#শেষ_চৈত্রের_ঘ্রাণ
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
[০১]
-‘আর করব না শুদ্ধ ভাই! ভুল হয়ে গেছে আমার, এবারের মতো মাফ করে দেন, জীবনেও আর অবাধ্য হবো না আপনার।’
উক্ত কথাটি বলতে বলতে প্রাণপণে ছুটছে শীতল। তার পেছন পেছন
চ্যালাকাঠ হাতে তেড়ে আসছে শুদ্ধ। ঘামে ভিজে আছে পরনের টি-শার্ট।
মুখভঙ্গি অত্যান্ত গুরুগম্ভীর। দৃঢ় কপাল ও ঘাড় বেয়ে ঝরে যাচ্ছে চিকন সুরু ঘাম। এই মুহূর্তে রাগে দ্বিকশূন্য সে। জেদ চেপেছে শীতলকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার। সে ঢাকা থেকে বাড়ি এসেছে আজ প্রায় তিনদিন হলো, তিনদিনই সে খেয়াল করেছে শীতল কিছু একটা লুকাচ্ছে। কি লুকাচ্ছে সেটা গতকাল রাতে ধরেও ফেলেছে। সেই সঙ্গে নজরে পড়েছে শীতলের পদে পদে উড়নচণ্ডী ভাব। সবকিছুতে গা ছাড়া মনোভাব। ও লাগামছাড়া
কথাবার্তা। আর এগুলো সে মোটেও পছন্দ করে না তাই বরদাস্ত করার প্রশ্নই আসে না। কারণ এই তিনটে বৈশিষ্ট্য বখে যাও প্রধান কারণ। আর
তার মতে, কারো ভুল শুধরে দেওয়ার পরেও সে যদি বারবার একই ভুল করে তার পানিশমেন্ট আপনাআপনিই ফরজ হয়ে যায়। শীতলেরও তাই হয়েছে। সময়ও এসেছে শক্ত হাতে তার লাগাম টেনে ধরার। এজন্য সেও আর দেরি করল না, সঠিক মানুষকে, সঠিক পন্থায়, সঠিক পানিশমেন্ট বুঝিয়ে দিতে চ্যালাকাঠ হাতে সামনে এগিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ আগের ঘটনা,
তখন সকাল সাড়ে ছয়টা। ঘুম থেকে উঠে পরিপাটি হয়ে বাগানে এসেছে শীতল। পরনে গোলাপি রঙা নতুন থ্রি-পিচ। লম্বা কালো চুলগুলো স্বযত্নে
বেনুনি করে সামনে এনে রাখা। মনটা বেশ ফুরফুরে। ঠোঁটে মিষ্টি হাসি।
স্নিগ্ধ মুখখানায় অপার মায়া। ডাগর ডাগর নেত্রজোড়ায় আনন্দের রেশ।
এত খুশির কারণ নেই তবুও সে খুশি। কারণ গোমরামুখে থাকতে ভালো লাগে না তার। দু’দিনের ছোটো এই জীবনে দেড় দিনই যদি মন খারাপ করে থাকে তাহলে হেসে খেলে জীবন উপভোগ করবে কখন? এটাই তো সময় জীবন উপভোগ করার। মুক্ত পাখির ন্যায় স্বাধীন মনে উড়ে উড়ে, ঘুরে ঘুরে বেড়ানোর। মনে মনে একথা ভেবে ঠোঁটে হাসি এঁটে আশপাশে তাকাল। একটুদূরে দারোয়ান কাকা মেইন গেটের সঙ্গে লাগোয়া ছোটো ঘরে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। দলে দলে পাখিরা নিজস্ব স্বরে ডেকে জানিয়ে দিচ্ছে সকালের আগমনী বার্তা। সে কয়েক ধাপএগিয়ে দৃষ্টি ছুঁড়ল মেইন গেটের ওপাশে। সামনের রাস্তা দিয়ে দু’একজনকে হাঁটতে দেখা যাচ্ছে। তাদের পাশ কাটিয়ে রিকশা টুং টাং শব্দে আসছে-যাচ্ছে নিজস্ব গন্তব্যে।
গেটের আশেপাশে কাউকে না দেখে সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কিছুক্ষণ আগে
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দেখেছে শুদ্ধ ভাই জগিং করতে বের হয়েছে। যদিও
উনার ফিরতে দেরি হয় প্রায়ই দিন তারপরও একটু সর্তক থাকা ভালো। আর যে ক’টাদিন থাকবে অবশ্যই চোখ, কান, খোলা রেখেই চলতে হবে। কারণ এই লোকের শকুনের মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, শেয়ালের মতো ধূর্ত বুদ্ধি, সহজে চোখ ফাঁকি দেওয়া যায় না। কিভাবে যেন সব বুঝে যায়।একবার যদি তার উদ্দেশ্যের ব্যাপারেও বুঝতে পারে তাহলে খবর করে ছাড়বে। এসব ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে আর না দাঁড়িয়ে নিজের কাজে লেগে পড়ল।
ফোনটা সঠিক স্থানে রেখে আলতা পরা খালি পায়ে ঘাসের উপর হেঁটে একটি ভিডিও ধারণ করল। চমৎকার হয়েছে ভিডিওটা। গাছের ফাঁক ফোঁকড় দিয়ে সূ্র্যের নরম আলো ঘাসে পড়ায় নজর কাড়ছে বেশি। তাও একটু ইডিট করে একটা হিন্দি গান লাগিয়ে নিলেই হবে। সকালের দিকে রান্নাঘরে তাড়া থাকায় বাড়ির গৃহিনীরাও বাগানের দিকে আসে না। আর ছোটোরা সাতটার পর ঘুম থেকে ওঠে। এই সুযোগে সে বাগানের ফুলের সঙ্গে, গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে, ঘাসের উপর বসে, একেক পোজে এক
রকমের ভিডিও নিলো। ভিডিওগুলো তার মনমতো হওয়ার হাসি লেপ্টে রয়েছে অধরজুড়ে। ভিডিওগুলো দেখতে দেখতে ভাবল লাস্ট আরেকটা ভিডিও নিয়ে চলে যাবে। ঘড়ির কাঁটা তখন টিকটিক করে এগিয়ে যাচ্ছে আটের ঘরে। যমরাজের ফেরারও সময় হয়ে গেছে। তাই সে দ্রুত চুলের বিনুনি খুলে খোলা চুলে পোজ নিয়ে দাঁড়িয়ে সামনে তাকাতেই বরফের ন্যায় জমে গেল। তার থেকে কয়েক হাত দূরে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে আছে শুদ্ধ ভাই। ওহ্ যা! ধরে পড়ে গেল? এখন কি বলবে? সে উপায় না পেয়ে গালভর্তি হেসে বলল,
-‘হে, হে, ভালো আছেন শুদ্ধ ভাই? জগিং সেরে ফিরলেন?’
-‘তুই এখানে কি করছিস?’
-‘ এমনি, এমনি হাঁটাহাঁটি করছিলাম আর কি।’
-‘হাঁটতে গেলে পায়ে আলতা পরতে হয়?’
-‘গ গরম লাগছিল। যা গরম! আলতা, আলতা তো রাতেই পড়েছিলাম।’
শুদ্ধ আর একটা কথাও ব্যয় করল না। শুধু এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজতে লাগল। পেয়েও গেল কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি। সে একটু গিয়ে
অনুষ্ঠানের জন্য আনা চ্যালাকাঠের স্তুপ থেকে তড়িৎ গতিতে চ্যালাকাঠ হাতে তুলে নিলো। শীতল ভয়ার্ত চোখে তাকাল। হাত দুটোও থরথর করে কেঁপে উঠল। মস্তিষ্কও সংকেত পাঠাল,’ এর মতিগতি সুবিধার নয়, পালা শীতল, পালা!’
অবস্থা বেগতিক বুঝে সে ফোনটা ফেলে প্রাণপনে দৌড়াতে শুরু করল।
আর মুখে বলতে লাগল, ‘আমি কিছু করি নি শুদ্ধ ভাই। ছেড়ে দেন। ম’রে যাব ওটা দিয়ে মারলে।’
সকাল সকাল মিথ্যা বলায় রাগে কোনো উত্তর করল না শুদ্ধ। তবে ওর মুখ দেখে মনে হলো ধরতে পারলে খবর আছে। এদিকে প্রত্যেক দিনের মতো ঘড়ির কাঁটা আটের ঘরে পৌঁছানো মাত্র ব্রেকফাস্ট করতে বসেছে
বাড়ির কর্তা ও তাদের সন্তানরা। সামনের চেয়ারেই বসেছেন শারাফাত, সাওয়ান ও শাহাদত চৌধুরী। এরপরে সায়ন, শখ, সৃজন, সাম্য, ও স্বর্ণ। আরো তিনটে চেয়ার ফাঁকা সেখানে বসবে শুদ্ধ, শীতল আর শতরুপা। একটুপরেই শতরুপা চৌধুরীও এসে বসলেন। পেশায় তিনি আইনজীবী। উপশহরে থাকেন নিজস্ব ফ্ল্যাটে। একমাত্র ছেলে রুবাব কবির, পেশায় মেরিনার। বছরের একবার ছুটিতে আসে। বর্তমানে মাঝ সমুদ্রে থাকায় যোগাযোগ হয়নি কয়েক দিন যাবত। এখানে উনি মাঝে মাঝেই আসেন ভাই-ভাবি ভাইপো-ভাইঝিদের সঙ্গে সময় কাটাতে।
সবাই এসেছে। শুদ্ধ আর শীতল শুধু অনুপস্থিত। ওদেরকে ডাকতে স্বর্ণ কেবল উঠে দাঁড়াতেই বাইরে থেকে থড়বড় করে ছুটে আসতে দেখা গেল শীতলকে।শীতলের পেছনে শুদ্ধকে দেখে সকলেই হতবাক। বিশেষ করে তার হাতের মেহগনি গাছের মোটা চ্যালাকাঠ দেখে। বিষ্ময়ে খৈই হারিয়ে ফেলেছেন সকলে। এইটুকু মেয়েকে চ্যালাকাঠ দিয়ে মারতে তেড়েছে?
মারলে মেয়েটা বাঁচবে? কি এমন বড় অপরাধ করেছে চ্যালাকাঠ দিয়ে মারতে হবে? তবে শুদ্ধ রেগে আছে দেখে সিতারা চৌধুরী আগে ছুটলেন ছেলেকে বাঁধ সাধতে। চ্যালাকাঠ দেখে বুঝতে বাকি নেই শীতল আবার কোনো কান্ড ঘটিয়েছে। নয়তো ছেলেটা হঠাৎ রাগল কেন? এখন যদি রাগের বশেই দু’ঘা বসিয়ে দেয় তখন কি হবে? ওই হাঁড়গিলে শরীরে শক্ত মার হজম করতে পারবে? এদিকে ছুটতে ছুটতে হাঁপিয়ে গেছে শীতল।
মুখ থুবকে পড়ে যাওযার উপক্রম। বড় মাকে আসতে দেখে ভরসা পেল। পায়ের গতি একটু শিথিল করামাত্রই পায়ের পেশি বরাবর বারি বসিয়ে দিয়ে দিলো শুদ্ধ। বারিটা জোরে দিয়েছে বলার অপেক্ষা রাখে না। তীব্র যন্ত্রণায় সে পা ধরে ‘ওমাগো’ বলে চিৎকার করে সেখানেই বসে পড়েছে। শুদ্ধ আরেক ঘা বসানোর আগেই সিতারা চৌধুরী দ্রুতবেগে চ্যালাকাঠ ধরে নিয়ে বললেন,
-‘ছেড়ে দে বাপ, কি করেছে মেয়েটা? এই টুকু বাচ্চা মেয়েকে চ্যালাকাঠ দিয়ে কেউ মারে? ম’রে যাবে তো মেয়েটা।’
-‘ যাক, ম’রে যাক। এইরকম বেয়াদব থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো।’
-‘কিন্তু কি করেছে সে, বলবি তো নাকি? সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ডাকাতের মতো রুদ্ররুপ ধরলি কেন, হ্যাঁ?’
একথা বলতে বলতে উনি ছেলেকে একটু দূরে সরাতে চাইলেন। কিন্তু শক্তপোক্ত দেহের পুরুষালি দেহটাকে একটা পাও নড়াতে পারলেন না। সে এখনো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শীতলের দিকে। এদিকে কাঁদতে কাঁদতে পেছন থেকে বড় মাকে জাপটে ধরেছে শীতল। মাত্র একটা বারি খেয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। চোখ, মুখ, লাল করে ভয়ে সিঁটিয়ে আছে বড় মার পেছনে। ফাঁটা বেগুনের মতো চুপসে গেছে একবুক সাহস। শুদ্ধ রাগে ফুঁসছে। আরেকটা বারি দেওয়ার জন্য হাত নিশপিশ করছে। কিন্তু সিতারা চৌধুরী হাত ধরে থাকায় পারছে না। তাকে কাঁদতে দেখে শুদ্ধ আরেকটা দেওয়ার জন্য মাকে সরাতে গেলে শীতল কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-‘আর করব না ভাইয়া। এবারের মতো মাফ করে দাও।’
-‘আর করবি কি না পরের হিসাব, এখন করলি কেন? বারণ করেছিলাম না? বলেছিলাম, চৌধুরী নিবাসের মেয়েরা এত সস্তা না। সস্তা মেন্টালিটি দেখাতে চাইলে বাসার বাইরে বেরিয়ে যেতে। বল বলেছিলাম?’
শুদ্ধর ধমকে কেঁপে উঠল শীতল। বড় মাকে ধরে পরপর মাথা নাড়াল। অর্থাৎ শুদ্ধ বারণ করেছিল। তাকে মাথা নাড়ানো দেখে শুদ্ধ মায়ের হাত
ছাড়িয়ে সাইড থেকে আরেক ঘা বসাল শীতলের পিঠে। তখন শারাফাত চৌধুরী কয়েক ধাপ এগিয়ে গুরুগম্ভীর সুরে বললেন,
-‘বাড়ির মেয়ের গায়ে হাত তোলা এ কেমন বিহেভিয়ার শুদ্ধ? এর আগে বারণ করেছিলাম না তোমাকে? মেয়েরা বড় হচ্ছে যখন তখন তাদের গায়ে হাত তুলবে না।’
-‘বাড়ির মেয়েটা যদি অবাধ্য হয় শুধু মার কেন প্রয়োজন গলায় ফাঁস দিয়ে সিলিংয়ে ঝুলিয়ে রাখব।’
বড় ভাইয়ের কথা৷ শুনে শখ আর স্বর্ণ গুটিয়ে গেল। ভয়ে একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। কারণ তারাও সদ্য প্রেমে মজেছে। একথা যদি শুদ্ধ জানে ওদের মেরে শুটকি করে রোদে শুকাতে দেবে। বেঁচে থাকলে অনেক প্রেম করা যাবে। ছেলের কথা শুনে শারাফাত চৌধুরী খুব বিরক্ত
হলেন। তাচ্ছিল্যের নজরে তাকিয়ে রইলেন। এই ছেলেকে কিছু বলা না বলা দুটোই সমান। মুখ তো নয় যেন ধারালো ব্লেড। যা বলবে কাট কাট উত্তর যেন প্রস্তুতই থাকে। তবুও তিনি দমে গেলেন না ছেলেকে শাসিয়ে বললেন,
-‘সে যতই অন্যায় করুন সেসব দেখার জন্য আমরা আছি। তুমি কেন মারবে?’
-‘কারো অপকর্ম যদি আমার সন্মানে সামান্য ছিঁড়ে ফোঁটাও দাগ লাগায় তাহলে আমি তাকে ছেড়ে দেবো না। সে হোক বাবা-মা কিংবা কাজিন।’
একথা বলে সে শীতলের দিকে তাকাল। ভয় পেয়ে শীতল সিঁটিয়ে গেল বড় মায়ের পেছনে। শুদ্ধ তখন অপর হাতে থাকা শীতলের মোবাইলটা স্বজোরে আছাড় মারল মেঝেতে। মোবাইলটা ভেঙে চূড়ে থান থান হয়ে ছিটিয়ে গেল চারদিকে। শখের মোবাইলের করুণ দশা দেখে শীতলের কান্নার গতি বাড়ল। কত কেঁদে কেটে ফোনটা কিনেছিল সে। অথচ এই বর্বর লোকটা ফোনের জান কবজ করে নিলো। তখন শারাফাত চৌধুরী
কিছু বলার আগে সাওয়ান চৌধুরী শুদ্ধকে জিজ্ঞাসা করলো,
-‘কি করেছে শীতল? মারছিস কেন বলবি তো নাকি?’
শুদ্ধ নিজের মুখে কিছু বলল না। বাধ্য হয়ে শীতলই ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলল,
-‘ট টিক টিকটিক করেছি।’
তাকে অর্ধেক কথা লুকাতে দেখে শুদ্ধ ভ্রুঁ বাঁকিযে তাকাতেই পুনরায় বলল,
-‘চারদিন হলো একটা প্রেমও করছি।’
একথা শুনে উপস্থিত সকলের বিষ্মিত নজর গিয়েপড়ল শীতলের দিকে। বলে কী এই মেয়ে? মাথা ঠিক আছে এর? তখন শুদ্ধ স্বর্ণ আর শখের দিকে তাকিয়ে কড়া কন্ঠে শুধাল,
-‘তোরা জানতি না?’
দু’বোন এবার ভয়ে গুটিয়ে গেল। ভয়ার্তের ছাপটা তাদের চেহারায় ফুটে উঠল। একথা তারা জানত। শীতলের পেট পাতলা যেটাই করুক তাদের বলে দেয়। তাদের মুখ দেখে শুদ্ধ যা বোঝার বুঝে গেল। এরা তিনজনেই এক ঘাটের মাঝি। এদের খবরও তার জানা আছে। একজন প্রেম করে টিউশন টিচারের সঙ্গে, আরেকজন ইউনিভার্সিটির একই ডিপার্টমেন্টের ছেলের সঙ্গে। এই দু’টোকেও একটা শিক্ষা না দিলে হবে না ভেবে ওদের দিকে তেড়ে গেলে সাওয়ান চৌধুরী থামালেন। তিনজনকে খুব বকলেন। মেজো বাবার বকা শুনে শখ, স্বর্ণ, শীতল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
অতঃপর এদিকের পরিস্থিতি সামলে নাস্তার পর্ব শেষ করে যে যার যার কর্মক্ষেতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। শারাফাত ও সাওয়ান চৌধুরী
উনাদের অফিসে চলে গেলেন। উনারা নিজস্ব আলাদা আলাদা ব্যবসা দেখাশোনা করেন। শাহাদত চৌধুরী আর্মি অফিসার। কিছুদিনের জন্য ছুটিতে এসেছেন। বর্তমানে আছেন চট্টগ্রামে।
শারাফাত চৌধুরী বাড়ির বড় কর্তা, উনার সহধর্মিণী সিতারা চৌধুরী এবং তার তিন সন্তান সায়ন, শুদ্ধ, শখ। সায়ন পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে রাজনীতি বেছে নিয়েছে। বলা যায় বড় মাপের রাজনীতিবিদ সে। শুদ্ধর পড়াশোনা চলমান এবং সে একজন গবেষক (researcher). সে ঢাকায় থাকে। সুযোগ বুঝে দু’চারদিনের জন্য বেড়াতে আসে। আর শখ অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্রী।
সাওয়ান চৌধুরী এই বাড়ির মেজো কর্তা। তার সহধর্মিণী সীরাত, তাদের জমজ ছেলে সৃজন ও সাম্য। তাদের বয়স বারো বছর। ওদের দু’জনের
চেহারা একই রকম। চট করে তাকিয়ে আলাদা করা মুশকিল। জন্মগত ভাবে তাদেন দু’জনের চোখেই সমস্যা বিধায় চশমা পরতে হয় দু’জনকে।
রোগ শোকও হয় একসাথে। সকালে একজনের জ্বর এলে দু’এক ঘন্টার মধ্যে আরেকজনের গা গরম হবেই মিস হওয়ার স্কোপ নেই।তাই একজন অসুস্থ হওয়া মাত্র সীরাত মানসিকভাবে প্রস্তুত নেয় আরেকজনের সেবা শুশ্রূষা করার। তবে তারা স্বভাবে হয়েছে উল্টো, একজন উত্তর মেরু তো আরেকজন দক্ষিণ মেরু।
শাহাদত চৌধুরী হচ্ছে এই বাড়ির ছোটো কর্তা। উনার সহধর্মিণী সিমিন, তাদের দুই মেয়ে, স্বর্ণ ও শীতল। স্বর্ণ অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী, শীতল সবে কলেজে পা দিয়েছে। শাহাদত চৌধুরী চাকরিস্থল চট্রগ্রাম, সেখানে থাকেন। স্ত্রীসহ মেয়েদুটোকে সবার সঙ্গে চৌধুরী নিবাসে থাকেন। তারা এই বাড়ি থেকে এক পা নড়তেও ইচ্ছুক নয়। ধরা বাঁধা নিয়মে নাকি খাপ খাওয়ানো তাদের পক্ষে নাকি সম্ভব নয়। একথা শুনে উনিও কিছু বলেন না। কারণ উনার অনুপস্থিততে স্বর্ণ বা শীতল কম আদর পায় না। বরং শারাফাত, সাফওয়ান চৌধুরীসহ বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্য একটু বেশিই ভালোবাসে তাদের। সিতারা, সীরাত, সিমিন তিন জা যত্ন করে আগলে রাখে পুরো চৌধুরী পরিবারটাকে। সব মানিয়ে নেয় নিজেদের মত করে।
তবে মজার ব্যপার এই চৌধুরী নিবাসের প্রতিটা সদস্যের নামের শুরু, স অথবা শ দিয়ে। যেটা সচারাচর কোথাও শোনা যায় না, দেখাও যায় না।
সায়ন রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে খেয়াল করে শীতল
কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার শাস্তি এখনো শেষ হয় নি। ড্রয়িংরুমে শুদ্ধ বসে তাই পালাতেও পারছে না। সে শীতলের দিকে তাকিয়ে খ্যাকখ্যাক করে হেসে বলল,
-‘আর ছেলে পেলি না? শেষে কি না ড্যান্ডিখোরের প্রেমে পড়লি?’
শীতল মুখ তুলে তাকাল। পায়ের ব্যথায় জান যায় যায় অবস্থা। সায়নকে হাসতে দেখে রাগ হলো খুব। কোথায় তাকে বাঁচিয়ে বড় ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করবে তা না করে দাঁড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। মীর জাফরের দল এক একটা। সময় তারও আসবে। সায়নের হাসি সহ্য হলো না তাই শীতলও খ্যাক করে বলল,
-‘কে ড্যান্ডিখোর? সে মোটেও ড্যান্ডিখোর না।’
একথা শুনে সায়ন হো হো করে হেসে ফেলল। তখন তাদের কথার মাঝে সীরাত অর্থাৎ শীতলের মেজো মা এসে উপস্থিত হলেন। উনি সায়নের উদ্দেশ্যে বললেন,
-‘ ড্যান্ডি কি রে বাপ?’
-‘ড্যান্ডি এক ধরনের আঠা। ড্যানড্রাইট অ্যাডহেসিভ নামের আঠাকে ছোট করে ড্যান্ডি বলে। ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, ডিভাইস, চামড়া এবং প্লাস্টিকের পণ্য জোড়া লাগানোর কাজে ব্যবহৃত হয় ড্যান্ডি। এটা এখন নেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে অনেকে।’
সায়নের কথা চোখ সীরাতের চোখ কপালে উঠে গেল। উনি আঁতকে উঠে বললেন,
-‘হ্যাঁ রে শীতল শেষে কি না আঠাখোরকে পছন্দ হলো তোর? ব্রেকআপ করে ফেল মা। আঠাখোর জামাই চাই না আমাদের। আঠা দিয়ে জামাই আপ্যায়ন করে কিভাবে তাও তো জানি না।’
মেজো মায়ের কথা শুনে সায়নের হাসি বেড়ে গেল। সে হাসতে হাসতে বলল,
-‘ কেন মেজো মা, আঠার দিয়ে সব আইটেম বানাবে। আঠার পোলাও, আঠার কোর্মা, আঠার রোস্ট, আঠার কালা ভুনা। আমাদের শীতলের ইউনিক জামাই বলে কথা, তাকে ইউনিক অ্যাপায়ন না করলে চলে?
একথা বলে সায়ন আবারও হাসতে লাগল। খাবারের আইটেমের নাম শুনে সীরাত মুখ কুঁচকে নিলেন। আর শীতল বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে রইল। বড় ভাইগুলোর কাজই হলো ছোটো বোনদের বফের ভুল ধরা। কি যে মজা পায় কে জানে! তবে বাড়ির সবাই জেনে গেছে দেখে সেও ভেবে নিলো আজই ব্রেকআপ করে নেবে। নয়তো শুদ্ধ ভাই চ্যালাকাঠ ভাঙবে তার পিঠের উপরে।
চলবে…