শিশিরে ভেজা আলতা পর্ব-৩২+৩৩

0
380

#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা

৩২.
স্বপ্নের মত কেটে গেছে আলতার পাঁচটি ঘন্টা। শিশিরের সাথে যখন কথা হলো তখন দেশে বিকেল ফুরিয়ে এসেছিল। ঘড়ির কাটায় সময় তখন পৌনে ছয়টা আর এখন এগারোটা পনেরো। আলতার চোখে আজ কতগুলো দিন ধরে ঘুম নেই। আজও হয়তো থাকতো না শিশিরের কণ্ঠ না শুনতে পারলে। কিন্তু এখন সব কথা জানার আগেই মনে প্রশান্তির হাওয়া বইছে। শিশিরের বলা ভালোবাসার উক্তি সারাটা ক্ষণ রুমঝুম ছন্দে বেজে চলছে তার কানে। শিশিরের কল এলো রাত বারোটায়। আলতা ফোন হাতে ফোনের স্ক্রীণে দৃষ্টি রেখেছে। হঠাৎ করেই কলটা এলে আলতা নম্বর দেখে চিনতে পারলো না। কিন্তু স্ক্রীণে স্পষ্ট ভেসে আছে লন্ডন নামটা। আর অপেক্ষা না করেই সে রিসিভ করে ফেলল কিন্তু হ্যালো বলল না। শিশির সেকেন্ড কয়েক অপেক্ষায় রইলো জবাবের তারপর নিজেই বলল, “ঘুমিয়ে পড়েছিলি?”

মন বলল জবাব দেয়, আমি ঘুমালেই বা কি জেগে থাকলেইবা কি। কারো সে নিয়ে ভাবনা হয়! কিন্তু এখন এই মুহুর্তে অভিযোগ করতে গিয়ে যদি আবারও সুযোগ হারিয়ে সব জবাব নেওয়ার। এই ভয়েই আর অভিযোগ নয় জবাবই দিলো, “অপেক্ষা করছিলাম।”

“কখন থেকে?”

“তখন কল কাটার পর থেকেই।”

“কেমন আছিস?”

“বলবো না।”

শব্দ করে হেসে উঠলো শিশির। এইতো আলতার সেই ছেলেমানুষী জেদ ফিরে এসেছে। অথচ আজ কতগুলো বছর হলো আলতা চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। তার সাথে সেই ঘটনার পর থেকেই পরিপক্ক কোন আলতাকেই চোখে পড়তো তার। কিন্তু আজকের এই এক বাক্যই যেন তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল পেছনের অবুঝ সময়ে৷

“রেগে আছিস বুঝতে পারছি কিন্তু এখন কি করলে রাগ ভাঙবে বলতো!”

“সেটাও বলবো না।”

“আচ্ছা! তবে এইটুকুই বল কেমন আছিস তুই?”

এবার আলতা রাগ করতে পারলো না উল্টো তার কান্না পেয়ে গেল অভিমানে। আজ এতদিন তাকে যন্ত্রণায় রেখে এখন জানতে চাওয়া হচ্ছে সে কেমন আছে! বলবে না কিছুতেই কেমন আছে আর না জানতে চাইবে শিশির ভাই কেমন আছে। তার তো আগে প্রশ্ন করার আছে কিছু সেগুলোই করবে।

“বলবো না কেমন আছি আপনি বলেন এমন কেন করলেন আমার সাথে?”

কথার সাথে কান্নাটাও স্পষ্ট শোনা গেল আলতার। শিশির ছটফট করে উঠলো সাথে সাথে। মাথার ওপর দিয়ে তার উড়ে গেল একঝাক পাখি। শিশির দাঁড়িয়ে আছে কেমব্রিজ থেকে মিনিট দশের দূরত্বে এক লেকের পাশে। লন্ডনের আকাশে তখন সূর্যের অন্তিমক্ষণ চলছে। সন্ধ্যেকালের প্রস্তুতিতে তখন চারপাশের আলো ঘোলাটে হতে শুরু করেছে। অক্টোবরের শুরু আর পাতা ঝরা সময়ও তখন চলমান। কানের পাশ দিয়ে হাওয়ার স্রোত শিশিরকে তৃপ্ততার ছোঁয়া দিয়ে গেল আলতার কান্নামাখা স্বর শুনে। তৃপ্ততায়ই বটে! প্রিয় মানুষের চোখের জল কখনও কখনও তৃষ্ণা নিবারক হয়ে যায় প্রেমিক, প্রেমিকার জীবনে। শিশিরের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। তার জন্য আলতার এ কান্নাও ঠিক তেমনি। যে কথা আলতা কখনো মুখে বলেনি আজ তার অশ্রুই তা বলে দিলো চুপিসারে। শিশিরের আর তর সইছে না এই ক্ষণে আলতার মুখটাকে দেখার লোভ তাকে পেয়ে বসেছে। আলতা তার কাছে কৈফিয়ত চাইছে সে কেন এমন করেছে অথচ বলেইনি কেমন করার কথা বলছে! শিশিরের এবার মাথায় একটু দুষ্টুমিও খেলে গেল। প্রথম প্রথম প্রেমের স্বাদ নিতে তার ব্যাকুল মন উতলা হয়ে ভিডিও কল দিয়ে বসলো। আলতা ভিডিও কল দেখে এবার অস্বস্তিতে পড়ে গেল। রুমমেট দুজন ঘুমিয়ে পড়েছে তবুও শুধু টুম্পা থাকলে হতো কিন্তু শিশিরের বন্ধুর বোন সিনিয়র আপুর সামনে এত রাতে কথা কি করে বলবে! অডিও কলে ফিসফিসিয়ে কথা বলা যাচ্ছে ভিডও কলে বাতি জ্বালিয়ে কথা বলবে দুজন দুজনকে দেখবে ইশ, কি লজ্জা! তার পক্ষে সম্ভব নয় তাই ভিডিও কল কেটে দিল আলতা।

“রিসিভ করলি না কেন?”

“ঘর অন্ধকার।”

“তাকে কি বাতি জ্বালিয়ে নে জলদি আমি দেখব।”

“কি দেখবে?” কথাটা বলেই কেমন অপ্রস্তুত হয়ে গেল আলতা। নিজের কানেই কেমন অদ্ভুত শোনালো আলতার। শিশিরও বুঝলো ওপাশের মেয়েটি কি ভাবছে কিন্তু এখন কি এত বেশি লজ্জা দেওয়া ঠিক হবে! থাক, আজ আর জ্বালাবে না। এখন থেকে তো রোজ কথা হবে এ সময়টায় আলতাকে বলে দিতে হবে।

“আচ্ছা শোন, ওই নম্বরটাতে আর কল দিস না ব্লক করে দে। এটা আমার নম্বর এখন থেকে যখন ইচ্ছে নক দিতে পারবি তবে কলে কথা শুধু এ সময়েই হবে।”

” আচ্ছা!”

“কি আচ্ছা! এবার বল কেমন আছিস?”

একই প্রশ্ন পুনরায় শুনতেই যেন মনে পড়ে গেল অভিমানের কথা। আলতা এবার শক্ত কণ্ঠে বলল, “আগে তুমি বলো সেদিন যা দেখেছি তার কি মানে?”

সময় কারো জন্যই থেমে থাকে না। সোহা মাত্র তিনদিনেই তা বুঝে গেল যা তার বিগত জীবনে একটুও টের পায়নি। সবটা দোষ সে এখন নিজেকেই দিচ্ছে। কারো মনে যন্ত্রণার তৈরি করলে সেই যন্ত্রণা নিজেকেই যে পুড়তে হয় সে কথাটাও তার জানা হয়ে গেল তিনদিনেই। জাহাঙ্গীর ভাইয়ার সাথে তার বিয়ে তাও কিনা আর দুদিন পর! তার ভাগ্য এমন নিশ্চয়ই আলতার বদদোয়া পেয়েই এমন হলো। নয়তো হুট করেই কেন তাকে পুরো বদলে যেতে হবে সারাজীবনের জন্য? জাহাঙ্গীর ভাইয়া তো কখনও তার সাথে তেমন কোন কথা বলেনি না ফুপি কোনদিনও ইঙ্গিত দিয়েছে তবে হুট করেই কেন একদম বিয়ের কথা উঠলো? ফুপি চলে গেছে কাল বিয়ের প্রস্তুতি নিতে। প্রথমে কাবিন পরে অনুষ্ঠান করে একদম দেশ ছেড়েই যেতে হবে! তিনদিন আগেই রাতের খাবার এর পর আম্মু জানালেন ফুপি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। সোহা হ্যাঁ না কিছু বলার আগেই আম্মু কেমন ড্রামাটিক এক সিন তৈরি করল! আব্বু আর সোহানের সামনে সোহার হাত নিজেই মাথায় রেখে বলে দিলেন, “এবার আর কোন কথা শুনতে চাই না সোহা। জাহাঙ্গীরের সাথে তোর বিয়ে হবে এই তোর হাত আমি মাথায় রেখে বলছি এবার কোন নাটক করলে আমি গায়ে আগুন দেব।”

সোহা কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে চাইলেই আম্মু আবার বলে উঠলেন, “ওই গায়ের ছেলে কোনদিনও তোকে তোর মত করে রাখতে পারবে না সোহা। শিশিরের মত ব্রাইট ফিউচারও নেই তার সেই ভাইয়ের। আমি গোড়ার খবর সব জানি তোর এই বারবার পাত্র রিজেক্ট করা, বিয়ে ভাঙার হাজারটা নাটক আমার এখন মুখস্ত। কোন কিছু শুনতে চাই না এবার। ঘরের ছেলে, চেনাজানা এমনকি উজ্জ্বল ভবিষ্যতও তার। আর হ্যাঁ জাহাঙ্গীর যেন ভুল করেও না জানে সেই ছেলের কথা। তোর জীবনে কেউ ছিল বা আছে এমন কোন শব্দও যদি উচ্চারণ করিস তবে এবার সত্যিই অঘটন ঘটবে কথাটা মনে রাখিস।”

ব্যস, জীবনের প্রায় সাড়ে তিন বছরের ভালোবাসাকে এক নিমেষে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেকে এখন তৈরি করছে সোহা জাহাঙ্গীর ভাইয়ার বউ হওয়ার। এটাই তার আলতার সাথে করা পাপের শাস্তি। অনুও তো তাকে ভুল বুঝছে এখন। সে নিজেই অনুকে জানিয়েছিল তাওহীদের সাথে সাথে আলতাও সেদিন ক্যাফেতে হওয়া দৃশ্য দেখেছে। শিশিরের অনুরোধে সে আলতাকে কল করেছে এটাও মিথ্যে। সেদিন কোন কলই করেনি সে আলতাকে । করলে হয়তোবা শিশিরের দেশ ছাড়ার অন্তিম মুহূর্তটাতে আলতা পাশে থাকতো। অনু খুব করে বকেছে সোহাকে, “কেন এমন করলি সোহা! আমি শিশিরকে ভালোবাসি এ কথা যেমন সত্যি শিশির তার আলতাকে ভালোবাসে এটাও তেমন সত্যি। আর সেই সাথে আরেকটা সত্যি হলো আলতাও শিশিরকে ভালোবাসে। যেখানে তারা একে অপরকে মনে প্রাণে ভালোবাসে সেখানে আমি তৃতীয়পক্ষ এটা তুই ভালো করেই জানিস। তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই ভুল বোঝাবুঝি চলছে এখন তোর আর আমার জন্য।”

অনুর কথাগুলো মনে পড়লেই সোহার মনে হচ্ছে অভিশাপ লেগেছে আলতার। নইলে শরত তো এবার তার প্রতি সদয় হয়েছে এখনই কেন জাহাঙ্গীর নামের মানুষটার সাথে এমন বন্দী হতে হবে! শরতের সাথে এখন রোজ দু চারটে কথা হয়। কেমন আছে, কি করছে? প্রশ্ন করলেই জবাব দেয় শরত আগে তো দিতো না। সোহার এখন নিজেকে খুন করতে ইচ্ছে করছে। জীবন এত জটিল কেন হয়ে গেল তার! এত চাওয়া, এত প্রার্থনা সব বিফলে কেন যায়! কেন মানুষ ভালোবাসলেই কষ্ট পায়! তবে কি ভালোবাসার দ্বিতীয় নাম যন্ত্রণা! নিজেই নিজেকে শুধায় সোহা, ভালোবাসা মানেই যন্ত্রণা।

আজ সারাদিন শরত বাড়ি আসেনি। দু দিন পর মামা বাড়িতে যেতে হবে বিয়ের দাওয়াতে তাই মায়ের আবদারে সে দুপুরে দোকান থেকে বেরিয়ে সদরে গেছে। ভালো মার্কেটে গিয়ে ভালো মানের একটা মেরুন রঙের জামদানী কিনতে। বাবার মৃত্যুর পর শরত আর শিউলি কেউই মামা বাড়ি যায়নি খুব একটা। এক মামা মামীই তো শুধু যোগাযোগ রাখতো তাও সম্পর্ক তেমন ভালো নয়। কিন্তু এবার অনেকগুলো বছর পর চাচাতো এক মামা মেয়ের বিয়ের দাওয়াত দিতে এলেন কয়েকদিন আগে। জয়তুন মেয়ের বাড়ি থেকে ফেরার পর দিনই এসেছিলেন তারা। দাওয়াত পেয়ে জয়তুন প্রথমে মুখটা হাড়ির মত করে ফেলেছিলেন কারণ তার বিপদে এই ভাইরা কিংবা তার আপন ভাইরাও কেউ তার কাছে ভীড়েনি খুব একটা যদি বোন টাকা পয়সা চেয়ে বসে! এখন জনে জনে কত ভাই বোন বের হচ্ছে তার ছেলের কথা জানতে পেরে। সেও তাই দেখিয়ে দিতে চায় তার এখন দিন ভালো কাটছে। শরতকে দিয়ে শাড়ি আনাচ্ছে, হাতে নগদ অনেক টাকা নেই কিন্তু গত বছরই সে একটা অল্প সোনা দিয়ে পাতলা আংটি গড়িয়েছিল এখন ভাবছে সেটাও দিয়ে আসবে এক কথায় ওই শয়তানের দলে দান করে আসবে। যেন পুরো গুষ্টিতে এবার তার আর তার সন্তানের নামের জয় জয়কার চলে। আংটি সে ভালো করেই গুছিয়ে নিয়েছে। কাল হলুদ মেয়ের কিন্তু ওই বাড়ি গিয়ে থাকার একদমই ইচ্ছে নেই। তার এত সুন্দর ছেলেকে নিয়ে থাকার তো প্রশ্নই আসে না। একেবারে শুক্রবারে সকালে রওনা দেবে সে। শরত একটা দুপুর খুঁজেও মায়ের বলে দেওয়া রঙের শাড়ি খুঁজে না পেয়ে নিজ পছন্দেই গোলাপি এক জামদানী কিনলো। শাড়ির রঙটা দেখতেই তার চোখে ভেসে উঠলো অলির মুখটা। নিজেই নিজেকে হঠাৎ গালি দিয়ে বসলো। কত চেষ্টা করছে সোহার জন্য মনে কিছু তৈরি করার অন্তত মেয়েটা তাকে ভালোবাসে বলে সেই ভালোবাসার সম্মানেই চাইছিলো সোহাকে মনে বসাতে। কিন্তু মনটা সেই প্রথম ভুলেই আটকে আছে তার। অলির শখ ছিল বিয়েতে সে তিনটা শাড়ি পরবে। একটা কবুল বলার আগে একটা কবুল বলার পর। আর তৃতীয়টা বাসরে বসার আগে পরবে। তিন শাড়িতে সে শরতের কাছে তিনবার সালামি নেবে! আহ্ এসব ভাবতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে অস্বস্তির নিঃশ্বাস। উঁচু জীবনযাপনের আশা করা নারী তার জীবনে না আসুক এটাই এখন কামনা করে সে তাই সোহাকে ভাবতে গিয়েও মনকে মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়। নিজের ভালোবাসার সম্মান পায়নি বলেই সে সোহার ভালোবাসে মূল্য দেওয়ার কথা ভাবছে কিন্তু মনটাই যে ধোঁকাবাজি করে যাচ্ছে অবিরত। শাড়িটা কিনে শরত পরিচিত দু একটা দোকানে ঘুরে মায়ের জন্য, শিউলি আট ভাগ্নির জন্যও কিছু না কিছু কিনলো। পরেই মনে হলো কাকীর জন্য শিশিরের আগে সেই কাকীর সন্তান৷ তাই মায়ের সাথে কাকীর জন্যও কিছি না কিনলে খারাপ লাগে তার৷ এমন ভাবনা থেকেই আবার মায়ের শাড়ির সাথে মিলিয়ে আরেকটা শাড়ি কিনলো। দুটোই সুতির শাড়ি একই কাজের শুধু রঙটা ভিন্ন। আজ অব্ধি সে অনেকগুলোই শাড়ি দিয়েছে সে কাকীকে আগে ফুপুআম্মাকেও দিত। এখন ফুপুআম্মাকে বিয়ে দিয়ে খুব একটা দেওয়া হয় না মনে পড়তেই সে ভাবলো আজ একটা উনার জন্যও কিনবে। সত্যিই সে কিনে নিলো নকশির জন্য একটা সুতি শাড়ি বাদ পড়লো না নকশির ছেলেও। এই করে করে সন্ধ্যায় যখন শরত বাড়ি ফিরলো তখন শিফা তাকে দেখে ঠাট্টা করে বসলো, “বাজান কি নিজের বিয়ের বাজারই করতে গেছিলেন?”

“আমার বিয়েতে কি এই কয়েকটা বাজার হবে? তখন তো আমার মা, চাচী বাজার দেখতে দেখতেই হাঁপিয়ে উঠবে এতোটা করব।”
শরত এইটুকু বলে আবার বলল, “কাকী একটু আম্মার ঘরে আসেন।”

শিফা ভাবলো, অনেক কিছু কিনেছে তা দেখতে ডাকছে হয়ত! আজ দু দিন ধরে শিফার মন ভালো আছে খুব৷ সেদিন শরতের জবাব শুনে আহসানুল্লাহ বাড়ি ফিরতেই আঁচ করলো কোন কারণে শিফা রেগে আছে খুব৷ এক কথায়, দুই কথায় শিফা বলে উঠলো, শিশির আলতাকে ভালোবাসে আহসান কেন তাকে না জানিয়ে শরতের সাথে আলতার বিয়ের কথা বলল! ঠিক তখনিই আহসানের মনে হলো রফিক যা দেখেছে তা সত্যি তবে সেখানে একটু ভুলও হয়েছে। রফিক শুধু আলতার মুখটাই হয়তো দেখেছে শিশিরের শরীর দেখলেও মুখ দেখেনি। আর এখানেই তার শিশিরকে শরত বলে ভ্রম হয়েছে। দেহ গড়নে শিশির আর শরতের যে কতোটা মিল তা সেদিনই আহসানের খেয়াল হলো। শিফাকে সে পুরো ঘটনা বলতেই শিফা আরও রেগে বলল, “এখন ভাবীকে কি বলবেন?”

আহসান নিশ্চিন্ত রইলো এ নিয়ে কারণ শরত আগেই প্রস্তাবে ‘না’ জবাব দিয়েছে। জয়তুন এক কথাতেই আলতাকে ছেলের বউ করতে রাজী ছিলেন কিন্তু আহসান যখন বলল, শরত রাজী না আর তিনি তাই আলতাকে শিশিরের বউ করবেন বলে ঠিক করেছেন। জয়তুন এ নিয়ে আর রা করেনি তারও মনে হলো ছেলের অমতে বউ এনে বিপদ ডাকবেন না৷ ছেলেটা যেদিন বলবে নিজে মেয়ে পছন্দ হয়েছে সেদিনই এক কাপড়ে বিয়ে পড়িয়ে বউ আনবেন।

শুক্রবার সকাল সাতটাতেই জাহাঙ্গীর আর পুরো পরিবার এসে হাজির সোহাদের বাড়ি। বিয়ে ঠিক হতেই জাহাঙ্গীর দু তিনবার কল দিয়েছে সোহাকে। কিন্তু দুজনের কথা হয়নি খুব একটা। জাহাঙ্গীর গম্ভীর স্বভাবের সে চেয়েও কাজিন সম্পর্ক থেকে পুরোপুরি বের হতে পারেনি দু দিনে। কিন্তু তার সোহার প্রতি যে ভিন্ন ভালোলাগার তৈরি হয়েছে তা সে দু এক কথাতেই প্রকাশ করে দিয়েছে। সোহা নির্বিকার শুধু মায়ের মুখ চেয়ে। শরতকে কাল কল দিলো মাঝরাতে শরত ফোন দিয়ে বলল ঘুমাচ্ছে এখন সকালে ফোন করবে। কই আর তো এলো না তার কল! বারোটার মধ্যেই সোহার খালা এসে তাকে শাড়ি, গয়না পরিয়ে হালকা করে সাজিয়ে দিলো বউয়ের সাজে। ঠিক দুইটায় খাওয়া শেষ করে কাজী নিয়ে সোহার বাবা, ফুপা আর দু তিনজন পুরুষ আত্মীয় সোহার ঘরে এসে বিয়ের কার্যাদি শুরু করলো। সোহার আঁচলের তলে লুকানো ফোনটা হাতে নিয়ে সে বারবার ডায়াল করতে লাগলো সোহা শরতের নম্বরে। কলটা রিসিভ হচ্ছে না শুধু বেজে চলছে অনবরত। কাজী সাহেব মেয়েকে কবুল বলতে বললেন বারবার৷ এবার পাশ থেকে সোহার খালাও বলে উঠলো, “কবুল বলো সোহা।”

____________________

“কবুল বলো শরত!”

মাত্র কয়েক সেকেন্ড এক নিঃশ্বাসে মাত্র তিন শব্দে রূপসাকে কবুল করে নিলো শরত তার জীবনে।
জয়তুনের চোখ দুটো উজ্জ্বল হওয়ার পরিবর্তে আরও ঝাপসা হয়ে এলো।যেন সকল আনন্দের ওপর তার পাতলা চাদরে ঢেকে গেল সবটা।

চলবে

#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা

৩৩.
শরত হলো না সোহার। সে নিজেই হয়ে গেছে এখন অন্যের ঘরণী। একটু আগেই তো কবুলের পর্ব চুকে গেছে সোহা, জাহাঙ্গীর এর। আর মাত্র ঘন্টাখানেক সময় তারপরই সে পাড়ি জমাবে জাহাঙ্গীর এর সাথে নিজের ঘরের উদ্দেশ্যে। একটু আগেও তার চোখে যে জলোচ্ছ্বাস ছিল হুট করেই তা মিলিয়ে গেল৷ বিষাদের হাওয়া এখন জ্বলন্ত আগুনের মত শুধু ভেতরটাই জ্বালাচ্ছে তার৷ বাহিরে তার বিন্দুমাত্র আভাস নেই৷ কঠোর মুখে চুপচাপ বসে আছে নিজের বিছানায়। তার ঘরে তার পাশে এখন তার ছোট খালা আর জাহাঙ্গীর এর চাচাতো ভাইয়ের বউ। সোহার আঁচলের আড়ালে ফোনটা এখনও তার হাতে। কবুল বলার আগ পর্যন্ত সে শরতকে ফোন করে গেছে কিন্তু ওপাশের নিষ্ঠুর মানুষটা একটিবার ধরেনি আর না নিজে ব্যাক করেছে। মানুষ এতই কঠিন হয়! লোহাও তো আগুনে গলে তবে শরত কি দিয়ে গলতো? মন গলানোর মন্ত্র সোহা কেন জানে না!

“আমার খুব মাথা ঘুরাচ্ছে খালামনি একটু লেবুর শরবত দিবে?”

খালাকে কথাটা বলে সোহা চোখ মুখ একটু কেমন ফ্যাকাশে করলো। তাকে দেখে তখন সত্যিই অসুস্থ মনে হলো৷ খালা সাথে সাথে উঠে গেল ভাগ্নির জন্য শরবত আনতে। এবার সোহা কোমর থেকে শাড়ি টেনে খুলে ভাবিকে বলল, “ভাবি একটু বাইরে যাবেন আমি একটু শাড়ির কুঁচি টা খুলে গেছে বোধহয়।”

জাহাঙ্গীর এর ভাবি একবার তাকালো সোহার দিকে। মহিলার একটু কেমন লাগলেও মুখে বলল না কিছু। চুপচাপ সে বেরিয়ে যেতেই সোহা দরজা আটকে ফোন হাতে আলতার নাম্বারে কল দিল। বেশি সময় লাগেনি রিসিভ হতে। আলতা হ্যালো বলার আগেই সোহা বলল, “আজ আমার বিয়ে হয়ে গেছে।”

আলতা কথাটা শুনলো সাথে চমকেও গেল। কই কাল রাতে তো শিশির ভাই কিছু বলল না তাকে। এখন তো রোজ রাতে কথা হয় তাদের। আলতা চুপ করে গেল আর ভাবছে শরতের কথা। সোহার তো শরতকে বিয়ে করার কথা ছিল। শরত ভাইকে তো রাজী করাবে বলে শিশির ভাই নিজেই এক প্ল্যান বলেছিল তাকে সেদিন তাহলে আচানক কি হলো!

“ক্ষমা করে দিও আলতা। তোমার সাথে অন্যায় করেছি বলেই হয়ত আজ তার শাস্তি পেলাম।”

“এসব কি বলছো সোহা আপু?”

“ঠিকই বলেছি সোহা, সেদিন রেস্টুরেন্টে শিশির অনুকে প্রপোজ করেছে সেটা একটা নাটক ছিল মাত্র তাওহীদকে কষ্ট দেওয়ার জন্য। অনুর জীবন থেকে সরিয়ে দেওয়ার ছোট্ট এই অভিনয়টাকে আমিই ইচ্ছে করে তোমার কাছেও সত্য বলে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলাম৷ অনুর খুশির কথা ভাবতে গিয়ে তোমার আর শিশিরের ভালোবাসায় বিচ্ছেদের অনল লাগাতে চেয়েছিলাম। তার শাস্তিও আমি আজ পেয়ে গেছি। ক্ষমা করে দিও আমায় আমি সত্যিই খুব বড় ভুল করেছি। শিশির অনুকে নয় তোমাকেই ভালোবাসে।” কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লো সোহা৷ দরজার ওপাশ থেকে তার খালা ডেকে যাচ্ছে কান্নার আওয়াজ পেয়ে। বারবার বলছে দরজা খুলতে হয়তো তিনি ভয়ও পাচ্ছেন। আলতাও ওপাশ থেকে কিছুটা শোরগোল বুঝতে পারছে। সে সোহাকে আশ্বস্ত করে বলল, “আমি সব জেনে গেছি সোহা আপু। শিশির ভাইয়ের সাথে আমার যে অনুভূতির সম্পর্ক, ভালোবাসার যে গভীরতা তা তোমাদের সাজানো নাটকে শেষ হওয়ার নয় উল্টো আমরা আগের চেয়ে বেশি বুঝতে শিখেছি দুজনকে। তোমার নতুন জীবনের জন্য শুভ কামনা রইলো ভালো থেকো৷”

আলতা কল কেটে দিলো। সোহাও চোখ মুখ মুছে দরজা খুলে দিতেই তার খালা আর মা হুড়মুড় করে ঢুকে গেলেন ঘরে। দুজনেই মিলে মেয়েকে জেরা করতে লাগলেন দরজা লাগিয়ে কি করছে সে! সোহার মা যেন ভরসা পাচ্ছিলেন না মেয়ের ওপর বাধ্য হয়ে তিনি আবারও নিজের আত্মাহুতি দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মেয়েকে প্রস্তুত করলেন বিদায়ের জন্য।

মাগরিবের আজান দিতেই আহসান তাড়া দিলো রূপসার বাবাকে, “ভাই এবার মেয়েকে একটু বলে, বুঝিয়ে দিন আমাদের বের হতে হবে।”

রূপসার বাবা -মা দুজনেরই চোখ মুখ অশ্রুজলে ভিজে একাকার। জয়তুনও তার এই চাচাতো ভাই ভাবীর দিকে তাকিয়ে মন খারাপ করে আছেন। রূপসা মেয়ে মন্দ না এ কথা তিনি একটু আধটু জানেন কিন্তু তাদের সাথে কোন কালেই সখ্যতা না থাকায় খুব বেশি জানা নেই এই ভাতিজী সম্পর্কে। আজ তো বড় গরিমা দেখাতেই বিয়ের দাওয়াতে এসে ছিলেন৷ নিজের অতীত দুঃখ-কষ্ট সব ঘুচে গেছে, এখন সে কারো সাহায্যের আশায় দিন পার করে না তা বোঝাতেই তো ছেলেকে দিয়ে শাড়ি আর নিজের এক আংটি নিয়ে এসেছিলেন বিয়ের উপহার দিতে। কিন্তু কে জানতো এই দাওয়াতে এসে ছেলের বউ নিয়ে ফিরতে হবে! মা, ছেলেতে দুপুরের আগেই এসে উপস্থিত হয়েছিল বিয়েতে৷ সেই কবে নানা বাড়ি বেড়াতে এসেছিল শরত তাও ঠিকঠাক মনে নেই। আপন ছোট মামা-মামী ছাড়া আর কারো কথাও তার ঠিকঠাক মনে নেই৷ শিউলির বিয়েতে সেই মামা-মামী দুজনই গিয়েছিল বাকিরা তো কোন যোগাযোগই রাখেনি। শরত এসেই একটু এলাকা ঘুরতে বেরিয়েছিল৷ দুপুরে নামাজ পড়ে সে যখন অনুষ্ঠানে ফিরলো তখন বরযাত্রী এসে গেছে। শরত প্যান্ডেলে বসে খাচ্ছিলো তখন তারই পাশে বসা ছিল বরের বাবা আর কনের বাবা৷ তারা ধীর কণ্ঠে কোন বিষয়ে আলোচনা করছিলো। খুব সম্ভবত কিছু একটা নিয়ে বাকবিতন্ডায় জড়াচ্ছিলো বরের বাবা। তার কানে একটু আধটু কথা প্রবেশ করলেও সে খাওয়া সেরে দ্রুত প্রস্থান করতে চাচ্ছিলো৷ কিন্তু তা আর হয়ে উঠলো না। বরের বাবা এক পর্যায়ে জোরেই বললেন, “কথা আছিলো মোটর সাইকেল, খাট-সুকেস(শোকেস) আর দুই ভরি সোনাও দিবেন। এহন হুুদা মোটরসাইকেল আর খাট দিলে কেমনে হইব? না না এমনে হইবো না মাইয়ার তো রঙডাও ময়লা। আমার পোলা কি গাঙের জলে ভাইসা আইছে?”

শরতের খাওয়া থেমে গেল। সে বুঝতে পারলো ঝামেলা হচ্ছে যৌতুক নিয়ে। কনের বাবা বারবার অনুনয় করে চলছেন তিনি ধীরে ধীরে সব দিবেন। একসাথে এত কিছু কেনা সম্ভব হয়নি৷ কিছু জমি বিক্রি করে সে এই অর্থই জোগাড় করতে পেরেছে যা দিয়ে সবকিছু করা সম্ভব হয়নি। শরত এঁটো হাতেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনলো সবটা। রাগে তার গা রি রি করছে। এ যুগেও মানুষ এমন বর্বর হয় কি করে! দেশ এত উন্নতি করছে অথচ দেশের মানুষ গুলো এখনও এতোটা মূর্খ কি করে রইলো? শরত এবার ঘাড় ঘুরিয়ে প্যান্ডেলের সামনের দিকে চৌকির মত স্টেজে তাকালো। বরকে দেখে সে নাক মুক কুঁচকে ফেলল একদম। বেটে খাটো লোকটা দেখতে খুব একটা সুদর্শন যুবক নয়। মোটামুটি বয়স তার মতই হবে অথচ সে শুনেছে এবার সবে ইন্টার প্রথম বর্ষে। বয়স আন্দাজ করলেও আলতার থেকেও জুনিয়র হবে। মেজাজ যেটুকু বিগড়ে ছিল বরকে দেখে সেটুকুও নষ্ট হয়ে গেল। সে দু পা এগিয়ে কনের বাবার দিকে তাকিয়ে আছে দেখার জন্য লোকটা আর কি কি বলে নিজেকে ছোট করে। বরের বাবা দু চার কথায় মুখ খারাপ করে দু একটা গালিও ব্যবহার করলো৷ এবার আর নিজেকে সামলাতে না পেরে সে লোকটাকে থামাতে চাইলো।

“এই যে চাচা মুখ খারাপ করছেন কেন? যৌতুক চেয়ে এমনিতেই তো অন্যায় করছেন তারওপর এত বাজে আচরণ কেন করেন?”

“ওই মিয়ে তুমি কেডা? যৌতুকের কথা কও ক্যান? বেডার মাইয়া কি ফালানি জিনিস যে মাইয়ারে কিছু দিব না? আর মাইয়াও তো ধলা না হেই মাইয়া নিমু লগে সোনাদানা না দিলে কেডা নিব এই মাইয়া?”

শরত যতোটা শীতল কণ্ঠে প্রশ্নটা করেছিলো বরের বাবা ঠিক ততোটাই উত্তেজিত কণ্ঠে জবাব দিল। আর এতেই শরত ভীষণ রেগে পুলিশের কথা তোলে। “যৌতুকের দায়ে এদের পুলিশে দেওয়া দরকার ” এই একটা বাক্যের ওপর ভিত্তি করে বিয়েটা ভেঙে দিলো। শরত বরকে ডেকে যখন বলল, তোমার কি মত এমন যৌতুকের পেছনে পড়েছো কেন? তখনই ছেলেটা দু চার কথায় বলে দিলো, “তোর এত জ্বলে ক্যা? আর যদি জ্বলেই তয় তুই বিয়া কইরা উদ্ধার কর শ্যামলা মাইয়ারে।”

ব্যস, এরপর শান্ত, গম্ভীর শরত অকল্পনীয় এক কাজ করে বসলো। সে তার এঁটো হাত টিস্যুতে মুছে বরকে বলল, “চুপচাপ দাঁড়াবি ঠিক ততক্ষণ যতক্ষণ আমি না থামবো।”

ভরা মজলিশে শরত বরের কলার চেপে পরপর এক, দুই, তিন করে ঠিক চারটা চড় মারলো। বরপক্ষের সবাই অবাক হয়ে চড় দেওয়া দেখলো তারপরই যখন সবাই ক্ষিপ্ত হয়ে শরতকে আক্রমণ করতে এলো তখনই যেন কনের বাড়ির মানুষদের সবার হুঁশ এলো। সবাই মিলে আগলে নিলো শরতকে।কিন্তু শরত সেখানেই থামেনি সে তৎক্ষনাৎ ফোন বের করে তাদের এলাকার পরিচিত পুলিশকে কল দিলো। ঘটনা শুনে অফিসার জানালেন তিনি এ থানার নয় তবে এই থানায় যোগাযোগ করে লোক পাঠাবেন। সত্যিই আধঘন্টার মাঝে পুলিশ এলো শরত নিজেই যৌতুকের মামলা করলো। বিয়ের আসর হঠাৎ করেই মৃতবাড়ির রূপ ধারণ করলো। জয়তুন বাকহারা হয়ে সবটা দেখে গেলেন আর মনে মনে ভয় পাচ্ছিলেন খুব৷ তাঁর ভয়কে সত্যি করে দিয়ে গ্রামেরই কয়েকজন মহিলা বলে উঠলো, “জয়তুনের পোলায় এইডা কি করলো অহন রূপসারে বিয়া করবো কেডা৷ মাইয়ার জীবনডা তো নষ্ট হইয়া গেল গো।”

এক কথা, দুই কথায় পুরো গ্রামে রটে গেল শরতের জন্য রূপসার বিয়ে ভেঙে গেছে। মেয়েটাও অপয়া নইলে বিয়ের আসরে বিয়ে ভাঙবে কেন! সবকিছুই শরতের চোখের সামনে ছিল। সে দেখতে পাচ্ছিলো মামীর আহাজারি, মামার মাথায় হাত। জমি বেঁচা টাকার কেনা বাইক পড়ে আছে উঠোনের কোণে, প্যান্ডেলে এখনও জ্বলছে লাল নীল মরিচা বাতি সেই সাথে জ্বলছে হয়তো বিয়ের কনের হৃদয়টাও। হঠাৎ করেই শরতের মনে হলো জীবনে সবচেয়ে বড় পাপটা সে আজই করে ফেলল। অসহায় একটা পরিবারকে সে এক লহমায় ধ্বংস করে ফেলল। এই যৌতুকের ঘটনা তো নতুন কিছু নয়। জন্মের পর থেকেই তো সে দেখে আসছে এই রীতি। কিন্তু সে যে মেয়েটার ভালো করতেই এগিয়ে এসেছিল৷ শরত দাঁড়িয়ে ছিল রূপসাদের ঘরের সামনে। উঠোন জুড়ে ভীড় করেছে গ্রামবাসী। তার ফোন বাজছে অনবরত। তার পাশেই দাঁড়িয়ে কেউ কেউ বলছে, ” ওই পোলায় বিয়া ভাঙছে ওই পোলারেই কও রূপসারে বিয়া করতে৷ বেশি দয়ালদারী দেখাইতে আইছে অহন দেখাক আরেকটু।” শরত ফোনে তাকিয়ে দেখলো সোহা কল দিচ্ছে। ফোনটাকে সাইলেন্ট করে সে মাকে খুঁজলো৷ ভীড়ের মাঝে পাওয়া গেল মাকে। সে হাত টেনে ধরে মাকে নিয়ে বের হলো বাড়ি থেকে৷ একটুখানি ফাঁকা জায়গা দেখে মাকে বলল, “আম্মা আমি একটা কাজ করতে চাই আপনি কি রাগ করবেন?”

জয়তুন যেন আগে থেকেই জানতেন ছেলে এমন একটা প্রশ্ন করবে। তিনিও জবাব প্রস্তুত রেখেছিলেন, “প্রথম কাজটা করতে যখন জিগানের দরকার মনে করোস নাই অহনেরটা ক্যান করতাছোস?”

সরাসরি নয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যেন ‘হ্যাঁ’ বলে দিলেন জয়তুন। তবে আরও একটা কথা বললেন, “রূপসারে তুই দেখোস নাই কোনদিন। মাইয়াডার রঙ আলতার মতো পরিষ্কার না তাই আগে একবার দেইখা নে।”

জয়তুন এবার ইঙ্গিত দিলেন আলতার সাথে তার বিয়ের কথা হয়েছিলো। শরত বুঝতে পেরেই বলল, “আম্মা আগেই বলছি আলতা আমার কাছে শিউলির মত। আর কাকী তো আগেই বলেছে শিশিরের বউ হিসেবে আলতারে কল্পনা করে রাখছেন৷ এখন তাহলে সে কথা তুলছেন কেন? আর এই মেয়েটা কালো বলছেন? আমি জেনেই রাজী আছি, অন্তত সারাজীবন কারো বিয়ে ভাঙার অপবাদ নিতে চাচ্ছি না।”

“তারমানে তুই ওরে করুণা কইরা বিয়া করবি৷ পরে যদি তোর অন্যদিকে মন যায়?”

“নিজের ছেলের ওপর বিশ্বাস নাই?”

“সময়ের উপ্রে বিশ্বাস নাই আমার।”

“কাকাকে ফোন দিয়ে আসতে বলেন আম্মা। আমার অভিভাবক তো কাকা-কাকীও তাইনা!”

শরতের কথার পর জয়তুন ফোন করে আহসানকে সারসংক্ষেপ সবটা বললেন। আহসান তখন বাড়ি থাকায় শিফাও জানলো সবটা। জয়তুন তাদের যেতে বললে শিফা আনন্দের সাথে বলে উঠলো, “ভাবী আপনার দেবর যাক। আপনারা বউ নিয়া আসেন আমি নকশিরে খবর দেই। বউ বরণ করার আয়োজন করব।”

শিফা বাড়ি থেকে নকশিকে খবর দিলো। শিশিরকেও লাইনে পেয়ে ফোন করে জানিয়ে দিলো শরতের বিয়ের কথা। জানলো আলতাও তবে বিষ্ময়কর ব্যাপার হলো শরত আর সোহা দুজন দুজনার হলো না অথচ একই দিনে প্রায় একই সময় দুজন হয়ে গেল অন্য দুজনের। নিয়তির খেল কখন যে কেমন করে বদলে নেয় চাল কারো বোঝার সাধ্য নেই। সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত শরত জানতেই পারলো না তার স্ত্রী রূপসা দেখতে কেমন, মেয়েটিকে তার সাথে আদৌও মানাবে কিনা! কাল পর্যন্তও সে সোহাকে মেনে নেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার চেষ্টায় মনকে বোঝাচ্ছিল অথচ আজ তার জীবনে সোহার নাম মিটিয়ে অন্য কেউ দখল নিলো। না চাইতেও অচেনা এক মেয়েকে আজীবনের দ্বায়িত্ব বানিয়ে সঙ্গে করে প্রস্তুতি নিচ্ছে। সন্ধ্যে হয়ে যাওয়ায় আর দেরি করতে চাইলো না আহসান। নতুন বউ নিয়ে যাবে বলে আহসান একটা সি এন জি আনিয়ে নিলো। এ এলাকায় যদি ট্যাক্সি পাওয়া যেত তবে সে ট্যাক্সি করেই নতুন বউ নিয়ে বাড়ি ফিরতো৷ হোক না বিয়েটা হঠাৎ হওয়া, হোক না সেটা দীর্ঘটনা তবুও তো বিয়ে বলে কথা। বউ নিয়ে যাবার আগে সে মিষ্টি আনিয়ে কনে বাড়িতে দিয়ে গেল। শুভ কাজে পাড়া-প্রতিবেশিকে মিষ্টি মুখ না করালে কি করে হবে! রাত আটটার মাঝেই বাড়ি পৌঁছে গেল শরত নতুন বউ নিয়ে। নকশি আর শিফা মিলে দুটো পিঁড়ি সাজিয়ে রেখেছে আলতা আর চুন দিয়ে, সাজানো কুলোয় চিনি, শরবত, ধান দূর্বা সবটাই আছে ।গ্রাম্যরীতিতে বউ বরণের আয়োজন করেছেন রূপসাসহ বাকিরা সবাই ভীষণ অবাক হলো এই হঠাৎ বিয়েতে নিয়ম নীতির বহর দেখে৷ বউ ঘরে তুলতেই শিফা এসে নতুন বউকে হাতে দুশো টাকা গুঁজে দিলো সাথে দিলো তার এক শাড়ি। বউকে বলে এলো, হঠাৎ বিয়ে তো তাই পুরনো কিছু দিয়েই মুখ দেখলাম। খুব শিগ্রই নতুন কিছু দেব তোমাকে।”

নকশিও জহিরকে দিয়ে শাড়ি আনালো নতুন এক। নতুন বউকে উপহার দিলো মুখ দেখে। এদিকে শিশিরের কারসাজিতে শরতকে গ্রুপ কলে যুক্ত করে শিউলি কেঁদে কেটে শেষ তার ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেছে আর সে জানলোই না। আলতাও অভিযোগের ঝুলি খুলল সে পার্লারে সাজবে ভেবেছিল শরত ভাইয়ের বিয়েতে। শিশির কিছু বলবে ভেবেছিল কিন্তু আলতার অভিযোগ শুনে সে কথারই জবাব দিলো, “ভাইয়েরটা থাক আলতা তুই তোর নিজের বিয়েতেই সং সাজিস।”

চলবে