শূন্যেরে করিব পূর্ণ পর্ব-০৩

0
163

#শূন্যেরে_করিব_পূর্ণ (পর্ব ৩)
নুসরাত জাহান লিজা

মিরানের আজ অফিসে যেতে ইচ্ছে হলো না। কোত্থাও যেতে ইচ্ছে হলো না। শুধু ইচ্ছে হলো হারিয়ে যেতে। কখনো কখনো অকারণেই এতটা মন খারাপের মেঘ এসে মনের আকাশে ভিড়ে, যে উপরের খোলা আকাশটাকে কেমন মেঘশূন্য ফ্যাকাশে মনে হয়। যেন সবকিছু অর্থহীন। আজ মিরানের তেমন একটা দিন।

রাস্তায় আজ জ্যাম অনেক বেশি। তবে রিকশাওয়ালা মামা অলিগলি রাস্তা ধরে ধরে একটা পার্কের সামনে এসে থামল।

“জায়গাটা ভালোই মনে হচ্ছে।”

“হ। সামনের ওই বস্তিতে থাহি আমি।”

“আপনার পরিবারে কারা আছে?”

“বউ, তিন বাচ্চা।”

“কখনো মনে হয় না আপনি একলা থাকলে ভালো হতো?”

“না, তা মনে হইব ক্যান! সারাদিন খাটনের পরে ঘরে গেলে বউ গামছা আগায়ে দেয়। পানি দেয়, খাওনের সময় পাশে বইসে গপ্প করে। বাচ্চারা কোলে উইঠে লাফঝাপ দেয়। মনে হয়, আহ, কী সুখ!”

শুনতে শুনতে কেমন ভাবালুতা পেয়ে বসে মিরানকে। এমন একটা পরিবার ওর কখনো হবে না! এই প্রথম নিজের সিদ্ধান্তের জন্য আফসোস হলো।

মনে হলো ওর সামনে দাঁড়ানো রিকশাচালক আইনুল পৃথিবীর সবচাইতে সুখী মানুষ। কত অল্পেই তুষ্ট ওরা। সময়মতো খাবার আর একটা নিশ্চিত মাথা গোঁজার ঠাঁই, প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য এটুকু ছাড়া আর কোনো চাহিদা এদের নেই।

একবার মিরানের মনে হলো তাকে জিজ্ঞেস করবে কখনো দুঃখী মনে হয় কিনা নিজেকে! কিন্তু লোকটার চোখ মুখে যে খুশির আভা ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে বিষাদ ছড়াতে ইচ্ছে করল না।

ঘড়িতে এগারোটা তেইশ। দেড় ঘন্টা রিকশায় ঘুরেছে। মিরান একটা বেঞ্চিতে এসে গা এলিয়ে বসল। দুই হাত দু’দিকে ছড়িয়ে দিয়ে, চোখ বন্ধ করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর মোবাইলটা বেজে উঠল। ওর কলিগ শফিক সাহেব কল করেছে।

“হ্যালো, শফিক ভাই..”

“রাখেন ভাই আপনার হ্যালো। কই আপনি? বস তো আপনার খোঁজ করতেসে বারবার। অফিসে চলে আসেন আর নইলে একটা কল করেন।”

“ধন্যবাদ ভাই। আমি ফোন করছি।”

“মিরান সাহেব, অবস্থা খুব একটা সুবিধার না কিন্তু। বসের মেজাজ বহুত চটা।”

মিরানের ইচ্ছে না করলেও বসের নম্বর ডায়াল করল।

“মিরান সাহেব, আপনি আজ অফিসে আসেননি কেন?”

“স্যার, আজ ইচ্ছে করেনি।”

“ইদানিং প্রায়ই অফিসে আসছেন না, এটাও কি আপনার ইচ্ছা অনিচ্ছায়?”

“জ্বি স্যার, কিছুটা তাই।

“আপনি এখন কোথায়?”

“স্যার, আমি একটা পার্কে বসে আছি। আমার সামনে একটা ছোট্ট বাদামওয়ালা ছেলে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।”

“আপনি যেখানেই থাকুন, এই মুহূর্তে অফিসে চলে আসুন।”

“স্যার, আজ আমি যেতে পারব না। আজ আমার মধ্যে একটা বৈরাগ্য ভাব এসে ভর করেছে। সেটা কাটলে…” হিমু হয়তো এভাবেই বলত, না, হিমুর মধ্যে দ্বিধা থাকে না। হিমুর স্পষ্টবাদীতা ওর বোধহয় রপ্ত করা সম্ভব হবে না। তবুও তার মতো চিন্তা করতে মিরানের মন্দ লাগছে না।

“আপনার আর অফিসে আসার দরকার নেই মিরান সাহেব। আজ মাসের সতেরো তারিখ। তবুও একাউন্ট স্যাকশনে বলা থাকবে পুরো মাসের বেতনের কথা। একদিন এসে নিয়ে যাবেন।”

“ঠিক আছে।”

“আপনি কি বুঝতে পারছেন আমার কথা?”

“জ্বি, পরিস্কার।

“আপনার টেনশন হচ্ছে না?”

“আজ হোক কাল হোক, ওই চাকরি আমার ছাড়তেই হতো। এটা নিয়ে টেনশনের কিছু নেই।”

“ভালো থাকবেন মিরান সাহেব। আপনাকে আমি বেশ পছন্দ করি। হয়তো অনেকসময় রাগারাগি করেছি। তাও বলছি আপনি একজন ভালো মানুষ।”

“ধন্যবাদ স্যার, আমি সামনে বিয়ে করতে যাচ্ছি। দোয়া করবেন।” এই কথাটা কেন বলল মিরান জানে না। তবুও বলার পরে মনে হলো পুরোপুরি মিথ্যে সে বলেনি। মিথ্যা কথা বলার পরে ভেতরে একটা চোর চোর অনুভূতি আসার কথা তা আসেনি একেবারেই।

“বিয়ে? আপনার? তাহলে এবার একটা সুযোগ দিচ্ছি। এটাই শেষবার, বুঝলেন মিরান সাহেব?”

“এই সুযোগটা কেন পেলাম স্যার? জানতে পারি?”

“হ্যাঁ পারেন। আমি যখন বিয়ে করি তখন আমি বেকার। বাবার অঢেল সম্পত্তি নেই। কিন্তু ওর ফ্যামিলি ওর অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। আমার ছন্নছাড়া অবস্থার মধ্যেও সে আমার হাত ধরে বেরিয়ে এসেছিল। অসম্ভব কষ্ট অভাবের মধ্যে আমরা দুইজন হাত ধরাধরি করে শুধু ভালোবাসা আর বিশ্বাসকে সম্বল করে আমরা বেঁচে ছিলাম। তারপর ধীরে ধীরে নিজেদের দাঁড় করানো। আমি আর আমার স্ত্রী যে-ই স্ট্রাগলের মধ্য দিয়ে গিয়েছি, আমি চাই না অন্য কেউ তা করুক।”

“আপনার তো কষ্টের মধ্যেও সুখ।”

“হ্যাঁ, একজন সত্যিকারের মানুষকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তাহলে যেকোনো গরলও মধুতে পরিণত হয়। নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা। কাল থেকে অফিসে আসবেন মিরান সাহেব। ধরে নিন এটা আমার পক্ষ থেকে বিয়ের সামান্য উপহার।”

কল কেটে গেল। এবার মিরানের অনুশোচনা হলো, এই মিথ্যেটা কেন যে বলল! মিথ্যে দিয়ে পাওয়া অর্জন উপভোগ্য হয় না, কেমন গলায় চেপে বসে। শ্বাস রোধ হয়ে আসে।

বসের বিয়ে আর সংসারের গল্পটা মাথায় ঘুরছে ওর। এমন একটা ভালোবাসার গল্প ওরও যদি হতো। একজনের চুরির রিনিঝিনি শব্দে ঘুম ভাঙবে, সেজেগুজে এসে বলবে, ‘দেখো তো, আমায় কেমন লাগছে?’ মাঝেমধ্যে কপট রাগে মুখ ভার করবে, মিরান সেধে তার মান ভাঙাবে।

দিবাস্বপ্ন ভাঙল চমকে উঠে। সেই অদ্ভুত স্বপ্নে শ্রাবণী কেন এলো! ওর মুখটা সবসময়কার মতো নয়, কেমন বউ বউ লাগছিল। অভিমানে রাঙা লাজুক মুখাবয়ব।

আর ভাবতে চায় না মিরান। সে উঠে পড়ল বেঞ্চি থেকে। হনহনিয়ে হাঁটতে শুরু করল। যেন ব্যস্ততায় ডুবে নিজের অবচেতন মনকে পরাস্ত করবার প্রাণান্তকর প্রয়াস।
………..
ক্রমশ
কেমন লাগছে?