শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব-২৪+২৫+২৬

0
225

#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_২৪

আজ শাকিরার বিয়ে, এতগুলো বছর পর প্রিয় মানুষকে নিজের করে পাবে সে কিন্তু পরিক্ষা শেষ করে বেরিয়ে সাজতে যাওয়ার সময় থেকেই মনটা কেমন যেন করছে তার। তার মনে হচ্ছে সবকিছু ঠিক নেই। বিয়েটা ঠিকঠাকভাবে হবে না খুব তাড়াতাড়ি। তার মনে হচ্ছে কোন একটা বিপদ নিশ্চয়ই হবে। কিন্তু সেই বিপদটা কি!

সাজ যখন প্রায় কমপ্লিট তখন শাকিরা নিহানকে কল করে। নিহান তখন রাস্তায়, আর কিছুটা পথ বাকি। হঠাৎ ফোন বেজে উঠকে বাইক থামিয়ে সাইডে দাঁড়ায়। পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে শাকিরা কল করেছে। কল রিসিভ করে বলে, ” আমি প্রায় চলে এসেছি, তুই যে নাম বলেছিলি পার্লারের ওখানেই আছিস তো তাই না?”

” হ্যাঁ ভাইয়া ওখানেই আছি। কতক্ষণ লাগবে তোমার আসতে?”

” দশ থেকে পনেরো মিনিট। তোর হয়েছে সাজ?”

” প্রায় শেষ , তুমি আসতে আসতে হয়ে যাবে।”

” হ্যাঁ তাড়াতাড়ি নে, রায়হান হয়তো চলেই এসেছে বরযাত্রী নিয়ে। ”

” হ্যাঁ হ্যাঁ মনে করিয়ে দিতে হবে না। ওরা পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পরেই আমরা বাড়ি পৌঁছে যাব। তুমি তাড়াতাড়ি আসো।”

” হ্যাঁ আসছি।”

” ওহ শোনো, শুভ্রতা কি বাড়ি গিয়েছে?”

” দেখা হয়নি। হয়তো চলে গিয়েছে।”

” ওহ, ঠিক আছে এসো তুমি।”

” হুম।”

নিহান ফোনটা সাইলেন্ট করে রাখে। গাড়ি চালানোর সময় ফোন আসাটা খুব বিরক্তিকর লাগে তার কাছে। ফোন পকেটে রেখে যাত্রা শুরু করে দেয়।

কয়েক মিনিটের মাঝে পৌঁছেও যায় শাকিরার কাছে। পার্লারের সামনে বাইক থামিয়ে শাকিরাকে কল দিলে শাকিরা বাহিরে চলে আসে। শাকিরা এসে নিহানের বাইকে উঠতে যায়। শাকিরার সাথে আরেকজন এসেছে তার জিনিসপত্রের ব্যাগ ধরে আছে। শাকিরা বাইকে উঠলেই সেটা তার কোলের ওপর দিয়ে দিবে। এমন সময় নিহান বলে ওঠে,

” এই আপনি কে, আমার বাইকে উঠছেন কেন?”

শাকিরা কোমরের দুইপাশে দুই হাত দিয়ে রাগের ভঙ্গিতে বলে, ” আমাকে চেনা যাচ্ছে না?”

” চেনা যাবে! কে আপনি?”

” ভাইয়া….”

নিহান হাসতে হাসতে বলে, ” আচ্ছা আচ্ছা ওঠ, মজা করছিলাম আমি।”

শাকিরা বাইকে উঠে বসলে নিহান বাইক চালানো শুরু করে। চারদিকে অন্ধকার হয়ে এসেছে প্রায়। একটু পরেই হয়তো রাত হয়ে যাবে। ইফতারের সময় হয়ে যাওয়ায় নিহান রাস্তার পাশেই মসজিদটায় গিয়ে ইফতার করে নামাজ আদায় করে আবার বের হয়েছিল শাকিরার উদ্দেশ্যে।

” আচ্ছা ভাইয়া, তোমরা বিয়ে করছো কবে?”

শাকিরার এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় নিহান। তোমরা বলতে কি বুঝালো শাকিরা! তবে কি শাকিরাও জানে শুভ্রতার ব্যাপারে!

” কি হলো? কিছু বলছো না কেন?”

” তোমরা মানে?”

” তুমি আর শুভ্রতা, তুমি কি ভেবেছ আমি জানি না? আমি সব জানি, তোমার চেয়ে বেশি কিছু।”

” তাই নাকি? কি জানিস শুনি?”

” শুভতা তোমাকে ভালোবাসে, এটা তুমি জানো না কিন্তু আমি জানি।”

শাকিরার কথায় বাইক থেমে যায়। নিহান আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে, ” শাকিরা কি বলছিস? শুভ্রতা আমাকে ভালোবাসে মানে? তুই কীভাবে জানতে পারলি?”

” বাইক চালাও, আমি বলছি। ”

নিহান আবারও বাইক চালানো শুরু করে। শাকিরাকে বলে, ” বল এবার।”

” শুভ্রতা বিয়েটাই করেছিল একটু চাপে পড়ে। ইমতিয়াজ ভাইয়া সারাক্ষণ ওকে পেইন দিতো। সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি করত। কিছুর থেকে কিছু হলে গালাগালি অবধি করত। আবার এসব থেকে বাঁচতে যদি শুভ্রতা ব্রেকাপের কথা বলত তখন ইমতিয়াজ ভাইয়া সুইসা*ইড করতে চলে যেত। ভয় দেখাতো সে মা*রা গেলে শুভ্রতাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে যাবে। শুভ্রতাও ওকে ভালোবাসতো তাই সব সহ্য করে নিতো। বিয়ের পর বছর না ঘুরতেই অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে শুভ্রতা। তখন থেকেই ডিভোর্সের কথা ভেবেছে সে কিন্তু নানারকম কারণে হয়ে ওঠে নি। মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষের সাথে আসলেই থাকা যায় না। বিয়ের পর বেশিরভাগ সময়ই শুভ্রতা এই বাড়িতে কাটিয়েছে। বিয়ের সময় তোমার সাথে ওর কথা হয়েছিল সে কী কান্না! তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করে অনেক কান্না করেছে মেয়েটা আমি নিজে দেখেছি কিন্তু ওর তখন কিছু করার ছিল না। শুভ্রতা তখন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল, সে ঠকবাজ উপাধি পেতে চায় নি। ভেবেছিল ইমতিয়াজ হয়তো বিয়ের পর ঠিল হয়ে যাবে, এটাই ছিল ওর ভুল সিদ্ধান্ত। ”

” আমার প্রতি ভালোবাসাটা তুই দেখলি কোথায়?”

” গত দুই মাসে। ও একপ্রকার তোমার থেকে পালিয়ে বেড়ায় যেন তুমি ওর অভ্যাস হয়ে না যাও।”

” আমি নিজেই তো ওর কাছে আত্মসমর্পণ করেছি তাহলে ওর কীসের ভয়?”

” ও মূলত এখন ক্যারিয়ারে ফোকাস করতে চাইছে। সেদিন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম যে নিহান ভাইয়া তোকে কতদিন ধরে পছন্দ করে আর তুই এখনো ‘না’ করে যাচ্ছিসই? তখন শুভ্রতা বলেছিল পছন্দ তো হয়তো আমিও উনাকে করি কিন্তু আমি এখনই আর সংসারে ঢুকতে চাইছি না। আমি আমার ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবছি। আমি জানি উনার মতো হয়তো আর কেউ আমাকে ভালোবাসতে পারবে না। আমি উনার থেকে কিছু সময় চাইব যদি উনি দেয় তাহলে আমি ভালো একটা জীবন পাব আর যদি অপেক্ষা না করে তাহলে আরেকটা মানুষকে আমি আর আমার জীবনে জড়াবো না। এই কথায় বোঝা যায় না ভাইয়া? শুভ্রতা কেমন যেন হয়ে গেছে, আগের মতো একদম নেই।”

নিহান আর কথা বাড়ায় না। কারণ সে নিজেও সেদিন শুভ্রতার চোখে নিজের জন্য মায়া দেখেছে। সে মায়া কিছুতেই মিথ্যা হতে পারে না। একসাথে থাকলে তো কুকুর বিড়ালের প্রতিও ভালোবাসা, মায়া জন্মে আর সে তো মানুষ!
~~

ফাউজিয়া ফোন হাতে নিয়ে বারবার শুভ্রতাকে কল করে যাচ্ছে কিন্তু কল রিসিভ করছে না। ফোন রিং হয়েই যাচ্ছে। এক পর্যায়ে সে সিদ্ধান্ত নেয় সাহিল স্যারকেই সে কল করবে। ফোনটা হাতে নিয়ে ভাবছে কল দেয়া উচিৎ হবে কী-না! না দিয়েও তো উপায় নেই সমস্যাটার সমাধান সে কিছুইতেই করতে পারছে না অথচ প্রশ্নটা আগামীকাল পরিক্ষায় আসতেও পারে৷ তাই সে আর দ্বিধা না করে সাহিল শেখকে কল করেই ফেলে।

সাহিল শেখ বসে বসে বই পড়ছিলেন। কফি নিয়ে বসেছিলেন হুমায়ুন আহমেদের ‘অপেক্ষা’ বইটা শেষ করার জন্য কিন্তু এখনো অনেকটা বাকি। সুপ্রভার মৃ*ত্যুটা কেমন যেন খারাপ লাগা সৃষ্টি করেছে। এত তুচ্ছ বিষয়ের জন্য কেউ এমন করে!

হঠাৎ ফোন বেজে ওঠায় বইটা বন্ধ করে কলটা রিসিভ করে।

” কে বলছেন?”

ওপাশ থেকে ফাউজিয়া বেশ জড়তা নিয়ে বলে, ” স্যার আমি ফাউজিয়া।”

” ফাউজিয়া! কিছু হয়েছে? আন্টি ঠিক আছেন?”

” জি স্যার। একটা বিষয় জানার ছিল।”

” হ্যাঁ বলুন।”

” স্যার আপনার কাছে কি বই আছে?”

” কোন বই, ক্লাসের?”

” জি স্যার।”

” না, বই তো বাসায় নিয়ে আসি না।”

” তাহলে কীভাবে জিজ্ঞেস করি স্যার!”

” তুমি বিষয়টা বলো, দেখছি আমি সাহায্য করতে পারি কী না!”

ফাউজিয়া প্রশ্নটা বললে বেশ সাবলীলভাবে সেটার উত্তর সাহিল শেখ ফাউজিয়াকে বুঝিয়ে দেয়। কথা শেষ করে ফাউজিয়া ফোন রেখে দেয়। রান্নাঘরে চলে যায় এক কাপ চা বানানোর জন্য। পড়ার সময় এক কাপ চা খুব প্রয়োজন তার।
~~
ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের পিছনের সাইডে মেয়েদের ছেলেদের হোস্টেল। সিনিয়ররা প্রথমবর্ষের দুইটা ছেলেকে ডেয়ার দিয়েছে অর্থনীতি বিভাগের ডানে যে পুকুরটা আছে ওখানে একদমে সাতটা ডুব দিয়ে আসতে হবে। পর্যবেক্ষণের জন্য আরো দুজনকে সাথে পাঠানো হবে। যে দুজনকে ডেয়ার দেওয়া হয় তারা একে অপরের দিকে একবার তাকিয়ে রওয়ানা দিয়ে দেয়। পিছে পিছে আরও দুজন আসছে তারা ডেয়ারটা সম্পূর্ণ করে কি না সেটা দেখতে।
চারজন হেটে চলেছে, হোস্টেলের সিড়ি বেয়ে নেমে পিছন সাইডে চলে যায় তারা। চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিয়ে একে একে চারজন প্রাচীর টপকে বাহিরে চলে যায়।
ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের সামনে এসে থেমে যায়। বিল্ডিংয়ের একদম শেষ মাথায় কোণার দিকে একটা পুরোনো ঘর আছে। পাশাপাশি দুইটা রুম, এদিক দিয়ে কেউ তেমন যাওয়া আসা করে না। ওদিকে মেয়েলি গলায় কেউ চিৎকার করছে। ঘর পুরোনো, অনেকদিন ধরে ওরকমই রাখা আছে। ওখান থেকে চিৎকারের শব্দ আসার কথা না। চারজন রাস্তায় থেমে যায়, চারজনের মনোযোগই সেদিকে। এখন কান্নার শব্দ আসছে, কেউ কাঁদছে। শরীর পুরো ভারী হয়ে আসে তাদের। এগোনো ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছে না। সবার মুখের ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।

” ক কে রে ওখানে বল তো?”

একজন শুকনো ঢোক গিলে বলে, ” আ আমি জা জানি না। ”

” তোরা যা ভাই ডেয়ার সম্পূর্ণ কর নইলে রাতের খাবার পাবি না। ওখানে যা আছে আছে, সেটা তোদের ভাবতে হবে না। ”

” ওই পথ দিয়েই তো যেতে হবে ভাই। যদি ভূ*ত হয় তাহলে?”

” আমারও যে ভয় লাগছে না এমন না। কি ওখানে ওমন করছে বল তো!”

” আমাদের ভয় দেখানোর জন্য কাউকে পাঠানো হয়নি তো?”

” মাত্র সন্ধ্যা পার হয়েছে, এশার আজান এখনো দেয় নি। এই সময় ভূ*ত থাকার কথা নয় তো। আর এমনিতেও এখন রমজান মাস, ভয়ের কিছু থাকারও কথা না।”

” আচ্ছা চল, এখান থেকে এক দৌঁড়ে পুকুরপাড় চলে যাব। কোথাও কোন থামাথামি নেই।”

” ঠিক আছে। ”

সবাই সম্মতি জানিয়ে একসাথে জোরে দৌঁড় দেয়। ঘরটার সামনে দিয়ে দৌঁড় দিয়ে পার হতেই ঘর থেকে শব্দ আসে দরজা ধাক্কানোর।
” কেউ আছো? বাঁচাও প্লিজ, আমার এখানে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাকে এখান থেকে বের করো না প্লিজ। কে যাচ্ছো এদিক দিয়ে, প্লিজ বাঁচাও আমাকে।”

#চলবে……

#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_২৫

বিয়ে বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গিয়েছে। শুভ্রতার মা খানিকক্ষণ বাদে বাদেই মেয়ের শোকে জ্ঞান হারাচ্ছেন। অনেকক্ষণ আগেই শাহাদাত সাহেব মেয়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছেন, ইরার বাবাও সাথে বেরিয়েছেন। শাকিরার বাবা মেয়ের বিয়ে জন্য বসে নেই তিনিও বাসায় নেই। নিহান যখন শাকিরাকে নিয়ে বাড়ি এসে জেনেছে শুভ্রতা এত রাত হয়ে গিয়েছে কিন্তু বাড়ি ফিরেনি সাথে সাথে সে বাড়ি থেকে ভার্সিটি এবং তার আশেপাশে আরও কয়েকটা থানায় খবর দিয়ে দিয়েছে। এতক্ষণে পুলিশ টিম ও বেরিয়ে পড়েছে শুভ্রতাকে খুঁজতে। সবাই মন খারাপ করে বসে আছে। বিয়েতে যারা এসেছিল বেশিরভাগই খাওয়া দাওয়া করে চলে গিয়েছে। রায়হান নিজেও বের হতে চেয়েছিল কিন্তু কেউ তাকে বের হতে দেয় নি। বাড়ির মানুষগুলো নিজেদের মতো চেষ্টা করে যাচ্ছে, একে ওকে কল দিচ্ছে। স্নিগ্ধা মায়ের পাশে বসে শুভ্রতার জন্য কান্না করছে। শাকিরা চিন্তিত মুখে বসে আছে একপাশে। সে আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিল তার বিয়েতে কিছু একটা অঘটন ঘটবে। কারো কোন হিসেব মিলছে না কে করল এমন!

রায়হান বাড়ির অবস্থা খারাপ থেকেও খারাপ হচ্ছে দেখে নিহানকে কল করে৷ রাতও অনেক হতে চলল।
রিং হতেই কল রিসিভ হয়ে যায়, হয়তো ফোনটা নিহানের হাতেই ছিল। রায়হান বলে,

” শুভ্রতার কোন খোঁজ পাওয়া গেল? মামির অবস্থা খুব খারাপ। কিছুক্ষণ পরপরই জ্ঞান হারাচ্ছে।”

” ছোটমাকে কান্না করতে নিষেধ কর। শুভ্রাকে নিয়ে আমি বাড়ি ফিরব। আইনের লোকেরা বেরিয়ে পড়েছে অনেক্ষণ আগেই, খুব তাড়াতাড়ি হয়তো ভালো খবর আসবে।”

” তুই কোথায় আছিস এখন?”

” আমি এইতো সদরে যে থানাটা আছে, ওখানে আছি। এখানে থেকে শুভ্রার ভার্সিটিতে যাব খুঁজতে। অন্যান্য থানা থেকে আশেপাশে বেরিয়ে পড়েছে।”

” শাহাদাত মামা কোথায়, তোর সাথে?”

” হ্যাঁ এখানেই আছে। ছোটমার কাছে ফোনটা দে তো।”

” দাঁড়া দিচ্ছি।”

আয়েশা বেগম অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়েছিলেন। মুখে কোন কথা নেই৷ বেশি শোকে হয়তো মানুষ পাথর হয়ে যায়, আয়েশা বেগমের হয়েছে ওরকম। কিছুক্ষণ আগেও চিৎকার দিয়ে বিলাপ করে কান্না করছিলেন তিনি। মেয়েটা আর কত কষ্ট সহ্য করবে! সংসার ভাঙার পর আবার নতুন বিপদ। কে জানে কেমন আছে শুভ্রতা, কি অবস্থায় আছে!

রায়হান আয়েশা বেগমের নিকট এসে ফোনটা এগিয়ে দেয়, ” মামি…”

আয়েশা বেগম রায়হানের দিকে চোখ তুলে তাকায়। রায়হান বলে, ” নিহান কথা বলবে।”

আয়েশা বেগম ফোনটা কানে ধরেই বলে, ” আমার মেয়েটা কোথায় নিহান? ও আর কত কষ্ট সহ্য করবে বলো তো? মানুষ কেন কষ্ট দেওয়ার জন্য আমার মেয়েটাকেই বেছে নেয়? আমার মেয়ে ঠিক আছে তো নিহান? ওর কিছু হলে আমি পাগল হয়ে যাব বাবা।”

নিহান শুকনো ঢোক গিলে, নিজেকে শান্ত করে। তার যে চিন্তা হচ্ছে না এমন না৷ কয়েক ঘণ্টা ধরে সে নিখোঁজ। রাত এগারোটা বাজতে চলল।

নিহান বলে, ” ছোটমা, আমি কথা দিচ্ছি শুভ্রাকে নিয়েই আমি বাসায় ফিরব।”

” নিহান, ওই ইমতিয়াজ আমার মেয়ের আবার কোন ক্ষতি করল না তো?”

” ছোটমা, ইমতিয়াজ নাকি এলাকায় নেই। পুলিশ ওকে খুঁজছে। তুমি চিন্তা করো না, আমি তোমার মেয়েকে নিয়েই ফিরব।”

” আমার মেয়েকে আমি অক্ষত অবস্থায় চাই নিহান।”

” শুভ্রার কিছু হবে ছোটমা। আল্লাহ আছেন, উনি ঠিক রক্ষা করবেন।”

নিহান কিছুক্ষণ থেমে আবার বলে, ” ছোটমা, স্নিগ্ধা কোথায়? ফোনটা ওর কাছে দাও তো।”

স্নিগ্ধা মায়ের পাশেই বসে ছিল। ফোনে স্নিগ্ধাকে চাইতেই আয়েশা বেগম ফোনটা স্নিগ্ধা দেন। স্নিগ্ধা ফোনটা কানে নিয়ে বলে, ” হ্যাঁ ভাইয়া।”

” তোর কাছে শুভ্রার বান্ধবীর নম্বর আছে?”

” না, শাকিরা আপুর কাছে হয়তো আছে। লাগবে?”

” হ্যাঁ, ওর থেকে নম্বরটা নিয়ে আমাকে দে তো তাড়াতাড়ি। ”

” আচ্ছা দিচ্ছি।”

নিহান ফোনটা রেখে দেয়। দুই মিনিটের মধ্যে শাকিরা ফাউজিয়ার নম্বর পাঠিয়ে দেয় কিন্তু কোন কাজের কাজ হয় না। ফাউজিয়ার বাসায় শুভ্রতা নেই, শুভ্রতাকে পাওয়া যাচ্ছে না এমন কথা শুনে শুধু শুধু মেয়েটা এখন চিন্তা করবে।

শাহাদাত সাহেব চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন। মাথা প্রচন্ড ব্যথা করছে, মেয়ের জন্য আর কত চিন্তা করা যায় একটা বাবার পক্ষে। মেয়ের জন্য চিন্তা শুরু হয়েছে তিন চার বছর আগে থেকে এখন অবধি চলছে। বাবারা অনেক কষ্ট সহ্য করতে পারে, বাবাদের কষ্ট দেখা যায় না। তারা সবসময় হাসিমুখে সব সহ্য করে নিতে জানে কিন্তু আজকে কেন সব অসহ্য হয়ে যাচ্ছে! মেয়েকে কি আদৌ পাবেন অক্ষত অবস্থায়!

নিহান শাহাদাত সাহেবের দিকে এগিয়ে এসে মাথায় হাত রাখলে শাহাদাত সাহেব চমকে ওঠে।

” খারাপ লাগছে কাকা?”

” আমার মেয়েটা ঠিক আছে তো নিহান?”

” আল্লাহ আছেন তো, তাকে ডাকুন দেখবেন তিনি নিরাশ করবেন না। বিপদে পড়লে আল্লাহকে ডাকতে হয় চিন্তা করতে হয় না। আমি এখানে কাউকে বলে দিচ্ছি আপনাকে বাসায় পৌঁছে দেবে। আপনার আর বাহিরে থাকতে হবে না। বাসায় গিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে মেয়ের জন্য দোয়া করুন। আল্লাহ সহায় হলে আমি শুভ্রাকে নিয়েই বাড়ি ফিরব।”

” আমি বাড়ি যাব না নিহান। বাড়ি গেলে চিন্তা আরও বাড়বে। তোদের সাথে থাকলে তবু ব্যস্ত থাকতে পারব।”

” না কাকা, আমি শুভ্রার ডিপার্টমেন্টের প্রধানকে কল দিয়েছিলাম উনি থানায় আসছেন। আসলেই ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরব। আপনি এখন বাসায় যাবেন আর কোন কথা না।”

নিহান ওখানকার একজনকে ডেকে শাহাদাত সাহেবকে এক প্রকার জোর করেই বাসায় পাঠিয়ে দেয় পুলিশের গাড়িতেই।

নিহান সেখানেই বসে ডিআইজিকে কল দেয়। প্রথমবার ফোন রিসিভ হয় না, আবার কল করতেই রিসিভ হয়।

কল রিসিভ হতেই নিহান বলে,” আসসালামু আলাইকুম স্যার।”

” ওয়ালাইকুমুস সালাম। কে বলছেন?”

” স্যার আমি মেজর নিহান বলছিলাম। ”

” কেমন আছো মা*ই বয়?”

” স্যার একটা বিপদে পড়ে আপনাকে কল দিয়েছি।”

” কি বিপদ বাবা?”

” স্যার আমার হবু বউ পরিক্ষা দিয়ে বাসায় ফিরেনি। কয়েক ঘণ্টা হয়ে গেল কিন্তু এখনো কোন খোঁজ মিলেনি। আপনি কি এই ব্যাপারে কোন সহযোগিতা করতে পারেন? ”

” ইউ মিন কিড*ন্যাপ হয়েছে?”

” হতে পারে। আমি আপনাকে ডিটেইলস দিয়ে দিচ্ছি। আপনি একটু সাহায্য করুন স্যার।”

” ঠিক আছে আমি দেখছি। ”
~~

কাজী সাহেব আর অপেক্ষা করতে নারাজ। মাঝরাত অবধি তো বিয়ে পড়ানোর জন্য অপেক্ষা করা যায় না। তাকেও তো বাড়ি ফিরতে হবে। শাকিরার মন খারাপ, কারো কোন কথা তার কানে যাচ্ছে না। সে বলছে শুভ্রতা না ফিরলে সে বিয়ে করবে না। আয়েশা বেগম নিজে শাকিরার পাশে এসে বসেন। একরুমে সবাই জড়ো হয়েছে, বাড়ির ছোটবড় সবাই আছে। কিন্তু কেউ কোন কথা বলছে না। শুভ্রতার চিন্তায় সবাই ডুবে আছে। বিয়েটা নিয়ে আর কারো কোন ইচ্ছে নেই কিছু বলার। নিহানের মা কিছুক্ষণ পরপর জোড়ে নিঃশ্বাস ছাড়ছেন।

শাকিরা চুপচাপ বসে আছে, আয়েশা বেগম তার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন, ” নিহান কথা দিয়েছে আমার শুভ্রতাকে নিয়েই বাড়ি ফিরবে। শুভ্রতা এসে যদি দেখে তোর বিয়ে বেধে আছে ওর জন্য তাহলে আমার মেয়েটা কষ্ট পাবে না বল তো? তুই কি চাস এত এত কষ্টের মাঝে এই বিষয়ে আবার কষ্ট পাক?”

শাকিরা কিছু না বলে আয়েশা বেগমের দিকে তাকায়। আয়েশা বেগম খেয়াল করেন শাকিরার চোখে পানি টলমল করছে। শাকিরার চোখে পানি দেখে বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে। আয়েশা বেগম শাকিরার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। শাকিরা কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, ” ছোটমা, আমি শুভ্রতাকে ছাড়া বিয়ে করতে পারব না। তুমি আমাকে এটা নিয়ে কিছু বলবে না।”

” বিয়ে মানুষের জীবনে একবারই আসে। এত সুন্দর একটা দিনে এমন বিপদ ঘটবে কে জানতো বল তো? শুধু কবুলটাই তো বলতে হবে, কাজী বলতে বললে বলে দে মা।”

শাকিরা মা এসেও মেয়েকে বলে মিসেস আয়েশার কথা শুনতে। শাকিরা এবার বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়।
মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, ” আমাকে কি মনে হয় তোমাদের? আমার বোনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না পাঁচ ছয় ঘণ্টা। কি অবস্থায় আছে, কেমন আছে কিচ্ছু জানি না। এই পরিস্থিতিতে ওকে ফেলে বিয়ে করে নেব আমি? এতোটা স্বার্থপর নই আমি, ও না ফিরলে আমি কিছুতেই বিয়ে করব না। ”

শাকিরা দৌঁড়ে নিজের রুমে চলে যায়। রায়হান ইশারা করতেই আবিরা, নেহা, স্নিগ্ধা, ইরা সবাই একে একে শাকিরার রুমের দিকে যায়। কাজী সাহেবের এবার খারাপ লাগতে শুরু করে। তিনি জানান এ বাড়ির মেয়ে বাড়ি ফিরলেই তিনি বিয়েটা সম্পন্ন করে বাড়ি ফিরবেন।
~~

ভার্সিটির মেইন গেইটের কাছে থেকে যে ডিপার্টমেন্টগুলো ছিল সেখান থেকে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়েছে। এক একদিকে চার থেকে পাঁচজন করে পুলিশ গিয়েছেন। নিহান তিনজন পুলিশকে সাথে করে শুভ্রতার ডিপার্টমেন্টের দিকে যায়। ডিপার্টমেন্টের প্রধানও সাথে আছে। সবার হাতে টর্চের আলো, চারপাশ আলোয় আলোকিত হয়ে গিয়েছে। নিহান শুভ্রতার নাম ধরে চিৎকার দিয়ে ডেকে চলেছে। খুব অসহায় লাগছে নিজেকে, কোনদিক থেকে কল আসছে না, আসলেও ভালো খবর আসছে না।

শুভ্রতার ডিপার্টমেন্টের বিল্ডিং দেখা শেষ হলে নিহান ডিপার্টমেন্টের প্রধান শওকত আলীকে বলে, ” স্যার পিছনে কি আর ডিপার্টমেন্ট আছে?”

” জি আছে।”

” দেখেছেন কি একটা অবস্থা এতরাতে আপনার এদিক ওদিক ঘুরতে হচ্ছে।”

” তুমি আমার ছেলের বয়সী, তুমি করেই বলি?”

” জি স্যার অবশ্যই।”

” শুভ্রতা আমার বিভাগের ভালো একটা ছাত্রী। আশা করছি এবারও সে খুব ভালো করবে। তুমি হয়তো তার বাড়ির লোক কিন্তু আমি তার র*ক্তের কেউ না হলেও সে আমার মেয়ের মতোই। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সে খবর পেয়েও আমি বাড়িতে কীভাবে ঘুমাই বলো তো? আমার মেয়ের সাথে এমন হলে আমি কি ঘুমাতে পারতাম?”

” আমি কৃতজ্ঞ থাকব স্যার। চলুন তাহলে পিছনের দিকে যাওয়া যাক।”

” হ্যাঁ সেটাই ভালো হবে।”

নিহান সবাইকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে আসে। পিছনেই বাংলা ডিপার্টমেন্ট তারপাশে অর্থনীতি আর পিছনের দিকে ইংরেজি। বাংলা ডিপার্টমেন্টে খোঁজ চলছে তাই তারা পিছনের দিকে এগিয়ে যায়। কয়েকজনকে আলো হাতে দেখে ছেলেদের হোস্টেলের গেইটে থাকা লোক এগিয়ে আসে। হাতে লাঠি এখনো রয়েছে। শওকত আলীকে দেখে এগিয়ে এসে সালাম দেয়।

” আসসালামু আলাইকুম স্যার। এখানে এতরাতে? কিছু হয়েছে স্যার?”

” ওয়ালাইকুমুস সালাম। আমার ডিপার্টমেন্টের একটা মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তুমি কি আশেপাশে অস্বাভাবিক কিছু দেখেছো?”

সে একটু ভেবে বলে, ” তেমন কিছু তো দেখি নি। তবে এশার নামাজের আগে হোস্টেলের তিন চারটা ছেলে এসে বলল কোণার দিকে পুরোনো দুই রুমের যে ঘরখানা পড়ে আছে ওখানে নাকি ভূত আছে, ভূতের গলা শুনেছে তারা। ভূত থাকতেও পারে স্যার বলা যায় না অনেক পুরোনো ঘর, ওই রাস্তায় তো কেউ যাওয়া আসা করে না।”

” থামো তুমি, এখানে এসেছো ভূতের খবর নিয়ে? যাও কাজে যাও।”

” স্যার সত্যিই ভূত আছে। নইলে ওরা মিথ্যা কথা কেন বলবে বলেন?”

” শাহাবুদ্দিন কাজে যাও।”

” জি স্যার, আসসালামু আলাইকুম। ”

শাহাবুদ্দিন চলে যেতেই নিহান প্রশ্ন করে, ” কোন পুরোনো ঘর স্যার?”

” ওই যে ওই রাস্তায় পুরো দুই রুমের ঘর পড়ে আছে, ওটার কথা বলল।”

নিহানের মনে খটকা লাগে। কীসের গলা শুনেছে এ বিষয়ে আগ্রহ জাগে তার। নিহান টর্চ হাতে নিয়ে শওকত আলীর দেখানো পথে দৌঁড় দেয়। ঘরের সামনে গিয়ে এদিকে ওদিকে টর্চ দিয়ে খুঁজে। গলা ছেড়ে শুভ্রতাকে ডাকতে থাকে। কয়েকবার ডাকার পরই ঘরের ভেতর থেকে গলার আওয়াজ আসে, ” ক কে? কে বাহিরে? আমাকে বাঁচাও প্লিজ। আমি আর এখানে থাকতে পারছি না।”

নিহান আওয়াজটা স্পষ্ট শুনতে পায়, কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেন সবকিছু থেমে যায়। সে কি ঠিক শুনলো! ভেতরে কে সাহায্য চাইল? শুভ্রা! তার শুভ্রা!

#চলবে………

#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_২৬

ঘরটার দরজা বাহির থেকে আটকানো, দরজা খুলে ভেতরে তাকাতেই পায়ের নিচে র*ক্ত দেখতে পায় নিহান। পায়ের দিক থেকে সামনে তাকালেই দেখে শুভ্রতা দাঁড়িয়ে। নিহান জোরে চিৎকার দিয়ে বলে, ” শুভ্রা!”

নিহানকে চিনতে পেরেই দৌঁড়ে এসে নিহানকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয় শুভ্রতা। শুভ্রতা শব্দ করে কান্না করছে নিহান তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। নিহান ওভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে বাহিরে দুজন পুলিশকে ইশারায় ভেতরে আসতে বলে। শওকত আলী আশ্চর্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন কিছু ঘটবে তিনি চিন্তাও করেন নি। তিনি থ’ মে*রে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

দুজন পুলিশ কনস্টেবল টর্চ হাতে ঘরের ভেতরে ঢুকে যায়। মেঝেতে একটা র*ক্তাক্ত পুরুষের দেহ পড়ে রয়েছে। উপুড় হয়ে পড়ে থাকায় কে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। দুজন ভেতরে গিয়ে দেহটা সোজা করে। শুভ্রতা নিহানের বুক থেকে মাথা তুলে সেদিকে তাকায়। নিহান পড়ে থাকা শরীরটা দেখেই শওকত আলীকে ডাক দেন।

” স্যার এদিকে একবার আসুন তো।”

শুভ্রতা ততক্ষণে নিহানকে ছেড়ে দিয়েছে। কান্না থামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাশে। নিহান শুভ্রতাকে হাত ধরে আবার কাছে নিয়ে এসে শুভ্রতার হাতে নিজের হাতটা রাখে। শুভ্রতার সারাশরীর কাঁপছে। নিহান শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বলে, ” আমি এসে গেছি শুভ্রা, এখন আর কোন ভয় নেই।”

শুভ্রতা কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। শওকত আলী রুমের ভেতর আসলে মেঝেতে পড়ে থাকা ব্যক্তির দিকে টর্চের আলো ফেলে বলে, ” এটা সেদিনের ছেলেটা না?”

তিনি ভালো করে দেখে বলেন, ” হ্যাঁ, সেদিনের ছেলেটা।”

” শুভ্রা কি হয়েছিল তোমার সাথে?”

নিহানের প্রশ্নে কোন উত্তর দেয় না শুভ্রতা। চুপচাপ মাথা নিচু করে থাকে। সবার আর বুঝতে বাকি থাকে না ছেলেটা শুভ্রতার সাথে কি করতে চেয়েছিল। নিহান খুব কষ্টে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে দাঁড়িয়ে আছে। সে আবার শুভ্রাকে জিজ্ঞেস করে, ” তুমি আত্মরক্ষার জন্য ওর এই হাল করেছ?”

শুভ্রতা এবার উপর নীচ মাথা নাড়ায়। শওকত আলী মান সম্মানের ভয় করছেন। কাল যখন সবাই জানতে পারবে তার ডিপার্টমেন্টে এরকম একটা ঘটনা ঘটেছে কি হবে তখন!

নিহান শওকত আলীর মুখ দেখে বুঝতে পারে তিনি চিন্তিত তার মজার ছলে এবার কনস্টেবলকে বলে, ” দেখুন তো বেঁচে আছে কি না? আমার হবু বউ খুব ছেলে পিটা*ইতে পারে। বেঁচে আছে তো নাকি?”

কনস্টেবল চেক করে দেখে বলে,” হ্যাঁ স্যার বেঁচে আছে।”

” ঠিক আছে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন ওকে তো আমি কালকে দেখে নিচ্ছি।”

” জি স্যার।”

একজন বাহিরে গিয়ে হয়তো টিম মেম্বারকে কল দিয়ে গাড়ি নিয়ে আসতে বলে। নিহানও বাড়িতে কল দিয়ে জানিয়ে দেয় শুভ্রতাকে পাওয়া গিয়েছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা বাড়ি ফিরবে। নিহান এবার শুভ্রতাকে ফোন ধরিয়ে দিয়ে বলে, “তোর বান্ধবীর নম্বর মুখস্থ থাকলে কল করে জানিয়ে দে তুই ঠিক আছিস নইলে ওই মেয়েটাও চিন্তায় রাতে ঘুমোতে পারবে না।”

ছেলেটাকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। নিহান এসআই -কে বললেন শওকত স্যারকে বাসায় পৌঁছে দিতে। শওকত আলী নিহানের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে বিদায় নিলেন।

নিহান আর শুভ্রতা হাটছে, কিছুদূরেই নিহানের বাইক রাখা। সেই অবধি হেটে যেতে হবে। রাত তখন একটা, চাঁদের আলো চারপাশে ছড়িয়েছে দুজন পাশাপাশি হাটতে হাটতে শুভ্রতা হঠাৎ থেমে যায়। শুভ্রতা থেমে যাওয়ায় নিহান ও দাঁড়িয়ে যায়। শুভ্রতার দিকে ফিরে বলে, ” কি হলো শুভ্রা?”

শুভ্রতা চুপচাপ নিহানের দিকে তাকিয়ে আছে। নিহান শুভ্রতার সামনে গিয়ে তার গালে হাত রাখতেই দূরে ছিটকে যায় শুভ্রতা। নিহান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ” কি হয়েছে, আমাকেও ভয় লাগছে?”

” ওই ছেলেকে মা*রার জন্য কি আমারও শা*স্তি হবে নিহান ভাই?”

” না, তোর কিচ্ছু হবে না শুভ্রা। এখন আর দেরি নয় বাড়ি ফিরতে হবে সবাই কত চিন্তায় আছে ভাবতে পারছিস! শাকিরা নাকি বিয়েতেই বসেনি। ও বলেছে তুই ফিরলে তবেই বিয়েতে বসবে। মেয়েটা তোকে কতটা ভালোবাসে বুঝতে পারছিস?”

” আমার তো কিছু করার ছিল না। কীসের থেকে যে কী হয়ে গেল!”

” বাইকে বসে সব শুনছি, এভাবে দাঁড়িয়ে কথা বললে আজ আর বাড়ি ফিরতে হবে না। মেয়েটার বিয়েও হবে না।”

” হুম চলেন।”

দুজন হাটা শুরু করে, দুই মিনিট হাটতেই বাইকের কাছে এসে দাঁড়ায়। নিহান বাইকে উঠে বসে শুভ্রতাকে উঠতে বলে। শুভ্রতা নিহানের কাধে হাত রেখে পিছনের সিটে বসে পড়ে।

রাস্তা ফাঁকা থাকায় বাইক খুব জোরে চালাচ্ছে নিহান। শুভ্রতা শক্ত করে ধরে বসে আছে। মনে মনে ভাবছে আল্লাহ যদি এই মানুষটাকে না পাঠাতো তাহলে হয়তো কয়েকদিন পর তার লা*শ উদ্ধার করত সবাই কারণ ওখানে কেউ যাওয়া আসা করে না। দুইদিন বা তিনদিন পর যখন মৃ*তদেহের পঁচা গন্ধ বের হতো তখন মানুষ উদ্ধার করত। একটা মানুষ কতটা ভালোবাসলে সবকিছু ফেলে ফুলে প্রিয় মানুষকে খুঁজে বের করার জন্য এতরাত অবধি নিজে বাহিরে থাকতে পারে! আর এই মানুষটাকেই কী না সে এতগুলো বছর কষ্ট দিয়ে এসেছে! ভালোবাসার মানুষ তো সে যে শুধু মুখে ভালোবাসি না বলে বিপদে পাশে থাকে সবকিছু থেকে আড়াল করে রাখে। শুধু ভালোবাসলেই হয় না ভালোবেসে আগলেও রাখতে হয়।

নিহান কোন কথা না বলে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে কারণ শুভ্রতাকে এখনই কিছু জিজ্ঞেস করলে সে কষ্ট পাবে এমনিতেই কয়েকঘন্টা সে অনেককিছু সহ্য করেছে। তার আগে বিশ্রামের প্রয়োজন তারপর সব কথা শোনা যাবে।

চল্লিশ মিনিটের রাস্তা বিশ মিনিটে অতিক্রম করে বাড়ি ফিরে আসে সবাই। বাহিরের উঠোনে বাইক এসে থামতেই বাড়ির ভেতর থেকে সবাই ছুটে আসে।

শুভ্রতা বাইক থেকে নেমে দাঁড়ায়, তার মা দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। স্নিগ্ধাও এসে শুভ্রতার একপাশে দাঁড়িয়ে কান্না করছে। শুভ্রতা একহাত দিয়ে স্নিগ্ধাকে কাছে টেনে নেয় তাতে স্নিগ্ধা আরও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে থাকে। শাহাদাত সাহেব ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না যে শুভ্রতা তার সামনে। চারপাশে সবাই শুভ্রতার দিকে এগিয়ে আসে। শুভ্রতা মায়ের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চোখের পানি মুছে দেয় আর বলে,

” আমি একদম ঠিক আছি মা, এই যে দেখো তোমার মেয়ে একদম ঠিক আছে কিচ্ছু হয়নি। কেঁদো না তো, একদম কাঁদবে না। এই স্নিগ্ধা থাম এবার, একদম কাঁদবি না। ”

শুভ্রতা এবার শাহাদাত সাহেবের দিকে অগ্রসর হয়। মেয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে দেখে তার বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে গলা অবধি ভারী হয়ে যায়। শুভ্রতা এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরতেই শাহাদাত সাহেব শব্দ করে কেঁদে ফেলে। কিছুক্ষণ পর শুভ্রতা বাবার থেকেও নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। নিজের চোখের পানি মুছে বলে,

” বাবা তুমি বাচ্চাদের মতো কান্না করছো? তুমি তো আমার স্ট্রং বাবা, আমার সুপারহিরো। তাহলে তুমি কাঁদছো কেন? এই দেখো আমি একদম ঠিক আছে। আর কাঁদবে না।”

সবার চোখে পানি টলমল করছে, নিহান বলে ওঠে, ” বলেছিলাম না যে শুভ্রাকে নিয়েই আমি বাড়ি ফিরব? ফিরলাম তো! এবার সবাই কান্নাকাটি বাদ দিয়ে যাও তো বিয়ের ব্যবস্থা করো। কাজী সাহেব এখনো এখানেই আছেন, উনাকে আমি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসব। এই রায়হান যা রেডি হয়ে নে, তোর বউয়ের আবার কাল পরিক্ষা আছে।”

নিহানের কথায় কেউ কেউ হেসে ফেলে কিন্তু শাকিরা একপাশে দাঁড়িয়ে শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে অঝোরে চোখের জল ফেলছে। শুভ্রতা সেটা খেয়াল করে। সব বোনগুলো এসে তাকে জড়িয়ে ধরায় শাকিরার দিকে যেতেও পারছে না। শুভ্রতাকে সবাই ছাড়লে সে শাকিরার কাছে যায়। শাকিরার সামনে গিয়ে বলে,

” যুদ্ধ জয় করে ফিরলাম, সবাই আমাকে জড়িয়ে ধরল আর তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তোর হবু বর কি কাউকে জড়িয়ে ধরতে নিষেধ করেছে?”

শাকিরা তখনও অভিমান করে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। শুভ্রতা এবার রায়হানকে উদ্দেশ্য করে বলে,

” কি গো রায়হান ভাইয়া, বউকে কি নিষেধ করেছ নাকি?”

শুভ্রতার কথায় রায়হান হেসে বলে, ” আমি তো নিষেধ করিনি তার মনে কি চলছে সেটা তুই নিজেই দেখ।”

শাকিরা এবার কোন কথা না বলে শুভ্রতাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে দেয়। শুভ্রতাও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শাকিরাকে।

আধাঘণ্টার মধ্যে শাকিরা আর রায়হানের বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যায়। সবাই যার যার বাড়িতে চলে যায়। নিহান নিজের বাইকে করে কাজী সাহেবকে বাসায় পৌঁছে দিতে গিয়েছে।
শুভ্রতারও এখন গিয়ে গোসল করতে হবে। অন্য পুরুষ যে তাকে খুব নোংরাভাবে ছুয়েছে, সেই ছোয়া ঘষে ঘষে তুলতে হবে। বাড়ির সবার সামনে, কিছু হয় নি এমন ভাব করলে ভেতরে ভেতরে সে ভেঙে চূড়মার হয়ে গেছে।
শাহাদাত সাহেব আগেই বাড়ি ফিরেছেন। শাকিরাদের বাসায় অনেকক্ষণ দেরি করে আয়েশা বেগম, স্নিগ্ধা, আবিরা, নেহা, তাদের মা সবাই একসাথে বাড়ি ফিরছে। শুভ্রতা রাবেয়া বেগমের হাত ধরে বলে,

” তুমি আমার সাথে কথা বলছো না কেন বলো তো?”

রাবেয়া বেগম অভিমানী গলায় বলেন, ” কেউ কি আমার সাথে কথা বলেছে?”

” আরে ডার্লিং রাগ করছো কেন? তুমি আমার কেউ হও না?”

” না, কেউ হই না। কেউ হলে তো হতোই।”

” আরে হবু শাশুড়ী, আই লাভিউ উম্মাহ।”

শুভ্রতা রাবেয়া বেগমের গালে চুমু দিয়ে দেয়। আয়েশা বেগম পাশ থেকে বলে, ” কার ওপর রাগ,অভিমান করবে আপা? এই মেয়ের ওপর? কখনো পারবে না।”

#চলবে…..