শ্যামারণ্য পর্ব-২৮+২৯+৩০

0
707

#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ২৮
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন

শ্যামা চোখ খিঁচে বন্ধ করেই রইলো অরণ্যের কথামতো,একটু আগের কথাগুলো ভেবে এখনো বুক কাঁপছে তার। তারপর ভেসে আসে মানুষের গগনবিদারী চিৎকার,বাঁচার আর্ত’নাদ,বাতাস ভারী হতে থাকে র’ক্তের ধাতব গন্ধে। শ্যামার থেকে থেকে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে এমন করুণ আর্ত’চিৎকার শুনে,আবার তার ভেতরের ক্ষত-বিক্ষত নারী স্বত্ত্বা দারুণ পুলকিত হয় তাদের বাঁচার আঁকুতি শুনে।
একটু আগে তার অসহায়ত্ব,বাঁচার আঁকুতির উপর হাসছিলো,তার আতঙ্ককে উপহাস করছিলো।
এখন বুঝেছো মৃ’ত্যুভয় কি জিনিস?
না জানি কতো শত মানুষকে তোমরা এই চরম আতঙ্ক দিয়েই ইহকালের সমাপ্তি ঘটিয়েছো। তোমাদের মৃ’ত্যুটাও এভাবেই হওয়া উচিত।

এক সময় থেমে যায় সব শোরগোল। আর এক জোড়া পুরুষালী হাতের বেষ্টনী পরম ভালোবেসে বুকে আগলে নেয় তাকে। এই হাতের বেষ্টনী,এই বুকের হৃদস্পন্দন,তার শরীরের সুবাস,আর তার ভালোবাসাময় স্পর্শ,এই সবকিছু তার অতি পরিচিত। চোখ বন্ধ থাকলেও বুঝতে পারে সে,তার প্রিয় মানুষটার কাছে অবশেষে ফিরতে পেরেছে সে।

শ্যামা অরণ্যকে দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। দুনিয়ার সকলের সামনে দাম্ভিক,সাহসী,শক্ত হওয়ার মুখোশ পড়ে ঘুরে বেড়াতে পারলেও,পারেনা শুধু এই মানুষটার কাছে। এই মানুষটা তাকে চরমভাবে প্রভাবিত করে,তার মনের সকল দুর্বলতা এই মানুষটার সামনে প্রকাশ করতে একটুও বাধেনা।

শ্যামা ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলে,
“অনেক ভয় পেয়েছিলাম আমি,মনে হয়েছিলো আর কখনো আপনাকে দেখতে পাবোনা। ম’রার আগে আপনাকে শেষ দেখাটাও দেখতে পাবোনা।”

অরণ্যের হাতের বাঁধন আরও দৃঢ় হয়,ওকে হারানোর কল্পনাটাও তার বুঁক কাঁপিয়ে দেয় যেনো,
“এমন কথা বলোনা আর শ্যামা। এই দেখো আমি তোমার সামনে আছি এখন,আর তুমি আমার বুকে। এবার কোনো বিপদ তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবেনা।”

বলেই শ্যামার কপালে,চোখে,গালে চুমুতে ভরিয়ে দেয় অরণ্য। শ্যামা চোখ বন্ধ করে অনুভব করে সবটা।
শ্যামার গালে ফুটে উঠা আ’ঘা’তের চিহ্ন গুলো দেখে বুঁকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে অরণ্য। সে একদৃষ্টিতে তার গালে আলতো হাত রেখে আঙ্গুল বোলাতে থাকে সেই লাল দাগগুলোর উপর।
অরণ্যকে হঠাৎ চুপ হয়ে যেতে দেখে শ্যামা চোখ খুলে তাকায় তার দিকে। এক জোড়া বেদনাকাতর মায়াবী চোখের সাথে দেখা হয়ে যায় তার যেগুলো একধ্যানে তার প্রাপ্ত আঘাতগুলো পর্যবেক্ষণ করে চলেছে।
এতোকিছুর মাঝেও তার ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে,মনের সব আতঙ্ক মুহুর্তেই মিলিয়ে যায় যেনো।

শ্যামা অরণ্যের গলা জড়িয়ে ধরে পায়ের আঙ্গুলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে অরণ্যের চোখ দুটোতে আলতো চুমু খেয়ে বললো,
“একটুও ব্যথা করছেনা জানেন?একটু আগে আদর দিলেন,তখন সব ব্যথা পালিয়েছে। আপনার চুমুতেও কি শক্তি গো অরণ্য”

অরণ্য শ্যামার হাসিমুখ দেখে আর তার আহ্লাদী কথাবার্তা শুনে নিজেও হেসে ফেলে,
“কোথায় আমি তোমাকে শান্তনা দিবো,তুমি উল্টো আমাকে শান্তনা দিচ্ছো?আর তোমাকে চোখ খুলতে বলেছে কে?আমার অবাধ্য হতেই হবে এমন কোনো পণ করেছো তুমি?”

“একটু দেখি না আপনাকে,আমিতো আর আশেপাশে তাকাচ্ছিনা। যদিও আমি না তাকালেও ঠিক জানি কি অবস্থা করেছেন আপনি ওদের,কান দিয়ে সব শুনেছি আমি।”

অরণ্য বাঁকা হেসে বলে,”ওদের ভাগ্য ভালো,তুমি আছো এখানে। তুমি ভয় পাবে বলে কিছুই করতে পারলাম না। নয়তো তোমার চোখ থেকে গড়ানো একেকটা অশ্রুর হিসাব নিতাম আমি।”

“এখন কিন্তু আপনাকে দেখে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে আমার।”

“ভালো,আমাকে একটু ভয় পাওয়া শিখো। তাহলে অন্তত আমার অবাধ্য হবেনা। এখন ফিরে যাওয়া যাক তবে।”

“নাহহ!”

হঠাৎ শ্যামার এমন চেঁচিয়ে উঠায় তব্দা খেয়ে যায় অরণ্য,প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেই শ্যামা বলে উঠে,
“আমার ব্যাগটা! ওটা খুঁজে বের করুন,মায়ের বালাগুলো আছে ওখানে!”

অরণ্য কিছু একটা বোঝার ভঙ্গিতে সম্মতি জানিয়ে বলে,”ঠিক আছে,আমি খুঁজে আনছি,তুমি এখানেই চোখ বন্ধ করে দাঁড়াও। খবরদার চোখ খুলবেনা!”

শ্যামা মাথা দুলিয়ে সায় জানিয়ে ভালো মেয়ের মতো চোখ বন্ধ করে নেয়। অরণ্য তা দেখে হেসে ফেলে,তার কপালে টুক করে একটা চুমু খেয়ে চলে যায় ব্যাগ আনতে। শ্যামা চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকে।

কিছুক্ষণ এভাবে অপেক্ষা করতে করতে মনের শয়তান কানে কানে ফিসফিস করে বলে যেনো
‘একটু দেখ না কি অবস্থা করেছে ওদের,একটু দেখলে কিছুই হবেনা’
শ্যামার কথাটা মনে ধরলো,একটুখানি দেখবে শুধু। কি এমন ক্ষতি হবে তাতে?
শ্যামা এক চোখের পাতা খানিকটা মেলে তার সামনে তাকায়,
তার থেকে কিছুটা দূরেই একটা মানুষের র’ক্তা’ক্ত কাঁটা মস্তক পড়ে আছে।
এমন ভয়ংকর দৃশ্য দেখে সে সাথে সাথে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে,পেট গুলিয়ে উঠে তার,মুখে হাত দিয়ে তা ঠেকায় সে। অরণ্য ফিরে আসতে আসতে বলে,
“এই জন্যই বলেছিলাম চোখ না খুলতে,আমার কথা না শুনলে এমনি হবে।”

শ্যামা চমকে উঠে হঠাৎ অরণ্যের আওয়াজ শুনে,লোকটার কাছে সবসময় ধরা খায় সে। উনার অবাধ্য আর হওয়া যাবেনা,এই ঘটনার জন্য উনি রেগে নেই এই টুকুই বা কম কি। তার তো মনে হয়েছিলো অরণ্য আর কথা ই বলবেনা তার সাথে।

অরণ্য কাছে এসে তার হাতে ব্যাগ ধরিয়ে দেয়,তারপর শক্ত করে কোমড় জড়িয়ে ধরে বলে,
“চোখ খুলতে পারো তুমি এবার”

শ্যামা চোখ খুলে,অরণ্য একটি সাদা রঙের শার্ট পড়ে আছেন,বুকের কাছে একটা বোতাম খোলা,তার ফর্সা শরীরে যেনো কেটে বসেছে রঙটা। সাদা শার্টের বিভিন্ন জায়গায় র’ক্তে’র দাগ,এই সুন্দর পুরুষটির রূপ এতো ভয়ংকর কেনো মনে মনে ভাবে শ্যামা।

অরণ্যের কথায় ঘোর কাটে শ্যামার,
“শক্ত করে ধরো আমাকে,নয়তো মাথা ঘুরাবে তোমার”

শ্যামা অরণ্যের কথার সারমর্ম কিছু না বুঝলেও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে। তারপরই হঠাৎ পায়ের নীচের জমিন অনুভব হওয়া বন্ধ হয়ে যায় তার,হঠাৎ তীব্র শীতল হাওয়ার আবরণ যেনো তাকে চেপে ধরে,নিঃশ্বাস নিতে না পেরে দম বন্ধ হয়ে আসে তার। তারপর এক সময় পায়ের নীচের জমিন ফিরে আসে,হাওয়ার আবরণ মিলিয়ে যায়,বুক ভরে শ্বাস নিতে থাকে শ্যামা। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে তারা স্টেশনের কাছে একটি গাছের নীচে এসে দাঁড়িয়েছে। অরণ্য চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করে,
“তুমি ঠিক আছো শ্যামা?প্রথম প্রথম একটু সমস্যা হবে।ভয় পেয়োনা,আমি আছি।”

শ্যামা অরণ্যের দিকে তাকায় ঘোরলাগা দৃষ্টিতে,অরণ্য তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠে,
“আমার ক্ষমতা সীমিত,এক বারে এতোটা দূর টেলিপোর্ট করতে পারিনা। আমাদের আরও দুইবার এভাবে যেতে হবে বাড়ি পৌছানোর জন্য।”

শ্যামা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শুধু অরণ্যের দিকে। অরণ্য এভাবে হঠাৎ যেকোনো জায়গায় পৌছে যেতে পারে জানতো সে,কিভাবে সেটা এখনো জানা বাকি তার। তবে সে এটা নিজ থেকে অনুভব করবে একদিন সেটা স্বপ্নেও ভাবেনি শ্যামা।
এভাবে দুইবার টেলিপোর্ট করার পর সে নিজেকে নির্জনা কুঠির ভেতর,তাদের রুমে আবিষ্কার করে।
তখন তার সামনে পুরো পৃথিবীটা ঘুরছে মনে হলো যেনো।
সে এভাবেই অনেকক্ষণ অরণ্যের বুকে মাথা রেখে তার শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক করে। অরণ্য কিছু না বলে নীরবে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে শুধু।
কিছুক্ষণ পর ধাতস্থ হয় সে খানিকটা।
অরণ্য তাকে কোলে করে খাটে শুইয়ে দিয়ে কপালে চুমু এঁকে বলে,
“তুমি কিছুক্ষণ রেস্ট নাও,আমি পরিষ্কার হয়ে আসি। সামশেরকে খাবার দিয়ে যেতে বলবো। তুমি এখানেই অপেক্ষা করো”

শ্যামা ছোট্ট করে হুম বলে সায় দেয়। আজ তার উপর অনেক ধকল গিয়েছে। সারাদিন টেনশনে ক্ষিধের কথা মাথায় ছিলোনা,এখন প্রচুর ক্ষিধে অনুভব হচ্ছে তার। তার উপর আসার পথের জার্নিটা অনেক কাহিল করে দিয়েছে তাকে।

অরণ্য যাওয়ার পর বেশ খানিকক্ষণ সে ওভাবেই শুয়ে থাকে।
তারপর উঠে বসে। তার শরীরের দিকে তাকায় সে। পড়নের জামাটা সারাদিনের দস্তাদস্তিতে কুঁচকে আছে,ঘামে ভেজা গন্ধ আসছে,গোসল করা তারও প্রয়োজন।
সে উঠে আলমারি থেকে নীল রঙের শাড়ীটা বের করে,অরণ্যের প্রিয় রঙ। তারপর তোয়ালে নিয়ে নীচে নেমে আসে গোসলখানার উদ্দেশ্যে।

গোসলখানার সামনে যেতেই দড়জা খুলে অরণ্য বেড়িয়ে আসে। মুখোমুখি হয়ে যায় দুজনে।
অরণ্য মাত্র গোসল সেরে বেড়িয়েছে। পড়নে শুধু কালো ট্রাউজার,কাধে সাদা তোয়ালেটা ঝোলানো। একমনে মাথার চুলগুলো ঠিক করতে করতে শ্যামার দিকে তাকায় সে।
শ্যামা তখন মন্ত্রমুগ্ধ চেয়ে আছে অরণ্যের দিকে।
উনার পুরুষালী দাগবিহীন ফর্সা উন্মুক্ত শরীরে এখনো জায়গায় জায়গায় পানির বিন্দু লেগে আছে,এলোমেলো কালো ভেজা চুলগুলো কপালের সাথে লেপ্টে আছে,চুল গুলো চুইয়ে কয়েক ফোটা পানি থেকে থেকে গড়িয়ে পড়ছে উনি চুলে হাত চালানোতে,তার গভীর সর্বনাশা চোখ গুলো এখন তার দিকে তাকিয়ে আছে,ঠোঁটে লেগে আছে তার স্মিত হাসি। এভাবে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় তার লাগামহীন ভাবনাগুলো মুখ দিয়ে বেড়িয়ে আসে,
“উফফ পুরাই আগুন!”

অরণ্যের আবার লজ্জায় কান লাল হয়ে উঠে,ঠোঁটের হাসি প্রসারিত হয়,সে দ্রুতকদমে শ্যামার দিকে এগিয়ে গিয়ে কাধের ভেজা তোয়ালেটা দিয়ে তার মুখ ঢেকে দিয়ে যেতে যেতে বলে,
“আগুন গিয়ে নিভিয়ে এসো ঠোঁটকাটা মহিলা,তোমার চোখের অনলে নয়তো পুড়িয়ে মা’রবে আমাকে”

অরণ্য চলে যেতেই সম্বিৎ ফিরে শ্যামার,নিজের বেফাঁস মন্তব্যের কথা মনে করে তোয়ালের ভেতর মুখ লুকায় সে। মনে মনে বলে,
‘ইশশ এতোটা লাগামহীন আমি কখন থেকে হলাম?সব উনার দোষ,আমাকে উনার মায়ায় বন্দী করে আবার আমাকে লজ্জা দেয় বারবার’
তোয়ালে থেকে অরণ্যের শরীরের গন্ধ ভেসে আসছে,বুকের ধুকপুকানিটা অনেকটা শান্ত হয় সেই সুবাসে। একটু আগের কথা চিন্তা করে মুচকি হেসে গোসলখানার দিকে পা বাড়ায় শ্যামা।
———————-
শ্যামা যখন তার লম্বা ভেজা চুলগুলো মুছতে মুছতে রুমে আসে তখন অরণ্য বিছানার উপর খাবার সাজিয়ে রাখছেন।
কালো ট্রাউজারের উপর কালো রঙের টিশার্ট পড়েছেন। তার উন্মুক্ত লোমশ পুরুষালী বাহুগুলো আবার তার মনে লাগামহীন অনুভূতির ঝড় তুলে। চোখ সরিয়ে নেয় শ্যামা। নয়তো ফের বেফাঁস কিছু বলে ফেলবে।

শ্যামার উপস্থিতি বুঝতে পেরে দড়জার দিকে ফিরে তাকায় অরণ্য। সাথে সাথে এক রাশ মুগ্ধতায় ছেয়ে যায় তার হৃদয়।
শ্যামার ভেজা লম্বা চুলগুলো বিক্ষিপ্তভাবে লেপ্টে আছে তার শরীরে,চুলের চুইয়ে পড়া পানিতে শাড়ির কিছু কিছু অংশ ভিজে গিয়েছে,আর নীল শাড়ীতে যেনো মেয়েটাকে সবসময় একটু বেশিই সুন্দর লাগে,তার উপর এই লাজুক মায়াবী মুখটা বারবার মুগ্ধ করে তাকে। হৃদস্পন্দন তীব্র হতে থাকে,নিজেকে সংবরণ করা দায় হয়ে ওঠে।

অরণ্য এগিয়ে গিয়ে একটানে নিজের কাছে মিশিয়ে নেয় শ্যামাকে,এক হাতে তার উন্মুক্ত কোমড় জড়িয়ে ধরে অন্য হাত তার গালের উপর রাখে। হঠাৎ উনি এতোটা কাছে টেনে নেওয়ায় চমকে উঠে শ্যামা। হাত থেকে তোয়ালে পড়ে যায়,অরণ্যের বক্ষ জড়িয়ে ধরে সে। অরণ্যের চোখে চোখ পড়ে যায় তার। লোকটা কেমন ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সেও হারিয়ে যায় তার চোখের সেই মাদকতায়।
অরণ্য শ্যামার কপালের কাছের অবাধ্য চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে চুলে হাত গলিয়ে দেয়,তারপর আলতো হাতে কাছে টেনে নেয় তাকে,দখল করে নেয় তার ঠোঁটজোড়া।
শ্যামা আবেশে চোখ বন্ধ করে এলিয়ে পড়ে অরণ্যের বুকে,আজকে সারাদিন এই মানুষটিকে কাছে পাওয়ার সকল আকুতির সমাপ্তি ঘটিয়ে সেও সাড়া দেয় অরণ্যের চুম্বনের প্রতি,হাত দিয়ে আঁকড়ে ঘরে অরণ্যের এলোমেলো ভেজা চুল। খানিকবাদে অরণ্য তার ঠোঁট নামিয়ে এনে তার কণ্ঠনালীতে গভীর চুম্বন করলো,সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে শ্যামার অরণ্যের স্পর্শে।
অরণ্য তার গলা জুড়ে এখনো জোরে জোরে গরম নিঃশ্বাস নিচ্ছে,শরীরের গন্ধ নিচ্ছে,শরীরের প্রতিটা লোমকূপ দাঁড়িয়ে যায় শ্যামার উনার প্রতিটা নিঃশ্বাসের সাথে।
একসময় সে আবার মুখ তুলে এনে শ্যামার চোখে চোখ রাখে।
শ্যামা সে নেশাক্ত দৃষ্টিতে এক অদম্য বাসনা স্পষ্ট দেখতে পায়,লজ্জায় মাথা নীচু করে ফেলে সে।
অরণ্য তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে ঘোরলাগা কন্ঠে বলে উঠে,
“কি জাদু করেছো আমার উপর মায়াবিনী?আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলছি তোমার মায়ায় পড়ে”

শ্যামা লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠে অরণ্যের কথায়,তার বুকে মুখ লুকোয় সে নীরবে। অরণ্য এদিকে বলে চলেছে,
“নিজেকে সংবরণ করা কঠিন হয়ে পড়বে আমার,তুমি এভাবে আমাকে প্রতিনিয়ত প্রলুব্ধ করতে থাকলে”

“কে বলেছে আপনাকে সংবরণ করতে?” মুখ ফসকে কথাটা বলেই জ্বিবে কামড় বসায় শ্যামা।

অরণ্য শব্দ করে হেসে ফেলে এবার,”আজকে তুমি অনেক বেশি সাহসী হয়ে গিয়েছো শ্যামা বলতে হবে,আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছো রীতিমতো”

অরণ্য শ্যামার থুতনিতে হাত দিয়ে তার লজ্জামাখা মুখটা তুলে ধরে,
“কালকের দিনটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ আমার জন্য,আমাদের জন্য। আমি আমার সবকিছু তোমাকে খুলে বলবো কাল। তারপর আমাদের বৈবাহিক সম্পর্ক কেমন রূপ নিবে সেটা আমি জানিনা,তাই চাইলেও আমি আগাতে পারছিনা এই সম্পর্কে। কাল যা ই হয়ে যাক কখনও ভেঙ্গে পড়োনা শুধু। আমি জানি আমার শ্যামা মোটেও দুর্বল নয়। তুমি ঠিক নিজেকে সামলে নিবে।”

শ্যামা অবশেষে মুখ তুলে তাকায় অরণ্যের দিকে,মুচকি হেসে বলে,
“আপনি যতোদিন আমার পাশে আছেন,আমি সব যুদ্ধ জয় করতে পারবো।আপনার সত্যিটাও যতোটা কঠিন হোক,আমি ভেঙ্গে পড়বোনা,আর আমি জানি আপনি আমাকে ভাঙ্গতেই দিবেন না।”

অরণ্য মনে মনে প্রার্থনা করে,’তাই যেনো হয়’

(চলবে)

#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ২৯
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন

খাবারের পালা শেষ করে অরণ্য হঠাৎ আবদার করে,
“পুকুরপাড়ে হাঁটতে যাবে?”

উনি প্রথমবার মুখ ফুটে আবদার করলেন তার কাছে,মানা করার প্রশ্নই আসেনা। শ্যামা হাসিমুখে সায় দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
অরণ্য স্মিত হেসে হাত বাঁড়িয়ে দেয় তার দিকে যেটি সে সাচ্ছন্দ্য গ্রহণ করলো।

ধরতে গেলে বিয়ের পর এই প্রথম তারা একসাথে এই ঘর ছেড়ে এই বাড়ির বাইরে পা রেখেছে,এভাবে হাতে হাত রেখে হাটতে বেরিয়েছে। রাত এখন গভীর। রাতের নিস্তব্ধ পরিবেশে থেকে থেকে ঝি ঝি পোকার ডাক ছাড়া আর কোনো সাড়াশব্দ নেই।
আকাশে গোল রুটির মতো চাঁদ উঠেছে,যার রূপোলী আলো পড়ে পুকুরের পানিগুলো চক চক করছে।
রাতের মৃদুমন্দ বাতাস এসে গা জুড়িয়ে দিচ্ছে।
আজকের রাতটা সবচেয়ে বেশি সুন্দর শ্যামার জীবনে,আর সবচেয়ে সুন্দর তার পাশের এই মানুষটি। চাঁদের আলো যেনো তার সৌন্দর্য আরও মোহনীয় করে তুলেছে।

এক সময় চলতে চলতে থেমে যায় অরণ্য,তাকে থামতে দেখে থেমে যায় শ্যামাও। সে এতোক্ষণ অরণ্যকেই দেখছিলো মুগ্ধ হয়ে,আশেপাশে তেমন খেয়াল ছিলোনা।
এবার সে ভালো করে খেয়াল করে,তারা পুকুরপাড়ের জবাফুল গাছগুলোর একটির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

“আমার মায়ের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা ছিলো এই পুকুরপাড়।”,অরণ্য হঠাৎ বলে উঠে।

শ্যামা অবাক দৃষ্টিতে তাকায় অরণ্যের দিকে। এই প্রথম অরণ্য তার মায়ের কথা সেচ্ছায় বলছে তাকে। এর আগে কথায় কথায় মুখ ফসকে কয়েকবার বলেছিলো তার মায়ের কথা। কিন্তু পরক্ষণে বুঝতে পেরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে সবসময়। এবার আর কোনো ভুল নয়,শ্যামা এখন নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছে অরণ্যের চোখেমুখে বিষাদের ছাপ।
মনে মনে ওই কুটনী বুড়িকে আচ্ছামত বকে দিলো,কি বলেছিলো ওই বুড়ি?অরণ্য তার মাকে ভালোবাসে না?তার খু’নী সে?

অরণ্য বলতে থাকে,
“তার একাকিত্বের একমাত্র সঙ্গী ছিলো এই পুকুরপাড়, তাই আমি উনার দেহাবশেষ এই পুকুর পাড়ের কাছেই সমাধিস্থ করেছি। উনার লাল জবাফুল অনেক প্রিয় ছিলো,তাই এই দ্বিতীয় গাছটি আমি লাগিয়েছি এখানে। জীবনদশায় উনি অনেক কষ্ট পেয়েছেন,তার মৃত্যুটাও অনেক মর্মান্তিক ছিলো।
আমি ছেলে হয়ে উনার জন্য কিছুই করতে পারিনি,শেষকালে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটাও হয়নি আমার।
আমি শুধু এইটুকু আশা রাখি উনি তার প্রিয় স্থানে,তার প্রিয় ফুল গাছের ছায়ায় শান্তিতে আছেন। উনি যেখানে আছেন ভালো থাকুক,ইহলোকের কোনো স্মৃতি উনার আত্মাকে তাড়া না করুক…”
বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে অরণ্য।
শ্যামা বাকরুদ্ধ হয়ে যায় অরণ্যের চোখে অশ্রু দেখে,তাকে এভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখে। সে নিজের অজান্তেই এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে।

অরণ্যও তাকে জড়িয়ে ধরে তার কাধে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে। উনার প্রতিটা অশ্রুতে লুকিয়ে থাকা কষ্টগুলো শ্যামার ভেতর পর্যন্ত নাড়িয়ে দেয়। সে কোনো প্রশ্ন না করে নীরবে অরণ্যের পিঠে,মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।

অরণ্য ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলে,
“আজকে আমি অনেক ভয় পেয়েছিলাম শ্যামা,অনেক বেশি। মনে হয়েছিলো যেভাবে মাকে হারিয়েছিলাম,ঠিক একিভাবে হারিয়ে ফেলবো তোমাকে। সেদিনও আমার তাকিয়ে তাকিয়ে আমার মাকে একটু একটু করে মরতে দেখা ছাড়া কোনো উপায় ছিলোনা।
আজ এতো বছর পর ঠিক একই আতঙ্ক অনুভব করেছি আমি। সব দূর থেকে দেখছিলাম আমি কিন্তু কিছুই করতে পারিনি আমি। আজ তুমি নিজ থেকে কিছু সাহস না দেখালে তোমাকেও চিরতরে হারিয়ে ফেলতাম আমি। ভাবলেই আমার গায়ে কাঁটা দেয়,আমি এটা কল্পনাও করতে পারছিনা শ্যামা।”

শ্যামার চোখও ভিজে উঠেছে তার প্রিয় মানুষটাকে কাঁদতে দেখে। অরণ্যকে শান্ত করার জন্য শান্ত কন্ঠে সে বলে উঠে,
“এমন কিছুই হয়নি অরণ্য। দেখুন আপনি ঠিক আমার কাছে পৌছে গিয়েছেন,কিচ্ছু হতে দেননি আমার। আপনার খুশি হওয়া উচিত এই মুহুর্তে যে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছুই ঘটেনি। এভাবে কাঁদেনা সোনা। আপনার মা যেখানে আছেন তিনি যদি আপনাকে এভাবে কাঁদতে দেখেন অনেক কষ্ট পাবেন।”
শ্যামা দু’হাতে অরণ্যের মুখ তুলে সামনে আনে,সে এখনো মাথা নীচু করে কেঁদে চলেছে,চোখমুখ পুরো লাল হয়ে গিয়েছে। অনেক হৃদয়বিদারক এই দৃশ্যটা শ্যামার কাছে। এই মানুষটাকে সে সবসময় শুধু হাসিখুশি দেখতে চায়,এভাবে কান্না করাটা একদম মানায় না উনাকে।

সে পায়ের পাতায় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে অরণ্যের কপালে গভীর চুমু খায়,তারপর চোখ দুটোতে,তারপর দুই গালে। কান্নার গতি অনেকটা কমে আসে অরণ্যের। সে আবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শ্যামাকে। শ্যামা শুধু তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অপেক্ষা করে ওর শান্ত হওয়ার।

এক সময় শান্ত হয় অরণ্য। শ্যামা তাকে কোনো প্রশ্ন করেনি,কিছু বলতে চাইলে উনি নিজ থেকে বলবেন। তার জন্য আপাতত অরণ্যের চোখমুখ থেকে এই বিষাদের ছাপটা মুছতে পারলে হলো।
অরণ্য পুকুরঘাটে নামে মুখ ধোয়ার জন্য। শ্যামা পাথরের সিড়িতে বসে অপেক্ষা করে তার। অরণ্যের ঝুঁকে পড়া পিঠের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনটা বিষাদে ছেয়ে যায় তার।
মনে মনে বিধাতার কাছে প্রার্থনা করে,
‘আমি আপনার কাছে সচরাচর কিছু চাইনা,কিন্তু আজকে খুব করে চাইতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমাকে এই মানুষটার জীবনের সব কষ্ট মুছে দিয়ে তার জীবনটা নতুন করে সাজানোর একটা সুযোগ দিবেন?শুধু উনাকে মন খুলে হাসতে দেখতে চাই।’

অরণ্য ফিরে এসে বসে তার পাশে। শ্যামা তার শাড়ীর আঁচল দিয়ে চোখমুখ মুছে দেয় তার। শ্যামাকে এমন চুপচাপ থাকতে দেখে কাছে টেনে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয় অরণ্য। শ্যামা চুপচাপ তার বুকে মাথা এলিয়ে দেয়। অরণ্য তার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলে,
“কোনো প্রশ্ন করলেনা যে?”

“কোনো প্রশ্ন নেই,আপনার যখন বলতে ইচ্ছে হবে তখন বলবেন আপনি। আমার কারণে নিজের উপর জোর করবেন না অরণ্য,আপনি চাইলে কালকে সবটা না বললেও চলবে। পরে নাহয় সময় হলে…”

“না…অনেক কষ্টে মনকে তৈরি করেছি। আর পিছু হটতে ইচ্ছে হচ্ছেনা।”

“আপনি যা ঠিক মনে করবেন,তাই হবে অরণ্য।”

অরণ্য মৃদু হেসে বলে,”তুমি কবে থেকে এতটা বাধ্য হলে আমার?”

শ্যামা চুপ থাকে,কোনো উত্তর দেয়না।
অরণ্য কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলে উঠে,
“তোমাকে অনেক ধন্যবাদ শ্যামা”

শ্যামা ভ্রু কুঁচকে বলে,”ধন্যবাদ কেনো?”

“প্রথমত, আজ নিজেকে আমি আসা পর্যন্ত রক্ষা করার জন্য,এটার জন্য আমি তোমাকে যতটা ধন্যবাদ দিই তা কম পড়বে।
আর দ্বিতীয়ত, তুমি বুড়ির কথা বিশ্বাস করোনি যে আমি আমার মায়ের হ’ত্যা’কারী। আমাকে এতোটা বিশ্বাস করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।”

“ওই বুড়িটা মিথ্যুক অরণ্য,আপনি উনার কথায় একদম মন খারাপ করবেন না। উনাকে আমি আচ্ছামত বকে দিয়ে আসবো সময় করে,ভুলভাল গুজব ছড়ায় আপনার নামে।”

“পুরোপুরি মিথ্যেও নয় সবকিছু শ্যামা,আবার পুরোপুরি সত্যিও নয় উনার কথা। তবে এটা সত্যি যে আমি খুব খারাপ মানুষ ছিলাম। হয়তো এখনও আছি,কারণ আমার জন্য তোমার ভালো থাকা ছাড়া আর কিছুই মাইনে রাখেনা। আর তোমাকে বিপদ থেকে দূরে রাখার জন্য আমি যেকোনো কিছু করতে পারি। তোমার সবকিছু শুনে আমাকে অনেক খারাপ মনে হতে পারে।”

“আমি আপনাকে আগেই বলেছি অরণ্য,আমি আপনাকে সব রূপেই ভালোবাসি। একদিন আপনি আমাকে বলেছিলেন দুনিয়ার সবাই আমাকে ভালো না বাসুক,আপনার একার ভালোবাসা আমার জন্য যথেষ্ট হবে কিনা। বেছে নিতে বলেছেন পুরো দুনিয়া আর আপনার মাঝে একটা। যেদিন আপনাকে বেছে নিয়েছি,সেদিনই আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি। আপনি কে,দেখতে কেমন,কতটা ভালো কতটা খারাপ আমি তখন খুঁজতে যাইনি। আমি তখনও ভালোবাসতাম আপনাকে,এখনও বাসি,আমরণ বাসবো।”

অরণ্যের মনটা প্রশান্তিতে ছেয়ে যায় শ্যামার কথা শুনে। মনের বিষাদগুলোর মাঝেও স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে তার হৃদয়জুড়ে। সে শ্যামাকে আরও খানিকটা বুকে মিশিয়ে নিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে বলে উঠে,
“আমার অনেক ইচ্ছে করে এভাবেই তোমার সাথে আজীবন কাটিয়ে দিতে,আমি কি অনেক বেশি কিছু চেয়ে ফেলেছি শ্যামা?”

“একদম না,কমপক্ষে এটুকু তো আমাদের প্রাপ্য।”

এরপর আর কোনো কথা হয়নি তাদের মাঝে। সকালের সূর্য নতুন দিনের সাথে নতুন একটা ঝড় আনতে চলেছে। দুজনেই তাদের মনকে প্রস্তুত করতে ব্যস্ত,সে ঝড় মোকাবিলা করার জন্য।

সকালবেলা অনেক বেলা করে ঘুম ভাঙ্গে শ্যামার। রাতে পুকুরপাড়ে অরণ্যের বুকে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো শ্যামা। ভোররাতের দিকে অরণ্য তাকে রুমে রেখে গেছে।
চোখ খুলে পাশ ফিরতেই অনেকদিন পর অরণ্যের চিরকুট দেখতে পায় শ্যামা। ঘুম সাথে সাথে পালায় চোখ থেকে।
তড়িঘড়ি করে চিরকুট খুলে পড়তে লাগলো যেখানে লেখা আছে,

“ঘুম থেকে উঠে ধীরে সুস্থে আমার ঘরে এসো।
তাড়াহুড়োর কোনো প্রয়োজন নেই।”

কে শুনে কার কথা। শ্যামা বেশ তাড়াহুড়ো করেই হাত মুখ ধুয়ে গোসল করেই চলে আসে দোতলার করিডোরে। বরাবরের মতোই কোনো আলো নেই,এদিকের জানালা গুলো সব বন্ধ থাকে সব সময়। শ্যামা আস্তে আস্তে আগাতে থাকে করিডোরের শেষ প্রান্তের রুমের দিকে। প্রত্যেক কদমে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে তার হৃদস্পন্দনের গতি।

দড়জা থেকে কয়েক কদম দূরেই সে হঠাৎ শুনতে পায় কারো অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ। চমকে যায় শ্যামা।
এমন গোঙানির শব্দ সে গতবার পেয়েছিলো একবার,কিন্তু পরে ভেবেছিলো মনের ভুল তার।
কিন্তু এখন থেকে থেকে ভেসে আসছে সে মৃদু গোঙানির শব্দ,এবার কোনো ভুল নয়। অরণ্যের ঘর থেকেই ভেসে আসছে শব্দটা,কেউ যেনো অনেক কষ্টে আছে।
হঠাৎ তার মনে কু ডাক দিতে থাকে। অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠে তার।

দড়জার কাছাকাছি যতোই আগাচ্ছে ততোই স্পষ্ট হচ্ছে সে আর্তনাদ। সে কাঁপা কাঁপা হাতে মৃদু ধা’ক্কা দিয়ে খুলে ফেলে দড়জা। এবার স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে,এটা আর কারোও নয়,অরণ্যের কন্ঠস্বর,কোনো ভুল নেই তাতে।
অরণ্য অনেক কষ্টে আছে,ভাবনাটা মনে আসতেই বুক ধ্বক করে উঠে শ্যামার। সে তড়িঘড়ি করে দড়জা খুলে ভেতরে পা রাখে।

অরণ্যের রুমটা সে যতটা ভেবেছিলো,তার চেয়েও বেশি অন্ধকার। ঘরের সব জানালা বন্ধ,মোটা কালো পর্দা টানানো। আলো বলতে একটা মৃদু আলোর বাতি জ্বলছে।
সেই মৃদু আলোতে সে যে দৃশ্য দেখলো,তা দেখে যেনো তার অন্তরআত্মা কেঁপে উঠলো।

অরণ্য খাটের উপর শোয়া অবস্থায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে,একটা মোটা কালো শিকল আষ্টেপৃষ্টে জড়ানো তার শরীরে। থেকে থেকে তিনি যন্ত্রণায় গুঙিয়ে উঠছেন।
শ্যামা দৌড়ে গিয়ে বসে অরণ্যের পাশে।
অরণ্যের পুরো শরীর ঘামে ভিজে উঠেছে,পড়নের কালো টি-শার্ট ভিজে গায়ে লেপ্টে গিয়েছে,তার গায়ে হাত দিয়ে দেখে শ্যামা,শরীর আগুনের মতো গরম অরণ্যের, হাত লাগাতেই তার হাত জ্ব’লে গেলো মনে হলো। সাথে সাথে হাত সরিয়ে নিতে বাধ্য হলো সে।
উনার কতটা কষ্ট হচ্ছে তা চোখেমুখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে তার,চোখের কর্ণিশ বেয়ে জল গড়াচ্ছে অরণ্যের।
এসব দেখে আতঙ্কে তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়,সে কি করবে বুঝে উঠতে পারলোনা।
সে কাঁদতে কাঁদতে ডাকলো অরণ্যকে,
“অরণ্য! চোখ খুলুন প্লিজ,কি হয়েছে আপনার?কে বেধেছে আপনাকে এভাবে?”

সামশের জবাব দেয় তাকে,”মনিব এখন কথা বলার অবস্থায় নেই মালকিন।”

শ্যামা চমকে উঠে তাকায় সামশের এর আওয়াজ শুনে,অরণ্যকে দেখার পর এতোক্ষণ খেয়াল করেনি সে,রুমে তিনিও আছেন। শ্যামা কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে,
“চাচা কি হয়েছে উনার?এমন করছেন কেনো?উনাকে এভাবে বেধে রেখেছেন কেনো?”

“মনিব বলেছেন আপনাকে ধৈর্য ধরতে,উনি উঠে সব বলবেন।”

“ধৈর্য ধরবো মানে?উনার শরীর আগুনের মতো গরম,উনাকে হাসপাতালে নিতে হবে। আর বেধে রেখেছেন কেনো উনাকে?দেখছেন না কষ্ট হচ্ছে উনার?এক্ষুণি খুলুন এগুলো।”

“মালকিন,মনিব সূর্য অস্ত গেলে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে যাবেন। তখন তিনি নিজেই বলবেন সবকিছু। উনার স্ত্রী হিসেবে শুধু এটুকুই বলবো আপনাকে,ধৈর্য ধরুন। উনার পাশে থেকে উনার সাথে এটুকু সহ্য করুন।”
বলেই সামশের চলে যায় রুমের দড়জা বন্ধ করে।
শ্যামা সেখানেই বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকে।

কোনোকিছুই বুঝতে পারছেনা সে,কি হচ্ছে এসব?এদিকে দিন বাড়তে থাকার সাথে অরণ্যের অবস্থা আরোও খারাপ হতে থাকে। রীতিমতো ছটফট করছে সে অসহ্য যন্ত্রণায়। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন,চোখ মুখ খিঁচে সহ্য করছেন সবকিছু। শ্যামার সেখানে বসে অশ্রু বিসর্জন করা ছাড়া কিছু করার থাকেনা।

একবার সে ভাবলো অন্তত উনাকে পেঁচিয়ে রাখা শেকলটা খুলে দিলে কষ্ট একটু কমবে উনার। কিন্তু শেকলের বন্ধনী খুঁজতে গিয়ে অভাবনীয় একটি জিনিস আবিষ্কার করে সে।
এই শিকল তার বুক ফুঁড়ে বের হয়ে অরণ্যের শরীর বেয়ে ঠিক সে যায়গায় গিয়ে থেমেছে। উনার শরীর থেকে বেড়িয়েছে এই শিকল,এটা কোনো সাধারণ শিকল নয় বুঝতে বাকি রইলো না আর। আতঙ্কে শিউরে উঠে শ্যামা।
মাথা পুরোপুরি কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে তার। সে ভেবেছিলো অরণ্যের কোনো ভয়ংকর অতীত রয়েছে। কিন্তু তার বর্তমানটাই এতোটা ভয়ংকর হবে ভাবতেও পারেনি সে।

এটাই যদি অরণ্যের ঘরবন্দী হওয়ার কারণ হয়ে থাকে,তাহলে সে মানুষটার সাথে প্রায় দুই মাস সংসার করেছে,তার সারাবাড়ি ঘুরে বেড়িয়েছে,হেসেখেলে দিন পার করেছে,একসাথে খেয়েছে,একসাথে ঘুমিয়েছে,
অথচ মানুষ টা এই বাড়ির একটা আবদ্ধ ঘরে এমন নরক যন্ত্রণা সহ্য করেছে দিনের পর দিন একা একা,সে কখনো টেরই পেলোনা? হঠাৎ প্রবল হতাশা,অনুশোচনা গ্রাস করে শ্যামাকে। ভগ্নহৃদয় নিয়ে অসহায়ভাবে কাঁদতে থাকে শ্যামা অরণ্যের শিয়রে বসে।
কি করবে সে এখন?কিভাবে ঠিক করবেন উনাকে?উনি এভাবে আর কতোক্ষণ সহ্য করবেন?মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে,কিন্তু তার উত্তর দেওয়ার মানুষটা এখন উত্তর দেওয়ার অবস্থায় নেই।

(চলবে)

#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ৩০
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন

দিন বাড়ার সাথে সাথে অরণ্যের পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকা কষ্ট বসে বসে দেখা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায় শ্যামার জন্য।
হাতের উপর হাত রেখে তার প্রিয় মানুষটাকে যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখা তার জন্য কোনো শাস্তির থেকে কম নয়।
সে বিক্ষিপ্ত কদমে নীচে গিয়ে কলপাড় থেকে এক বালতি ঠান্ডা পানি নিয়ে আসে।
রিমু শ্যামাকে এমন অবস্থায় দেখে আঁতকে উঠে,কোনো প্রশ্ন করতে গেলেও শ্যামা উত্তর দেয়না। যাওয়ার আগে শুধু বলে গেলো আজ রাতের রান্নাটা যেনো সে নিজে করে দিয়ে যায়।

শ্যামা আর কাঁদছেনা,সে যেনো পাথরের এক মূর্তি এখন,যে কাঁদতেও ভুলে গেছে। সে চুপচাপ সুতির ন্যাকড়া দিয়ে পানি চেপে চেপে অনবরত অরণ্যের মুখ,গলা মুছে চলেছে। হাতে ছ্যাঁকা লাগার ব্যপারটাও পুরোপুরি অগ্রাহ্য করলো সে। এভাবে ঠিক কতোক্ষণ করেছে সে তার ইয়ত্তা নেই,এটা আদোও অরণ্যের কষ্ট একটু নিরাময় করতে পেরেছে কিনা সেটাও জানেনা সে।

তবে দিনের আলো কমতে কমতে অরণ্যের আর্তনাদ কমতে থাকে,শ্বাস-প্রশ্বাস আগের থেকে একটু স্বাভাবিক হতে থাকে।
আকাশের সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে সেই অস্বাভাবিক শেকলটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। মিলিয়ে যায় বললে ভুল হবে,কারণ শিকলটিকে তার শরীর বুকের কাছ থেকে শুষে নিয়েছে। শিকলটি পুরোপুরি তার বুকে ঢুকে যাওয়ার সাথে সাথে অরণ্য ধরফরিয়ে উঠে বসে এক দলা র’ক্ত বমি করে।
এই দৃশ্য যেনো শ্যামার ভেতরটা পুরোপুরি ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়। সে পাথরের মূর্তির মতো চেয়ে থাকে ফ্লোরে পড়া র’ক্তের দিকে,পলক ফেলতেও ভুলে গিয়েছে যেনো।

সামশের সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথেই আসে। অরণ্যের কুলকুচি করার পানি আর গামলা নিয়ে,যেনো নিত্য দিনের কাজ এটা তার। তিনি অরণ্যকে ধরে তুলে কুলকুচা করতে সাহায্য করলেন। অরণ্যের গা মোছার জন্য পানি এগিয়ে আনতেই শ্যামা হঠাৎ শান্ত গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
“আমি করবো এসব এখন থেকে,আপনি যেতে পারেন।”

সামশের একবার সম্মতির জন্য অরণ্যের দিকে তাকালো,সে চোখের ইশারায় তাকে সম্মতি দিয়ে চলে যেতে বললো।
অরণ্য এখনো শ্যামার দিকে তাকায়নি,ওর চোখে চোখ রাখার সাহস হচ্ছেনা তার। একটু আগের তার গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বর তাকে আরও চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।
মেয়েটা দুপুর থেকে চুপ হয়ে গেছে,কান্নাও করছেনা। এভাবে ও অসুস্থ হয়ে পড়বে।

শ্যামা চুপচাপ অরণ্যের পিঠে বালিশ দিয়ে তাকে আধশোয়া করতে সাহায্য করে। শরীর অনেক দুর্বল তার এই মুহুর্তে,গায়ের তাপমাত্রা কমলেও এখনো স্বাভাবিক হয়নি,তার চোখেমুখে তাকালেই দেখতে পাচ্ছে এটুকু উঠে বসতেও তার অনেক কষ্ট হচ্ছে।
শ্যামা কোনো কথা বললোনা,অরণ্যের চোখের দিকেও তাকালোনা,সে আস্তে আস্তে অরণ্যের ঘামে ভেজা টি-শার্ট খুলে নিলো। বালতিতে ন্যাকড়া ভিজিয়ে একমনে তার সারা শরীর মুছে দিতে লাগলো।
অরণ্য বেদনাকাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শ্যামার দিকে।
এই মুখটা সবসময় কেমন হাসিখুশি থাকতো,আজ তার ছিটেফোঁটাও নেই। সে কি আর কোনোদিন মেয়েটার মুখের হাসি দেখতে পাবেনা?
তার এই ভাবনাটা আজ শরীরের ব্যথার চেয়েও বেশি কষ্ট দিচ্ছে তাকে। তার অনেক ভয় হচ্ছে এখন,এটুকু ধাক্কা মেয়েটিকে এমন করে দিয়েছে।
পরের টুকু মেয়েটা সহ্য করতে পারবে তো?
অরণ্য তার দুর্বল হাতটা রাখে তার শরীর মুছতে ব্যস্ত শ্যামার হাতের উপর। মেয়েটা একপলক তার দিকে না তাকিয়েই হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলে,
“উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ুন,পিঠের দিকটা মুছতে হবে”

অরণ্য আর সহ্য করতে পারলোনা,শরীরের ব্যথা উপেক্ষা করে এগিয়ে গিয়ে শ্যামাকে বুকে মিশিয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ে।
শ্যামা ছাড়া পাওয়ার জন্য মোচড়ামুচড়ি করতে থাকে। তার প্রিয় মানুষটার বুকে আসতেই মনের পাথর গলতে থাকে তার। চোখ থেকে অঝোর স্রোতে গড়াতে থাকে জল।
শ্যামা ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলে,
“ছাড়ুন আমাকে অরণ্য,আমার কাজ এখনো শেষ হয়নি।”

অরণ্য নীরবে তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরে থাকে তাকে। শ্যামা একটু পরেই ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা বন্ধ করে দিয়ে অরণ্যের বুকে নেতিয়ে পড়ে। নিজের কান্না সংবরণ করার কোনো চেষ্টা করলোনা,হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে সে,
“আমি এখন কি করবো অরণ্য?আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা,আমাকে প্লিজ কোনো পথ দেখান। আমার মাথায় কিছুই আসছেনা।”

অরণ্য নীরবে শ্যামার মাথায় হাত বোলাতে থাকে শুধু,কাঁদুক আরও কাঁদুক,কাঁদলে মন হালকা হবে। পরের কথাগুলো সহ্য করতে পারবেনা নয়তো।

অরণ্য শ্যামাকে বলে উঠে হঠাৎ,
“আমাকে একটু পানি খাওয়াতে পারবে শ্যামা?”

শ্যামার ঘোর কাটে তখন,মানুষটা সারাটাদিন ঘেমেছে,কিছু খায়নি। তার খেয়াল রাখা উচিত ছিলো উনার তেষ্টা পেয়েছে। সে উঠে গিয়ে টেবিলের জগ আর গ্লাস নিয়ে এসে নিজ হাতে পানি খাওয়ায় অরণ্যকে। পরপর দুই গ্লাস পানি খেতে খেতে সামশের খাবার নিয়ে আসে ঘরে।

এই সময়ে খাবার দেখে আবার মনে পড়ে যায় শ্যামার,কেনো অরণ্যকে সারাদিন না খেয়ে থাকতে হতো। আজ অবশেষে উত্তর দিয়েছে তাকে অরণ্য।

শ্যামা খাবার মেখে খাইয়ে দেয় অরণ্যকে,তার জোরাজুরিতে না চাইতেও তাকেও খেতে হলো কিছুটা। তারপর সে নিস্তেজ হয়ে তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।
উনাকে অনেক ক্লান্ত দেখাচ্ছে এই মুহুর্তে। শ্যামা শুধু চুপচাপ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে,কিছুক্ষণের মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ে অরণ্য।
অরণ্যের ঘুমন্ত মুখটা অত্যন্ত মায়াবী দেখাচ্ছে,ক্লান্ত হয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন তিনি।
শ্যামারও মাথাটা প্রচুর ধরেছে,একটু ঘুম তারও প্রয়োজন। কিন্তু আজ চোখ বন্ধ করতেও ভয় লাগছে তার। বারবার দিনের দৃশ্য গুলো চোখে ভাসছে তার।
সে খাটের সাথে হেলান দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে জানালার বাইরে। পরিবেশটা এখন ততোটাই নিস্তব্ধ যতটা কোলাহলপূর্ণ দিনের আলোতে ছিলো।
এভাবে কতক্ষণ কেটে গিয়েছে সে জানেনা,তার সম্বিৎ ফিরে অরণ্যের কথায়,

“তুমি সত্যিই অনেকটা আমার মায়ের মতো শ্যামা”

শ্যামা চকিতে ফিরে তাকায় তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকা অরণ্যের দিকে। তার দিকে স্মিত হেসে তাকিয়ে আছে অরণ্য,জানালা গলে খানিকটা চাঁদের আলো এসে পড়েছে তার মুখে,অসম্ভব মায়া খেলা করছে তার চোখেমুখে। কখন জেগে উঠেছেন উনি টেরই পায়নি শ্যামা। রুমের ঘড়ির দিকে তাকায় শ্যামা,কাটায় কাটায় রাত বারোটা এখন।
অরণ্য বলতে থাকে,
“আমার এই অবস্থা হওয়ার পর মা ও ঠিক এতোটাই বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। সারাটা দিন আমার শিয়রে বসে কান্নাকাটি করতেন,সারাটাদিন আমার শরীর ভেজা কাপড় দিয়ে মুছতে থাকতেন,সন্ধ্যায় এভাবেই খাইয়ে দিতেন,আমি উনার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তাম ক্লান্ত হয়ে,যখন চোখ খুলতাম দেখতে পেতাম তিনিও একদৃষ্টিতে জানালার বাইরে পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে আছেন। আজ অনেক বছর পর সেই একি অনুভূতি অনুভব করেছি আমি।
অবশ্য এর আগেও অনেকবার এমনটা মনে হয়েছিলো আমার,তোমরা কিছুদিক দিয়ে ভিন্ন হলেও অনেক মিল আছে তোমাদের মাঝে। মা বেঁচে থাকলে তোমাকে তার অনেক পছন্দ হতো শ্যামা।”

“আপনার আমাকে সাধারণ কথা বলে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে হবেনা অরণ্য,আমি ঠিক আছি। আপাতত অন্তত। কিন্তু থেকে থেকে কেনো জানি মনে হচ্ছে আপনি আমাকে এর চেয়েও ভয়ংকর কিছু বলবেন,যা আমাকে পুরোপুরি নিঃশেষ করে দিবে।
নয়তো আপনি আপনার সত্য বলার শুরুটাই আমাকে এসব দেখিয়ে করতেন না।” বলতে বলতে চোখের কর্ণিশ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে শ্যামার।

অরণ্যের বুকের বা পাশটা মোচড় দিয়ে উঠে হঠাৎ, সে শোয়া থেকে উঠে আধশোয়া হয়ে শ্যামাকে বুকে টেনে নেয়। শ্যামা চুপচাপ অশ্রুসিক্ত নয়নে তার বুকে মাথা রাখে। অরণ্য বলে উঠে,
“আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম শ্যামা,সবকিছু অনেক জটিল হবে তোমার জন্য। তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে নিজেকে সামলে নিবে।”

“বলেছিলাম মানছি আমি। আপনি আমাকে সাবধানও করেছিলেন সত্যিটা অনেক ভয়ংকর হবে। কিন্তু এতোটা ভয়ংকর হবে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
আমি ভেবেছিলাম খারাপের চেয়ে খারাপ কি হতে পারে?আপনি হয়তো বলবেন আপনি কোনো পিশাচ,আমার হৃদপিণ্ড নিজ হাতে ছিড়ে দিতে হবে আপনাকে?আমি হাসতে হাসতে দিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু এটা তার চেয়েও ভয়ানক,অনেকগুণ বেশি। আমার ভয় হচ্ছে অনেক,চরম ভয়।”

“তাহলে আজকের দিনটা বাদ দাও,কালকে নাহয়…”

শ্যামা আঁতকে উঠে বলে,
“না…একদম না! কিছু না জেনে কালকের দিনটাও আপনাকে এভাবে দেখতে হলে আমি জানিনা কি অবস্থা হবে আমার। আমি জানতে চাই সব। এক্ষুনি! ”

অরণ্য কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“ঠিক আছে শ্যামা,আমি বলছি সব। চুপ করে শুনবে সবকিছু। আর আমি আবার মিনতি করছি শ্যামা,প্লিজ ভেঙ্গে পড়োনা।”

শ্যামা কোনো জবাব দিলোনা অরণ্যকে,শুধু আরও খানিকটা আঁকড়ে ধরলো তাকে,যেনো হাত ছুটলেই হারিয়ে যাবে মানুষটা।

অরণ্য আরেকবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করে,
“আমি কোনো স্বাভাবিক মানুষ না তা তুমি জানো। তবে আমি ১০৪বছর আগেও একজন সাধারণ মানুষ ছিলাম।
আমার মা একজন যাযাবর গোষ্ঠীর মানুষ ছিলেন। দেখতে কৃষ্ণবরণের ছোটো খাটো গড়নের একজন সাধারণ মহিলা ছিলেন তিনি। তার না কোনো বংশ পরিচয় ছিলো,না কোনো ধন-দৌলত,না তিনি তথাকথিত রূপসী ছিলেন।
তবুও আমার উচ্চাকাঙ্খী এবং সুন্দরের পূজারী বাবা কেনো তাকে বিয়ে করেছিলেন,তা এখনো অজানা আমার।
এমনকি কেউ মাকে কোথা থেকে আনা হয়েছে সে ব্যাপারেও জানতোনা। বাবা এই ব্যপারটা সবসময় গোপন রেখেছিলেন,মা ও এই ব্যপারে কোনো কথা বলতেন না কারণ বাবার বারণ ছিলো। উনি যে যাযাবর ছিলেন তা কেবল আমি জানতে পেরেছি কারণ মা ছোটবেলায় প্রায়ই তার বিভিন্ন জায়গার ভ্রমণের কাহিনী শুনাতেন আমাকে।
আমার মা যখন আমাকে জন্ম দেন তখন তিনি মাত্র পনেরো বছরের একজন কিশোরী ছিলেন। কম বয়সে পুষ্টিহীন শরীরে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে তিনি আমার জন্মের পরপরই শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন।
কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তার গায়ের বরণ বা তার পুষ্টিহীনতার কোনো প্রভাব তার সন্তানের উপর পড়েনি। বরং তার বিপরীতটা ঘটেছিলো।
আমি সাধারণ শিশুদের চেয়েও অনেক বেশি সুস্থ আর সুদর্শন ছিলাম। আমার বয়সী অন্য সাধারণ ছেলেদের তুলনায় আমি অনেকটাই অস্বাভাবিক ছিলাম।
গ্রামের সবচেয়ে উঁচু গাছটায় যেখানে বড়োরাও উঠতে পারতোনা,আমি অনায়সে উঠে যেতাম। দৌড়ে কেউ আমার কাছে ঘেষতে পারতোনা। কারো সাথে মা’রা’মা’রি লাগলেও সামনে যে ই থাকুক,জয় টা আমার হতো। আমার সৌন্দর্যের প্রসংশা করতো সবাই।পাঠশালার শাস্ত্রবিদ্যা হোক বা অস্ত্রবিদ্যার কৌশল হোক,আমি সকল জ্ঞান অনায়াসে রপ্ত করতে পারতাম,সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলো আমার প্রতি। আমার ভাইয়েরা আর সৎমায়েরা আমার দিকে হিংসার দৃষ্টিতে তাকাতো,আশেপাশের দশগ্রামে আমাকে নিয়ে চর্চা হতো।
বাবা আমার প্রতি অনেক খুশি ছিলেন,আমাকে উনি সবচাইতে বেশি ভালোবাসতেন। আমি যখন ছোট ছিলাম,তখন সবার এমন ব্যবহার দেখে ভীষণ অবাক হতাম আমি। আমার ছোট্ট মনে অনেক প্রশ্ন উঠতো তখন।
ওরা এমন আশ্চর্য কেনো হতো আমাকে দেখে? আমি যা করছি তা কি অতি সাধারণ বিষয় নয়?এটা তো সবাই করতে পারে তাইনা?আমিতো ওদের মতোই সাধারণ মানুষ তাইনা? একদিন আমি এই প্রশ্নগুলো আমার বাবাকে করেই ফেলি। কিন্তু তখন বাবা আমার জীবনের সব থেকে বড়ো ভুল শিক্ষাটি আমাকে দিয়েছিলেন। তিনি আমাকে পরম স্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন,
“তুমি মোটেও ওই সাধারণ মানুষগুলোর একজন নও অরণ্য।
তুমি যা অনায়সে করতে পারো,তা তারা হাজারো অনুশীলন করেও করতে পারেনা,তাহলে তুমি তাদের একজন কিভাবে হতে পারো অরণ্য?
তোমাকে বিধাতা অপার প্রতিভা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন,তুমি অসাধারণ। আর এসব প্রতিভা তোমাকে কোনো কারণ ছাড়া দেয়নি তাইনা?
তোমাকে এতো ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে,তোমাকে অসাধারণভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে সাধারণদের উপর রাজত্ব করার জন্য।
এটাই তোমার জীবনের লক্ষ্য,এর জন্যেই জন্মেছো তুমি।
তোমাকে ক্ষমতা অর্জন করতে হবে,ক্ষমতাবানের আগে সবাই দুর্বল।
কেউ তোমার সামনে মাথা তুলে দাঁড়ানোর স্পর্ধাও করতে পারবেনা,সবাই মাথা নত করবে তোমার সামনে।”
বাবার কথাটা আমার পছন্দ হয়েছিলো,ভীষণ পছন্দ হয়েছিলো। অবশেষে আমি আমার জীবনের লক্ষ্য জানতে পারলাম। আমার প্রিয় বাবা যখন বলেছেন আমি সাধারণ কেউ নই তাহলে অবশ্যই আমি অসাধারণ।

(চলবে)