শিশির ভেজা রোদ্দুর পর্ব-২৭+২৮

0
781

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_27
#Writer_NOVA

—ইফাতরে এএএএএএএএএএ! তোরে আজকে নুন, তেল, মরিচ ছাড়া ভর্তা বানামু।

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই দিলাম বিশাল বড় এক চিৎকার। নেংটি ইদুরটা একটু আগে আমার কপালে চুমু খেয়ে পালিয়েছে। আমার চিৎকারের আগেই নেংটি তার লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে।আমার চিৎকারে খালামণি ছুটে এসে জিজ্ঞেস করলো,

— এই নোভা কি হয়েছে?

— কি হয়নি তাই বলো?

— দেখ তো মেয়ের কাণ্ড আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করলাম ও তার উত্তর না দিয়ে উল্টো আমাকে প্রশ্ন করে।

— ঐ বিচ্ছু আমার রুমে ঢুকলো কি করে?

— কার কথা বলছিস তুই?

— ঐ ইফাত পুঁচকে।

—কেন কি করেছে?

— কি করে বলি তোমায়?

— আমাকে বলতে কি সমস্যা?

— কিছু না যাও। এখন শান্তিতে একটু ঘুমাতেও পারবো না।

— তুই কপাল ডলছিস কেন?

— আমার এই কপালটা যে অনেক ভালো। তাই খুশিতে ডলতেছি। একটু পর থাপড়াইয়া ফাটামু এই ভালো কপালটারে।

— না বাবা এই মেয়ের আবার কি হলো?

কপাল ডলতে ডলতে ওয়াসরুমে চলে গেলাম। ইচ্ছে মতো ফেসওয়াশ দিয়ে ডলে মুখ ধুয়ে বাইরে এলাম। ঐ পুঁচকেটা আজ ঘুমের মধ্যে আমার কপালে চুমু খেয়েছে। কপালে ছোট ঠোঁটের পরশ পেতেই ধড়ফড় করে উঠলাম। দেখি বিচ্ছুটা দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। প্রথমে মাথায় কিছু খেলে নি। যখন পুরো ব্যাপারটা ক্লিয়ার হলো তখন গগনবিদারী এক চিৎকার দিলাম। খালামণিকে কি করে এসব কথা বলি। আমার নিজের কাছেই তো কেমন জানি লাগছে। তাই কথাটা এড়িয়ে গেলাম। আমি ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে শুনতে পেলাম খালামণি তায়াং ভাইয়াকে বলছে,

— এই তায়াং দেখ তো তোর বোনের কি হলো? আমি তো বাবা তোদের হাব-ভাব কিছুই বুঝি না। চিৎকার দিয়ে সারা বাড়ি এক করে ফেললো। আর জিজ্ঞেস করায় বলে কিছু হয়নি। তুই গিয়ে একটু দেখ।

খালামণি জোরে জোরে কথা বলায় আমার রুম থেকেও কথাগুলো শোনা গেলো। আমি তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে, মাথায় হালকা করে চিরুনি চালালাম।তারপর মাথায় ওড়না দিয়ে ঘোমটা টেনে রওনা দিলাম ইফাতদের ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্য। আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বো। দুই বার কোলিং বেল বাজানোর পর সিফাত দরজা খুললো। আমাকে দেখে চোখ দুটো বড় বড় করে মুখে হাত দিয়ে বললো,

— আরে ভাবীজী তুমি?

— এত ঢং করতে হইবো না। সামনের থেকে সর।

— আমারে একটা চিমটি মারো। আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না তুমি এখানে?

— ত্যারি তো…

— এই একদম সামনে আসবা না। আমি কোন দুষ্টুমি করিনি। তোমায় ভালো করে জিজ্ঞেস করছি।

— তোর আম্মু কই রে?

— কিচেনে।

— এই অবস্থায় কিচেনে কি করে?

— রান্না করতাছে

— কাজের বুয়া কই?

— সে আজকে আসবে না। তাই আম্মু রান্না করতাছে।

— তোর দাদী কই? সে থাকতে তোর আম্মু এই অবস্থায় রান্না করে কেন?

— ঐ বুড়ির কথা বইলো না। সেই তো আম্মুরে রান্না করতে বললো।

— তোর বিচ্ছু ভাই কোথায়?

— একটু আগে কই থিকা আইসা দরজা আটকাইয়া বইসা রইছে।

— ওর ব্যবস্থা পরে করতাছি। আগে তোর আম্মুর কাছে যেয়ে নেই। সামনের থেকে কি সরবি? নাকি এমনি দাঁড়ায় থাকবি?

— হুম আসো, আসো। কতদিন পর আমার ভাবীর আগমন ঘটলো আমাদের বাসায়।

— আবার পাকনা পাকনা কথা।

ঠোঁট কামড়ে রাগী ভঙ্গিতে সিফাতের দিকে তেড়ে যেতেই সিফাত ওর দাদার রুমে দৌড় দিলো।আমি দরজা আটকে কিচেনে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি ইফাতের আম্মু ভাতের মাড় ঝড়ানোর জন্য সবেমাত্র পাতিলে হাত দিবে। আমি দৌড়ে গিয়ে চেচিয়ে বললাম,

— আরে আরে আন্টি করছেন কি? পাগল হয়ে গেছেন? এই শরীর নিয়ে আপনি ভাতের মাড় ঝড়াতে যাচ্ছেন। সরেন আমি করতেছি।

— নোভা, আমি পারবো।

— কোন কথা বলেন না তো। গিয়ে ঐ টুলে বসেন।

তার কোন কথা না শুনে তাকে জোর করে টুলে বসিয়ে দিলাম। বিশাল বড় একটা পাতিল। প্রেগন্যান্ট অবস্থায় উনি এটাকে উঠাবেন আমি তো চিন্তা করতে গিয়েই মাথা হ্যাং হয়ে যাচ্ছে। উনার শাশুড়ীটা কিরকম জানি। এই অবস্থায় কেউ কি এসব কাজ করে? তাকে এখন ফুল বেড রেস্টে থাকতে হবে। তা না করে বেচারীকে দিয়ে রান্না করাচ্ছে। আল্লাহ না করুক কোন দূর্ঘটনা যদি ঘটে যায়।আমি ভাতের মাড় ঝড়াতে দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,

— আন্টি কি রান্না করবেন আজ?

— এই তো দুইবেলার রান্না একসাথে করে রাখছি। আলু দিয়ে করলা ভাজি, ডাল, ভাত আর চিংড়ি মাছ ভুনা। রাতের জন্য রুটি বানিয়ে নিবো।

— ইয়াম্মি, খুব মজাদার খাবার।

— তা তুমি কি মনে করে আজ আমাদের বাসায়?

— কেন আসতে পারি না?

— না না আমি তা বলিনি।

— দেখতে এলাম আমার শাশুড়ী আম্মা কেমন আছে? পড়াশোনার চাপে তো একটু আসাও হয় না। তার মধ্যে যে অসুস্থ হয়েছিলাম।

— আর শাশুড়ী আম্মা। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না গো। রাতে বাজে স্বপ্ন দেখি। দোয়া করো আমার জন্য। আমার মনে হয় এবার বোধহয় আমি বাঁচবো না।

কথাগুলো বলতে বলতে উনি আঁচলে মুখ গুঁজে কান্না করতে লাগলেন। আমি সামনে গিয়ে তার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে হাত দুটোকে শক্ত করে ধরে সাহস জুগানোর জন্য বললাম,

— কি বাচ্চা মানুষের মতো কান্না করছেন বলেন তো? আপনার কিচ্ছু হবে না। আল্লাহ আছে তো আপনার সাথে। একদম কান্না করবেন না। তাহলে কিন্তু আমাদের বোনও রাগ করবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।

— তাই যেন হয়।

— ভাজির কড়াই কোথায়?

— কেন কি করবে?

— কোন কথা বলবেন না তো। চুপ করে এখানে বসে থাকেন। বাকি যা রান্না আছে তা আমি করবো।

— আরে না না তোমার কিছু করতে হবে না। আমি করতে পারবো।

— একদম চুপ করে থাকুন। আমি কি আপনাকে জিজ্ঞেস করেছি কে রান্না করবে? এত চিন্তা করার কিছু নেই। আমার রান্না এতটা খারাপ নয় যে মুখে দিতে পারবেন না। বেশ ভালো রান্না করি আমি। শুধু পোলাও,বিরিয়ানি ছাড়া বাকি সবকিছু পারি।

— বাহ্ বউতো কাজের আছে।

— হুম দেখতে হবে। কড়াই ঐ মিটসেফের কোণায়।

কড়াই নিয়ে চুলায় বসিয়ে দিলাম। এক সাইডে ভাজি বসিয়ে দিয়ে আরেক চুলোয় ডাল ঘুঁটনি দিয়ে ডাল ঘুঁটে দিলাম। আন্টি ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তবে তার মুখে ছিলো তৃপ্তির হাসি। ডাল বাগার দিয়ে নামিয়ে নিলাম। আন্টিকে জিজ্ঞেস করে হলুদ,মরিচের পরিমাণ করে চিংড়ি মাছের জন্য মশলা কষাতে লাগলাম। মাঝে মাঝে ভাজি নেড়ে দিচ্ছি। যাতে নিচে পোড়া না লেগে যায়। মশলা কষানো শেষ হতেই মাছগুলো দিয়ে আরেকটু কষিয়ে নিলাম। এক হাতে খুন্তি নাড়তে নাড়তে আন্টিকে বললাম,

— চিংড়ি মাছ ভুনা আমার বেস্টফ্রেন্ড সাদ্দামের অনেক পছন্দ। ওকে যদি বলি আজ চিংড়ি মাছ ভুনা করবো তাহলেই ও বলবে আমার জন্য পাঠিয়ে দিস। ডিম ভাজা, চিংড়ি মাছ ভুনা, মিষ্টি ওর ভিষণ পছন্দ। এগুলো থাকলে আমার মনে হয় না আর কিছু লাগবে।

— ইফাত,সিফাত দুজনেই পছন্দ করে। তুমি পছন্দ করো না?

— পছন্দ করলেও লাভ নেই। আমার এলার্জী। এগুলো খেয়েও শান্তি নেই। চোখ চুলকাতে চুলকাতে সাদা অংশ ফুলে যায়। এই কষ্টে খেতেও ইচ্ছে হয় না।

— তুমি হঠাৎ করে কেন এলে তাতো বললে না?

— ইফাতের নামে বিচার দিতে এসেছিলাম।

— ছেলেটা ভীষণ দুষ্ট হয়ে গেছে। গতকাল রাতে তোমার চাচ্চু মানে ইফাতের আব্বু ইফাতকে অনেক মেরেছে।

— সেকি! কেন?

— পড়াশোনা ঠিকমতো করে না। আর মাথা খেয়ে ফেলছে। তোমাকে বিয়ে করবে বলে। ওর একটাই কথা নোভার সাথে আমাকে বিয়ে না দিলে আমি কোন কিছু করবো না।

— ওরে বাটপার! জল এতদূর গড়িয়েছে!

— ছেলে তো এখন তুমি বলতে পাগল। এখন বলো আমার ছেলেকে কি তাবিজ করেছো?

— ওকে তাবিজ কি করবো আমি? আর মানুষ পান না খুজে? ওর জ্বালায় তো আমি অতিষ্ঠ। ও যা শুরু করছে আন্টি। তা সহ্য করার মতো নয়।

— ছেলে দুটো যে এতো দুষ্ট কি করে হলো আল্লাহ মালুম। আমার শরীর ভালো নেই। ওদের দিকে ভালো করে নজরই দিতে পারি না। সেই সুযোগে আরো বিটকেল হচ্ছে।

— ধূর, টেনশন করেন না তো। এই অবস্থায় অতিরিক্ত টেনশন একদম করবেন না। এতে শরীর খারাপ হবে। রাতে আমি রুটি বানিয়ে দিয়ে যাবো।আপনার কিছু করতে হবে না। তা আপনাদের বাসার বুয়ার কি হয়েছে?

— এই বুয়া যে কি জ্বালাচ্ছে মা। তা আর কি বলবো? ইফাত বড় থাকলে এখন তোমাকেই ঘরের বউ করে নিয়ে আসতাম। তাতে আমিও একটু স্বস্তি পেতাম। আমার ছেলের পাগলামিও কমতো।

তার কথা শুনে আমি মুচকি হাসলাম। মাছের তরকারিতে পরিমাণ মতো গরম পানি ঢেলে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে সেটাকে মাঝারি আঁচে রেখে দিলাম। যেই কাজে এসেছিলাম তা আর হলো না। তবে একজনের মুখে হাসি ফুটাতে পেরেছি তাও বা কম কিসের? তার কাজে সাহায্য করতে পেরে এখন নিজেরি ভালো লাগছে। কোন ভালো কাজ করলে আপনি নিজের মনের মধ্যে অন্য রকম একটা ভালো লাগার অনুভূতি খুঁজে পাবেন। যা অন্য কিছুতে নেই।

💖💖💖

রাতে…..

ইফাতের আম্মুকে রাতের জন্য রুটি বানিয়ে দিয়ে বাসায় ঢুকলাম। সারাদিনে ইফাত ভুলেও আমার সামনে আসেনি। আস্তে করে সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পা টিপে টিপে রুমের দিকে যেতেই কিচেন থেকে ঠুকঠুক শব্দ কানে এলো। খালামণির প্রেসার উঠেছে। তাই সে খাবার, ঔষধ খেয়ে শুয়ে আছে। তন্বী পরীক্ষা দিয়ে আসার পর থেকে মাথাব্যথায় ভুগছে। তাই রুম অন্ধকার করে ঘুমিয়ে গেছে। দুজনের একজনের ওঠার কোন চান্স নেই। তায়াং ভাইয়া বাসায় নেই। আমি দরজা বাইরে দিয়ে আটকে রেখে গিয়েছিলাম। কিন্তু আসার সময় দরজা আবজানো ছিলো। তাহলে কি ফ্ল্যাটে চোর ঢুকলো নাকি? টি-টেবিল থেকে মাটির ফুলদানিটা নিয়ে ধীর পায়ে কিচেনে উঁকি দিলাম। তারপর যা দেখলাম তাতে আমি হাসতে হাসতে শেষ। তায়াং ভাইয়া রুটি বেলছে। সারা শরীর ওর আটায় মাখামাখি। রুটি যে একেকটা কোন দেশি মানচিত্র হচ্ছে তা একমাত্র ও জানে। আমার হাসির শব্দ শুনে তায়াং ভাইয়া একটা রাগী লুক নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

— হাসিস না। তোর থেকে ভালো বানাচ্ছি।

— তাতো দেখতেই পাচ্ছি।

— খুদা লাগছে। ঘরে কোন কিছু নেই। বাইরে থেকে খেয়ে আসতে মন চাইলো না। তাই রুটি বানাতে বসলাম। কিন্তু দেখ এগুলো কি হচ্ছে?

— একেক দেশের মানচিত্র🤭।

— মুখ টিপে হাসা হচ্ছে?

— এখুনি তো তোকে ফুলদানি দিয়ে মাথা ফাটাতাম। আমি ভাবলাম কিচেনে বোধহয় চোর ঢুকেছে।

— খুদা লাগছে কথা বলিস না। রাগ উঠে যাবে।

— ভাইয়া কোন দেশের মানচিত্র আঁকছিস? একটু লিখে দিলে ভালো হতো না।

— মজা নিস না।

— আরে আস্তে ধর রুটি ব্যাথা পাচ্ছে তো।

ভাইয়া চোখ পাকিয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি হো হো করে হাসতে লাগলাম। তাওয়ার ওপর এতো যত্ন সহকারে আলতো হাতে রুটি সেঁকতে দিচ্ছে যে আমার মনে হচ্ছে জোরে ধরলে রুটি ব্যাথা পাবে। আটার ডো পানি দিয়ে একদম লেক লেকে করে ফেলছে। তার মধ্যে ইচ্ছে মতো আটা দিয়ে আবার মতছে। সেটাকে বেলতে গিয়ে এদিক সেদিক দিয়ে ছিঁড়ে একটা বাজে অবস্থা করে ফেলছে। রুটির মান-ইজ্জত কিছু নেই। রুটি যদি কথা বলতে পারতো তাহলে বলতো, “তায়াং আমারে ছাড়। আমি আর তোর কাছে অপমানিত হতে চাই না। আমি তো বাকি রুটিদের কাছে আমার মুখ দেখাতে পারবো না। ” ময়লা সরাতে ফুঁ দিতেই পাশের থেকে শুকনো, ঝরেঝরে আটা এসে ওর মুখে ভরে গেলো। আমি তা দেখে হাসতে হাসতে বসে পরেছি।

— এই সর তো সামনে থেকে। তোকে দেখে আমার রুটি গোল হতে চাচ্ছে না।

— তোর রুটি তো ঘুরেই না গোল হবে কি করে? আর এগুলোকে রুটি বলে রুটির মান-সম্মান খাস না।

— আমি যা পারছি তাই করছি। কারো জন্য বসে তো রইনি।

— সর আমি বানিয়ে দেই।

— একটুও না। যা ভাগ। আমি পারি।

— হুম কোন ঘোড়ার আণ্ডা পারো তাতো দেখতেই পাচ্ছি। এর জন্য বলে কারো উপকার করতে নেই।

— আমিও রুটি বানিয়ে দেখিয়ে দিবো। আমি কোন কাজে কম নয়।

— হুম ঠনঠনাঠন ঘন্টা।

ভাইয়া আরেকবার চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। আমি মিটমিট করে হেসে তা জহুরির চোখ পর্যবেক্ষণ করছি। একটা রুটিও ভালো নেই। প্রত্যেকটা পুড়ে ফেলেছে। একদিকে কাঁচা, আরেকদিকে পোড়া। ডিম পোচ করতে গিয়ে উল্টাতে পারে না। আমি বলেছিলাম উল্টে দেই। কিন্তু সে খুন্তি দেয়নি। পাকনামি করে উল্টাতে গিয়ে ডিম ছুটিয়ে, কুসুম ফাটিয়ে তেরটা বাজিয়ে ফেলছে। তেলর ছিটাও হাতে লাগছে। আমি সামনে এগিয়ে যায়নি। বুঝুক মজা। বেশি পাকনাদের এমনি হওয়া উচিত।অবশেষে আধা ঘণ্টা যুদ্ধ করে তায়াং ভাইয়া সফল হলো।

— যাক বাবা শেষ হলো।

— তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

— দেখছিস আমিও পারি😎।

— হুম দেখলামই তো।

— এখন এসবের সাথে একটা সেলফি হয়ে যাক।

— যেই রান্না তার সাথে আবার সেলফি😏।

— মুখ বাঁকাস না। আমি যে বানিয়েছি সেটাই তো বেশি।

— হ্যাঁ একদম। আমারে উদ্ধার করে ফেলছিস। সাথে রুটি, ডিমের মান-মর্যাদা খেয়েছিস।

ভাইয়া আমার কথায় কান না দিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে সেলফি তুলতে লাগলো। নিশ্চয়ই একটু পর ফেসবুকে ছাড়বে। আমি দৌড়ে ওর পাশে দাঁড়িয়ে বললাম,

— ভাইয়া আমাকেও একটু নে। আমিও তুলি সেলফি।

— যা ভাগ।

— এমন করিস কেন? তোর রুটি, ডিম ভাজা খেতে চেয়েছি। একটা সেলফিই তো তুলতে চেয়েছি। আল্লাহ কেমন করে?

আমি কোন কথা না বলে ভাইয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ও অনেকটা নিচু হয়ে আছে। আমি ওর কাধের ওপর থুতনি রেখে আঙুল দুটোকে V আকৃতি করে মোবাইলের দিকে তাকালাম। দেখি ভাইয়া সেলফি টাইম ঠিক করে, চোখ দুটো ছোট ছোট করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হুট করে তার হাতের দুই আঙুল দিয়ে শক্ত করে আমার মুখ চেপে ধরলো। তখুনি একটা ছবি ক্লিক হয়ে গেলো। ফাজিলটায় আমার পোজটাই নষ্ট করে দিলো।

#চলবে

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_28
#Writer_NOVA

আমি ভালোবাসি তোর পায়ের
রিমঝিম ঐ নুপুর
তুই না হয় ভালোবাসলি আমার
শিশির ভেজা রোদ্দুর

সকাল হতেই চারিপাশে ব্যস্ততায় ঘিরে যায়। আজ আমার মনের আকাশে একরাশ ঘনকালো আধারে ঢেকে গেছে। সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে এক মগ কফি হাতে নিয়ে ছাদে চলে গেলাম।মগের হাতলের সাথে সবুজ কাগজের ছোট চিরকুটটা এক টুকরো সুতলি দিয়ে বাঁধা ছিলো।চোখের পানিগুলো যখন গাল বেয়ে নিচে পরছিলো তখন চোখ যায় সেদিকে।সেটাকে হাতে নিয়ে দেখতে পাই উপরোক্ত কথাগুলো লেখা ছিলো।
একবার পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম পায়ে নুপুর পরা। গতকাল রাতেই পরেছিলাম। কিন্তু সে কি করে জানলো?চিরকুটটা ভাজ করে হাতে রেখে আমি নাক টেনে কফির মগে চুমুক দিলাম। তায়াং ভাইয়া তার বন্ধুদের নিয়ে মিনিট বিশ আগে বের হয়ে গেছে। আমি একটা জিনিস খেয়াল করেছি যদিন তায়াং ভাইয়ার সকল ফ্রেন্ড বাসায় আসে সেদিনই আমার রুমে আগে থাকতে এক মগ কফি মজুদ থাকে। সাথে একটা চিরকুট। এই চিরকুট প্রেমীকে শুধু হাতে নাতে ধরাটাই বাকি। সকালের আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

আজ হঠাৎ করে অতীতগুলো একে একে চোখের সামনে ভেসে উঠছে। যেদিন প্রথম রোশানের সাথে দেখা হয়েছিল। সেদিন ছিলো ঝুম বৃষ্টি।

ফ্লাশব্যাক……

আমি তখন সদ্য কলেজে ওঠা এক প্রাণবন্ত কিশোরী। ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার মানেই হাওয়ায় উড়ন্ত বয়স।কলেজে উঠে গেছি ভাবসাবের তো একটা ব্যাপার আছে। সারাক্ষণ এমন একটা মুড নিয়ে চলতাম না জানি কত বড় ডিগ্রি অর্জন করে ফেলেছি।বেশিরভাগ সময় ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে কফি হাউসে কিংবা ফাস্টফুডে হামলা করতাম।গ্রামের কলেজ হওয়ায় আমাদের ধরা বাঁধা কোন নিয়ম নেই। ইচ্ছে হলে ক্লাশ করো।নয়তো পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে যাও।এতে যেনো আমাদের আরে বেশি সুবিধা হতো।

সেদিন ছিলো ঝুম বৃষ্টি।আমি,সাদ্দাম, শাকিল,
তামিম,জারা,সাফা,ঝুমা সাতজন ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে কফি হাউসে গিয়ে আটকা পরে গেলাম।সে কি বৃষ্টি থামার নামও নেই। শাকিল বিরক্তি সহকারে বললো,

—দেখ তো কি বৃষ্টি নামলো?এবার কলেজে যাবো কি করে?

তার সাথে সুর মেলালো জারা,
— পরের ক্লাশ আজ বাদ।

তামিম ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে টেবিলে এক পা হেলান দিয়ে বসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— ধূর, এতো ক্লাশ ক্লাশ করোস কেন? দুই-একদিন ক্লাশ না করলে কি হয়?

সাদ্দাম তামিমের পিঠে চাপর মেরে বললো,
— তোর মতো ছাত্রর জন্য কিছুই হয় না। কিন্তু আমাদের হয়। এরপরের ক্লাশ হলো ইংরেজি। তুই ইংরেজিতে হেব্বি ভালো। কিন্তু আমরা হলাম পুরো গোবর পঁচা। তাই আমাদের জন্য অনেককিছু। তুই মাম্মা ইংরেজি পরীক্ষায় কোপায় ফালাস। কিন্তু আমাদের পাস নাম্বার উঠাতেও হিমশিম খেতে হয়।

ঝুমা ওদেরকে থামানোর উদ্দেশ্য হাত নাড়িয়ে বললো,
— থাম তোরা। ঝগড়া করিস না। বৃষ্টি নামবে সেটা তো আমরা কেউ জানতাম না। এখন চুপ করে থাক। বৃষ্টি থামলে কলেজ চলে যাবো।

আমি ও সাফা কোন উত্তর দিচ্ছিলাম না। ওরা ওদের মতো কথা বলছিলো। বৃষ্টি মানেই ছিলো তখন অন্য রকম ভালো লাগা। এক ধ্যানে বৃষ্টি দেখছিলাম আর বৃষ্টির পানিতে হাত ভিজাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম এক হাত মাথায় দিয়ে আরেক হাতে কফির মগ নিয়ে একটা ছেলে আমাদের পাশে দাঁড়ালো। সে দাঁড়িয়ে মাথা,শার্ট ঝাড়তে লাগলো। আমি মাথা বাঁকিয়ে তাকে দেখার জন্য পেছনে ঘুরতে নিলেই অসাবধানতা বশত আমার হাত লেগে তার কফি পরে যায়। কফি পরবি ভালো কথা কিন্তু ছেলেটার শার্টে পরার কি দরকার ছিলো। বেচারার সাদা শার্ট কফি পরে পুরো নষ্ট। আমি মুখে হাত দিয়ে ভয়ার্ত মুখে তার দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বললাম,

— সরি, আমি আসলে ইচ্ছে করে করিনি। দূর্ভাগ্যবশত হয়ে গেছে। প্লিজ মাফ করে দিবেন।

উনি একবার রাগী লুকে তাকিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে কফি মুছতে লাগলো। তামিম গিয়ে তাকে বললো,
— ভাই প্লিজ কিছু মনে করবেন না। এই মেয়ে হলো এক নাম্বার নিষ্কর্মা। যেখানে যাবে ভেজাল লাগাবেই। ওর পক্ষ থেকে আমরা মাফ চাইছি।

উনি গম্ভীর মুখে বললো,
— ঠিক আছে। পরেরবার থেকে সাবধানে থাকতে বলবেন। চোখ দুটো শুধু সামনের দিকে নয় আশেপাশেও রাখতে বলেন।

জারা পাকনামি করে বললো,
— ও একটু এরকমি। আপনি কিছু মনে করেন না ভাইয়া। আপনার জন্য খারাপ লাগছে যে আপনার সাদা শার্টটা নষ্ট হয়ে গেলো। এর জন্য আমারা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।

জারার কথায় কেন জানি রাগ উঠে গেলো। মাঝে মাঝে ও একটু বেশি বুঝে। এখন এসব কথা বলার মানে কি? কপাল কুঁচকে অন্য দিকে দৃষ্টি দিলাম। মিনিট দশ পর বৃষ্টির বেগ কমলো। আমরা অতি দ্রুত সেখানে থেকে চলে এলাম। না ছেলেটার জন্য নয়। জারার জন্য। যতক্ষণ সেখানে ছিলো সেধে সেধে ছেলেটার সাথে কথা বলতে গিয়েছিল। ছেলেটাও সেরকম ওর সাথে কথা বলছিলো। মাঝে মাঝে আড় চোখে ওদের দিকে তাকাতে দেখি ছেলেটা আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। জারার এই কান্ডে আমরা সবাই বিরক্ত। তাই বৃষ্টি পুরোপুরি না থামতেই সেখান থেকে কেটে পরেছি। ভেবেছিলাম এই ঘটনা এখানেই শেষ। কিন্তু না এখান থেকে শুরু হয়।

এই ঘটনার দুই দিন পর থেকে খেয়াল করি ছেলেটা ইদানীং আমাকে ফলো করছে। প্রথমে বিষয়টা পাত্তা না দিলেও পরে আমি সিউর হয়ে যায়। জারার থেকে জানতে পারি তার নাম রোশান দেওয়ান। চেয়ারম্যানের মেজো ছেলে। চেয়ারম্যান ও জারার বাবা আবার খুব ভালো বন্ধু। দেওয়ান বাড়ির মানুষ এভাবেই আমাদের গ্রামের কেউ পছন্দ করতো না। এর ক্ষমতার দাপটে অন্যায় করেও পার পেয়ে যেতো। রোশানকে যে আমার ভালো লাগতো না তা কিন্তু নয়। আমি নিজেও এর জন্য অনেকটা দূর্বল ছিলাম। কারণ ও দেওয়ান বাড়ির অন্য ছেলেদের মতো ছিলো না। দিনকে দিন রোশানের ফলো করা বেড়ে গেলো। ওর বন্ধুমহলের কাছে ভাবী ডাকে পরিচিত পেলাম। সপ্তাহ দুই ঘুরতে না ঘুরতেই রোশান একদিন আমায় কলেজের পেছনের পুকুর পাড়ে ফিল্মি স্টাইলে হাঁটু গেড়ে প্রপোজ করলো। আমি ভয়ে একসেপ্ট করিনি।ভয় পাওয়ার কারণ আছে। কলেজে নতুন আসার পর আব্বু সাবধান করে দিয়েছিলো। কোন ছেলের সাথে কোনরকম সম্পর্ক নয়। আর দেওয়ান বাড়ির ছেলেদের সাথে তো একদমি না। যদি এমন কিছু আব্বুর কানে যায় তাহলে পড়াশোনা বাদ।তাই আমি একটু ভয়ে ছিলাম। আব্বুর ওপর কেন জানি সেদিন খুব বেশি রাগ হয়েছিল। কেন আব্বু আগে থাকতে চেয়ারম্যান বাড়ির ছেলেদের সাথে সম্পর্কের সাথে মানা করলো। এখন বুঝি বাবা-মা কখনও সন্তানের খারাপ চায় না।

আমি রোশানের প্রপোজ একসেপ্ট করিনি বলে সে হাত কেটেও ফেলছিলো। একদিকে তার প্রতি দূর্বলতা আরেকদিকে আব্বুর ভয়, আপরদিকে রোশানের পাগলামি। আমার তখন পাগল পাগল অবস্থা।রোশানের বন্ধুরা আমাকে চাপ দিচ্ছিলো।রোশানের বন্ধু আহাদ রোশানকে ও আমাকে মিলাতে পুরোদমে কাজ করেছে। আহাদের জোড়াজুড়িতে শেষে এক প্রকার বাধ্য হয়েই রোশানকে দুই দিন পর একসেপ্ট করে নিতে হয়। ধীরে ধীরে আমাদের সম্পর্ক এগিয়ে যেতে লাগলো। ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে আমি প্রেম করতে ব্যস্ত থাকতাম।বন্ধুরা বারবার সাবধান করেছে। সম্পর্কে জড়িয়েছিস ভালো কথা। কিন্তু নিজের বিপদ ডেকে আনিস না।আমি ওদের কথা এক কান দিয়ে ঢুকিয়েছি আরেক কান দিয়ে বের করে দিয়েছি।নতুন নতুন প্রেমে পরলে যা হয় আরকি।

রোশান তখন মাস্টার্সে পড়তো। ও ঢাকার যে বেসরকারি কলেজে পড়তো সেখানে মাসে মাসে গিয়ে শুধু পরীক্ষা দিয়ে আসতো। আর সারা মাস আমাদের কলেজে ঘুরতো,ফিরতো,বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতো। আমি এখন রোশানের দিওয়ানা। পড়াশোনা আমার লাটে উঠেছে। বাবা চাকরিসূত্রে নবাবগঞ্জ আর আম্মু সারাদিন স্কুলে শিক্ষকতা করার দরুন আমার দিকে ততটা নজর রাখতে পারতো না।এতে আমি যেনো আরো বেশি সুযোগও পেয়ে গিয়েছিলাম। দেখতে দেখতে চার মাস কেটে গেলো। রোশনকে আমি আমার সবটুকু দিয়ে ভালোবাসি। এখন রোশান বলতেই অজ্ঞান। কিন্তু কিছু দিন যাবত রোশানের ভাব-ভঙ্গি অন্য রকম। ওকে প্রায় সময় নাকি জারার সাথে দেখা যায়। বন্ধুরাও কানাঘুষা করতে লাগলো এই বিষয়ে। কিন্তু আমার বিশ্বাস হতো না। একটা মানুষকে পাগলের মতো ভালোবাসলে যা হয় আরকি।রোশান সবসময় আমাকে রাই বলতো। কারণ জিজ্ঞেস করলে বলতো আমি তার কাছে স্পেশাল একজন। তাই আমাকে ভিন্ন নামে ডাকে।যদিও রাই আমার নিকনাম। কিন্তু এই নামে কেউ না ডাকায় এর মধ্যে জং ধরে গিয়েছিল। সেই জং ছুটাতে রোশান এই নামে ডাকতো। আমার তুমি বলতে লজ্জা লাগতো বলে আপনি করে বলতাম।

সেদিন কলেজের পেছনে বসে সবাই আড্ডা দিচ্ছিলাম। মূলত সবাই কথা বলছিলো আমি পানির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।আমাদের মধ্যে জারা ছাড়া সবাই ছিলো। হঠাৎ রোশান জারার হাত ধরে আমার সামনে এসে হাজির। এসেই সে বললো,

— রাই, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।

#চলবে