শ্যামারণ্য পর্ব-৩১+৩২+৩৩

0
691

#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ৩১
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন

আমার মা অসুস্থ থাকার কারণে সারাদিন বিছানাবন্দী থাকতেন যখন আমি ছোট ছিলাম। আমি সারাদিন দৌড়-ঝাপ করে এসে সাথে সাথে সবকিছু মা কে বলতাম, কিভাবে আমি নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করে এসেছি।

আর মা ছিলেন সব চাইতে আলাদা। বাকি সবাই আমার গুণের প্রসংশা করতো,সৎ মাগুলো ভাইয়েরা আমার মতো কেনো না তা নিয়ে বকতো তাদের,গ্রামের মানুষ আমাকে সম্মান করে চলতো,বাচ্চারা ভয়ে আমার সাথে তর্কে যেতোনা,বাবা পর্যন্ত খুশি আমার উপর। শুধু মা ই খুশি নন এগুলো নিয়ে।

তিনি সবকিছুতেই বাধা দিতেন আমাকে। যেমনঃ এতো বড়ো গাছে উঠবেনা,পড়ে গিয়ে ব্যথা পাবে,মা’রা’মা’রি করা ভালোনা,যাও ক্ষমা চেয়ে এসো,অস্ত্র চালনা কেনো শিখতে হবে?এসব বিপদজনক কাজ,আমি এখনো ছোট ইত্যাদি ইত্যাদি। উনি সবসময় খালি আমাকে বকতেন।
বিশেষ করে যেদিন আমি বাবার বলা কথাগুলো উনাকে বলেছিলাম যে আমার জীবনের উদ্দেশ্য কি তখন তিনি আঁতকে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিলেন।

আমাকে বুঝিয়ে বলেছিলেন,
“অরণ্য, তোমাকে বিধাতা এজন্য সাধারণ মানুষ থেকে বেশি ক্ষমতা দিয়েছেন যাতে তুমি তোমার সামর্থ্য দিয়ে তোমার থেকে দুর্বলদের রক্ষা করতে পারো।
মানুষকে ভালোবাসতে শিখো,তুমি যতটা দয়াশীল তাদের প্রতি হবে তারা ততোটা বেশি তোমাকে ভালোবাসবে।
ভালোবাসা পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো ক্ষমতা,এটা গায়ের জোরে এটা অর্জন করা যায়না।
যার কাছে ভালোবাসা নেই সে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নিঃস্ব।
কোনো ধন-সম্পদ ভালোবাসার অভাব পূরণ করতে পারেনা।
ভালোবাসার জোরে তুমি সবার মনের উপর রাজত্ব করতে পারবে,তুমি কখনো নিঃসঙ্গ হবেনা।
তাই ভালোবাসা হলো সবচেয়ে শক্তিশালী ক্ষমতা।
তোমার সক্ষমতা ভালোবাসা অর্জন করতে কাজে লাগাও অরণ্য।”

আমি শুনেছিলাম মায়ের সব কথা,মন দিয়ে শুনেছিলাম।
কিন্তু বিশ্বাস করতে পারিনি।
ভালোবাসা দিয়েই যদি সবার মনে রাজত্ব করা যায়,তাহলে তিনি কারো মনে জায়গা করতে পারেননি কেনো?
তিনি চাকরদের সাথে পর্যন্ত ভালো ব্যবহার করতেন,কই তারা তো উনাকে ভালোবাসে না?
উনি জমিদারনি, এই ‘জমিদারনি’ খেতাবটার ক্ষমতার জন্য সবাই উনার সামনে উনাকে সমীহ করে চললেও,আড়ালে ঠিকই উনাকে নিয়ে কটুক্তি করতো তারা।
মাকে ডা’ই’নী ডাকতো,মিথ্যা গুজব ছড়াতো তার নামে।
আমি অনেকবার তাদের হাতেনাতে ধরতে পেরে কঠোর শাস্তি দিয়েছি,এরপরে বাকিরা কেউ অন্দরমহলে মায়ের নামে ক’টুক্তি করার সাহস পায়নি।
তাহলে কি দাঁড়ালো?বাবা ঠিক,মা ভুল।
ক্ষমতার জোর যার আছে তার সামনে দুনিয়া ঝুঁকতে বাধ্য। সাধারণের প্রতি ভালোবাসা দেখাতে গেলে এরা তোমাকেই অবজ্ঞা করবে।
ভালোবাসা যদি সত্যি সব ক্ষমতার উর্ধ্বে হয়ে থাকতো তাহলে মা সবার চেয়ে ক্ষমতাবান হতো।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসা দুনিয়ার সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা।
এই দুর্বলতা থাকার কারণে মা নামে জমিদারনি হলেও কখনো প্রকৃতপক্ষে এর ক্ষমতা অর্জন করতে পারেননি।
কিন্তু বাবার অন্যান্য স্ত্রী গুলো মায়ের থেকে নীচু পদের হলেও তারা ঠিকই তাদের প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন।

আবার এই ভালোবাসা উনার আমার বাবার প্রতিও ছিলো। বাবাকে আমি আমার জন্মের পর থেকে কখনো মায়ের কক্ষে যেতে দেখিনি,বা তাঁদের হেসেখেলে কোনোদিন এক কাপ চা পান করতে দেখিনি। বাবা তার অন্যান্য স্ত্রী আর রক্ষি’তাগুলো নিয়ে মজে থাকতো।
আর মা শুধু নীরবে অশ্রু বিসর্জন করতো আর সব সহ্য করতো। বাবার এই দিকটা আমারও অনেক খারাপ লাগতো। বাবা আর কিছু না হোক,মায়ের সাথে মাঝে মাঝে কথা তো বলতে পারতো।
এখানে মা পুরোপুরি নিঃসঙ্গ,তার পরিবার নেই,কোনো বন্ধু নেই,চাকরগুলো দূরত্ব বজায় রেখে চলে তার সাথে,আমি ছাড়া উনার কেউ নেই কথা বলার,বাবাও তো একটু বুঝতে পারতো মায়ের কষ্টটা তাইনা?
কিন্তু উনি বুঝতোনা মায়ের ভালোবাসা,মা রূপসী নয়,সেজন্য মায়ের দিকে তাকাতেন না তিনি। মনের অজান্তেই তখন এই সৌন্দর্যের পূজারি মানুষগুলোকে ঘৃ’ণা করতে শুরু করি আমি।
কিন্তু সবচেয়ে বেশি ঘৃ’ণা আমার মায়ের ভালোবাসার প্রতি হতো। উনি কেনো কখনো কোনো প্রতিবাদ করেননি?
কেনো কখনো স্ত্রী হওয়ার অধিকার আদায় করতে যাননি বাকিদের মতো?
শুধু নীরবে ভালোবেসে অশ্রু বিসর্জন করে গিয়েছেন।
আবার এবং বারবার তিনি আমাকে প্রমাণ করেছেন ভালোবাসা একটি ভ্রম শুধু,এই ভ্রম এর পিছনে ছুটতে গেলে শুধু কষ্ট পেতে হবে,এই ভ্রম যার আছে সে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তি।
আর আমি বাবার কথামতো ক্ষমতাধর হতে চেয়েছিলাম,মায়ের মতো দুর্বল নয়। তাই এই ভালোবাসার সবগুলো বিপরীত পন্থি বৈশিষ্ট্য আমি নিজের মধ্যে ধারণ করেছিলাম।

আমার এমন চালচলন নিয়ে মায়ের সাথে প্রায়ই কথা কা’টাকাটি হতো আমার।
প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা ছিলো এগুলো যেনো,
বড়ো হতে হতে আমি মায়ের এই শাসনের উপর বিরক্ত হয়ে পড়ছিলাম। রাগের মাথায় কথা কা’টাকাটির সময় আমি প্রায়ই উনার দুর্বলতা গুলোর কথা তুলে উনাকে আক্র’ম’ণা’ত্মক কথা বলতাম।
যেগুলো শুনে মা অনেক কষ্ট পেতেন,আমার সামনেই কেঁদে ফেলতেন উনি।
আমি রাগ করে বেরিয়ে যেতাম সবসময়,মনে মনে পণ করতাম আর কখনো মায়ের কাছে যাবোনা আমি।
কিন্তু মা কখনো আমার প্রতি অভিমান দেখিয়ে দূরে সরে থাকতেন না।
রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে উনি তার দুর্বল শরীরটাকে টেনে নিয়ে আসতেন আমার ঘরে। আমি দড়জা খুললেই টের পেয়ে যেতাম,তবু ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকতাম।
মা এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন,কপালে চুমু খেতেন,তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকতেন শুধু। আমি নীরবে অনুভব করতাম শুধু।
মায়ের হাতের স্পর্শটা কেনো যেনো সবার থেকে আলাদা ছিলো।
বাবাও আমাকে স্নেহ করেন কিন্তু তার স্পর্শটা কেনো জানি মন পর্যন্ত পৌছাতো না,কারণ হয়তো বাবা আমার মাথায় এভাবে হাত বুলানোর পরেই আমার কাছে কিছুনা কিছু আশা,ইচ্ছা ব্যক্ত করতেন।
কিন্তু মা এভাবে মাথায় হাত বুলানোর পর আমার থেকে কিছুই চায়নি কখনো,উনি সবসময় আমাকে শুধু বিপদ এড়িয়ে চলতে বলেছেন যাতে আমার কোনো ক্ষতি না হয়।
তাই প্রতিবার আমার অভিমান এক রাতেই গলে যেতো,পরেরদিন আমি আবার যেতাম উনার বকা খাওয়ার জন্য।
কিন্তু আমি আমার মধ্যে উনার কথামতো কোনো পরিবর্তন আনার চেষ্টা করিনি।
আমার বিশ্বাসগুলোর প্রতি আমি অটল ছিলাম।

আমি মায়া,দয়া,ভালোবাসা নামক দুর্বলতাগুলো আমার মনে ঘর করতে দিইনি কখনো। আর আমার সৌন্দর্যের উপর মোহিত নারীগুলোকেও কখনো জীবনে ঠাঁই দিইনি,তাদের আমি চরম ঘৃ’ণা করতাম।
আমি ২১বছরে পড়তেই বাবা উনার জমিদারি ভার আমার হতে তুলে দেন। আমার হাতে জমিদারি তুলে দেওয়াটা ছিলো লোকমুখে।
আসলে আমার জমিদারিকালের সিদ্ধান্ত সব উনি নিয়েছেন।
উনি আমাকে বলেছেন,যাও অরণ্য ওই জমিগুলো দখল করে নাও,আমি তাই করেছি। উনি যখন বলেছেন এই গ্রামের জমিদারকে হটানো দরকার,আমি তাই করেছি। উনি আমাকে বলেছেন এরা বিরোধ করছে,এদের ফসলি জমি জ্বা’লিয়ে দাও,আমি তাই করেছি।
ধরতে গেলে এমন কোনো কাজ নেই যেটি তিনি তার ক্ষমতার জোরে করাতে পারেননি,তা আমাকে দিয়ে করিয়ে নেননি।

আর আমার মাথায় ভুলেও কোনোদিন এমন কোনো ভাবনা আসেনি যে আমি কোনো খারাপ কাজ করছি বা বাবা আমাকে শুধু ব্যবহার করছেন।
কখনো ভেবে দেখিনি আমার করা কাজগুলো শত শত মানুষের হাহাকারের কারণ হয়েছে,কতোগুলো মানুষ নিজের ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে,কতোগুলো মানুষ অনাহারে দিন পার করেছে আমার কাজগুলোর কারণে।
আমি তখন শুধু দেখেছিলাম বাবার কথামতো চলাতে আমার জমিদারি,আমার ক্ষমতা দিনদিন বেড়ে যাচ্ছিলো,পাতালঘরের সিন্দুকগুলো সোনাদানায় উপচে পড়ছিলো,মানুষ আমার নাম শুনেই ভয়ে কাঁপতো,আমার বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস কোনো বড়ো জমিদারও দেখাতো না,ইংরেজ সাহেবরা রীতিমতো মতো আমার পায়ে পড়েছিলো তাঁদের ব্যবসার জন্য।
বাবা অত্যন্ত খুশি ছিলেন,আমিও অনেক সন্তুষ্ট ছিলাম আমার অবস্থান নিয়ে।

কিন্তু মা ততোটাই অসন্তুষ্ট ছিলেন আমার প্রতি। আমাদের মনোমালিন্যগুলো আমার জমিদারি হাতে নেওয়ার পর থেকে বিরোধে রূপ নেয়। মা এক সময় আমার সাথে কথা বলা ই বন্ধ করে দিলেন। কখনো অন্দরমহলে দুজন সামনা সামনি পড়ে গেলেও তিনি মুখ ফিরিয়ে চলে যেতেন।
মায়ের এই পরিবর্তন আমাকে অনেক কষ্ট দিতো,জানি মা তার থেকেও বেশি কষ্টে আছেন। নয়তো তিনি এভাবে নিজের ছেলের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন না।
কিন্তু আমার পক্ষে উনার কথাগুলো মেনে নেওয়া অসম্ভব ছিলো।
তাই আমি মাকে নিজের হালে ছেড়ে দিলাম,তিনি আমার সাথে অভিমান করে বেশিদিন থাকতে পারবেন না। একদিন ঠিকই আবার আমাকে সব ভুলে কাছে টেনে নিবেন তিনি।
কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে,মা সত্যিই আমার থেকে নিজেকে দূর করে ফেলেছিলেন। দিন পেরিয়ে মাস পেরিয়ে বছরও কেটে যায়,কিন্তু মা নিজ থেকে তার অভিমান ভুলে আমার মাথায় হাত আর বুলিয়ে দেননি,আমিও নিজের জিদ ভুলে উনার সামনে মাথা নত করতে পারিনি। তাই আমাদের সম্পর্কটা আর ঠিক হয়ে উঠেনি।

এভাবেই পাঁচটা বছর পেড়িয়ে যায়। তারপরেই আমার জীবনে আসে ১০৪বছর আগের সেই অনাকাঙ্ক্ষিত দিনটি।
হঠাৎ করে বাবার ডাক পড়ে আমার জন্য।
সবে বিকেল তিনটা তখন। আমি তখন জমিজমার কাজ তদারকি করতে ব্যস্ত।
তবে বাবার ডাক কক্ষনো ফেলিনি আমি,চলে গেলাম তার সাথে দেখা করতে।

————————————————————————–
= ফ্ল্যাশব্যাকঃ ১০৪বছর আগের অভিশপ্ত দিনটি =
————————————————————————–
অরণ্য যখন বসার ঘরে প্রবেশ করলো,জমির তালুকদার তখন সোফায় বসে হুক্কা ফুঁকছিলেন। গায়ে সাদা পাঞ্জাবী আর লুঙ্গি,মেহেদী দেওয়া লাল দাঁড়ি,কালচে হয়ে যাওয়া দুটি ঠোঁট,ভাবলেশহীন মুখশ্রী,পায়ের উপর পা তুলে আয়েশ করে বসে আছেন তিনি। তার দুই পাশে তার দুই সুন্দরী দাসী হাওয়া করছেন তাকে।
পায়ের কাছে মাথা নিচু করে হাটু গেড়ে বসে আছে তার সৎ ভাই রোকন।
অরণ্য এগিয়ে আসতে আসতে একবার ভ্রু কুঁচকে তাকালো সেদিকে।
অরণ্যকে আসতে দেখে জমির তালুকদার তার হুক্কা সরিয়ে রাখে একপাশে,তার রুক্ষ চেহারায় হাসি ফুটে যখন তিনি বলেন,
“এইতো আমার একমাত্র সক্ষম ছেলেটা এসে গিয়েছে। তোমাকে ছাড়া আমি কি করতাম জানিনা বাবা অরণ্য। এতোগুলো ছেলের মধ্যে একমাত্র তোমাকেই পুরুষ বানাতে পারলাম। বাকিগুলো শুধু গায়ে গতরেই বড়ো হয়েছে, তিনবেলা গেলা আর গঞ্জে গিয়ে মেয়ে নিয়ে ফূর্তি করা ছাড়া কিছুই পারেনা অ’কর্মাগুলো।”

বলতে বলতে পায়ের কাছে বসে থাকা রোকনের দিকে নাক ছিঁটকে তাকালেন তিনি। পাশের দাসীগুলোও ঠোঁট চেপে হেসে উঠলো হেসে উঠলো এই কথা শুনে।

রাগে অপমানে রোকনের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায়। কথাটি যে তাকে কটাক্ষ করে বলা হয়েছে তা বুঝতে কারো বাকি নেই।
সে চোখের কোণা দিয়ে একবার তাকালো তার ভাই অরণ্যের দিকে।
কালো রঙের পাঞ্জাবির সাথে সাদা পাজামা পড়ে আছে,অত্যন্ত সুদর্শন ও সক্ষম এই ব্যক্তিটির জন্য সারাজীবন তার নরক হয়ে গিয়েছে। ছোট থেকে উঠতে বসতে সব ভাইকে এই লোকের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
তারা ভাইয়েরা রূপে গুণে এতো খারাপ নয়,কিন্তু এই লোকটির পর্যায়ে শত চেষ্টা করেও পৌছানো অসম্ভব।
অবশ্য সম্ভব হবে কি করে?তারা তো আর তার মতো ডা’ই’নীর পেট থেকে জন্ম নেয়নি,রোকন মনে মনে কটাক্ষ করে ভাবে।

অরণ্য তার হিংসাভরা দৃষ্টি পুরোপুরি অবজ্ঞা করে। লোকের হিংসা ভরা দৃষ্টি তার গা সওয়া হয়ে গেছে। তার অবশ্য রাগ হয়না এদের হিংসা দেখলে,গর্ব হয়। এই সাধারণ মানুষগুলো যতই চেষ্টা করুক,তার থেকে নীচুই থাকবে।
সে মুচকি হেসে বাবার কাছের সোফায় বসতে বসতে বলে,
“তা তোমার একমাত্র সক্ষম ছেলেকে এই সময় কি কারণে ডাকলে বাবা?”

অরণ্যের খোঁচাটা বেশ গায়ে লাগে রোকনের,সে রাগী চোখ তুলে তাকায় তার দিকে। অরণ্য ওকে রাগাতে পেরে মনেমনে বেশ মজা পেলো,সে আরেকটু ঘাটানোর জন্যই গম্ভীরমুখে জিজ্ঞেস করলো,
“ছোটভাই এভাবে হাটু গেড়ে মাটিতে বসে আছে কেনো বাবা?তার দুই মণের ভুড়িটা নিয়ে এভাবে বসতে কষ্ট হচ্ছেনা?সোফায় গা এলিয়ে বসো ভাই,আমার টাকায় নিজে পছন্দ করে কিনেছি সাহেবি সোফাটা।তুমি আর তোমার ভুড়ি দুজনেই নিশ্চিন্তে বসতে পারো,ভেঙ্গে পড়ে যাবেনা তোমরা।”

রোকন এবার প্রচন্ড রেগে যায়,সে একটু মোটা বলে এই ছেলেটা তাকে বারবার এই নিয়ে খোঁচায়। সে রেগে তেড়ে যেতে নেয় তার দিকে কিন্তু জমির তালুকদারের ধ’মকে সম্বিৎ ফিরে তার,
“বে’য়াদব ছেলে! সাহস কি করে হয় গ্রামের জমিদারের গায়ে হাত তোলার চেষ্টা করার?বড়ভাই হিসেবে একটু মশকরা করেছে তোমার সাথে,এটুকু নিয়ে তেড়ে আসো কোন সাহসে?
আমার ছেলের টাকায় খেয়ে পড়ে শরীর বাড়িয়েছো,এখন তার দিকে ফনা তুলছো অকৃতজ্ঞ? বেড়িয়ে যাও আমার চোখের সামনে থেকে!এখন থেকে দুদিন তোমার খাবার বন্ধ,এটাই তোমার শাস্তি!”
রোকনের অপমানে চোখে পানি চলে আসে। সে আর এক মুহুর্তও সেখানে না দাঁড়িয়ে চলে যায় সেখান থেকে।

অরণ্য বেশ খুশি হয় মনেমনে,এভাবেই এদের নিজের অবস্থান বুঝিয়ে দিতে হয় মাঝে মাঝে,তাহলে তার দিকে এভাবে চোখ তোলার আগে আরেকবার ভাববে। আর তাকে সমর্থন করার জন্য বাবা তো আছেনই,বাবাকে সে অনেক বিশ্বাস করে। দুনিয়া উল্টে গেলেও বাবা তার পক্ষে থাকবে। সে এবার দায়সারা ভাবে বলে উঠে,
“এসব ছাড়ো বাবা,কীজন্য ডেকেছিলে জলদি বলো। তুমিতো জানোই এই সময়ে কতো কাজ থাকে আমার।”

জমির তালুকদার তার কাঁধ চাপড়ে বলেন,
“আমি জানি তুমি তোমার কাজের প্রতি কতোটা দ্বায়িত্বশীল।
কিন্তু এদিকে একটা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে যা সমাধান হচ্ছেনা। তাই না পারতে তোমাকে ডাকতে হলো।”

অরণ্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
“কি সমস্যা বাবা?”

(চলবে)

#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ৩২
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন

“কোন পা’গ’ল বুড়োর উপদ্রব শুরু হয়েছে গ্রামে।
পশ্চিম দিকের আমাদের আম বাগানের সব আম নাকি সেই বুড়ো পেড়ে রাতারাতি গ্রামের সবাইকে বিলিয়ে দিয়েছে। তারপর নাকি সেই আম বাগানেই আস্তানা গেড়ে বসেছে। লোকমুখে খবর এসেছে।”

অরণ্যের কুঞ্চিত ভ্রু আরও খানিকটা গভীর হলো,
“কি?! বাবা আজ রিচার্ড সাহেব নিজে আসবেন বলে জানিয়েছেন আমের পেটিগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য,আমিতো ভেবেছিলাম ইতোমধ্যে তা পেটিতে ভরা হয়ে গিয়েছে।”

“সেটাই তো বলছি। সকাল থেকে দুই দুইবার লোক পাঠিয়েছি আম তুলে আনার জন্য,না ওদের কোনো খবর এসেছে না বাগানের প্রহরীর।
তার মধ্যে কানে আসলো এমন সব কথা।আর না পেরে রোকনকে পাঠাতে চাইলাম,সে না গিয়ে আহার করতে বসে গিয়েছে। একটু আগে ওকে এ নিয়েই কথা শুনাচ্ছিলাম আমি।
তাই বলছি ওদেরকে আমি আর ভরসা করতে পারছিনা,
তুমি নিজে গিয়ে একবার দেখে এসো ব্যাপারটা।”

“জ্বি বাবা,আমি এক্ষুনি যাচ্ছি। রিচার্ড সাহেব অনেক বড়ো বণিক,আমি চাইনা কোনো পা’গ’লের উপদ্রবের কারণে আমাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক খারাপ হোক।”

জমির তালুকদার নীরবে মাথা দুলিয়ে সায় দেয়। অরণ্য উঠে পড়ে বাগানে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
চারুলতা তখন সিড়ি বেয়ে নীচে নামছিলেন। শরীরের ব্যথার কারণে আস্তে-ধীরে হাঁটেন তিনি। এই সময়ে প্রায়ই তিনি পুকুরপাড়ে একা সময় কাটাতে যান।
নামতে নামতে বসার ঘরের সব কথা ই তিনি শুনেছেন।
এক সাথে বেরোনোর সময় দড়জার কাছে মুখোমুখি পড়ে যান মা-ছেলে।

চারুলতা তার দিকে না তাকিয়ে চলে যেতে গিয়ে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে নেয়,কিন্তু অরণ্য তড়িৎ গতিতে গিয়ে তাকে ধরে ফেলে।
অরণ্য চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করে,
“মা তুমি এভাবে অসুস্থ শরীরে একা হাঁটছো কেনো?সাথে কোনো দাসী নাওনি কেনো?”

চারুলতা হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নেয় নিজেকে,তারপর অভিমানী কন্ঠে বলে,
“তোমার ওই র’ক্তমাখা অপবিত্র হাত দিয়ে কক্ষণো ছোঁবেনা আমাকে। আর আমি একা থাকতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করি।”
বলেই চলে যান তিনি সেখান থেকে।
অরণ্য আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার যাওয়ার পানে।

সাথে দুজন রক্ষী নিয়ে অরণ্য চলে যায় গ্রামের পশ্চিম দিকের আম বাগানের দিকে। নির্জনা কুঠি থেকে বেশ খানিকটা পথ হেটে যেতে হয় সেখানে।
পুরো পাঁচ বিঘা জমি নিয়ে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা বিশাল আম বাগান তাদের।
সেখানে পৌছে বাগানের প্রবেশপথে কোনো প্রহরী বা বাবার পাঠানো কোনো লোককে দেখতে না পেয়ে রাগ উঠে যায় তার।
সে দ্রুতকদমে প্রবেশ করে বাগানের ভেতর। কয়েকবার নাম ধরে ডাকার পরেও কেউ সাড়া না দিলে সে আরও গভীরে এগুতে থাকে বাগানের।
অবশেষে কিছুদূর গিয়ে একজন প্রহরীর দেখা মিলে তার,তাকে অনেক বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে।

অরণ্য রেগে জিজ্ঞেস করে তাকে,
“বাগানের প্রবেশমুখ এভাবে ফেলে রেখে তুমি এখানে কি করছো?তোমাকে কি এই জন্য মাইনে দিয়ে রাখা হয়েছে?আসার পথে দেখলাম গাছের সব পাকা আম আর নেই। তার মানে সত্যিই চুরি হয়েছে। তোমাদের গাফিলতির কারণে কতো বড়ো ক্ষতি হয়েছে কোনো ধারণা আছে তোমার?”

প্রহরী এদিকে থরথর করে কাঁপছে অরণ্যের ধমক শুনে,সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে,
“ক্ষমা করবেন জমিদার বাবু,কিন্তু বিশ্বাস করুন এখানে অতিপ্রাকৃত কিছু ঘটছে কাল রাত থেকে।
রাতে আমি বাগানে কিছু শব্দ শুনে চোর এসেছে ভেবে দেখতে আসি বাকি প্রহরীদের বাইরে রেখে।
এখানে এসে আমি গাছের নীচে এক বুড়োকে বসে থাকতে দেখতে পাই। তার চোখে চোখ পড়ার সাথে সাথেই যেনো আমি কোনো ঘোরের মধ্যে চলে যাই। যখন ঘোর কাটে তখন আমি আর কাউকে দেখতে পাইনি। অনেক খুঁজেও আমি সেই বুড়োকে আর দেখতে পাইনি। অবশেষে আমি ফিরে আসতে নিই। কিন্তু অনেক খুঁজেও আমি বাইরে যাওয়ার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কাল রাত থেকে আমি এখানে এভাবেই পথ খুঁজে চলেছি।”

অরণ্যের রাগে মাথার রগ ধপধপ করে কাঁপতে থাকে,
“একেতো তোমরা তোমাদের দ্বায়িত্বের গাফিলতি করেছো,তার উপর এখন আজগুবি কাহিনি শোনাচ্ছো আমাকে?আর বাকিরা কোথায়?”

“আমি জানিনা মনিব তারা কোথায়। আমি সত্যি কোনো আজগুবি কাহিনি শোনাচ্ছি না। আমার মনে হচ্ছে কাল রাত থেকে আমি চক্রাকারে এক জায়গায় ঘুরে চলেছি। বাকিরা বাইরে না থাকলে আমার মনে হয় বাকিদের সাথেও এটাই ঘটেছে।”

অরণ্যের মেজাজ বিরক্তির শেষ সীমানায় গিয়ে ঠেকে এসব আজগুবি কথাবার্তায়,
“চুপ! একদম চুপ! এক্ষুনি আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও,তোমাদের সবার শাস্তির ব্যবস্থা পরে করছি আমি। এর আগে আমি সেই বুড়োকে দেখতে চাই। দেখি কার এতো ক্ষমতা যে অরণ্য তালুকদারের জিনিসে হাত দেয়। এমন শাস্তির ব্যবস্থা করবো যে অন্য কেউ এই দুঃসাহস দেখানোর কল্পনাও করবেনা কখনো।
গুজব যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে এই আম বাগানের কোথাও লুকিয়ে আছে এই বুড়ো। আমি নিজেই খুঁজে বের করবো তাকে।”

অরণ্য সাথে আনা রক্ষীদের অন্যদিকে খুঁজতে বলে সামনের দিকে আগাতে থাকে। মেজাজ প্রচুর বিগড়ে আছে তার। এখান থেকে বেরোতে পারলে এর সাথে জড়িত একটাকেও ছাড় দিবেনা।
সে হাঁটতে হাঁটতে একদম বাগানের শেষ মাথায় পৌছে যায়,পথিমধ্যে কাউকে খুঁজে না পেয়ে সে এবার রেগে হুংকার ছাড়ে,
“আমার বাগানে এসে ঘাটি গাড়ার সাহস দেখিয়েছিস,তাহলে এখন লুকিয়ে আছিস কেনো?সাহস থাকলে সামনে আয়!”

“কথাটা কি আমাকে বললি নাকি?”

হঠাৎ পিছন থেকে কারো আওয়াজ ভেসে আসায় চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকালো অরণ্য।
তার সামনের গাছটার নীচেই বুড়োটি বসে আম খাচ্ছে। পড়নে ছেড়া আলখেল্লা,মাথায় লাল রংচটা গামছা বাধা,মুখে একগাল সাদা দাড়ি। তাকে পিছন ফিরে তাকাতে দেখে হাতের আমের আটি ফেলে দিয়ে কাধে তার পুটলি ঝুলিয়ে লাটিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো বৃদ্ধটি।

অরণ্য আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ সেদিকে,সে হলফ করে বলতে পারে যে একটু আগে সে যখন এই গাছটি পার করে এসেছে সেখানে কেউ ছিলোনা।
তবে সে সেসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে বুড়োকে জিজ্ঞেস করে,
“তুই ই তাহলে সেই চোর? তোকে দেখে আমি অবাক হচ্ছি,এই শরীরে তুই এতোগুলো আম কিভাবে চুরি করেছিস?তোর আর কোনো সাথী আছে নাকি?সত্যি করে বল!”

বৃদ্ধ ফকির হঠাৎ রেগে যায়,রাগী কন্ঠে সে বলে উঠে,
“বেয়াদব মানুষ! আমাকে চোর বলিস কোন সাহসে?! মুখ সামলে কথা বল”

“একেতো আমার বাগানের আম চুরি করেছিস,তার উপর জমিদার অরণ্য তালুকদারের সাথে তুই তুকারি করছিস?! আর আমার সামনেই আমের আঁটি ফেললি তুই,তবু বলছিস কেনো চোর কেনো বলছি তোকে?”

“তোর বাগানের আম মানে? এই মাটি,এই জমি সৃষ্টিকর্তার,আর এই ফল তার নেয়ামত। এই ফল খাওয়ার অধিকার সকল জাতির রয়েছে। একে তুই একাধারে তোর বলে দাবি করিস কোন প্রেক্ষিতে?
সাবধান করে দিচ্ছি ছেলে,আরেকবার আমাকে চোর অপবাদ দিবিনা! তুই জানিস না কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিস তুই!”

অরণ্যের পুরো শরীরে জ্ব’লুনি ধরে যায় এমন কথা শুনে,সে হিসহিসিয়ে বলে উঠে,
“তুই জানিস?তুই কার সামনে কথা বলছিস?আমি আশেপাশের দশ গ্রামের জমিদার,এই ভূমির মালিক আমি,এখানের সমস্ত ফলন আমার!”

“কিসের জমিদার তুই?তুই যদি জমিদার হয়ে থাকিস,এই ভূমির মালিক হয়ে থাকিস তাহলে এই ভূমিতে বসবাসরত মানুষগুলোও কি তোর আপন নয়?এই গ্রামে এতো ফল থাকতে,এতো শস্য থাকতে তোর মানুষগুলো না খেয়ে থাকে কেনো তাহলে?”

অরণ্য বাঁকা হেসে তাচ্ছি’ল্যের সুরে বলে,
“ওহহ…তাই বুঝি তুই চুরি করে সেই ফল সবাইকে বিলিয়েছিস?বেশি মায়া হচ্ছিলো তাদের প্রতি?
তুই ঠিক বলেছিস,এখানে বসবাসরত মানুষগুলোও আমার,তাই আমি ওদের বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু প্রয়োজন সব দিয়েছি।
মানুষের বাচ্চা ওরা,মানুষ না খেয়ে এক সপ্তাহ বেঁচে থাকতে পারে আর খাওয়ার পানি থাকলে তো অনায়াসে দুই-তিন মাস বেঁচে থাকতে পারে তারা।
এই গ্রামে যেহেতু এই পর্যন্ত না খেতে পেয়ে কেউ মা’রা যায়নি,তার মানে আমি ওদেরকে যথেষ্ট দিয়েছি বেঁচে থাকার জন্য,তাই নয়কি?
ওদের মতো সাধারণ দুর্বল মানুষগুলো এর চেয়ে বেশি দিয়ে কি করবে?ওরা তো শুধু বেঁচে থাকার জন্যই আহার গ্রহণ করে,ওদের জীবনের কোনো মূল্য আছে নাকি?
আর যেসব সাধারণ মানুষগুলোর জন্য তুই চুরি করতে গেলি,এখন আমি তোকে কোমড়ে দড়ি বেঁধে তাদের সামনে টানতে টানতে বন্দী করে নিয়ে যাবো,
কিন্তু তোর ওই অকৃতজ্ঞ মানুষগুলো একবার তোকে বাঁচানোর জন্য মুখ ফিরে তাকাবেনা পর্যন্ত এদিকে।
কারণ কি জানিস?
কারণ এই দুনিয়ায় মায়া,দয়া,ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই। আমি তাদের খেতে দিইনি,কিন্তু তারা তবুও আমাকে ঝুঁকে সালাম করবে এখন দেখলে। আর তুই তাদের মায়া দেখিয়ে খেতে দিয়েছিস। তাদের ভালো করতে গিয়ে তোর শাস্তি হবে, কিন্তু তারা তোকে একবারও রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসবেনা।
মানুষ জাতটা এতোটাই অকৃতজ্ঞ। তাদের প্রতি ভালোবাসা দেখাতে নেই।
কারণ তারাও জানে কে ক্ষমতাবান আর কে দুর্বল।
দুর্বলের পক্ষে কেউ থাকেনা,হোক সে যতোই ভালো।
যেমন আজ তোর পক্ষে কেউ থাকবেনা।”
বলেই অরণ্য এগিয়ে আসতে নেয় বৃদ্ধকে ধরার জন্য।

কিন্তু বৃদ্ধ ফকির হঠাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে তখন যেনো বেশ মজার কিছু শুনেছেন তিনি,সেই সাথে আশেপাশে প্রবল জোরে বাতাস বইতে থাকে,যেনো এক্ষুনি কোনো বড়ো ঝড় আসবে। অরণ্য চমকে উঠে হঠাৎ আবহাওয়ার আকস্মিক পরিবর্তনে।

বৃদ্ধ ফকির হাসতে হাসতে তার দাঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বলে,
“তোর ক্ষমতার অনেক লোভ,অনেক দম্ভ তোর ক্ষমতার উপর তাইনা জমিদার? ক্ষিধের জ্বা’লা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন জ্বা’লা এটুকু পর্যন্ত বোধ করার অনুভূতি নেই তোর মাঝে। মানুষের প্রতি মায়া,মমতা,ভালোবাসা তোর তুচ্ছ মনে হয়। গায়ের জোর,ক্ষমতার জোর সবকিছুর উর্ধ্বে,বাকি কোনো সম্পর্ক তোর প্রয়োজন নেই তাইতো?
তোকে আমার পছন্দ হয়েছে ছেলে।
আমরা জ্বীনেরা প্রায়ই এমন,আমাদের আশ্চর্য সব ক্ষমতা রয়েছে,কিন্তু আমাদের সাধারণ মানুষকে ভালোবাসা বারণ,নিয়মবিরুদ্ধ এটা।”

বৃদ্ধ ফকির বলতে বলতেই তার পুটলি থেকে এক লম্বা কালো শিকল বের করে এনে আকাশের পানে তুলে ধরে,
“তোর ভেতরের মানুষ সত্ত্বা প্রচন্ড দুর্বল,একে দিয়ে তোর কোনো কাজ নেই। তোকে আমার মনে ধরেছে তাই আমি তোকে এই জ্বিন সত্ত্বা উপহার দিলাম। আজ থেকে এই শেকল হবে তোর সকল ক্ষমতার আধার,
তোর মানুষ সত্ত্বাকে দিনের আলোতে তিলে তিলে গিলে খাবে এই জ্বিন সত্ত্বা,রাতের প্রথম দুই প্রহর তোকে তার প্রদত্ত আঘা’ত নিরাময়ের সুযোগ দিবে আর শেষ দুই প্রহরে দিবে তার সব ক্ষমতা।
তোকে অমরত্ব প্রদান করে চিরকালের জন্য ক্ষমতাবান করবে তোর জ্বিন সত্ত্বা।
জ্বিন দের কোনো সাধারণ মানুষকে ভালোবাসা নিয়ম বিরুদ্ধ,নিয়ম ভঙ্গ করলে প্রাণনাশ হবে তার।
আবার কোনো সাধারণ মানুষের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ই পারে এই শেকল ছিন্ন করে তোর জ্বীন সত্ত্বাকে মুক্তি প্রদান করতে।
কোনোদিন যদি তোর এই প্রাপ্ত ক্ষমতার বদলে তুই কি কি হারিয়েছিস,ক্ষমতার লোভে কতোটা ভুল করেছিস বুঝতে পারিস তাহলে খুঁজে নিস এমন এক মানুষকে যে নিঃস্বার্থভাবে শুধু তোকে ভালোবাসবে।
চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদকে যখন অন্ধকার পুরোপুরি গ্রাস করবে তখন এই শেকল রাতের বেলা দৃশ্যমান হবে আর তোর জ্বিন সত্ত্বা সেই মূহুর্তে হবে শক্তিহীন,তখনি সেই মানুষ এই শেকল ছিন্ন করতে পারবে তোর দেহ থেকে আর তুই মুক্তি পাবি এই জীবন থেকে।”

বৃদ্ধ লোকটির কথা শেষ হবার পরপরই যেনো নেতিয়ে থাকা সেই শেকলটি জীবন্ত হয়ে উঠে। বৃদ্ধের হাত থেকে উড়ে এসে সোজা ঢুকে যায় অরণ্যের বুকে।
অরণ্য এতোক্ষণ আশ্চর্য হয়ে তাকিয়েছিলো,লোকটা কি বলছে কিছুই বোধগম্য হয়নি তার,তার সাথে কি হতে চলেছে কোনো ধারণা ছিলোনা তার।
সে বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়েছিলো যখন ফকিরের হাতের সেই শেকল জীবন্ত হয়ে উঠে,তার কিছু বোধগম্য হওয়ার আগেই সেই শেকল তার বুকের ভেতর ঢুকে যায়,সাথে অনুভব হয় সারা শরীরে অমানুষিক এক যন্ত্রণা,সেই ব্যথার তাড়না এতোটাই তীব্র ছিলো যে সে প্রচন্ড জোরে আত্মচিৎকার করে উঠে।
বৃদ্ধ ফকির মিলিয়ে যায় সেখান থেকে,সাথে সাথে মিলিয়ে যায় সেই আম বাগানে সৃষ্ট মায়াজাল।
মায়াজালে আটকে পড়া প্রতিটা প্রহরী এবং রক্ষী শুনতে পায় সেই আর্তনাদ।
তারা ব্যস্ত পায়ে ছুটে আসে যেদিক থেকে সেই আওয়াজ এসেছে।

(চলবে)

#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ৩৩
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন

বর্তমানঃ
======
শ্যামা অবাক হয়ে মাথা তুলে তাকায় অরণ্যের মুখের দিকে। অরণ্য বুঝতে পেরে বললো,
“হ্যাঁ এই বৃদ্ধ ফকিরটির সাথে নাকি তোমার দেখা হয়েছে। তার সাথে আমার আবার দেখা হয়েছিলো কিছুদিন আগে, এটা তিনি বলেছিলেন আমাকে। সেই কথাও পরে আসবে।”

শ্যামা মাথা নামিয়ে আবার অরণ্যের বুকে মাথা রেখে বলে,
“তারপর কি হয়েছিলো?”

“তারপর শুরু হয় আমার এই অভিশপ্ত জীবন। সেই বিকেলে আম বাগানে জ্ঞান হারিয়েছিলাম আমি।
আমাকে যখন রক্ষীরা বাড়ি নিয়ে আসে সবাই ভেবেছিলো আমি অসুস্থ।
এমনকি সন্ধ্যায় জ্ঞান ফেরার পর আমিও বিষয়টাকে মনের ভুল ভেবে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম।
আমার অসুস্থতার কথা শুনে মা পর্যন্ত সব অভিমান ফেলে সেদিন আমার ঘরে ছুটে এসেছিলেন।
আমি সবাইকে আশ্বস্ত করেছিলাম সেদিনের মতো।
কিন্তু আসল ভীবিষিকা শুরু হয় পরের দিন থেকে।
তখন আমার অবস্থা বর্তমানে যা দেখেছো,তার চেয়েও করুণ ছিলো।
দিনের প্রহর শুরু হতেই আকস্মিক শুরু হয় শরীরের অসহ্য যন্ত্রণা,যেনো আমার শরীরের সব অঙ্গকে সহস্র চাকু দিয়ে একসাথে আঘা’ত করা হচ্ছে।
জানালা গলে আসা সূর্যের আলো যেনো ঝলসে দিচ্ছে আমার পুরো শরীর,আমাকে আষ্টেপৃষ্টে পেঁচিয়ে রেখেছে এই শেকল,নড়তেও পারছিলাম না আমি।শুধু ব্যথায় আর্তনাদ করা ছাড়া আমি আর কিছুই করতে পারছিলাম না।

আমার চিৎকার শুনে বাবা-মা সবাই ছুটে আসে আমার ঘরে। সেদিন এক আশ্চর্যের ব্যাপার আবিষ্কার করি আমি।
এই শেকল আমি ব্যতীত আমার মা ছাড়া কেউ দেখতে পায়না। মা তো আমার এই অবস্থা দেখে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। বাকিরা শুধু ধরে নিলো আমি অসুস্থ।
তাদেরকে মা শেকলের কথা জানালেও তারা মায়ের কথা পা’গলের প্রলাপ ভেবে গুরুত্ব দেয়নি।
সেদিন প্রথমবার টের পাই আমি যন্ত্রণা কি জিনিস,গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে,পেটের ক্ষিধে অনুভব হচ্ছে কিন্তু আমি একটা আঙুল নাড়ানোর অবস্থায় পর্যন্ত নেই,কিছু খাওয়া দূরের কথা।
সারাদিনের যন্ত্রণা শেষে সন্ধ্যায় আমি নেতিয়ে পড়ি,
রাত বারোটায় হুঁশ ফিরে আমার,তখন শরীরে এক আশ্চর্য পরিমাণ শক্তি অনুভব করি আমি,যেনো আমি যেকোনো কিছু করতে পারবো এই মুহুর্তে।

কিন্তু সেই ক্ষমতাগুলো কি,এদের কিভাবে ব্যবহার করতে হয় তখন আমি কিছুই জানতাম না,আর সেই মুহুর্তে জানার অবস্থাতেও ছিলাম না আমি।
চরম আতঙ্ক আমাকে তখন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছিলো,জীবনে প্রথমবার ভয় নামের অনুভূতিটার সাথে পরিচয় হয় আমার।
চোখ খুলে যখন আমার শিয়রে মাকে বসে থাকতে দেখি আমি তখন ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে আম বাগানে ঘটে যাওয়া সবকিছু জানাই তাকে।
সব শুনে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন,কিন্তু পরে তিনি আশ্বস্ত করেন আমাকে। অন্য কেউ সেই শেকল দেখতে পায়নি কিন্তু তিনি পেয়েছেন। তার মানে তিনি পারবেন এই অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে আমাকে। এখন শুধু চন্দ্রগ্রহণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
তখন আমি সত্যি একটু আশ্বস্ত হয়েছিলাম,তাহলে আমাকে বেশি অপেক্ষা করতে হবেনা। মা ই সেই ব্যক্তি যে আমাকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসে।

সকাল বেলা মা বাবাকে আমার সব খুলে বললেও তিনি বিশ্বাস করেননি। তার কথা হলো যদি ভালোবাসার মানুষই সেই শেকল দেখতে পারে,তাহলে তিনি দেখতে পাচ্ছেন না কেনো?
তিনি কি আমাকে মায়ের থেকে কম ভালোবাসেন নাকি?উল্টো মায়ের থেকে বেশি ভালোবাসা দিয়েছেন তিনি আমাকে। এই প্রশ্নটা আমার মনেও এসেছিলো কিন্তু এর উত্তরের জন্য আমাকে বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি।

বাবা যেহেতু বিশ্বাস করেননি আমার অভিশপ্ত হওয়ার কথা,তাই আমার অবস্থাকে অসুস্থতা হিসেবেই গণ্য করা হলো।
তিনি আমার জন্য ডাক্তার,কবিরাজ,ওঝা সব ধরনের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু ফলাফল শূন্য।
কেউ এই রোগ ধরতে পারলো না,সবার একি জবাব যে
এটা বড়ো দুরারোগ্য অসুখ ,এটা থেকে সেড়ে উঠা অসম্ভব।
বাবা অনেক আশাহত হয়েছিলেন এবং তারচেয়ে বেশি আশাহত হয়েছিলাম আমি।
দিনের পর দিন এই অমানুষিক যন্ত্রণা সহ্য করার সময় যখন চরম ভয় আমাকে গ্রাস করতো,তখন কোনো নিরাময় থেকেও বেশি চাইতাম আমার পাশে কেউ থাকুক,আমার ভয় কম লাগবে। মা সবসময়ই ছিলেন আমার পাশে,কিন্তু বাবা একবারও এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেননি সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি তার আরও ভিন্ন রূপ দেখেছিলাম যখন তিনি বুঝলেন আমি আর সেরে উঠবো না।
ইতোমধ্যে তিনি আমায় দেখতে আসা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তার চিন্তা তখন এই জমিদারি ভার কে সামলাবে,নতুন জমিদার কে হবে,ব্যবসাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে কিনা এসব নিয়ে।
আমি আমার ঘরে বসে সব দেখতে এবং শুনতে পেতাম আশ্চর্যজনকভাবে।
আমর জ্বিন সত্ত্বা রাত বারোটার আগে তার সব ক্ষমতা আমাকে না দিলেও,সে আমার শরীরের অংশ। তার দৃষ্টিশক্তি এবং শ্রবণশক্তি প্রচন্ড প্রখর ছিলো।
সে দিনের বেলায়ও ইচ্ছে করে আমাকে এসব দেখাতো এবং শোনাতো,যেনো আমার কষ্টের মাত্রা আরও বাড়াতে চায় সে।
আমি সত্যি অনেক কষ্ট পাচ্ছিলাম তখন।
নিজের প্রিয় বাবা যাকে আমি ছোট থেকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করতাম তার এমন স্বার্থপর ব্যবহার,যেনো আমি কোনো অকেজো যন্ত্র যার ব্যবহার ফুরিয়ে গিয়েছে তাই তাকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে, যে মানুষগুলো আমার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে চলতো তারা এখন আমাকে আর গোনায় ধরেনা,সৎ মা আর সৎ ভাইদের আনন্দ উল্লাস সবকিছু আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছিলো।

এতোকিছুর মাঝে শুধু একটা মানুষ আমার পাশে ছিলো,সেটা হলো আমার মা।
সকাল থেকে রাত পুরোটা সময় তিনি আমার পাশে থাকতেন।তার অসুস্থ শরীর নিয়ে একাই আমার শুশ্রূষা করতেন।
আমার অন্ধকার সময়ের একমাত্র আলো ছিলেন আমার মা।
আর কেউ বিশ্বাস করুক না করুক আমরা তো বিশ্বাস করি,চন্দ্রগ্রহণের পর সব ঠিক হয়ে যাবে।জ্বিন সত্ত্বা তখনো পুরোপুরি গ্রাস করেনি আমাকে। আমরা দুজন মুখ বুঁজে সেই দিনটার অপেক্ষা করছিলাম শুধু।
আমি ততোদিনে কে আমার আপন,কে পর সব বুঝে গিয়েছিলাম।
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম সুস্থ হয়ে উঠলে আর কোনোদিন মায়ের অবাধ্য হবোনা,আর এই স্বার্থপর মানুষ সবগুলো থেকে তাকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো।

মাসের অর্ধেক বাকি ছিলো চন্দ্রগ্রহণের,তখন আমার সৎ ভাই রোকন লোকমুখে ছড়িয়ে দেয় জমিদার অরণ্য তালুকদার দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত,তিনি আর সেড়ে উঠবেন না।
বাবা আমার অসুস্থ হওয়ার কথা গোপন রাখতে চেয়েছিলেন যতদিন সবকিছু সামলে না উঠে।
কিন্তু আমার ভাইয়ের তর সয়নি তখন আমাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করার,সে সবচেয়ে বেশি উচ্ছ্বসিত ছিল আমার অবস্থা নিয়ে তাই এই খুশির খবর সবাইকে শোনাতে তার আর অপেক্ষা সয়নি।
নির্বোধ ছেলে,ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি স্বয়ং নিজের মৃ’ত্যুকে
দাওয়াত দিয়ে এসেছে সে।
আমার জমিদারিকালে আমি যতটা ক্ষমতা অর্জন করেছিলাম তার থেকেও বেশি অর্জন করেছিলাম শত্রু।
যাদের কে পদদলিত করে আমি সবার উপরে উঠেছি তারা তো এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলো যে কখন আমি দুর্বল হবো আর তারা আমাকে আঘা’ত করবে।
আমার কাছে জমিদারি হারিয়ে নিঃস্ব জমিদাররা ও তাদের সমর্থকেরা,এমনকি দুর্দশায় জর্জরিত সাধারণ মানুষগুলোরও প্রচন্ড ক্ষোভ ছিলো এই জমিদার বংশের উপর।
তারা একজোট হয়ে গোপনে বিদ্রোহ পরিকল্পনা শুরু করে তালুকদার বংশের উপর।

চন্দ্রগ্রহণ হওয়ার কথা ছিলো সেদিন রাতে। সেই দিন জ্বিন সত্ত্বা আমাকে দেখায়,তারা আসছে,আজকে জমিদার বাড়ির সবাইকে জ্যান্ত পু’ড়িয়ে মা’রা হবে এই পরিকল্পনা নিয়ে।
চরম আতঙ্ক তখন পুরোপুরি গ্রাস করে আমাকে,দিশেহারা হয়ে পড়ি আমি।
আমার এই দুনিয়াদারি,এই জমিদার বাড়ি,এখানের কোনো মানুষের প্রতি আর কোনো মায়া অবশিষ্ট ছিলোনা তখন।
আমার সব চিন্তাজুড়ে তখন একটাই বিষয় ঘুরছিলো,
আমার পাশে বসে থাকা আমার একমাত্র ভালোবাসার মানুষটার প্রাণ সংকটে আছে।
এখানে থাকলে মে’রে ফেলবে তারা তাকে। কিন্তু আমি কোনোমতেই বলতে পারছিনা সেটা।
সন্ধ্যা নামতেই যখন সেই শেকল আমাকে ছেড়ে দেয় তখন আমি নেতিয়ে পড়ার আগে আমার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে মাকে বলেছিলাম ‘পালাও,বিপদ’।

কিন্তু মা হয়তো বুঝেন নি আমার কথা বা বুঝলেও শেষ পর্যন্ত আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতেও পারেননি তিনি।
সেই সন্ধ্যায় অন্ধকার একটু গাঢ় হতেই জমিদার বাড়ি চারদিকে ঘেরাও করে বিদ্রোহীরা।
তারা সংখ্যায় অনেক বেশি ছিলো,জমিদার বাড়ির রক্ষীরাও পেড়ে উঠেনি তাদের সাথে,তাদেরকেই সর্বপ্রথম হ’ত্যা করা হয়।

ততক্ষণে জমিদার বাড়ির সকলে বুঝে গিয়েছে কি ঘটতে চলেছে তাদের সাথে,
মা ও বুঝে গিয়েছিলেন,কিন্তু তবুও তিনি বাকিদের মতো পালানোর চেষ্টা করলেন না।
আমার মা টা ভীষণ সহজ সরল ছিলেন,এটুকুও বুঝেনি ওরা শত চেষ্টা করলেও আমাকে হ’ত্যা করতে পারবেনা আমার অভিশাপের কারণে,তার নিজের প্রাণের চিন্তা করা উচিত। কিন্তু তিনি এক পা ও সরলেন না আমার পাশ থেকে।

বিদ্রোহীরা অবশ্য কাউকে পালাতে দেয়নি,এমনকি চাকরদেরও নয়। তারা জমিদার বাড়ির সবাইকে টেনে হিঁচড়ে বের করে এনে বাগানে জড়ো করে।
মা আর আমাকে যখন আমাদের ঘর থেকে তুলে আনা হচ্ছিলো তিনি তখন শুধু বারবার মিনতি করছিলেন আমাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য।
আমার শরীর তখন দুর্বল হলেও আমার পুরো হুঁশ ছিলো।
আমি বারবার মনে মনে আওড়াচ্ছিলাম,
‘মা পালিয়ে যাও এখান থেকে,আমার কিচ্ছু হবেনা,তুমি পালাও’

কিন্তু সেই কথা তার কান অবধি পৌছালোনা।
যেখানে আমার প্রিয় বাবা ভাই সবাই তাদের প্রাণ ভিক্ষা চাইছিলেন আর বলছিলেন যে যা করেছি আমি করেছি,তাদের কোনো দোষ নেই,শাস্তি দিলে আমাকে দিতে।
কিন্তু আমার দ্বারা সারাজীবন অবহেলিত মা উনার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত বলে চলেছিলেন ‘আমার ছেলেকে ছেড়ে দাও,ও আর কোনো ভুল করবেনা,এবারের মতো ছেড়ে দাও ওকে’।

বিদ্রোহীরা দুই পক্ষের কারোও কথা ই শুনেনি। তারা সবার আগে তাদের গয়নাগাটি দামী জিনিস সব ছিনিয়ে নেয়,তারপর সবাইকে সমানভাবে অত্যা’চার করতে থাকে। সেসব আঘা’ত আমাকে এতোটুকুও কষ্ট দিতে পারেনি। কিন্তু আমার চোখের সামনে আমার মাকে র’ক্তা’ক্ত হতে দেখা আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো শাস্তি ছিলো, আমি তখন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারিনি,এটা এখনো কষ্ট দেয় আমাকে।
মায়ের শরীরে করা প্রত্যেকটা আঘা’তের সাথে বাড়তে থাকে আমার ক্রোধ। সেই ক্রোধ পুরোপুরি গ্রাস করে আমাকে যখন জমিদার বাড়ির সকলে র’ক্তা’ক্ত অবস্থায় নেতিয়ে পড়ে,আর বিদ্রোহীরা তাদের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়।

মা তার নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে,তার চোখের পানি,তার র’ক্তা’ক্ত শরীর আমার ভেতরটা ভেঙ্গে পুরোপুরি গুড়িয়ে দিয়েছিলো। সেইদিন সেই মুহুর্তে বুঝতে পারি আমি মাকে কতটা ভালোবাসি,তাকে হারিয়ে ফেলছি আমি একটু একটু করে এই ভাবনাটা সহ্য হচ্ছিলো না আমার।
আমার শরীরের আগুন আমাকে একটুও জ্বা’লাতে পারেনি,আমি সম্পূর্ণ সজাগ ছিলাম।
আমার মায়ের দেহকে আমার সামনে আগুনে পুড়তে দেখছিলাম,তার আর্ত’নাদ শুনছিলাম।
আমার ভেতরের ক্রোধ এবং অন্ধকার সময়ের সাথে বাড়তে থাকে। এক সময় রাত বারোটা বাজলো।
আমার শরীরে অসীম ক্ষমতার সঞ্চার হলো,সাথে সাথে যেনো আমার পুরো বোধশক্তি লোপ পেলো।
আমি তখন কি করছি,কেনো করছি,আশেপাশে কি হচ্ছে সব ভুলে গিয়েছিলাম যেনো। র’ক্তের নেশা পেয়ে বসেছিলো আমায়,মাথায় শুধু একটা ধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলাম আমি ‘ছিড়ে ফেলো,সবকটাকে ছিড়ে ফেলো’।
আমার জ্বিন সত্ত্বা আমার দুর্বল মানুষ সত্ত্বাকে পুরোপুরি আয়ত্ত্ব করেছিলো সেদিন।

আমার হুঁশ ফিরে যখন চাঁদকে অন্ধকার পুরোপুরি গ্রাস করে,আমার শেকল দৃশ্যমান হয়,আমার জ্বীন সত্ত্বা শক্তিহীন হয়ে পড়ে।
যখন হুঁশ ফিরে তখন আশেপাশে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে দেখি আমি, একটি ছিন্ন ভিন্ন লা’শের স্তুপের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করি নিজেকে।
ঘোর কাটতেই মনে পড়ে আমার মায়ের কথা। শেকল দৃশ্যমান হলেও আমার শরীরে তা দিনের মতো কোনো প্রভাব ফেলেনি। আমি ছুটে যাই সেখানে যেখানে মা ছিলেন।
কিন্তু সব শেষ ততক্ষণে। এক দলা পুড়ে ছার’খার হয়ে যাওয়া দেহাবশেষ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই সেখানে।”

বলতে বলতেই হাঁপাতে থাকে অরণ্য,তার চোখ বেয়ে আবার অঝোরে অশ্রু গড়াতে থাকে সেই দিনটার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে।
শ্যামার নিজের এমন ভয়ংকর দৃশ্য কল্পনা করতেও বুক কাঁপছে,অরণ্যের জন্য নিজের চোখের সামনে এসব ঘটতে দেখা কতোটা কষ্টকর ছিলো সেটা সে কল্পনাও করতে পারছেনা।
শ্যামা একটু উঁচু হয়ে বসে অরণ্যের মাথা নিজের বুকে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।
কি বলে শান্তনা দিবে বুঝে উঠতে পারছেনা সে।

অরণ্য একটু ধাতস্থ হয়ে আবার বলতে থাকে,
“মায়ের লা’শটা বুকে নিয়ে শান্তিতে কাঁদার সময়টুকুও পাইনি আমি। দিনের আলো ফুটলে আবার বন্দী হতে হবে।
তার আগেই মাকে নিজ হাতে পুকুরপাড়ে সমাধিস্থ করি আমি। আসার সময় শেষ চিহ্ন হিসেবে মায়ের বালা জোড়া নিয়ে এসেছিলাম।
শোকে পুরোপুরি পাথর হয়ে গিয়েছিলাম আমি সেই সময়।
পাতালঘরের সিন্দুকগুলোতে তখনও উপচে পড়া ধন-সম্পদ ছিলো,এত্তো বড়ো জমিদার বাড়ি পুরোটাই আমার ছিলো,আমার ভয়ে তখনো মানুষ এদিকে পা মাড়ানোর সাহস পেতোনা,কটু চোখে তাকানোর বা মায়া দয়া ভালোবাসা দেখানোর কোনো মানুষ অবশিষ্ট ছিলোনা আমার জীবনে।
কিন্তু এই সবকিছুই যেনো অসহ্য ছিলো,শূন্যতা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো আমাকে।
সব হারিয়ে পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলাম আমি।
আমার মন দুনিয়ার সকল ধন-সম্পদের বদলে হলেও আমার মাকে ফেরত পেতে চেয়েছিলো তখন,কিন্তু এটা এখন কক্ষনো সম্ভব না।”

(চলবে)