারছে তাকে আরও অবহেলা সহ্য করে যেতে হবে। চাইলেই সে জোর খাটাতে পারে এই মেয়েটার ওপর কিন্তু তার মনটা সায় দেয় না বলেই সহ্য করছে।

দিনের তৃতীয় প্রহর চলছে। শিশির একটু ঘুমাবে ঘুমাবে করেও ঘুম এলো না চোখে৷ আজ কতগুলো দিন হয়ে গেছে বাড়ি এসেছে। হলের সিট সে এখনো ছাড়েনি এখান থেকে আবারও যাবে সেখানে। শেষ মুহূর্তে হল থেকেই এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বের হবে বলে সেটাই সুবিধা। এমনিতেও আরও কিছু কাজ আছে ঢাকায় আর তাতে সবচেয়ে বড় কাজ আলতার ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে যেন কোন সমস্যা না হয় সেদিকটার একটা ব্যবস্থা করে যাওয়া। শিশির চায় আলতা যে করেই হোক ঢাবিতে চান্স পাক তবে সেটা না হলেও যেন ভালো কোথাও পায়। পরিচিত এবং খুব কাছের বন্ধু, বান্ধবীদের সাথে আলতাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে যাবে যেন প্রয়োজনে তাদের সহযোগিতা নিতে পারে। শিশির নিজের ঘরে শুয়ে এসবই ভাবছিলো তখনি কানে এলো অপুর কণ্ঠ৷ শিশির ভাবছিল তার বন্ধু নিশ্চয়ই তাকেই ডাকতে এসেছে কিন্তু খেয়াল করে শুনলো, “কাকী নকশি ফুপু অসুস্থ হয়ে পড়ছে৷ নকশির ফুপু ননদে আপনাদের ডাকতেছে।”

শিফা কথাটা শুনে চিন্তিত হলো৷ বাড়িতে বড় ভাবী নেই তিনি শরতকে সাথে নিয়ে শিউলির শ্বশুর বাড়ি গেছে। নকশির ননদ বলতে তো জহির ভাইয়ের চাচাতো বোনদের কেউ একজন হবে তারমানে নকশির কাছে মুরিব্বি গোছের কেউ নেই। শিফা একটু ঘাবড়ে গেল তৎক্ষনাৎ কিন্তু শিশির ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। সে জিজ্ঞেস করলো কি সমস্যা শিফা তা বলতেই শিশির বলল, “আম্মা তুমি বোরকা পরে আসো আমি আগে গিয়া গাড়ির ব্যবস্থা করি।”

জহির বাড়ি নেই সে নিজ কাজে শহরে গেছে। বাড়িতে রেখে গেছে তার বিধবা চাচাতো বোন জাহানারাকে। সে নকশিরই বয়সী কিন্তু তার একার পক্ষে সম্ভব নয় নকশিকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার। নকশি যখন আচমকা পেটে ব্যথা বলে ছটফট করছিল তা দেখে জাহানারা ভয়ে তার মা মানে জহিরের চাচীকে ডাকলো। বৃদ্ধা নকশির অবস্থা যাচাই করে বললেন, “অর তো সময় অইয়া গেছে দাঈ ডাকতে হইবো।”

নকশির গর্ভাবস্থায় কিছুটা জটিলতা আছে সে কথা জাহানারা শুনেছিলো জহির ভাইয়ের মুখে তাই সে তার মাকে থামিয়ে জহিরকে ফোন দিলো। জহির যথেষ্ট দূরে আছে বলে সে বলল, “আহসানদের বাড়িতে খবর দে। শিশির, শরত কাউকে বল হাসপাতালে নিয়ে যেতে তুই বা নকশির ভাবীদের কাউকে বল তারাই যাবে আমি সোজা হাসপাতালে আসি।”

জাহানারা কথাগুলো শুনে নিজেই বের হচ্ছিলো মাস্টার বাড়িতে যাওয়ার জন্য। বাড়ির গেইটে অপুকে দেখে বলল ও বাড়ি একটা খবর দে। ছেলেটাও দেরি না করে এসে খবরটা জানালো। শিশির বাড়ি থেকে কিছুটা এগোতেই পরিচিত একজনের অটো দেখতে পেলো। শিফাও একদম প্রস্তুত হয়ে নকশির কাছে গিয়ে দেখলো শিশির অটো নিয়ে হাজির। তারা আর কাল বিলম্ব না করে নকশিকে নিয়ে ছুটলো সদর হাসপাতালে। তারপর কাটলো আরও ঘন্টা তিনেক এর মধ্যে এক ব্যাগ রক্ত লাগলে শিশিরের বন্ধু অপুর সাথে গ্রুপ মিলে যাওয়ায় সেই দিলো। জহির তখনও এসে পৌঁছায়নি হাসপাতালে। নকশির যা অবস্থা তাতে সিজারের বিকল্প ছিলো না। কিন্তু তার আগে যে বন্ড সাইন করতে হবে সেটা নিয়ে কিছুটা সমস্যা দেখা দিলো। লিগ্যাল অভিভাবক ছাড়া সই কে করবে! ডাক্তার যখন মানতে নারাজ তখন বাধ্য হয়ে জহিরের সাথে ফোনে কথা বলে শিশিরকেই দেওয়া হলো অভিভাবকের নাম৷ শিশির কাগজটাতে সই করতেই শুরু হলো অপারেশন। এর মধ্যে শরত আর জয়তুনও বাড়ি ফিরে ঘটনা জানতে পেরে তারাও চলে এলো হাসপাতালে। আরো দীর্ঘ সময় কাটলো সবার চিন্তিত মনে। অপারেশন থিয়েটার থেকে একসময় বের হলো ডাক্তার, নার্সরা। সবার কৌতূহলী দৃষ্টি দেখে ডক্টর মুচকি হেসে শিশিরকে বলল, “পেশেন্ট আপনার কি হয়?”

“ফুপুআম্মা।”

” ভাই হয়েছে আপনার।মিষ্টি নিয়ে আসেন বড় ভাই।” কথাটা হাসতে হাসতে মজা করে বলল ডাক্তার। শিফা, জয়তুন, শরত উপস্থিত সবার মুখেই আনন্দের হাসি৷ সকলেই আলহামদুলিল্লাহ বলে জহিরকে ফোন করতে বলল। শরত জহির কাকাকে সুসংবাদ জানাচ্ছে এদিকে শিশির একটু সরে গিয়ে আলতাকে ফোন দিচ্ছিলো৷ হুট করে তার পেছন থেকে অপু এসে কাঁধে হাত রেখে ফিসফিস করে বলল, “মিষ্টি খাওয়ান শালার বোনজামাই৷ শালা হইছে আপনার সেই খুশিতে জলদি করে মিষ্টি নিয়ে আসেন দুলাভাই।”

বন্ধুর মশকরা শুনে শিশির শব্দ করে হেসে উঠলো। একটু দূর থেকে সকলে তার হাসি দেখে বিষ্ময়ে তাকাতেই হাসি বন্ধ করে মুখটাকে স্বাভাবিক করে নিলো ঝটপট। ওপাশে আলতা কলটা আগেই রিসিভ করে হ্যালো হ্যালো করছে।

চলবে