#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|৩৫|
-“আপনি আমাকে পছন্দ করেন কখন থেকে, নীরজ ভাই?”
প্রিয়র প্রসঙ্গ এড়ানোর ধরন দেখে শরৎ না চাইতেও অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলল। তারপর প্রিয়কে বলল,
-“ভেঙে গুড়িয়ে যাওয়া মেয়েকে যখন কোমরে গামছা বেঁধে ঝগড়া করতে দেখলাম, ঠিক তখন। আমি এতটা পরিবর্তন অন্য কোথাও দেখিনি, অন্য কারো মধ্যে দেখিনি। মানুষ ভিন্নতায় আটকায়। আমি মনুষ্যজাতির বাইরের নই। তাই একটা ঝগড়ুটে মেয়েতে পিছলে গেলাম।”
প্রিয় পিটপিট করে তাকাল। শরৎ ওর দিকে তাকায়। ওকে প্রলুব্ধ করতে বলে ওঠে,
-“কিন্তু তুমি যে আরও দুইধাপ এগিয়ে, তা জানা ছিল না। আমাকে পছন্দ করতে কতক্ষণ সময় নিয়েছিলে?”
প্রিয় গাল ফোলাল,
-“আপনাকে আমি পছন্দ করি বাচ্চাকাল থেকেই। যখন আমি কিছু বুঝতামই না, ঠিক তখন থেকেই আপনাকে অনুকরণ করে এসেছি।”
-“এই পছন্দ না রে, পাগলি। বড়োদের পছন্দ করার কথা বলছি। কবে তুমি আমাকে বড়োদের মতো পছন্দ করা শুরু করলে?”
প্রিয় আমতাআমতা করে বলল,
-“আমার খেয়াল নেই। আপনি অপছন্দ করার মতো মানুষ নন। তাই শুরু থেকেই বোধহয়।”
শরৎ আবারও ঠোঁট চেপে হাসল। প্রিয় শুধাল,
-“আপনি আমাকে শুরুতে আপনি, এরপর তুমি, এখন আবার আপনি করে কথা বলেন কেন?”
শরৎ এর একটা দারুণ জবাব দিলো,
-“বড়ো হওয়ার পর প্রথম দেখা। তুমি করে ডাকাটা সমীচীন নয়। তাই আপনি করে ডেকেছি। এরপর তুমিতে এলাম। এসে দেখলাম, আপনিটাই বেশি ভালো লাগছিল। বেশি সুইট, একটু বেশিই কেয়ারিং শোনাচ্ছিল। তাই আর কী। আর আপনি?”
প্রিয় সামনের সব ক’টা দাঁত বের করে হেসে বলল,
-“সেম!”
_____
ফিরতে ফিরতে রাত নয়টা। শরৎ প্রিয়কে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। প্রিয় একবার ভেতরে আসতে বলতে চেয়েছিল। কিন্তু এতরাতে শরৎকে সাথে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলে নাহারা পারবে না আজই শরৎকে মেয়ের জামাই হিসেবে কবুল করে নেবে! প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বিদায় জানাল প্রিয়। বিদায়সূচক শব্দ হিসেবে প্রিয় বলেছিল,
-“আপনি একজন দারুণ মানুষ, নীরজ ভাই। একদম মনের মতো। সব ঠিক থাকলে দারুণ মানুষটাকে নিজের মানুষ বলতে পারতাম। অথচ ভাগ্য সহায় হলো না।”
শরৎ তা শুনে মিহি হাসে। যেই হাসিটা আঁধারিয়ায় বড়ো করুণ সুরে প্রিয়কে জানিয়েছিল,
-“প্রিয়! এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ফুল। আপনি কি জানেন? আপনি চাইলেই আপনি আমার আর না চাইলেও আমি আপনার…”
প্রিয় বাড়ি ফেরার পর নাহারার চিন্তারত মুখ দেখতে পেল। আসার সময় একবার জানিয়েছিল অবশ্য যে ফিরতে দেরি হবে। তবুও মা তো! প্রিয় এসে সবার আগে নাহারাকে জড়িয়ে ধরল। নাহারাও মেয়েকে আগলে নিলেন। হেসে ফেলে বললেন,
-“হঠাৎ এত আহ্লাদ?”
-“মাঝে মাঝে এরকম আহ্লাদী হতে মন চায়, আম্মু।”
-“ওরে আমার আহ্লাদী রে!”
প্রিয় হাসে,
-“হয়!”
-“দিন কেমন কাটল, মা? সব ভালো?”
প্রিয় নাহারাকে জড়িয়ে ধরেই সোফায় বসে পড়ল। দুইহাতে নাহারার ডান হাতটি জড়িয়ে নিয়ে কাঁধে মাথা রেখে বলল,
-“ভীষণ ভালো।”
নাহারা বাঁ হাতটি প্রিয়র গালের এপাশে রেখে বলল,
-“ভালো আছ, মা?”
-“আলহামদুলিল্লাহ আম্মু, ভালো আছি।”
-“সত্যি ভালো আছ?”
-“সত্যি সত্যি ভালো আছি।”
-“যাক, আলহামদুলিল্লাহ।”
প্রিয় হেসে আরও খানিকটা আহ্লাদ করে বলল,
-“এই তুমিটাকে যদি শুরুতে পেতাম! তাহলে আমি কোনো ভুল করতাম না। প্রতিটি মায়ের উচিত নিজের মেয়ের বন্ধু হওয়া। আমি তোমাকে বন্ধু হিসেবে পেয়েছি, তবে দেরি করে। আচ্ছা আম্মু, এই দেরিটা হওয়া কি খুব জরুরি ছিল?”
নাহারা ব্যথিত হলো প্রিয়র মলিন আওয়াজ শুনে। আসলেই প্রিয়কে সে ছাড় দিয়েছিল, কিন্তু বন্ধুত্বটা করেনি। এই আফসোস তার নিজেরও। নাহারার নিশ্চুপতায় প্রিয় বলে উঠল,
-“যদি আমার কখনও মেয়ে হয়, আমি আমার মেয়ের বন্ধু হব। আমি তাকে কোনো কিছু করতে বারণ করব না। আমি তাকে সব করতে দেবো। তাই সে আমার থেকে কিছুই লুকোবে না। বাচ্চাদের একটা ধ্রুব স্বভাব কী জানো? তাদের যা করতে নিষেধ করা হবে, তারা তা-ই করবে, করবেই! আমি আমার মেয়েকে কোনো কিছু করতে নিষেধ করব না। ওকে করতে দেবো। সেই সাথে সবকিছুর পরিণাম সম্পর্কে অবগত করব।”
নাহারা প্রিয়র মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। প্রিয় টুপ করে নাহারার কোলে শুয়ে পড়ল। সোফায় টান টান হয়ে শুয়ে নাহারার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“ধরো ও আমাকে এসে বলল, ওর ফ্রেন্ডস সবার কাছে ফোন আছে। আমি ওকে ফোন দেবো তখনই। ফোন হাতে দিয়ে তারপর ওকে এর সব ক্ষতিকর দিকগুলো জানিয়ে দেবো বিস্তারিতভাবে। এটা থেকে কী কী হতে পারে, সব। ফোন ওর জন্য নিষিদ্ধ না, এজন্য ও অ্যাডিক্টেড হবে না।
আবার ধরো, ওকে কোনো ছেলে প্রপোজ করল। ও আমাকে এসে অবশ্যই বলবে যদি আমি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে থাকি। আমি তখন ছেলের ব্যাপারে বিস্তারিত জানব। ওকে সতর্ক করব কোন ধরনের ছেলেরা কেমন হয়ে থাকে। ওকে নিষেধ করব না, শুধু সতর্ক করব।
আম্মু, জানো? আমি আমার বাচ্চাদের সবসময় পজিটিভ থিংকিং শেখাব। ধরো, এখনকার গার্জিয়ানরা কী বলে? বলে যে, এক্সামে ফেইল করলে এই হবে, সেই হবে। আমি আমার বাচ্চাদের জানাব, এক্সামে হাই স্কোর করলে কী কী হবে।
ওরা ওদের সন্তানদের মন বোঝে না। অথচ আমি হব বেস্ট ফ্রেন্ড।”
প্রিয়র চোখে আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলো জ্বলজ্বল করছে। নাহারা বিস্মিত হলো। সে-ও তো পারতো নিজের মেয়ের বন্ধু হতে। পারতো! পারল না কেন? প্রিয়র ভাগ্যে এরকম একটা ধাক্কা ছিল বলেই পারেনি। নাহারা এসব ভাবতে ভাবতেই প্রিয় বলে উঠল,
-“আম্মু, শ্রেয়ান আমাকে আবারও স্টক করছে।”
নাহারা চমকে উঠল। জিজ্ঞেস করল,
-“কবে থেকে?”
-“আগে থেকেই।”
-“আমাকে বলোনি কেন?”
-“প্রয়োজন পড়েনি।”
-“আজ বললে?”
-“হয়তো আমি ভেবে নিয়েছিলাম, আমি বড়ো হয়ে গেছি। নিজেরটা নিজে বুঝে নিতে পারব। নিজে থেকে নিজের সমস্যাগুলো হ্যান্ডেল করতে পারব। কিন্তু এই মুহূর্তে তোমার কোলে শুয়ে আমি উপলব্ধি করলাম, আমি একটুও বড়ো হইনি। আমি এখনও তোমার আদরের জন্য হুটহাট আবদার করি। আমি এখনও তোমাকে চোখের আড়ালে রেখে খুব বেশি সময় থাকতে পারি না। ছোটবেলায় যেমন তোমার ওড়না ধরে ধরে ঘুরতাম না? তুমি রান্নাঘরে গেলে ওড়নার কোণা ধরে আমিও যেতাম, তুমি রুমে গেলে পিছু পিছু আমিও। কিছু সময়ের জন্য চোখের আড়াল হলে চিল্লিয়ে বাড়ি মাথায় তুলতাম না? আমি এখনও তোমাকে খুব বেশিক্ষণ না দেখতে পেলে ছটফট করি। তোমার কাছে এলে কী যে শান্তি! একটা বড়ো মানুষ কখনই কারো কোলে এসে টুপ করে শুয়ে পড়ে না। আমি পড়ি। কারণ আমি এখনও ছোট। তোমার কাছে ইহজনমে বড়ো হওয়ার ইচ্ছে নেই। আম্মু, জানো? তোমার কাছে খুব শান্তি, খুব সুখ। আমার সব দুঃখ মিটে যায়।”
নাহারার চোখ থেকে টুপ করে এক ফোটা জল গড়াল। প্রিয় তা দেখল না। প্রিয় চোখ বুঁজে কথা বলে যাচ্ছে,
-“আম্মু, তোমার মেয়ে ভীষণ শক্ত। তোমার মেয়ে না? শক্ত না হয়ে পারবে নাকি? একদম না। ওই ছেলেটাকে নিয়ে টেনশন কোরো না। আমি ওর কাছে ফিরব না। ও জ্বালাতে জ্বালাতে হাঁপিয়ে যাক, মরে যাক।”
নাহারা নিজেকে সামলে নিল। প্রিয়র চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলল,
-“তবুও ও এসেছে, বিষয়টা কেমন যেন!”
-“হ্যাঁ, কেমন যেন আমিও জানি। তুমি চিন্তা কোরো না। হ্যাঁ, এভাবেই বিলি কেটে দাও চুলে। ভালো লাগছে। আম্মু, নীরজ ভাইকে চেন না?”
প্রিয় থেমে থেমে কথাগুলো বলল। শেষ প্রশ্নের বিপরীতে নাহারা বলল,
-“হ্যাঁ, চিনব না কেন? কী হয়েছে? কোনো সমস্যা?”
-“না না, সমস্যা নয়। তবে শ্রেয়ানের ব্যাপারটা প্রহর আর নীরজ ভাই মিলে ধরতে পেরেছিল।”
-“প্রহর নীরজকে এসব জানিয়েছে?”
-“হ্যাঁ। তুমি অবাক হচ্ছ না?”
-“না। অবাক হওয়ার কী আছে? ওদের মধ্যে ভালো একটা বন্ডিং আছে, তা কি অজানা নাকি?”
-“আশ্চর্য আম্মু, আমি বাদে সবাই জানে!”
-“কী?”
-“এই যে, নীরজ ভাইয়ের সাথে প্রহরের যোগাযোগ।”
-“নীরজের সাথে শুধু প্রহরের না, আমাদের সবারই যোগাযোগ আছে। প্রহরের মাধ্যমে জানতে পারি ও এই শহরেই থাকে। খুব একটা দূরেও তো না। তারপর থেকে প্রায়ই দেখা-শোনা হতো। এই বাসাতেও তো এসেছে অনেকবার।”
প্রিয় লাফিয়ে উঠল,
-“আমি কই মরেছিলাম, আশ্চর্য! আমার বাড়িতে এসে নীরজ মশাই নৃত্য করে যায়, আমি জানি না!”
নাহারা প্রিয়র মাথায় একটা চাটি মেরে বলল,
-“তুই তো ওই শয়তানের বাচ্চার মধ্যে মরেছিলি, জানবি কীভাবে? সারাদিন রুমের ভেতর পড়ে ছিলি। এদিকে নীরজ এই বাড়িতে আসত, গল্প করত, খাওয়া-দাওয়া করে তারপর যেত। প্রহরকে একদম আপন ভাইয়ের মতো ট্রিট করে। আমার আরেক ছেলে ও।”
প্রিয়র ফেইসটা সেন্টি ইমোজির মতো, এক্সপ্রেশন ছাড়া একটা হাসি ঠোঁটে ঝুলছে। সে হজম করতে না পেরে বলে উঠল,
-“এটা কী শুনাইলা, আম্মা? ওই ব্যাটা নীরইজ্জ্যা আমার বাড়িত আইসা খায়-দায় যাইত, আমার মায়রে মা আর আমার ভাইরে ভাই বানাইলো। এখন আমারে শুধু বইন বানানোই বাকি আছে। ওরে কল দেও। এক্ষুনি কও শুভ কামডা করি ফেলতে।”
চলবে..
#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|৩৬|
রাতে নিজের রুমে ফেরার আগে প্রিয় একবার প্রহরের রুমের দিকে গেল। দরজা নক করলে কিছুক্ষণ পর ওপাশ থেকে প্রহর দরজা খুলে দিলো। প্রিয়কে আসতে দেখে বলল,
-“কী খবর, আপু। হঠাৎ?”
-“এমনিই। ভেতরে আসতে দিবি না?”
-“হ্যাঁ, আয়।”
প্রিয় ভেতরে এলো। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে বলল,
-“কুড়ি মিনিট দিলাম। তোর একূল-ওকূল সবকূলের ডিটেইলস ফটাফট বল।”
প্রহর ভ্রু-কুঁচকে বলল,
-“বুঝিয়ে বল।”
-“আয়াতের সাথে কী চলছে?”
মুখের সামনে হাত রেখে সামান্য কেশে উঠল প্রহর। এদিক-ওদিক তাকাল। তারপর চুলগুলো সামান্য চুলকে নিয়ে বলল,
-“নাথিং স্পেশ্যাল।”
প্রিয় বাতাসে হাত নেড়ে বলল,
-“আ-রে বল! আমরা আমরাই তো।”
প্রহর ঠোঁট চেপে হাসল,
-“তাই না? আমরা-আমরাই?”
দু-পাটি দাঁত বের করে প্রিয় বলল,
-“ইয়েস!”
প্রহর হেসে ফেলল,
-“আচ্ছা, শোন।”
-“হুম হুম, বল বল।”
-“কলেজ লাইফ থেকেই আমার লাইফটা ভাজাভাজা করে আসছে ও। তারপর আস্তে-ধীরে কীভাবে যেন ফল করল। আমি তখন রিলেশনশীপ ব্যাপারটা পছন্দ করতাম না। তো সেভাবেই চলছে। কথা হচ্ছে। আমি আমার মতো থাকি, ও ওর মতো সারাক্ষণ বকবক করতে থাকে…”
প্রিয় ঠোঁট উলটে বলল,
-“যাহ! এটুকুই?”
প্রহর সেন্টার টেবিলটা টেনে প্রিয়র মুখোমুখি বসে পড়ে বলল,
-“আমাদের ঘটা করে প্রেম হয়নি, প্রেমের আনুষ্ঠানিকতাও হয়নি। শি ইজ ম্যাড অন মি, আর আমি চুপচাপ ওর ম্যাডনেস দেখে যাই। বিষয়টা চমৎকার।”
প্রিয় উদাস গলায় বলল,
-“ও তোকে ভালোবাসে?”
-“পাগলের মতো বাসে।”
-“আর তুই?”
-“তোর কী মনে হয়?”
-“মনে হচ্ছে পছন্দ করিস।”
-“তাহলে তাই।”
প্রিয় রাগ করল,
-“যাহ! তুই বল। ভালোবাসিস?”
-“নিঃসন্দেহে।”
-“ও প্রকাশ করেছে ওর অনুভূতিগুলো?”
-“মুখে বলেছে অনেকবার, আর ওর চাহনি সেগুলো বিশ্লেষণ করেছে অসংখ্যবার। ও যতবার তাকায়, ততবারই ওর চোখে বিষণ্ণ মুগ্ধতা ও এক আকাশ সমান ভালোবাসা দেখতে পাই।”
-“তুই তোর ফিলিংসগুলো মুখে বলিসনি?”
-“আমার নিশ্চুপ চাহনি ওকে সহস্রাধিক বছর ধরে সঙ্গ দেবে বলে অঙ্গীকার করেছে।”
প্রিয় মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে,
-“ইন্ট্রেস্টিং! শোন, এই উইকেন্ডে ফ্রি আছিস?”
-“হ্যাঁ। আছি।”
-“আর আয়াত?”
-“ও ২৪/৭ ফ্রি।”
-“আর তোর প্রিয় অভিবাবক? তিনি ফ্রি?”
প্রহর কপাল কুঁচকে বলল,
-“আই গ্যেস তুই নীরজ ভাইয়ের কথা বলছিস!”
প্রিয় শয়তানি হাসে,
-“জি।”
-“জিজ্ঞেস করে দেখতে হবে ফ্রি আছে কি না।”
-“যদি ফ্রি থাকে, তবে বলে দিস এই উইকেন্ডে সবাই মিলে একটু লাঞ্চে যাব।”
-“আচ্ছা।”
প্রিয় নিজের রুমে চলে এলো। ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার শেষে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুম দিলো। ঘুম ভাঙল সাড়ে বারোটার পর। অভ্যেসবশত ফোন হাতে নিল। নিউজফিড ঘাটতে ঘাটতে বোর হয়ে এলে ম্যাসেঞ্জারে চলে এলো। সবার ওপর একটি অনাকাঙ্ক্ষিত অ্যাকাউন্ট থেকে আনরিড ম্যাসেজ জ্বলজ্বল করছে। পাশে দেখা গেল, ম্যাসেজটা এসেছে আরও ৩৫ মিনিট আগে। প্রিয় সিন করল নীরজ শিকদার নামের অ্যাকাউন্ট থেকে আসা ম্যাসেজটি।
কিছু পিকচার সেন্ড করেছে। প্রিয় ছবিগুলো ওপেন করল। একটাতে সে ব্রিজের ধারে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে আর খোলা চুলগুলো অন্য হাত দিয়ে এলোমেলো করছে। আরেকটাতে আইস্ক্রিমের কোণ খেতে গিয়ে নাকে লেগেছে, আরেকটিতে প্রিয় সেই নাকে লাগা আইস্ক্রিমটা ট্যাড়া চোখে দেখছে। আরেকটাতে রোড সাইড বেঞ্চে বসে চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া। এরকম অনেকগুলো ছবি।
প্রিয় দেখল, সবগুলাই লুকিয়ে তোলা। গোপনে হাসল। তারপর লিখল,
-“এত নজর দেওয়া ভালো না, মশাই।”
প্রিয় ভাবল, এখন শরৎ দেখতে পাবে না তা। প্রিয়কে অবাক করে দিয়ে তৎক্ষনাৎ সিন হলো। পাশের গোল বৃত্তটি প্রথমে নীল, এরপর শরতের প্রোফাইলে পূর্ণ হলো। সাথে যোগ হলো অন্যপাশের টাইপিং লেখাটি।
শরৎ রিপ্লাই দিলো,
-“কিছু স্পেশ্যাল জিনিসে নজর দেওয়া, কিছু স্পেশ্যাল মানুষের জন্য স্পেশ্যালি বাধ্যতামূলক।”
-“যাহ নীরজ ভাই, নিজেকে স্পেশ্যাল বললেন?”
-“আপনাকেও তো বললাম।”
-“স্পেশ্যাল?”
-“নাহ, আমার।”
প্রিয় ঠোঁট কামড়ে হাসে। শরৎ ম্যাসেজ করে,
-“ঘুম থেকে উঠলেন সবে?”
-“হুঁম।”
-“শান্তিকুঞ্জে থাকার সময় তো ঘুমাতেনই ৩টার পর! আজ এত আগে অর্ধেক ঘুম হয়ে গেল যে?”
টিজ করাটা প্রিয় ধরতে পারল না, রিপ্লাই দিলো,
-“ভার্সিটি, টিউশনি শেষে বাসায় ফিরতে ফিরতে টায়ার্ড হয়ে যাই। ঘুম আপনা-আপনি এসে পড়ে।”
-“এখন কী করছেন?”
-“এই তো, বসে। আপনি?”
-“আমিও।”
অনেকক্ষণ ম্যাসেজিংয়ের পর হুট করে শরৎ বাহানা দিলো,
-“আমার না হাতে ব্যথা হচ্ছে।”
-“হঠাৎ?”
-“হ্যাঁ, টাইপিং করতে পারছি না।”
-“আচ্ছা, তাহলে ঘুমিয়ে পড়েন। শুভ রাত্রি।”
-“এই না, কথা শেষ হয়নি তো।”
-“তাহলে কী করব?”
শরৎ শুধু একটা ইমোজি ম্যাসেজ দিলো,
-“☹️”
প্রিয় ব্যাপারটা ধরতে পেরে ফিক করে হেসে ফেলল। তারপর কল দিলো। শরৎ কল রিসিভ করল সাথে সাথেই। প্রিয় ফোন কানে চেপে ধরল, কিছু বলল না। ওপাশ থেকে শরৎও কিছু বলছে না। প্রিয় অনেকক্ষণ বাদে দু’বার বলল,
-“হ্যালো! হ্যালো!”
অতঃপর নিস্তব্ধতায় ঘেরা শরতের আওয়াজ এলো,
-“এটা বুঝতে এত সময় লাগালেন কেন, ফুল?”
প্রিয় চোখ বুঁজে ফেলল। এজন্যই শরৎকে তার এত বেশি পছন্দের। ওর কল্পপুরুষের সাথে একাধিক বৈশিষ্ট্যে মিলে যায় বলে। প্রিয় গায়ের কম্বলটা সরিয়ে বিছানা থেকে পা নামাল। রুম স্লিপারটা পরে নিয়ে আলতো পায়ে বারান্দায় চলে এলো। শরৎ জিজ্ঞেস করল,
-“ভালো আছেন, ম্যাডাম?”
প্রিয় রেলিংয়ে সামান্য ঝুঁকল। পরিচ্ছন্ন আকাশে শহুরে ঘ্রাণ। প্রিয় বড়ো করে একটা শ্বাস টেনে বলল,
-“ভীষণ ভালো। আপনি?”
-“এতক্ষণ ভালো। আপনার ‘ভালোর’ পাশের ‘ভীষণ’ বিশেষণটা আমার ভালো থাকার পরিমাণটা বাড়িয়ে দিয়েছে।”
প্রিয় হাসে,
-“তাই?”
-“জি।”
-“এবার বলুন তো, এভাবে লুকিয়ে-চুরিয়ে ছবি তুললেন কেন?”
-“একটা দারুণ স্মৃতি ক্যাপচারের জন্য।”
-“আপনি কি জানেন নীরজ ভাই, আমি স্মৃতিবন্দী পছন্দ করি না?”
-“আপনি কি জানেন প্রিয়, আপনি দুঃখ ভুলতে সুখের স্মৃতি বারংবার মনে করতে পছন্দ করেন?”
প্রিয় থমকে যায়। তার পছন্দের এত সূক্ষ্ম জিনিসও শরতের নরজ এড়ায়নি বলে সামান্য অপ্রস্তুত হয়। শরৎ বলে ওঠে,
-“খাওয়া-দাওয়া হয়েছে রাতে?”
-“উম..আপনার?”
-“হ্যাঁ। এখন আবার ঘুমাবেন?”
-“উম.. পরে।”
-“কেন?”
-“কথা বলতে ভালো লাগছে নীরজ ভাই, আসেন দুটো সুখ-দুঃখের গল্প করি।”
ওপাশ থেকে শরতের কণ্ঠটা কেমন যেন শোনাল,
-“ঘুমান এখন। শুভ রাত্রি।”
প্রিয়কে কিছু বলতে না দিয়েই শরৎ কল কেটে দিলো। প্রিয় স্তব্ধ বনে দাঁড়িয়ে রইল। যাহ! এটা কী হলো? পরপরই শরতের ম্যাসেজ আসে,
-“এভাবে কখনও ঘুম থেকে উঠে আমায় কল দেবেন না, ঘুমভাঙা চোখমুখ নিয়ে আমার সামনে আসবেন না, প্রিয়।”
প্রিয় জিজ্ঞেস করল,
-“কেন?”
-“আমি নিয়ন্ত্রণ হারাই। প্রথমত আপনি আমার প্রিয় নারী। দ্বিতীয়ত আপনি আমার শখের নারী।”
প্রিয় কিঞ্চিৎ লজ্জা পেলেও তা প্রকাশ করল না। বরঞ্চ পালটা প্রশ্ন করল নিজেকে ভীষণ স্বাভাবিক দেখিয়ে,
-“প্রিয় নারী আর শখের নারী—দুটো শব্দ আলাদাভাবে মেনশন করলেন কেন? একই না?”
-“না, ম্যাডাম। ভাবার্থ ভিন্ন। প্রিয় তো অনেকেই হয়, শখের সবাই হতে পারে না। বলতে গেলে শখের সবকিছুই আমাদের প্রিয় অথচ প্রিয় সব শখের নয়। আপনি দুটোই।”
প্রিয় পুনরায় কল দিলো। শরৎ রিসিভ করেই জিজ্ঞেস করলাম,
-“আমাকে জ্বালাতে খুব ভালো লাগে আপনার, তাই না?”
প্রিয় ঠোঁট চেপে হাসে। শরৎ আর কিছু বলল না। ছাদে শীতলপাটি বিছিয়ে বসে ছিল। এখন এক হাত মাথার নিচে রেখে টুপ করে শুয়ে পড়ল। মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল।
প্রিয় নিজেও আকাশের দিকে তাকাল। জ্যামজটবিহীন একটা রাস্তা। একে-অপরের বিপরীতে একটা নির্দিষ্ট সিরিয়াল মেইনটেইন করে একাধারে অসংখ্য ল্যাম্পপোস্ট। এদিকের ল্যাম্পপোস্ট তিনটা নষ্ট হয়েছে বোধহয়। জ্বলছে না। দূরের আলোয় আবছা অন্ধকার রাস্তাটির অন্ধকারত্ব পরিষ্কার, আর ঠিক উপরের দিকটায় একটা ভীষণ সুন্দর বাঁকা চাঁদ। থমথমে নিরবতায় প্রিয় শরতের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দগুলো উপলব্ধি করতে শুরু করল। চমকে উঠল তৎক্ষণাৎ। অস্থির ভঙ্গিমায় শরৎকে বলল,
-“শুভ রাত্রি।”
তারপর কল কাটল। আচমকা কল কাটায় শরৎ কান থেকে ফোন সরিয়ে একবার সামনে নিয়ে এলো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। কল ব্যাক করল না। পরপর পাশে রেখে টানটান হয়ে শুয়ে হাসতে লাগল৷
তারপর প্রিয় আবারও ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডি-অ্যাক্টিভেট করে ফেলল। নয়তো বেশি বেশি হতে হতে লাগবে শরতের সাথে। হুমায়ুন আহমেদ স্যার বলেছেন, ভালোবাসার মানুষের খুব বেশি কাছে যেতে নেই।
শরৎ ওর ভালোবাসার নয়, তবে পছন্দের এবং অত্যাধিক প্রিয়ও বটে। প্রিয় ছাদে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে লাগল। অস্থির মন শান্ত হলে রুমে এসে শুয়ে পড়ল। ঘুমোনোর আগে আরেকবার যখন ফোন হাতে তুলল। হোয়াটসঅ্যাপে একটা ম্যাসেজ শো হলো,
“কার কাছ থেকে পালাচ্ছেন, ফুল? আমার অনুভূতিকে পছন্দের বেলিফুল ভেবে ডায়েরির পাতায় সযতনে ফেলে রাখতে আপনি পারেনই। তবে নিজেরটা? আপনার অনুভূতি আপনায়য় ক্ষণে ক্ষণে কিছু মিষ্টিক্ষত দেবে। আপনাকে জানাবে, আমাদের গল্পটা কোনো অপ্রেমের নয়। আমাদের দারুণ একটা প্রেমের গল্প হবে। আপনি প্রস্তুত?”
চলবে…গল্পের তার মানে মানে কি করো না এটা এটা তো