#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|৩৯|
প্রিয় জবাব না দিয়ে জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে রইল, অতঃপর সামান্য হাসল। একইভাবে শরৎও হেসে বলল,
-“আমিও।”
প্রিয় কপাল কুঁচকে ফেলল হাসতে হাসতে। এক আকাশ সমান অনিশ্চয়তার সাথে শুধাল,
-“আপনারও কোনো এক্সমেক্স কিংবা টক্সিক মোমেন্টাম ছিল নাকি?”
-“আপনার ছিল।”
-“আমারটা তো ছিলই, এখনও পিছে দৌড়াচ্ছে। এজন্য আমি উঠতে-বসতে সেন্টি খাই। বাট হুয়াই ইউ?”
-“কারণ আমার মানুষটার কষ্ট আমি তার থেকেও বেশি উপলব্ধি করতে গিয়ে হাড়কাঁপানো কষ্টে দুমড়ে যাই।”
ভেতর থেকে প্রিয় কেঁপে উঠল। শরৎ কিছু বলল না। সোজা তাকিয়ে ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিলো। অনেকটা সময় নিস্তব্ধতার নামে লিখে দেওয়ার পর প্রিয় কেশে উঠল,
-“উহুম উহুম!”
শরৎ আড়ালে হাসে,
-“বলুন কী বলবেন। নার্ভাস হচ্ছেন কেন? আমরা-আমরাই তো।”
প্রিয় নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
-“আপনি সব কিছুতে মাত্রাতিরিক্ত করা শুরু করছেন, নীরজ ভাই। আমাদের মধ্যে একটা ভালো বন্ডিং আছে। এর বেশি কিছু আই গ্যেস পসিবল না। আপনার এসব কথায়, এসব ব্যবহারে আমি ভীষণ অপ্রস্তুত হই। আমার খারাপ লাগে।”
শরৎ গাড়িটা একটা ফুচকার স্টলের সামনে পার্ক করল। তারপর নিজের সিটবেল্ট খুলে প্রিয়র দিকে ঘুরে শান্ত হয়ে বসে বলল,
-“ফার্স্ট অব্ অল, আমাদের মধ্যে কী আছে—আমার চেয়ে বেশি আপনি ভালো জানেন। আমাদের মধ্যে একটা ভালো বন্ডিং আছে। আর এর চেয়েও ওপরে কিছু একটা আছে। প্রিয়, সেটা না বোঝার মতো অবুঝ আপনি নন। অ্যান্ড সেকেন্ডলি, আপনি মানুন বা না মানুন, আমি মানি আপনি আমার মানুষ। আর…”
প্রিয় শুধাল,
-“আর?”
শরৎ প্রিয়র চোখে চোখ স্থির রেখে বলল,
-“আর নিজের মানুষকে স্পেশ্যাল ফিল করানোর জন্য আই ক্যান ডু দ্য ওয়োর্স্ট ক্রাইম এভার। ট্রাস্ট মি! প্রসঙ্গ যখন আপনার মুখের এক চিলতে হাসির, আমি মানুষ খুন করতেও রাজি।”
প্রিয় অকপটে বলে ফেলল,
-“শ্রেয়ানকে খুন করতে পারবেন?”
ফিক করে হেসে ফেলল শরৎ,
-“এতদিনে অবশ্যই করে ফেলতাম। যদি না ওর মৃত্যু আপনার মনে বিন্দুমাত্র মন-কেমনের উৎস তৈরি করত। প্রিয়, আপনি অস্বীকার করতে পারেন না—আপনার হোল লাইফকে নরকে ঠেলে আপনি সেই একটি মানুষকে এক জন্মের সব ভালোবাসা একযোগে দিয়ে গিয়েছিলেন।”
প্রিয় অস্বীকার করার সামর্থ রাখে না। লম্বা করে একটা শ্বাস টেনে সেই কথার রেশ ধরেই বলে,
-“আপনার কথাটা লক্ষ করুন। সেই একটি মানুষকে এক জন্মের সব ভালোবাসা একযোগে দিয়ে গিয়েছি! আপনাকে দেওয়ার মতো আর কিছুই বাকি নেই, নীরজ ভাই।”
প্রিয়র আওয়াজ অত্যন্ত মলীন। শরৎ মুচকি হেসে বলল,
-“চেয়েছি আমি?”
-“কী?”
-“ভালোবাসা!”
প্রিয়র স্থিরতায় শরৎ বলে ওঠে,
-“আমার ধারণা—আমার একার অনুভূতি দু’জনের জন্য এনাফ। আপনি যেভাবে আমার থেকে দূরত্ব বাড়াতে পারেননি, সেভাবে আমি কাছে আসাতেও একচুল নড়বেন না। আমি এগোচ্ছি, আমাকে এগোতে দিন। আপনি পেছাতে পারছেন না, স্থির দাঁড়িয়ে থাকুন।”
শরৎ প্রিয়র থেকে আর কিছু না শুনেই উঠে পড়ল। এ পাশের ডোর খুলে প্রিয়কে বেরোতে বলে জানাল,
-“ফুচকা খাবেন, প্রিয়? শুনেছি—মেয়েরা পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন প্রেমিক পুরুষকে রিজেক্ট করতে পারলেও, ফুচকাকে পারে না।”
প্রিয় মুচকি হাসল। ফুচকাতে তার মাত্রাতিরিক্ত লোভ। সে বিকেলে তারা পুরো ঢাকার প্রায় সব ফেমাস প্লেসগুলোর স্ট্রিটফুড ট্রাই করল। সন্ধ্যের শহরে রিকশা নিয়ে ঘুরল। রাত করে ফুটপাত ধরে স্ট্রিটলাইটের আলোয় অনেকটা পথ হাঁটল। প্রিয় আজ বাঁধা দেয়নি। উলটো নিজেও মন খুলে ঘুরে-ফিরে কাটিয়েছে।
ফেরার পথে শরৎ অনেকটা সময় প্রিয়র হাসিমুখটার দিকে তাকিয়ে ছিল। তার কাছে মনে হয়েছে, সে অনন্য কিছু দেখছে। পৃথিবীটা কতটা সুন্দর!
প্রিয়কে বাড়ি পৌঁছে একবার বলেছিল,
-“পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ফুল, শুনুন! দিন কেমন কাটল?”
প্রিয় হেসে ফেলে বলেছিল,
-“অসম্ভব সুন্দর।”
শরৎ বিমুগ্ধ চোখে প্রিয়র গালের টোল আর থুতনির ভাঁজ দেখে যায়। সুহাসিনী সে! শরৎ মুগ্ধতা দুচোখে স্থির রেখে বলল,
-“আমাকে একবেলা পেয়েই দিনটা অসম্ভব সুন্দর, একজনমের জন্য পেলে কী হবে ভেবেছেন?”
প্রিয়কে অপ্রস্তুত করে দিয়ে শরৎ গা দুলিয়ে হেসে ফেলে। রাস্তার মাঝে শরতের হাসি যান্ত্রিক কোলাহলের জন্য ফিকে হয়ে পড়েনি। বরঞ্চ আরও আকর্ষণীয় ঠেকছিল। নিষিদ্ধ ও আকর্ষণীয় যেন পরস্পর সমানুপাতিক সম্পর্কে আবদ্ধ। প্রিয় আর পিছে না ঘুরে সোজা বাসায় ঢুকে পড়ে। ফরসা গাল দুটো লাল টকটকে হয়ে আছে। শরৎ চালাক খুব! অনেক কিছু ধরে ফেলবে।
এভাবে শরতের অসম্ভব ভালোবাসার কাশফুল হয়ে কয়েকটা মাস কেটে গেল। প্রিয় আর শরতের মাঝের সম্পর্ক সেই আগের মতোই ঝুলন্ত আছে। প্রিয় এগোয়নি আর। নিজের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। শরৎ কদম কদম এগাতে এগোতে প্রিয়র খুব কাছে এখন। প্রিয় মুখ ফেরাতে পারে না। ওদের প্রতিদিন দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। নিয়ম করে রোজ কথা হয় না। এই তো, প্রিয়র অবসরে কল্পপুরুষ দেখা না দিলে সে টুপ করে শরৎকে একটা ম্যাসেজ পাঠিয়ে বসে,
-“নীরজ ভাই? অনলাইনে আছেন? আসেন একটু কথা বলি। সিরিয়াস কথা কিন্তু।”
এই বলে শুরু করে দুনিয়ার যত আজাইরা কথা বলা যায়, প্রিয় ঘণ্টা-খানেক ভরে বলে যায়। শরৎ তখন ভীষণ চমৎকার রকমের শ্রোতা হয়ে সব শোনে। প্রিয়র কথা শেষ হলে মিষ্টি হেসে বলে,
-“এভাবে হুটহাট আমার দিনগুলোকে সুন্দর বানানোর জন্য আপনাকে শতকোটি ফুলের ভালোবাসা।”
প্রিয় কল কেটে দেয় ঠিক তখনই। শরৎ আর কল ব্যাক করে না। নিজ থেকে ম্যাসেজও দেয় না। দুইদিন, তিনদিন, সাতদিন, পনেরো দিন পর হলেও প্রিয় নিজ থেকে আবার আরেকটা ম্যাসেজ করবে, কল দেবে, ঘন্টাখানেক বকবক করবে। এটা নিয়ম। শরৎ নিয়ম মেনে চলে, প্রিয় নিয়ম পালনের জন্য উৎসুক থাকে।
_____
আজ সন্ধ্যেয় প্রিয় যখন একটা নন-একাডেমিক বই পড়ছিল, তখন হুট করেই মনে পড়ল শ্রেয়ানকে দেওয়া ছয়টি মাসের মধ্যে আজই শেষ দিন। সে তড়িঘড়ি করে ক্যালেন্ডার দেখল দিলো। ওই তো! মার্ক করা! হ্যাঁ, আজই!
খুশিতে প্রিয়র ভেতরটা হালকা হয়ে এলো। শ্রেয়ানের সাথে দূরত্ব খুব বেড়েছে। ও কথা বলতে চাইলেও প্রিয় আগ্রহ পায় না। তার চেয়েও বেশি অনাগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে ক’দিন আগে শ্রেয়ানকে পানশীতে আরেকটা মেয়ের সাথে বসে থাকতে দেখে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে ফোন হাতে তুলল। সুইচ অফ করে রেখেছিল। সুইচ অন করতেই শ্রেয়ানের অগণিত কলের নোটিফিকেশন আসতে লাগল। ম্যাসেজ আসছে, কল আসছে। প্রিয় ধীরে-স্থিরে কল ব্যাক করল। ওপাশে যেন শ্রেয়ান ফোন হাতেই বসে ছিল। সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করে বলল,
-“ফোন অফ কেন, বেবি? ডোন্ট ইউ নো, কতটা মিস করি তোমায়?”
প্রিয় ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বসে বলল,
-“হ্যাঁ, বলো।”
-“কী করছ?”
-“বিশেষ কিছু নয়।”
-“প্রিয়শ্রী, মিট করবে?”
-“নাহ।”
-“কেন?”
-“এমনি।”
-“সবসময় এরকম করো কেন? দেখা করতে বলেছি, ইউ শ্যুড লিসেন। তা না করে যা ইচ্ছে করছ!”
প্রিয় কিছু বলল না। শ্রেয়ান একাধারে অনেককিছু বলতে লাগল। প্রিয় হুট করেই জিজ্ঞেস করল,
-“লাস্ট কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিলে কবে?”
শ্রেয়ান অবাক হয়ে থেমে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত কণ্ঠে বলে উঠল,
-“বছর দুয়েক আগে। এরপর কথা হয়েছে অনেকের সাথেই, সেভাবে জড়াতে পারিনি।”
-“এই ইনটেনশনে লাস্ট কবে কোনো মেয়ের সাথে কথা বলেছ?”
অকপটে শ্রেয়ান বলে ফেলল,
-“দের বছর আগে।”
-“অ্যান্ড আই হেইট লায়ার্স।”
কথাটি বলে প্রিয় হাসল। শ্রেয়ান টের পেল, প্রিয় তার মিথ্যে ধরে ফেলেছে। প্রিয় তো ক’দিন আগেই একটা ক্যাফেতে শ্রেয়ানকে অন্য এক মেয়ের হাত ধরে বসে থাকতে দেখেছিল। বোকা প্রিয়! সে কি না সুযোগ দিতে চেয়েছিল। নিজের বোকামোতে আরও একচোট হাসল। খানিকটা ভড়কে শ্রেয়ান বলল,
-“ভুল বোঝো না, লেট মি এক্সপ্লেইন।”
ফটাফট প্রিয় বলে ফেলল,
-“তোমার ছয়মাস শেষ। আই রিয়ালাইজড, আই হ্যাভ ফিল নাথিং ফর ইউ।”
-“প্রিয়শ্রী, লিসেন..”
-“অ্যান্ড, ইট’স্ আপ!”
কল কেটে দিলো প্রিয়। অতঃপর সবখান থেকে ব্লক। শ্রেয়ান আবার জ্বালাতে আসবে এই বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত প্রিয়। কিন্তু এবার ভুল করবে না। এবার আর সুযোগ দেবে না। অযথা কাজ! সুযোগ দিয়েই বা কী লাভ?
ঠিক তার ঘন্টাখানেক পর প্রিয়র বাসার সামনে শ্রেয়ান এলো। নিচে দাঁড়িয়ে প্রিয়র নাম ধরে খুব জোরে ডাকাডাকি শুরু করলে প্রিয় আর রুমে বসে থাকতে পারে না। এগিয়ে যায় বারান্দায়। দেখতে পায়, আশে-পাশের বাড়ির মানুষেরা কেমন কৌতুহল নিয়ে জানালা-বারান্দায় মুখ উঁচিয়ে তাকিয়ে আছে। প্রিয় ফট করে বারান্দার গ্লাস লাগিয়ে দেয়, এরপর পর্দা টেনে দেয়। আওয়াজ শুনে নাহারা আর প্রহর দৌড়ে প্রিয়র রুমে আসে।
নাহারা অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে,
-“এসব কী হচ্ছে প্রিয়, ও এখানে কী করে?”
প্রিয় নাহারার দিকে নরম চোখে তাকায়। পরপর দৃষ্টি শক্ত করে প্রহরের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“এক্ষুনি পুলিশে কল দে।”
চলবে..
#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|৪০|
রাতটা থানায় কাটানোর পর, পরদিনই বেরোনোর ব্যবস্থা হয়ে যায় শ্রেয়ানের। ভোর করে পুলিশ স্টেশনে আসেন আনোয়ার রহমান। ছেলেকে ছাড়ানোর সব কাজ সম্পন্ন করে একবার শ্রেয়ানের দিকে তাকান। শ্রেয়ান ভীষণ সাদা-মাটাভাবে বসে বসে এদিক-ওদিক দেখছিল, যেন কিছুই হয়নি, দিনটা অন্যান্য দিনের মতোই। বাবাকে আসতে দেখেও স্বাভাবিক রইল। মুচকি হেসে বলল,
-“ভালো আছেন, বাবা?”
ছেলের এমন অবস্থা দেখে সঙ্গে সঙ্গে জিভের সাথে তালুর ক্ষণ-সন্ধির দরুন, ‘চ্যাহ’ উচ্চারণে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এমন বেয়াদব, অসভ্য একটা ছেলে তার! ভাবতেই লজ্জা পান নিজের ওপর। টুকিটাকি কাজ সেড়ে নিতে লাগেন। শ্রেয়ান জানত তিনি আসবেন, আর এই ভোরেই চলে আসবেন। ফর্মালিটির শেষ দিয়ে আনোয়ার সাহেব আর পিছে তাকালেন না। দাম্ভিক পায়ে হেঁটে স্টেশনের বাইরে পার্ক করা গাড়িতে গিয়ে বসে পড়লেন।
শ্রেয়ান খুবই শান্ত ভঙ্গিমায় এক-পা দু-পা করে বেরোতে লাগল। সময় নিয়ে গাড়ির কাছে এলো। এরপর ব্যাকসিটে বাবার পাশে বসে পড়ল। ড্রাইভার নাহিদ গাড়ি স্টার্ট দিলো। মিনিটের মধ্যে এরিয়াটা ছেড়ে এলে আনোয়ার সাহেব সোজা শ্রেয়ানকে শুধালেন,
-“মেয়ের নাম?”
শ্রেয়ান হামি তুলে মাথা চুলকালো। এক গাল হেসে বলল,
-“প্রিয়শ্রী।”
-“পরিচয়?”
-“ভার্সিটিতে, আমার জুনিয়র ছিল ও।”
-“কয় বছরের সম্পর্ক?”
-“গতমাসে ছয় বছর হলো।”
-“কীসে পড়ে এখন?”
-“মাস্টার্সের এক্সাম দিলো গতমাসে।”
-“কম্পলেইন এসেছে তুমি নেশা করে তার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছ।”
-“করেছি।”
-“কম্পলেইন তার ফ্যামিলি মেম্বার করেছে?”
-“না।”
-“মেয়ে নিজেই?”
-“হ্যাঁ।”
-“কেন?”
-“কারণ কাল ব্রেকআপ হয়ে গেছে।”
বড়ো একটা শ্বাস টেনে আনোয়ার সাহেব শ্রেয়ানকে বললেন,
-“ব্রেকআপের কারণ?”
-“বোকা মেয়ে চালাক হয়ে উঠেছে, বাবা। এর চেয়ে বড়ো কারণ খুঁজে পেলাম না।”
-“তুমি নির্দোষ?”
-“আমার চোখে সবসময় আমি নির্দোষ।”
-“সেই মেয়েটির চোখে?”
-“আমি দোষ করতে করতে সীমা অতিক্রম করেছি। আমি নারীকে অপশনে রেখেছি। আমি একাধিকের সাথে মন বিনিময় করেছি।”
এ-সব তাঁর অজানা নয়। তবে ছেলেটা যে ছয় বছর একটা মেয়ের সাথে সম্পর্কে ছিল—এ যেন অষ্টম আশ্চর্য! ধাঁধায় পড়ে গেছিলেন তিনি। সেই ধাঁধা মিলল, শ্রেয়ানের ‘বোকা মেয়ের চালাক হয়ে উঠেছে’ বলায়। মেয়েটার জন্য ভীষণ মায়া লাগল আনোয়ার সাহেবের। ছেলেকে তিনি ছোটবেলা থেকেই আদরে রাখতে পারেননি। বড়ো হয়েও তাই শাসনের অধিকার আর রাখেন না। তবুও অসংখ্যবার শ্রেয়ানকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন এসব থেকে দূরে আসতে। শ্রেয়ান বরাবরই মুচকি হাসি দিয়ে সরে যেত।
তারপর আর না পেরে শ্রেয়ানের ওপর নজরদারি করার লোক রেখে দেন। প্রতিটি গার্লফ্রেন্ডের ব্যাপারে জেনে, তিনি শ্রেয়ানের সেই গার্লফ্রেন্ডদের সাবধান করতেন। তাদেরকে শ্রেয়ান সম্বন্ধে জানাতেন সবটা। তারপর তারা নিজ থেকেই সরে যেত। এভাবেই চলছিল। অথচ ছয় বছরের এই সম্পর্কটা কীভাবে চাপা পড়ে থাকতে পারল, তার মাথায় আসে না।
তার প্রশ্ন করার আগেই শ্রেয়ান হেসে উঠল,
-“আমার রিসেন্ট ২-৪টা টাইমপাস করা গার্লফ্রেন্ড বাদে বাকিদের কারো খবরই আপনার কাছে যায়নি, বাবা। আমি আপনার টাকা দিয়েই আপনার লোককে কিনেছি।”
সরু চোখে তাকালেন আনোয়ার সাহেব। থেমে থেমে বললেন,
-“কেন? তুমি সিরিয়াস এর ওপর?”
-“নিঃসন্দেহে।”
-“তবে বাকি মেয়েরা?”
-“ডিফরেন্ট টেস্ট করতে থাকি, যাতে একজনে বিরক্ত হয়ে না যাই।”
-“তোমার কি মনে হয় না, তুমি মেয়েটার সাথে ভুল করছ?”
-“আমার দিক থেকে আমি ঠিক। যদি তোমার কিংবা অন্য কারো দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা লাগে, তবে হয়তো আমি সর্বোচ্চ ভুল।”
আনোয়ার সাহেবের রাগ লাগতে লাগল। কীভাবে কীভাবে যে নিজেকে সামলে আছেন, তার চেয়ে ভালো আর কেউ জানেন না। শ্রেয়ান এ-পর্যায়ে ঠোঁটের ভাঁজে তর্জনী ও মধ্যমার স্পর্শ রেখে হাসি চাপতে লাগল। শব্দটা কিঞ্চিৎ আনোয়ার সাহেবের কানে পৌঁছাতেই তিনি প্রলম্বিত শ্বাস ছেড়ে ছেলেকে শুধালেন,
-“মেয়ে তোমাকে চায়?”
-“ওর নাম প্রিয়শ্রী বাবা, আপনি প্রিয় ডাকবেন। ‘মেয়ে’ সম্বোধনটা কেমন কটু শোনায়। আর ও আমাকে চায় না।”
-“তবে ওর পিছে আছ কেন?”
-“কারণ আমি ওকে চাই।”
-“তাহলে বাকি মেয়েদের ছাড়ছ না কেন?”
-“আমার নজর একেকসময় একেকদিকে ঘুরলেও, অবসরে ওর দিকেই স্থির হয়। আমি কী করব? আমার দোষ?”
আনোয়ার সাহেব অত্যন্ত নরম গলায় বললেন,
-“তুমি চাইছ কী, আশফিক?”
শ্রেয়ান মলিন চাহনিতে তাকায় তাঁর দিকে, বলে,
-“প্রিয়শ্রীকে চাই। জানেন, বাবা? বোকারা ভালোবাসতে জানে। প্রিয়শ্রী বোকা ছিল। ভালোবেসেছিল। যার কিঞ্চিৎ ভালোবাসা আমার বাকি গার্লফ্রেন্ডদের কারো মাঝে পেলে, আমি হয়তো আর ওর দ্বারে যেতাম না।”
-“ও তোমাকে চায় না।”
-“আমি চাই, এটাই কি শক্ত কারণ হতে পারে না ওকে পাওয়ার?”
-“পারে না। দূরত্ব বাড়াও।”
-“নয়তো?”
-“আমি কঠোর হব।”
শ্রেয়ান আনোয়ার সাহেবের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলল।
_____
প্রিয় গতরাতে ভাই কিংবা মা, কাউকেই কিচ্ছুটি জানায়নি। রুমে এসে মেডিসিন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সকালে প্রিয় যখন নাশতা করতে এলো, তখন দেখল পরিস্থিতি ঠান্ডা বেশ। বাবা অফিসে চলে গেছেন। বাড়িতে প্রহর, নাহারা, আর মেড আছেন।
প্রিয় দেখল, প্রহর ডাইনিংয়ে বসে খাবার খাচ্ছে। প্রিয় চেয়ার টেনে পাশে বসে পড়ল। কোমল গলায় জানাল,
-“শুভ সকাল, প্রহর।”
প্রহর খেতে খেতে বলল,
-“শুভ সকাল।”
নাহারা রান্নাঘর থেকে বাইরে এসে প্রিয়র সামনে দাঁড়ালেন। খাবার বেড়ে দিতে লাগলেন। প্রিয় বলল,
-“সব এত স্বাভাবিক কেন?”
প্রহর বলল,
-“ঝামেলা করার মতো কিছু হয়নি।”
-“আমাকে কেউ এই নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবে না?”
-“তোর ইচ্ছে হলে তুই নিজ থেকেই বলবি। এখন তোর ইচ্ছে নেই, আমরাও জানতে চাইব না।”
মায়ের চুপ থাকাটাও যে ভায়েরই কাজ, সেটা প্রিয় ধরতে পারল। ধাতস্থ হয়ে শ্বাস ছেড়ে নাহারাকে বলল,
-“বাবাকে কীভাবে সামলালে?”
-“কিছু একটা বলেছি।”
-“মা, রেগে আছ?”
-“না। তবে চিন্তা হয়।”
-“চিন্তা কোরো না। সব ঠিক হয়ে গেছে।”
-“যায়নি। ছেলেটা শীঘ্রই আবারও আসবে।”
প্রিয় তা জানে, তাই চুপ থাকে। নাহারা ওর পাশে চেয়ার টেনে বসে পড়ল। উৎসুক নয়নে তাকিয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ। তারপর বলল,
-“একটা বিয়ে করবি?”
প্রিয় হেসে ফেলল তৎক্ষণাৎ। বলে উঠল,
-“তুমি এভাবে বললে যেন, এখন একটা বিয়ে করি, পরে আবার ইচ্ছে আবার একটা করব।”
-“পরে ইচ্ছা হলে করিস। এখন একটা কর।”
প্রিয় হাসতে হাসতে খেতে লাগল। নাহারা জোর দিলো,
-“কী? কর না, মা! আমি নইলে শান্তি পাব না।”
প্রিয় খেতে খেতেই বলল,
-“আচ্ছা ঠিকাছে। কিন্তু এটাই শেষ। এরপর আর বিয়ে করতে বলবে না।”
এবার প্রহর হেসে ফেলল৷ নাহারা ওদের দুষ্টমিতে তাল মেলালেন,
-“ঠিকাছে, আর বলব না। এটা পছন্দ হবে শিওর।”
-“আচ্ছা।”
-“আমি তবে সব ব্যবস্থা করি?”
-“করতে থাকো। বাট আমার কিছু কন্ডিশন আছে।”
-“কী?”
-“সেগুলো আমি সোজা আমার জন্য চ্যুজ করা লোকটাকেই বলব।”
-“মাথায় কোনো দুষ্ট বুদ্ধি নেই তো?”
-“না, নেই।”
-“আমার তোকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না।”
-“বিশ্বাসে মেলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। অন্যথায় বিয়ে ক্যান্সেল।”
ঘাবড়ে গেলেন নাহারা। তখনই কলিং বেলের আওয়াজ এলো। নাহারা গিয়ে দরজা খুলে শরৎকে দেখতে পেলেন। ওমনিই ক্লান্তি সব উবে গেল তাঁর। ঠোঁটের কোণায় এক টূকরো হাসি ঝুলিয়ে বলল,
-“বাবা, এসেছ? আসো ভেতরে।”
শরৎ সালাম দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। নাহারা সালামের জবাব দিয়ে দরজা আটকে ফেলে ওকে বললেন,
-“এত দেরি করলে কেন? সকালে আসার কথা ছিল তোমার।”
-“আন্টি, একটু অফিশিয়াল কাজ সেরে আসতে হয়েছে। তাই দেরি হয়ে গেল।”
-“আচ্ছা, ফ্রেশ হয়ে ডাইনিংয়ে বসো।”
-“না না, আন্টি খেয়েছি।”
-“এ-বাবা! কেন? তোমাকে সকালে আসতে বলেছি বলে কত কিছু রান্না করলাম।”
-“ব্যাপার না, আন্টি৷ পরে খাওয়া যাবে।”
প্রহর এগিয়ে এসে শরৎকে জড়িয়ে ধরল। কিছু ফর্মালিটিস পূরণ হতেই শরৎ আঁড়চোখে প্রিয়র দিকে তাকাল। তারপর নাহারাকে বলল,
-“আন্টি, শুনুন।”
-“বলো, বাবা।”
-“ডাইনিংয়ের চেয়ারের ওপর দশ বছরের অভুক্ত বাচ্চার মতো ছটিয়ে ছিটিয়ে খাবার খেতে থাকা মেয়েটার চোখে কি আমি ইনভিজিবল? একবার এসে সালামটাও দিলো না। কী অভদ্র!”
শরতের গলায় নাহারা রসিকতার আভাস পেলেন। ঠোঁট চেপে হেসে প্রস্থান ঘটালেন। প্রিয় তবুও এদিকে তাকাল না। খেতে খেতে বিরবির করল,
-“বেয়াদ্দব ব্যাটালোক!”
চলবে..