শিশিরে ভেজা আলতা পর্ব-৩৭

0
355

#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা

৩৭.(প্রথম অংশ)

রোজ সকালে দোকানে যাওয়ার সময় জানালায় কিংবা টিনের গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকা, রাতে ঘরে ফিরতেই বিছানা পরিপাটি, টেবিলে পানি ভর্তি জগ- গ্লাস, প্রতি দু, তিন অন্তর অন্তর ঝকঝকে পরিষ্কার কাপড়চোপড় আর প্রতি সপ্তাহে একটা করে নতুন নতুন বিস্বাদ খাবার সবটাই যে শ্যামরঙা মেয়েটার কম্ম তা কি শরতের অজানা! একদমই না; সে জানে ওই হাঁটুর বয়সী রূপকন্যাও তারই মত তার প্রতি আসক্ত হচ্ছে অথবা হয়েই গেছে৷ কিন্তু তার ভেতরের ভয়-ভীতিটা যে আজও তাদের এক হতে বাধ সাধছে। বয়সটা তো এখনও পঁচিশ -ছাব্বিশে রয়ে যায়নি৷ সমবয়সীদের সকলেরই ছেলে মেয়ে এখন প্রাইমারিতে ভর্তি হয়ে গেছে এইতো কালই দেখা হলো ও পাড়ার সাইফুলের সাথে। শরতের সাথেই পড়াশোনা করেছিল৷ সাইফুলের মেয়ে নাকি ক্লাস ফোরে পড়ছে আর এদিকে শরতের আজ অবধি ফুলশয্যাই হলো না৷ পুরুষ মানুষ বিয়ের আগে যতটা ধৈর্য্য দেখাতে পারে বিয়ের পর বউ থাকতেও কি ততোটা আদৌও সম্ভব! শরত নিজেকে নিয়েই উপলব্ধি করছে তা অসম্ভব৷ কিন্তু উপায়ও তো কিছু পাচ্ছে না। কাল রাতে আলতার খুনসুটি হোক বা বাঁদরামো যাই বলুক না কেন তাতে একটু সুযোগ পেয়েছিল শরত নিজেরই বউটিকে একটু আদর করার। আজ তাই মন বড় বেহায়া হয়ে আরেকটু কাছে চাইছে রূপকে৷ কাল রাতে শরত যখন খাবার খেয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো তখন মনে পড়লো সে মোবাইলটা আম্মার ঘরে রেখে এসেছে। দরজা তার ভেজানোই আছে তাই চেঁচিয়ে মাকে ডাকলো, “আম্মা আমার মোবাইলটা একটু পাঠান তো।”

আম্মার ঘরে আলতা, রূপসা দুজনই আছে তাই সে বলেছিল।৷ মোবাইলখানা দিতে আলতা আসেনি রূপসাকে দিয়ে জোর করেই পাঠিয়েছিল এ ঘরে৷ রূপসা ঘরে ঢুকে ফোনটা শরতের হাতে দেওয়ার আগেই আওয়াজ পেল দরজা লাগানোর৷ বাইরে থেকে কেউ দোর বন্ধ করে দিল! আঁতকে ওঠে রূপসা তবে শরত বুঝতে পারলো কাজটা আলতা করেছে। খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে শরত। সামনেই দাঁড়ানো তার ভীত, সন্ত্রস্ত, কিশোরী বউটি কেমন সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। হাসি পেল খুব করে, তার মন বলল একটানে বুকের ওপর ফেলে দেই কিন্তু মস্তিষ্ক বিবেকবুদ্ধি নিয়ে চলে। তাই আলতো করে রূপসার হাত টেনে বসিয়ে দিল খাটের ওপর। ছটফট করতে লাগলো মেয়েটি তবুও শরত ছাড়লো না হাত।

“তাকাও তো আমার দিকে।”

রূপসা তাকায় না৷ শরত আবারও বলে, তাকাতে বলেছি না!
ভয় হয় এবার তাই চোখ তুলে তাকায়। এই বুঝি প্রথম হলো শুভদৃষ্টি তাদের৷ দু চোখ মেলে কাছ থেকে একে অপরকে দেখার এটাই ছিল প্রথম ক্ষণ শরত রূপসার। এরপর শরত কথা বলল রূপসা শুনে গেল।

“আমাকে দেখলে পালাও কেন এমন? বিয়ে হয়েছে একসাথে থাকতে হবে, সংসার, সন্তান সবই তো করতে হবে এভাবে পালাই পালাই করলে কি করে চলবে!” এইটুকু বলেই শরত হাত তুলে রূপসার ঘাড়ে রাখতে যাচ্ছিল। বোকা মেয়ে ভয়ে আচমকা বসা থেকে দৌড় লাগালো কিন্তু তা দরজা অবধিই৷ শরতের ভীষণ হাসি পেলো নিঃশব্দে হাসা ছেলেটা তখন উচ্চশব্দে হেসে আলতাকে ডাকলো, “আলতা দরজা খুলে দে।”

“পাজি লোক এখনই আমার অন্তরটা বাইর হইয়া যাইত” বিড়বিড় করতে লাগলো রূপসা ততক্ষণে শরত তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আলতা দরজা খুলছে না দেখে রূপসা হাত তুলল দরজা ধাক্কাতে। শরত আর তা করতে দিলো না উল্টো হাতে রূপসাকে টেনে দরজার সাথে দাঁড় করিয়ে কপালে চুমু খেয়ে নিল।ঠোঁটজোড়া স্পর্শ করার অভিপ্রায় নিয়ে মাথাও কিছুটা নামিয়েছিল তখনি আওয়াজ পেল দরজার কড়া খুলেছে বাইরে থেকে। শরত সরে গেল রূপসার সামনে থেকে আর মেয়েটা তখনও জমে থাকা বরফের মত শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কালকের এই দৃশ্যটা মনে পড়তেই মনটা বড় আঁকুপাঁকু করছে তার আজও।তারপরই মনে পড়ল আজ তো একটু পরই আলতা রওনা দেবে ঢাকার পথে তখন রূপসাকে দেখা তার জন্য আরও মুশকিল। আলতাটা ছিল এতদিন তাই সকাল বিকাল নিয়ম করে ঘুরতে যাওয়ার বাহানা করে রূপসাকে দেখতে পারত।

রাত বাজে নয়টা ; বাড়ির গেইটে অটো দাঁড়িয়ে আছে। আহসানুল্লাহ্ তৈরি সে ব্যাগ নিয়ে অটোতে বসেছে কিন্তু আলতাই এখনো বের হচ্ছে না। মা, মামীরা বিদায় না দিয়ে মেয়েটাকে ধরে সাবধান, সতর্ক করতে গিয়েই দেরি করে দিচ্ছে। আহসান এবার তাড়া দিলো, “তোমরা কি এবার ছাড়বে ওকে রাত বাড়ছে না!”
আহসানের তাড়া পেয়ে আলতা বের হয়ে এলো। তার পাশেই নকশি, শিফা, জয়তুন আর পেছনে রূপসা দাঁড়িয়ে আছে। আলতা সবার কাছে বিদায় নিয়ে অটোতে উঠে বসল।
আওলাদ দাঁড়িয়ে আছে মুখটা তার একটুখানি হয়ে আছে। একদিন যে সন্তানের কথা তার জানাই ছিল না এখন সেই সন্তানের জন্য তার মন পোড়ে খুব। এবারও এডমিশন পরীক্ষা দিয়ে আলতা গ্রামে আসতেই আওলাদ নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিল৷ তার বউটা বড় পাজি মেয়েটা দুটো দিন ছিল দু দিনই রান্নাবান্না করেছে যাচ্ছে তাই। কত করে বোঝালো মেয়েটা আমার বেশিদিন থাকব না একটি খাতির করে দে। মহিলা শুনলো না. তার এক কথা, “সতীনের মাইয়ার অত খাতির করতে পারুম না৷ মাস শেষে কাড়ি কাড়ি ট্যাকা দেন হেইডাই বহুত।”

আলতা অবশ্য এ নিয়ে মাথা ঘামায়নি। সে বুঝতে শিখেছে সমাজ, পরিবার আর আপনজনের মধ্যে ব্যালেন্স রাখাটা। সে বাবার চোখের সামনে হাসিখুশি থেকেছে দুটোদিন। তাতে কি! আওলাদ ঠিক বুঝতে পেরেছে মেয়ে ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছে তাই আর জোর করেনি বেশিদিন থাকতে। আলতা চলে এসেছে আহসানের কাছেই। বলতে নেই, মা’ও কখনো কখনো একের অধিক সন্তানের মাঝে সমতা রাখতে হিমশিম খায় তা যেন আহসানের খুব করে জানা। তাই আলতার যখন হোস্টেল ছাড়ার কথা হলো সেদিনই হঠাৎ সে গিয়ে হাজির হলো জহিরের বাড়িতে। নকশি বাচ্চাকে গোসল করিয়ে খাওয়ানোতে ব্যস্ত আহসানকে বসতে বলল। আহসান পুরো একটা ঘন্টা বসেছিল সেখানে তার পুরোটা সময় নকশি আর জহিরকে দেখেছে। এবং তার ঠিক তখনই মনে হয়েছিল তার উপলব্ধি সঠিক। একটা মা একের অধিক সন্তানদের মাঝে সবসময় সমতা রাখতে পারেন না তার পেছনে অবশ্য যথেষ্ট কারণ থাকে৷ আর এই বয়সে ঠিক জীবনের সতেরো- আঠারো বছর পেরিয়ে এখন এসে তার একার জন্য থাকা কোলটাতে ভাগ দেখে একটু একটু করে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। হতো না যদি বাবা আর মায়ের ঘর একটা দেখতো। যদি তার বাবা-মা আর ভাইটা মিলে একটা পরিবার হতো তবে আলতার কাছে সবটা স্বাভাবিক মনে হতো কিন্তু এখন! বাবাহীন একমাত্র মায়ের উদরের একমাত্র সন্তান হয়ে কেটেছে তার শৈশব, কৈশোরের শুরু। এখন মায়ের জীবনে জহির আর তার সন্তান আলতাকে অসহায় করে দেবে তাই আহসান নিজ মনে যে সিদ্ধান্ত নিয়ে নকশির কাছে এসেছিল তাই অকপটে উপস্থাপন করেছিল। সে জানিয়েছিল, আলতা বাড়ি এলে তাদের বাড়িতেই থাকবে। আওলাদ কিংবা নকশির ভাগাভাগি করে নিজেদের কাছে যেন রাখার আবদার না করে। নকশি প্রথমে অবাক হয়ে জোর করে বলেছিল কেন থাকবে না! মা ছাড়া সে কার কাছে থাকবে? আহসান বোঝাতে ভুল করেনি বরং স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছে আলতা হতে পারে এ বাড়ি থাকতে স্বচ্ছন্দ বোধ করবে না আবার আওলাদের বাড়িতেও না কিন্তু তার জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা মাস্টার বাড়িতে সেখানে থাকতে তার কিছুতেই সংকোচ হবে না। বরং এখানে জহির আর আওলাদের বাড়িতে তার স্ত্রী দু দিকেই সে একটু হলেও অস্বস্তি নিয়ে থাকবে। তারচেয়ে ভালো আহসান নিজের কাছে রাখবে। একটি মাত্র ভাগ্নিকে সে নিজের কাছে রাখতে একটুও সমস্যায় পড়বে না বরং শিফা আর ভাবীও বেশ আহ্লাদে রাখবে। আহসানের টসব কথা শুনে নকশির মুখ ভার হয়েছিল প্রথম প্রথম অথচ আলতা আসার পর সে নিজেই ঠিকঠাক সময় দিতে পারছিল না। বাচ্চার দেখাশোনা, সংসারের কাজকর্ম, জহিরের প্রয়োজন সব মিলিয়ে আলতার প্রতি নজর দিতে একটু তো ফাঁক রয়েই যাচ্ছিল। আলতাও ছোট্ট ভাইটিকে পেয়ে খুব খুশি হয়েছিল কিন্তু মায়ের সাথে যে সুক্ষ্ম দূরত্ব সেটাও তাকে আঘাত করছিলো। এরপর সে ইচ্ছে করেই দু রাত মায়ের সাথে থেকে চলে গেল মামীদের কাছে। শিফা তাকে শিশিরের ঘরে থাকতে দিয়েছিল। একা বলে জয়তুন আবার নিজের কাছে রেখে দিল। মাস দেড়েকের বেশি সময় আলতা গ্রামে কাটিয়ে গেছে পুরোটাই ছিল শিশিরদের বাড়িতে। এই এতগুলো দিন সে গ্রামে থেকে সে উপলব্ধি করলো তার মামা বদলায়নি, মামীরা একই আছে, শরত ভাই, পাড়ার লোক এমনকি শিশিরদের ঘরের পিছের শিউলি ফুলের গাছটাও ঠিক আগের মতোই আছে৷ শুধু বদলে গেছে একটি মানুষ। ‘মা’ তার জীবনে এই একটি শব্দই ছিল সবচেয়ে আপন, একমাত্র আশ্রয়স্থল কিন্তু এবার গ্রামে এসে তার মনে হলো সব একই আছে শুধু তার আশ্রয়স্থলটা বদলে গেছে। বাবাকে নিয়ে তার জীবনে আহ্লাদ নেই তবে মায়া আছে। বাবা তার জন্য আগে কিছু করতে পারেনি কিন্তু এখন দ্বায়িত্বের সবটা উসুল করতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু মা! সে চায় তার মা তার জন্য জীবনে যতোটা ত্যাগ করেছে তার দ্বিগুণ পেয়ে যাক৷ কিন্তু তার সাথে যে দূরত্ব তৈরি হবে এমন পাওয়া মায়ের না হোক। মা ছাড়া যে দুনিয়াটাই অন্ধকার তার। আলতার গন্তব্য এবার সাভারে আর তার থাকার জন্য যে জায়গা তা পাওয়া গেছে তাওহীদের মাধ্যমে। কথা ছিল শরত আসবে এবার আলতার সাথে। দূরে থেকেও আলতার ভবিষ্যতটাকে আলোয় ভরে দিতে পরিশ্রমের ত্রুটি নেই শিশিরের। ভালোবাসার মানুষটির সকল প্রয়োজন, চাওয়া- পাওয়া যেন দূর থেকেই সে পূরণ করতে প্রস্তুত। আলতা চান্স পেয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জুওলজিতে। এদিকে তার তিনটে টিউশনি নতুন জোগাড় হয়েছে সাভারেই। আব্বার কাছ থেকে টাকা নিতে এখন তার বিবেকে বাঁধে খুব। তারওপর এখন খরচ দ্বিগুণ বেড়েছে হয়ত আব্বা আর আম্মা দুজনের পক্ষে খরচটা সাধ্যের বাইরেও হতে পারে তাই নিজের জন্য তাকে ভাবতেই হবে। আগেও টিউশন করেছে কিন্তু তখন তো তার টাকাগুলো সব জমা করতো শিশিরের খুলে দেওয়া ব্যাংক একাউন্টে৷ এ বছর থেকে হয়ত আর জমা হবে না কিছুই তবুও চলতে পারলেই হলো। আহসান প্রথম দিনই আলতাকে তার নতুন বাসায় রেখে প্রথমেই তার রুমমেট এবং বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলেছে৷ কথা বলেছে শিশিরের কথানুযায়ী তাওহীদের সাথেও কিন্তু ব্যস্ততার জন্য তাওহীদ দেখা করেনি৷ সাবলেট বাসা নেওয়ার বুদ্ধি তাওহীদেরই ছিল আলতা টিউশনি করে বলে৷ হলে উঠলে নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে তাকে রুমে ফিরতে হবে। শিশিরের সাথে কথা বলে তাওহীদ দুই রুমের ফ্ল্যাট ব্যবস্থা করে দিল। আলতার সাথে আরও তিনজন যুক্ত হলো তার মাঝে আলতা খুশি হলো টুম্পাকে পেয়ে৷ দুজনের একই সাথে একই ভার্সিটিতে চান্স পাওয়া সৌভাগ্যই বটে! প্রতি রুমে দুজন থাকবে তাই আলতা টুম্পাকে আর টুম্পাও আলতাকেই পছন্দ করে নিলো। আহসান পুরো এলাকাটা ঘুরে ঘুরে দেখে গেল। ইউনিভার্সিটিতেও গেল সেই সাথে ডিপার্টমেন্ট হেড-এর সাথে সুযোগ পেয়ে আলাপ করে এলো। আলতা সারাটাদিন মামাকে দেখলো আর অবাক হলো৷ একসময় সে প্রশ্ন করে বসলো, “এতকিছু কি করে চেনেন মামা?”

“এত কই চিনলাম শুধু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশটাই যা চেনা এখানকার ভিপি, প্রফেসরস আর বিভিন্ন পদের কর্মচারীদের তো চিনিইনা।”

“আশপাশটাই কি করে চেনা? আপনি না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন? ”

“হু, কিন্তু সারাক্ষণ তো আর সেখানেই থাকতাম না। বন্ধু বান্ধবরা মিলে এখানে কত এসেছি৷ আর কত স্মৃতি জমা আছে এই এলাকায়ও।” আলতার প্রশ্নে পুরনো স্মৃতিরোমন্থনে মন চঞ্চল হয়ে উঠেছিল আহসানের৷ সন্ধ্যার পর আলতাকে তার রুমে পাঠিয়ে আহসান নিজেও রওনা দিয়েছে।

চলবে

#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা

৩৭.(শেষাংশ)

“তোর এখানে টিউশনি করতে সমস্যা হয় না?”

“একটু একটু হচ্ছে কিন্তু আগামী মাস থেকে তো কোচিং সেন্টার জয়েন করব আর হবে না।” হাসিমুখে জবাব দিল আলতা৷ শিশির ক্যামেরার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷ গোলাপি গালগুলো কেমন ফ্যাকাশে লাগছে, চোখের নিচে রাতজাগা আর পরিশ্রমের চিহ্ন৷ রাতজাগাটা অবশ্য তার জন্যই বেশি হয়। সাভারে এসে আলতার টিউশনির ঝামেলা কমে যাওয়ার কথা ছিল অথচ এখন সেটা বেড়ে গেছে দুই স্টুডেন্টের জন্য৷ প্রত্যেকেরই বিকেল থেকে রাত আটটার মধ্যে সময় দেওয়া ছিল। হুট করেই একজনের স্কুল কোচিং বিকেলে পড়ে গেল। তার জন্য সময় বদলে সকালে করে নিতে হলো আরেকজন সন্ধ্যা সাতটায় পড়তো এখন পরবে আটটা থেকে। মানে আলতার বাড়ি ফিরতে সাড়ে নয়টা পেরিয়ে যায়। তারপর আবার রান্না-খাওয়ার ঝামেলাটা এখন নিজের ওপর। হলে উঠতে পারলে এ নিয়ে চিন্তা ছিল না কিন্তু সেখানে অন্যান্য অসুবিধা তো আছে।

“আমার এ বছরের টার্ম শেষ হতে আর মাত্র পনেরো দিন দোয়া করিস যেন পরিশ্রমের সুফল পাই।”

“ইনশাআল্লাহ্” বলেই আলতা আবার বলল, “তুমি আর এক বছর পরই দেশে ফিরবে তাইনা!”

” তুই কি চাস?”
শিশিরের প্রশ্ন শুনে আলতা ভ্রু জোড়া উঁচিয়ে তাকায়।

“আমি যা চাই তা দিয়ে কি হবে? তোমার তো দু বছর থাকার কথা।”

“তুই বললে দু দিনেই চলে আসব।” মুচকি হাসছে শিশির তা দেখে আলতার ক্লান্তি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

“পড়া শেষ করেই এসো তবে অপেক্ষা তো করছিই।”

-তোর অপেক্ষা যে বড্ড লম্বা হতে চলছে রে আলতা। মনে মনে এ কথাই বলছে শিশির। তার পক্ষে পড়া শেষ করেই দেশে ফেরা সম্ভব নয়। কয়েক মাস যাবৎ একটা কফি শপে কাজ করেছে , এখন একটা ফাইভস্টার হোটেলে জব পেয়েছে। একটু একটু করে টাকা জমিয়ে গত মাসেই শিশির ল্যাপটপ কিনেছে। অস্ট্রেলিয়ান এক ফ্রেন্ড এর মাধ্যমে সে বিভিন্ন অনলাইন কাজও করছে। এ দেশে তার পড়ার স্বপ্ন পূরণ করতে মা-বাবার যে সম্পদগুলো এক নিমেষে শেষ হয়েছে তা একটু একটু করে আবার গড়ে তবেই না ফিরবে সে। তার ওপর তার প্রিয়সখীর জন্যও তো কত কি নিতে হবে, কাছের-আপন মানুষগুলোর জন্যও কি না নিয়ে পারবে! এসব তো ছাত্র শিশির নিতে পারবে না৷ অবশ্যই তাকে সুযোগ বুঝে নিজেকে এখান থেকেই প্রতিষ্ঠিত করার পথ সুগম করে যেতে হবে। আলতার সাথে রোজ রোজ কথা হয় শিশিরের তাদের মধ্যকার সম্পর্ক এখন একদমই স্বাভাবিক প্রেমিক-প্রেমিকার মত। কোথাও কোন কমতি নেই দুজনের যত্ন-ভালোবাসায় আর সেই ভরসাতেই যেন শিশির নিজের মত কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে৷ সম্পূর্ণ ফোকাস পড়ায় রেখেও সে এদিক ওদিকের সময়গুলো কাজের ক্ষেত্রে ব্যয় করছে৷ এতে করে আলতার সাথে তার কথা বলার সময়টা হয়েছে মধ্যরাতের পর যার দরুন আলতার চোখে মুখে ক্লান্তি।

নকশির দিনগুলো কাটছে ছোট্ট ছেলের পেছনে ব্যস্ততায়। আগে প্রায় রোজই জহিরের বাড়ি না থাকার সময়টুকু সে চলে যেত ভাবীদের কাছে কিন্তু এখন আর সেই ফুরসৎ নেই। ছেলেটা হাঁটতে শিখেছে টুকুর টুকুর করে সারাদিনই বাড়িতে হেঁটে বেড়ায় কখনো কখনো শরত এলে চলে যায় তার সাথে। ছোট্ট বাচ্চাটার খাওয়া-পরা তার আদর যত্নের সময়টুকুতেই নকশি হুট করেই মন খারাপ হয়ে যায়। মনে পড়ে আলতার ছেলেবেলা কতোটা কষ্ট পেয়েছে তার ওইটুকুনি মেয়েটা! দুধের বাচ্চাটাকে রেখে দিনভর স্কুল, টিউশন আর নিজের পড়ায় সে মেয়েটাকে ঠিকঠাক বুকের দুধটুকুও দিতে পারতো না। পরিস্থিতি তাকে মাতৃত্বের সকল স্বাদ আস্বাদনের সুযোগ দেয়নি৷ এখন ছেলেটার যত্নআত্তি করতে গেলেই তার অশ্রুজলে গাল ভিজে ওঠে প্রতিবার। কি দূর্ভাগাই না তার আলতাটা আর তাই দিনরাত সে ওপরওয়ালার কাছে মেয়েটার সুখ কামনা করে। মেয়েটা তার আজও কি দুঃখ পাচ্ছে না! এবারও যখন এডমিশন পরীক্ষার পর এলো মেয়েটা তখনও কি পেল মাকে নিজের করে? সে তো একটুও সময় দিতে পারেনি। পাখির পালকের মত কোমল মেয়েটার জীবন কত যে শক্ত হয়ে উঠেছে মা হয়ে সে কি টের পায়নি! পেয়েছে অবশ্যই পেয়েছে নকশি তবুও ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেছে। একবার যখন শক্ত হয়েই গেছে তবে আরও হোক৷ নিজেকে গড়ে তুলুক নিজের মত করে। তৈরি হোক তার নিজের একটা অবস্থান যেখানে কোন বিপদ, কোন অসহায়ত্ব আলতাকে দ্বিখণ্ডিত করবে না যেমনটা তাকে করেছিল আওলাদের পরিবার। নিজের জীবন থেকে পাওয়া শিক্ষাই তাকে কঠিন করে দিয়েছে কিন্তু তার এখন ভাবনার দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে জহিরের কথাগুলো। কাল রাতে খেতে বসে জহির প্রশ্ন করেছিল, “আলতার বিয়েশাদি নিয়ে কি ভাবলা নকশি?”

“এখনই কিসের বিয়েশাদি! ও তো মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো। কম করে হলেও চার, সাড়ে চার বছর অনার্সেই লেগে যাবে তার পরে না এসব ভাবব।”

” আমাকে ভুল বুইঝো না নকশি আমিও জানি তুমি কি চাও। আমিও ওকে আমার মেয়ে ভাবি তাই আমারও চাওয়া মেয়েটা খুব বড় হোক কিন্তু…” একটু থামে জহির৷ কিছুটা সময় নিয়ে জানায় এমপি সাহেব কাল আবার তার সাথে দেখা করে আলতার জন্য বিয়ের প্রস্তাব রেখেছেন নিজের ছেলের জন্য।”

নকশি হা হয়ে তাকায় জহিরের দিকে৷ আলতার রূপ যে তাদের আশপাশের কয়েক গ্রামেই চর্চার বিষয় এ কথা জানতে বাকি নেই কারোই। নিজেদের এলাকার এমপি এ নিয়ে কিছুদিন খুব জ্বালিয়েছেও তাদের ভাগ্য ভালো তারা আলতাকে খুঁজে পায়নি। নকশির কলিজায় ভয়ডর অনেক মেয়ের রূপ নিয়ে কিন্তু অনেক দিন হয় পিছিয়েছে এমপি সাহেব নিজে থেকেই আবার কি এমন হলো! জহির বুঝতে পারে নকশির ভাবনা তাই সে জানায় এমপির ছেলেটা বড্ড গোঁয়ার। তাকে নাকি আরও হাজারটা সুন্দর মেয়ে দেখানো হয়েছে কিন্তু ছেলেটার এক কথা সে বিয়ে আলতাকেই করবে৷ আর বোঝোই তো এমপির ছেলে তেমনভাবে তো থামানোও সম্ভব নয়! সেই থেকে নকশি ভয়ে অস্থির মেয়েটা একা থাকে দূরে৷ সে আজ আলতাকে ফোন করে বলবে যেন একা না বের হয় রুম থেকে অতি শিগ্রই সে কোন একটা ব্যবস্থা করে তবেই আলতাকে পাঠাবে শহরে। এদিকে তার মনে হয় শিশির আর আলতার মাঝে কিছু একটা চলছে। এমপির ছেলের চরিত্র ভাল না তার ওপর আবার অর্থবিত্তের কুমির এমপি মহোদয়। অত উঁচুনিচু কোন সম্পর্কে সে মেয়ে দেবে না৷ মেয়ের সুন্দর একটা ভবিষ্যতের জন্য একজন সৎ মনের মানুষ চাই অত চাকচিক্য, অর্থবিত্ত দিয়ে কি করবে!

রূপসা মুখ বাঁকিয়ে বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে এক ধ্যানে। শরত সেই কখন থেকে তাকে একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছে সেদিকে কান নেই তার। কলেজে ভর্তি হওয়ার কোন ইচ্ছেই তো তার ছিল না লোকটা কেন জোর করে ভর্তি করল! আলতা চলে যাওয়ার পরপরই শরত রূপসার পেছনে লেগেছে যে করেই হোক অন্তত কলেজ পাশ করা চাই। এমনিতেও বউ সে এখন কাছে পাবে না তবে আর বসিয়ে রেখে লাভ কি। পড়াশোনা করেই না হয় আরেকটু বড় হোক! যেমন ভাবনা তেমন কাজ কলেজের ফার্স্ট টার্ম হয়ে গেছে তবুও চাচার পরিচিতির সুবাদে ধরে বেঁধে বউকে কলেজে ভর্তি করিয়েছে। পড়াশোনার চর্চা তার বহু আগে থেকেই নেই তবুও তার একটিমাত্র বউকে সে কলেজের শিক্ষকদের কাছে দেবে না টিউশন পড়তে৷ তাই নিজেই এখন রাত্রিবেলা বইপত্র নিয়ে একটু পড়াশোনা করে রূপসাকে পড়ায়। কখনো কখনো শিশিরকেও এ নিয়ে জ্বালাচ্ছে সে। বাড়িতে এখন এ নিয়ে কি যে হাসাহাসি কারবার! শিউলি তো এবার বেড়াতে এসে বলেই ফেলল, “ভাই একদম বউপাগল হয়ে গেছে আম্মা। তোমার আর নাতিপুতি করে কাঁদতে হবে না দেইখো।”

শিফাও মাঝেমধ্যে মশকরা করতে ছাড়ে না। কোন কিছু প্রয়োজনে শরত মাকে ডাকলে শিফা বলে ফেলে, “আব্বাজান এখন আর আম্মা আম্মা না করে আমাদের আম্মাজানরে ডেকে নেন।”

এতে করে রূপসাও লজ্জা পায় খুব। চাচী শ্বাশুড়িও মজা করতে ছাড়ে কি যে লজ্জা লাগে! এসবে তার সময় খুব ভালোই কাটে কষ্ট তো শুধু সন্ধ্যের পরের সময়টা। লোকটা দোকানপাট বন্ধ করে বউ নিয়ে বই খুলে বসে। গম্ভীর সেই শান্ত, রাগী বরটা তার পাজি আর জোকার টাইপ হয়ে গেল কেমন করে ভেবে ভেবে কপাল চাপড়ায় রূপসা।

লন্ডনের আকাশ তখনো ঝকঝকে রোদে ঝলমল। সোহা হাতের ঘড়িটাতে সময় দেখে ওভারকোটের পকেটে দু হাত ঢুকিয়ে নিলো। শীতের সিজন এখনো শুরু হয়নি তবুও বাতাস হিম শীতল। জিন্স, ট্যাংক টপের ওপর কোটটা চড়িয়ে সে একটু আগেই ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এসেছে। জাহাঙ্গীর কালই নরওয়ে পৌঁছেছে অথচ আজ সারাদিনেও একটিবার কল করেনি। চিন্তা করবে না করবে না করেও এখন চিন্তা হচ্ছে আপনা থেকেই। মাস দুই হলো সে লন্ডনে এসেছে জাহাঙ্গীর এর জোরাজুরিতে৷ লোকটা সুন্দরী বউকে ছাড়া নাকি থাকতে পারবে না অথচ এই দু মাসে সোহা প্রায়ই একাই থাকছে এখানে। চমৎকার এক সুযোগ পেয়ে জাহাঙ্গীর সিঙ্গাপুর থেকে লন্ডনের এক হাসপাতালে এসেছিল। এখানে সুযোগ পেতেই বউকে নিয়ে এলো৷ অথচ বউয়ের কাছেই তার থাকা হচ্ছে না৷ এদিকে সোহারও এখানকার কাগজপত্র জমা দিতেই কি করে যেন এক মাসেই সব হয়ে গেল। নির্দ্বিধায় সে লন্ডনে ঘুরছে, ফিরছে জাহাঙ্গীর বলেছে গ্রাজুয়েশন এর সুযোগও করে দেবে এখানেই। বিয়ের প্রায় বছর হয়ে এলো তাদের সোহা এখনও শরতকে ভালোবাসে৷ কিন্তু স্বামীকেও তো অবহেলা করতে পারছে না শুধু হেরে গেছে নিজ সত্তার কাছে। আগের মত হাস্যজ্জ্বল সোহা আর সে হতে পারছে না কিছুতেই। জাহাঙ্গীরের সাথে মানসিকভাবে পুরোপুরি এডজাস্ট না হতে পারলেও শারিরীক ব্যাপারে সে স্বাভাবিক। স্বচ্ছন্দ্যে সে উপভোগ করে ব্যক্তিগত মুহুর্তগুলো অথচ শরত নামের মানুষটাকে মন থেকে সরাতেই পারে না। খোলা আকাশের নিচে সরু পথ চলতে চলতে সোহা আবারও শরতের ভাবনায় ডুবে গেল। একলা থাকার সময়গুলো তাকে পদ্মদিঘির সেই গ্রাম, সেই ছেলেটাই বেশি মনে পড়ে। মেলার সেই রাত, শিশিরের চলে আসার দিন সি এনজির সেই মুহূর্তটুকু তাকে ছিন্নভিন্ন করে দেয় পরমুহূর্তেই মনে পড়ে জাহাঙ্গীর ঠোঁট ছুঁয়ে যাওয়া আদর আর তার বুকের সেই মাতাল করা সুবাস। দোটানার জীবন থেকে বেরিয়ে আসার জন্যই সে মনে মনে ভেবে নিয়েছে এবার সে নিজের একটা বাচ্চা চাইবে জাহাঙ্গীরের কাছে। জাহাঙ্গীর নিজে থেকেই তাকে বলেছিল, তোমার পড়াশোনা, ক্যারিয়ার সব ঠিক করে তবেই আমরা বাচ্চাকাচ্চ নিবো সোহা। কিন্তু সোহা জানে তার মন কতোটা বিক্ষিপ্ত। দু নৌকায় যেমন পা রেখে ভাসা যায় না তেমনিই মনের মাঝে দু জন মানুষের ভালোবাসাও বয়ে বেড়ানো যায় না৷ মা তো বলে বাচ্চা হলেই নাকি মন স্থির হবে তার তবে চেষ্টা করেই দেখুক না! শিশির তো বলে তার ভাই এখন ভীষণ খুশি থাকে তার ভাবীকে পেয়ে৷ সোহাও না হয় খুশি থাকবে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে৷

অনুর জীবন এখনো অগোছালো যেমনটা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সময়টাতে। শিশির অবাক হয় এত ব্রিলিয়ান্ট একটা মেয়ে কি করে নিজের জীবনটাকে আঙ্গুলের ডগায় রেখে চলতে পারে! কখনো শিশির, কখনো বিদেশী বয়ফ্রেন্ড এর জন্য তাওহীদের মত মানুষটাকে কষ্ট দিচ্ছে৷ এইতো সেদিন আলতা জানালো তাওহীদ ভাই নিজের জন্য মেয়ে খুঁজছে৷ খুব শিগ্রই হয়ত বিয়েও করে নেবে এতে হতে পারে অনুর পেছনে আর পড়বে না সে৷ কিন্তু অনু কি লোকটাকে হারিয়ে নিজেরই ক্ষতি করছে! শিশিরের মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে জোর করে বলতে, ভুল করছিস অনু তুই ভীষণ বড় ভুল করছিস৷ কিন্তু লাভ কি বলে মেয়েটা কি শুনবে তার কথা? বন্ধুত্বের দোহাই আগে দেওয়া যেত এখন তো সবটাই ঠুনকো সবটাই ফাঁকা৷

চলবে