শিশির ভেজা রোদ্দুর পর্ব-২৯+বোনাস পর্ব

0
768

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Bonus_Part
#Writer_NOVA

— রাই, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।

তাদের দুজনকে এভাবে দেখে আমি কিছুটা অবাক হলাম। সাথে রাগও হলো।রোশান ও জারার হাতের দিকে তাকিয়ে আমি কিছুটা কঠিন গলায় বললাম,

— কথা পরে বলেন। আগে বলেন ওর হাত কেন ধরেছেন?

— তার কৈফিয়ত আমি তোমাকে দিতে বাধ্য নই।

— আপনি বাধ্য।

— চুপ করো। আমি তোমার কথা শুনতে আসিনি। আমার কথা বলতে এসেছি।

ওর বাজখাঁই গলা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। রোশান কখনো আমার সাথে এমন বিহেভ করিনি। আমি ছলছল চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো,

— আমি তোমাকে ভালোবাসি না। এতদিন তোমার সাথে অভিনয় করেছি। আসলে আমার ও জারার ছোটবেলা থেকে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তোমার সাথে প্রেম করেছিলাম। অনেক দিন ধরে বলবো করে সত্যি কথাগুলো বলা হয়নি।

আমি স্তব্ধ চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছি। বাহ্, কি সুন্দর কথা! চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি পরছে। আজ তারাও আমার কথা শুনতে রাজী নয়।আমি চোখের পানি মুছে এগিয়ে গিয়ে রোশানের হাত ঝাঁকি দিয়ে বললাম,

— মজা করছেন আমার সাথে। আমার এরকম মজা ভালো লাগে না। জারা তুইও আমার সাথে মজা করছিস? আমি না তোর বেস্টফ্রেন্ড। তুই কি করে এসব করছিস?

— রাই, আমরা মজা করছি না। এগুলো সত্যি কথা।

— আমি বিশ্বাস করি না। আমার বেস্টফ্রেন্ড কখনও আমার সাথে এমন করতেই পারে না। আর আপনি, আপনি না আমায় ভালোবাসেন? আপনি আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন আমাকে বিয়ে করবেন।আমাদের ছোট একটা সংসার হবে।

রোশান আমাকে ঝাটকা মেরে সরিয়ে গালে ঠাস করে এক থাপ্পড় মেরে বললো,

— তোর মতো মেয়েতো আমার পায়েরও যোগ্য নয়। আর তোকে বিয়ে, ওয়াক থু। আমার চয়েজ এতটাও খারাপ হয়নি।ভালো করে কথা বলছিলাম ভালো লাগেনি।আসলে তুই ভালো কথার মানুষই না।তোর সব সত্যি জেনে গেছি আমি। তাই এসব ন্যাকামো অন্য কোথাও কর।

— কি সত্যি জেনে গেছেন আপনি? কি যা তা বলেন এসব? আমি তো আপনার কাছ থেকে কোন কথা লুকায়নি।

— লুকিয়েছিস, অনেক কথা লুকিয়েছিস।তুই সপ্তাহে সপ্তাহে বয়ফ্রেন্ড পাল্টাস, তোর তো কোন মান-সম্মান নেই, নিজেকে তো কিছুদিন পর নিলামে উঠাবি, নিজের শরীর দেখিয়ে কত ছেলেদের আকর্ষণ করছিসরে? তোর থেকে ভালো তো ঐ পতিতারা। তোর মতো মেয়েকে কখনও ভালোবাসা যায় না। আরে তোর থেকে প্রস্টিটিউড মেয়েদের ভালোবাসলেও একটা ছেলে ভুল করবে না। আমার বদ কিসমত যে তোর মতো মেয়েকে আমি ভালোবেসতে নিয়ে ছিলাম। ভাগ্য ভালো সময় থাকতে তোর আসল চেহারা দেখে নিয়েছি। এখন আমি ও জারা একে অপরকে ভালোবাসি। তোর ঐ নোংরা চেহারাটা না আমাকে দেখাস না। আমি তো আমার চেহারা তোকে কখনও দেখাবো না। নিজের মধ্যে যদি নূন্যতম মান-সম্মান থাকে তাহলে আমার থেকে দূরে থাকিস। হা কাকে কি বলছি আমি? যে কিনা নিজের শরীর দেখিয়ে অন্যকে আকর্ষণ করতে পারে তার আবার মান-সম্মান!

রোশান তাচ্ছিল্যের সহিত কথাগুলো বলে নিচে একদলা থুথু ফেললো।সাদ্দাম এসব কথায় চটে গেলো। আমি তো পাথর হয়ে গেছি। কি বলে এসব? সাদ্দাম জোরে চেচিয়ে বললো,

— অনেক বলছেন থামেন এবার। কি প্রমাণ আছে এসবের? আপনি না জেনে কেন ওকে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছেন? এই জারা এই তুই কি মানুষ? তোর সামনে তোর বেস্টফ্রেন্ডকে সে কথা শুনাচ্ছে আর তুই চুপচাপ শুনে নিচ্ছিস।

জারা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,
— রোশান ভুল কিছু বলেনি।

জারা কথাটা বলতে দেরী ওর গালে একটা থাপ্পড় পরতে দেরী নয়। ভেবেছিলাম থাপ্পড়টা সাদ্দাম দিয়েছে। কিন্তু না থাপ্পড়টা মেরেছে তামিম। সাদ্দাম হাত উঠিয়েছিলো। তার আগেই তামিম মেরে দিয়েছে। তামিমও রাগে ফুঁসছে। শাকিল জারার সামনে গিয়ে বললো,

— তোকে আমাদের ফ্রেন্ড ভাবতেও লজ্জা করছে। ওয়াক থু। তোর মতো কাল নাগিনকে নিজের বেস্টফ্রেন্ড ভাবতাম। তার জন্য নিজের ওপর ঘৃণা হচ্ছে।

জারা গালে হাত দিয়ে ফুঁসতে লাগলো। আমি এগিয়ে গিয়ে রোশানের পায়ের কাছে হাঁটু মুড়ে বসে দুই হাত জোর করে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,

— আপনার দোহাই লাগি রোশান। আপনি এসব কথা বলেন না। আপনার পায়ে পরি আমি। আপনি চুপ করুন। আপনার যদি আমার প্রতি কোন অভিযোগ থাকে তাহলে মারুন,কাটুন যা খুশি করুন। কিন্তু দয়া করে এসব মিথ্যে অপবাদ দিয়েন না। আপনার যদি মনে হয় আপনি সম্পর্ক রাখবেন না। তাহলে শেষ করে দিন।আমি কিচ্ছু বলবো না। তবুও আমার নামে এতগুলো অপবাদ দিয়েন না।আমি সত্যি আপনাকে অনেক ভালোবাসি। আপনাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। প্লিজ আপনি একটু বোঝার চেষ্টা করুন।

অলরেডি আমাদের ঘিরে সারা কলেজের স্টুডেন্ট জড়ো হয়ে গেছে। সবাই এতে দাত কেলিয়ে বিনোদন নিচ্ছে। কয়েকটা ছেলে মোবাইল চালু করে ভিডিও করতে নিয়েছিলো।শাকিল দৌড়ে ওদের হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নেয়।ভালোবাসলে যে কতটা বেহায়া হতে হয় সেদিন আমি বুঝতে পেরেছি। রোশান আমাকে ধাক্কা দিয়ে ওর সামনে থেকে সরিয়ে বলেছিলো,

— শরম থাকলে তোর এই চেহারা আমাকে ২য় বার দেখাস না। খুব শীঘ্রই আমি ও জারা বিয়ে করছি। তোর মতো মেয়ের সাথে টাইম পাস করা যায়, বিয়ে করা নয়।

সাদ্দাম এগিয়ে এসে রোশানের কলার ধরে বললো,
— কুত্তার বা** মুখ সামলাইয়া কথা বল। কিছু বলছি না বলে বেড়ে গেছিস। আগে নিজের দিক দেখ। তারপর ওরে নিয়া বাজে কথা বলিস।আমার বোনকে নিয়ে আরেকটা কথা বললে জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে ফেলবো।বড় বলে সম্মান করছিলাম। কিন্তু তুই সম্মানের যোগ্য নস। (জারার দিকে তাকিয়ে) জারা তোরে আমি জানে মাইরা ফালামু। তুই হলি যত নষ্টের গোড়া।

রোশান ঝাড়া মেরে সাদ্দামের হাত থেকে কলার ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,

— প্রমাণ আমি নিজে। আমি নিজের চোখে অনেক কিছু দেখেছি।

তামিম আমাকে ধরে উঠিয়ে বললো,
— রিলেশনে যাওয়ার আগে বলছিলাম তোরে। এই মানুষরূপী জানোয়ারের থেকে সাবধানে থাকিস। তুই তো আমাদের কথা শুনলি না। এখন বিশ্বাস হইছে তো। আর তোর বেস্টফ্রেন্ডের পরিচয় দেখছিস।এদের জন্য আমাদের থেকে দূরে যেতে চেয়েছিলি তুই।

আমি কিছু বলার মতো অবস্থায় নেই। কাঁদতে কাঁদতে আমার হেচকি উঠে গেছে। সাফা,ঝুমা আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। যেখানে সাদ্দাম, শাকিল,তামিম কথা বলে সেখানে আমরা কোন মেয়ে কথা বলি না। তাই সাফা, ঝুমা চুপ করে নিরব দর্শকের ভুমিকা রেখেছে। রোশান জারার হাত ধরে সেখান থেকে চলে গেল। আমি দৌড়ে সেদিকে যেতে নিলে সাদ্দাম, তামিম আটকে ফেলে।

আমি মুখে ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে বসে পরি।জীবনের প্রিয় দুটো মানুষ বিশ্বাসঘতকতা করলো।যাদেরকে চোখ বুজে অন্ধবিশ্বাস করতাম। তারাই আমাকে ধোকা দিলো।১.বেস্টফ্রেন্ড ২.ভালোবাসার মানুষ। তারাই আমার কাছে বৈইমান নামে পরিচিত পেলো। আমার ভুল ছিলো না তা আমি বলবো না। হ্যাঁ, আমারও ভুল ছিলো। একজনকে পাগলের মতো ভালোবাসতাম, আরেকজনকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতাম। তার যোগ্য উপহার আমাকে তারা দিয়েছে।

তারপর ঘটে যায় অনেক ঘটনা। আমি বেহায়ার মতো কতবার রোশানের কাছে গিয়েছি।কিন্তু অপমান,ধিক্কার ছাড়া কিছু পাইনি। এই ঘটনা যখন সারা কলেজে ছেয়ে যায় তখন প্রিন্সিপাল আব্বুকে ইনফর্ম করে। সাথে রোশানের বাবাকেও। সেদিন প্রিন্সিপালের রুমে আমার সাথে সাথে আমার বাবাও অপমানিত হয়। ক্ষমতার দাপটে সেদিন আমাদের বাপ-বেটির কথার কোন গুরুত্ব থাকে না। চেয়ারম্যানের ছেলে হওয়ায় সে পার পেয়ে যায়। আর সব দোষ হয় আমার।আমি নাকি রোশানকে ডিস্টার্ব করতাম, ওর পেছন পেছন ঘুরতাম। আরো কত কি! এমনকি সব মিথ্যে অপবাদগুলো সত্যি রূপে পরিণত হয়। সেদিন বাসায় আসার পর বাবা আমার দুই গালে দুটো শক্ত চড় বসিয়েছিলো। আর বলেছিলো তার সাথে কোনদিন কথা বলতে না। গ্রামের লোকেরাও তিলকে তাল করে আমাকে দোষারোপ করা শুরু করে। কিন্তু কেউ ঘেটে দেখে না আসলেই আমার দোষ কিনা। এতো এতো মানসিক চাপে আমি নিজেকে চার দেয়ালে বন্দি করে ফেলি।ডিপ্রেশন চারদিক থেকে আমাকে ঘিরে ধরে।তাই একদিন পৃথিবীর সব মায়া ত্যাগ করে, আব্বুর হাই পাওয়ারের ঘুমের ঔষধের পাতা থেকে পুরো এক পাতা ঔষধ একসাথে খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করি।

কিন্তু সঠিক সময়ে হসপিটালে নেওয়ায় বেঁচে যাই। হসপিটালে থেকে আসার পর সবার কথার অত্যাচারে আমি অতিষ্ঠ হয়ে যায়। আবার আত্মহত্যার কথা মাথায় আসে। সেদিন সাহস করে ফলের ছুড়িটা হাতে নিয়ে মাত্রই পোঁচ দিবো তখুনি ঝড়ের গতিতে তায়াং ভাইয়া এসে থামিয়ে ফেলে। তারপরের ঘটনাগুলো স্বপ্নের মতো ঘটতে থাকে। তায়াং ভাইয়া ও পরিবারের সাপোর্টে আমি ডিপ্রেশন কাটিয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ হতে থাকি। আহাদ ভাইয়াও রোশানের বিরুদ্ধে এসে আমাকে অনেক হেল্প করেছে। আব্বু আমার সাথে কথা না বললেও বাসায় এলে পুরো সময় আমার খেয়াল ও যত্ন নিতো। পুরো ছয় মাস পর আব্বু আমার সাথে কথা বলে। যেদিন আমার পরীক্ষার রেজাল্ট দেয় সেদিন। রোশান এসব খবর পেয়েও একবারও আমার সাথে দেখা করতে আসেনি। না এসে ভালো করেছে। জারার সাথে আমরা সব ফ্রেন্ড বন্ধুত্ব শেষ করে দেই। জারা পরীক্ষা শেষ করে ঢাকা চলে যায়। রোশান হাই স্টাডির জন্য ইউ.কে তে চলে যায়। আহাদ ভাইয়ার মুখে এতটুকুই জেনেছিলাম।এরপর ঢাকা ভর্তি হলাম। তায়াং ভাইয়া, খালামণি,তন্বীর সংস্পর্শে, সবার ভালোবাসায় মনের জোড় ফিরিয়ে এনে আবার আগের আমিতে ফিরে এলাম।এবার আপনারাই বলুন তো রোশান,জারাকে কি আমার মাফ করা আদোও উচিত? যদিও তাদের সাথে আরেকজনও আছে। যে এসবের মেইন কালপ্রিট। আমাকে নিয়ে সেই মুলত খেলেছে। রোশান,জারাতো ছিলো তার খেলার গুটি। আমি তার কথা পরে জানতে পেরেছি।যে কিনা ভালোর মুখোশ পরে আমার মনে জায়গা নিতে চেয়েছিলো।কিন্তু তার আগেই সব সত্যি আমি জেনে যাই। আমি এই তিনজনকে কখনো মাফ করবো না। কখনো না।

ফ্লাশব্যাক এন্ড……

এক দমকা হাওয়ায় বেবী চুলগুলো চোখের সামনে আসতেই ধ্যান ভাঙলো। চোখের পানি মুছে নিলাম।সিএনজির শব্দ পেতেই নিচের দিকে তাকালাম। আমাদের দালানের সামনে সিএনজি থেমেছে। সেখান থেকে দুজন নামলো। আমি ভাবলাম কার না কার ফ্লাটে মেহমান এসেছে সেদিকে তাকিয়ে আমি কি দেখবো?তাই আর আমি সেদিকে তাকালাম না। ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। বাসার ভেতর ঢুকতেই দেখি তন্বী পিঠ ধরে সোফায় বসে আছে। ওকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগে আমার পিঠে দুম করে এক তাল পরলো। আমি “আল্লাহগো” বলে চিৎকার জুড়ে দিলাম। ততক্ষণাৎ তার দিকে তাকিয়ে ব্যাথার কথা ভুলে খুশিতে জোরে চেচিয়ে বললাম,

—তুমি!

#চলবে

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_29
#Writer_NOVA

—তুমি!

আমার চিৎকারে অপরপাশে থাকা ব্যক্তিটা কানে হাত দিয়ে বললো,
— চুপ কর নোভি। আমার কান গেলো।

আমি এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম
— নূর আপি তুমি! তুমি তো অনেক বড় সারপ্রাইজ দিয়ে দিলা৷ কার সাথে এলে?

— তোর মামীর সাথে।

— মামী কোথায়?

— ভেতরে।

— তুমি আসবা তা কালকে বললা না কেন?

— এটাই তো সারপ্রাইজ।

— হুহ যাও কাট্টি তোমার সাথে। তুমি বলো নাই।

নূর আপি আমার কান টেনে ধরে বললো,
— তোর কাট্টি বের করতাছি।

— আহ্ নূর আপি ছাড়ো। ব্যাথা পাচ্ছি তো। তোমরা পইছো কি হুম?একজন রাগলে চুল টানে, আরেকজন কান। আমি কি লুটের মাল নাকি?

— কে আবার চুল টানে?

— কে হতে পারে বলো? তায়াং ভাইয়া ছাড়া কি অন্য কারো সাহস আছে?

— একদম ঠিক করে।

নূর আপি আমার কান ছেড়ে দিলো।আমি তন্বীর দিকে তাকিয়ে বললাম
—ঐ ছেমড়ির কি হইছে? পিঠে হাত দিয়ে বসে আছে কেন?

নূর আপি মিটমিট করে হেসে বললো,
— ওর পিঠেও একটা তাল ফালাইছি।

— আহারে বেচারীর মেরুদণ্ড বোধহয় ভেঙে ফেলছো।

কথাটা বলে আমরা দুজন একসাথে হো হো করে হেসে উঠলাম। তন্বী আমাদের দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো ফেস করে বললো,

— হুম হাসো, হাসো।বেশি করে হাসো তোমরা। দিন আমারও আসবো। আর নূর আপি কেউ এমনে মারে?আমার পিঠ বাঁকা হয়ে গেছে।

নূর আপি তন্বীর সামনে গিয়ে বললো,
— কি বললি আবার বল? তোদের দুটোকে তো আরো জোরে মারা উচিত। তোদের কল দিয়ে পাওয়াই যায় না। কি বিজি মানুষ! অনলাইনে থাকলেও নো রিপ্লাই। এই জন্য আসতে চাইনি। মা জোর করে নিয়ে এলো।

তন্বী মুখ ভেংচি দিয়ে বললো,
— আসছো কেন তাহলে চলে যাও।

— এখন তো তুই বললেও যাবো না। আমার আন্টির বাসায় আসছি তোকে বলে কি যাবো?

আমি দৌড়ে এসে দুজনকে হাত দিয়ে থামিয়ে বললাম,
— থামো, থামো। ঝগড়া করো না বাচ্চারা। ঝগড়া করা ভালো নয়।

নূর আপি দাঁত চেপে বললো,
— ঝগড়া করা ভালো না। তোর ভালো ছুটাইতাছি। তোরে তো আমি এখন বানামু।

— ধরতে পারলে তো বানাবে। আমি এখন দৌড়ে মামীর কাছে চলে যাবো।

আমি দাঁত কেলিয়ে দৌড় লাগালাম। নূর আপি অল্প একটু ধাওয়া করেছিলো। আমি তার আগেই ছুট। আমার দুই মামা। বড় মামার তিন মেয়ে। তাদের কোন ভাই নেই। নূর আপি বড় মামার ছোট মেয়ে। বড় দুই আপুর বিয়ে হয়ে গেছে। বড় আপুর দুই ছেলে,
মেজো আপুর এক ছেলে। তারা তাদের শ্বশুর বাড়ি থাকে। নূর আপি এখনো অবিবাহিত। নূর আপির পুরো নাম আয়েশা খান। ডাকনাম নূর।পড়াশোনা শেষ করে একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে।ছোট মামার দুই মেয়ে। তারও কোন ছেলে নেই। আর আমারও ভাই নেই। সাধারণত দেখা যায় ভাগ্নিরা মামার পাগল হয়।কিন্তু আমরা উল্টো। আমি,ইভা, তায়াং ভাইয়া, তন্বী এই চারজন দুই মামীর পাগল। মামী বলতে আমরা অজ্ঞান। আমাদের দুই মামীর মতো মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। তারাও ভাগ্নে-ভাগ্নী পেলে বাকিসব ভুলে যায়। আমার দেখা বেস্ট মামীদের মধ্যে আমার দুই মামী আছে। হয়তো ভাবছেন একটু বেশি বলছি। কিন্তু না আমি আরো কম বললাম। তাদের গুণগান সারাদিনও শেষ করতে পারবো না।

দৌড়ে গিয়ে খালামণির রুমে চলে গেলাম। বড় মামী সবেমাত্র বোরখা খুলে ফ্যানের নিচে বসেছে।আমি গিয়ে কুশালদি জিজ্ঞেস করলাম।

— আসসালামু আলাইকুম মামী। কেমন আছেন?

— আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি মামী। তুমি কেমন আছো?

— আলহামদুলিল্লাহ। পথে আসতে কোন অসুবিধা হয়নি তো?

— না কোন অসুবিধা হয়নি। সকাল সকাল চলে আসছি। তাই যামেও পরতে হয়নি। গুলিস্তান থেকে একেবারে ডাইরেক্ট সিএনজি নিয়ে চলে এলাম।

— ও তাহলে সিএনজি দিয়ে আপনারা আসছেন। আমি ভাবলাম কোন ফ্ল্যাটে আবার মেহমান এলো।এখন দেখি আমাদের ফ্ল্যাটেই।

মামী খালামণিকে জিজ্ঞেস করলো,
— তানভীরের মা, তানভীর কোথায়?

খালামণি বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— একটু আগে বন্ধুগো নিয়া বের হয়ে গেলো। তার কত কাজ আছে না। এর একটা গতি করতে পারলে ওর আব্বুর আর আমার একটু শান্তি হইতো। সারাদিন টই টই করে বন্ধুদের নিয়ে ঘুরে, আড্ডা দিয়ে বেড়ায়।

আমি মুখ টিপে হেসে বললাম,
— খালামণি তায়াং ভাইয়া কাজ করেতো। এই যে টো টো কোম্পানির ম্যানেজার। সারাদিন টই টই করে ঘুরাও তো একটা কাজ। সেটা বা কয়জন পারে।

খালামণি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— হইছে আর ভাইয়ের গুণগান গাইতে হবে না। যা গিয়ে তোর মামীর জন্য এক গ্লাস লেবুর শরবত বানিয়ে নিয়ে আয়। তন্বীকে বললাম কিন্তু ওর কোন খবর নেই।

— তন্বীর হয়তো মনে নেই। আমি নিয়ে আসতেছি।

আমি বের হয়ে দরজা পর্যন্ত আসতেই বড় মামী ডাকলো,
— নোভা শুনো।

— জ্বি মামী।

— এখন এতো তাড়াহুড়ো করতে হবে না। আমি তো আছি। কয়েকদিন থাকবো।তাই এতো ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। তুমি আমার পাশে বসো। তোমার শরীর কেমন এখন?

— আল্লাহর রহমতে ও আপনাদের দোয়ায়
আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

—গত সপ্তাহে তোমার কি অবস্থা গেলো। আমার শরীরও ভালো ছিলো না। নয়তো পরেরদিন চলে আসতাম। তখন আসতে পারিনি বলে এখন চলে এলাম। কালকের থেকে শরীরটা একটু ভালো। তাই নূররে বললাম চল তোর আন্টির বাসা থেকে ঘুরে আসি। কবের থেকে সবাইকে দেখি না। তাছাড়া আমার বড় ভাগ্নির কি অবস্থা গেলো একটু দেখাও করতে পারলাম না। কালকে রাতে হুট করে ঠিক করলাম আজকে এই বাসায় আসবো। তাই চলে এলাম।

— আমিও তো বলতেছি খালামণি তো কিছু বললোও না। আপনারা আগে থেকে জানায় আসলে তো খালামণি বলতোই। মামার শরীরটা কেমন?

— আছে আলহামদুলিল্লাহ। তোমার মামা তিনদিনের তাবলীগে গিয়েছে সেই সুযোগে আমরাও চলে এলাম।

— একদম ভালো করছেন। আপনি বসেন আমি আসতেছি। এতদূর থেকে যার্নি করে আসছেন। এখন একটু বিশ্রাম নেন। খালামণি তুমি একটু কিচেনে আসো। সকালে কি রান্না করবা হেল্প করে দিবোনি। আজ আর কলেজ যাবো না😁। বাসায় মেহমান রেখে কলেজ যেতে ইচ্ছে করছে না।

খালামণি বাহুতে আলতো করে চাপর মেরে বললো,
— এই তো পাইছে দুই বোন ছুতা। মামী আসছে সেই খুশিতে ভাগ্নীরা বাসাই থাকবে।

খালামণির কথা শুনে মামী মুচকি হাসলো। আমি দাঁত কেলিয়ে কিচেনের দিকে ছুটলাম। কি মজা আজ কলেজে যাবো না। ইউরেকা🥳।

💖💖💖

পরেরদিন সন্ধ্যায়……..

দুইদিন ধরে আমি ও তন্বী দুজনের কেউ কলেজে যাইনা। মামী, নূর আপি এসেছে সেই ছুতোয় কলেজ যাওয়া বন্ধ। গতকালও যাইনি। আজও নয়। তায়াং ভাইয়া দুদিন ধরে সকাল সকাল বের হয়ে যায়। বাসায় ফিরে রাত দশটার পর। এসে খেয়ে, ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পরে। তাই আমাদের খোঁজ খবরও নেয় না। সেই সুযোগে আমরা কলেজ ফাঁকি দেই। মাগরীবের আজান হচ্ছে। আমরা তিন বোন মিলে লুডু খেলছি। নূর আপি, তন্বী মিলে আনার সব পাকনা গুটিগুলো খেয়ে কাঁচা করে দিয়েছে। তার মধ্যে একটা ছক্কাও উঠছে না যে আমি একটা গুটি উপরে উঠাবো সেই দুঃখে আমার এক গ্লাস পানিতে ডুবে মরতে ইচ্ছে করছে। খেলায় টানটান উত্তেজনা। তখন পাশের রুম থেকে খালামণি আমায় ডেকে বললো,

— নোভা, এই নোভা।

আমি এতোই খেলায় মগ্ন যে খালামণির কথা শুনতে পেয়েও উত্তর দিতে ভুলে গেছি। নূর আপি আমায় ধাক্কা মেরে বললো,

— এই নোভি, আন্টি তোকে ডাকে।

আমি চেচিয়ে উত্তর দিলাম,
— হ্যাঁ খালামণি বলো।

— তোর তায়াং ভাইয়ার রুমের জানালাগুলো একটু বন্ধ করে দে। আজান দিতেছে। ঐ রুমের জানালা, বারান্দার দরজা কিছুই আটকানো হয়নি। আর এখন খেলা বন্ধ কর। আজান দিছে ওযু করে নামাজ পরে নে। যদি খেলার তালে নামাজ কাযা করিস তাহলে তিনটারই খবর আছে।

— আচ্ছা খালামণি আমি বন্ধ করে দিতেছি।

খেলা ছেড়ে উঠে তায়াং ভাইয়ার রুমে গেলাম। দরজা,জানালা বন্ধ করে লাইট ধরিয়ে দিলাম। আসার সময় চোখ পরলো ছোট টেবিলের ওপর কালো একটা ডায়েরির দিকে।সেটা হাতে নিয়ে কপাল কুঁচকে তাকালাম। নিজের মনে বিরবির করে বললাম,

— এটা আবার কার? তায়াং ভাইয়াকে তো কখনো ডায়েরি লিখতে দেখি নি। যার মন চায় তার হোক বাবা। আমি অন্যের জিনিস ধরছি না। না বলে ধরাটা ঠিক হবে না।

উপরে বড় করে ইংরেজিতে তানভীর লেখা। এতে সিউর হলাম এই ডায়েরি আমার গুনধর ভাইয়ের।
ভীষণ কৌতুহল লাগছে ভেতরে কি লিখা আছে তা নিয়ে। কিন্তু অন্যের জিনিস না বলে ধরাটাও একটা অন্যায়। তাই ডায়েরিটা না খুলে যথাস্থানে রেখে দিলাম। টেবিলের সাইড কেটে যাওয়ার সময় তার পায়ার সাথে বারি খেয়ে ধপাস করে পরে গেলাম। ব্যালেন্স রাখতে টেবিলের ওপরের দিকটা ধরতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ফলাফল জিরো। টাখনুতে বেশ ভালো ব্যাথা পেয়েছি। নিচে বসেই পা ধরে ডলতে লাগলাম। চিন চিন ব্যাথা করছে।তখুনি ধপ করে মাথার ওপর ডায়েরিটা পরলো।আউচ বলে মাথাও ধরলাম। ডায়েরিটা আমার কোলে মেলে পরেছে।

যখন ব্যালেন্স রাখতে চেয়েছিলাম তখন ডায়েরিটা টেবিলের কোণার দিকে ছিলো। হাত লেগে অল্প একটু বেজে ছিলো। আরেকবার নাড়া খেতেই আমার মাথার ওপর পরেছে। পৃথিবীর যতকিছু আছে সবকিছুর সাথে আমার খালি ধাক্কাই লাগে। আর আমি শুধু ব্যাথাই পাই। ডায়েরিটা দুই পার্টে পুরো খুলে আছে। সেদিকে চোখ যেতেই চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো। এক পৃষ্ঠায় ছোট করে লিখা, “অনেক ভালোবাসি”। তার নিচে ছোট করে একটা নাম লেখা,যেটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না দূর থেকে।এতটুকু দেখে অনেক বেশি কৌতুহল হলো। ডায়েরি হাতে নিয়ে নিচের নামটা পড়ে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। সবাই দাঁড়ানো থেকে বসে পরে আর আমি বসা থেকে দাড়িয়ে গেলাম। ব্যাথার কথাও ভুলে গেছি। নামটা দিকে আমি অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলাম।

মনে হচ্ছে কেউ দ্রুত পায়ে এই রুমের দিকেই আসছে। কিন্তু আমি ডায়েরি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মিনিট দুই পর বাইকের চাবি আঙুলের ডোগায় ঘুরাতে ঘুরাতে রুমে ঢুকলো তায়াং ভাইয়া। চাবিটা বিছানায় ছুঁড়ে মেরে আমার দিকে না তাকিয়ে বললো,

— কি রে শাঁকচুন্নি, তুই আমার রুমে কি করিস?

প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েই সে তার হাতের ব্যাসলাইট খুলতে ব্যাস্ত হয়ে গেলো। আমার কোন শব্দ না পেয়ে আমার দিকে তাকালো। তারপর ঝড়ের গতিতে এসে আমার থেকে ছোঁ মেরে ডায়েরি কেড়ে নিয়ে রেগে ঝাঁঝালো গলায় বললো,

— তুই এই ডায়েরি কার অনুমতি নিয়ে ধরছিস?

আমি ওর দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলাম।তারপর নিরবতা ভেঙে ওর দিকে দৃষ্টি রেখেই ছলছল চোখে বললাম,

— এতো ভালোবাসিস! তাহলে বলে দিলি না কেন?

#চলবে।