শিশির ভেজা রোদ্দুর পর্ব-৩৮+৩৯

0
716

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_38
#Writer_NOVA

— নোভা, will you be my পোলাপাইনের আম্মা?

আমার কথা শেষ হতেই এনাজ আবারো তার বিখ্যাত উক্তিতে আমাকে জিজ্ঞেস করলো। আমি একবার সবার দিকে কটমট করে তাকিয়ে এনাজের দিকে তাকালাম। এতদিন আমি জানতাম প্রপোজ করে ডু ইউ লাভ মি, উইল ইউ ম্যারি মি বলে। আজ প্রথম এমন আজব স্টাইলের প্রপোজ দেখলাম। সোজা পোলাপাইনের আম্মা। আমার সাথে থাকতে থাকতে কি তারও মাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি🤔? আসলেই ভাববার বিষয়। আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম,

— ভালোবাসা, বিয়ের কথা না বলে সোজা বাচ্চা-কাচ্চার চিন্তা? এত এডভান্স হতে কে বলেছে?

এনাজ মুখটা কুচোমুচো করে বললো,
— গতকাল ইফাতের যা কান্ড দেখলাম তাতে আমি আর দেরী করতে চাইনি। সোজা প্রপোজ করে দিলাম। ঐ পিচ্চি পোলা তোমার পেছনে যেভাবে আঠার মতো লেগেছে তাতে আমার তো ভয় হচ্ছিলো তুমি আবার ওকে মেনে না নাও। তাহলে আমার কি হবে বলো তো?

আমি কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
— আপনার যখন ভালোবাসা, বিয়ে ছাড়া বাচ্চার দরকার তাহলে ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে নিন।নয়তো অনলাইন থেকে অর্ডার করুন। কিংবা আল্লাহর কাছে চান। উপর থেকে টুপ করে ফেলে দিবে।

তায়াং ভাইয়া আমাকে ধমক দিয়ে বললো,
— এতো কথা পেঁচাচ্ছিস কেন? ও যা জিজ্ঞেস করেছো তার উত্তর দে।

আমি ডান হাতের নখ কামড়িয়ে তায়াং ভাইয়ার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
— বাচ্চা যে আকাশ থেকে টুপ করে পরে তা তোরা জানিস না? কেন ঐ গল্পটা শুনিস নি?

সবাই আমার দিকে বিস্মিত চোখে তাকালো। আমার এমন আজব কথাবার্তা শুনে তারা যে অবাক প্লাস রেগে যাচ্ছে তা আমি জানি। তবে আজ আমি কিছুতেই এনাজের প্রপোজ এক্সেপ্ট করবো না। আমার আনন্দ মাটি করে সারপ্রাইজ দিলো।আরেকটু হলে আমি কান্না করে দিতাম। এবার বুঝবে মজা।আগে থাকতে একটু জানালে কি হতো? সবাই একসাথে জিজ্ঞেস করলো,

— কোন গল্প?

আমি হাই তুলে বললাম,
— বলছি। তবে আগে একটু বসে নেই। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যাথা করছে। (এনাজের দিকে তাকিয়ে) নৌকার মাচা ভালো তো?

এনাজ একবার রেগে তাকালো। আমি তার দৃষ্টি উপেক্ষা করে আরাম করে দুই পা মুড়ে নৌকার ওপর বসে পরলাম। তারপর বললাম,

— তোমরা চাইলে বালিতে বসতে পারো। যদি তোমাদের ইচ্ছে হয় আরকি। এত মানুষ তো আর এই ছোট নৌকায় জায়গা হবে না।

রওনক মুখটাকে নিস্তেজ করে বললো,
— আমি আগেই বলছিলাম তায়াং ভাই আপনার বোন দেখেন আজকের এত সুন্দর একটা মোমেন্টকেও তেরটা বাজিয়ে দিবে। এবার বিশ্বাস হলো তো?

শারমিন বিরক্তির সাথে বললো,
— নোভা তুই কি শুরু করছিস?

আমি ঠোঁট উল্টিয়ে বললাম,
— আমি আবার কি করলাম? আমিতো একটা গল্প বলতে চাইছিলাম। কিন্তু তোরাই শুনছিস না।

তায়াং ভাইয়া রেগে বললো,
— তোর গল্পের গুষ্টি কিলাই। এনাজের প্রপোজালের উত্তর দে।

আমি হুমকির সুরে বললাম,
— একদম আমার সাথে রাগ দেখাবি না। চুপচাপ আমার গল্প শোন। নয়তো তোর বন্ধুকে কিন্তু রিজেক্ট করে দিবো।

এনাজ তায়াং ভাইয়াকে বললো,
— চুপ কর তায়াং। ওকে বলতে দে। ওকে দিয়ে বিশ্বাস নাই। তারপর যদি সত্যি আমায় রিজেক্ট করে দেয় তখন কি হবে? টিডি পোকা তুমি বলো।

আমি অনুমতি পেয়ে খুশি হয়ে গেলাম। তায়াং ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি দিয়ে বলতে শুরু করলাম।

— এক ছোট বাচ্চা ছেলে তার মা কে জিজ্ঞেস করলো, “আম্মু আমি কিভাবে হলাম?” তার মা মুচকি হেসে বললো, “আমি একটা টবে ছোট একটা বীজ বুনেছিলাম। তারপর সেটাকে প্রত্যেকদিন পানি দিতাম, যত্ন নিতাম আর আল্লাহর কাছে একটা ছেলে বাবু চাইতাম। একদিন গিয়ে দেখি টবের মধ্যে তুমি শুয়ে শুয়ে কাঁদছো। আল্লাহ তোমাকে আমার কাছে এভাবেই পাঠিয়েছে।” ছোট বাচ্চাটা এসব কথা মনোযোগ সহকারে শুনলো। সেদিন বিকেলেই তাদের বারান্দায় থাকা টবে একটা ছোট বীজ লাগিয়ে দিলো। পরেরদিন বিকেলে সে পানি দিতে গেলো। গিয়ে দেখে টবের ওপরে মাঝারি সাইজের একটা ব্যাঙ বসে আছে। তাকে দেখে বাচ্চাটা রেগে বললো,” ইচ্ছা করতাছে তোরে আছাড় দিয়া মাইরা ফালায়। কিন্তু কেমনে মারি? তুই তো আমার পোলা। বাবা হয়ে তো আমি সন্তানকে মারতে পারি না।” আমার গল্প এখানেই শেষ। এনজিও সংস্থা আপনি এই পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন। তাহলে আপনার আর পোলাপাইনের আম্মাকে খুঁজতে হবে না।

আমার গল্প শুনে সবাই মুচকি হাসতে লাগলো। শারমিন, তন্বী হো হো করে হাসছে। তন্বী বললো,
— এটা কি ছিলো নোভাপু? টবে বীজ বুনলে বাচ্চা হয়। আজকে প্রথম জানলাম। এসব গল্প তোমার দ্বারাই সম্ভব।

আমি দাঁত বের করে শয়তানি হাসি দিয়ে বললাম,
— ধন্যবাদ।

তন্বী হাসি থামিয়ে বললো,
— আমি সিউর ঐ পিচ্চি ছেলেটা ইফাত। কারণ ঐ পিচ্চি এতো এডভান্স।

এনাজের দিকে তাকিয়ে দেখি সে এক হাত মাথায় দিয়ে দুই পা ছড়িয়ে নৌকার ওপর বসে আছে। তায়াং ভাইয়া সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— চল তো সবাই। ওদের একটু একা কথা বলতে দে।

ভাইয়ার বলতেই সবাই একে একে চলে গেল। কিছু সময় কেউ কোন কথা বললাম না। আমি নৌকার ওপর থেকে একটা গোলাপ ফুল নিয়ে মনোযোগ সহকারে তার পাপড়ি ছিঁড়তে লাগলাম। নীরবতা ভেঙে এনাজ প্রথমে আমাকে ডাকলো।

— টিডি পোকা!

— হুম বলুন।

— আমাকে এক্সেপ্ট করে নাও না প্লিজ?

— উহু এত সহজে না। খুব সহজে আমাকে পেয়ে গেলে আমার মূল্য বুঝবেন না। আগেরজনের মতো অবহেলাও করতে পারেন। আপনাকে আমি এক্সেপ্টও করবো না। আবার রিজেক্টও করবো না। আপনি ঝুলে থাকবেন। বাদুড়ের মতো ঝুলতে থাকুন। দেখি আপনি আমাকে কতটা ভালোবাসেন। আপনার ভালোবাসার পরীক্ষাও হয়ে যাবে।

— দেখো আমি কিন্তু তোমার অতীতের সবকিছু জানি। আমার তোমার অতীত নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। তুমি শুধু আমার হলেই চলবে।

— পাওয়ার আগে সবাই এরকম ডায়লগ ছাড়ে।

— আমি ডায়লগ ছাড়ছি না। সত্যি বলছি। আচ্ছা একটা সত্যি কথা বলবে।

— হুম বলেন।

— তুমি কি আমায় একটুও পছন্দ করো না?

— সত্যি বলবো নাকি মিথ্যে বলবো?

— অবশ্যই সত্যি বলবে।

— আপনাকে আমার ভালো লাগে। তবে সেই ভালো লাগাটা ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে কিনা তাতে আমার ডাউট আছে।

— তাহলে এক্সেপ্ট করতে সমস্যা কি?

— ঐ যে বললাম খুব সহজে পেয়ে গেলে আমার মূল্য বুঝবেন না। বরং আমাকে সস্তা ভাববেন। তাছাড়া আরো দুটো কারণ আছে।

— কি?

— আপনি যেদিন দেশে আসছেন সেদিন এয়ারপোর্টে কিন্তু আমাকে ইনসাল্ট করেছিলেন। অনেক এটিটিউড দেখিয়েছেন। যেটা আমার ভীষণ খারাপ লেগেছিলো। আমি মনে মনে সেটা জমিয়ে রেখেছি।

এনাজ শুকনো মুখ করে জিজ্ঞেস করলো,
— কি করছি আমি?

— এখুনি ভুলে গেছেন। আপনি হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে ছিলেন। তখন আমি হাত মেলানোর আগে আপনি তন্বীর সাথে হাত মিলিয়ে ফেলছেন। আমার সেটা অনেক খারাপ লাগছে।আমার প্রেস্টিজে লেগেছে।তাছাড়া আপনি একবার আমার দিকে তাকাননি। বাপরে কি এটিটিউড! এখন থাকেন আপনার এটিটিউড নিয়ে। আমি আপনাকে এক্সেপ্ট করবো না তো।

— সেই মাসখানেক আগের কথা এখনো মনে রেখেছো?

— মেয়েরা এমনি। যেই বিষয়টা তাদের প্রেস্টিজে লাগে সেটা সারাজীবন মনে রাখে। আর সুযোগ পেলে সেটার সুদসুদ্ধ উসুল করে।

— আমি তোমার সাথেই হাত মিলাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মনে হঠাৎ শয়তানি বুদ্ধি জাগলো। তাই তোমার সাথে না মিলিয়ে তন্বীর সাথে হাত মিলালাম। আর তোমার দিকে আমি তাকাইনি তা কে বলেছে? গাড়িতে না হলেও বিশ-ত্রিশবার আমি তোমার দিকে তাকিয়েছি। সেটা কি তুমি দেখছো?

— হুহ😏! ভালো করছেন। এবার বসে থাকেন।

—এবার ২য় কারণ বলো।

— আমাকে এতবড় সারপ্রাইজ দিবেন তা আগে বললেন না কেন? আমি মন খারাপের জন্য কোনকিছু উপভোগ করতে পারিনি। আমি ভেবেছি আপনি হয়তো অন্য কাউকে পছন্দ করেন। আমার ভীষণ খারাপ লাগছিলো।যখন আপনি বললেন আপনার ভালোবাসার মানুষকে প্রপোজ করবেন। তখন আমার অনেক কান্না পাচ্ছিলো।

💖💖💖

আনমনে যে আমি কি বলে দিয়েছি নিজেও জানি না। যখন হুশ এলো তখন জিহ্বায় কামড় দিয়ে একহাতে মুখ ঢেকে ফেললাম। এনাজ মুচকি হেসে আমার দিকে এগিয়ে এলো। তাকে এগিয়ে আসতে দেখে আমি পেছন দিকে হেলে পরলাম। উনি মিটমিট করে হাসতে হাসতে বললো,

— তুমিও আমাকে ভালোবাসো। আগে ডাউট ছিলো এখন সিউর হলাম।

— একটুও না। আপনাকে আমার ভালো লাগে। ভালো লাগা আর ভালোবাসা এক নয়।

— তুমি আমাকে ভালো না বাসলে প্রপোজের কথা শুনে কখনই মন খারাপ করতে না। কিংবা তোমার চোখ পানিতে টলমল করতো না। আমি কিন্তু বাইকের আয়নায় দেখেছিলাম তুমি উপর দিকে তাকিয়ে চোখের পানি নিচে না পরার ব্যর্থ চেষ্টা করছিলে।

— একদম না। আমি আপনাকে ভালোবাসি না। দূরে যান। অস্বস্তি লাগছে।

— তুমি আমাকে ভালোবাসো। সেটা তুমি স্বীকার না করলেও আমি জানি। আর যদি ভালো নাও বাসো তাতেও সমস্যা নেই। খুব শীঘ্রই আমাকে ভালোবেসে ফেলবে৷ তোমার মুখ থেকে আমি ভালোবাসার কথাটা স্বীকার করিয়েই ছাড়বো। যাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।

— এত সোজা নয়।

— এত কঠিনও নয়।

— হু হু আমিও দেখবো।

— ওকে দেখে নিও।

এনাজ আমার থেকে দূরে সরে গেলো। আমি বড় করে হাফ ছাড়লাম। এতক্ষণ ধরে মনে হচ্ছিলো কেউ নিঃশ্বাস বন্ধ করে রেখেছে। হঠাৎ একটা কথা খেয়াল হতেই আমি এনাজকে বললাম,

— চলুন নৌকা দিয়ে ঘুরি।

— আমি নৌকা চালাতে পারি না।

— তাহলে পারেনটা কি?

— তোমাকে অনেক ভালোবাসতে।

— ইস!

— তায়াং, ইমারনদের ডাকি। দেখি ওরা কেউ পারে কিনা।

এনাজ সবাইকে ডাকলো। একে একে সবাইকে জিজ্ঞেস করা হলো। কিন্তু কেউ নৌকা চালাতে পারে না। আমি ভেবেছিলাম নৌকায় ঘুরবো। কিন্তু সেই আশায় গুড়ে বালি। রেগে বললাম,

— কেউ যখন নৌকা চালাতে পারেন না তাহলে এই নৌকা রাখার মানে কি? মনে হচ্ছে মাশরুমের বদলে ব্যাঙের ছাতা সাজিয়ে রেখেছে। যাও সবাই মিলে এই নৌকাকে জাদুঘরে সাজিয়ে রেখে আসেন। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে এই নৌকার সাথে কি ইতিহাস জড়িত,তাহলে সাথে লিখে দিয়েন এই নৌকায় এনজিও সংস্থা তার টিডি পোকাকে প্রপোজ করেছে। তাই এই নৌকা এত স্পেশাল। একটাও কাজের না সব নিষ্কর্মা।

এনাজ মুখ গোমড়া করে বললো,
— আমার কোন দোষ নেই। এই পুরো প্ল্যান ওরা সবাই মিলে করেছে।

আমি জোরে চেচিয়ে বললাম,
— এই নৌকার আইডিয়া কার?

সব বন্ধুরা একসাথে ইমরান হাশমি ভাইয়ার দিকে তাকালো। ভাইয়া হে হে করে হেসে বললো,
— নৌকায় বসে প্রপোজ করার আইডিয়া আমার ছিলো। কিন্তু তোমার যে নৌকা দিয়ে ঘুরতে মন চাইতে পারে সেটা আমার খেয়াল হয়নি। নয়তো সেই ব্যবস্থাও করে রাখতাম।

আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
— যেমন ঘাটোরা মানুষ তেমন তার ঘাটোরা আইডিয়া। একটাও কাজের নয়। ধূর, মুডটাই নষ্ট করে দিলো।

আমি নৌকা থেকে নেমে গেলাম। এনাজও নেমে এলো। সে নামতেই তার সব বন্ধু তাকে ঘিরে ধরলো। তওহিদ ভাইয়া জিজ্ঞেস করলো,
— কি এনাজ এক্সেপ্ট করেছে?

এনাজ মুখটাকে একটুখানি করে মাথা নাড়িয়ে না বললো। তারপর কান্নার অভিনয় করে রায়হান ভাইয়ার কাঁধে মুখ গুঁজে বললো,
— এক্সেপ্টও করেনি আবার রিজেক্টও করেনি। ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছে😵।

শাহেদ ভাইয়া বললো,
— এই মেয়েরা না এরকমি। ছেলেদেরকে তাদের পিছনে না ঘুরিয়ে কখনও এক্সেপ্ট করে না। একটা ছেলেকে তার পেছনে ঘুরিয়ে কি মজা পায় তা আল্লাহ আর মেয়েরাই জানে। আজ অব্দি আমি বুঝতে পারলাম না।

তাদে কথা শুনে আমি মিটমিট করে হাসতে লাগলাম। সবাই বেচারাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। আর তায়াং ভাইয়া আমার দিকে রেগে খাইয়া ফালামু লুক দিচ্ছে। মিনিট দশেকের মধ্যে সেখান থেকে সবাই বের হয়ে গেলাম। একটা ছোট টং দোকান থেকে সবাই একসাথে আনন্দ করে চা খেলাম। চায়ের বিলটা অবশ্য এনাজই দিয়েছে। তারপর যার যার বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। শারমিনকে তওহিদ ভাইয়া পৌঁছে দিবে। তন্বী তায়াং ভাইয়ার বাইকে আর আমি এনাজের বাইকে উঠলাম। নদীর পাড়ে যাওয়ার সময় যতটা খারাপ লাগছিলো এখন তার দুই ডবল বেশি ভালো লাগছে। ইস, এনজিও সংস্থা আমাকে ভালোবাসে🙈। এই কথাটা মনে আসতেই মনে লাড্ডু ফুটছে। আমি এনাজকে মেনে নিবো। তবে একটু দেরী করে। বাসার গেইটের সামনে আসতেই আমরা নেমে গেলাম। তায়াং ভাইয়া, তন্বী ভেতরে ঢুকে গেছে। এনাজ বাইকের সামনে থেকে প্রপোজ করার সেই গোলাপগুলো আর এক বক্স চকলেট আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

— এগুলো তোমার জন্য। রিজেক্ট যেহেতু করোনি এগুলো নিতে তো কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

— একসেপ্টও কিন্তু করিনি।

— করোনি তো কি হয়েছে? খুব শীঘ্রই করে নিবে।তাছাড়া এতদিন অপেক্ষা করতে পেরেছি আর কয়েকটা দিন কি করতে পারবো না? অবশ্যই পারবো। ইফাতের মতো আমিও একটা কথা বলছি তুমি ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে নিও। এই এনাজ বিয়ে করলে তার টিডি পোকাকেই করবে। টিডি পোকা শুধু এনাজের। আর কারো নয়।

কথাটা বলেই এক চোখ মারলো। আমরা দুজন একসাথে হেসে উঠলাম। আমি চকলেট বক্সটা আর গোলাপগুলো তার হাত থেকে নিয়ে নিলাম। সে বাইক ঘুরিয়ে স্টার্ট করতেই আমি কিছুটা জোরে চেচিয়ে বললাম,

— আমার বাবা-মাকে রাজি করান। তারা রাজী হলে আমার কোন আপত্তি নেই। আপনার পোলাপাইনের আম্মা হতে আমি রাজী আছি।

এনাজ চোখ দুটোকে রসগোল্লা বানিয়ে চাবি ঘুরিয়ে বাইক বন্ধ করে আমার দিকে তাকালো। আমি হাতে থাকা গোলাপগুলো দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললাম। গোলাপ সরাতেই দেখতে পেলাম সে খুশি হয়ে ঠোঁটে হাত দিয়ে ফ্লাইং কিস দেখালো। আমি লজ্জা পেয়ে বাসার ভেতরে দৌড় দিলাম। পেছনে তাকানোর মতো অবস্থায় আমি নেই।

#চলবে

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_39
#Writer_NOVA

সারা বাসায় হুলস্থুল লেগে গেছে। সেই সকাল ছয়টার থেকে গোছগাছ শুরু হয়েছে। এখন সকাল নয়টা। তবুও গোছগাছ শেষ হয়নি। আজ থেকে কলেজ বন্ধ। আর আজই আমরা গ্রামে যাবো। আগামীকাল ভাইয়ার হলুদ সন্ধ্যা। সকাল থেকে এই অব্দি আম্মু,আব্বু, চাচাতো ভাই-বোন, ভাগ্নিরা কল দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠছে। গতকাল রাতে কোন কিছু গোছানো হয়নি। এতে তায়াং ভাইয়া আমাদের তিনজনের ওপর হেব্বি রেগে আছে। সব গুছিয়ে বোরখা পরে তৈরি হয়ে বসে আছি। কিন্তু এখন তায়াং ভাইয়ার খবর নেই। আধা ঘণ্টা আগে বের হয়ে গেছে এখনও আসার নাম নেই। বোরখা উঠিয়ে সোফায় দুই হাঁটু মুড়ে বসে বসে মোবাইল গুতাচ্ছি। তন্বীরও একি অবস্থা। খালামণি নেকাব লাগিয়ে আমাদের সামনে এসে বললো,

— সব ঠিকমতো নিয়েছিস তো? গ্রামে গিয়ে আবার বলিস না এটা নিতে মনে নেই, ঐটা আনিনি।

আমি মোবাইলের থেকে চোখ সরিয়ে খালামণির দিকে তাকিয়ে বললাম,
— আমি সব ঠিক মতো নিয়েছি। তন্বীকে জিজ্ঞেস করো ভালো করে। এর তো আবার অভ্যাস আছে এসবের।

খালামণি আমার সামনে থেকে সরে গিয়ে তন্বীকে জিজ্ঞেস করলো,
— সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছিস তো? কোনকিছু বাদ পরেনি তো আবার? ভালো করে চেক করে দেখ। যদি বিয়ের অনুষ্ঠানে বলিস কোন জিনিস আনতে মনে নেই তাহলে কিন্তু খবর আছে।

তন্বী বোকার মতো খালামণির দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর জোরে চেচিয়ে বললো,
— আমাকে কিছু বলো? কি বলো? কিছু শুনতে পাচ্ছি না তো। জোরে বলো।

— একটা থাপ্পড় দিয়ে বয়রা বানিয়ে ফেলবো। তাহলেই শুনতে পাবি। কানের থেকে ইয়ারফোন খোল। যখন সময় পায় তখুনি কানে ঢুকিয়ে বসে থাকে।

— কি বলো আম্মু?

খালামণি রেগে তন্বীর কানের থেকে টেনে ইয়ারফোন খুলে ফেললো। তন্বী খালামণির মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে তিনি এতো রেগে আছে কেন। আমি মুখ টিপে কিছু সময় হাসলাম। খালামণি ওকে একদফা ঝারলো। আমি হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলাম। নয়টা বেজে পনের মিনিট। তায়াং ভাইয়া আসার নাম নেই। আমি খালামণিকে জিজ্ঞেস করলাম,

— খালামণি আমরা কি বাসে যাবো? আমার বাসে উঠতে ভালো লাগে না। বমি করতে করতে অবস্থা খারাপ। বাসায় যাওয়ার পর বিছানার থেকে মাথা উঠাতে পারি না। বাসের ঘূর্ণিটা মনে হয় আমার মাথায় ঘুরে।

খালামণি ব্যাগগুলো একসাথে জোরো করতে করতে বললো,
— তোর তায়াং ভাইয়া তো সিএনজি আনতে গেলো। কে জানে পেয়েছে নাকি। যদি সিএনজি পায় তাহলে বাসে যাবো না। ডাইরেক্ট এখান থেকে সিএনজি নিয়ে তোদের বাসার সামনের রাস্তার মোড়ে নামবে। আর যদি সিএনজি না পায় তাহলে বাসেই যেতে হবে।

— বাসের কথা শুনলেই আমার ভেতর থেকে সব গুলিয়ে আসে। এখনি বমি বমি লাগছে। বাসে উঠলে কি হবে আল্লাহ মালুম 😵।

— সাতটা বাজে রওনা দিতে চেয়েছিলাম। দশটা বেজে গেলো। যামে পরলে বিকালের আগে যেতে হবে না। ছেলেটার আসারও খবর নেই।

আমি সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। উদ্দেশ্য ইফাতদের ফ্ল্যাটে যাবো। তাদের থেকে বিদায় নিতে হবে তো। ৬-৭ দিনের সফরে যাচ্ছি। তায়াং ভাইয়া বলে বৌ-ভাতের পরদিন সকালে চলে আসবে। কিন্তু আমি জানি জামাই বাজারের আগে আসা হবে না। আজকে বুধবার আসতে আসতে সামনের মঙ্গলবার। আমাকে উঠতে দেখে খালামণি জিজ্ঞেস করলো,
— কোথায় যাচ্ছিস?

— ইফাতদের বাসায়। সবার থেকে বিদায় নিয়ে আসি।

— আমি সকালে গিয়েছিলাম। যাওয়ার আগে আরেকবার বলে যাবো।

আমি দ্রুত পায়ে ওদের ফ্ল্যাটের দিকে চলে গেলাম। দরজা খোলায় ছিলো। ভেতরে ঢুকে গেলাম। দেখি ইফাত, সিফাত সোফায় বসে টিভিতে কার্টুন দেখছে। আমাকে দেখে সিফাত জিজ্ঞেস করলো,
— কোথায় যাও ভাবী?

— আমাদের গ্রামের বাসায় যাচ্ছি। তোর আম্মু কোথায়?

— রুমে আছে।

আমি গ্রামে যাবো শুনে ইফাতের মুখটা একটুখানি হয়ে গেলো। মুখ গোমড়া করে জিজ্ঞেস করলো,
— কবে আসবা?

— ১ সপ্তাহ পর।

— এতদিন থাকবা কেন?

— চাচাতো ভাইয়ের বিয়ে।

আমি আর ড্রয়িংরুমে দাঁড়ালাম না। ইফাতের আম্মুর রুমে ঢুকলাম। তার থেকে বিদায় নিলাম। ইফাতের দাদীর সাথেও দেখা করে এলাম। আন্টি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
— সাবধানে যেও। আর তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। তুমি বাসায় না থাকলে মনে হয় সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা।

আমি তাকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে বললাম,
— দোয়া করবেন। সহিসালামত যেন বাসায় ফিরে আসতে পারি। নিজের খেয়াল রাখবেন। আমার ননদিনীকে না খাইয়ে রাখবেন না। (পেটের কাছে কান রেখে) এই যে ননদী, আমার শাশুড়ী আম্মাকে কষ্ট দিও না। কিক মেরো না। তবে তোমাকে না খাইয়ে রাখলে দু-একটা কিক মেরো। তবে বেশি জোরে না।

দাদী ইফাতকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— কিরে ইফাত তোর বউ তো গ্রামে চলে যাচ্ছে। তুই যাবি না তোর শ্বাশুড়বাড়ি।

ইফাত মন খারাপ করে বসে ছিলো। ওর দাদীর কথায় দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেল। ধরাম করে দরজা আটকে দিলো। সিফাত মুখ টিপে হেসে বললো,
— ভাবী চলে যাবে তাই ভাইয়া কষ্ট পাচ্ছে।

ওর কথা শুনে আমরা সবাই হো হো করে হেসে উঠলাম। এর মধ্যে তন্বী দরজা দিয়ে উঁকি মেরে বললো,
— নোভাপু চলে আসো।ভাইয়া সিএনজি নিয়ে চলে আসছে। আরো দেরী করলে ভাইয়া রেগে আইটেম বোম হয়ে যাবে। তখন যাওয়া ক্যান্সেল হয়ে যাবে।

আমি দ্রুত পায়ে দরজা দিয়ে বের হতে হতে তাদেরকে বললাম,
— আসি আন্টি, আসছি দাদী। সিফাত ভালো থাকিস। আমার শ্বাশুড়ি মা কে জ্বালাস না। আরেকজন তো গাল ফুলিয়ে দরজা আটকে বসে আছে। তাকে বলে দিয়েন আমি চলে গেছি।

💖💖💖

বাসায় ঢুকে ব্যাগ নিয়ে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলাম। খালামণি তাদের থেকে বিদায় নিয়ে ভালো করে তালা লাগিয়ে নিচে চলে এলো। সিএনজির সামনে যেতেই দেখি তায়াং ভাইয়া আমাদের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। আমি ওর মন জয় করার জন্য সব দাঁত বের করে একটা ভুবন ভুলানো হাসি দিলাম। এতে কাজ হলো না। ভাইয়া আরো রেগে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। ব্যাগ,জিনিসপত্র সব সিএনজিতে উঠালো ভাইয়া। তন্বী সিএনজি তে উঠে বসলো। আমি উঠতে নিলে ভাইয়া বললো,
— তুই এখানে কেন উঠিস?

— তাহলে কোথায় উঠবো?

— সিএনজিতে তোর জায়গা হবে না।

— তাহলে আমি কিসে যাবো?

— সিএনজির ছাদে বসে যদি যেতে পারিস তাহলে তোকে নিতে পারি। নয়তো তুই তোর ভালুপাসা ইফাতের কাছে থাকবি।

আমি ওর দিকে খাইয়া ফালামু লুক দিয়ে জোরে চিৎকার দিয়ে খালামণিকে ডাকলাম,
—খালামণি দেখো তোমার পোলায় কি কয়?

— কি বলে?

— আমাকে সিএনজির ছাদে বসে যেতে বলে।

— ওর কথায় কান দিস না তো।

আমি মুখ ভেংচি কেটে সিএনজিতে উঠতে নিলে তায়াং ভাইয়া আবার বললো,
— সিএনজি তোর জন্য আনি নাই।

আমার ভীষণ রাগ হচ্ছে। সাথে কান্নাও পাচ্ছে। রেগে বললাম,
— যা আমি যাবো না। তোরাই যা।

চোখ দিয়ে পানি বোধহয় এই পরে যাবে। তায়াং ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললো
— না গেলে আরো ভালো। থাক তুই। তোর জন্য বাইকের ব্যবস্থা করলাম। আর তুই আমার সাথে এমন করলি না। যা তুই সিএনজি তে যা। আমি বাইকে চলে যাচ্ছি।

তায়াং ভাইয়ার কথার আগাগোড়া কিছু বুঝলাম না। চোখ, মুখে বিস্ময় চিহ্ন নিয়ে ভাইয়ার দিকে তাকালাম। তখুনি আমার সামনে এসে একটা বাইক থামলো। বাইকে থাকা মানুষটা দেখে আমি আরেকদফা অবাক। এনজিও সংস্থা এখানে কি করছে? তার কাঁধে ব্যাগ। পরনে পাঞ্জাবী। চোখে সানগ্লাস। ভাব পুরো জামাই, জামাই।এনাজ মুখ দিয়ে টক করে শব্দ করে বললো,
— বাইকে উঠো।

— মানে?

— গ্রামে যাবা না?

— হ্যাঁ।

— তাহলে বাইকে উঠে বসো।

— আপনি কোথায় যাবেন?

— তোমার গ্রামে।

— আমি ঠিক বুঝলাম না।

— আমিও তোমাদের সাথে বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছি।

— আপনিও আমাদের সাথে যাবেন?

— হুম। দাওয়াত ছাড়া যাচ্ছি না।গরীব হতে পারি। কিন্তু এতটা নিচ মানসিকতার মানুষ নই।

— আমি তা কখন বললাম? আসলে কিভাবে কি আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

তায়াং ভাইয়া সিএনজিতে উঠার আগে এনাজকে বললো,
— সাবধানে আসিস। আর শাঁকচুন্নিকে ধরে, বেঁধে রাখিস। কোন শ্যাওড়া গাছ পেলে যেন আবার ঝুলে না পরে।

এনাজ মুচকি হেসে বললো,
— তোরা যেতে থাক। আমরা আসছি। গ্রামে গিয়ে দেখবি তোদের আগে আমরা পৌঁছে গেছি।

তায়াং ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটলো। আমি রেগে ওর দিকে তাকালাম। এনাজ ওর পিঠের ব্যাগটা দৌড়ে সিএনজিতে রেখে আসলো। খালামণি এনাজকে বললো,
— সাবধানে চালিয়ো। বেশি স্প্রিডে চালানোর দরকার নেই।

তন্বী চেচিয়ে আমাকে বললো,
— তোমারই তো ভালো হলো নোভাপু। আরামে বাইকে করে আসতে পারবে। একটু সাবধানে বসো। এনাজ ভাইকে আবার জাপ্টে ধরে চাপ্টি বানিয়ে ফেলো না। গ্রামে দেখা হচ্ছে। হ্যাপি জার্নি।

আমি ওর দিকে রেগে তাকাতেই ও খিল খিল করে হেসে উঠলো। খালামণি আমাকে সাবধান করে দিয়ে বললো,
— বোরকা সাবধানে রাখিস। বাইকের চাকার মধ্যে পেচিয়ে যেন না যায়। দূর্ঘটনা ঘটতে সময় লাগে না।

এনাজ এসে বাইকে বসলো। সিএনজির চালক আল্লাহর নাম নিয়ে রওনা দিলো। এনাজ আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
— গ্রামে যাওয়ার ইচ্ছে আছে?

— জ্বি।

— তাহলে উঠেন। এবার রওনা দেই।

আমি চুপচাপ তার পেছনে উঠে বসলাম। কাঁধে হাত রাখতেই উনি বাইক চালু করলো। আমার কাছে একটা সাইড ব্যাগ ছাড়া কিছুই নেই। সবকিছু সিএনজিতে। মাঝারি স্প্রিডে বাইক চলছে। আমার মন খুঁতখুঁত করছে। আমি এনাজকে জিজ্ঞেস করলাম,
— আপনি সত্যি আমাদের বাসায় যাবেন?

— না তোমাকে বেচতে যাচ্ছি। মেয়েদের দালালের হাতে তুলে দিয়ে বেশ বড় একটা এমাউন্ট পাবো। সেগুলো নিয়ে বিদেশ চলে যাবো।

— ধূর!

এনাজ জোরে হাসতে লাগলো। তারপর হাসি থামিয়ে বললো,
— সত্যি তোমাদের বাসায় যাবো। বিয়ের অনুষ্ঠানে থেকে তোমাদের সাথেই আসবো। নিশ্চয়ই মনে মনে ভাবছো আমি দাওয়াত ছাড়া যাচ্ছি নাকি?

— আরে না তা নয়।

— সেদিন তায়াং-এর সাথে তোমার ভাইয়ার বিয়ের শপিং-এ গিয়েছিলাম। তোমার মনে আছে? আমি যেতে চাইনি। তায়াং জোর করে নিয়ে গিয়েছিল।

— হ্যাঁ।

— সেখানে শপিং শেষ করে তোমার চাচাতো ভাই-বোন জেঁকে ধরেছিলো। বিয়েতে আমাকে যেতেই হবে। ঐদিনই আমাকে দাওয়াত করেছিলো। সকালে তোমার চাচাতো ভাই কল করেছিলো। এত করে তারা বললো আমি যদি না যাই তাহলে তো বিষয়টা খারাপ দেখায়। সকালে তায়াং ও জোর করে বললো যেতেই হবে। আমি তো প্রথমে রাজী হয়নি। তায়াং রেগে যায় আমি আসবো না বলে। অগত্যা আসতেই হলো। আমিও মনে মনে ভাবলাম হবু শ্বশুরবাড়ি দেখা হয়ে যাবে। তাছাড়া হবু বউও আমার চোখের সামনে থাকবে। এই সুযোগ তো মিস করা যায় না

আমি মুচকি হাসলাম তার কথায়। কিন্তু কোন উত্তর দিলাম না। মেইন রোডে উঠে দশ মিনিট পর যামে পরলাম।একটু এগোই আবার যাম। আজ থেকে সরকারি ছুটি। পুজোর ছুটি উপলক্ষে সবাই কম-বেশি গ্রামে যাচ্ছে। যাম থাকাই স্বাভাবিক। গুলিস্তানে এসে আবার পরলাম যামে। সেকি যাম বাবা গো🥵! অবস্থা খারাপ। আমি এনাজের পিঠে হেলান দিয়ে কখন ঘুমিয়ে পরেছি নিজেও জানি না। আমি জার্নি করতে গেলে ঘুমিয়ে সময় পার করি।

💖💖💖

কুচিয়ামোড়া ব্রিজে আসতেই বিকেল তিনটে বেজে গেলো। এত যামে আগে কখনও পরিনি। বসে থাকতে থাকতে কোমড় ধরে গেছে। ঘুম ভাঙলো একটু আগে। একটু জাগি আবার একটু ঘুমাই। বেচারার পিঠকে আমি বালিশ বানিয়ে নিয়েছি। কখন যে তার এক বাহু পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তার পিঠে মাথা রেখেছি বলতেও পারি না। এনাজ অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিলো কিছু খাবো কিনা। কিন্তু আমি জার্নির সময় কিছু খেতে পারি না। আসলে খেতে ভালো লাগে না। আমি খাইনি বলে এনাজও খায়নি।মাওয়া রোডে চলে এসেছি। নীমতলা আসার কিছু আগে আমাদের বাইক আটকালো ট্রাফিক পুলিশ। এনাজের সামনে এসে বললো,

— বাইকের লাইসেন্সের কাগজ দেখান।

— ওয়েট।

এনাজ বাইকের সামনের থেকে কাগজপত্র খুজে পুলিশের হাতে দিলো। পুলিশ একবার কাগজের দিকে তাকিয়ে আরেকবার আমার দিকে তাকালো। তারপর এনাজকে জিজ্ঞেস করলো,

— মেয়েটা কে?

— আমার বউ।

— কোথায় যাচ্ছেন?

— শ্বশুরবাড়ি।

এনাজের কথা শুনে আমার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো। তবে মুখে কিছু বললাম না। তাহলে আমরা দুজনেই এখন কট খাবো। এনাজ কথাগুলো বলার সময় একটু হাসেওনি।পুরো সিরিয়াস মুডে ছিলো।পুলিশ আমার দিকে তাকাতেই আমি জোর করে একটা হাসি দিলাম। ট্রাফিক পুলিশ এনাজকে বললো,

— আপনারা যে স্বামী-স্ত্রী তার প্রমাণ কি?

এনাজ বিরক্তি মুখে বললো,
— এখন কি বউ নিয়ে শ্বশুড় বাড়ি গেলেও প্রমাণ সাথে নিয়ে ঘুরবো? আগে জানলে কাবিননামা গলায় ঝুলিয়ে রাখতাম।

— দেখুন আপনি কিছু মনে করবেন না। আসলে ঢাকা টু মাওয়া রোডে প্রায় অনেক ছেলে-মেয়ে বাইকে করে ঢাকা থেকে ঘুরতে আসে। তারপর তারা অনেকে এখানে অসামাজিক কার্যকলাপও করে। তাতে আমাদের এখানে নিয়োগ করা হয়েছে। আগে এখানে কোন পুলিশ কাস্টাডি ছিলো না।

এনাজ পকেট থেকে মোবাইল বের করে ওন করলো। মোবাইলের ওয়ালপেপার দেখালো। ওয়ালপেপারের ছবিটা দেখে পুলিশটা বললো,
— ওফস সরি। আপনারা এখন যেতে পারেন।

আমিও একটু উঁকি মেরে ওয়ালপেপারের ছবিটা দেখলাম। ছবি দেখে আমার চোখ চড়কগাছ। এটা তো গতকালের নৌকায় থাকা ছবি। আমি পেছনে হেলে আছি আর এনাজ আমার দিকে ঝুঁকে আছে। তখন ছবি কে তুললো? আর এরকম একটা ছবি কেউ ওয়ালপেপারে দেয়। ইস, আমার দেখেই তো লজ্জা করছে। আর উনি এই ছবি পুলিশকে দেখালো। আমি মুখ ঘুরিয়ে রাখলাম। পুলিশ আমাদের ছেড়ে দিলো। এনাজ বাইক চালু করতেই আমি তার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম।

— এই ছবি কে তুলছে?

— ইমরান।

— কখন তুললো?

— যখন আমি তোমার দিকে ঝুঁকে ছিলাম তখন।

—এরকম ছবি কেউ ওয়ালপেপার দেয়?

— আমার কাছে ভালো লাগছে তাই দিয়েছি। আরো অনেক ছবি আছে। তোমার অজান্তে তুলেছি।

—😳😳

— কি হলো চুপ হয়ে গেলে যে?

— বদমাশ বেডা কি সাধে বলি?

— আমি ভালো ছেলে।

— হুম তার নমুনা তো দেখতেই পাচ্ছি। আপনি পুলিশকে মিথ্যে বললেন কেন? পুলিশকে কি ভয় পান না? উনার সাথে এভাবে কথা বললেন কেন?

— আমি কি ক্রিমিনাল নাকি যে ভয় পাবো? আর আমি তো ভালোভাবেই কথা বলছি।

— হুম দেখলামই তো। তা আমি আপনার বউ হলাম কবে?

— হওনি তবে খুব শীঘ্রই হবে। আমি আসলে হবু বউ ও হবু শ্বশুরবাড়ি থেকে হবু শব্দটা কেটে দিয়েছি। মিথ্যে তো বলিনি।

— সবসময় সব কথার লজিক জমানোই থাকে।

— রাখতে হয়।

আমি ভেংচি কেটে আশেপাশে দেখতে লাগলাম। আমাদের উপজেলার রাস্তায় এসে পরেছি। উপজেলার মোড়ে আসতেই পেছনের একটা রাস্তা দেখিয়ে এনাজকে বললাম,
— এই রাস্তা দিয়ে তাজপুর নামের একটা গ্রামে যাওয়া যায়। ঐ গ্রামের রাস্তাটা খুব সুন্দর। ছায়াঢাকা, সবুজ গাছপালায় ঘেরা খুব সুন্দর একটা রাস্তা। বিকেলে হাঁটতে আসলে মন পুরো ফ্রেশ হয়ে যায়।

— আমরাও তাহলে একদিন আসবোনি।

— আচ্ছা।

উপজেলার বাজারে এসে এনাজ বাইক থামালো। আমাকে থানার সামনে রেখে সে বাজারের ভেতরে চলে গেল। দশ মিনিট পর কয়েকটা প্যাকেট নিয়ে ফিরে এলো। এক প্যাকেটে চিপস,বিস্কুট, চানাচুর দেখা যাচ্ছে। আর দুটো তে ফল, মিষ্টি। আমি দুই হাত কোমড়ে রেখে রেগে জিজ্ঞেস করলাম
— এসব কি?

— প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি যাবো। খালি হাতে তো আর যেতে পারি না।

— আমি কিন্তু এক্সেপ্ট করিনি।

— রিজেক্টও করোনি। এবার কথা না বলে বাইকে উঠো।

প্যাকেটগুলো বাইকের হাতলে ঝুলিয়ে দিলো।আবার চলতে শুরু করলাম আমরা।গ্রামের রাস্তায় এসে পরেছি আমরা।রাস্তার দুই পাশে যতদূর চোখ যায় খেতের পর খেত। সেগুলো এখন পরিষ্কার করা হচ্ছে। কোন কোন খেতে চাষ দেওয়া হচ্ছে। কোনটায় বা রোদে পুড়ে সার দিচ্ছে। এখন আলু বোনার মৌসুম। আলু বোনার আগের সকল ব্যবস্থা নিচ্ছে সবাই। রাস্তার দুই পাশে বড় বড় গাছ লাগানো। সেগুলো থাকায় রোদ লাগছে না গায়ে। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিলাম। নিজের গ্রাম এটা। সবকিছুকে নিজের বলে দাবী করতে পারি। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। ঠান্ডা হাওয়া আর বিশুদ্ধ অক্সিজেন। মনটা এমনি খুশি খুশি লাগছে। চারিদিকে তাকাতে নিমিষেই মন ভালো হয়ে গেছে। এনাজ চুপচাপ বাইক চালাচ্ছে তার নিজের গতিতে। প্রায় ৬ মাস পর গ্রামে আসা হলো। অনেক কিছু বদলে গেছে। তবুও ভীষণ ভালো লাগছে। ইচ্ছে করছে উড়াধুরা নাচতে। হাত দুটো দুই দিকে মেলে বাতাসটা অনুভব করতে লাগলাম। কিন্তু এনাজের ধমকে বেশি সময় হাত মেলে রাখা হলো না। এক হাতে তার কাঁধে রেখে চুপ করে বসলাম। বাইক থামলো আমাদের বাসার সামনের মাটির রাস্তায়।

#চলবে।