#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_52
#Writer_NOVA
এক সপ্তাহ পর……
সময় যেন চোখের পলকে কেটে যাচ্ছে। মনে হলো সেদিন এনাজের ওপর অভিমান করে বাসায় চলে এলাম আজ এক সপ্তাহ কেটে গেলো। এতো দ্রুত কিভাবে সময় যাচ্ছে তাও বুঝতে পারছি না। সেদিনের পর থেকে আমি এনাজের সাথে কোন কথা বলি না। এনাজ বেসরকারি এক কোম্পানিতে জব পেয়েছে। তাই মাঝে এনাজ একদিন মিষ্টি নিয়ে এসেছিলো।তারপর আর খবর নেই। জিদ করে একদিন কলও দেইনি। সে দিলেও রিসিভ করে তন্বীর হাতে দিয়ে দিতাম। গত পরশু বিকেলে তায়াং ভাইয়ার দাদী এসেছে।শরীর অসুস্থ তাই ডাক্তার দেখাতে। অবসরে তার সাথে গল্প করেই সময় কেটে যায়। সকালের খাবার খেয়ে কলেজের জন্য তৈরি হতেই কোলিং বেল বেজে উঠলো। মাথার হিজাবটা ঠিক করতে করতে তন্বীকে বললাম,
— তন্বী দেখতো কে এলো।
— তুমি একটু যাও না নোভাপু। আমি হিজাবটা ঠিক করছিলাম। এখন গেলে আমার হিজাব বাধাটাই ভুলে যাবো।
— আচ্ছা তাহলে আর কি করার। আমিই যাই। খালামণি তো দাদীকে ঔষধ খাওয়াচ্ছে।
আরেকবার কলিং বেল বাজতেই আমি দৌড়ে সেদিকে ছুটলাম। দরজা খুলতেই ইফাতের আম্মুকে দেখতে পেলাম। আমি হাসিমুখে বললাম,
— আরে শাশুড়ী আম্মা যে! তা কি মনে করে হঠাৎ? আপনি কষ্ট করে কেন আসতে গেলেন? আমাকে ডাকলে আমিই চলে যেতাম।
— ভাবী কোথায়?
— দাদীর কাছে। কোন দরকার আন্টি?
— একটু পর হসপিটালে যাবো। তাই ভাবলাম তোমাদের সাথে দেখা করে যাই। যদি বেঁচে না ফিরতে পারি। তাহলে তো আর দেখা হবে না।
উনি কথাগুলো বলতে বলতে চোখের পানি ফেলে দিলেন। আমি এক হাতে আলতো করে তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
— কি হয়েছে? এমন উদ্ভট কথাবার্তা কেন? আপনার কিচ্ছু হবে না। আল্লাহ আছে তে।
— হসপিটালে যাবো আজ। ডক্টর বলেছে বাচ্চার কন্ডিশন ভালো না হলে আজ রাতেই সিজার করবে।আর যদি ভালো হয় তাহলে ১৫ দিন পর। আমার ভয় করছে নোভা। মনে হচ্ছে এবার আমি বাঁচবো না। আমি মরে গেলে ইফাত,সিফাতকে একটু দেখো।
— ছিঃ কি বলেন এসব! খবরদার বাজে কথা বলবেন না। আল্লাহ আছে তো সাথে। উনি চাইলে সব ঠিক হবে। আপনি খামোখা টেনশন করছেন।
উনি আঁচলে চোখ মুছে আমার দিকে তাকিয়ে করুন মুখে বললো,
— কোন অপরাধ করলে মাফ করে দিও মা। নিজের অজান্তে যদি কোন কষ্ট দিয়ে ফেলি তাও মাফ করে দিয়ো। হায়াতের মালিক আল্লাহ। তবুও ভয় করে। যদি বেঁচে না ফিরতে পারি।
— আহ্ আন্টি, কি শুরু করলেন? এবার থামুন তো। আল্লাহ ভরসা কিছু হবে না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।
উনি আঁচলে চোখ মুছলেও ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেদে উঠলেন।কিছু সময় কান্না করে আমাকে সাইড কাটিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। আমি এক দৃষ্টিতে তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লাম। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে একজন মা তার সন্তানকে জন্ম দেন। আর বর্তমানে সেই মা-কেই তার সন্তান বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসতে দুইবার ভাবে না।
💖💖💖
বিকেলে……..
দাদীর সাথে বসে তার পুরনো দিনের গল্প শুনছিলাম। তন্বী দুই মগ কফি নিয়ে এসে আমার দিকে এক মগ বারিয়ে দিলো। আমি কফির মগে হালকা করে এক চুমুক দিয়ে বড় করে একটা নিশ্বাস নিয়ে সাথে সাথে ছাড়লাম। দাদী আমাদেরকে বললো,
— কি খাস তোরা এসব? চায়ের মতো কি আর কিছু আছে? কিরকম তিতা, তিতা লাগে!
আমি মুচকি হেসে বললাম,
— তুমি খাবা সতিন? খেলে বলো বানিয়ে দেই। তবুও একে চায়ের সাথে তুলনা দিও না। চায়ের স্বাদ আলাদা, কফির স্বাদ আলাদা। কারো সাথে কারো তুলনা হয় না। যার যার জায়গায় সেই বেস্ট।
তন্বী সোফায় বসে বললো,
— তুমি কি চা খাবা? বানিয়ে দিবো?
— দে একটু আদা কুচি দিয়ে রং চা বানিয়ে দে।
— আচ্ছা আমি বানিয়ে আনছি।
তন্বী সোফা থেকে উঠে কিচেনে চলে গেলো। আমি কফি শেষ করে চুপ করে বসে রইলাম। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে দাদী বললো,
— কি সতিন এতো চুপচাপ কেন? টেনশনে পরে গেলি নাকি?
— টেনশনে পরবো কেন?
— তোর জামাইয়ের ভাগ বসাতে চলে এসেছি। সতিন এলে তো মাথায় চিন্তা আসবেই। তোর থেকে যদি তোর জামাইকে হাত করে নেই।
— এত সোজা নাকি? তুমি যত জাদু করো আমার জামাইকে সে আমারি থাকবে।
— দেখি কতদিন আঁচলে বেঁধে রাখতে পারিস।আমি জাদু করে আমার কাছে নিয়ে যাবো।
— এক মিনিট সতিন সাহেবা! আমার জামাই কোথায়? আগে জামাই দাও। তারপর এসব চিন্তা করো। এখন জলদী আমায় জামাই দাও। বুড়ি হয়ে গেলাম এখনো জামাই পেলাম না।
আমি দাদীর দুই হাত ধরে ফ্লোরে পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে কান্নার অভিনয় শুরু করলাম। জোরে চেচিয়ে বললাম,
— ও দাদী জামাই দাও। শীতকাল চলে আসছে তো। এই শীতে জামাই ছাড়া থাকতে চাই না। আমার দাবী, আমার দাবী মানতে হবে মানতে হবে। এবার শীতে জামাই দিতে হবে, দিতে হবে। ইহা আমার ক্ষুদ্র দাবী।জামাই চাই🥺। ঠিক বয়সে বিয়ে হলে এখন দুটো পোনাইয়ের(বাচ্চার) মা হয়ে যেতাম। ও দাদী জামাই দাও। আমার জামাই লাগবো।
— বাড়িতে বলবো?
— জলদী বলো।দেরী করছো কেন? আমি বিয়া করমু।
দাদী আমার কাহিনি দেখে হেসে কুটিকুটি। আমি অপলক চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। দাদীর আদর কি হয় আমি তা জানি না। আমার দাদী মারা গেছে আমার আব্বু-আম্মুর বিয়ের আগে। কিন্তু উনাকে পেলে মনে হয় নিজের দাদীকে পেয়েছি। উনি তায়াং ভাইয়া, তন্বী, আমাকে সমান আদর করে। দাদী হাসি থামিয়ে বললো,
— দেরী কর তুই। আমি এই শীতেই তোর বিয়ের ব্যবস্থা করছি।
— জলদী করো। আমি জামাই চাই।
— তানভীর কোথায়?
— জানি না দাদী। সেই যে সকালে বেরুয়েছে এখনো আসিনি।
— নাতীটা আমার একদম ওর দাদার মতো হয়েছে। সতিন, আমার পানের বাটাটা নিয়ে আসবি একটু? পান চাবাইতে মন চাইতাছে।
“আরে বিয়া করায় দে, আরে বিয়া করায় দে।” গান গাইতে গাইতে রুমের দিকে যেতে নিলেই দাদী বললো,
— অপেক্ষা কর নাতনী। আমি বিয়ার ফুল ফোটানোর ব্যবস্থা করছি।
আমি লজ্জায় ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে দৌড়ে তার রুমে ছুটলাম। খালামণি রুমে ঘুমাচ্ছে।তাই আস্তেধীরে সেই রুম থেকে বের হলাম।দরজা খটখটানির শব্দ হতেই আমি ওঠার আগে সেদিকে ছুটলো তন্বী।আমি দাদীর সাথে একটা পান সাজিয়ে মুখে দিলাম।তখুনি পেছন থেকে কেউ বললো,
— ও ডার্লিং! কেমন আছো?
এনাজের কণ্ঠ পেয়ে দরজার দিকে তাকালাম। এনাজ ও তায়াং ভাইয়া এসে দাদীর পাশে বসলো। দাদীকে জড়িয়ে ধরে এনাজ বললো,
— ভুলেই গেছো ডার্লিং। একটা খবরও নাও না।
দাদী অভিমানী সুরে বললো,
— আমার দুই নাম্বার জামাইয়ের আজকে হুশ এলো। আমি দুদিন ধরে এলাম আর তুমি আজকে এলে।
— চাকরী পেয়েছি দাদী। অন্যের চাকরী করলে কি হুটহাট আসা যায়। সময়ই পাই না আজকাল। আজকে একটু সময় পেলাম তাই চলে এলাম। তোমার শরীর কেমন?
—আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তোর?
— আল্লাহর রহমতে আর তোমাদের দোয়ায় আছি আলহামদুলিল্লাহ।
এনাজ দাদীর সাথে গল্পের ঝুলি খুলে বসলো। অনেক আগের থেকেই এনাজের এই বাড়িতে চলাচল। সেই সুবাদে দাদী এনাজকে ভালো করেই চিনে। দুজনের বন্ডিংও মনোমুগ্ধকর। তায়াং ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
— কিরে শাঁকচুন্নি হা করে তাকিয়ে কি দেখছিস? যা গিয়ে আমাদের জন্য চা-নাস্তা কিছু নিয়ে আয়।
আমি মুখ ভেংচি দিয়ে শব্দ করে পান চাবাতে লাগলাম। যার মানে তোর কথার কোন গুরুত্ব আমার কাছে নেই। এনাজ একবার আমার দিকে তাকিয়ে এক হাতে কান ধরে ইশারায় সরি বললো। আমি চোখ ঘুরিয়ে ফেললাম। কিছু সময় পর আবার তাকাতেই সে ঠোঁট চোখা করে চুমু দেখালো। আমি একটা খাইয়া ফালামু লুক দিয়ে উঠে কিচেনে চলে গেলাম।
💖💖💖
রাতে…..
আমি ও তন্বী রাতের জন্য আলু পরোটা বানাচ্ছি। এনাজ কিছু সময় পরপর কিচেনে এসে ঘুরে যাচ্ছে। কিন্তু আমি তাকে পাত্তাও দিচ্ছি না। সে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আমাকে কত কিছু বলছে। আমি কোন কথাই শুনছি না। এনাজ, তায়াং গিয়ে সোফায় বসে লুডু খেলতে লাগলো। দাদী এসে বললো,
— হ্যাঁ রে বড় নাতনী আমাদের তানভীরকে তোর কেমন লাগে?
আমি রুটি বেলতে বেলতে ভ্রু কুঁচকে দাদীর দিকে তাকিয়ে বললাম,
— হঠাৎ এই প্রশ্ন?
— বল না তানভীরকে কেমন লাগে?
— পাঠারে আর কেমন লাগবে?
— আমি জিজ্ঞেস করছি তানভীরকে কেমন লাগে?
— হ্যাঁ মানুষের মতোই লাগে। আবার মাঝে মাঝে ভিনগ্রহের এলিয়েনর মতোও লাগে।
— নাহ এই পাগলনীর মাথা ঠিক নেই।
— এই সতিন কি বলো আমায়? আমি পাগলনি না।
— হু তাতো দেখছি।
— তন্বী আমার সাথে একটু আয় তো।
তন্বী তাওয়ায় তেল দিয়ে দাদীর দিকে তাকিয়ে বললো,
— হ্যাঁ, আসতাছি তুমি যাও।
দাদী চলে যাওয়ার কিছু সময় পর তন্বী চলে গেল। আমি রুটি বেলে পরোটার ভাজ দিলাম। তাওয়ার পরোটা উল্টে দেওয়ার জন্য খুন্তি নাড়াতে গেলে এনাজ গলা খাকরি দিয়ে বললো,
— সরি, টিডি পোকা। এবার তো মাফ করে দাও।
উনি দরজার সাথে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুজে দাড়িয়ে আছে। আমি একবার তার দিকে তাকিয়ে পরোটা উল্টাতে মনোযোগ দিলাম। খুন্তি দিয়ে পরোটা উল্টাতে গেলে এক ঝাটকা গরম তেল এসে আমার হাতে লাগলো। আমি আল্লাহগো বলে চেচিয়ে উঠতেই এনাজ দৌড়ে এসে ব্যস্ত হয়ে পরলো।
— একটু সাবধানে কাজ করতে পারো না। আমার জিদ পরোটার ওপর তুলতে কে বললো? এখন জ্বালাটা কে সহ্য করবে? আমি নাকি তুমি?
উনি এগিয়ে এসে হাত টেনে নিয়ে বেসিনের কল ছেড়ে দিয়ে পানির নিচে হাত ধরে রাখলো। তারপর দৌড়ে ফ্রীজ থেকে বরফ বের করে নিজে ডলে দিলো। আমি দুই-তিনবার হাত সরিয়ে নিতে গেলে চোখ পাকিয়ে তাকালো।তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
— কিছু বলছি না বলে ভেবো না পার পেয়ে গেছো। তুলে এমন আছাড় দিবো যে সারাদিন আমার নাম জপবা। ভালো আছি ভালো থাকতে দাও। খারাপ হলে কিন্তু তোমার ক্ষতি। আমার খারাপ রূপ এখনো দেখোনি। বেশি তিড়িং বিড়িং করবা সত্যি তুলে আছাড় দিবো। তখন এই এনাজকে দেখে ভয়ে কাঁপবে।
আমি তার রাগী গলা শুনে অনেকটা ভয় পেয়ে গেলাম। ভয়ে ভয়ে মাথা হেলিয়ে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিলাম। উনি তেল ছিটকে আসার জায়গায় যত্ন সহকারে ফুঁ দিয়ে বরফ ডলে দিচ্ছে। আমার কান্না শুনে ধমক দিয়ে বললো,
— একদম চুপ। আরেকটা শব্দ যেন না হয়। কি বাচ্চাদের মতো শুরু করছো? মুখে তালা দাও।
— এ্যাঁ, এ্যাঁ, এ্যাঁ ও খালামণি😭।
— চুপ। বলছি না কোন শব্দ হবে না।
— ই-ই-ই-ই-ই-ই-ই-ই-ই-ই🥺।
— তুমি সত্যি আমার হাতে আরেকটা থাপ্পড় খাবে টিডি পোকা।
আমি ঠোঁট উল্টে ছলছল চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি চুলোটা অফ করে দিয়ে আমাকে টুলে বসালো। তারপর ফার্স্ট এইড বক্স এনে বার্ণ মলম দিয়ে দিলো। চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললো,
— সরি পাগলী। সেদিন আমার মাথা ঠিক ছিলো না। তোমার কল দেখে আমি পাগল হয়ে গেছিলাম। ভেবেছিলাম রোশান লোক দিয়ে তোমার কোন ক্ষতি করেছে। আমি এক মুহুর্তের জন্য নিজের মধ্যে ছিলাম না। তোমার কিছু হলে আমার কি হবে বলোতো? ভালোবাসি পাগলী।
— ছাড়েন, একদম ধরবেন না আমায়। আপনি অনেক জোরে থাপ্পড় মেরেছিলেন। আমি ভুলি নাই 😭।এখন আবার কতগুলো বকা দিছেন।
— সরি বললাম তো।
— কাজ হবে না।
— কি করতে হবে?
— কিছু না। সরেন এখান থেকে। ছাড়েন আমায়। সাহস হয় কি করে আমাকে জড়িয়ে ধরার? ছাড়ুন বলছি।
এনাজ আগের থেকে জোরে আমাকে শক্ত করে ধরে কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে বললো,
— সরি টিডি পোকা। আর কখনো এমন করো না। তোমার সামান্য বিষয় নিয়ে আমি সিরিয়াস।
আমি তার বুকে কতগুলো আলতো করে কিল-ঘুষি বসিয়ে তাকে ছেড়ে অন্যদিকে চলে এলাম। এভাবে কেউ অভিমান ভাঙালে তার সাথে কি অভিমান করে থাকা যায়? একটুও না। ইস, আমার এখন লজ্জা করছে। সে আমায় জড়িয়ে ধরে ছিলো। উনি আমায় লজ্জা না দিয়ে আমার সাথে হাতে হাতে কাজ করতে লাগলো। আমি আর তার দিকে তাকালাম না। তন্বীকে সে আর কাজ করতে দিলো না। তন্বীকে জোর করে কিচেন থেকে পাঠিয়ে দিলো।আমি পরোটা বানিয়ে দিলাম সে ভেজে দিলো। রাতের খাবার টেবিলে দিয়ে আমি খালামণি ও দাদীকে ডেকে আনতে গেলাম। তারা দুজন কিছু নিয়ে কথা বলছে। তাদের রুমের সামনে যেতেই আমি যা শুনলাম তাতে আমার হাত-পা ঠান্ডা হওয়া শুরু হলো। মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবী ঘুরছে। যেকোনো সময় মাথা ঘুরিয়ে পরে যাবো।
#চলবে
#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_53
#Writer_NOVA
সকালবেলা সারা ছাদে এদিক থেকে ঐদিকে পায়চারি করছি। গতরাতে যা শুনেছি তাতে আমার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। সকালবেলা থেকে মাথাব্যথা উঠে গেছে। তাতেও আমার এখন ভ্রুক্ষেপ নেই। মাথাব্যথার থেকে বেশি টেনশন আমাকে ঘিরে ধরেছে। কাপের বদলে কড়া লিকারের এক মগ চা খেয়েছি। কপালে এক হাত দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছি। কি করবো, কি হবে, কোথায় যাবো? কিছু বুঝতে পারছি না।
— বউ!
— ও ভাবী কি করো?
দুই পুঁচকের সুর পেয়ে নিজের কপালে জোরে একটা চাপর মারলাম। এমনি আমি টেনশনে শেষ। এই দুটো এসেছে আমাকে আরো জ্বালাতে। চোখ দুটো ছোট ছোট করে ওদের দিকে তাকালাম। দুজন মুখে শয়তানি হাসি রেখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
— এই তোরা এখানে কি করিস? সকালে ওঠে পড়াশোনা না করে ছাদে কি তোদের?
— তুমি কাকে বলো ভাবী? তুমি নিজেও তো পড়াশোনা না করে ছাদে ঘুরছো। আমাদের বলো কেন?
— এই সিফাত একদম মুখে মুখে কথা বলবি না। নয়তো অনেক খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু।
আমাকে রাগতে দেখে ইফাত মিষ্টি সুরে বললো,
— রাগো কেন বউ? সামনে বার্ষিক পরীক্ষা বলে কি আমরা তোমাকে আগের মতো ডিস্টার্ব করি বলো তো? তুমি জানো আব্বু কি বলছে?
— যা বলার বলছে। এখন আমার সামনে থেকে যা তো। তোদের সাথে ফালতু পেচাল পারার সময় নেই আমার। মাথা টেনশনে ফেটে যাচ্ছে আমার। এর মধ্যে এরা এসেছে ঢং-এর পেচাল নিয়ে।
— বউ শুনো না। আব্বু কি বলছে একটু শুনো?
মুখটাকে বাংলা পাঁচের মতো করে ইফাতের দিকে তাকালাম। তারপর কাঠ কাঠ গলায় বললাম,
— হুম বল।
আমি অনুমতি দেওয়ায় ইফাত খুশি হয়ে গেলো। আমার সামনে এসে খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,
—আব্বু বলছে বার্ষিক পরীক্ষায় আমি যদি প্রথম হই তাহলে তোমার সাথে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিবে। তুমি আমার বউ হয়ে যাবে। নুবা শুধু ইফাতের।
— আমার নাম নোভা নট নুবা🤦♀️।
— কি হলো বউ?
— ইফাত এদিকে আয়।
— পাপ্পি দিবা?
আমি রেগে বললাম,
— তুই আগে এদিকে আয়।
— না, তুমি মারবা।
— ঐ কোণার থেকে ইটটা নিয়ে আয়। তারপর জোরে একটা আমার মাথায় বারি দে। আমি মইরা যাই। ভাই আমি বাঁইচা আছি কেন? আমারে মাইরা ফালা।এতো ঝামেলা ভালো লাগে না।
— তুমি এসব কি বলো বউ🥺?
— আরেকবার বউ বললে আমার মাথায় আমি নিজেই ইট দিয়ে বারি দিবো। আমি আর বেঁচে থাকতে চাই না। এত জ্বালা ভালো লাগে না আমার।
সিফাত মুখ আটকিয়ে হেসে বললো,
— তুমি মরে গেলে আমার ভাইয়ের কি হবে ভাবী?
— ভালো চাইলে চোখের সামনে থেকে সর তো। আমার এত জ্বালাযন্ত্রণা ভালো লাগে না। আমাকে একটু শান্তি দে তো তোরা। আমি হাতজোড় করছি একটু শান্তি দে।
ইফাত আমার সামনে এসে চোখ দুটো টলমল করে বললো,
— এসব কথা বলো না। আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি। তুমি ছাড়া আমি বাঁচমু না।
— তোর ভালুপাসার গুষ্টি কিলাই। দূর হো সামনে থেকে। নয়তো তোদের মেরে আমি জেল খাটবো।
সিফাত মুখটাকে সিরিয়াস ভঙ্গি করে বললো,
— কি হয়েছে বলো তো ভাবী? তোমাকে আজ অনেক টেনশনে মনে হচ্ছে।
— কিছু হয়নি। তোর আম্মুর শরীর কেমন? হসপিটাল থেকে আসছে?
— আম্মু ভালো আছে ভাবী। আম্মু আর বাবু দুজনেই ভালো আছে। তাই ১৫ দিন পর যেতে বলছে।
— আলহামদুলিল্লাহ।
ইফাত নাক টেনে চোখের কোণে আসা পানি মুছে কাঁদো কাঁদো ফেস করে বললো,
— তোমার কি হইছে বউ? বলো না তোমার কি হইছে? তোমারে কেউ কিছু বললে আমাকে বলো। আমি তার খবর নিয়ে ফেলবো।
— হইছে থাম তুই। দুই আনার মানুষ বারো আনার ডায়লগ দিতে হবে না। এখন দয়া করে আমার সামনে থেকে একটু যা। আমাকে একা থাকতে দে।
সিফাত কনুই দিয়ে ইফাতকে খোঁচা মেরে ফিসফিস করে বললো,
— ভাবীর মুড ভালো না ভাইয়া। চলো এখান থেকে চলে যাই। নয়তো ধাওয়া দিবে। তুমি তো খাবেই সাথে আমাকেও খাওয়াবা।
ইফাত জোর গলায় বললো,
— আমার বউকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না।
আমি কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
— সত্যি তুই এখন যাবি না?
— না যাবো না।
— ভালো করে জিজ্ঞেস করছি যাবি কিনা বল?
— যাবো না।
— তুই যাবি না তোর ঘাড়েসুদ্ধ যাবে। তুই শুধু একটু দাঁড়া।
আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে ছাদের কোণা থেকে একটা ইট নিয়ে ওদের পেছন ধাওয়া করতেই সিফাত, ইফাতকে টেনে দরজা দিকে দৌড়ালো। আমি একবার ইটের দিকে তাকিয়ে মৃদু করে আমার কপালে দুটো বারি দিলাম। ঠাটিয়ে দুটো দিয়ে যদি নিজের পোড়া কপালটাকে পুরোপুরি ভেঙে ফেলতে পারতাম তাহলে বোধহয় একটু শান্তি পেতাম।
💖💖💖
দুপুরে…..
খাবার টেবিলে গোল হয়ে সবাই বসে আছি। এনাজ, তায়াং ভাইয়া, তন্বী আমি একপাশে বসেছি। আরেকপাশে দাদী, খালামণি বসেছে। এনাজ জোহরের নামাজের পর এখানে চলে এসেছে। আমি খাবার না খেয়ে প্লেটে আঁকিবুঁকি করছি। আসলে খাবার আমার গলা দিয়ে নামছে না। খালামণি তা খেয়াল করে বললো,
— কি রে তোর কি হয়েছে? তুই খাচ্ছিস না কেন?
আমি কিছুটা থতমত খেয়ে বললাম,
— কই খালামণি? আমি তো খাচ্ছি। তুমি খেয়াল করোনি।
— দেখছি তো কি খাচ্ছিস!
দাদী গ্লাসে পানি ঢেলে কিছুটা পানি খেয়ে বললো,
— নাতনী বিয়ের চিন্তায় খাওয়া ভুলে গেছে। আরে চিন্তা করো না সতিন তার ব্যবস্থা করে ফেলছি।
আমি চমকে তার দিকে তাকাতেই আমার সাথে সাথে তন্বী, তায়াং ভাইয়া ও এনাজও তাকালো। তন্বী ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
— কি বলছো তুমি দাদী?
— ওহ তুই তো কিছু জানিসই না তনিমা। দাঁড়া আমি সবাইকে বলছি।
এনাজ আমার দিকে বিস্মিত চোখে তাকালো। আমি জোর করে মুখে হাসি টেনে নিচের দিকে নজর দিলাম। তায়াং ভাইয়া বললো,
— কি এমন কথা গো ডার্লিং?
— বলছি, বলছি।
এনাজ চোখে, মুখে বিস্ময়ভাব রেখে দাদীকে বললো,
— মনে হচ্ছে খুব সিরায়াস কথা।
— অনেকটা তাই গো আমার দুই নাম্বার জামাই।
আমি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে চুপ করে রইলাম। দাদী কথাটা বলার পর যে কি হবে তা আল্লাহ মালুম। আমার হাত-পা কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেছে। একবার তায়াং ভাইয়ার মুখের দিকে আরেকবার এনাজের মুখের দিকে তাকালাম। দাদী কিছু সময় থেমে বললো,
— তানভীরের সাথে আমি নোভার বিয়ে দিতে চাই। বাঁচবো আর কয়দিন। তাই বড় নাতীর বিয়েটা তাড়াতাড়ি দিবো। যাতে তোদের ঘরের ছেলে-মেয়ে দেখেই মরতে পারি।
আমি তায়াং ভাইয়া ও এনাজের রিয়েকশন দেখার জন্য তাদের দিকে তাকালাম। দুজনের মুখ নিমিষেই রাগে লালবর্ণ ধারণ করলো। আমি জানতাম এমন কিছুই হবে। গতকাল রাতে তো আমি এই কথা শুনেই কোমায় যেতে যেতে ফিরে এসেছি। গতকাল রাতে তাদের ডাকতে গিয়ে আমি রুমের সামনে গিয়ে আমার ও তায়াং ভাইয়ার বিয়ের কথা বলতে শুনেছি। কিন্তু এখন কি হবে? দাদী আবার বললেন,
— নোভার বাবা-মায়ের সাথে সকালে কথা বলা আমার শেষ। তারা দু-একদিনের মধ্যে আসবে। তারা আসলে ঘরোয়াভাবে এই সপ্তাহেই দুজনকে বিয়ের সুতোয় বেঁধে দিবো। তারপর না হয় নোভার পড়ালেখা শেষে বড় করে অনুষ্ঠান করে উঠিয়ে আনবো।
তায়াং ভাইয়া জোরে চেয়ার টেনে উঠে বেসিনের কাছে চলে গেল। হাত ধুয়ে এক মিনিটও দেরী করলো না। নিজের রুমে চলে গেল। এনাজও খাবার ছেড়ে উঠে গেলো। হাত ধুয়ে গটগট পায়ে বাসার বাইরে চলে গেল। দাদী, খালামণি একে অপরের দিকে তাকিয়ে দুজনের যাওয়ার পানে অবাকভাবে তাকিয়ে রইলো।
দাদী বললো,
— কি হলো তানভীরের মা?
— আমিও তো বুঝলাম না মা।
তন্বী বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর আমি এক দৃষ্টিতে সামনের পানির জগের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এমনটাই হওয়ার ছিলো। একটু পর ভাইয়ার রুম থেকে ভাংচুরের শব্দ আসবে। আর আমার ওপর দিয়ে একটা বিশাল ঝড় যাবে।তন্বী আমাকে খোঁচা মেরে মিনমিন করে বললো,
— কি হচ্ছে এসব নোভাপু?
আমি ওর দিকে মলিন চোখে তাকিয়ে বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। মাথা আমার ভনভন করে ঘুরছে। চোখ মুখে অন্ধকার দেখছি। আমি বোধহয় এই যাত্রায় পটল তুলবো। এরপরের কাহিনিগুলো এত দ্রুত ঘটলো যে আমি পুরো স্তম্ভ হয়ে রইলাম। চোখের পলকে একেকটা ঘটনা ঘটতে লাগলো। বিয়েটা হলে চারটা জীবন নষ্ট। আমি তো তা হতে দিতে পারি না। কিন্তু বিয়েটা আটকাবো কি করে? এখন নিজের ওপর রাগ হচ্ছে। কেন যে গতকাল বিয়ের জন্য লাফালাম। নিজের কপাল নিজেই পুড়েছি। এখন ভালোই ভালোই বিয়ে ভাঙতে পারলেই আমি বাঁচি।
#চলবে।