#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|১৮|
-“গানটা সুন্দর, তবে আওয়াজটা নয়। কাইন্ডলি এর মতো আর কোনো গানকে খেয়ে দেবেন না।”
অপমান! রাগে গা শিরশির করে উঠল প্রিয়র। ত্বরিতে পিছে ঘুরে বলে উঠল,
-“ভাই, আপনার সমস্যা কী বলবেন? গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা? বুক জ্বালাপোড়া করে? ওমিপ্রাজল খান। তা না করে, আমার পেছনে লাগতে এসছেন ক্যান?”
শরৎ কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে পিছু ঘুরে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। প্রিয়র রাগ আরও কয়েক ধাপ বেড়ে গেল। এসবের মানে কী? অভদ্র লোক! কেউ প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে হয়, সে তো তা দিলো না, উলটো এড়িয়ে গেল! অমানবিক লোক কোথাকার! তিনবার মুখোমুখি হয়েছে, তার মধ্যে দুইবারই অপমান করে বসল। ছি ছি ছি! জঘন্য!
প্রিয়র মুখের ভেতরটা তিতকুটে হয়ে এলো। শরৎ দু-কদম এগিয়ে আবার পিছু মুড়ল। প্রিয়র পরনে একটা মাল্টি কালারের ঘাগড়া আর কালো শর্ট কামিজ, ওড়নাটা চাদরের মতো করে পেচিয়ে রেখেছে। চুলগুলো কাটা দিয়ে বেঁধে রাখা। সামনে দিয়ে দু’গাছি চুল বেরিয়ে আছে। শুক্লা চতুর্থীর ক্ষীণ আলোতে তার ছোট পান্তুয়ার ন্যায় গোল মুখটি ভালোভাবেই দৃশ্যমাণ। ঠোঁট আর চিবুক সংলগ্ন ভাঁজটা মারাত্মক গভীর। চাঁদের আলোয় প্রিয়র ক্ষণে ক্ষণে ফুঁলে ফেঁপে ওঠা ছোট নাকটা দেখে শরৎ হাসল। তার দিকটা আঁধার, সেই হাসি অদৃশ্য, প্রিয় দেখতে পেল না। তবে বুঝতে পারল, ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। আবার কিছু বলতে যাবে, তার আগেই শরৎ বলে উঠল,
-“শোধ নিচ্ছি, নেব, নিতে থাকব।”
কপাল কুঁচকে উঠল প্রিয়র,
-“কীসের শোধ?”
-“মনে নেই কিছুই?”
অবাক হয় শরৎ। প্রিয়র আসলেই মনে নেই কিছু। প্রিয় ঠোঁট সামান্য উলটে দু-ধারে মাথা নাড়ে। উত্তপ্ত শ্বাস ফেলে শরৎ,
-“ডাবল শোধ হবে এবার। বি রেডি।”
চলে গেল শরৎ। প্রিয়ও আর কথা বাড়াল না। রিধিমার থেকে জেনে নেবে, ছোটবেলায় কী কাহিনি ঘটিয়েছিল। প্রিয় এসএসসির ছুটিতে আসার পর শরতের দেখা পায়নি, শরৎ তখন ঢাকায় ছিল। দেখা হলে এর আগেই হয়েছে। আর এর আগে এসেছিল সে, যখন ক্লাস টু-তে পড়ত, শরৎ ক্লাস নাইন-টেনে। শেষ দেখাটা হিসেবমতো তখনই হওয়ার কথা। কিন্তু তখন কী হয়েছিল? কীসের শোধ?
আপাতত ওসবে আর প্রিয় মাথা ঘাটাল না। তবে মন খারাপ হয়ে গেল। কী উপভোগ্য একটা পরিস্থিতি কীভাবে নষ্ট করে দিলো লোকটা! অসহ্য অসহ্য অসহ্য!
______
রাত তখন সাড়ে এগারোটা ছুঁইছুঁই। করিডোর ঘুরে, রুমে শুয়ে-বসে, ফেসবুকিং করে যখন প্রিয় বিরক্ত প্রায়। তখন গিয়ে বুকটা হু হু করে কেঁপে উঠল। কয়মাস আগেও, এই সময়টা তার শ্রেয়ানকে ভেবে যেত। শ্রেয়ানের উপস্থিতি, অনুপস্থিতি সবটাই তার সমস্ত ধ্যান-জ্ঞানে কাবু করে ফেলত। প্রিয় ভেবে পায় না, কাউকে মনে ঠায় দিতে এত সময় লাগলেও মন থেকে উঠিয়ে দিতে কয়েক ক্ষণও লাগে না কেন?
ভেতর থেকে কেমন অসহনীয় লাগছে। একবার মনে হচ্ছে, সব কিছু ভুলে গিয়ে আবারও ফিরে যাবে। তো আবার লাগছে, কীজন্য ফিরবে? কার জন্য ফিরবে? কার কাছে ফিরবে? সেই পুরুষের কাছে? যার ভেতর তার জন্য নূন্যতম সম্মানবোধ নেই, যে তাকে বন্দী করে রাখতে চায়? তার কাছে ফিরবে? প্রিয় ছিল উড়নচণ্ডী। শ্রেয়ান তার পাখা কেটে, পায়ে শেকল জড়িয়ে সামনে আটকে রাখতে চায়। প্রিয় তো তা চায় না। প্রিয় চায় ডানা মেলে বাঁচতে। কী সুন্দর আকাশ! প্রিয় সেই আকাশে উড়ে-বেড়াতে চায়। এক পুরুষের একচ্ছত্র সম্পত্তি হিসেবে সে কখনই নিজেকে মানতে পারে না।
কিন্তু মন খুব খারাপ একটা জিনিস। মন তাকে ফিরতে বলে। মন তাকে বন্দিনী হতে বলে। মন বলে, আরেকবার সেই পুরুষকে ভালোবাসতে। মন বলে, তাকে আরেকবার জড়িয়ে ধরে ভালোবাসি বলতে। কী সাংঘাতিক! প্রিয় তা পারছে না, প্রিয় তা চাইছে না। প্রভুত্ব বিষয়টা সুন্দর না। শ্রেয়ানের মধ্যে এর অভাব নেই। সে কৃতিত্ব ফলাতে চায় সর্বক্ষণ।
প্রিয়র মনে নেই, যতটা সে সম্পর্কের শেষ বছরটায় কেঁদেছে, ততটা কান্না তার পুরো জীবনের একাংশেও ছিল কি না!
“আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান
বিষের তরে সঁপেছি প্রাণ…
যতই দেখি তারে ততই দহি,
আপন মনোজ্বালা নীরবে সহি,
তবু পারি নে দূরে যেতে, মরিতে আসি,
লই গো বুক পেতে অনল-বাণ।”
প্রিয় খাটে হেলান দিয়ে শুয়ে সিলিংয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে মিনমিনে স্বরে গানটি গাইল। নাহ! ভালো লাগছে না আর। ত্বরিতে খাট থেকে উঠে বসল। এক কোণায় পরে থাকা সিল্কের ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ফোন হাতে বেড়িয়ে পড়ল। একবার ভাবল, নীহিনকে ডেকে নিয়ে বাইরে বের হবে। পরক্ষণেই ভাবল, থাক। এখন না, আরেকটু রাত বাড়লে তারপর যাবে। এখন কোথায় যাওয়া যায়? পশ্চিমে সিঁড়িঘর। প্রিয় ধীরপায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল।
মৃদুমন্দ আলোয় প্রিয় সিঁড়িগুলো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। তবে এ-পাশটা পরিচ্ছন্ন বিধায় চাঁদের এত নরম আলোটা কিছুটা হলেও দিক বোঝাতে সাহায্য করছে। প্রিয়র আলসেমিবোধের কারণে আর ফোনের টর্চ অন করা হলো না।
সিঁড়ি দিয়ে যত কদম এগোচ্ছে, ততই উল্লাসিত আওয়াজ তার কানে তীব্রতরভাবে ধাক্কা খাচ্ছে। প্রিয় ধীর কদমে গিয়ে একদম দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে পড়ল। সে লক্ষ করল ছাদের একটা কোণা জুড়ে রাজত্ব চালাচ্ছে বাড়ির ইয়াং জেনারেশন। প্রিয় সবাইকে লক্ষ করল। নাহ, নীহিনের কথা অনুযায়ী অত মানুষও নেই এখানে। রিধিমা এক কোণায় বসে আছে। তাকে ঘিরে নীহিন, নিধি, আরুশি আর দু’জন বসে আছে। উলটো দিকে আসিফ আর তিনটে ছেলে আছে। তিনজনের একজনের মুখটা চেনা, তবে নাম মনে করতে পারল না। বোধহয় নীহিনের ছোট ভাইটা হবে। আর বাকি দু’জনকে ছেলে-মেয়েকে চিনল না, ফুপাতো ভাই-বোন হবে হয়তো।
রিধিমা তখন বলল,
-“চলো গানের কলি খেলি।”
তারপরই পিছে ঘুরে ডেকে উঠল,
-“এই ভাইয়া! তোমার হয়নি?”
প্রিয় রিধিমার দৃষ্টি অনুসরণ করে ওদিকে তাকাল। পরনে হালকা রঙের টি-শার্ট আর গ্রে ট্রাউজার। বাঁ হাত পকেটে ঢোকানো, ডান হাতটি কানে ফোন চেপে ধরা। রিধিমার ডাকে সে পকেট থেকে বাঁ হাতটি বের করে পাঁচ আঙ্গুল দেখিয়ে ইশারায় বোঝাল,
-“আর পাঁচ মিনিট।”
তারপর নিজের ফোনালাপ কন্টিনিউ করতে লাগল। এই রাতের প্রায় বারোটার দিকে অবশ্যই কোনো অফিশিয়াল আলাপন কেউ করে না। প্রিয়র ধারণা, শরৎ এখন তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছে। যা ইচ্ছা করুক। কথা বলুক, নাচুক, লাফাক, প্রয়োজন পড়লে ছাদ থেকে লাফ দিক; ওর কী? কিচ্ছু না।
প্রিয় মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। তখনই নিধি ডেকে উঠল,
-“প্রিয় আপিইইইইইই! এদিকে এসো।”
প্রিয় থতমত খেয়ে ওদিকে তাকায়। আসরের সবাই এখন তার দিক চেয়ে আছে। নিধির গালে এখন একটা কম বল প্রয়োগের চড় বসাতে পারলে মনটা শান্ত হতো। ফাজিল মেয়ে, এভাবে ডাকা লাগে?
প্রিয় অপ্রস্তুত হয়ে হাসল। সেদিকে এগিয়ে গেল। নীহিন একটু সরে বসে রিধিমার আর তার মাঝখানে জায়গা তৈরি করে দিলো। প্রিয় গিয়ে সেখানে বসল।
কিছুক্ষণের মধ্যে শরৎ নিজেও এগিয়ে এসে ঠিক তার সামনে বসে পড়ল। সন্ধ্যা-রাতের সেই কথা মনে পড়তেই প্রিয় মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। বাধ্য হয়েই প্রিয়কে ওদের সাথে রাত আড়াইটা অবধি থাকতে হলো।
এখানে থমকে সময়
তবুও আবেগ ছুঁয়ে যায়
এই দূর সুদূর সীমানায়
গল্প বলে মেঘ ছায়ায়, শোনো।
এখানে অন্ধকারে,
তবু হাওয়া বারে বারে
এই গান আহ্বানে হারায়
তোমার চোখের তারায়, দেখো।
গান গাওয়া-গাওয়ি শেষ হওয়ার পর ছেলেরা সেখানেই চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল, মেয়েরা উঠে পড়ল চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। প্রিয় নীহিনকে এক ফাঁকে বলে ওঠে,
-“সোজা আমার রুমের সামনে দাঁড়াবে।”
নীহিন মাথা নেড়ে যায়। প্রিয় নামতে গেলেই সিঁড়িঘরের ওখানে একটা ডাক পড়ে। পিছে তাকায় সে। দেখতে পেল সেই মুখচেনা ছেলেটা। প্রিয়কে জিজ্ঞেস করল,
-“তোমার নাম কী?”
প্রিয় নরম গলায় জানায়,
-“প্রিয়শ্রী। রিধিমার কাজিন আমি।”
-“ওয়েএএট! তুমি প্রহরের সিস্টার?”
প্রিয় ওপর-নিচ মাথা নাড়ে। ছেলেটা নিজ থেকে জানায়,
-“আমি নিশান। রিধিমা আপুর বড়ো চাচার ছোট ছেলেটা। মনে নেই?”
প্রিয়র মনে আছে, তবে খেয়ালে ছিল না। সে-বার এসএসসির ছুটিতে দেখা হয়েছিল, ওরা সেম ব্যাচের। প্রিয় বলল,
-“মনে আছে।”
ত্বরিতে নিশান বলে উঠল,
-“ইউ ক্যান কল মি শান। সবাই তাই ডাকে।”
-“আচ্ছা।”
প্রিয় চলে যেতে নেয়। নিশান ওকে আটকায়। গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে বলে ওঠে,
-“তুমি খুব সুন্দর। আমার তোমাকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে।”
প্রিয় চকিতে তাকায়, এটা কী বলল? জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-“হুহ?”
যেন কিছুই বোঝেনি৷ চাঁদের মৃদুমন্দ আলোয় প্রিয় নিশানের হাসিটা দেখতে পেল। সেই হাসিটা খুব চওড়া। সে এবার প্রপোজালটা দিয়েই ফেলল,
-“উইল ইউ বি মাই ….”
চলবে…
#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|১৯|
-“তুমি খুব সুন্দর। আমার তোমাকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে।”
প্রিয় চকিতে তাকায়, এটা কী বলল? জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-“হুহ?”
যেন কিছুই বোঝেনি৷ চাঁদের মৃদুমন্দ আলোয় প্রিয় নিশানের হাসিটা দেখতে পেল। সেই হাসিটা খুব চওড়া। সে এবার প্রপোজালটা দিয়েই ফেলল,
-“উইল ইউ বি মাই ভাবি?”
ছেলে বলে কি? এত বছর পর প্রথম সাক্ষাতে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস না করে দিলো প্রপোজাল, তাও আবার ভাবি হওয়ার। প্রিয়র হাসি পেল। মানে পুরোই যা-তা! এই পর্যায়ে মিষ্টি করে নিশান নিজেও হাসল,
-“জাস্ট কিডিং। আসলে তোমাকে খুব কিউট দেখাচ্ছে। আগে তো ছিলেই এক কিউটের ডিব্বা, আর এখন পুরোই গোডাউন। তাই ভাবলাম, ভাইয়ের দোহায় দিয়ে ধরে-বেঁধে রেখে দিই।”
প্রিয় হাসি থামিয়ে বলে,
-“তোমার কমনসেন্স আগের মতোই লো-ক্লাসে স্ট্যান্ড করছে, একটুও উন্নতি হয়নি।”
-“ইনসাল্ট! ব্রোকেন হার্টের ইমোজি।”
-“আচ্ছা, পরে কথা হবে। থাকো।”
-“ঠিকাছে।”
প্রিয় নিচে চলে আসে। রুমের সামনে এসে দরজার চিপায় নীহিনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলো। দুইজন মিলে প্রায় মিনিট দশেক অপেক্ষা করল। সবাই যার যার রুমে চলে যাওয়ার অপেক্ষা।
দশ মিনিট পর প্রিয় নীহিনের হাত ধরে বলল,
-“চলো যাই।”
ভেতরের সিঁড়ি না ব্যবহার করে বাইরের সিঁড়ি ব্যবহার করল ওরা। বাইরের সিঁড়িটা বাড়ির পেছনের দিকের। নীহিন প্রশ্ন করল,
-“এখন বলো কই যাব?”
-“বাড়ির পেছনে।”
-“এ না!”
আঁতকে উঠল নীহিন। কপাল কুঁচকে প্রিয় জিজ্ঞেস করল,
-“কেন না?”
-“দিনের বেলাতেই ওখানে যেতে ভয় লাগে, আর এখন মাঝরাত!”
-“ভয় লাগবে কেন? বাঘ আছে ওখানে?”
-“না, তবে অন্ধকার ওদিকটা।”
-“রাতের বেলা অন্ধকারই থাকার কথা।”
-“দিনের বেলাতেও অন্ধকার। গাছগুলো অনেক ঘন প্রিয়দি, আলো আসে না।”
-“না এলো। চলো যাই।”
-“না গেলে হয় না, প্রিয়দি?”
-“হয় না।”
-“কেন হয় না?”
-“কারণ আমার ইচ্ছে করেছে। এখন না গেলে আমার ঘুম আসবে না রাতে।”
-“ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুম দাও, প্রিয়দি।”
প্রিয় দাম্ভিক গলায় বলল,
-“নীহিন, তোমার যাওয়ার প্রয়োজন নেই, তুমি বাড়ির ভেতরে যাও। আমি একাই যাব।”
নীহিন পর পর বড়ো দুটো শ্বাস টেনে হেসে বলল,
-“রাগ করো কেন? এই তো যাচ্ছি, চলো।”
নীহিন প্রিয়র হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে। প্রিয় ঠোঁট চেপে হেসে এগোতে লাগে। ফোনের টর্চটাও অন করল। শুরুতে একটু ফাঁকা জায়গা, এরপর ফল বাগান। হাঁটতে হাঁটতে আরও কিছুটা আসার পর বাগান শেষ, এখানে ইট দিয়ে চারফুট উঁচু দেয়াল। বাড়ির মূল সীমানাটাও এখানেই বোধহয় শেষ।
নীহিন তা দেখে বলল,
-“প্রিয়দি, রাস্তা শেষ। ওদিকে যাব কীভাবে? চলো ফিরে যাই!”
-“একদম না।”
-“যদি সাপ থাকে?”
-“থাকলে থাকবে। তুমি তো কোনো নাগিনীর নাগের সাথে লাইন মারোনি যে বদলা নিতে ফোনা তুলে ফোঁসফোঁস করতে করতে ছোবল মারবে! নাকি লাইন মেরেছ?”
প্রিয় সরু চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করে। নীহিন থতমত খেয়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে ডানে-বাঁয়ে মাথা নেড়ে বলে,
-“না না! কী বলো। মনুষ্য প্রজাতির সাথেই লাইন-টাইন মারতে পারিনি, সর্প তো বহুত দূরের এলাকা।”
প্রিয় হাসে,
-“তাহলে জাস্ট চিল করো। এলে আসবে, দেখবে, ভাল্লাগলে একবার চুমু খাবে, তারপর চলে যাবে। প্যারা খেয়ো না।”
নীহিন প্রিয়র এমন যুক্তিতে চুপ মেরে গেল। প্রিয় এদিক-ওদিক লক্ষ করে দেখল ওরা এগিয়ে যেতে লাগল। কিছুটা পর ভাঙা দেয়াল দেখতে পেল, ইটগুলোও কেমন আলগা হয়ে আছে। প্রিয় হাত দিয়ে টেনে বের করার চেষ্টা করল। সফলও হলো। ইট বের করা ফাঁকা জায়গার ওপাশটায় আঁধার। প্রিয় আলগা ইটগুলো যতটুকু পারে সাবধানতা অবলম্বন করে সরিয়ে ফেলল। তারপর নীহিনকে বলল,
-“একটা বৃত্তকে লক্ষ করেছ? বিন্দুকে কেন্দ্র করে চলমান পরিধির সীমা যেখান দিয়ে শুরু হয়, সেখানে এসেই থামে। আবার শুরু হয়, আবার শেষ। উপসংহার থেকেই নতুন কিছুর সুচনা ঘটে। চক্রের মতো চলতেই থাকে। পৃথিবীও গোল, জীবনটাও.. কোনো রাস্তারই শেষ নেই। ইচ্ছা থাকলে রাস্তা এভাবেই বের হয়।”
প্রিয় নীহিনের দিকে তাকায়, ওর মুখটা অস্পষ্ট। প্রিয় হেসে বলে,
-“মৃত্যুকে অন্ত ভাবলে, তুমি ভুল। সেটা শুরু, অনন্তকালের জীবনের শুরুটা কেবল মৃত্যু।”
প্রায় মিনিট দশেক হাঁটা লাগল আরও। নিস্তব্ধতায় মাটিতে পড়ে থাকার শুকনো পাতায় পা পড়ায় খচখচে শব্দটা বিকট শোনাচ্ছে। মাঝে মাঝে শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। ঝিঁঝিঁর ডাকটাও এর মধ্যে মিশে আছে। ধীরে ধীরে ঘন গাছগাছালির পরিমাণটা কমে আসছে। একসময় কোত্থেকে যেন আলোর রেখা ধরা দিলো, সেই আলোতে ওদের রাস্তা অল্প পরিষ্কার। খেয়াল করল আলোর উৎসটা ডানে থেকে আসছে।
প্রিয় নীহিনের হাতটা আরও শক্ত করে চেপে ধরে ডান দিকে যেতে যেতে বলল,
-“মেবি দারুণ কিছু পেতে চলেছি।”
নীহিনের মনের ভেতর ভয়। সে দারুণ কিছু চায় বা না-চায়, খারাপ কিছু ভুলেও চায় না। মনে মনে দোয়া-দরুদ পড়তে ব্যস্ত। আরেকটু এগোনোর পর আর গাছ নেই। বাঁকা চাঁদ প্রতিফলিত দিঘি, কামিনী ফুলের সুবাস, ঝিঁঝিঁর আওয়াজ আর আকাশ সমান প্রশান্তি। প্রিয়র হুট করেই মন থেকে উঠে গেল এতকালের যন্ত্রণাগুলো। নীহিনের মুখেও চমক। এই জায়গাটা অনেক সুন্দর। সে এর আগে কেন দেখেনি? কেন আসেনি? কত সুন্দর একটা জিনিস মিস করে গেল!
আলগোছে সে প্রিয়র দিকে তাকায়। দেখতে পায়, প্রিয় মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় সোজা তাকিয়ে আছে। চেহারার অভিব্যক্তিতে ভরপুর বিস্ময়। প্রিয় বিরবির করছে। নীহিন শোনার তাগিদ দেখাল, প্রিয়র কথাটা সে শুনতেও পেল,
-“শত-সহস্র জনম বাঁচার ইচ্ছে জাগছে আমার…”
______
সকালের খাবার শেষে প্রিয় রিধিমার রুমের দিকে এসেও, রাস্তা ঘুরিয়ে শাহানাজের রুমে চলে গেল। শাহানাজ কাপড় ভাঁজ করছিলেন, দরজা খোলা। প্রিয় নক করে বলল,
-“বড়োমা, আসি?”
শাহানাজ দরজার দিকে এক পলক তাকালেন। ঠোঁটের কোণায় তাঁর কিঞ্চিৎ হাসি। পাঞ্জাবিটা ভাঁজ করতে করতে বললেন,
-“এসো!”
প্রিয় এগিয়ে এসে শাহানাজের সামনের বিছানায় বসে পড়ল,
-“বড়োমা, জানো তোমাদের কত মিস করেছি?”
-“ওমা তাই?”
-“হুম হুম।”
-“তাহলে এত বছরে এলে না কেন?”
-“ব্যস্ততা! পড়াশোনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। ফ্রি টাইমটুকু নিজেকে দিতাম। তাছাড়া ঘোরাফেরার মানসিকতাও ছিল না।”
সামান্য মিথ্যে বলল প্রিয়। ব্যস্ততা পড়াশোনার না-কি অন্য কিছুর, তা খুবই সুন্দরভাবে গোপন করে গেল। শাহানাজ ভাঁজ করা কাপড়গুলো আলমারিতে তুলে এসে বাকিগুলোয় হাত লাগালেন। কাজে মন তাঁর। মাঝে মধ্যে প্রিয়র দিকেও তাকাচ্ছেন। প্রিয়র জবাবের প্রেক্ষিতে তিনি বললেন,
-“বুঝলাম।”
-“কী বুঝলে?”
-“এ-ই যে আপনি অত্যাধিক ব্যস্ত মানুষ। আমাদের মনে করার সময় কোথায়?”
প্রিয় খিলখিল করে হেসে উঠল, উঠে গিয়ে একহাতে আলতো করে শাহানাজকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“ব্যস্ততা টেম্পারারি। আপনারা পার্মানেন্ট।”
-“বুঝেছি।”
-“এবার কী বুঝলে?”
-“রাজকন্যা প্রিয়শ্রীর মুখে কথার খই ফুটেছে।”
প্রিয় আরেকদফা হেসে উঠল,
-“বড়োমা, তুমি আগের মতোই কিউট আছ! কত্ত ভালো লাগে তোমাকে আমার বোঝাতে পারব না।”
-“আর তুমি আগের মতোই দুষ্ট আছ। আমার ছেলেটাকে তো জ্বালিয়ে ভাঁজা-ভাঁজা করে ফেলতে।”
-“কীভাবে?”
-“মনে নেই, না? ছোটবেলার কথা তো। মনে থাকার কথাও না।”
প্রিয় সহমত,
-“তুমি বলো, কী কী করতাম।”
শাহানাজ হাসলেন। প্রিয় লক্ষ করল শাহানাজের হাসিটা একদম নীহিনের মতো। হাসলে নীহিনের ঠোঁটের দুইপাশে নিচের দিকে ছোট গর্ত দেখা যায়। শাহানাজেরও তাই। কী মিষ্টি লাগে দেখতে! শাহানাজ প্রিয়র দিক থেকে চোখ ফেরাচ্ছেন, আবার তাকাচ্ছেন, সেই সাথে চলমান রাখছেন নিজের কাজ। এদিক-ওদিক হেঁটে হেঁটে বলতে লাগলেন,
-“তুমি যে-বার প্রথম এই বাড়িতে এলে, তখন বয়স ৪-৫ বছর হবে। তোমার খালামণি নিয়ে এসেছিল। বাড়িতে তখন বাচ্চাদের মধ্যে বড়ো ছিল শরৎ, সৌরভ। রিধিমাও ছোট। সবাই তোমার সাথে খেলতে চাইলেও, শরৎ খেলত না। ওর বয়স তখন ১২-১৩। ওর আবার বাচ্চা-কাচ্চা পছন্দ না সেই বয়সে। নিজের ভাইকে নিয়ে অবধি খেলত না। ব্যাপারটা তোমার মাথায় কিক করেছিল। তুমি কী করেছিলে জানো? সবসময় ছেলেটাকে জ্বালানো শুরু করেছিলে। ও যখন পড়তে বসত তখন তুমি তোমার যোদ্ধা বাহিনী—রিধিমা, নিধি, নিশান, আসিফসহ বাড়ির পিচ্চুদের নিয়ে ওর ঘরের সামনে যুদ্ধের অনুশীলন করতে। ও খেতে বসলে, তুমিও পাশে বসে যেতে। ও মাছের বা মাংসের যেই টুকরো নিতে চাইত, তুমি ওটা নিতেই বায়না জুড়তে। ওর পাতের খাবারও উঠিয়ে নিয়ে নিজের পাতে রেখে ওকে মুখ ভেঙিয়েছ। ও ঘুমালে, আরুশিকে নিয়ে ওর রুমে বসিয়ে দিয়ে আসতে। আরুশি তখন দুধের বাচ্চা, ঘুম থেকে উঠে মা’কে না দেখলেই কান্নাকাটি করত। তুমি সেই বয়সে, সেই কান্নার সুযোগ নিয়েছিলে, সুবিধাবাদী মেয়ে!
তাছাড়া আরেকটা ব্যাপার, তুমি ছেলেটাকে প্রচুর কপি করতে। ও তখন থেকেই হালকা রঙের জামা-কাপড় পরত। ওর দেখাদেখি তুমিও এখানে থাকার প্রত্যেকটা দিন নিজের সাদা কাপড়গুলো পরেছিলে। আম্মাকে সবাই দিদা-দাদি ডাকলেও, শরৎ বুবুজান ডাকে। তুমিও বুবুজান ডাকতে।
প্রথমবার এসে আড়াইমাস থেকেছিলে। আর সেই আড়াইমাসে এই ঘটনাগুলো ঘটিয়েছ। এর তিনবছর পর আবার এসেছিলে। তখনও নিজের কাহিনি ধরে রেখেছিলে। বিশ্বাস করো, ছেলেটাকে এক চুল ছাড়ও তুমি দাওনি। ও কোথাও যেতে নিলে, তুমিও যাওয়ার বায়না ধরতে। সবসময় পিছু পিছু ঘুরতে। ও উঠে যেদিকে যেত, তুমিও সেদিকে যেতে।
ও বিরক্ত হয়ে বলত, ‘এদিকে আসছ কেন?’
তুমি বলতে, ‘আমার ইচ্ছা।’
তারপর ও আমাকে বিচার দিত। আমি কিছু বলার আগেই তুমি অবাক হয়ে বলতে, ‘আশ্চর্য! ব্যক্তি স্বাধীনতাও নেই?’
ওইটুকুন বাচ্চার এই কাহিনি শুনে আমি হেসে বাঁচতাম না। ছেলেটা তুমি আসার পুরো সময়টা শুরুরদিকে রুমলক করে রাখলেও, এরপর দেখেও না-দেখে থাকত। তারপর সবটা সয়ে নেয়, আর তাল মেলায়। ওর পাতে থেকে তুমি কোনো খাবার তুলে খেয়ে নিলে, ও তোমার পুরো প্লেটটা ধরেই নিয়ে নিত। তুমি ওর সাথে কোথাও যেতে চাইলে, ও নিয়ে যেত। এরপর সেখানেই রেখে বাড়ি ফিরে আসত। যেহেতু ও নিতে চায়নি, জোর করেই যাও, তাই ওর কোনো দায় নেই। তবুও ওকে বকতাম। সন্ধ্যের দিক দিয়ে এলাকার কেউ এসে বাড়িতে দিয়ে যেত তোমায়। তোমার কেঁদেকেটে লাল হয়ে যাওয়া মুখ দেখে আমি ওকে আরেক দফা বকতাম।
একবার তুমি ওর ক্রিকেট ব্যাট ভেঙে দিয়ে বাড়ির কোনো এক কোণায় লুকিয়ে পড়েছিলে। সন্ধ্যের আগে ঘরে ফিরে দেখতে পেয়েছিলে তোমার সব ক্লিপস, ব্যান্ডস, নুপুর, ব্রেসলেট ও ভেঙে ফেলেছে। তোমার কান্না তখন বাড়ি কাঁপিয়ে তুলত। আর ছেলেটা দরজা আটকে কানে তুলো গুঁজে পড়াশোনা করত, যেন তোমার কান্নাটা পাশের জমিতে কনস্ট্রাকশনের কাজের শব্দের মতোই এক ব্যাপার। যতদিন আছ হবেই।
সে-বার ও ফ্রিজ থেকে আইস্ক্রিম বের করার সাথে সাথেই তুমি কোত্থেকে এসে ওর হাতের আইস্ক্রিমটা নিয়ে মুখে তুলে ফেলেছিলে। আর বলেছিলে,
-‘আইস্ক্রিম কিউট জিনিস। এটা আমার মতো সুইট মেয়েরাই খায়। বিচ্ছুরা আইস্ক্রিম খায় না, বিচ্ছুরা কেঁচো বা অন্যান্য কীটপতঙ্গ শিকার করে খায়। বুঝেছ? বিচ্ছু কোথাকার!’
তুমি আইস্ক্রিম নিয়ে চলে যেতে নিয়েছিলে, তখনই ও ফ্রিজ থেকে পাঁচ লিটারের পানির বোতল বের করে তোমার মাথায় ঢেলে দেয়। আমি পাশেই দাঁড়িয়েছিলাম, রেগে গিয়ে এটা কী করল জিজ্ঞেস করাতে ও বলেছিল,
-‘বেশি সুইট হয়ে গেছিল। তাই পানি ঢেলে দিলাম।’
তারপর টানা ছ’দিন তোমার জ্বর ছাড়েনি। এই জ্বর নিয়েও একে-অপরকে কোনো প্রকারের ছাড় তোমরা দাওনি। তুমি যেমন ওকে জ্বালিয়ে গেছ, ও-ও জ্বরে পোড়া মেয়েটাকে মায়া দেখায়নি।
আরও অসংখ্য ঘটনা। ওর সাদা টি-শার্টে তুমি কাদা ফেলেছিলে একবার, ও তোমার ব্যাগ থেকে সব সাদা জামা নিয়ে কাদা পানিতে চুবিয়েছিল। সেদিন তুমি কী কান্না!
তোমার কান্না দেখে ওকে যখন বকতে লাগলাম, ও যেন কিছুই করেনি এমন ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার বকা শুনল। আমি হাঁপিয়ে যাওয়া শেষে ও গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিল, ‘ব্যক্তি-স্বাধীনতার অভাব পড়ে গেছে বাড়িতে, হুহ!’
তোমাদের দুইটার জ্বালায় সবাই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম, বুঝেছ?”
প্রিয় এতক্ষণ গালে হাত দিয়ে শাহানাজের কথা শুনছিল। তাঁর বলা শেষ হতেই প্রিয় লাফিয়ে ওঠে,
-“বড়োমা, ওটা আমিই ছিলাম তো? নাকি অন্য কেউ? আমার টুইনস টাইপের কেউ আছে নাকি?”
-“তুমিই ছিলে!”
-“কী বলো! ইশ! কী কিউট ছিলাম!”
প্রিয়র কথা বলার ধরন দেখে শাহানাজ হো হো করে হেসে ওঠে।
______
বিকেলের দিকে যখন শরৎ বাড়ি থেকে বের হচ্ছিল, ঠিক সেই সময় প্রিয় কোত্থেকে যেন উদয় হলো চুলটা বাঁধতে বাঁধতে। প্রিয়কে ওর সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে দেখে শরৎ থেমে দাঁড়ায়। প্রিয় ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-“কী?”
শরৎ-ও প্রশ্ন করে,
-“কী?”
প্রিয় হাতের ইশারায় বলল,
-“চলেন।”
চলবে..?