#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|৩১|
পৃথিবীর সকল কিছুই আপেক্ষিক। নির্ভরশীলতা প্রতিটি বস্তুতে পরিলক্ষিত। রোজ সাঁঝে সূর্য অস্ত যায়, এটা জেনেই যে পরদিন ভোরে আবার সে আসবে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত শেষে গিয়ে আবার আসে গ্রীষ্ম। ঘড়ির কাটা এক থেকে বারো অবধি ঘোরে, তারপর আবারও এক-এ চলে আসে এবং ঘূর্ণনশীলই থাকে। পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে, একইভাবে চাঁদ পৃথিবীকে।
পূর্ণচাঁদ ধীরে ধীরে অর্ধপূর্ণ এবং পরিশেষে অমানিশার রূপ নেয়। এরপর সেই চাঁদের আকৃতি বাড়তে থাকে ক্রমেই, পনেরো দিনের মাথায় চাঁদটি পূনরায় একটি পূর্ণচাঁদে পরিণত নয়। চাঁদের পরিপূর্ণ দশা থেকে অমানিশা অবধি পনেরো দিনটি কৃষ্ণপক্ষ। একইভাবে অমানিশা থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে চাঁদ পরিচ্ছন্ন হয়ে শেষে পূর্ণচাঁদে পরিণত হওয়াকে ঘটা করে শুক্লপক্ষ বলা হয়। শুক্লপক্ষের প্রথম দিনটা অমানিশা, যা পরিশেষে পূর্ণেন্দুতে এসে থামে।
তো? সবেরই শুরু আছে, সবেরই শেষ আছে। ঠিক এভাবেই শেষ থেকেও একটা শুরু আছে। যদি দেখে থাকো, তবে জানবে জীবনটা চক্রের ন্যায়।
আজ পূর্ণেন্দু। আকাশে ভীষণ জ্বলজ্বলে গোল চাঁদ, আর তার নিচে দোলনায় দোল খেতে থাকা প্রিয়শ্রী। ঘড়িতে আড়াইটার কাছাকাছি কোনো একটা সময় হবে। প্রিয় খুবই নরমভাবে দোল খাচ্ছে, আর এসব ভাবছে। রিধিমার বিয়ের সন্ধ্যেতেই প্রহরকে এক প্রকার বাধ্য করেই ঢাকায় ফিরে এসেছে তারা। ফেরার সময় একবার শরতের মুখোমুখি হয়েছিল, দৃষ্টি গিয়ে শরতের ঘোলাটে নজরে থেমেছিল অবশ্য। কিন্তু কেউ কোনো কথা বলেনি। শরতের চোখ তখন প্রিয়কে অনেক কিছু বলেছিল। প্রিয় সেগুলো বুঝেছে চোখের ইশারাতেই।
তারপর আজ ছয়দিন হলো প্রিয় নিজ বাড়িতে ফিরেছে। প্রথম দুইদিন শরৎকে সে মাত্রাতিরিক্ত মিস করেছিল, কল দিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করেছিল। কিন্তু তারপরই সে থেমে যায়।
সে ছোট থেকেই হুমায়ুনভক্ত, বিশেষ করে হিমু! হিমুর চলন-কথনের ওপর অন্য রকমের ঝোঁক ছিল। মহাপুরুষ হতে ইচ্ছে করত। আচ্ছা, মেয়েরা মহাপুরুষ হতে পারে? তাহলে তো তাদের আর মহাপুরুষ ডাকা যায় না। তাদের মহানারী ডাকা লাগে। প্রিয়র তা হতে ইচ্ছে করত। আর হয়তো এই মুহূর্তে তার কাছে নিজেকে কোনো মহানারীর চেয়ে কম কিছু লাগছে না; কেননা তারা মায়ায় আটকাতে জানে না।
প্রিয় পূণরায় চাঁদের পানে তাকায়। পাশ থেকে তার কল্পপুরুষ ডাকে,
-“ফুল?”
প্রিয় জবাব নেয়,
-“হুঁ।”
-“সে তোমাকে বড়ো মিস করে।”
-“করুক।”
-“তুমি কি তাকে একটা কল করবে?”
-“না।”
-“একটা ম্যাসেজ?”
-“না।”
-“ফেসবুকে কানেক্ট আছ। মেসেঞ্জারে যে কেউ একটা ম্যাসেজ করতে পারে। এতে করে ম্যাসেজ দেওয়া ব্যক্তিকে কেউ দূর্বল ভাবে না, ফুল। সে-ও তোমাকে তার প্রতি দূর্বল ভাববে না।”
-“যদি এমনই হতো, তবে সে কেন কল-ম্যাসেজ করল না।”
-“হয়তো তোমার কারণ আর তার কারণ অভিন্ন নয়। তুমিও তো চাইছ, সে আগে ম্যাসেজ/কল দিক।”
প্রিয় মুখ ঘুরিয়ে ফেলে,
-“তাহলে প্রয়োজন নেই।”
-“তবে তার কথা এত ভাবছ কেন?”
-“ভাবছি না।”
-“তুমি যা ভাবো, তাই আমি বলি। ফুল, তুমি কি তা ভুলে যাচ্ছ?”
প্রিয় আমতাআমতা করতে লাগে। কল্পপুরুষ মুচকি হেসে বলে,
-“আজকের চাঁদটা সুন্দর না?”
নিজ কল্পনায় প্রসঙ্গ পালটে প্রিয় স্বাভাবিক হয়ে পড়ে ক্ষণিকেই,
-“ভীষণ।”
-“একদম তোমার মতো।”
প্রিয় হাসে তার দিকে তাকিয়ে,
-“প্রাণ, চাঁদের মতোই কলঙ্কিত আমি। তবে তাঁর কলঙ্ক গায়ে লেগেছে, আমারটা মনে। তারটা সবাই সৌন্দর্য হিসেবে ধরে নিচ্ছে, অথচ আমারটা পাগলামি আর বিশেষ ধরনের ক্ষত হিসেবে।”
কল্পপুরুষ চোখে হাসে,
-“পাগলের মতো ভালোবেসেছ আর সে তোমাকে দুনিয়ার সামনে পাগল বানাবে না—ভেবেছ?”
প্রিয় হেসে বলল,
-“ভেবেছিলাম তো কত কিছুই। সব যে আমাদের ভাবনামাফিক হবে এমন নয়। এখন নিজেকে সামলে নেওয়াও শিখে নিয়েছি, আর সব মেনে নেওয়াও।”
-“দ্যাটস লাইক মাই গার্ল!”
এমন সময় প্রিয়র ফোন বেজে ওঠে। প্রিয় স্কার্টের সাইডের স্পেশ্যাল পকেট থেকে ফোন বের করে নেয়। দেখতে পায় একটা প্রাইভেট নাম্বার। স্ক্রিনের ওপরের দিকে জ্বলজ্বল করে জানান দিচ্ছে, ইট’স টু থার্টি এইট এ.এম.। এই অসময়ে কে কল দেবে? প্রিয় সময়-জ্ঞান হারিয়েছিল দুটো পুরুষের সান্নিধ্যে। তার ধারণা ঠিক হলে তাদেরই একজন কল দিয়েছে। প্রিয়র ভীতসন্ত্রস্ত মনটা কল রিসিভ করতে চাইছে না। এভাবেই কলটা কেটে গেল। আবারও কল এলো, রিং হতে লাগল, ধারাবাহিকতা চলতে লাগল।
পাশ থেকে প্রিয়র মনের মানুষ তাকে সাহস জোগাল,
-“আমার প্রিয় ভীষণ সাহসী। নিজের সাহসিকতার পরিচয় দাও।”
প্রিয় কল রিসিভ করে নেয় ততৎক্ষণাৎ। লম্বা শ্বাস টেনে ফোন কানে নিতেই ওপাশ থেকে বড়ো শীতল একটা আওয়াজ প্রিয়র গা শিরশির করে তুলল,
-“প্রিয়শ্রী…”
প্রিয় হারিয়ে গেল সেই দিনটায়। প্রহরকে নিজের সম্পর্কের ব্যাপারে সব জানানোর কিছুদিন পর প্রহর প্রিয়র রুমে এসেছিল কিছু ডক্যুমেন্টস নিয়ে। প্রিয়র মানসিক অসুস্থতা তখন বেশ ছিল। সারাক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে থাকত। আর সেদিন সেই অন্যমনষ্কতা বোধহয় খানিকটা বেশিই ছিল। প্রহরকে আসতে দেখেও কিছু বলেনি, প্রহর আপনা থেকেই ডক্যুমেন্টসটা দেখায় প্রিয়কে। যার আগা-গোড়া কেবল শ্রেয়ানের হিস্ট্রি নিয়েই ছিল। তার পরিবার, গার্লফ্রেন্ডস, বিহেভিয়ার আর সবচেয়ে বেশি ছিল চ্যালেঞ্জিং মনোভাবটা। প্রিয়র অবিশ্বাস্য নজরে সব দেখার কথা। অথচ সে প্রতিক্রিয়া দেখায়নি প্রহরকে। নীরস আওয়াজে বলেছিল, ‘জানি।’
শ্রেয়ান ঠিক কেমন প্লেয়ার, সব জানা তার। তবে বাকিসবের বর্ণনা ওখানে দেখে মাথা হ্যাং মেরে যায় তার, অসুস্থতা সর্বোচ্চতে গিয়ে পৌঁছায়, বিশ্বাস তো আগেই ভেঙেছিল। সে আরও অন্যমনস্ক হয়ে চুপ থাকে। কথা বলা বন্ধ করে দেয় সবার সাথে।
তারপর দীর্ঘদিনের কাউন্সেলিংয়ের পর প্রিয় স্বাভাবিক পর্যায়ে আসে। তবুও পুরোপুরি সুস্থ হতে পারে না। সুইসাইডাল চিন্তা-ভাবনা না থাকলেও, মাঝে মাঝেই প্রিয়র সবকিছু থেকে বিতৃষ্ণা চলে আসে। মাঝে মধ্যেই চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে।
প্রিয় এখন বেশ সুস্থ। হুট করেই পুরোনো কথা মনে পড়ায় গভীর শ্বাস নিল। শ্রেয়ান আবার ডাকে,
-“ঘুমোচ্ছিলে, প্রিয়?”
প্রিয় দোলনায় পিঠ ঠেকিয়ে নিজেকে দোলাতে লাগে আবার, চোখ গিয়ে আটকায় আকাশে। নরম গলায় বলে,
-“ঘুমাইনি।”
-“অনেক রাত তো। এত রাত জাগা কি ঠিক নাকি? ঘুমানো উচিত তোমার।”
-“নিজেরটা বুঝে নেব। তুমি বলো। তোমার কী খবর? দিনকাল ভালো?”
এই পর্যায়ে গিয়ে শ্রেয়ান মলিন গলায় বলল,
-“ভালো থাকব? তোমাকে ছাড়া আদৌও সম্ভব?”
-“তাহলে খারাপ আছ?”
-“এভাবে কথা বলছ কেন?”
-“আমার ইচ্ছে।”
-“তুমি কি টের পাচ্ছ না প্রিয়শ্রী, আমার কষ্ট হচ্ছে?”
-“পাচ্ছি না।”
-“এতটা পাষাণ হয়ে গিয়েছ?”
-“হয়েছি।”
-“এমন কোরো না প্রিয়শ্রী, আমি তোমাকে এভাবে মেনে নিতে পারছি না।”
-“ডু ইউ থিংক আই রিয়্যেলি কেয়ার?”
চমকে উঠল শ্রেয়ান। খুব করে বুঝতে পারছে, প্রিয়র নির্বিকারত্ব তাকে ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে। শ্রেয়ান জিজ্ঞেস করল,
-“নতুন সম্পর্কে জড়িয়েছ, প্রিয়?”
-“ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে ফেললে না, শ্রেয়ান?”
-“আমার আর তোমার মাঝে ‘ব্যক্তিগত’ শব্দটা এলো, কীভাবে?”
-“শোনো, শ্রেয়ান। ব্যক্তিগত মানে নিজস্ব, একান্ত। আমি পাগল ছিলাম, তাই নিজের জন্য কিছুই রাখিনি, নিজেকে ভালোবাসিনি। এখন আমি এনাফ সুস্থ।”
-“তাই অন্য ছেলেটে জুটিয়ে নিয়েছ?”
প্রিয় ঠোঁটে হাসি এনে বলল,
-“নিলে নিয়েছি।”
-“ব্রেকআপ করো তার সাথে, ফিরে এসো আমার কাছে।”
-“কেন ফিরব?”
-“কজ আই ওয়ান্ট ইউ।”
টিপ্পনি কেটে প্রিয় বলল,
-“তাই নাকি?”
শ্রেয়ানের অস্থির কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে,
-“হ্যাঁ, তুমি আমার।”
প্রিয় এবার শব্দ করে হাসতে লাগে। হাসতে হাসতে বলে,
-“যতদিন তোমার গল্পে তোমার নারী একা থাকবে, ততদিন নারী তোমার। অথচ আমি শুরু থেকেই ছিলাম অপশন। তুমি কীভাবে নিজের বলো?”
শ্রেয়ান হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। শব্দ পায় না বলার মতো। নিজের চুরি ধরা পড়ে গিয়েছে নাকি? চোরের মনে সর্বদা ধরা পড়ার আশঙ্কা থাকে, শ্রেয়ানের ছিল না। কেননা ধরা পড়লেও সে ভঙচঙ বুঝিয়ে নিতে পারবে। এর আগেও এমন বহুবার হয়েছে। রাত-বিরেতে ফোন ওয়েটিংয়ে পেলে প্রিয় যখন জিজ্ঞেস করত, কার সাথে কথা বলছিল। শ্রেয়ান জানিয়ে দিত, বিদেশি ক্লায়েন্ট। আবার যদি বুঝেও যেত, তবুও শ্রেয়ানের ধারণা প্রিয় থেকে যেত। হয়তো কান্নাকাটি করে বলত, সবাইকে ছেড়ে দিতে। এটুকুই! এর বেশি করার প্রিয়র ক্ষমতা নেই।
অথচ এই প্রিয় যেন পুরোই বিপরীত কেউ। শ্রেয়ানের অস্বস্তি লাগা শুরু করে। নিজেকে এক্সপ্লেইনের চাহিদায় বলে ওঠে,
-“বলেছিলাম না? আশফিক রহমান শ্রেয়ান বিলংস টু ইউ? আমি শুধুই তোমার, প্রিয়শ্রী।”
-“আর বাকি মেয়েরা?”
-“কোন মেয়েদের কথা বলছ?”
-“নাটক কোরো না, শ্রেয়ান। আমি বড়ো ক্লান্ত।”
শ্রেয়ান চুপ থাকে। প্রিয় অনুভূতিশূন্য গলায় জানায়,
-“তোমার সব নারী আসক্তি আমি টের পেয়েছিলাম সম্পর্কের প্রথম বর্ষেই। ততদিনে আমি তোমাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। তোমাকে ছেড়ে যাওয়া আর মৃত্যুকে চেনা যেন একই লেগেছিল। আমি তোমাকে ছাড়তে পারিনি, উলটো ভালোবাসা বাড়িয়ে দিলাম। তুমি মানুষ, তুমি মায়ায় আটকাবে। এর চেয়ে বড়ো সত্য নেই। আমি তোমাকে আটকাতে চেয়েছিলাম। আমি তোমাকে সীমাহীন বিশ্বস্ততা দিয়েছিলাম, আমি তোমাকে অতিরিক্ত ভালোবাসা দিয়েছিলাম, আমি তোমাকে কল্পনাতীত ছাড় দিয়েছিলাম, আমি তোমাকে অদৃশ্য সুতোয় বন্ধনমুক্ত রেখেছিলাম। ঠিক এতটা বিশ্বাস দেখিয়েছিলাম, যাতে ঠকানোর আগে অন্তত দু’বার ভাবো। অথচ তুমি মানুষের কাতারে পড়োনি বলেই হয়তো আটকাওনি, হয়তো তা-ই তোমার মাঝে বিন্দু পরিমাণ অনুশোচনা তৈরি হয়নি আমাকে ঠকানোর পর।
কাজী ইশরাক জাহানের একটা লেখা পড়েছিলাম তোমার সাথে দেখা হওয়ার আগে। তখন ভীষণ পছন্দের ছিল, এখন ঠিক ততটাই অপছন্দের। কারণ এখন মিলে গেছে না?
এক সমুদ্র ভালবাসার পরেও
যার অন্যের প্রতি থাকে ঝোঁক,
সেই মানুষটা আমার না হোক।
কারো উপর ভীষণভাবে আকৃষ্ট হয়ে
আমাকে যে দেখায় ব্যস্ত থাকার নাটক,
সেই মানুষটা আমার না হোক।
আমার দূর্বলতায় বারংবার আঘাত করে কাঁদিয়ে
যার বড্ড বেশি লাগে সুখ,
সেই মানুষটা আমার না হোক।
বুঝলে, শ্রেয়ান? সেই মানুষটা আমার না হোক। তোমাকে শোধরানোর জন্য আমি সময় দিয়েছিলাম পাক্কা চার বছরের অধিক। সময় ঘুরে আজ সাড়ে পাঁচবছর। তুমি শোধরাওনি। তারপর আমি তোমার বাড়ানো দূরত্বে দেয়াল টেনে দিলাম।”
চলবে…