শুক্লপক্ষের পরিশেষে পর্ব-৩৩+৩৪

0
351

#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|৩৩|

-“সময় দিয়েছি ৬ মাস। আমাকে আটকানোর। এই ৬ মাসে না পারলে ও আর কখনই আমাকে ডিস্টার্ব করবে না।”

শরৎ বাঁকা হাসে,
-“বোকাফুল!”

প্রিয় কিছু বলে না। চায়ের ডেট শেষ হলে শরৎ প্রিয়কে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। পকেট হাঁতড়ে ফোনটা বের করে। বুড়ো আঙ্গুলের সাহায্যে দক্ষ হাতে ফ্রেন্ডস গ্রুপে টাইপ করে, “স্পেশ্যাল মানুষটাকে নিয়ে আজকের এই সন্ধ্যেটাকে স্পেশ্যাল বানাব। আজ আড্ডা হবে না। উইশ মি গুডলাক।”

সিন হলো সবার। সবাই গুডলাক জানানোর সাথে বিভিন্ন মজা নেওয়া শুরু করল। শরৎ ততক্ষণে ফোন পকেটে পুড়ে ফেলেছে। পাশে বাইক স্ট্যান্ড করা। উঠে হেলমেট পরে নিল। প্রিয়কে পিছে উঠতে না দেখে বলল,
-“আমি পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যেতে পারি না। আর আজ রিকশা পাবেন না। আপাতত আমার এই হাওয়াইজাহাজ ছাড়া গতি নেই। লাজ-লজ্জা এক সাইডে সামলে নিয়ে উঠে পড়ুন। আমি লজ্জা দেবো না আপনাকে।”

প্রিয়র গাল দুটো লাল হতে থাকে,
-“আমি লজ্জা পাব বলে উঠছি না, আপনাকে কে বলল? বেশি বেশি ভাবেন, নীরজ ভাই। উঠছি আমি।”

প্রিয় উঠে বসতে নিলে শরৎ বলে,
-“তার মানে লজ্জা দিতে পারব? পার্মিশন আছে?”

প্রিয় গোপনে হাসে। শরৎ তা ধরতে পেরে বলে,
-“ম্যাডাম, উঠে বসুন। আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলে চালান কাটবে।”

প্রিয় এদিক-ওদিক তাকিয়ে উঠে বসল। এক হাত শরতের কাঁধে রাখতে গিয়েও রাখল না। শরৎ হেসে ফেলে। বাইক স্টার্ট করার আগ মুহূর্তে বলে ওঠে,
-“আমার কাঁধ এটা, রেস্ট্রিকটেড পার্কিং এরিয়া নয়। হাত রাখলে হাতসহ পয়সা কাটা যাবে না। নির্দ্বিধায় রাখুন।”

প্রিয় হাত রেখে বলল,
-“এত ঢং করছেন কেন, নীরজ ভাই?”

শরৎ বাইক স্টার্ট করে বলল,
-“ঢং? ওহে কন্যা, ওটা আপনাদেরই কাজ। আমাদের নয়।”
-“নীরজ ভাই, আপনি বড্ড বেশি কথা বলছেন।”
-“চুপ থাকব?”

প্রিয় এতক্ষণ লজ্জা পেয়ে বেশ অনেক কিছুই বলে ফেলেছিল। কিন্তু সে চায় না শরৎ থামুক। মিনমিনে স্বরে বলল,
-“না।”

শরৎ বাতাসের তেজে কিছু শুনতে পেল না। তাই আবারও শুধাল,
-“কী? থামব?”

প্রিয় জোরে বলল,
-“উঁহু! কথা বলুন। আপনাকে শুনতে ভালো লাগছে।”

প্রিয়র অকপটে স্বীকারোক্তিতে একটা পাতলা হাসির রেখে ধরা দিলো শরতের ঠোঁটে।

______
-“শোন মিস্টার প্রহর, এখন রাত্রির আট ঘটিকা। আর তুই বোধহয় ভুলে বসেছিস আগামী দিনটা আমার দিন। মানে আমার জন্মদিন। এনি প্ল্যান ফর মি, বেইবি?”

আয়াত ভীষণ উত্তেজিত গলায় কথাখানা বলে থামল। প্রহর চুপ থেকে সবটা শুনে তারপর হাতঘড়ির দিকে দেখল। আটটা কুড়ি বাজে। আয়াতের কথাকে শুদ্ধ করে বলল,
-“ইট’স এইট টুয়েন্টি পিএম..”

আয়াত ক্ষেপে উঠল,
-“তো? তোর কাছে আমার বার্থডে আগে নাকি আজগুবি কাহিনি আগে? আশ্চর্য! কোথায় তুই জান-প্রাণ দিয়ে আমার বার্থডে সেলিব্রেট করায় লেগে যাবি। তা নয়, এত রিল্যাক্সড বসে আছিস!”

প্রহর কপাল কোঁচকাল। মিহি আওয়াজে বলল,
-“বার্থডে সেলিব্রেট করার মতো কিছু?”

আয়াত দমে গেল। আর কিছু বলল না। ওর ফুলকো গালটা প্রহর ভিডিয়ো কলিংয়ের মাধ্যমে দেখতে পেল। বেশ ভালো লাগল দেখতে। আয়াত পড়ার টেবিলে বসে আছে। সামনে ফোন স্ট্যান্ডে ফোন রাখা। পরনে কালো রঙের টিশার্ট। দুই হাতের কনুই টেবিলের ওপর রাখা। হাতের তালুদ্বয়ের সম্মিলিত স্থানটিতে থুতনি দ্বারা মুখের ভর রাখা। ফুলকো গালে ঠোঁট কামড়ে ধরে, ভ্রু কোঁচকানো। চোখ দুটো ছোট ছোট হয়ে আছে। সরু নাকটা ফুলে ফেঁপে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। প্রহর এক ধ্যানে তা লক্ষ করে গেল।
আঁড়চোখে প্রহরের গতিবিধি লক্ষ করতে গিয়ে আয়াত আটকে গেল। নিজের দিকে এমন অভদ্র নজরে প্রহরকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আয়াত কেশে উঠল। প্রহরের বিমুগ্ধ নজরে ভাঁটা পড়ল। নিজের শক্ত রূপটা পুনরায় তুলে নিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
-“পানি খাও।”

আয়াত পানি খেয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন, ভাই? তোর চাহনি মাত্রাতিরিক্ত নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছে।”

স্বাভাবিকভাবেই প্রহর শুধাল,
-“তাকাতেও পারব না?”

বিষয়টা হজম করে নিয়ে আয়াত বলল,
-“নাহ, তাকা তুই! চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে তাকা, ইন ফ্যাক্ট তুই চাইলে খুলে নিয়েও তাকাতে পারিস। আই ওয়োন্ট মাইন্ড..”

প্রহর মনে মনে হাসল। প্রকাশ্যে মাথা নাড়ল,
-“হুঁ।”

আয়াত কিছু একটা ভেবে চওড়া হেসে বলল,
-“ইন্ট্রোভার্ট আর এক্সট্রোভার্টের জুটি ভীষণ দারুণ হয়, জানিস? একজন যেমন নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে না, অন্যজন তেমন কিছু লুকোতে পারে না। একজন আগুন তো অন্যজন পানি। প্রহর, তুই থেকে যা আমার হয়ে। আমি তোকে অসম্ভব ভালোবাসি।”

প্রহর পলক ঝাপটিয়ে সুদৃঢ় নজরে চেয়ে রইল। ঠোঁট নাড়ল অস্পষ্ট,
-“থেকে গেলাম..”

____
প্রিয় বাসায় ফেরার রাস্তায় ব্রিজের ধারে একটা আইস্ক্রিম পার্লার দেখে শরৎকে থামতে বলল। শরৎ রাস্তার পাশে বাইক পার্ক করল। প্রিয় নামার পর সে নেমে হেলমেট খুলতে খুলতে বলল,
-“এই ঠান্ডা ওয়েদারে কার আইস্ক্রিম খেতে ইচ্ছে করে, প্রিয়? বলবেন আমাকে?”

প্রিয় আইস্ক্রিমের অর্ডার দিয়ে শরতের দিকে তাকাল। চোখ পিটপিট করে উচ্চারণ করল,
-“আমি।”
-“স্ট্রেঞ্জ লেডি!”
-“হ্যাঁ, তো?”
-“কিছু নয়।”
-“কেন কিছু নয়, নীরজ ভাই? কিছু হওয়া উচিত। আসুন, ঝগড়া করি।”

শরৎ হেসে ফেলে,
-“আপনাকে দেখে আর ঝগড়া আসে না, ম্যাডাম।”
-“আসা উচিত। আমরা ঝগড়া যার-তার সাথে করতে পারি না। আমরা যাদের..”

প্রিয়র কথা সম্পূর্ণ করল শরৎ,
-“আমরা যাদের ভীষণ পছন্দ করি, কিংবা যাদের ভীষণ অপছন্দ করি—কেবল তাদের সাথেই ঝগড়া করতে পারি।”

প্রিয় শুধাল,
-“আপনি আমাকে পছন্দ করেন না, নীরজ ভাই?”

ঢাকার ব্যস্ত শহরের এই খোলা আকাশের নিচে শরৎ প্রিয়র চোখে চোখ রেখে বলল,
-“একটু বেশিই পছন্দ করি।”

প্রিয় সে চোখে স্থির তাকিয়ে আছে। শরৎ নিজের কথা সম্পূর্ণ করে পালটা শুধাল,
-“আপনি কি অপছন্দ করেন আমায়, প্রিয়?”

বিমুগ্ধ প্রিয় সোজাসাপটা বলল,
-“উঁহু। পছন্দ করি। আপনি ভীষণ মনের মতো মানুষ, নীরজ ভাই। কিন্তু..”

শরৎ নতমুখী হয়ে হাসল,
-“এক্সপ্লেনেশন লাগবে না, প্রিয়। এটুকু এনাফ।”

প্রিয় আর কিছু বলল না। আইস্ক্রিম বানানো শেষ হলে, আইস্ক্রিম দুটো নিয়ে একটা শরতের হাতে দিলো, অন্যটা নিজে নিল। তারপর বিল পে করতে গেলে শরৎ বলল,
-“আমি দিচ্ছি।”

প্রিয় নেতিবাচকতা প্রকাশ করল,
-“একদম না। কেউ আমার খরচ নিজে মেটাক, আমার পছন্দ নয়।”
-“এটা তো আমিও বলতে পারি। আপনি আমার বিলটাও নিজে দিতে চাইছেন।”

প্রিয় বলল,
-“এত কাহিনি করছেন কেন?”
-“আপনি কি চুপ আছেন?”
-“উফ! আসেন, ফিফটি-ফিফটিতে আসি।”

শরৎ হেসে ফেলল প্রিয়র এহেন কথা শুনে,
-“আজ্ঞে না। আপনি জব করেন না, প্রিয়। যেদিন জব পাবেন, সেদিন ট্রিট দেবেন। আজকেরটা আমার পক্ষ থেকে।”

প্রিয় তবুও মানতে রাজি নয়,
-“নিজেকে চালানোর মতো এনাফ ইনকাম আমার আছে, নীরজ ভাই।”
-“ওহ আচ্ছা, তাই? তা করেন কী?”

প্রিয় হাতের কর গুনে বলল,
-“দুটো টিউশনি করাই। ক্লাস টেনের ও টুইলভের। আর কন্টেন্ট রাইটিংয়ের মাধ্যমেও একটা হেলদি অ্যামাউন্ট আসে। মেয়ে মানুষ বলে অপজিশন সাইটকে কোনো কিছুতে কম মনে করবেন না।”

শরৎ মানিব্যাগ বের করে টাকা পে করে বলল,
-“করব না। বাট আজকেরটা আমিই দেবো। আপনাকে আমি মেয়ে মানুষ বলে নয়, বরঞ্চ আমার চেয়ে বয়সে ছোট একটা পিচ্চি ভাবছি। আর আপনি আমার প্রিয় মানুষও বটে। আমি সাথে থাকতে কী করে আপনাকে দিয়ে পে করাই? ওসব বাদই দিই। আপনি যদি নীহনকে নিয়ে বের হন, ফিফটি ফিফটি ভাগাভাগিতে বিবেকে বাঁধবে না?”

প্রিয় এবার দমে যায়। আইস্ক্রিম গলে যাচ্ছে। আমতাআমতা করে বলতে লাগে,
-“হয়েছে হয়েছে। পে করুন। বাট নেক্সট টাইম আমি।”
-“ওকে ম্যাডাম।”

প্রিয় আর শরৎ এগিয়ে গিয়ে ব্রিজের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। চুপ হয়ে আকাশ দেখতে এমন সময় খারাপ লাগছিল না। শরৎ বলে,
-“শ্রেয়ানের বিষয়টা আমার পছন্দ হচ্ছে না।”

প্রিয় নিজের ব্যক্তিগত বিষয়ে অন্য কারো মতামত এখন আর পছন্দ করে না। তবে আজ খারাপ লাগল না। বরঞ্চ ভালোই লাগল। ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
-“এই তো, আর সামান্য কটা মাস।”
-“হ্যাঁ, সামান্য কটা মাসে আপনি আবার পিছলে যান। আর আমি দেখতে থাকি।”
-“আপনি এত চেতছেন কেন, নীরজ ভাই?”

প্রিয় হাসতে হাসতে কথাটি বলে শরৎের দিকে তাকায়। শরৎ দাঁতে দাঁত পিষে চাপা কণ্ঠে বিরবির করে,
-“আমার যে কোথায় লাগছে, তা আপনি বুঝবেন না। ইচ্ছে করছে শ্রেয়ানকে ধরে পিস পিস করে কেটে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে আসতে। শালার খেক শেয়াল কোথাকার। ছ্যাহ!”

খুবই ধীর আওয়াজে বললেও, প্রিয় কথাগুলো শুনতে পেয়ে হো হো করে হেসে উঠল। তখন ওর ফোন বেজে উঠল। দেখল শ্রেয়ানের কল। প্রিয় বলল,
-“শয়তানের নাম নিতে নিতেই শয়তানের কল। নীরজ ভাই, আপনি এই মুহূর্তে এই শয়তানটার নাম উচ্চারণ করে চরম অন্যায় করেছেন।”
-“তা শাস্তি কী পাব?”
-“পরে ভেবে-চিন্তে বলব।”

শরৎ মাথা নেড়ে বলল,
-“এখন পিক করবেন?”

প্রিয় দুষ্ট হাসল,
-“হুঁ।”

কল কেটে গিয়ে পুনরায় রিং হতেই প্রিয় কল রিসিভ করে স্পিকারে দিয়ে দিলো। যান্ত্রিক মুঠোফোনে ওপাশ থেকে শ্রেয়ানের আওয়াজ এলো,
-“বেইবি, আ’ম্মিসিউ…”

শরতের মুখ ফসকাতে চাইলো। প্রিয়কে বলে উঠতে চাইলো,
-“প্রিয়, ও আপনাকে বেইবি ডেকেছে। ওকে এক্ষুনি আব্বু ডাকুন।”

চলবে?

#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|৩৪|

যান্ত্রিক মুঠোফোনে ওপাশ থেকে শ্রেয়ানের আওয়াজ এলো,
-“বেইবি, আ’ম্মিসিউ…”

শরতের মুখ ফসকাতে চাইলো। প্রিয়কে বলে উঠতে চাইলো,
-“প্রিয়, ও আপনাকে বেইবি ডেকেছে। ওকে এক্ষুনি আব্বু ডাকুন।”

তা বলল না শরৎ। প্রিয় রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। ফোনটা সামনে রেখে বলল,
-“হুম, এরপর?”

শ্রেয়ান বলল,
-“কী করছ, বেইবি?”

প্রিয় শরৎের দিকে তাকিয়ে ওকে রাগে ফুঁসতে দেখল। মিহি হেসে শ্রেয়ানকে বলল,
-“বাড়ির বাইরে আছি।”

ওপাশ থেকে শ্রেয়ানের চিন্তিত আওয়াজ এলো,
-“এত রাতে?”
-“আমার ইচ্ছে।”
-“দেখো প্রিয়শ্রী, তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমি এখন আর কিছু বলি না। তাই বলে তুমি যাচ্ছে তাই করে বেড়াতে পারো না। রাত করে এদিক-সেদিক কী? শহরের মানুষ ভালো না, সোনা। তুমি লোকেশন সেন্ড করো আমায়। আমি পিক করছি। ইউ ডোন্ট হ্যাভ ইনি আইডিয়া, এরা কত খারাপ!”

প্রিয় হেসে ফেলল,
-“বাট আই হ্যাভ মাচ আইডিয়া এবাউট ইউ, শ্রেয়ান। আই গ্যেস, তোমার চেয়েও বাজে কিছু ফেইস করতে হবে না।”

শ্রেয়ান চুপ থাকল। গতদিন ধানমণ্ডির এই অ্যাপার্টমেন্টে এসেছে শ্রেয়ান। উদ্দেশ্য ছিল খুব জলদি দেখা করবে প্রিয়র সাথে। এখন প্রিয়কে বাড়ির বাইরে থাকতে দেখে চটজলদি কথা বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল। পরনের কালো রঙা টিশার্ট আর গ্রে ট্রাউজারটা চেঞ্জ না করেই বেরোতে চেয়েছিল। পকেটে প্রয়োজনীয় ক্যাশ ঢুকিয়ে কারের চাবি হাতে নিতেই প্রিয় কথাটা বলে উঠল। শ্রেয়ান চাবিটা মুঠোবন্দি করে ফেলল। গম্ভীর আওয়াজে বলল,
-“তুমি কি একবারও বলতে পারো আমি তোমার সাথে বাজে বিহেভ করেছি? আমি তোমাকে তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কখনও ছুঁয়েছি?”

প্রিয় নেতিবাচকতা প্রকাশ করে বলল,
-“সবাই শরীর ছুঁয়ে কলঙ্কিত করে না, কেউ কেউ মন ছুঁয়ে মস্তিষ্ক নিয়ে খেলতে পছন্দ করে। তুমি ওমন একজন। একটা সাই…”

প্রিয়র কথা সম্পূর্ণ করল শ্রেয়ান,
-“সাইকো বলো আর যাই বলো, তোমারই তো।”

প্রিয় আগ্রহ দেখাল না। শরৎের দিকে তাকাল। সে হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। সেভাবে তাকিয়েই শ্রেয়ানকে বলল,
-“একটু ব্যস্ত আছি, শ্রেয়ান। রাখছি, হুঁ?”

শ্রেয়ান ত্বরিতে বলল,
-“এই! রাখবে না। আমি কলে থাকি। কথা বলো। সবসময় শুধু রাখি রাখি কোরো না। আমাকে টাইম দাও তুমি। ৬ মাস সময় দিলে, অথচ দিনে একবার একমিনিটের জন্য কথা বলো না, দেখা করো না। এভাবে চলবে?”

প্রিয় হাসল,
-“অভিযোগ করছ, শ্রেয়ান?”
-“কেন? করতে পারি না?”
-“অবশ্যই পারো। আচ্ছা, শুনি। ৫ মিনিট দিচ্ছি, ফটাফট অভিযোগগুলো করে ফেলো দেখি।”

শ্রেয়ান অভিযোগের পসরা সাজাতে থাকে,
-“তুমি আগের মতো অভিমান করো না।”
-“মান ভাঙাতে না এলে, অভিমানেরা মুখ ফিরিয়ে নেয়, আসতে চায় না।”
-“আগের মতো সময় দাও না।”
-“সময়গুলো দামী হয়ে গেছে, বুঝে-শুনে খরচ করি এখন।”
-“আমার খোঁজ নাও না।”
-“নিজেকে ভালো রাখায় ডুবে গেছি, অন্য কেউ মরলেও বিচলিত হই না।”
-“আমার জন্য তুমি কান্না করো না।”
-“চোখের জলেরাও একসময় শুকিয়ে যায়।”
-“তুমি আমায় ভালোবাসো না, প্রিয়শ্রী।”
-“এখনও আশা করো?”

শ্রেয়ানের দীর্ঘশ্বাস প্রিয় শুনতে পেল। সামান্য হেসে বলো,
-“ওয়েল ট্রাই। চেষ্টা করে যাও আর ৪ মাস। এর আগে যদি হাঁপিয়ে যাও, জানিয়ো।”

শ্রেয়ান বলল,
-“আমার ভালোবাসা তুমি এই ৬ মাসেই উপলব্ধি করতে পারবে। তখন আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারবে না।”
-“দ্যাটস দ্য স্পিরিট! চালিয়ে যাও। আমি রাখছি।”

কল কেটে দিলো প্রিয়। রেলিং থেকে সরে গিয়ে শরৎের মুখোমুখি দাঁড়াল। বুকে দু-হাত গুঁজে শরৎের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“বাহ রে নীরজ ভাই, আপনি ওমন গাল ফোলাচ্ছেন কেন?”

শরৎ তাকাল ওর দিকে, পকেটে হাত গুঁজে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
-“বুঝবেন? বুঝবেন না।”
-“বোঝালেই বুঝব, বোঝান।”

শরৎ কিছু বোঝায় না। প্রগাঢ় দৃষ্টিতে প্রিয়র চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রিয় ভড়কে যায়। এদিক-ওদিক তাকিয়ে সরে আসে। শরৎ তখন বলে,
-“জানেন প্রিয়, এই আপনিটা আমার বড়ো পছন্দের।”
-“জানি।”

ঠান্ডা পরিবেশে অনেকক্ষণ বাদে শরৎ আচমকা বলে ওঠে,
-“প্রহরের সাথে আমার অনেক আগে থেকেই যোগাযোগ আছে, জানেন?”

প্রিয় বলল,
-“জানতাম না।”
-“কাজিনগ্রুপে রিধিমা আপনার আর ওর একাউন্ট অ্যাড করে। ও কখনও কথা বলেনি, আমিও বলতাম না সেভাবে। আপনাকে আগে থেকে চিনলেও, তখন সেভাবে নোটিস করিনি। সম্ভবত ৪-৫ বছর আগে কলেজের রিইউনিয়নে ওর সাথে আমার দেখা হয়। আমি প্রথম দেখায় ঠিক চিনতে পারিনি, তবে ফেইসটা চেনা লেগেছিল। অনেকক্ষণ ভাবার পর চিনতে পারি। ওকে ডেকে, কথা বলে শিউর হই। তখন ও একদমই কথা বলত না। কেমন যেন ভীরু ছিল। তবে আমার ভালো লেগেছিল। তারপর মাঝে মাঝেই ওর সাথে কথা হয়। ও আমার সাথে স্বাভাবিক হতে থাকে। আমার কাছে সবকিছু শেয়ার করতে থাকে।”

প্রিয় এটুকু শুনে বলল,
-“ও আমাকে এসব জানায়নি! আমি অবাক হচ্ছি।”

শরৎ বাঁকা হেসে বলল,
-“তখন আপনি দিন-দুনিয়া ভুলে এক শয়তানের বাচ্চার ওপর ডুবে মরছিলেন। ওর জন্য সময় ছিল না আপনার।”

প্রিয় আর কিছু বলল না। অপরাধবোধে ভুগতে লাগল। শরৎ দম ফেলে বলল,
-“ও কারো সাথে মিশতে জানত না। ওর সব কথা কেবল আপনাকে বলত। অথচ ও ধীরে ধীরে আপনাকেও হারিয়ে ফেলে। প্রচণ্ড বিষণ্ণতায় ঘিরে থাকতে লাগে সারাটাদিন। তারপর আমি ওকে বিভিন্নভাবে মোটিভেট করতে থাকি। ওর আর আয়াতের গল্পটাও শুরু থেকেই জানা আমার। তারপর একদিন আপনার কথা জানায়। আপনাকে তখন আমি সেই ছোটবেলার অসম্ভব দুষ্ট মেয়ে হিসেবেই জানতাম। আমি বুঝতে পারছিলাম না, যেই মেয়েটাকে পুরো এলাকাকে নাকানিচুবানি খাইয়ে বেড়াতো, সেই মেয়েটাকে একটা ছেলে কীভানে নাকে দড়ি বেঁধে ঘোরায়? খুব অবাক হয়ে যাই। বয়স তো কম হয়নি। অনেকের গল্প শুনেছি। ফ্রেন্ড সার্কেলের অনেক মেয়েকে অল্প বয়সে এমন টক্সিক রিলেশনে জড়াতে দেখেছি, তাদের সেই বয়সেই ঝরে পড়তে দেখেছি। অনেক ফ্রেন্ডকে সুইসাইড করতেও দেখেছি। একপ্রকার ভয় জন্মালো। আপনার বিষয়টা খতিয়ে দেখব ভাবলাম। তখন প্রহর নিজ থেকেই আমাকে বলে, শ্রেয়ানের বিষয়টা একটু দেখতে। ওর পুরো ডিটেইলস বের করতে আমার সময় লেগেছিল একমাস। লাভ হয়েছিল ওর ফোন হ্যাক করে। শালার এত জায়গায় এত স্ক্যান্ডেলের সাথে জড়িত, আমি কালেক্ট করতে হিমশিম খাচ্ছিলাম।”

শরৎ তাকাল প্রিয়র দিকে। সে নিশ্চল দৃষ্টিতে রাস্তায় চলমান গাড়িগুলো দেখে যাচ্ছে। শরৎকে থামতে শুনে শুধাল,
-“তারপর?”
-“আশফিক রহমান শ্রেয়ান। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। বাবা সবসময় টাকা পয়সার পিছে ছুটতে ছুটতে ছেলেকে সময় দেয়নি সামান্যও। তার বাবার থেকে সময় পায়নি তার মা নিজেও। তাই মায়ের পরকীয়াও দেখেছে বেড়ে উঠতে উঠতে। বাড়িতে ওকে সামলানোর মতো তেমন কেউ ছিল না। নিজের মতো বড়ো হতে লাগল। পাগলামি বাড়তে লাগল। স্কুলে অসৎ সঙ্গ পেয়ে বিভিন্ন নেশা-টেশা করতে লাগল। কলেজে উঠে বাবার থেকেও সব রকমের ছাড় পেতে থাকল। পাবলিকলি নেশা করত। তখন থেকেই মেয়েজনিত বিভিন্ন কাণ্ডে নিজেকে জড়াতে লাগল। রাতে বাড়ি ফিরত না। প্রতিরাতেই নতুন নতুন টেস্ট করত। মেয়ে, নেশাদ্রব্য ও ক্যাসিনো। এই নিয়েই ওর লাইফ। এরপর ভার্সিটিতে উঠেই আলাদা থাকার জন্য বাড়িতে আবদার করল। বর্তমান অ্যাপার্টমেন্টটা ওর বাবা ওকে তার সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই গিফট করল। এখানে এসে উঠল। মেয়েদেরকে নিজ থেকে ওর প্রতি আকর্ষিত করার মধ্যে অন্যরকমের মজা পেত ও। ও কখনও কোনো মেয়েকে জোর করেনি রিলেশনের জন্য। মেয়েদের কেবল হালকা ইঙ্গিত দিত। আর তারা নিজে থেকেই সায় দিত। তারপর বেডে আসতেও দ্বিধা করত না। প্রতিটি মেয়ের সাথে বেড টাইমের ভিডিয়ো রেকর্ড করে রাখত। ব্রেকাপের সময় কোনো মেয়ে ঝামেলা করলে ওগুলো দেখিয়ে বেঁচে যেত। তোমার সাথেও একইভাবে এগোতে চেয়েছিল। তুমিও পা বাড়ালে। ও মেয়েদের ব্যাপারে এতটাই অভিজ্ঞ হয়ে গিয়েছিল যে, তোমার মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছিল তুমি জলদি জলদি এগোনোর মানুষ না। ও আস্তে আস্তে এগোতে লাগল। প্রথমে ফ্রেন্ডশিপ আর তারপর একটা টক্সিক রিলেশনশিপের সূচনা। তুমি খুব দারুণভাবে এগোচ্ছিলে। ও তোমার পিছে অযথা এত সময় অপচয় করতে চাইছিল না। তোমাকে একপাশে রেখে নিজের লাইফটা নিজের মতো লিড করে যাচ্ছিল।”

শরৎ থামল। বড়ো করে একটা শ্বাস টেনে আবার বলল,
-“বোকাফুল, তুমি টের পাওনি। ও তারপর মায়ায় জড়াতে থাকে। তোমার সরলতার মায়ায়। তোমাকে রেখে দেওয়ার মতলব আঁটে। ওর কোনো গার্লফ্রেন্ড এমন ছিল না। ওর কোনো গার্লফ্রেন্ড ৬ মাস টেকেনি, যেটা মাসখানেক টিকেছিল সেটাও নাকি টের পেয়ে গেছিল ওর বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে ডুব মারার আসল কাহিনি। কিন্তু তুমি কিচ্ছুটি বোঝোনি। ও তাই ভাবল, এরকম একটা পার্মানেন্ট মানুষ থাকলে ক্ষতি নেই। তোমাকে ও চেয়েছিল, এটা ধ্রুব সত্য। ঠিক যেমনটা তুমি বোকাফুল।”

প্রিয় মলিন আওয়াজে বলল,
-“আমি সত্যিই বোকাফুল। আমি ওর বিভিন্ন গার্লফ্রেন্ডের গল্পটা জানা সত্ত্বেও চুপ থাকি, বোকা সেজে থাকি৷ আমি চেয়েছিলাম ও দেখুক আমার ভালোবাসার গভীরতা। ও তা উপলব্ধি করে এক নারীতে আসক্ত হোক।”

শরৎ হাসল,
-“কুকুরের লেজ সোজা হয় না, প্রিয়।”
-“হুঁ।”
-“আপনি শুধু শুধু নিজের লাইফের এতটা সময় নষ্ট করেছেন।”
-“আমার এই আফসোস যাবে না।”
-“আফসোস করবেন না। ভুল থেকে শিক্ষা নিন। আপনি কি জানেন, এই ভুল আপনাকে বড়ো করে তুলেছে? আপনাকে ম্যাচিউর করে তুলেছে?”
-“হুঁ।”

শরৎ ইচ্ছাকৃত কুহকের বিষয়টা এড়িয়ে গেল। এই নিয়ে তার আলাদাই পরিকল্পনা আছে। প্রিয় বলল,
-“আপনি আমাকে পছন্দ করেন কখন থেকে, নীরজ ভাই?”

প্রিয়র প্রসঙ্গ এড়ানোর ধরন দেখে শরৎ না চাইতেও অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলল।

চলবে…