#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|২৯|
-“কী নিয়ে কথা বলছ?”
দুটো পুরুষই অপ্রস্তুত হয়ে উঠল একই সঙ্গে। প্রিয় এগিয়ে যায়। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল শরৎ আর প্রহর। প্রিয়র ডাক শুনে ওরা এদিক ঘুরে দাঁড়িয়েছে। শরৎ বলে উঠল,
-“বয়ে’জ ম্যাটার। গার্লস আর নট অ্যালাউড.. সরি!”
প্রিয় চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল,
-“বাহ-রে! ঢংয়ের আলাপ জমানোর জন্য আমার ভাইকেই পেয়েছিলেন? আর কেউ ছিল না, না?”
শরৎ হাসল খানিকটা, চোখ দুটো ছোট ছোট হয়ে এলো,
-“ছিল না।”
-“ভালো কথা। নীরজ ভাই, শুনুন।”
-“বলুন।”
-“আমার রুম ক্রস করে আসার সময় আপনার রুম থেকে আপনার ফোন বাজার আওয়াজ পাই। হাতে মেহেদী, তাই দেখতে পারিনি। গিয়ে চেক করে নেবেন।”
শরৎ অবাক হয়ে বলে উঠল,
-“ওয়াহ প্রিয়, ওয়াহ! আপনার নজর এতদিকে থাকে? সো ইম্প্রেসিভ!”
-“এই! বেশি তিড়িংবিড়িং করবেন না। দেখার নজরে হাত পড়লে মাসখানেক তাকানোর লায়েক থাকবেন না।”
-“বাপ্রেহ! ভয় পেয়েছি, প্রিয়।”
প্রিয় মুখ বাঁকিয়ে বলে,
-“ঢং!”
প্রহর পালাক্রমে শরৎ আর প্রিয়র কথা গিলে যাচ্ছিল। এই পর্যায়ে মিটিমিটি হেসে ফেলে। ঠিক তখন ফোনে কল আসে প্রহরের। আয়াতের কল৷ সেই যে রাত করে কথা বলতে বলতে মেয়েটা ভোরের দিকে ঘুমিয়ে গিয়েছিল, তারপর আর কথা হয়নি। প্রহর সেখান থেকে সরে দাঁড়ায়। ছাদের উলটো দিকটায় গিয়ে দাঁড়িয়ে কল রিসিভ করে। ভিডিয়ো কল।
আয়াত কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। কল রিসিভ হতেই ফোনটা পাশে রেখে কাঁধের ওপর কম্বলটা টেনে নিয়ে চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে ঘুম জড়ানো গলায় বলল,
-“ছোট আম্মু সকালে উঠিয়ে জোর করে খাইয়ে দিয়েছে। এরপর সেই যে সেকেন্ড টাইমিং ঘুম, মাত্র ভাঙল। অ্যান্ড আই মিস ইউ সোওওও মাচ!”
প্রহর হাসে,
-“লাঞ্চ করেননি? এখন রাত। এত অনিয়ম কেন?”
-“তুই নিয়ম করে আমায় সামলে রাখবি বলে।”
প্রহর বিমুগ্ধ হয়ে আয়াতের ফোলা চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইচ্ছে করল মুখের সামনে এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকা চুলগুলো গুছিয়ে কানের পিঠে গুঁজে দিতে। ইচ্ছে করল টুপ করে তেলতেলে গালে ঠোঁট ডুবিয়ে দিতে, আলতো করে বুকে জড়িয়ে নিতে। মিষ্টি সব ভাবনার মাঝে আয়াত আড়মোড়া ভেঙে ডেকে ওঠে,
-“প্রহর!”
-“হুঁ?”
-“তোকে এত আমার আমার লাগে কেন?”
প্রহর আয়াতের ঠোঁট উলটে করা প্রশ্নের বিপরীতে ছোট্ট করে বলে উঠল,
-“কারণ আমি তোর..”
অনুভূতির বিশ্লেষণে এর চেয়ে বড়ো কোনো বাক্য আমার জানা নেই। আয়াত লাজুক নয়, তবুও মুচড়ে উঠল। কাঁধ অবধি টানা কম্বল দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। গাল দুটো ফুলে ফুলে উঠছে, মুচকি হাসছে, এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, সামান্য পর পর চোখ বন্ধ করে নিচ্ছে। মরন-সুখ!
____
মোটা করে কাজল লাগিয়েছে আজ কুহক। গায়ে জড়িয়েছে স্লিভলেস, ব্যাকলেস, লো নেকের একটা কালো রঙের ব্লাউজের সাথে সাদা শিফনের শাড়ি। হাত-ভর্তি এন্টিকের চুড়ি, কানে বড়ো ঝুমকো আর শাড়ির ফাঁকফোকর দিয়ে পিউর সিলভার বেলিচেইনের স্টোনগুলো জ্বলজ্বল করছে, নজর কাড়ছে। কুহকের ফিঙ্গার রিংয়ের প্রতি আছে প্রবল আকর্ষণ। সেই সাথে নাকে একটা নোজরিং।
কুহক বাঁ হাত দিয়ে কাঁধের কাছের চুলগুলো পিছে সরিয়ে নিল। হাইহিলের ঠকঠক শব্দ তুলে এগিয়ে এলো। ঠিক বিপরীতের গাড়িতেই বসে আছে শ্রেয়ান। তার দৃষ্টি এদিকেই। সে মুগ্ধ হয়ে কুহককে দেখে যাচ্ছে। সে ভেবে পায় না, একটা মেয়ে ঠিক কতটা আবেদনময়ী হতে পারে! তার চলন, তার কথার ধরন, তার চাহনি, তার হাসি! শ্রেয়ানের জানামতে, এর সবেতেই শিল্প আছে। নয়তো এত অসাধারণ তার আর কাউকেই লাগেনি।
আর প্রিয়? প্রিয় ভীষণ ভালো একটা মেয়ে ছিল, খুব মিষ্টি একটা মেয়ে, খুব আদুরে। নিঃসন্দেহে প্রিয় পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু সে ভুলেভালে পৃথিবীর সবচেয়ে অযোগ্য কাউকে নিজের ভালোবাসা দিয়ে ফেলেছিল। শ্রেয়ান তো অযোগ্য কেউই।
শ্রেয়ানের দিক থেকে ধরতে গেলে, সে প্রিয়কে পছন্দ করে। অবশ্যই প্রিয়র মতো এতটা ভালো তাকে তার অন্য কোনো গার্লফ্রেন্ড বাসেনি। প্রিয়র মতো এতটা ইম্পর্ট্যেন্স অন্য কোনো গার্লফ্রেন্ড তাকে দেয়নি। বোকাদের ভালোবেসে আনন্দ আছে, তারা ঠকাতে জানে না। সেদিক থেকে শ্রেয়ান প্রিয়কে শেষ অবধি রাখতে চেয়েছিল। প্রিয়কে বিয়েও করতে চেয়েছিল। কিন্তু বোকা মেয়েটা চালাক হয়ে উঠল!
চাপা শ্বাস ফেলতে ফেলতে খেয়াল করল, কুহক গাড়িতে এসে বসেছে। সে সিট বেল্ট বাঁধার সময় হাতের দুই আঙ্গুল দিয়ে আড়া-আড়িভাবে নিজের শরীরকে প্রদর্শন করে ছুঁয়ে গেল। বাঁকা নজরে শ্রেয়ানকে দেখে গোপনে সূক্ষ্ম হাসল,
-“মিসড্ মি, বে-ই-বি?”
শ্রেয়ানের সমগ্র অঙ্গে বিদ্যুৎ খেলে গেল। আপনমনেই হাত চলে গেল বুকের বাঁ-পাশটায়। কুহক এবার সত্যিই হাসল, রঙ্গ করে হাসল। চোখ ঘুরিয়ে জানালার বাইরে স্থির করে বলল,
-“গাড়ি স্টার্ট করো। আজ একটা ভীষণ রকমের লং ড্রাইভে যেতে চাই। হাইওয়ে দিয়ে চলো। জঙ্গল টাইপের রাস্তা হলে বেশ হয়।”
-“আচ্ছা। তোমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে, কুহকিনী।”
কাজল-দৃষ্টিটি শ্রেয়ানের ওপর এসে থামে, শ্রেয়ান ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে লাগে চোখের অতলে। মেয়েটা চোখ সরু করে ফেলে বলে ওঠে,
-“আর কেমন লাগছে?”
-“ভয়ঙ্কর!”
-“লাইক অ্যা ব্ল্যাকহোল?”
কুহকের করা প্রশ্নে মাত্রই শ্রেয়ান আসল বিশেষণটা খুঁজে পেল, পলক ঝাপটিয়ে বলল,
-“ইয়েস!”
-“তবে আমায় বরঞ্চ তুমি ডেকো বিনাশিনী নামে।”
-“কেন?”
কুহক জবাব দেয় না, কেবল হাসে। তার পরিকল্পনা কতটা ভয়াবহ, তা ভেবেই হাসি চওড়া হয়। শ্রেয়ান বলে,
-“এভাবে কত ছেলের মাথা যে খারাপ করেছ!”
-“সেই ‘ছেলেদের’ লিস্ট থেকে তুমিও বাকি নেই বলছ?”
কথাটা ভুল নয়, তবুও শ্রেয়ান নিজের অহং দেখিয়ে অস্বীকার করে বসে,
-“আমি আর সব ছেলেদের মতো নই যে, যার তার ওপর যখন তখন ফল করব।”
-“আমি আর সব মেয়েদের মতো নই যে, যে-কোনো ছেলের মিষ্টি কথায় মজব।”
শ্রেয়ান এদিক-ওদিক তাকায়, কুহক বাইরে তাকিয়ে বলে,
-“আমাকে পেতে হলে করতে হবে কঠোর সাধনা। আমাকে পেতে হলে মরতে হবে, আমাকে পেতে হলে নিজেকে ভুলতে হবে। আমাকে পেতে হলে, তাকে আমার মন পড়তে হবে। সবার আগে আমাকে চিনতে হবে।”
-“আমি পাইনি কি?”
-“তিল পরিমাণও না।”
শ্রেয়ানের রাগ লাগে। ইচ্ছে করল, মেয়েটাকে কষিয়ে দুটো থাপ্পড় মেরে নিজের জায়গা বুঝিয়ে দিতে। কিন্তু তা করা যাবে না। সে এই মেয়েকে শিক্ষা দেবে। এই মেয়েকে ছুঁবে, নোংরা করবে, তারপর ছেড়ে যাবে ঠিক তখন, যখন মেয়েটা তাকে ছাড়া কিচ্ছুটি বুঝবে না।
এসবের মাঝেই কুহক বলে ওঠে,
-“এসি অন করে দাও, ঘামছ খুব। বাইরের ওয়েদারটা ঠান্ডা বেশ। তবে কি আমি ধরে নেব আমার হটনেসই তোমাকে এত ভীষণ উত্যক্ত করছে?”
শ্রেয়ান কেশে উঠে জানালা বন্ধ করে এসি অন করে, এরপর কোনো কথা না বলেই গাড়ি স্টার্ট দেয়। কুহকের পছন্দানুযায়ী রাস্তার দিকে যেতে যেতে বলে,
-“সেজেছ যে এত?”
-“তো, সাজতে পারি না?”
-“পারো।”
কুহক আর কিছু বলল না। শ্রেয়ান লুকিং গ্লাসে ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল,
-“আমার জন্য সেজেছ?”
সঙ্গে সঙ্গে তরঙ্গের মতো একটা ধারালো হাসি কুহকের ঠোঁট ছুঁয়ে গেল। বলল,
-“যে নারী নিজেকে ভালোবাসতে জানে, তার অন্যের জন্য সাজার প্রয়োজন পড়ে না, বেইবি। আমি নিজের জন্য সাজি।”
শ্রেয়ান সেখানটাতেও থমকাল, প্রশ্ন তুলল,
-“আমায় ভালোবাসো না?”
কুহক বড়ো রাজকীয় ভঙ্গিমায় বলে উঠল,
-“নিজের চেয়ে বেশি কাউকে নয়।”
______
রাত আড়াইটা ছুঁতে যাচ্ছে, কারো চোখে তখন ঘুম নেই। প্রিয় আলগোছে নিজের রুমে এসে কাপড় বদলে নেয়। একটা কাঁচা হলুদ রঙের একরঙা কুর্তা-পাজামা পরে নেয়। খোলা চুলগুলো কাঁটার মাধ্যমে বেশ ওপরে বেঁধে ফেলে। এলোমেলো চুল মুখের সামনে লুটোপুটি খায়। প্রিয় নিজেকে আরেকবার আয়নায় দেখে নিল। মিষ্টি দেখাচ্ছে বেশ! নিজেকে দেখে মুচকি হাসল, ডান গালটা ডেবে গেল তৎক্ষণাৎ। শ্রেয়ান তার গালের ডিম্পলটা বেশ পছন্দ করত। এ নিয়ে কত কথা বলত! ভাবতে ভাবতেই প্রিয়র হাসি মলিন হয়ে যায়।
প্রিয় চমকে যায়। নিজের ওপর কেন তার এত প্রভাব সে পড়তে দিচ্ছে? কেন? দেবে না সে। আবারও নিজেকে আয়নায় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে ভেতর থেকে প্রাণখুলে হাসতে লাগল।
নিজেকে দেখা শেষ হলে প্রিয় আলগোছে, ভীষণ গোপনে বাড়ি থেকে বের হলো। পশ্চিমের এতদিনের পরিচিত রাস্তা ধরে বিলপাড়ে চলে গেল। আজকের চাঁদটা বেশ বড়ো-সড়ো, আর ভীষণ উজ্জ্বল। প্রিয় অনেকটা সময় চন্দ্রবিলাস করল। এর মাঝে প্রবেশ হলো তার প্রাণের। সে ডাকল,
-“ভালো আছ, ফুল?”
প্রিয় একবার পাশে তাকিয়ে দেখতে পেল নিজের কল্পপুরুষকে। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
-“ভালো, তুমি?”
-“ভালো নেই।”
-“কেন নেই?”
-“তোমার খেয়ালে আমার বিচরণ কমে গেছে।”
প্রিয় আশ্চর্য হয়ে যায়। আসলেই! আগে নিজেকে ঘর-বন্দী করে রাখার পর দিন-রাতের ৯৫% সময়ই সে তার কল্পপুরুষের সাথে কাটাত, সেখানে এখন কেবল রাতের এই নিস্তব্ধতা ছাড়া আর কোনো সময়ই সে আসে না। মলিন মুখ প্রিয় চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আমি দুঃখিত, প্রাণ।”
সে তাতে মুচকি হেসে বলল,
-“দুঃখ কমেছে, কামিনীফুল?”
-“কমেনি।”
-“কেন? তোমার না নতুন মানুষ হয়েছে? নিজের মানুষ হয়েছে?”
প্রিয় অবাক হয়ে যায়,
-“আমার মানুষ?”
-“তোমার নয়?”
প্রিয় টের পায় সে কার কথা বলছে। আমতাআমতা করে তাই বলে,
-“ভুল বকছ, এরকম কিছু না।”
-“তুমি নিজেও জানো, আমি তোমার মনের কথাগুলোই তোমাকে বলি।”
প্রিয় কিছু বলে না। চোখ বুঁজে যায়। অনেকটা সময় পর প্রিয়র কল্পপুরুষ হেসে ফেলে। হেসে হেসে বলে,
-“আবারও একই ভুল করতে যাচ্ছ, ফুল।”
প্রিয় চোখ খোলে, ত্বরিতে তাকায় তার দিকে। সে বলে,
-“একবার ভেঙে নিজেকে আবার জুড়ে নিয়েছ। এবার ভাঙলে মরে যাবে।”
প্রিয়র বুক কাঁপে। এদিক-ওদিক তাকাতে লাগে ক্রমাগত। এরই মাঝে আবারও সে বলে ওঠে,
-“কিংবা বেঁচে যাবে। এবার ভয়ানক কিছু হবে। এবার হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ফুলটি তুমি হবে, কিংবা ফুল ঝরে যাবে..”
প্রিয় বুঝে ওঠে না কী করবে, কী করা উচিত তার। বিক্ষিপ্ত নজরে এদিক-ওদিক তাকাতে থাকে। ভয় লাগে তার। আবারও যদি হয়? সে খানিকটা দূর্বল অবশ্যই হয়েছে শরতের ওপর। কিন্তু সে চায় না ওরকম কিছু। ভাবনারা প্রিয়কে বহুত জ্বালাচ্ছে। বুকের ভেতরে হাঁসফাঁস লাগছে। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বোকা প্রাণীর সাথে তুলনা করতে ইচ্ছে করছে। কেন শুধু শুধু শরতের কথাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিল? শরৎ তো বলেছিলই, দূরত্ব আনা উচিত। কথাটা ১০০% সত্য। প্রিয়ই তো নিজের অনুভূতিদের সাথে গেইম খেলা শুরু করল। তার নিজের ওপর কতটা কন্ট্রোল, তা মাপা শুরু করল। শিট! ভয়াবহ অনুচিত কাজ করেছে প্রিয়।
অস্থির প্রিয়র এক হাতের নখ ইতোমধ্যে অন্য হাতের অগ্রবাহু ছুঁয়েছে। নখের তীক্ষ্ণ জ্বলুনি অনুভব করতে না করতেই কেউ একজন তার শক্ত মুঠে বাহু ছুঁয়ে ফেলে। প্রিয় থেমে যায়, শান্ত হয়, নরম হয়। তখনই একটা ভারি আওয়াজ তার কানে এসে বাড়ি খায়,
-“অনুভূতির সাথে খেলতে যেয়ো না, প্রিয়৷ তুমি হেরে যাবে। অনুভূতিরা জ্বাল বুনতে জানে, অনুভূতিরা মানুষটাকে আঁটকে ফেলতে জানে।”
চলবে..
#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|৩০|
-“অনুভূতির সাথে খেলতে যেয়ো না, প্রিয়৷ তুমি হেরে যাবে। অনুভূতিরা জ্বাল বুনতে জানে, অনুভূতিরা মানুষটাকে আঁটকে ফেলতে জানে।”
প্রিয় তাকায় শরতের দিকে। শরৎ দুম করে পাশে বসে পড়ে, দৃষ্টি তাক করে বিলের জলে। ওষ্ঠে তার অতি সূক্ষ্ম হাসি, যা ক্ষণেই বিলীন হয়ে এলো। মলিন গলায় বলল,
-“আমার সিক্রেট প্লেস এটা। এখানে কী করছ, প্রিয়?”
প্রিয় ফিসফিসিয়ে বলল,
-“সিক্রেটলি অনুভূতিতে সুখ নিচ্ছি, নীরজ ভাই।”
-“কীভাবে নেয়?”
-“বলব না।”
শরৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-“এখানে কী করছ, বললে না?”
প্রিয় একবার বাঁকাচোখে শরৎকে দেখে নিল, দৃষ্টি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আবার বলল,
-“তোমার পছন্দ সুন্দর, এই জায়গাটাও সুন্দর। আমার ভালো লেগেছে, তাই রোজ রাতে আসি।”
-“এত রাতে ভয় করে না?”
-“কীসের ভয়?”
-“অন্ধকার?”
-“অন্ধকার প্রিয় চাঁদকে নজরকাঁড়া করে, তাকে ভয় কীসের?”
-“একাকিত্ব”
-“একা কই? কল্পপুরুষ আছে।”
-“জন্তু-জানোয়ার?”
-“খুব বেশি হলে ছিঁড়ে খাবে, সর্বোচ্চ মৃত্যু হবে। মানুষের তুলনায় ধরতে গেলে, ওদেরকে ভয় পাওয়ার কারণ নেই।”
বুক চিঁরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো শরতের। সে আওয়াজ বোধহয় প্রিয় শুনতে পেল। সামান্য হেসে বলল,
-“আসো, তোমাকে শেখাই কীভাবে অনুভূতিতে সুখ নেওয়া যায়।”
কৌতুহলী শরৎ বলল,
-“হুম, শেখাও।”
প্রিয় প্রলম্বিত শ্বাস টেনে বলল,
-“চোখ বন্ধ করো, নীরজ ভাই।”
-“করলাম।”
-“উম..পাহাড়ি অঞ্চল। চারপাশে অসংখ্য পাহাড়, মেঘেরা এদিক-ওদিক খেলে বেড়াচ্ছে। বাতাসে বুনো ঘ্রাণ! ঠিক এমন এক ভোরে গায়ে একটা ছাই-রঙা চাদর পেঁচিয়ে নিলে। লম্বা শ্বাস টেনে জায়গাটা কল্পনা করো।”
শরৎ শ্বাস টানল, চোখের পাতায় ঠিক এমনই এক দৃশ্য ফুটে উঠল। প্রিয় বলল,
-“এত এত পাহাড়ের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের শৃঙ্গে একটা কটেজ। সেই কটেজের বারান্দার ফ্লোরে তুমি আর আমি বসে আছি। নীরজ ভাই, কোথায় আছ?”
-“বারান্দায়।”
-“কী দেখতে পাচ্ছ?”
-“আমার পৃথিবী কতটা সুন্দর তা দেখছি, আর দেখছি…
-“আর কী দেখছ, নীরজ ভাই?”
-“একজন পাহাড়কন্যাকে।”
প্রিয় লাজুক হেসে বলল,
-“কল্পনায় কথোপকথন চালাও তোমার পাহাড়কন্যার সাথে।”
-“তুমি প্রচণ্ড রকমের বিলাসী..”
-“আমি বিনাশীও অবশ্য।”
-“তুমি পূর্ণচাঁদের ন্যায় স্নিগ্ধ।”
-“আমি অমানিশার মতো ভয়ঙ্করও।”
-“তুমি সমুদ্রের জলতরঙ্গের ন্যায় অশান্ত।”
-“আমি আগুনের প্রলুব্ধ শিখায় ন্যায় শান্তও।”
-“তুমি বড়ো মায়াবী।”
-“মাঝে সাঝে নিষ্ঠুরও।”
-“তুমি এক কোমলপ্রাণ।”
-“অথচ আমি অত্যাধিক উগ্রও।”
-“তুমি ভীষণ আদুরে।”
-“প্রয়োজনে সবচেয়ে বেয়াদবও।”
-“তুমি সঁজীবনী সুধা।”
-“আর স্বয়ং অসুখও।”
-“এত বিচিত্রতা কেন তোমার মাঝে?”
-“ভিন্নতা মানুষকে আকর্ষণীয় বানায়। নিজের বলতে আমি ছাড়া কেউ নেই।”
-“মেয়ে, তোমাকে চাঁদ ভেবে আকাশ হয়ে যেতে ইচ্ছে করে।”
প্রিয় কথাটির মর্মার্থ ধরতে পারে। আর ঠিক এখানটাতে গিয়েই ভড়কে যায়। এলোমেলো নজরে এদিক-ওদিক তাকাতে থাকে ক্রমশ। শরৎ বন্ধ দু’চোখে বলতে থাকে,
-“প্রিয়, তোমাকে পৃথিবী চেনাতে ইচ্ছে করে।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রিয় বলে,
-“চিনেছি।”
-“জানো, মেয়ে? পৃথিবীর দুটো দিক রয়েছে, একটা যা শ্রেয়ান তোমায় দেখিয়েছে। অন্যটা আমি দেখাতে চাই।”
প্রিয় নতমুখী হয়ে ছিল, শরতের কথা শুনে ওর পানে তাকায়। একটু এগিয়ে গিয়ে লাগোয়া হয়ে বসে। তারপর হুট করেই শরতের কাঁধে মাথা রাখে। বিদ্যুৎ স্পর্শের মতো চমকে ওঠে শরৎ। তাকায় প্রিয়র দিকে। প্রিয় মিনমিনে স্বরে বলে,
-“অথচ, তা সম্ভব নয়।”
-“কেন নয়?”
-“কারণ আমি চাই না।”
শরৎ প্রিয়র চোখে চোখ স্থির রেখে বলে উঠল,
-“কী চাও, প্রিয়?”
-“আপাতত দূরত্ব চাই। তুমি ভীষণ ভালো, নীরজ ভাই। ভীষণ রকমের মনের মতো। তাই মন তোমাকে চেয়ে বসছে, আমার অবাধ্য হচ্ছে। ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো লাগছে না। আমি দূর্বল হয়ে যাচ্ছি। নীরজ ভাই, তোমাকে আমি খুব পছন্দ করি। এই পছন্দটা হুট করে যদি ভালোবাসায় রূপ নিয়ে ফেলে, ভয় হচ্ছে।”
-“ক্ষতি কী?”
-“একই ভুল দ্বিতীয়বার কী করে করি?”
-“ভুল সববারই হবে, এর কোনো মানে আছে?”
-“সম্ভব নয়, নীরজ ভাই।”
প্রিয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিয়ে মাথা তুলে শরতের দিকে তাকায়। ঠিক সেই মুহূর্তে গিয়ে প্রিয় উপলব্ধি করে, সে শরতের এতটাই কাছে যে নিঃশ্বাসের শব্দগুলোও মিলে-মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। প্রিয় অপ্রস্তুত হয়। এক রাজ্য ঔদাস্য নিয়ে তাকিয়ে থাকে। শরৎ প্রিয়র ডান হাতটা নিজের মুঠোয় নিল। হাতটার পিঠে বৃদ্ধাঙ্গুল বোলাতে বোলাতে বলল,
-“তোমার চাওয়াকে সম্মান করি।”
প্রিয় অসীম মুগ্ধতা নিয়ে শরতের দিকে তাকাল। সেই চোখে মুগ্ধতার সাথে ছিল মলিনতাও। প্রিয়র এক মন চায় শরতের দিকে এক পা এগোতে, ঠিক সেই ক্ষণে অপর মন তাকে চার কদম পিছিয়ে ফেলে। শেষমেষ প্রিয় সবটা ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গেল।
শরৎ ধরে রাখা ডান হাতের পিঠে হুট করেই ঠোঁট ছোঁয়াল। সময় নিয়ে চুমু খেয়ে বলল,
-“তোমার সব মলিনতা আকাশে মিশে যাক, মেঘ জমুক, বৃষ্টি হোক। তুমি হয়ে ওঠো আগের মতোই প্রাণোচ্ছল। প্রিয়, তুমি কি জানো—তোমায় কেউ একজন আচমকাই চেয়ে বসেছে?”
______
আজ শ্রেয়ান পাগল হতে বসেছে। কুহককে তার চাই-ই চাই। এই মেয়েটা যেন রীতিমতো তাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে। কুহকের সাথে তার প্রথম দেখা হয়, প্রিয়র সাথে ঝামেলা হওয়ার কিছুমাস আগে, ধানমন্ডি লেকে। মেয়েটার মাঝে কী যেন ছিল, শ্রেয়ান তাকে অবজার্ভ করতে বাধ্য হয়। বেশ অনেকটা সময় পর শ্রেয়ান যখন ফেরার উদ্দেশ্যে গাড়িতে গিয়ে বসে, কুহক এসে লিফট চায়। তখনকার টুকিটাকি কথা, নাম্বার বিনিময়। এ-ই তো! এসবই হলো।
এরপর হোয়াটসঅ্যাপে চ্যাট হতে লাগে। শ্রেয়ান অবাক হয় কুহকের প্রতিটি কাজে। যেখানে অন্য মেয়েরা তার পাত্তা পাওয়ার জন্য পাগল, সেখানে কুহক বরাবরই তাকে ইগনোর করে এসেছে। এরপর কথা হতে থাকে, বার বার দেখা হতে থাকে। শ্রেয়ান খেয়াল করে, মেয়েটার টেস্ট ভিন্ন। সে স্মোক করে, ড্রিংক করে। রাত-বিরেতে ঘোরাফেরা করে। ড্রেসাপ সেন্সও আর বাকিদের চেয়ে অন্যরকম। সেই সঙ্গে সে ভীষণ রকমের বোল্ড। আর এইখানে গিয়েই তো সে দূর্বল হয়। শ্রেয়ানের ধারণা ছিল, এসব মেয়েরা খুব জলদিই বেডে চলে আসে। কিন্তু সেই ধারণায় এক বালতি জল ঢেলে দিয়ে আজ প্রায় ১ বছর হলো, মেয়েটা হাতে আসছে না।
শ্রেয়ান দেখা করতে ডেকেছে। ইদানিং যেন দেখাও করছে না। তার ভালো লাগছে না কিছু। মেয়েটাকে চাই তার। কিন্তু এসব কী? তার চাওয়াকে প্রাধান্য দিচ্ছে না? তার চাওয়াকে? শ্রেয়ান কল দিলেই কুহক রিসিভ করল, বলল,
-“কী?”
-“কী মানে? কল পিক করছ না কেন?”
-“এমনি।”
-“এমনি না, দেখা করো।”
-“তোমার ইচ্ছেতে?”
-“হ্যাঁ।”
-“সরি, বাট আমার ইচ্ছে করছে না।”
-“কুহকিনী, আসতে বলেছি এসো।”
-“আমাকে হুকুম দিতে এসো না, আমি কারো হুকুমের দাস না। তোমাকে পায়ে মাড়াতেও আমার সময় লাগবে না।”
-“অহংকার করছ? কীসের এত অহংকার? কী আছে?”
কুহক হাসে,
-“অসম্ভব সুন্দরী আমি।”
-“আমি কোনো অংশে কম?”
-“ভীষণ বুদ্ধিমতী আমি।”
-“আমার ঘটে বুদ্ধি কম?”
-“টাকা-পয়সার অভাব নেই।”
-“আমার বাপের কম?”
শ্রেয়ানের চিবিয়ে চিবিয়ে বলা কথাগুলোকে হেসে ওড়াল কুহক,
-“আমি তোমার মতো বাপের টাকা ওড়াই না। দেশের টপ ফ্যাশন ডিজাইনারদের মধ্যে একজন আমি। নিজের যা টাকা আছে, তাতে তোমার মতো দশ শ্রেয়ানকে কিনে ফেলতে পারব।”
ভড়কালো শ্রেয়ান, রাগে গা থরথর করে কাঁপতে লাগল। এ কোন ভাষায় কথা বলছে কুহক? চিল্লিয়ে উঠল,
-“মুখকে আটকাও, কুহকিনী! আমি সেকেন্ড টাইম সহ্য করব না।”
খুবই ধীর ও অবিচলিত আওয়াজে কুহক বলল,
-“আ-আ! আমার সামনে আওয়াজ উঁচু করার সাহস কোরো না, শ্রেয়ান। আমি পছন্দ করি না।”
শ্রেয়ান রাগে কাঁপছে। সামনে থাকা গ্লাসটা ছুঁড়ে মারল সেন্টার টেবিলের ওপর, টেবিলের কাঁচসহ ভেঙে গেল। ভাঙচুরের আওয়াজ পেয়ে কুহক বলল,
-“বাপের টাকা নষ্ট করছ।”
-“কুহকিনী, চুপ! থামতে বলেছি না?”
-“নিজের খাই, নিজের পড়ি। তোমার কথায় আমার কিচ্ছু ছেঁড়া যাবে না।”
শ্রেয়ান নিজের চুল মুঠো করে রাগ দমনের চেষ্টা করল। জোরপূর্বক হেসে বলল,
-“প্লিজ, কুহকিনী। ডোন্ট ইউ লাভ মি?”
কুহক হাতের নেইলসগুলো দেখতে দেখতে বলল,
-“ফার্স্ট অব্ অল আই লাভ মাই সেলফ্।”
-“দেন মি, রাইট?”
-“নোহ…”
কুহক শব্দ করে হেসে ওঠে। তারপর বলতে লাগে,
-“আমি নিজেকে এত বেশি ভালোবেসে ফেলেছি যে, অন্য কোনো কিছুর প্রতি আর সামান্য ভালোবাসাও আসে না।”
শ্রেয়ান আর রাগ দমাতে পারল না,
-“ইউ চিটেড অন মি?”
ফিক করে হেসে ফেলল কুহক,
-“রিয়েলি, বেইবি? আর তুমি দুধে ধোয়া করলাপাতা, তাই নাহ?”
-“আমার পুরো একটা বছ নষ্ট করলে।”
-“যেভাবে তুমি করেছিলে..”
-“আমি কী করলাম?”
-“যেটা আমি করলাম।”
শ্রেয়ান ভড়কায়,
-“কী?”
-“ফিলিংস নিয়ে খেলা! ওহ বেইবি, তোমার থেকেই তো শিখেছি।”
শ্রেয়ান বলার মতো কিছু পেল না। সপ্তাহ খানেক আগে কেনা নতুন ফোনটা ছুঁড়ে মারল ভাঙা কাঁচের ওপর। কুহক হাসতে হাসতে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো। যা করার সে করেছে, বাকিটা শ্রেয়ানের হেরে যাওয়া মস্তিষ্ক আপনা থেকেই করবে। কারো দীর্ঘশ্বাসের কারণ হয় ক’টা দিনই বা ভালো থাকা যায়? শ্রেয়ান টের পাবে তা।
চলবে..