#শূন্যেরে_করিব_পূর্ণ (পর্ব ২)
নুসরাত জাহান লিজা
“হবু হিমু সাহেব, দিনকাল কেমন যাচ্ছে আজকাল?”
চট করে ঘুরে তাকিয়ে শ্রাবণীকে দেখতেই হৃদপিণ্ড লাফিয়ে গলার কাছে চলে এলো মিরানের। সর্বনাশ! এই মেয়ে এখানে কী করছে! সব পন্ড করতে চলে এসেছে নিশ্চিত। মিরান গলায় গাম্ভীর্য ফুটিয়ে উত্তর দেবার চেষ্টা করল,
“তুমি? দেখো, তুমি যদি ভেবে থাকো আমি তোমাকে দেখলেই বিয়েতে রাজি হয়ে যাব সেটা ভুল।”
“তুমি কেন ভাবছ আমি নাচতে নাচতে তোমাকে বিয়ে করতে চলে এসেছি?”
এবার মিরানের চোখে মুখে দ্বিধার ছাপ পড়ল। ভ্রু কুঁচকে বলল, “তাহলে এখন কেন এসেছ?”
“কেন? তুমি ভুলে গেছ এটা আমার ফুপুর বাড়ি? আমি যখন ইচ্ছে তার কাছে আসতে পারি। তুমি এমন কোনো লোভনীয় বস্তু নও যে তোমার টানে চলে এসেছি।”
“বিয়ে করে হাসব্যান্ড নিয়ে এসো তাহলে।”
“আমি হাসব্যান্ড নিয়ে আসব নাকি বাচ্চা কাচ্চা, শ্বশুর, শাশুড়ি নিয়ে আসব সেটা আমার মর্জি। তুমি কে এটা বলার?”
মিরান কী বলবে বুঝতে পারে না। এই বিচ্ছু ধরনের মেয়ের সাথে সে কথায় কোনোকালেই পেরে উঠেনি।
“তা তোমার হিমু হবার মিশন কতদূর?”
“এটা আমার লাইফ। তুমি জানতে চাইবার কে?”
“শুনলাম, হাঁটতে গিয়ে নাকি পা কেটে ফেলেছ? এখনো রাস্তায় হাঁটতে শেখোনি। মুখে এত বড় বড় বুলি! সব ফাঁকা আওয়াজ।”
“ওটা খালি পায়ে ছিলাম বলে, তাছাড়া রাস্তায় কাঁচ ছিল।”
শ্রাবণী শব্দ করে হাসল। সুরেলা হাসি। কিন্তু মিরানের গায়ে জ্বালা ধরে গেল।
“হাঁটতে না জানলে উঠান বাঁকা।”
“তুমি চলে যাও, প্লিজ।”
“তুমি যদি সাত দিনের মধ্যে পুরোপুরি হিমু হয়ে দেখাতে পারো, আমি সেদিনই চলে যাব। মনে রেখো, হিমু মানে হিমু। নকল, দুই নম্বর হিমু না। খাঁটি হুমায়ুন আহমেদের হিমু।”
কথাটা বলে একটু থেমে মাথাটা একটু সামনে এগিয়ে ষড়যন্ত্রীর মতো করে বলল, “আর না পারলে…”
আবার থেমে গিয়ে অদ্ভুতভাবে হাসল শ্রাবণী। হাসিতে কী একটা যেন ছিল। মিরান ভয় পেয়ে গেল। কোনোরকমে বলল,
“চ্যালেঞ্জ করছ?”
“নাহ্! তোমাকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে কী করব! আমি তোমাকে টাস্ক দিলাম। ফেইল করলে দুর্ভোগ পোহাতে হবে মনে রেখো।”
বিস্ময়াবিষ্ট হতবুদ্ধি মিরানকে রেখে দৃপ্ত ভঙ্গিতে ছাদ থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল শ্রাবণী। দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইল মিরান। রাতের নৈসর্গিক সৌন্দর্য ওকে আর এতটুকু স্পর্শ করছে না। টাস্ক জেতার আগেই তো সে হেরে বসে আছে। হিমু হওয়া মুখের কথা নাকি!
সে নিশ্চয়ই শ্রাবণীর বেতনভুক্ত কর্মচারী নয় যে ওর টাস্ক কমপ্লিট করতে হবে, কিছু চাপিয়ে দিলেই মেনে নিতে হবে! এসবের কোনো মানেই হয় না।
***
রাতে রাবেয়া শ্রাবণীর ঘরে এলেন। শ্রাবণী তখন চুল আঁচড়াচ্ছিল। তিনি বিছানায় বসে বললেন,
“আয়, আমি চুলে বিলি কেটে দিই।”
শ্রাবণী গিয়ে তার পাশে বসল। ফুপু বিলি কাটছে, স্নেহের পরশে পরম শান্তিতে ওর চোখ বুঁজে আসছিল।
“তুই কী করবিরে শ্রাবণী?”
“আগেই তো বলেছি ফুপু।” চোখ বন্ধ রেখেই অলস গলায় উত্তর দিল সে।
“এসব না করলেই নয়?”
“না করলেই যদি চলত তবে আমি এসেছি কেন ফুপু?”
“তুই মিরানকে পছন্দ করে ফেলেছিস?”
শ্রাবণী ঝট করে চোখ খুলল, এরপর ক্ষিপ্ত গলায় বলল, “ফুপু, তুমি পাগল? ওই গাধাকে আমি কোন দুঃখে পছন্দ করতে যাব? ব্যাটার খুব শখ আমাকে হারিয়ে দেবে। ওর ওই আত্মতৃপ্তি আমি বসে বসে সহ্য করে হার মানব? এত সহজ?”
রাবেয়া মুহূর্তকাল নীরব রইলেন, এরপর বললেন, “যা করবি ভেবেচিন্তে করিস মা। আমার ভীষণ চিন্তা হয়।”
শ্রাবণী বলল, “আমার ঘুম পাচ্ছে ফুপু। আমি তোমার কোলে মাথা রেখে শুই?”
রাবেয়া আপত্তি করলেন না। শ্রাবণী মাতৃছায়া পেয়েছে তার কাছে। আজও প্রশান্তি অনুভব করল। অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল।
***
মিরান সকালে ঘুম থেকে উঠে যথারীতি অফিসে যাচ্ছিল। বাড়িতে সৌম্য, শোভা আর রাবেয়া ছাড়া মিরানের সাথে কেউ কথা বলছে না। বাবার সামনে পড়া এড়াতে আগেভাগে চুপচাপ নাস্তা সেরে বেরিয়েই এসেছিল। কিন্তু গেটের কাছে শ্রাবণীকে দেখে থামল। এরপর না দেখার ভাণ করে এড়িয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু নাছোড়বান্দা মেয়েটাও বেরিয়ে এলো সাথে।
“তুমি আমার পিছু নিয়েছ কেন?”
“প্রয়োজন আছে তাই।”
“কী প্রয়োজন?” নিরস গলায় প্রশ্ন করল মিরান।
“সামনের মোড় থেকে আমার জন্য একটা রিকশা পাঠিয়ে দাও। এরপর অফিসে যাও।
“পারব না।”
“তাহলে আমি তোমার সাথে সাথে যাব। আজ সারাদিন তোমার সাথে আঠার মতো লেগে থাকব। সেটা ভালো হবে?”
মিরান অগত্যা রাজি হলো। নইলে দেখা যাবে ওর সাথে অফিসে চলে যাবে। অফিসে যে ওকে নিয়ে টীকাটিপ্পনী চলে, আড়ালে আবডালে হাসাহাসি হয় সেসব মেয়েটা জেনে যাবে। আর শ্রাবণী ওকে জ্বালাতন করার মোক্ষম অ স্ত্র পেয়ে যাবে। জেনে-বুঝে শত্রুর হাতে মোক্ষম অস্ত্র তুলে দেবার মতো বোকামি সে করতে চায় না।
মোড়ে এসে দেখল মোটে তিনটা রিকশা দাঁড়িয়ে। একটাতে আবার চালক নেই। একজন বলল,
“এদ্দুর যায়ে যদি দেহি ম্যাডান যেনে যাব, ওইহানে আমি যামু না৷ তাইলে কষ্ট কইরা যাইয়া লাভ নাই।”
মিরান বলল, “আমি এটুকুর ভাড়া দিয়ে দেব।”
“তাও যামু না।”
অন্য রিকশা রাজি হলো। সেটা এগুতে যাবে, ততক্ষণে মিরান দেখল একটা রিকশা এদিকেই আসছে। তাতে বসে রয়েছে শ্রাবণী।
“রিকশা পেয়ে গেলাম৷ তোমাকে কষ্ট করতে হলো না। তবুও উপকার করতে রাজি হয়েছ তাই ধন্যবাদ।”
ওকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল শ্রাবণী। কেন যেন মিরানের মনটা খারাপ হয়ে গেল। যে রিকশা রাজি হয়েছে, সেটায় চেপে বসল।
“কোনহানে যাইবেন?”
“আপনার যেদিকে যেতে ভালো লাগে সেদিকে যান। তবে জ্যাম নেই, একটু নির্জন এমন জায়গায় নিয়ে যান মামা।”
…….
ক্রমশ