শ্যামাবতী প্রেয়সী পর্ব-১০

0
19

#শ্যামাবতী_প্রেয়সী
#পর্ব ১০
#জেসমিন_জেমি

রাত বাড়লো ঘড়ির কাঁটা গিয়ে থামলো ১ টায়। পুরো শহরের মানুষ এখন ঘুমিয়ে, কিন্তু রাত এখনো জেগে । পুরো পৃথিবী নিস্তবতায় ঘেরা। প্রতিটি রাত জানে, এই নিস্তব্ধতার আড়ালে কত না বলা কথা, হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন আর একাকীত্বের দীর্ঘশ্বাস মিশে আছে।
জানালা খোলা থাকায় হালকা শীতল হাওয়া রুমে ঢুকলো, বাসা থেকে দূরে একটা কুকুর একবার ডেকে উঠে থেমে গেলো। এহতিশাম উঠে গিয়ে জানালা আটকে দিলো ফিরে এসে ঘুমন্ত পরীর হাত শক্ত করে মুঠোয় পুরে ধরলো যেনো ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে, অদৃশ্য হয়ে যাবে যেমন প্রতিটি স্বপ্নে পরী হাসি মুখে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতো অদৃশ্য হয়ে যেতো। এহতিশাম গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পরীর মুখশ্রী পানে, এই সেই মায়াবী যে বাংলাদেশে থেকে সূদূর কানাডার এক সুদর্শন যুবকের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলো। এই সেই প্রেয়সী যাকে দেখার জন্য এহতিশাম ছটফট করতো, নির্ঘুম কাটাতো এই নিস্তব্ধতায় ঘেরা রাতগুলো । আচ্ছা এই মেয়েটা কি একটুও জানতো ? উহু জানতো না, জানলে এই মেয়ে এভাবে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারতো?
এহতিশাম পরীর কপালে ঠোট ছোঁয়ালো। ঘুমন্ত পরীর মুখের কাছে ফিসফিস করে বললো,

প্রান,
তুমি সম্পূর্ণ আমার,
এহতিশামের বিছানার অর্ধেক জুড়ে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত মানুষটা এখন এহতিশামের।

এই কথাটা এহতিশাম কতবার বলেছে আজ কে জানে। যতবারই বলুক তবে তা পরীর কর্ণকুহর হয়েছে বলে মনে হয় না। পরী হয়তো ঘুমের ঘোরে নিজের ভীষণ কাছে কারো উপস্থিতি টের পেলো নড়েচড়ে উঠতেই এহতিশাম পরীর ঠিক পাঁশে শুয়ে পড়লো। ছোট খাটো দেহের পরীকে টেনে নিলো নিজের প্রশস্ত বুকে পরীও উষ্ণতা পেয়ে ঘুমের ঘোরে গুটিশুঁটি হয়ে পরে রইলো। এহতিশাম হাসলো ধীরকন্ঠে বললো,
আমার ঘুম কেড়ে নিজে ঠিকই শান্তিতে ঘুমিয়েছো! দিস ইস নট ফেয়ার প্রাণ?

পরী কি এসব শুনলো? এই মেয়ের এতো ঘুমাতে কেনো হয়? ঘুমালে এই মেয়ের চারপাঁশে কি হচ্ছে কিছু জানে না কিছু না।

এহতিশাম পরীকে জড়িয়ে দুচোখ বুঝলো। আজ হয়তো ও ঘুমাবে এক শান্তির ঘুম প্রেয়সীকে বুকে জড়িয়ে ধীরকন্ঠে বললো,
দুটো বছর জ্বালিয়েছো আমায়, তোমাকে কি শান্তিতে ঘুমাতে দেওয়া উচিত?

পরীর বদঅভ্যাস আছে ও সারা বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমায়। আর ঘুমের মাঝে নড়াচড়া না করলে ও বোধহয় ঘুমাতেই পারে না। পরী এহতিশামকে ছেড়ে অন্যপাঁশ ফিরতে নিলেই এহতিশাম শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো পরী হয়তো বিরক্ত হলো ঘুমের মাঝে নাক মুখ কপাল কুঁচকালো ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু হয়তো বলল। এহতিশাম বাঁকা হাসলো বললো,
আজ থেকে ছোটাছুটি শেষ ।
এভাবেই, ঠিক এভাবেই আমার বাহুডোরে ঘুমাতে হবে আপনাকে মিসেস এহতিশাম আঁয়াশ। আর এটাই আপনার শাস্তি।

এহতিশাম চোখ বুঝলো। হুট করেই মনে পড়লো দু বছর আগের কথা। দুটো বছর এক অদ্ভুত মায়ায় জড়িয়ে ছিল এহতিশাম। এক অতি সুদর্শন যুবক যার আঁশেপাঁশে অতি সুন্দরীদের আনাগোনা। সেই সুদর্শন যুবক কিনা হুট করে এক শ্যামবর্ণ মেয়ের মায়ায় জড়ালো তাও কিনা মেয়েটার একটা মাত্র ছবি দেখে। এটাও সম্ভব? এহতিশাম ভীষণ অবাক হয়েছিলো। ছবিতে মেয়েটার পড়নে ছিলো নীল রংয়ের শাড়ী, চুলগুলো খোঁপা করা চুলে গোঁজা ছিলো বেলীফুলের গাজরা। চোখ জোড়ায় ছিলো গাঢ় কাজল মেয়েটার হাস্যজ্জ্বল মুখ কপাল কুঁচকে কয়েক পলক দেখেছিলো এহতিশাম। তারপর? তারপর হঠাৎ করে কি হলো এহতিশামের? হুটহাট মেয়েটার হাস্যজ্জ্বল মুখটা ভেসে উঠতো চোখের সামনে। সারাক্ষণ কাজে ডুবে থাকা এহতিশামের কাজে মন বসতো না। মাঝে মাঝে বিরক্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে যেতো।
যখন ঠিক করলো মেয়েটাকে আর মনে করবে না। ঠিক তখনি কি হলো কনফারেন্স মিটিং শেষ করে এলোমেলো চুলে, হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে মেহতাবের ল্যাবটব নিয়ে বসলো। অনলাইনে এসে দেখলো মেয়েটা অনলাইনে এহতিশাম হুট করে কল দিয়ে বসলো। এতো আগ্রহ অন্য কোনো মেয়ের ক্ষেত্রে কাজ করেনি এহতিশামের কখনো না। মেয়েটা কল রিসিভ করার আগেই এহতিশাম ক্যামেরা অফ করে দিলো। অপাঁশ থেকে অন্ধকার দেখালেও এপাঁশের স্ক্রিনে ভেসে উঠলো এক শ্যামবর্ণের মিষ্টি চেহেরা। মেয়েটার এলেমেলো চুল, গায়ের উড়না ঘুরিয়ে পেছিয়ে কোমড়ে বাঁধা । অপাঁশে অন্ধকার দেখে মেয়েটা ঠোঁট নাড়িয়ে বললো,
মেহতাব ভাই আপনাকে দেখা যাচ্ছে না।

এহতিশাম ঠোঁট কামড়ে হাসলো। মেয়েটা আবারও বললো,
মেহতাব ভাই কিছু বলছেন না কেনো?

এহতিশাম বাঁকা হাসলো। পরপর নিজেই খুব অবাক হলো সে কি বাচ্চামি করছে? এগুলো তো বাচ্চাদের মতো আচরণ। তবে কি এহতিশাম আয়াশ,,,,

পরী সেদিন পুরো বাড়ী পরিষ্কার করছিলো ক্লান্তিতে মেয়েটা চট করে রেগে গেলো। রাগীস্বরে বিরবির করে বললো ,
ধ্যাত এই মোবাইলটাও না শুধু নেট প্রবলেম।

পরপর স্ক্রিনে তাকিয়ে বললো,
মেহতাব ভাই আরেকবার কল করবেন কলটা কেটে?

এহতিশাম কল কাটলো তবে আর কল করলো না। সোফায় গা এলিয়ে দিলো। বাম হাতে টা-ই ঢিলে করে বিরবির করে আওড়ালো,
– এতো এতো দূরত্ব! অথচ মুহুর্তেই এহতিশাম আঁয়াশকে উন্মাদ করে তুলছো ।
কে তুমি? সাধারণ এক মেয়ে! এতো অসাধরন ক্ষমতা তোমাকে কে দিলো ? এতো সাহসই বা কোথায় পেলে? আমি তো দেয়নি?

কিছুদিন যেতেই এহতিশাম বুঝলো। সে আসলে মায়ায় জড়িয়েছে। এক শ্যামবর্ণের মেয়ের মায়ায় কুব বাজে ভাবে জড়িয়ে পড়েছে। আসলে মায়া অদ্ভুত জিনিস। কখন, কোথায়, কিভাবে কার মায়ায় কে জড়াবে সেটা কেউ বলতে পারবে না কেউ না।

———–
ভোরের নিস্তব্ধতা ভেঙে সবার আগে সাড়া দেয় ভোরের পাখিরা। জানালার গ্রিলে বসে থাকা চড়ুই। বাতাসে মিঁশে থাকা মাটির সোঁদা গন্ধ এক নতুন দিনের সতেজ বার্তা নিয়ে আসে । প্রতিদিনের মতো সূর্য একটু একটু করে আঁকাশে উঠে আসে, তার ঝলমলে আলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয় শহরের প্রতিটি কোণায় কোণায় । রাতের অন্ধকার পুরোপুরি মিলিয়ে যায় সূর্যের চকচকে আলোয়। ভোরের মিষ্টি রোদ গায়ে মেখেই পুরো শহর আবারও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে, আবারো এক নতুন গল্প শুরু হয়। সকাল মানেই এক নতুন শুরু, নতুন স্বপ্ন, আর নতুন আশার রোদ্দুর!

পাখির কিচিরমিচির শব্দে পরীর ঘুম ছুটে গেলো। নড়তে গিয়ে বুঝলো সে কারো শক্তপোক্ত বাহুবন্ধনে আবদ্ধ। পিটপিট করে চোখ মেলতেই চোখের সামনে ফুটে উঠলো এক ফর্সা উন্মুক্ত লোমশহীন বুক। পরীর চোখ বড় বড় তাকালো। মানুষটা আর কেউ নয় এটা যে সাদা বিলাই সেটা বুঝতে ২সেকেন্ডও লাগলো না পরীর। পরপর মাথা উচু করে তাকাতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো ধবধবে ফর্সা মুখশ্রী। পরীর ঘুম ছুটে গেলো চোখ পিটপিট করে দেখলো পাঁশে থাকা মানুষটাকে এলেমেলো অবাধ্য চুল গুলো কপালের দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পরী মাথা নড়াতেই খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি গুলো পরীর কপালে লাগলো। পরী ভ্রু কুঁচকালো। চোখ মুখ কুঁচকে দাঁড়ির দিকে তাকালো। বিরবির করে বললো,
বাত্তামিজ !

পরপর বললো দাঁড়ি আবার বাত্তামিজ ও হয়?
এহতিশাম নড়তেই পরী তড়িঘড়ি করে সরে যেতে নিলো কিন্তু বাঁধ সাঁধলো এহতিশাম। পরীর পেটের উপর দিয়ে নিজের হাত রাখলো । পরী সরতে পারলো না। এহতিশাম ঘুমঘুম কন্ঠে বললো,
– ডোন্ট ডিস্টার্ব।

পরী চুপটি করে পরে রইলো। এহতিশাম পরীকে নিজের দিকে টেনে নিতেই লজ্জায় পরীর গাল মুখ লাল নীল হয়ে উঠলো। এই লোকটা ঘুমের ঘোরে করছে কি? পরী আর নড়লো না পাথর হয়ে শুয়ে রইলো। চোখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বাহির থেকে আসা আলোয় রুমে দেখলো। মনে মনে আওড়ালো,
এটা কোথায়? কোথায় নিয়ে এসেছে সাদা বিলাই ?

পরী নিজমনে আরো অদ্ভুদ অদ্ভুদ অবান্তর কথা ভাবলো,
আল্লাহ জানে লোকটা তাকে কোথায় নিয়ে এসেছে। পরী তো রাস্তা ঘাট দেখে আসে নি চিনেও না। জায়গার নাম ও জানে না। যদি লোকটা ওকে মে*রে ফেলতে চায় ? যদি এখানে ফেলে রেখে পালায়? পরী তো কিছুই চিনে কি করবে? কার কাছে যাবে? ফোন পরীর ফোন কোথায়? শিট সে রাতে কেনো ঘুমিয়েছিলো কে জানে। ঘুমানোর কথা মনে পড়তেই পরী তড়িৎগতিতে চোখ মেলে তাকালো,
সে তো গাড়ীতে ঘুমিয়েছিলো এখানে কিভাবে এলো? কই সে তো নিজে আসে নি? লোকটা তাকে ডাকে নি কেনো? লোকটার কোনো বাজে মতলব নেই তো? পরী সাবধানে থাক, সাবধানের মা*র নেই বুঝলি?

চলবে,,,,,,

(ভুলক্রুটি মার্জনীয়)