শেষের পঙক্তি পর্ব-২২+২৩

0
495

#শেষের_পঙক্তি
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২২
অপলক দৃষ্টিতে মিহালের নত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে আছে। ছন্দটা বলার সময় মিহাল তূরের চোখের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বলেছিল তারপর আবার নুপুর পড়ানোতে মন দিয়েছে। তূরের আঁখিযুগল নোনাজলে ভরে উঠলো। মিহাল যে হুট করে মাথা উুঁচু করবে তূর বুঝতে পারে নি। তূরের ভেজা নয়ন দেখে ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে পরে মিহাল আর তূর নিজের চোখ মুছতে থাকে। মিহাল উঠে দাঁড়িয়ে তূরের গালের দুই পাশে হাত রেখে মুখমণ্ডল উুঁচু করে নমনীয় স্বরে জিজ্ঞাসা করে,

–কী হয়েছে? কাঁদছো কেনো? আমার করা কোনো কাজ তোমাকে কষ্ট দিয়েছে?

তূর না বোধক মাথা নাড়ায়। মিহাল তূরের চোখ ভালো করে মুছিয়ে দিয়ে বলে,
–তোমার চোখে জল এলে আমার হৃদয়ে কম্পন শুরু হয় জানো? আমার কারণে এই নয়নযুগল দিয়ে অনেক বর্ষণ হয়েছে। আমি চাই না আর বর্ষণ হোক আমার কারণে। পূর্বের করা কর্মের গ্লানি এখনো আমাকে পীড়া দেয়। এখন রংধনু উঠুক তোমার আমার দুঃখের বর্ষণ শেষে।

তূর মায়াময় নয়নে মিহালের চোখের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আদুরে স্বরে বলে,

–আনন্দাশ্রু ছিল ওটা। আর রংধনুর রঙে রাঙার পর ভালোবাসার বর্ষণ হোক আমাদের হৃদকুটিরে।

মিহাল তূরকে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়। হঠাৎ তূরের মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চাপে। সে মিহালের বাহুডোর থেকে আচমকা সরে এসে বাঁকা হেসে বলে,

–এই এই! দূরে থাকো হ্যাঁ! এখনও আমাদের বিয়ে হয় নি। ধৈর্য ধরতে শিখো প্রিয়! বুঝেছো? কন্ট্রোল!

এই বলে তূর দৌঁড়ে ছাদ থেকে নেমে যায়। মিহাল বোকার মতো কিছুক্ষণ তূরের গমনপথের দিকে তাকিয়ে থেকে বিষয়টা বুঝতে সক্ষম হলে এক হাত কোমড়ে ও আরেকহাত ঘারে রেখে হেসে ফেলে। তারপর মিহালও নিচে নেমে যায়। ওদের এতো প্রেম দেখে সূর্যও লজ্জা পেয়ে লুকিয়ে গেছে। আকাশে এখন সূর্যের কাল্পনিক লজ্জামিশ্রিত রক্তিম আভা দৃশ্যমান।

দুই পরিবারের পারস্পারিক সম্মতিতে মিহাল ও তূরের বিয়ে ঠিক হলো। ইতোমধ্যে ইফতির পরিবারের সাথেও ফোনে যোগাযোগ হয়ে গেছে। তারা তো এক মাস আগে থেকেই বিয়ের জন্য তৈরি তাই বিশেষ আপত্তি করে নি কিন্তু হাতে অন্তত দশ দিন সময় লাগবে বলে জানিয়েছে। দশ দিন পর গায়ে হলুদ হবে তিন পরিবারের একই সাথে তার পরেরদিন বিয়ে। তূরের আমেরিকার ফ্লাইট বিয়ের পরেরদিন পরেছে আর মিহালেরটা তার পরেরদিন। দুইজনের দুই দিনে ফ্লাইট হওয়াতে বিশাল ঝামেলা হয়ে গেছে। ইফতির ফুফা সেই ঝামেলাটাও মিটিয়ে দিলো। ইফতির ফুফার এয়ারপোর্টে চেনাজানা আছে। তার মাধ্যমে তূরের ফ্লাইট একদিন পিছিয়ে আনা গেলো।

_________

প্রকৃতি মত্ত তার আপন লীলাখেলায়। ঝড় বৃষ্টির তাণ্ডবে বিকেল হতেই সন্ধ্যা নেমে গেছে। বর্ষা ঋতু আসন্ন কিন্তু জৈষ্ঠ মাসের শেষ সময়ে বৈশাখের আবহ পাওয়া যাচ্ছে। দুপুর পর্যন্ত কাঠফাটা রোদ্দুরে তেজস্বী রূপে আকাশ হাসছিল পরক্ষণেই আকাশের মন খারাপে বৃষ্টি হয়ে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। তূর ও নীরা আজ বৃষ্টিতে ভিজতে ছাদে উঠেছে। ওদের মায়ের হাজার বারণ স্বত্বেও ওরা ভিজবে। নাফিহা ও তূর্যকে ছাদে আসতে দেয় নি কিন্তু ওরা কম পরিশ্রম করছে না ছাদে আসার জন্য। তূরের মা ও চাচি নাফিহা ও তূর্যকে ধ’মকে ধা’মকে আটকে রেখেছে। কিছুক্ষণ পর ওরাও ওদের মায়েদের অসাবধানতার ছুট পেয়ে দৌঁড়ে ছাদে উঠে গেছে। এখন চার ভাই-বোন বৃষ্টির পানিতে ভিজছে।

তূরের মা ও চাচির খেয়াল হলে তাদের মাথায় হাত। তূরের মা ছাদের সিঁড়িতে গিয়ে রে’গে মে’গে বলছে,

–আজকে এই চারওটার জ্বর আসবে। আমার কথা মিলিয়ে নিস তোরা। এই বিকেল বেলার বৃষ্টিতে ভিজতেছিস তো। আর ভিজিস না। চলে আয়। জ্বর হলে তো সেই আমাকেই দেখতে হবে। আয়। ভেতরে আয় বলছি।

ওদের চার ভাই-বোনের কোনো হেলদোল নেই। ওরা চারজন খিলখিল করে হাসছে আর ভিজছে। আধঘন্টা ভেজার পর জবুথবু অবস্থায় ওরা ঘরে ঢুকলো। বৃষ্টির রেশ কমে এসেছে। ঘরে ঢুকে একে একে চার জনেই হাঁচি দেয়া শুরু করলো। ওরা হাঁচি দিয়ে অপরাধী দৃষ্টিতে ওদের মায়েদের দিকে তাকিয়ে আছে। ওদের মায়েরা চোখ গরম করে ওদের দিকে রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। তূর ওর তিন ভাই-বোনকে তাড়া দিয়ে বলে,

–এই এই তোরা জলদি ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। নাহলে ঠান্ডা লেগে যাবে।

তূর এইগুলো বলেই চো’রের মতো সটকে পরলো। ফ্রেশ হয়ে তূর, নীরা ও নাফিহা গরম গরম লেবুচা পান করে কিছু বিস্কিট খেয়ে দুইটা করে প্যা’রাসিটে’মল খেয়ে নিলো আগাম নিরাপত্তা হিসেবে। তূর্যকে না’পা সিরাপ খাইয়ে দিলো।

_______
বিয়ের আর দুইদিন বাকি। আজ মেহেদী দেওয়া হবে আর কাল গায়ে হলুদ হবে তিন পরিবারের একসাথে। তূর ও নীরার ফ্রেন্ডরা আজকেই কয়েকজন এসে হাজির। অর্ক, রাফি, রণক, আসফি ও তাওহীদ এসেছে কারণ ওরা ডেকোরেশনের কাজ দেখবে তূরের এক কাজিন ভাইয়ের সাথে। তূরের কাজিন ভাই তিনজন বাদে সবাই ছোট। বড় তিন জনের মধ্যে দুইজন দেশের বাহিরে তাই আসতে পারে নি।
লিরা, ফাইজা, নাদিয়া, জারিন ও নীরার কিছু বান্ধুবী মিলে ওদের দুই বোনকে মেহেদী পড়াচ্ছে সাথে হাসি-আড্ডায় মেতে উঠেছে। তূরের তিন মামারা তাদের পরিবার নিয়ে হাজির। তূরের রুমে তূর ও নীরা সহ ওদের বান্ধুবীরা গাদাগাদি করে থাকবে কিন্তু নাদিয়াকে শাফকাত অফিস থেকে ফেরার পথে এখানে এসে কিছুক্ষণ থেকে নিয়ে যাবে। নাদিয়াকে ছাড়া টানা দুইরাত থাকবে শাফকাত এটা মানতে পারছে না। হলুদের রাতে নাদিয়া তূরদের সাথে থাকবে। নীরার রুমটা ছেড়ে দিয়েছে ওদের মামিদের, মামাতো বোন ও নাফিহার জন্য। মামাদের জন্য আরেকটা রুম বরাদ্ধ। আরও কিছু আত্নীয় স্বজন ও ফুফিরা হলুদের দিন আসবে।

ওদিকে মিহালদের বাড়িতে আজকে শপিং নিয়েই মিহালের মা, বোন ও চাচিরা পরে আছে। মিহাল অফিস শেষে এসে পরে পরে ঘুমাচ্ছে। আজকেই সে অফিসে শেষবার গেলো। ইস্তফা দেওয়া হয়ে গেছে। এরপর আমেরিকায় ভার্সিটি থেকে যে জব পেয়েছে সেটা করবে। মিহাল তূরের ইউনিভার্সিটিতেই মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে।

মিহালের ভাগনি রিয়ানা মিহালের ঘরে এসে কোমড়ে হাত রেখে তার ঘুমন্ত মামার দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে আছে। রিয়ানা এবার বিছানায় উঠে মিহালের পেটের উপর চেপে বসে। তারপর মিহালের গাল দুটো হাত দিয়ে টানা শুরু করেছে। মিহালের ঘুম ছুটে যায়। মিহাল ঘুম ঘুম চোখ খুলে দেখে তার মিষ্টি পরীটা রাগ করে আছে। মিহাল আবছা ঘুম ও জাগরণের মাঝেই রিয়ানাকে জিজ্ঞাসা করে,

–কী হয়েছে আমার মামাটার? মুখ এমন ফুলিয়ে রেখেছো কেনো?

রিয়ানা সেই আগের মতো করেই তাকিয়ে আছে। মিহাল এবার চোখ হাত দিয়ে কচলিয়ে রিয়ানাকে পেটের উপর থেকে নামিয়ে বিছানায় বসিয়ে বলে,

–এতো রাগ? আমি তো ভয় পেয়ে গেছি!

রিয়ানা এবার ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে দেয়। মিহাল অবাক হয়ে গিয়ে রিয়ানাকে কোলে নিয়ে থামানোর চেষ্টাতে আছে। কিছুক্ষণ কসরত করার পর রিয়ানা থামে। মিহাল আদুরে কন্ঠে বলে,

–কী হয়েছে? মামাকে বলবে না? আম্মু ব’কেছে?

রিয়ানা আধো বুলিতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে যা বলল তাতে অর্থ দাঁড়ায়,
“সে হাতে মেহেদী দিবে। তার মামি নাকি মেহেদী দিচ্ছে সেটার ছবি তার মায়ের ফোনে সে দেখেছে। এখন সে তার মাকে কয়েকবার বলেছে কিন্তু ওর মা পাত্তা দেয় নি।”

মিহাল ওর বোনকে ডাক দিয়ে বললো,
–আপু, মেহেদী দিয়ে না রিয়ুর হাতে। বাচ্চাটা কান্না করছে।

কায়রা মুখ ঝামটা দিয়ে বলে,
–তুই দিয়ে দে। আমার কাজ আছে।

কায়রা চলে গেলে মিহাল অসহায় চোখে রিয়ানার দিকে তাকায়। রিয়ানা কাঁদো কাঁদো হয়ে চেয়ে আছে তার দিকে। মিহাল কোনো উপায় না পেয়ে তার ডেস্ক থেকে লাল মার্কার পেন নিয়ে আসে। অতঃপর রিয়ানার ছোট ছোট হাতে ফুল আঁকিয়ে দেয়। রিয়ানাতো বেজায় খুশি। সে তার মামার গালে পাপ্পি দিয়ে দৌঁড়ে চলে যায় সবাইকে হাতের ফুল দেখাবে বলে। মিহাল রিয়ানার খুশি দেখে নিজেও হাসে তারপর এশারের নামাজ পড়ে আবার ঘুম দেয়। আজকে রাতে আর সে খাবে না।

______
গায়ে হলুদের দিন সকাল বেলা তূর নিজের রুমে ঘুমিয়ে আছে। সারারাত মেহেদী দেওয়া ও শুকানো সাথে আড্ডার জন্য ঘুম হয় নি। ফজরের নামাজের সময় তূর হাত ধুয়ে ফেলেছে। ঘুম না হওয়াতে তীব্র মা’থা ব্যাথায় ফজরের নামাজ পড়েই সে ঘুম দিয়েছে। তূরের মা’থা ব্যাথার প্রবলেমটা বহু পুরোনো। হঠাৎ ফোনের রিংটোনের শব্দে তূর নড়েচড়ে উঠে। ফোনের রিংটোন কিছুক্ষণ বেজে বন্ধ হয়ে যায় এরপর আবারও বাজা শুরু হয়। তূর ঘুমের মধ্যে হাতরে হাতরে ফোনটা খুঁজে নাম না দেখেই রিসিভ করে কানে নিয়ে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে,

–হ্যালো।

অপরপাশের ব্যাক্তি নিরব। তূরের ঘুম ঘুম কন্ঠে সে মোহিত হয়ে নিজেই নির্বাক হয়ে গেছে। তূর কোনো জবাব না পেয়ে ফোন কেটে দিয়ে আবারও চোখ বুজে ফেলে ঘুমানোর উদ্দেশ্যে। আবারও তৃতীয়বারের মতো ফোন তার কর্কশ কন্ঠে চিৎকার করে উঠে। এবার তূর বিরক্ত হয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকায়। সেখানে মিহালের নামটা জ্বলজ্বল করছে। এবার কর্পূরের ন্যায় সব বিরক্তি হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে তূরের। তূর ফোন রিসিভ করে সালাম দিয়ে বলে,

–একটু আগেও কি তুমি ফোন করছিলে?

মিহাল বাঁকা হেসে জবাব দেয়,
–জি ঘুমকুমারী। আপনি তো ঘুমের ঘোরে ছিলেন।

তূর হাই তুলে বলে,
–ওহ। রাতে ওদের জ্বালায় ঘুমোতে পারি নি তাই মা’থা ব্যাথাতে ফজরের পর ঔষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছি। কী করছো?

মিহাল জবাব দেয়,
–আমিও ফজরের পর ঘুম দিয়ে আধ ঘন্টা আগে আপুর পীড়াপীড়িতে উঠে নাস্তা করেছি। তোমার মা’থা ব্যাথা কমেছে।

তূর হ্যাঁ বোধক জবাব দিলে মিহাল বলে,
–ভিডিও কলে আসো। তোমার হাতের মেহেদী দেখবো।

তূর অবাক হয়ে বলে,
–না না। সম্ভব না। বাসায় সবাই আছে। আমার রুমের মধ্যেও ওদের আনাগোনা চলছে। তোমাকে আমি ছবি তুলে পাঠিয়ে দিচ্ছি সেখান থেকে দেখে নিও। তাছাড়া কায়রা আপুকেও গতকাল পাঠিয়েছি।

মিহাল নাছোড়বান্দার মতে জেদ করে বসেছে। ভিডিও কল দিতেই হবে। তূর অনেকবার নিষেধ করার পরেও কাজ হলো না। তূর আশেপাশে নজর বুলিয়ে দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে ভিডিও কল দিলো। এক মিনিটের কম সময় ভিডিও কলে থেকে তূর নিজ থেকে কল কেটে দিলো। ভিডিও কলে ওদের দুজনের মধ্যে কোনো কথা হয় নি। শুধু হাতের মেহেদী দেখিয়েই শেষ।

চলবে ইন শা আল্লাহ্,

#শেষের_পঙক্তি
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৩
উৎসব মুখর পরিবেশে আচ্ছাদিত বিয়ের ভেন্যু। তিন পরিবারের আত্নীয় স্বজনরা সব জড়ো হয়েছে। স্টেজে হলুদের সাঁজে সজ্জিত দুই কনে। হরেক রকমের আলোকসজ্জাতে দুই কনেকে অগনিত পুষ্পের মাঝে পরিস্ফুটিত পুষ্পের ন্যায় লাগছে। কাঁচা ফুলের গহনাতে পুষ্পরাণী উপাধি দিলে মন্দ হবে না। কনেদের মুখে লেগে আছে লাজুক হাসি। বিপরীত স্টেজে দুই বর বসে আছে। তাদের নজর আটকে আছে তাদের পুষ্পরাণীদের দিকে। মিহাল ফাইজাদের ইশারাতে তূরের সাথে একান্তে কথা বলিয়ে দিতে রিকুয়েস্ট করেছে কিন্তু ফাইজা ও লিরা মুখ ভেঙচি দিয়ে চলে গেছে। মিহাল ওদের ব্যাবহারে বে’ক্ক’ল বনে গেল।

মিহাল এবার অর্ক ও রাফিকে ডেকে বলে,
–একটু কথা বলার জন্য স্পেস করে দে না। পাঁচ মিনিট শুধু। কিছু কর। ডাক্তার ইফতিও নীরার সাথে কথা বলবে। কিছু ব্যাবস্থা কর। ফাইজা, লিরা ওদের বলেছিলাম। একেকটা ভাবের জন্য পাত্তাই দিলো না।

রাফি বাঁকা হেসে বলে,
–ব্রো! আমিও কনেপক্ষ। এমনি এমনি তো কথা বলার ব্যাবস্থা করবো না।

মিহাল ও ইফতি একে অপরের দিকে তাকিয়ে সেন্টি ইমোজির মতো হাসি দেয়। তারপর অসহায় কন্ঠে মিহাল জিজ্ঞাসা করে,

–কী করতে হবে?

অর্ক অতি উৎসাহী হয়ে বলল,
–সিঙ্গেল লাইফে কোনো রমনির আগমন করিয়ে বাধিত করেন দুলাভাইইই!

মিহাল ও ইফতি ভ্রঁ কুঁচকে তাকায় অর্কর দিকে। অর্ক ক্যাবলা মার্কা হাসি দিয়ে বলে,

–ইয়ে না মানে! যদি আপনাদের কোনো কাজিন থাকে। আপনারা আমাদের দুলাভাই লাগেন। এটা আপনাদের নৈতিক দায়িত্ব যে অবিবাহিত সিঙ্গেল শ্যালকদের মি’ঙ্গেল করানো।

ইফতি নিজের সোফায় গা এলিয়ে বলে,
–আমার কোনো আনম্যারিড কাজিন সিস্টার নেই। সো এসব তোমাদের বন্ধু প্লাস বড় দুলাভাইকে বলো।

অর্ক ইফতির কথা শুনে আশাহত হয়ে ছ্যা’কা’খো’র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বেদনাতুর কন্ঠে মিহালকে উদ্দেশ্য করে বলে,

–দোস্ত তুই অন্তত আমার মতো অবলা বন্ধুকে ছ্যাকা দিস না। উপস দুলাভাই। পিলিজ! আপনার কি এই অসহায় শ্যালকদের প্রতি মায়াদয়া হয় না?

মিহাল বাঁকা দৃষ্টিতে তাকায় অতঃপর বলে,
–একটা কাজিন সিস্টার আছে কিছুটা বড়। আর বাকি যারা বড় ছিল সবগুলার আ’ণ্ডা’বা-চ্চাও আছে। আর গুরাগারি যা আছে সব ১৪ এর নিচে। তোর মতো ২৪ বছরের বু’ড়া নিশ্চই নিজের থেকে দশ বছরেরও বেশি ছোট বাচ্চার সাথে প্রেম করবে না!

অর্ক মুখ ফুলিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয় তাকে বু’ড়া বলাতে। রাফি হাসতে হাসতে ইফতির উপর পরে যেতে নিয়েও সামলে নিয়েছে। ইফতিও মুখ টিপে হাসছে। তখন সেখানে আসফি, তাইজুল, তাওহীদ, রণক, রিজভী ও শাফকাত এসে পৌঁছায়। শাফকাত জিজ্ঞাসা করে,

–এতো হাসছো কেনো রাফি? আর অর্ক এমন মুখ ফুলালো কেনো?

অর্ক শাফকাতের দিকে তেড়ে গিয়ে বলে,
–আপনি তো কথাই বলবেন না। আপনার চৌদ্দকুলে কোনো অবিবাহিত বিবাহ উপযোগ্য বোনই নাই। আমার বান্ধুবীগুলা আপনাদের মতো জামাই কেন বিয়ে করে? যারা সিঙ্গেল শ্যালকদের মিঙ্গেল করতে পারে না! আমি, তাওহীদ, আসফি, রিজভী কি সিঙ্গেল থেকে যাবো আজীবন?

মিহাল অর্ককে একটু রাগাতে বলে,
–একটা কাজিন সিস্টার কিছুটা বড় আছে। ১৭ বছর সেটার। কিন্তু তাও তো তোর থোকে সাত সাতটা বছরের ছোট! জাতি কী এই অসম মিলন মেনে নিবে! তুই তো আগে বলতি তোর বউ তোর থেকে পাঁচ বছরের বেশি ছোট হতে পারবে না।

অর্কর মন খুশিতে নেচে উঠলো। সে মিহালকে হুট করে জড়িয়ে ধরে বলে,
–আগের কথা ভুলে যাও বন্ধু। সাত আর পাঁচ কাছাকাছিই। আর নয়-দশ বেশি ডিফারেন্স হলেও সাত ঠিকই আছে। তোর ওই বোনই আমার বউ হবে!

শাফকাত কথার মাঝে বলে,
–আমার ও নাদিয়ার বয়সের ডিফরেন্স আট বছর। কিন্তু সে মাঝে মাঝে রেগে গেলে আমার মনে হয় সেই আমার থেকে বড়!

তাওহীদ শাফকাতের কাঁধে হাত রেখে বলে,
–আপনার কপাল ভালো যে এক বছর সংসার করেও আপনি অক্ষত আছেন। নেহাত নাদু আপনাকে অসম্ভব ভালোবাসে। নাহলে কবেই আমাদের বান্ধুবীর ধা’রা’লো নখের খা-ম-চি ও পাতলা হাতের কি-ল ও থা*প্প-ড় খেয়ে নিজের ৩১ বছরের জীবনটা বিসর্জন দিয়ে দিতেন। আমরা প্রচুর খা’ই’ছি এসব।

শাফকাত মলিন দৃষ্টিতে তাকায়। মিহাল ওদের খেঁজুরে আলাপ দেখে উতলা হয়ে বলেই ফেলে,
–এবার দয়া করে কিছু ব্যাবস্থা করেন ভাইয়েরা আমার।

বাকিরা যারা বিষয়টার সম্পর্কে অবগত ছিল না তাদেরকে বলা হয় সবটা। রাফি কিছু একটা প্ল্যান করে খাবারের টেবিল থেকে ফিরনির বাটি নিয়ে স্টেজের দিকে যায়। এরপর তূরের পাশে দাঁড়িয়ে হো’চট খাওয়ার ভান করে তূর ও নীরার শাড়িতে ফিরনি ফেলে দেয়। তূর ও নীরা হতবাক হয়ে রাফির দিকে মুখ হা করে তাকায়। নাদিয়া ও ফাইজা রাফির দিকে তেড়ে এসে বলে,

–কী করলি তুই এটা। ব-ল*দ জানি কোথাকার! নষ্ট করে দিলি তো শাড়িটা।

রাফি অনুতপ্ত হওয়ার ভান করে বলে,
–সরিরে। বুঝতো পারি নি। জলদি করে পরিষ্কার করে নে। ওয়াশরুমে যা জলদি।

জারিন ও নাদিয়া তূর ও নীরাকে ওয়াশরুমের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। রাফি ইশারা করে মিহালদের দিকে। আর আসফিকে ইশারা করে সকেট বোর্ডের কাছে যেতে। ওদিকে অর্ক মিহালের কাছ থেকে মিহালের কাজিন সিস্টারের খোঁজ নিয়ে ভাব জমাতে কাজিন সিস্টারের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে।

নাদিয়া ও জারিন তূর ও নীরাকে ওয়াশরুমের কাছে নিয়ে যেতেই হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে যায়। সবাই চিল্লাপাল্লা শুরু করে দেয়। কেউ কেউ মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট অন করছে। নাদিয়ারা কেউ সাথে করে মোবাইল আনে নি। তাই তূর ও নীরাকে নিয়ে যেখানে দাঁড়ানো সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।
এদিকে ইফতি ও মিহাল ফ্ল্যাশলাইট অন করে ওদের দিকে যাচ্ছে। ইফতি মিহালকে বলে,
–ওরা চিৎকার করবে নাতো? চিৎকার করলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।

মিহাল ইফতিকে ভরসা দিয়ে বলে,
–আপনার রুমাল আছে না? আপনি তো ডাক্তার। সাথে একটা ক্লো’রোফর্ম স্প্রে থাকলে টেনশনই করতে হতো না। এখন রুমাল দিয়ে পেছোন থেকে মুখ চেপে ধরে কানের কাছে আস্তে করে নিজের নাম বলবেন। চিৎকার করবে কিনা তা আমার আইডিয়া নাই। কখনও এরকম করতে হয় নি তো।

ইফতি ও মিহাল তূর ও নীরার পেছোনে এসে দাঁড়িয়েছে। তূর হলুদ শাড়ি পরেছে আর নীরা বাসন্তী রঙের। কিন্তু মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় কোনটা কোন রঙ বোঝা যাচ্ছে না। ওরা দুজনে সন্দিহান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হুট করে ইফতি কী করলো! সে যেকোনো একজনকে কাঁধে হাত দিয়ে আস্তে করে ডাক দিলো। তাও ডাক দিয়েছে তূরকে। তূর আচমকা কাঁধে কেউ হাত দেওয়াতে ভয়ে ভ্যাবাচেকা খেয়ে পেছোনে ঘোরে। ইফতি নিজের ফোনের ফ্ল্যাশলাইট উপরের দিকে দিয়ে রেখেছে যাতে আবছা হলেও ওরা বুঝতে পারে কে ডেকেছে। তূর ইফতি ও তার পাশে মিহালকে দেখে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে। ইফতি ক্যাবলা হাসি দিয়ে বলে,

–আসলে আপু, নীরাকে একটু ডাক দিন প্লিজ আর আপনি মিহাল ভাইয়ের সাথে যান। সরি আপু।

তূর সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায় মিহালের দিকে আর মিহাল দাঁত কে-লি’য়ে হাসছে। নীরাকে তূর ডাক দিয়ে দেয়। এদিকে জারিন ও নাদিয়া কিছুটা সামনে এগিয়ে পরিচিত কাউকে আবছা আলোতে খোঁজার চেষ্টা করছে। মিহাল তূরকে ও ইফতি নীরাকে নিয়ে যায়। দুই জুটি টেরেসের দুই দিকে যায়। ইফতি নীরাকে বলে,

–সকাল থেকে তোমাকে কতোবার ফোন করেছি। একবারও ধরলে না। কেনো?

নীরা অস্বস্থি ও লাজুক স্বরে আমতা আমতা করে বলে,
–না মানে আসলে, আমার ফোনটা কই ছিলো জানতাম না।

ইফতি ফোনের স্বল্প আলোতে দেখতে পাচ্ছে নীরার কাঁচুমাচু করা মুখশ্রী। ইফতি গম্ভীর স্বরে বলে,
–মিথ্যা বলছো তুমি।

নীরা চুপ করে থাকে। ইফতি নরম কন্ঠে বলে,
–তোমার অস্বস্থি হচ্ছিলো? ইটস অকে। কালকে অস্বস্থি হলেও আমার সাথেই থাকতে হবে কিন্তু!

ইফতি বাঁকা হাসে। নীরা লজ্জায় নুইয়ে পরে। ওদিকে মিহাল তূরকে বলে,

–জানো কতো কসরত করতে হয়েছে তোমার বন্ধুগুলাকে কনভেন্স করতে? তোমার পক্ষে গিয়ে ওরা আমাকে থ্রে’ট দেওয়া শুরু করেছে।

তূর মিহালের সামনে দাঁড়িয়ে লজ্জায় জড়োসড়ো অবস্থা। একটু আগেও তূরের লজ্জা লাগছিল না কিন্তু হুট করে যেনো লজ্জারা ঝেঁকে বসেছে ওর উপর। তূরকে চুপ করে থাকতে দেখে মিহাল ভাবুক কন্ঠে বলে,

–কী হলো? কিছু বলো?

তূর তাও চুপ। মিহাল এবার তূরের বাহুতে আলতো স্পর্শ করলে তূরের শরীর কেঁপে উঠে। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। মিহাল কিছুটা বুঝতে পেরে বলে,

–আর ইউ ফিলিং সাই? প্লিজ ডোন্ট বি সাই। তাহলে আমারও লজ্জা করে। দুজনে লজ্জা পেলে আমাদের নাতি-নাতনি কিভাবে ডাউনলোড হবে!

তূর এরকম কথা শুনতে প্রস্তুত ছিল না। তূরের হাসি এসে পরে। হাসতে হাসতে ছাদের মেঝেতে বসে পরেছে। মিহাল ভ্রুঁ কুঁচকে নাক ফুলিয়ে তূরের হাসি দেখছে। মিহাল এবার বলে,

–তোমার লজ্জারা বড়োই চালাক। হুট করে আসে আবার হুট করে চলে যায়।

সিঁড়ির কাছ থেকে কয়েকজনের গলার আওয়াজ আসছে। তূর ও নীরা দুজনেই তটস্থ হয়ে মিহাল ও ইফতিকে লুকাতে বলে। মিহাল ও ইফতি প্রথমে না বুঝলেও যখন কন্ঠস্বর গুলো আরেকটু পরিষ্কার হলো তখন লুকাতে যায় আর নীরা তূরের কাছে আসে। নাদিয়া, জারিন ও আসফি এসেছে টেরেসে। জারিন এসে বলে,

–তোরা এখানে কেনো এসেছিস? বিয়ের কনেদের রাতবিরেতে একা আসা ঠিক না। তাও এখন সন্ধ্যা ৭.৩০টা। নিচে চল।

তূররা নিচে চলে গেলে আসফি মিহাল ও ইফতিকে ডাক দিয়ে নিয়ে যায়।

হলুদের সব কার্যকর্ম জলদি শেষ হয়। রাত ১০টার আগে অনুষ্ঠান শেষ করার তাড়া ছিল কারণ কমিউনিটি সেন্টারটা শুধু হলুদের জন্য বরাদ্দকৃত ছিল। বিয়ের অনুষ্ঠান অন্য জায়গায় হবে। বর ও কনেদের ফটোশেসন শেষ হতে সময় লাগে কিছুটা।

_____অনুষ্ঠানের পর বাড়ি ফিরে তূর ও নীরা শাওয়ার নিয়ে ক্লান্তিতে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। নাদিয়া ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে তূরের মুখের উপর তোয়ালে ছুঁড়ে বলে,

–মাত্র এটুকুতেই তুই হাঁপিয়ে গেছিস? তাহলে কালকে তো তোকে খুঁজেই পাওয়া যাবে না। ভারী শাড়ি ও গহনা পড়ে তো তুই চিৎপটাং হয়ে যাবি রে।

ফাইজা টিটকারি করে বলে,
–তাহলে তোকে যেমন জিজু কোলে করে গাড়িতে তুলেছিল অসুস্থ হয়ে যাওয়াতে তেমনি তূরকেও মিহাল কোলে তুলবে।

নাদিয়া চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। জারিন হাসতে হাসতে বলে,
–নাদু বেবি তো নাচতে নাচতে কাহিল হয়ে গেছিলো। নিজের বিয়েতে না নাচলে কী চলে! তাই না নাদু বেবি?

নাদিয়া জারিনকে রাগী লুক দিয়ে বলে,
–দাঁড়া তুই। তোর একদিন কি আমার একদিন!

ওরা দুজন চরকির মতো পুরো রুমে বিছানা-ফ্লোরে দৌঁড়ে চলেছে।

তূররা ওদের অবস্থা দেখে হাসতে থাকে তূরের ফোনে টেক্সট আসে। তাতে লেখা,

“এই লাজুকলতা! এতো হাসি কোথায় পেলে বলোতো? আমি একটু তোমার সাথে মন খুলে কথাও বলতে পারলাম না। থাক সেসব। কালকে ভাবছি, জোৎসনা আনবো তোমার শিয়রে! তারপর মুগ্ধ নয়নে অপলক দেখবো তোমায়।”

তূরের গাল দুটোতে ঈষৎ রক্তিম আভা ফুটে উঠে। চোখ বন্ধ করে ফোনটা বুকে চেপে ধরে মুচকি হাসে।

চলবে ইন শা আল্লাহ্,

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।