শেষ থেকে শুরু পর্ব-০১

0
2703

#শেষ_থেকে_শুরু
#সূচনা_পর্ব
লেখিকা #Sabihatul_sabha

আজ পাঁচ বছর পর বাড়িতে পা রাখতেই পায়ের কাছে কাউকে মুখ থুবড়ে পড়তে দেখে থমকে গেলো অভ্র। সাথে সাথে দুই পা পিছিয়ে গেলো।

” এই মেয়েকে না বলেছি আমার সামনে না আসতে!ওকে আমার সহ্য হয় না, ও কি চায়.? আমিও আমার ছেলের সাথে ম’রে যাই,বেঁচে আছি ভালো লাগছে না ওর.? আমার ছেলেকে খেয়ে,শেষ করে ও শান্তি হয়নি.? ওর মতো অলক্ষ্যি, অপয়া মেয়ে জেনো এই বাড়িতে পা না রাখে কখনো, বিয়ে হতে না হতেই আমার ছেলেটা কে মে*রে ফেললো! ওর জন্য হয়েছে সব! শুধু ওর জন্য! ”
ভেতর থেকে চিৎকার করে বলে উঠলেন এক ভদ্রমহিলা।

বাড়ির সবাই দৌড়ে বাহিরে আসলো।
অভ্র এখনো থমথমে চোখে মুখে তাকিয়ে আছে পায়ের দিকে, ধবধবে সাদা শাড়ি গায়ে জড়ানো,চুল গুলো এলোমেলো, গাল, মাথা,থুতনি থেকে তরল তাজা র*ক্ত গড়িয়ে পরছে। দেখেই মনে হচ্ছে কেউ প্রচুর মেরেছে।

বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসলো মেঝো বউ শায়লা সিদ্দিকী। দরজার সামনে অভ্র কে দেখেই উনার পা থমকে গেলো। উনি কি ভুল দেখছেন.? অভ্র এখানে কিভাবে.? তাও এত বছর পর!
শায়লা সিদ্দিকী ভুলেই গেলেন কেনো দৌড়ে এসে ছিলেন।

অভ্র আস্তে করে হাঁটু গেড়ে মেয়েটার সামনে বসলো।
ঝাপসা চোখে মেয়েটা মাথা তুলে আশেপাশে তাকানোর চেষ্টা করলো অথচ শরীর এতটাই দূর্বল ছিল যে চারপাশে অন্ধকার হয়ে আসলো সামনে ঝাপসা কারো অবয়ন দেখেই জ্ঞান হারালো।

শায়লা সিদ্দিকীর হুঁশ ফিরলো, উনি দৌড়ে মেয়েটার কাছে এসে বললেন ” জবা! এই জবা!.. জবা ”
অভ্র শায়লা সিদ্দিকীর দিকে তাকিয়ে বললো,’ মেঝো মা এই মেয়ে কে??”
শায়লা সিদ্দিকী অভ্রর গালে হাত রেখে বললো,’ অভ্র বাবা তুই এখানে.? কখন আসলি.? আর কাউকে কিছু বলে কেন আসিসনি.?’

আস্তে আস্তে বাড়ির ছোট বউ, দাদী মা, বের হয়ে আসলো পেছন পেছন বাড়ির কাজের লোকগুলো ও উঁকি দিলো। ভয়ে কারো সাহস হলো না সামনে আসার।

সবাই জেনো অভ্র কে দেখেই ব্যাস্ত হয়ে পরলো। ছোট বউ শার্লিন দৌড়ে গিয়ে খবর দিলো ‘ বড় দিদি আমাদের অভ্র এসেছে গো”

এই বাড়ির বড় বউ কুলসুম বেগম যার দুই ছেলে। এক ছেলে আসিফ মাহমুদ, দ্বিতীয় ছেলে অভ্র চৌধুরী।
অভ্র এসেছে শুনেই উনি রুম থেকে বের হয়ে সিঁড়িতে এসে থেমে গেলেন।
অভ্রের কোলে সাদা শাড়ি পরিহিত নারী দেখে বুঝতে বাকি নেই কে এটা।
অভ্র সোফায় ওকে রেখে মেঝো মায়ের দিকে তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো এই মেয়ে কে মেঝো আম্মু..?
শায়লা সিদ্দিকী ছলছল চোখ মুছে অভ্রের দিকে তাকিয়ে বললো,’ তোর বড় ভাইয়ের বউ জবা।’
অভ্র আরও একবার অবাক হলো, ভাই কখন, কবে বিয়ে করলো!?? মাথায় হাজার প্রশ্ন ঘুরপাক খেলো,জবার দিকে তাকিয়ে বললো,’ র*ক্ত জবা!’

___________

বাড়ির ছোট ছেলে বাড়ি ফিরেছে এই আনন্দে দাদিজান বিশাল আয়োজন করলেন। আজ একমাস এই বাড়িটা প্রায় মৃত হয়ে পড়েছে, মৃত হয়ে পড়েছে বাড়ির প্রতিটা সদস্য।
অভ্র ফ্রেশ হয়ে ওর মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে।
বাড়ির ছোট বউ শার্লিন শাড়ির আঁচল ঘুরাতে ঘুরাতে কুলসুম বেগমের ঘরে উঁকি দিয়ে বললো,’ বড়দিদি অভ্র বাবা আর তোমাকে শাশুড়ী আম্মা নিচে ডাকছে।’
কুলসুম বেগম অভ্রর দিকে তাকিয়ে বললো,’ তুই যা আমরা আসছি!’

(শার্লিন বাড়ির ছোট বউ,উনার স্বামী পুলিশ অফিসার সন্তান বলতে এক মেয়ে বেলী। বেলী এইবার কলেজে পড়ে। মা মেয়ে এক সাথে দাঁড়ালে লোকে কনফিউশানে পরে যাবে এরা সমবয়সী বোন নাকি মা মেয়ে! অবশ্য সবাই বলে তাদের দেখতে বোন মনে হয়, শার্লিনর বয়স তেমন বেশি না গরিব ঘরের মেয়ে হওয়ায় অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে, দেখতেও অনেক সুন্দরী। তবে উনার একটা গুণ হলো উনি এখানের প্যাচ ওখানে লাগাতে বেশ ভালো পারেন, এক জনের সাথে অন্য জনের ঝগড়া লাগিয়ে বসে বসে মজা দেখাই উনার প্রতিদিনের কাজ )

অভ্র বাড়িতে আশার পর থেকে খেয়াল করছে বাড়িটা খুব শান্ত সৃষ্ট হয়ে গেছে কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই। বাড়ির বাকি লোক কোথায়.?

________

অভ্র নিচে এসে এত খাবার দেখে অবাক হয়ে বললো, ‘ এতকিছুর কি প্রয়োজন ছিল সুইটহার্ট.? ‘
অভ্রর দাদিজান ওর গালে হাত রেখে বলে উঠলো , ‘ আমাদের চোখের মনি ফিরে এসেছে তার জন্য এতটুকু করবো না!’
অভ্র মুচকি হেঁসে বলে উঠলো, ‘ বাকি সবাই কোথায়.? কাউকে দেখছি না।’
বাড়ির মেঝো বউ শায়লা সিদ্দিকী অভ্রর প্লেটে খাবার বেড়ে দিয়ে বললো,’ আয়ান ত নিজের অফিসে আর বেলী কলেজে একটু পর চলে আসবে।’
অভ্র খাবারের প্লেটে হাত বুলিয়ে বলে উঠলো,, ‘ আর আসিফ ভাইয়া.?’
সাথে সাথে সবার মুখ বন্ধ হয়ে গেলো। মনে হলো আমাবস্যা নেমে এসেছে।
অভ্র~ কি হলো.?
কুলসুম বেগম সোফায় বসে বলে উঠলো, ‘ আগে খাবার শেষ করো তারপর না হয় উত্তর দিচ্ছি। ‘

অভ্র একবার জবার কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে গেলো। তারপর আবার শায়লা সিদ্দিকীর দিকে তাকিয়ে বললো,’ মেঝো মা ওই মেয়েটাকে যেভাবে মেডিসিন আর মলম লাগিয়ে দিতে বলে ছিলাম দিয়ে ছিলে.?’

শায়লা সিদ্দিকী একবার কুলসুম বেগমের দিয়ে তাকিয়ে আরেকবার অভ্রর দিকে তাকালো।
অভ্র উত্তরের জন্য তাকিয়ে আছে।
শায়লা সিদ্দিকী আস্তে করে বললো,’ হুম ‘
যদিও এটা মিথ্যা কথা। কুলসুম বেগম কাউকে জবার রুমে ঢুলতে দেয়নি, ও যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে মা*রা যাক যেভাবে একজন মায়ের বুক থেকে ছেলেকে কেড়ে নিয়েছে।

____________

অভ্র খাবার শেষ করে মায়ের সামনে বসে আছে। অভ্রর দাদিজান ওর পাশে, শায়লা সিদ্দিকী সবকিছু গুছিয়ে এসে বসলো, শার্লিন বিনুনি ঘুরাচ্ছে।

কুলসুম বেগম ছেলের হাত নিজের হাতে নিয়ে বলে উঠলো, ‘ আজ তিন মাস তুমি বাড়িতে একটা কল দাওনি। মনে আছে লাস্ট কবে কল দিয়ে ছিলে.?

অভ্র মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,’ আম্মু তুমি ত জানো,শুধু তুমি কেন বাড়ির সবাই জানে আমি কেন কল দেইনি, আমার ডাক্তারির লাস্ট কোর্স ছিল তিন মাস, আর এই তিনমাস আমার সবকিছু থেকে দূরে থাকতে হয়েছে, মোবাইল টোটালি বন্ধ ছিল।’

কুলসুম বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো,’ জানি, দুইমাস আগে তোমার বড় ভাই আসিফ কোনো এক কাজে আমাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ছিল আর ফিরে এসেছিল সাথে বউ নিয়ে। ‘

অভ্র অবাকের উপর আজ অবাক হচ্ছে, আসিফ ত মায়ের বাধ্য ছেলে ছিল, মা যা বলতো তাই। মায়ের কথা ছাড়া কখনো কিছু করতো না এমন কি হয়ে ছিল যে মাকে না বলে বউ নিয়ে এসে ছিল.?’

হঠাৎ কুলসুম বেগম উত্তেজিত হয়ে গেলেন, এলোমেলো কথায় বলে উঠলেন এই মেয়ে, এই মেয়ে আমার ছেলেকে শেষ করে ফেলেছে অভ্র, আমার আসিফ কে শেষ করে ফেলেছে, ও খু*নি ওর জন্য শুধু মাত্র ওর মতো অলক্ষ্যীর জন্য আজ আমার ছেলে আমাদের ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে আমরা ওর লা*শটাও পাইনি। তোমার বাবা মা*রা যাওয়ার পর আমি নিজ হাতে তোমাদের লালন-পালন করে বড় করেছি, কখনো কষ্ট বুঝতে দেইনি আজ একটা মেয়ে আমার সবকিছু, আমার ছেলেকে শেষ করে দিল! আমি মেনে নিতে পারছি না অভ্র, আমার আসিফ কে এনে দাও অভ্র, ওকে বলো এনে দিতে…
কুলসুম বেগম কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। শায়লা সিদ্দিকী আর শার্লিন উনাকে রুমে নিয়ে গেলেন অভ্র মায়ের কন্ডিশন দেখে কি বলবে, ভুলে গেলো সে নিজেও একজন হার্ট ডাক্তার, বলা যায় শহরের সবচেয়ে বড় ডাক্তারদের মধ্যে অভ্র ফাস্ট পজিশনে আছে। কি রিয়েক্ট করবে ভুলে গেছে। আজ তিন মাসে এতকিছু হয়ে গেলো.? ওর ভাই আর নেই মানে.? লা*শ খুঁজে পায়নি!
অভ্র চুল গুলো টেনে ধরে সোফায় বসে রইলো দাদিজান বলতে শুরু করলো আসলে কি হয়ে ছিল।

( আজ থেকে দুইমাস আগে হঠাৎ আসিফ একটা মেয়েকে নিয়ে এসে বললো এটা ওর বউ। আসিফের বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল কুলসুমের, এমন বাধ্য ছেলের অবাধ্য কাজ উনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। কিছুতেই এই মেয়ে উনি মেনে নিবেন না। কতভাবে জিজ্ঞেস করা হলো আসিফ কে এই মেয়ে কে.? বাড়ি কোথায়.? কোন বংশের.? সব সময় আসিফের একটাই উত্তর ছিল ” ওর পরিচয়, বংশ এখন সবকিছু আমি ” এই মেয়েকেও জিজ্ঞেস করে কিছু বের করা যায়নি। কুলসুম পছন্দ করতো না বলে সারাদিন রুমে বন্দি হয়ে থাকে কারো সাথে কথা বলে না। একমাস এভাবে গেলো আস্তে আস্তে সবার সন্দেহ বাড়তে শুরু করলো কোনো না কোনো ত কাহিনী এর আড়ালে লুকিয়ে আছে, কিন্তু সেটা কি.? তোর মেঝো মায়ের ছেলে আয়ান ত পুলিশ, আয়ান কে বলা হলো গ্রামে ভালো করে খুঁজ নিতে, আয়ান খুঁজ নিয়ে ছিল তবে কিছুই পায়নি, এতটুকু বুঝে ছিল এই মেয়ে গ্রামের কেউ না তাহলে কোথায় থেকে আসলো.? একদিন সকালে আসিফ অফিসের উদ্দেশ্য বেড়িয়ে গেলো, যাওয়ার আগে জবার কপালে চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরে ছিল তারপর! তারপর আর ফেরা হয়নি ওর ঘরে। মাঝ রাস্তায় গাড়ি এক্সিডেন্ট হয় পাহাড় থেকে নিচে পরে অনেক খুজেও ওর লাশ পাওয়া যায়নি। এই মৃত্যুর জন্য কুলসুম জবা কে দোষী করে ওর মনে হয় জবার জন্য আজ আসিফ নেই । আজ সকালেও কুলসুম উত্তেজিত হয়ে জবাকে মে’রেছে মেয়েটা প্রতিদিন কুলসুমের হাতে এত এত মার খেয়েও টু শব্দ করে না, ও কান্নাও করে না কেমন পাথরের মতো শুধু তাকিয়ে থাকে।.. আসিফের মৃত্যুর কথা শুনেও এমন পাথরের মতো হয়ে ছিল)

দাদিজানের মুখে সবকিছু শুনে অভ্রর চোখ জ্বালা করছে। চোখের সামনে আসিফের সাথে কাটানো হাজারো স্মৃতি ভেসে উঠছে। সে আর এক মিনিট ও বসে না থেকে নিজের রুমে চলে গেলো। শব্দ করে লাগিয়ে দিল দরজা।

__________

অন্ধকার এক রুমে জ্বরে কাতরাচ্ছে জবা, ফর্সা মুখটা কেমন কালচে হয়ে গেছে, চুলগুলো মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, কুলসুম বেগমের আদেশ ওর রুমে জেনো কেউ প্রবেশ না করে।
কুলসুম বেগম বাড়ির বড় বউ হওয়ায় সবাই উনাকে অনেক মানেন, ভয়ও পান। ভীষণ রাগী মহিলা। পুরো বাড়িটাকে আগলে রেখেছেন, ঘর সামলে এত বড় চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রি ও উনি সামলান।

পা টিপে টিপে কেউ একজন আশেপাশে তাকিয়ে জবার রুমে প্রবেশ করে ভেতর দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো।

জবা অনেক কষ্টে চোখ খুলে বলে উঠলো, ‘ কে এখানে.? ‘

চলবে,