শিশির ভেজা রোদ্দুর পর্ব-৫৭+৫৮

0
641

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_57
#Writer_NOVA

(নিচের কথাগুলো অবশ্যই পড়বেন)

সকালবেলা আম্মুর পা জড়িয়ে ধরে ফ্লোরে হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছি। মাদার বাংলাদেশ আমার হেব্বি রেগে আছে। তায়াং ভাইয়া খালামণির পা ধরে বসে আছে। দূরে দাঁড়িয়ে আমাদের কান্ড দেখে এনাজ,
এনাম মিটমিট করে হাসছে। আমরা দুজন যা শুরু করেছি তাতে হাসি আসারই কথা। কত কিছু করে পটানোর চেষ্টা করছি কিন্তু একটুও পটছে না। দাদী তো রেগে খালামণির রুমে দরজা আটকে বসে আছে। আম্মু বাজখাঁই গলায় বললো,

— নোভা, পা ছাড় বলছি।

— মাফ করে দাও না আম্মু।

— কে আম্মু, কিসের আম্মু? তোর আম্মু মরে গেছে। আমি যদি তোর আম্মু হতাম তাহলে এভাবে আমাদের মুখে চুনকালি মেখে পালাতে পারতি না।

— এখানে চুনকালি লাগানোর কি হলো? তোমাদের দুই বোনকে আমরা দুই ভাই-বোন আগেই বলছি আমরা এই বিয়ে করতে পারবো না। তাতো কোন গুরুত্ব দেওনি। ধরে-বেধে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছো। একবারও জিজ্ঞেস করেছো আমরা এই বিয়েতে রাজী আছি কিনা? আমরা কোন উপায় না পেয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছি।

আম্মু মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে রেখেছে। তায়াং ভাইয়া খালামণিকে বললো,

— তোমাকে আমি সব খুলে বললাম। তবুও তুমি জোর করে কেন আমাকে বিয়ে দিতে চাইলে বলো তো? দাদীর সাথে সাথে তোমারও মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

খালামণি সোফার উল্টোদিকে তাকালো। সেখানে পাশাপাশি ইভা ও তন্বী দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বললো,

— তোদের যারা পালাতে সাহায্য করেছে তাদের বিচার আগে হবে। তারপর তোদেরকে ধরবো।

খালামণির কথাটা বলতে দেরী তন্বী ও ইভার সেখান থেকে চম্পট দিতে দেরী নয়। ওদের দৌড় দেখে আমার ভীষণ হাসি পেলো। কিন্তু এখন হাসলে আমার কপালে শনি আছে। মামা,আব্বু সোফায় বসে আছে।আব্বুর মুখটা গম্ভীর হয়ে আছে।তার সামনে যাওয়া তো দূরে থাক তার দিকে তাকাতেও আমার ভয় করছে। আমি তায়াং ভাইয়াকে ঠেলা দিয়ে ইশারা করে আব্বুর সাথে কথা বলতে বললাম। তায়াং ভাইয়া ইশারায় মানা করলো। আমি এবার ওকে একটা জোরে চিমটি কাটলাম। ও আহ্ করে মৃদু চিৎকার দিয়ে আমার দিকে ক্রুর দৃষ্টি দিলো। আমি মোলায়েম একটা হাসি দিয়ে ওকে ইশারায় আবার অনুরোধ করলাম। ভাইয়া খালামণির পা ছেড়ে আব্বুর সামনে দাঁড়ালো।

— খালু আমার কিছু কথা ছিলো।

— হুম বলো।

— যদিও আমরা একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছি। তাও মাফ চাইছি। কথাগুলো আমাদের আগেই বলে ফেলা উচিত ছিলো। তাহলে আর এত ভেজাল হতো না।

— ভাগ্যিস ঘরোয়াভাবে বিয়ের আয়োজন করেছিলাম। নয়তো আমাদের মান-সম্মান যতটুকু ছিলো তাও হারাতাম।

— আমরা দুজন দুজনকে ভাই-বোনের চোখে দেখি। তাই বিয়েটা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। পালিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় পাইনি। আপনারা কেউ আমাদের কোন কথাই শুনতে চাইছিলেন না।

— দেখো বাবা তায়াং। আমারও আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে পছন্দ নয়। নোভার আম্মু তোমাকে অনেক পছন্দ করে। তাই তার জোড়াজুড়িতে এক প্রকার বাধ্য হয়ে বিয়েতে রাজী হতে হয়েছে। তবে আমি মন থেকে চাইনি বিয়েটা হোক। আমার বড় মেয়েকে আমি পাঁচজন নিয়েই বিয়ে দিবো। তবে এক জায়গায় আমারও ভুল হয়েছে। তোমাদের মতামতটা নেওয়া প্রয়োজন ছিলো। আমরা তোমাদের ওপর আমাদের মতটা চাপিয়ে দিয়েছি। এটা অন্যায় হয়েছে।

আব্বুর কথা শুনে আমার চোখ দুটো রসগোল্লা হয়ে গেলো। এক লাফে আম্মুর পা ছেড়ে সোফায় গিয়ে আব্বুকে জড়িয়ে ধরলাম। সামনের পাটির দাঁত দেখিয়ে আব্বুকে বললাম,

— শুকরিয়া আব্বু। যাক তুমি তো বুঝতে পেরেছো। আর কাউকে লাগবে না আমার। এবার একটু আম্মুকে এই সহজ বিষয়টা বুঝিয়ে দাও।

— তবে মা-মণি তুমি পালিয়ে যেয়ে কাজটা ঠিক করোনি।

— আমি জানি আব্বু। কিন্তু আর কোন আইডিয়া মাথায় আসেনি। সরি তার জন্য ☹️।

তায়াং ভাইয়া কিছু সময় থেমে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— আমি সবাইকে একটা কথা বলতে চাই।

খালামণি দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে কঠিন গলায় বললো,
— তোর কোন কথা শুনতে আমরা আগ্রহী নই।

— তোমাদের শুনতে হবে আম্মু। এই কথাটা আরো আগে বললে এতকিছু হতো না। তুমি তো জানো। কিন্তু তার নামটা জানো না। আমি তার নামটা একসাথেই সবাইকে জানিয়ে দিতে চাইছি।

মামা জিজ্ঞেস করলো,
— কি কথা তায়াং বাবা?

ভাইয়া কিছু সময় জোরে দম নিয়ে বললো,
—আমি নূরকে পছন্দ করি। বিয়ে করলে ওকেই করবো।

সবাই একসাথে চমকে তায়াং ভাইয়ার দিকে তাকালো। মামা,মামী দুজনেই বিস্মিত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। খালামণি জানতো ভাইয়া একটা মেয়েকে পছন্দ করে। কিন্তু সে যে নূর আপি তা জানতো না। তাই সেও চোখ বড় বড় করে ভাইয়ার দিকে তাকালো। তায়াং ভাইয়া চোখ দিয়ে ইশারা করে এনাজকে কিছু বলতে বললো। এনাজ সামনে এসে মাথা চুলকে বোকা ভঙ্গিতে আব্বুকে বললো,

— আঙ্কেল আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।

আব্বু ভ্রু জোড়া কুঁচকে এনাজের দিকে তাকিয়ে বললো,

— কি কথা?

— আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমি নোভাকে বিয়ে করতে চাই।

এনাজের কথা শুনেই আব্বুর কপালে ভাজ পরলো। মুখের হাসিটাও মলিন হয়ে গেলো। আমার ভয় করছে। আব্বু যদি এনাজকে মানা করে দেয়। আব্বু কিছু সময় চুপ থেকে বললো,

— তোমার আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে পাঁচজনকে নিয়ে এসো। আমি তাদের সাথে কথা বলবো।

— আঙ্কেল আমার কেউ নেই। আমি এতিম ছেলে। যারা আছে তাদের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। আপনি আমার বিষয় খোঁজ খবর নিন। তারপর আপনার যদি মনে হয় আমি খারাপ তাহলে রিজেক্ট করে দিবেন। কিন্তু আমাকে ভালো ছেলে হিসেবে চিহ্নিত করলে অবশ্যই আপনার বড় মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিতে হবে।

— আমি পাঁচজন ছাড়া তো আমার মেয়েকে দিতে পারি না। আমরা একটা সমাজ নিয়ে চলি বাবা। সবদিকে নজর রাখতে হয়। তাছাড়া এটা আমার আদরের বড় মেয়ে। দশ জায়গা দেখে এক জায়গায় দিবো। তায়াং-এর সাথে বিয়েতে আমি রাজী ছিলাম না। তাতো একটু আগে বললামই। একবার ও ভুল করেছে। তাই ওকে নিয়ে আমি একটু বেশি সেনসেটিভ।

— আঙ্কেল আপনার মেয়ে আমার সাথে থাকবে। ওর দায়িত্ব আমার। এখানে সমাজের কথা বললে তো হবে না। তাছাড়া আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি। এর থেকে বড় কোন কথা তো থাকতে পারে না।

💖💖💖

তাদের দুজনের কথার মাঝে আমরা কেউ কোন কথা বলছি না। সবাই নীরব দর্শকের ভুমিকা রাখছে। তাদের কথার চক্করে তায়াং ভাইয়ার নূর আপিকে পছন্দ করার কথাটা ধামাচাপা পরে গেলো। আব্বু মুখটাকে থমথমে করে এনাজকে বললো,

— দেখো এনাজ যা বলার তাতো বলেই দিলাম। তুমি তোমার পরিবারের পাঁচজন নিয়ে আসো। আমি তাদের সাথে বসে কথা বলবো। তারপর ভেবে দেখবো তোমার সাথে আমার মেয়ে বিয়ে দিবো কিনা। তুমি যদি আমার মেয়েকে ভালোবেসে সুখে রাখতে পারো তাহলে তোমার হাতেই নির্দ্বিধায় তুলে দিবো।

এনাজ শক্ত গলায় আব্বুর কথার প্রতিবাদ করে বললো,

— আমি তো পাঁচজন আনবো না আঙ্কেল। যারা আমার বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর একদিন একটা খোঁজ নেয়নি, একটু উঁকি মেরে দেখেনি আমরা কেমন আছি। বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি। কিভাবে চলছি কি করছি।তাদের কে কেন আনবো আমি? চাচারা এতিমের সম্পদটুকু কেড়ে নিয়েছে। এখন তাদের আনতে হলে আমার তেল মাখতে হবে, হাতে-পায়ে পরতে হবে।শুধুমাত্র বিয়ের জন্য তাদের হাত-পায়ে তো ধরবো না আমি। আমি তাদের মুখও দর্শন করতে চাই না। আমি এই বিষয়টা মানতে পারলাম না আঙ্কেল।

— তুমি পাঁচজন না আনলে তো আমি কথা এগুতে পারছি না। আমার মেয়েকে তো সারাজীবনের সিকিউরিটি দিয়ে কারো হাতে তুলে দিতে হবে। পরবর্তীতে আল্লাহ না করুক কোন দূর্ঘটনা ঘটলে আমাদের কপাল চাপড়াতে হবে।

— আঙ্কেল আমি এতিম বলে কি আমার জন্য এতো শর্ত জুড়ে দিলেন? আমার ওপর কি বিশ্বাস হচ্ছে না আপনার? তায়াং-কে জিজ্ঞেস করুন। ওর থেকে ভালো আমাকে আর কেউ চিনে না।

— যা বলার তাতো বলেই দিলাম। তুমি পাঁচজন নিয়ে আসো তারপর দেখা যাবে।

আমি শুকনো মুখে এনাজের দিকে তাকালাম। ওর মুখটা বিষন্ন লাগছে। তায়াং ভাইয়া চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কিছুটা সাহস যুগিয়ে আব্বুকে বললাম,

— আব্বু আমার কথাটা একটু শুনো প্লিজ……

পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই আব্বু হাত উঠিয়ে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

—একবার ভুল করেছো। ২য় বার এমন কিছু করো না। তোমার কোনটা ভালো সেটা আমাদের থেকে বেশি তুমি বুঝো না। তোমার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমি ও তোমার আম্মু এখনো বেঁচে আছে। নিজেকে বড় ভেবো না। তুমি আমাদের কাছে সবসময় ছোটই থাকবে।

আব্বু দ্রুত রুমে চলে গেলো।আব্বুর সাথে সাথে আম্মু,খালামণি, মামা মামীও চলে গেল। ড্রয়িংরুমে শুধু আমি, এনাজ, তায়াং ভাইয়া, এনাম। আমি ছলছল চোখে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। এনাজ আমার সামনে এসে টলমল চোখে বললো,

— এতিম হয়ে বোধহয় জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছি। আমাদের কদর কোথাও নেই। সব জায়গায় আমাদেরকে চোখের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয় আমরা এতিম। সবার সাথে টক্কর দেওয়া আমাদের বোকামি। আচ্ছা, আমরা কি ইচ্ছে করে এতিম হয়েছি? কেউ কি চায় ইচ্ছে করে এতিম হতে? এটা কি আমাদের দোষ?

আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
— কি বলছেন এসব? এতিম হওয়া দোষের কেন হবে? আপনাদের ভাগ্য আল্লাহ বাবা-মা রাখেনি। এতে আপনাদের দোষ কেন হবে?

—যদি দোষ না হয় তাহলে কেন সবক্ষেত্রে আমাদেরকে নিচু করে দেখা হয়। তোমার বাবার মতো বুদ্ধিমান মানুষের দ্বারা এমন কিছু আশা করিনি। সত্যি আমি আশাহত।

— এনাজ আমার কথাটা শুনেন।

— ব্যাস অনেক শুনেছি নোভা। এভাবে ডেকে এনে অপমান না করলেও পারতে। তোমার কথায় শুধুমাত্র এখানে এসেছিলাম। তুমিও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে আমি তোমার যোগ্য নই।

— কি উল্টো পাল্টা বকছেন? এখানে আমি কি করলাম? আপনি আমাকে শুধু শুধু ভুল বুঝছেন কেন? আমি কি বলেছি আপনি আমার যোগ্য নন?

— থাক আর কোন কথা শুনতে হবে না। আমি পাঁচজন নিয়ে আসতে পারবো না। আমার ওপর ভরসা করে যদি তোমার বাবা-মা বিয়ে দেয় তাহলে আমি সর্বদা চেষ্টা করবো তোমাকে রাণী করে রাখতে।

—একটু অপেক্ষা করুন আমি আব্বুকে মানিয়ে নিবো।ধৈর্য্য ধরুন সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি সব ঠিক করে ফেলবো। তবে আপনাকে আমার হাত শক্ত করে ধরে রাখতে হবে। মাঝপথে ছেড়ে দিলে চলবে না।

— আমি তোমার হাতটা ছেড়ে দেওয়ার জন্য ধরিনি। তোমাকে আমার প্রয়োজন। সবকিছুর বিনিময়ে হলেও তোমাকে আমার হাসিল করতে হবে। কিন্তু এমন হলে তো আমাকে হতাশা ঘিরে ফেলবে। আমার বেঁচে থাকা দায় হয়ে যাবে।উনি কথাটা অন্যভাবেও বলতে পারতো। আমার দিক বিবেচনা না করে উনি নিজের রায় দিয়ে দিলো। এটা আমি মানতে পারছি না।

আমার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এনামকে বললো,
—এনাম চল, আমাদের জন্য সবকিছু বরাদ্দ নেই রে ভাই। শুধুমাত্র এতিম হওয়ার কারণে বোধহয় আমরা এতো অপমানিত হয়। আমাদের ভালোবাসার কোন দাম নেই। সবচেয়ে বড় কথা আমরা এতিম।

এনাজ চোখের পানি মুছে আমার দিকে ঘুরে কান্না জড়ানো কন্ঠে বললো,

— তোমার বাবা এতো ঘুড়িয়ে-পেচিয়ে কথা না বলে আমাকে সরাসরি বলে দিতে পারতো কোন এতিম ছেলের সাথে তার মেয়েকে বিয়ে দিবে না।

আমি রেগে বললাম,
— তখন থেকে কি এতিম এতিম বলা শুরু করেছেন? আমার বাবা কি একবারো এই শব্দটা উচ্চারণ করেছে? এবার কিন্তু বেশি বুঝছেন আপনি।

— আমি বেশি নই সঠিকটাই বুঝছি। সেই ছোট বেলা থেকে একা একা জীবনযুদ্ধ করে এসেছি। কার কথা বলার ভঙ্গি কোনদিকে ইঙ্গিত করে তা বোঝার ক্ষমতা আমার আছে নোভা। তবুও যদি তোমার আব্বু আমাকে বিশ্বাস করে তোমাকে আমার হাতে তুলে দিতে পারে তাহলে আমাকে বলো। আমি খুশিমনে সব ভুলে তোমাকে গ্রহণ করতে চলে আসবো। আমার কোন অভিযোগ কিংবা দাবীদাওয়া থাকবে না। আমার শুধু তুমি হলেই চলবে।আসছি, ভালো থেকো।

এনাজ ওর ভাইয়ের হাত ধরে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। আমি তায়াং ভাইয়ার দিকে তাকালে সেও আমার দিকে কপাল কুঁচকে তাকালো। আমি ধপ করে সোফায় দাঁড়ানো থেকে বসে পরলাম। চোখ দুটো দিয়ে আপনাআপনি পানি পরছে।সারা পৃথিবী ঘুরছে আমার। এমনটা না হলেও পারতো!

#চলবে

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_58
#Writer_NOVA

২ দিন পর…..

কলেজের ক্যান্টিনে বসে আছি। সাথে তন্বী ও শারমিন। ওরা দুজন বকবক করছে আমি নিরব শ্রোতার মতো সব শুনছি। তবে ওদের কোন কথা আমার মাথায় গাঁথছে না। আমি তো গত দুই দিন আগের কথা চিন্তা করতে করতে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কি হবে সামনে তা জানি না।এদিকে এরা দুজন রাজ্যের পেচাল শুরু করছে। ওদের থামানো এখন আমার জন্য দায়। শারমিন কথা থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— কিরে তুই এমন স্টপ হয়ে আছিস কেন?

— এমনি।

— চিন্তা করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে।

— কিচ্ছু ঠিক হবে না। যদি না আমরা ঠিক করি।

— তাহলে ঠিক করে নে।

— মুখে বললে তো ঠিক হয়ে যায় না। এর জন্য ইচ্ছা, আগ্রহ, পরিশ্রমও চাই।

তন্বী আমার হাতের ওপর একটা হাত রেখে আস্বস্ত গলায় বললো,

— তুমি টেনশন করে শুধু শুধু নিজের চেহারার বেহাল দশা করো না। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমাকে ভেঙে পরলে চলবে না।

— আমি ভেঙে পরছি না তন্বী, আমি ভয় পাচ্ছি।

— কেন নোভাপু?

— শেষ অব্ধি আমরা একে অপরের হবো তো?

— আল্লাহ চাইলে সব ঠিক হয়ে যাবে। যদি তোমার ভাগ্যে এনাজ ভাইয়া থাকে তাহলে দশ বছর পর হলেও সে তোমারি হবে।

আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে তন্বীকে বললাম,
— কিন্তু সে তো আজকাল ইগনোর করছে তন্বী।

— এটা কখনো হতে পারে না নোভাপু। আমি এনাজ ভাইয়াকে সেই ছোটবেলা থেকে দেখছি। তাকে আমি ভালো করে চিনি। সে কখনো তোমাকে ইগনোর করতেই পারে না।

— গত দুদিন ধরে না হলেও আমি শত শত কল দিয়েছি। বারবার সুইচ অফ বলেছে। সে নিজ থেকে একটা কলও দেইনি।

— না জেনে কথা বলো না তুমি।

শারমিনও তন্বীর সাথে একমত হয়ে বললো,
— তুই না জেনে কথা বলিস না। এমনও তো হতে পারে তার মোবাইলের কোন সমস্যা হয়েছে।

আমি দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ওদের দিকে মলিন চোখে তাকিয়ে বললাম,

— জানি না। হতেও পারে। বাদ দে এসব কথা। তোরা কি খাবি বল?

শারমিন চোখ মুখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন একে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

— খাবারের কথা পরে। আগে বল আন্টি-আঙ্কেল কি চলে গেছে?

— হ্যাঁ, কেন?

— যাওয়ার আগে কিছু বলে যায়নি?

— না।

— আবার কবে আসবে?

—তায়াং ভাইয়ার কাবিনের সকল ব্যবস্থা হয়ে গেলে সামনের সপ্তাহে আসবে। ভাইয়ার বিয়েতে সবাই রাজী আছে। শুধু দাদী ছাড়া। দাদীকে রাজী করালে আগামী সপ্তাহে ওদের কাবিন হয়ে যাবে। তারপর খালু এলে অনুষ্ঠান করে উঠিয়ে নিয়ে আসবে।

— কিন্তু তন্বী যে বললো তোর নূর আপি নাকি রাজী না। তাহলে বিয়ে কিভাবে হবে?

— কে বলেছে রাজী না? আমার সাথে তায়াং ভাইয়ার বিয়ে ঠিক হয়েছিল বলে আপি খুব কষ্ট পেয়েছে। তাই এখন ভাইয়ার সাথে অভিমান করে আছে। যার জন্য সবাইকে বলে বেরুচ্ছে সে বিয়েতে রাজী নয়।

— ওহ আচ্ছা। আঙ্কেল, আন্টি এবার এলে তাদের সাথে তুই নিজে কথা বলে দেখিস।

— হুম তাই করতে হবে। তন্বী খাবার নিয়ে আয়।

— ওকে নোভাপু।

তন্বী চলে গেল। ও যাওয়ার পরপরই রওনক আমাদের সামনে হাজির। অনেক দিন পর তাকে দেখলাম। লাফ দিয়ে সামনের চেয়ারে আমার মুখোমুখি বসে বললো,

— আসসালামু আলাইকুম ভাবী। কেমন আছো?

আমি মুখে জোর করে হাসি ফুটিয়ে মিষ্টি করে সালামের উত্তর দিলাম।

— ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?

— আলহামদুলিল্লাহ। তা দিনকাল কেমন যাচ্ছে?

— যাচ্ছে ঠেলে ধাক্কিয়ে কোনরকম আপনার?

— এই তো ভালোই।

— হঠাৎ কি মনে করে আজ আমার কাছে?

— না এমনি। ভাবলাম অনেক দিন ধরে বড় ভাইয়ের হবু বউয়ের সাথে দেখা হয় না তাই একটু দেখা করে আসি।

আমি তাচ্ছিল্য করে বললাম,
— আর ভাইয়ের হবু বউ!

— এমন করে বললে কেন?

— নাহ কিছু না।

— আমি কিন্তু সবই জানি ভাবী।

— জানলে তো ভালোই।

— তুমি আমার থেকে বয়সে ছোট তাই তুমি করে বলছি। কিছু মনে করো না।

— নাহ মনে করার কি আছে?

— কিছু মনে না করলেই ভালো।খুদা লাগছে, কিছু খাওয়াও।

উনার কথা বলার ভঙ্গিতে আমার হাসি পেলো। অন্য সময় হলে এর সাথে এই খাওয়ানো নিয়ে নানা কথা শুনিয়ে দিতাম। কিন্তু আজ তা করতে মন সায় দিলো না। ধীর কন্ঠে বললাম,

— কি খাবেন বলুন?

রওনক চোখ দুটো গোল গোল করে বললো,
— আল্লাহ তুমি রাজী হয়ে গেলেন মিস ঝগড়ুটে সরি ভাবী? আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আমার সাথে ঝগড়া করবে। কিন্তু তা না করে রাজী হয়ে গেলে? আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না।

— আপনার কি ধারণা আমি সবসময় ঝগড়া করি😒?

— তাই ভাবতাম এতদিন।

💖💖💖

আমাদের কথার মাঝে তন্বী চলে এলো। তন্বী খাবারগুলো আমাদের সামনে রেখে আড়চোখে রওনকের দিকে তাকালো। দুজনের চোখাচোখি হতেই মিষ্টি একটা হাসি বিনিময় হলো। চোখে চোখে কিছু ইশারাও হলো। আমি দেখেও না দেখার ভান করে বসে রইলাম। আপাতত এসব বিষয়ে নিজেকে ফোকাস করতে ইচ্ছে করছে না। তন্বীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রওনক ওকে তাড়া দিয়ে বললো,

— এই চেয়ারে বসো।

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রুর কাছে চুলকে লাজুক ভঙ্গিতে রওনক বললো,

— আজ আসি ভাবী। আমাকে একটু উঠতে হবে। পাশের কলেজে আমাদের সভা আছে।

আমি ভদ্রতা বজায় রাখতে তাকে বললাম,
— সেকি খেতে না চাইলেন? না খেয়ে চলে যাবেন? এটা ঠিক নয় বসুন।

— আজ নয় আরেকদিন। আজ উঠি।

সবার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে রওনক চলে গেলো। ওর যাওয়ার পানে তন্বী এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ওর মুখটা অনেকটা মলিন দেখাচ্ছে। আমি ওর মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললাম,

— কি দেখিস তন্বী?

তন্বী কিছুটা চমকে আমার দিকে ফিরে মুখ কুচোমুচো করে বললো,

— কিছু না।

আমি কথা বাড়ালাম না। চুপচাপ খাবার খেতে লাগলাম। ওরা দুজন হাসি-ঠাট্টায় মেতে খাবার খাচ্ছে। আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখে খাবার মুখে পুরছি। হঠাৎ এনাজকে দেখতে পেয়ে কিছুটা চমকে উঠলাম। এনাজের সাথে রওনককে কথা বলতে আরেকদফা অবাক। রওনক হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলছে। এনাজ চুপ করে তা শুনছে। আমি দ্রুত খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। তন্বী, শারমিন একসাথে প্রশ্ন করে উঠলো,

— কোথায় যাস নোভা?

— যাচ্ছো কোথায় নোভাপু?

আমি দ্রুত সেখান থেকে যেতে যেতে ওদের দিকে পেছন ঘুরে হাত দেখিয়ে বললাম,

— একটু আসছি। তুই এখানেই থাকিস।

আমি দৌড়ে এনাজের দিকে গিয়েও তাকে নাগাল পেলাম না। রওনকের সাথে কথা বলে সে দ্রুত পায়ে এখান থেকে কেটে পরছে। আমি পেছন থেকে বেশ কয়েকবার ডাকলাম।

— এনজিও সংস্থা। মিস্টার এনাজ! ও হ্যালো।

উনি একবারের জন্যও পেছনে তাকালো না। দ্রুত পায়ে কলেজের গেট পেরিয়ে বাইরে চলে গেল। আমি আরো কয়েকবার ডাকলাম। কিন্তু সে সাড়াও দিলো না, পেছনে ফিরেও তাকালো না। গেটের বাইরে গিয়ে বাইকে উঠে চাবি ঘুরিয়ে স্টার্ট দিলো। তারপর সে একটানে চলে গেলো। আমি দৌড়ে গেইটের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। যতখন অব্দি তার বাইক দেখা গেলো ততক্ষণ পর্যন্ত ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। আমাকে ইগনোর করলো সে। আমি তো অনেক জোরেই তাকে ডেকেছি। দূরের মাঠের ছেলেগুলো আমার কন্ঠ শুনে অদ্ভুত চাহনিতে তাকিয়ে ছিলো। কিন্তু সে এত কাছে থেকে শুনতে পায়নি। বিষয়টা কিরকম সন্দেহজনক। উনি বোধহয় সত্যি আমাকে ইগনোর করা শুরু করেছে। নয়তো একবারের জন্য হলেও ফিরে তাকাতো। কখনও তো এমনটা হয়নি। ইগনোর না করলে আজ এমনটা হলো কেন?

ধীর পায়ে পুনরায় কলেজের ভেতর প্রবেশ করলাম। সামনেই রওনককে দেখতে পেলাম। ওকে দেখে আমি ওর দিকে এগিয়ে গেলাম।

— রওনক আপনার সাথে আমার একটু কথা ছিলো।

রওনক কয়েকটা ছেলের সাথে কথা বলছিলো। আমার দিকে ঘুরে কপাল কুঁচকে তাকালো। তারপর সাথের ছেলেগুলোকে বিদায় জানিয়ে আমাকে বললো,

— হ্যাঁ ভাবী বলো।

— কথায় কথায় ভাবী বলেন না তো ভালো লাগে না।

আমি কঠিন গলায় কথাটা বলতেই রওনক মুচকি হেসে বললো,

— ভাইয়ার ওপর রাগ করেছো?

— নাহ, রাগ করবো কেন?

— ওহ তাহলে অভিমান হয়েছে।

— কিছুই হয়নি।

মুখে স্বীকার না করলেও তার ওপর আমার প্রচন্ড অভিমান হয়েছে। উনি তো কখনও এমন করেননি। অন্য সময় হলে নিজে আমার সাথে দেখা করতে চলে আসেন। আজ আমি ডাকলাম আর উনি আমাকে এড়িয়ে চলে গেলো। অভিমান হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। রওনক আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বললো,

— তুমি কি জানি বলবে!

— হুম বলবো তো।

— কি?

— তোমার ভাইয়া তোমার সাথে কি কথা বললো?

— ওই তো তোমার খোঁজ খবর নিলো। আমাকে তোমার কাছে সেই পাঠিয়ে ছিলো।

আমি অবাক চোখে জিজ্ঞেস করলাম,
— সে তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়েছে?

— হ্যাঁ, সকালে কল করে কলেজে আসতে বললো। আমি তো আজ আসতাম না। শুধু তোমার খবর নিতে ভাইয়ার অনুরোধে আসতে হলো।

— সে তো কলেজে এসেছিলো। তাহলে নিজে এসে কেন জিজ্ঞেস করলো না।

— সেটা তো আমি জানি না। তুমি তাকে জিজ্ঞেস করো।

— তাকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে তো আমায় ইগনোর করে চলে গেলো। কতবার ডাকলাম একটু শুনলো না।

রওনক অবিশ্বাস্য কন্ঠে চোখ দুটো বড় বড় করে বললো,

—এনাজ ভাই তোমাকে ইগনোর করছে এটা আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না। তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। ভাই কখনো তোমাকে ইগনোর করবে না।

— কিন্তু এটাই হয়েছে।

— রওনক যাবি না সভায়?

পেছন থেকে একটা ছেলে রওনককে চেচিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করলো। রওনক উঁকি মেরে তার দিকে তাকিয়ে বললো,

— হুম যাবো তো। একটু দাঁড়া আমি আসছি।

— ওকে আয়। আমি এখানে আছি।

রওনক আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
— আমাকে যেতে হবে। আমি তোমাদের বিষয়ে নাক গোলাতে চাইছি না। আমি চাই তোমাদের মধ্যকার যাবতীয় কিছু তোমরা নিজেরাই সমাধান করে নাও। আসছি।

রওনক আমাকে সাইড কাটিয়ে সামনের দিকে চলে গেল। আমি শূন্য দৃষ্টিতে দূরের মাঠটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সেখানে কয়েকজন ছেলে-মেয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে। টুপ করে চোখের কর্ণিশ বেয়ে দু ফোঁটা জল অবাধ্য হয়ে ঝড়ে পরলো। আমি শত চেষ্টা করেও তাদেরকে আটকাতে পারলাম না।

#চলবে