#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ৩৬
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন
শ্যামা গোসলখানায় গিয়ে একের পর এক মগ ভরে ঠান্ডা পানি ঢালতে থাকে মাথায়। নিজেকে স্বাভাবিক করতে চায় সে যত দ্রুত সম্ভব।
একটু পর ভোর হবে,তাকে অরণ্যের পাশে থাকতে হবে। ভাবতে হবে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে,নিতে হবে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত।
অবশ্য সে ইতোমধ্যে নিয়ে নিয়েছে সিদ্ধান্ত। তার পক্ষে আর যাইহোক তার প্রিয় মানুষটাকে এভাবে যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখা অসম্ভব।
শুধু নিজের স্বার্থের কথা ভেবে উনাকে এভাবে চিরকাল আটকে রাখতে পারেনা সে।
মন মানছেনা তাকে যেতে দিতে,কিন্তু ভাগ্যের হাতে বন্দী যখন দুজন তখন বাকিটাও ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিলো না হয়।
সে ঠিক করেছে আর কাঁদবেনা অরণ্যের সামনে এখন থেকে।
কেঁদে বুক ভাসানোর সময় নয় এটা,যেখানে অরণ্যের সাথে কাটানোর দিনগুলো সীমিত সেখানে প্রত্যেকটা মূহুর্ত গুরুত্বপূর্ণ।
একটা মূহুর্তও কান্না করে নষ্ট করা যাবেনা।
সবসময় নিজেও হাসিমুখে থাকবে,অরণ্যকেও হাসিখুশি রাখবে,বিদায় জানাতে হলে হাসি মুখেই বিদায় জানাবে।
তার কাছে উনার স্মৃতিগুলো না থাকলেও,উনি যেনো তাদের অনেক সুন্দর সুন্দর স্মৃতি নিয়ে এই পৃথিবী থেকে যেতে পারেন।
উনার তিক্ত অতীতের ছিটেফোঁটাও উনার গমনকালের সঙ্গী হতে দিবেনা পণ করে সে। অন্তত এটুকু সে করতেই পারে তার অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে।
বাকিটা বিধাতার ইচ্ছা,উনি জানেন কি ঠিক করে রেখেছেন তাদের জন্য।
নির্জনা কুঠির সিড়িতে বসে একধ্যানে এসব ভাবছিলো শ্যামা। আকাশ একটু ফর্সা হতে শুরু করতেই উঠে দাঁড়ায় শ্যামা।
অরণ্য উঠেই তাকে তার পাশে চাইবে,তাকে তার অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে তার শিয়রে বসে তার কষ্ট ভাগ করে নিতে হবে,সহ্য খানিকটা তাকেও করতে হবে তার সাথে।
ঠান্ডা পানির গামলা আর পরিষ্কার ন্যাকড়া নিয়ে ফিরে যায় শ্যামা অরণ্যের কাছে।
———————————-
সন্ধ্যায় অরণ্যের শেকল মিলিয়ে যেতেই সে ধরফরিয়ে উঠে বসে এক দলা র’ক্ত বমি করে।
শ্যামা এবার শান্তভাবে নিজ থেকে তাকে কুলকুচি করতে সাহায্য করে,তাকে পানি খাইয়ে তার গা মুছিয়ে দেয় আস্তে আস্তে।
অরণ্য একধ্যানে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে শ্যামাকে।
বোঝার চেষ্টা করছে সে আসলেই স্বাভাবিক কিনা,আজ সারাদিন না সে একটা কথা বলেছে না কান্নাকাটি করেছে।
শ্যামা ভাত মাখাতে মাখাতে অরণ্যের অনুসন্ধানী দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলে,
“কি দেখছেন ওভাবে?আমি সত্যিই সামলে নিয়েছি নিজেকে,নিজের দুর্বল শরীরটার উপর এতো চাপ নিবেন না তো।আমি ঠিক আছি।”
অরণ্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অবশেষে তার হাসিমুখ দেখে। কাল থেকে ভয়ে ভয়ে ছিলো কিভাবে সামলাবে ও নিজেকে,
উল্টো পাল্টা কিছু ভেবে নিজের ক্ষতি না করে বসে এই চিন্তায় পা’গ’ল হয়ে যাচ্ছিলো এতক্ষণ।
শ্যামা স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠে,
“আজকে আপনার পছন্দের চিংড়ির ঝাল রান্না করেছে,অনেক বড় বড় চিংড়িগুলো। রিমুর রান্নার হাত কিন্তু আমার থেকেও ভালো,খেয়ে ভালো লাগবে আপনার।
এর থেকে মনে পড়লো অরণ্য,সামশের চাচা আমাকে বলেছিলেন আপনি নাকি এই চিংড়ি মাছ ছাড়া অন্য কোনো মাছ খান না কারণ কাঁটা বাছতে পারেন না আপনি। আপনি একেবারে প্রকৃত ধনী বাবার অতি আদরে বাঁদর হওয়া ছেলেটা দেখছি।”
অরণ্য হালকা হেসে ধীরে ধীরে বলে,
“এটা শুধু বাহানা ছিলো। আসলে ছোটবেলায় একবার মাছ খেতে গিয়ে কাটা বিধে গিয়েছিলো গলায়,অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম তখন কয়েকদিন।
আর আমি হলাম বিদ্রোহী মানুষ,কেউ আমাকে ব্যথা দিলে তাকে দু চার ঘা দিতে না পারলে শান্তি নেই আমার। কিন্তু এই কাঁটা যতই কষ্ট দিক,গলার কাঁটাকে দু চার ঘা দেওয়া তো দূরে থাক গলা থেকে উপড়েও ফেলতে পারিনি। সেই রাগ থেকে আর কাঁটাওয়ালা মাছ খাইনি আমি,ছোটবেলার অভ্যাসটা তাই এখনো রয়ে গিয়েছে। মাছ হিসেবে তাই এই চিংড়ি টাই প্রিয় আমার। ভদ্র মাছ,পেটে পেটে কোনো শয়তানি নেই।”
শ্যামা হেসে কুটিকুটি হয় অরণ্যের ছোটবেলার কাহিনি শুনে।
ছোট খাটো স্মৃতিচারণের মাঝেই তাদের খাওয়ার পর্ব শেষ হয়। অরণ্য খাওয়া শেষ করে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে শ্যামার কোলে মাথা রেখে। শ্যামা তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে অপেক্ষা করে তার জেগে উঠার।
আজ আরেকটা দিন এভাবেই কেটে গেলো।
১৪টা দিন বাকি আর।
সময় হঠাৎ এতো দ্রুত চলে যাচ্ছে কেনো,এখানেই থেমে গেলে কি হয়?এই রাত কখনো না ফুরালে,সূর্যের আলো কখনো না ফুটলে তার জীবনের অন্ধকারগুলো ফিরে আসতোনা আর।
তার ভাবনার মাঝেই সময় তার নিজস্ব গতিতে পার হয়ে যায়,রাত বারোটা বাজে অরণ্য জেগে উঠে।
শ্যামা তার নড়াচড়া বুঝতে পারায় ফিরে তাকায় তার দিকে,ততক্ষণে অরণ্য উঠে বসে তাকে নিজের কাছে টেনে নেয়।
“কি ভাবছো এতো গভীর ভাবে?”, স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করে সে।
অরণ্যের হাসিমুখটা দেখে সেও হেসে ফেলে,শ্যামা অরণ্যের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
” ভাবছি আপনাকে নিয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে গেলে কেমন হয়?যেখানে কখনো সকাল হয়না?”
“বুদ্ধিটা খারাপ না,এমন জায়গা থাকলে সত্যি ভালো হতো। আমি আমার নৈশ ভ্রমণে অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি,কিন্তু আফসোস একটাও এমন জায়গা খুঁজে পেলাম না।”
“আমাকে নিয়ে যাবেন?”
“কোথায়?”,অরণ্য ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞেস করলো।
“আপনার প্রিয় স্থানগুলোতে,আপনার ভ্রমণে যে জায়গাগুলো আপনার সবচেয়ে বেশি পছন্দ হয়েছিলো। আমিও দেখতে চাই।”
মুহুর্তেই অরণ্যের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে যায়,
“তুমি যাবে?সত্যি?! আমারও অনেক ইচ্ছা তোমাকে নিয়ে যাওয়ার,কিন্তু ওইদিন তোমাকে টেলিপোর্ট করে আনাতে তুমি অনেক ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলে,ভেবেছিলাম আর কখনো এভাবে যেতে চাইবেনা তুমি। তাই আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম।”
“ওটা তো প্রথমবার ছিলো তাই এমন লেগেছে,ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাবে। আমি কি বলেছি নাকি একবারও যে আমার খারাপ লেগেছে ওভাবে?”
অরণ্যের মুখের হাসি আরোও খানিকটা প্রসারিত হলো শ্যামার উৎসাহ দেখে,সে দ্রুতকদমে খাট থেকে নামতে নামতে বলে উঠে,
“তুমি বসো একটু,আমি এক্ষুনি কাপড় বদলে আসছি।”
বলেই সে দৌড়ে গেলো তার আলমারির কাছে,হাতের কাছে প্রথম টি-শার্ট যেটা পেয়েছে সেটাই পড়তে থাকে অরণ্য।
শ্যামা অরণ্যের উৎসাহী পিঠের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে। উনাকে এতটা খুশি দেখে মনটা প্রাশান্তিতে ছেয়ে যায় শ্যামার।
অরণ্য ফিরে এসে হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দেয় তার দিকে,
“চলো,নিয়ে যাবো তোমাকে অরণ্যের দুনিয়ায়”
শ্যামা সানন্দে তার হাত গ্রহণ করে উঠে দাঁড়ায়। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে দুজন দুজনকে।
তারপরই অনুভূত হয় সেই একি দম বন্ধকর অনুভূতি,তবে বেশি সময় লাগেনা এইবার।
বেশ দ্রুত মাটি অনুভব হয় শ্যামার পায়ের নীচে।
সে চোখ খিঁচে বন্ধ করে ছিলো এতক্ষণ।
মাটিতে অবতরণের সাথে সাথে ভেসে আসে পানির কলকল ধ্বনি এবং অনবরত ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক।
চকিতে চোখ খুলে তাকায় শ্যামা,সাথে সাথে হারিয়ে যায় আশেপাশের মনোমুগ্ধকর দৃশ্যে।
চোখ বড় বড় করে দু’হাতে মুখ ঢেকে আশেপাশে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে সে।
তারা একটি পাহাড়ি ছোট্ট ঝর্ণার সামনে দাঁড়িয়ে আছে,সেখান থেকেই পানির কলকল ধ্বনি ভেসে আসছে যা এই নিস্তব্ধ পরিবেশে অনেক স্নিগ্ধ শোনাচ্ছে। আশেপাশে যেদিক চোখ যায় ঘন কালো জঙ্গল। বড় বড় গাছের ফাঁক গলে চাঁদের আলো এতোটা আলোকিত করতে পারেনি স্থানটি,
কিন্তু তার কমতি পূরণ করার জন্যই হয়তো ছোট ছোট তারার মতো শখানেক জোনাকি পোকা একত্রিত হয়েছে এই জায়গায়,যেগুলো একবার জ্বলছে আরেকবার নিভছে। মনে হচ্ছে যেনো আকাশের তারাগুলো জমায়েত হয়েছে এই জায়গাটায়।
পুরো দৃশ্যটাই যে কারো মন ভালো করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
অরণ্য হাসিমুখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শ্যামাকে এভাবে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে,সে বলে উঠে,
“তোমার এই জায়গা টা এতো পছন্দ হবে জানলে অনেক আগেই নিয়ে আসতাম তোমাকে এখানে।”
শ্যামা চকিতে ফিরে তাকায় অরণ্যের দিকে,হাসিমুখে বলে উঠে,
“সত্যি অরণ্য আমি এমন সুন্দর দৃশ্য আগে কক্ষণো দেখিনি।এটা তো কোনো রূপকথার গল্প থেকেও বেশি সুন্দর!”
“তোমার থেকে বেশি সুন্দর নয়”, অরণ্য ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলে।
শ্যামা এমন আকস্মিক প্রশংসায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নেয়। অরণ্য হেসে ফেলে তার লজ্জামাখা অভিব্যক্তি দেখে।
অরণ্য এগিয়ে গিয়ে শ্যামার এক হাত নিজের হাতে নিয়ে এগিয়ে যায় ঝর্ণার ধারে। সেখানে একটি পাথরের উপর বসে দুজনেই পা ডুবিয়ে দেয় ঝর্ণার শান্ত ঠান্ডা জলে।
অরণ্য শ্যামার কোমড় জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নেয় তাকে। শ্যামা আবেশে মাথা এলিয়ে দেয় তার বুকে।
দুজনেই নীরবতার মাঝে এই নিস্তব্ধ পরিবেশটাকে অনুভব করে কিছুক্ষণ,শ্যামা ই প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করে প্রশ্ন করে,
“এই জায়গাটা কোথায় অরণ্য?”
“আমাদের গ্রামের কাছেই একটি পাহাড়ে,এদিকটা বেশ খাড়া আর জঙ্গল বেশি ঘন, তাই সহজে এদিকে কেউ আসেনা। আমি একদিন ঘুরতে ঘুরতে এই জায়গাটা খুঁজে পেয়েছিলাম।
প্রথম দেখাতেই মন ছুঁয়ে গিয়েছিলো।”
“হুম… একদম ঠিক বলেছেন,মনটা কেমন শান্ত হয়ে গেছে এখানে এসে। বিশেষ করে এই জোনাকি পোকাগুলো,ভীষণ সুন্দর এগুলো।”
“তোমার জন্য কিছু বয়মে ভরে নিয়ে যাবো রাখার জন্য?”
“না,এগুলো এখানেই থাক। ভবিষ্যতে যতবার ইচ্ছে করবে দেখতে,আপনাকে নিয়ে চলে আসবো এখানে।”
চমকে উঠে তাকায় অরণ্য শ্যামার মুখ পানে। শ্যামা তার উপর অরণ্যের দৃষ্টি অনুভব করে তার বুকে থুতনি ঠেকিয়ে মাথা তুলে তাকায় তার দিকে,
অভিমানী কন্ঠে বলে উঠে,
“এভাবে তাকাচ্ছেন কেনো?ভবিষ্যতে হয়তো আপনি থাকবেন না,তাই বলে আমি আমাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারবোনা নাকি?আমার স্বপ্নপুরুষকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার অধিকার আমারও আছে,নিকুচি করেছে আপনার বাস্তবতার।”
অরণ্য নীরবে এক দৃষ্টিতে মাথা নীচু করে তাকিয়ে থাকে শ্যামার মুখপানে। তাদের মধ্যে কয়েক ইঞ্চির দূরত্ব মাত্র। রাতের মৃদুমন্দ বাতাসে শ্যামার খোলা চুল গুলো বারবার তার চেহারায় আছড়ে পড়ছে।
অরণ্য ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সেই অবাধ্য চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দিয়ে মিটিয়ে দেয় সেই কয়েক ইঞ্চির ব্যবধান।
অধরে অধর ডুবিয়ে গভীর চুম্বন করে একজন আরেকজনকে।
একটু পর অরণ্য ছেড়ে দিয়ে তার কপালে আলতো চুমু খেয়ে বলে,
“ঠিক বলেছো একদম। স্বপ্ন দেখার অধিকার তো সবার আছে,তুমি আমি বাদ যাবো কেনো?”
শ্যামা তৃপ্তির হাসি হেসে বলে,
“এইতো বুঝতে পেরেছেন। তাই আমি একেবারে ইচ্ছেমতো স্বপ্ন দেখছি। ১৪দিন পরেও আপনি আমারই থাকবেন,আপনার অভিশাপও কেটে যাবে,আমরা একটা নতুন জীবন শুরু করবো,আপনাকে নিয়ে মা বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো,তাদের সম্মতি নিবো,তারপর আমাদের টোনাটুনির সংসার হবে,বছর ঘুরতেই আমাদের কোল জুড়ে একটা ছোট্ট বাবু আসবে,তাকে নিয়ে হেসে খেলে কেটে যাবে আমাদের দিনগুলো,তারপর কয়েক বছর পর আরেকটা বাবু নিবো,ওরা বড়ো হবে,বিয়ে হবে,ওদের বাবু হবে,আমরা একসাথে বুড়ো হবো,মৃ’ত্যু নাহয় তারপর আসলে আসবে।”
অরণ্য স্মিত হেসে নত কন্ঠে বলে উঠে,
“এতোদূর ভেবে ফেলেছো তুমি?তবে এই স্বপ্নটা সত্যি অনেক সুন্দর,এই স্বপ্নটা সত্যি হলে অনেক ভালো হবে।”
“হুম” শ্যামা স্মিত হেসে ছোট্ট করে জবাব দেয়।
এভাবে আরও কিছুক্ষণ কাটানোর পর তারা ফিরে আসে নির্জনা কুঠিতে। শ্যামা ঘুমিয়ে পড়ার আগে অরণ্য ইতস্ততভাবে সেই প্রশ্নটি করে যেটি সে এতোক্ষণ চেপে রেখেছিলো মনে,
“তুমি কি ঠিক করেছো কি করবে তুমি?”
শ্যামা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরের জানালাটা বন্ধ করতে করতে জবাব দেয়,
“হুম,আমি ঠিক করেছি আপাতত যেটা করা উচিত, সেটাই করবো আমি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এখন আপনাকে এই কষ্ট থেকে মুক্ত করা,আমি সেটাই করবো। বাকিটা যা হওয়ার হবে।”
অরণ্য কিছু বললোনা আর। শ্যামা তার বুকে মাথা রাখতেই কিছুক্ষণের মধ্যে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। কাল থেকে এই প্রথম ঘুম এলো তার চোখে।
অরণ্য এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তার ঘুমন্ত মুখশ্রীর দিকে।
আর কয়েকটা দিন মাত্র এরপর আর দেখা হবেনা তার এই প্রিয় মুখটা।
(চলবে)
#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ৩৭
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন
সময় বহমান। সময়ের নিষ্টুর গতি থেমে থাকেনি দুটি হৃদয়ের নীরব আঁকুতি শুনে হলেও। চোখের পলকে কেটে গেলো মাঝখানের দিনগুলো।
আজ শেষ দিন। আজ রাতে হবে চন্দ্রগ্রহণ,হারিয়ে যাবে একজন আরেকজন থেকে।
ভাবনাটা সকাল থেকে শ্যামার হৃদয়কে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।
মাঝখানের দিনগুলো যেনো হঠাৎ চোখের পলক ফেলতেই কেটে গিয়েছে। এই দিনগুলোতে শ্যামা নিজেকে একটুও কাঁদতে দেয়নি। সব সময় শান্ত রেখেছে নিজেকে,সারাদিন অরণ্যের পাশে বসে সেবা করেছে তার,সন্ধ্যা হলে মুখে হাসি ঝুলিয়ে তাকে খাইয়ে দিয়েছে,মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে। ফের রাত বারোটা বাজলে দুজন হারিয়ে গিয়েছে দূর-দূরান্তে। অরণ্য তাকে নিয়ে গিয়েছে সমুদ্রের পাড়ে,নাম না জানা কোনো গ্রামে,পাহাড়ি উঁচু টিলায় এবং তার সব প্রিয় স্থানে। এই সময়টুকুতেই শুধু তারা নিজেদের কষ্টগুলো একজন আরেকজনের ভালোবাসার আবেশে ভুলে থাকতে পারতো। কিন্তু বাড়ি ফিরে আসতেই মনে সেই একি আতঙ্ক চেপে বসতো। একজন আরেকজনকে হাসির আড়ালে বুঝতে দিতোনা সেটা। কিন্তু প্রতি রাতে একে অপরকে জড়িয়ে রাখা বাহু বেষ্টনীর ক্রমাগত বাড়তে থাকা দৃঢ়তা একে অপরকে ঠিক বুঝিয়ে দিতো সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকা মনের লুকায়িত আতঙ্কটা।
আজ অবশেষে না চাইতেও এসে গেলো দিনটি। শ্যামার বুকে জমে থাকা কষ্টের পাহাড়টা যেনো ধীরে ধীরে খসে পড়তে শুরু করেছে। সকাল থেকে না চাইতেও থেকে থেকে অবাধ্য অশ্রুগুলো গড়িয়ে পড়ছে।
সন্ধ্যায় অরণ্য ছাড়া পাওয়ার পর শ্যামা তাকে কুলকুচি করতে সাহায্য করে নিত্যদিনের মতো। এখনো সে নিজেকে সামলে রেখেছে। কিন্তু আজকে যেনো শরীর কিছুতেই সায় দিচ্ছেনা কোনো কাজে, অরণ্যের গা মোছার পানিটাও আজ সামশের চাচাকে দিয়ে আনিয়েছে।
মন সামশেরেরও আজ ভালো নেই। সেও জানে আজ কি হতে চলেছে,আজ সে আরও একবার একা হয়ে যাবে।
বিষন্ন মনে সে পানি রেখে বেড়িয়ে যেতে নিলে অরণ্য তাকে ডাক দেয়
“সামশের….”
সামশের দৃঢ় পায়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে জবাব দেয়,
“জ্বি মনিব”
অরণ্য তার দুর্বল শরীর টেনে তুলে দাঁড়াতে গিয়ে টাল হারিয়ে পড়ে নিতে নিলে সামশের তড়িৎ গতিতে এগিয়ে এসে ধরে ফেলে তাকে।
শ্যামাও অরণ্যের হঠাৎ এমন কাজে আঁতকে উঠে।
অরণ্য দুর্বলভাবে হেসে ফেলে দুজনের এমন ভয়ার্ত অভিব্যক্তি দেখে,
“আমি ঠিক আছি,ভয় পেয়োনা। কিন্তু আজকে কিছু কথা না বললে পরে হয়তো আর কক্ষণো বলা হবেনা।”
“মনিব আপনি দুর্বল এই মুহুর্তে,নিজের শরীরকে কষ্ট দিবেন না। কিছু লাগলে আদেশ করুন। এই সামশের আপনার প্রতিটা আদেশ পালন করবে।”
“আর কোনো আদেশ নয় সামশের। একবার জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ বলতে চাই তোমাকে।
আমি কখনো সংকোচের কারণে তোমাকে বলতে পারিনি কিন্তু আমি অনেক অনেক কৃতজ্ঞ তোমার প্রতি।
তুমি না থাকলে কি হতো আমার তা কল্পনাও করতে পারিনা আমি। হয়তো এখনো কোথাও ভবঘুরে হয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতাম একা একা এই মুহুর্তে।
কিন্তু বিধাতা আমার জীবনে তোমাকে পাঠিয়েছেন। একজন বন্ধু হয়ে,একজন পরিবার হয়ে,আমার গুরুজন হয়ে।
আমার একাকি জীবনের সঙ্গী হওয়ার জন্য ধন্যবাদ, আমার অগোছালো জীবনটাকে গুছিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ, আমার জন্য দিন রাত পরিশ্রম করার জন্য ধন্যবাদ, আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকে আমার স্ত্রীকে খুঁজে দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ। তোমাকে আমি যতবার ধন্যবাদ দিই কম হবে।
আজ আমি চলে যাচ্ছি। তোমাকে জ্বা’লানো ছাড়া আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারিনি।
অনেকবার কারণে অকারণে রাগ দেখিয়েছি,সংকোচের কারণে ক্ষমা চাওয়াটাও হয়নি।
আমার গমনকালে কোনো অভিমান পুষে রেখোনা মনে,
আমার ভুল ত্রুটিগুলোর জন্য ক্ষমা করে দিও আমাকে।”
সামশের ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে এদিক সেদিক মাথা দুলিয়ে অসম্মতি জানায়,অরণ্যও কাঁদতে কাঁদতে আলিঙ্গন করে তাকে।
সামশের ধরে আসা গলায় বলে,
“আপনি আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে বা আমার থেকে ক্ষমা চেয়ে ছোট করবেন না মনিব। আপনিও আমার জীবনে আমার একমাত্র পরিবার। আপনার প্রতি কোনো অভিমান নেই, কোনো অভিযোগ নেই আমার,শুধু আছে কৃতজ্ঞতা। আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ,আমাকে একাকি জীবনের অভিশাপ থেকে বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ,আমাকে একটা আশ্রয় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
আপনাকে যেতে দিতে অনেক কষ্ট হচ্ছে আমার,জানিনা এরপর কি করবো আমি,কোথায় যাবো। কিন্তু আপনি এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে চলেছেন এটাই একমাত্র শান্তি আমার।”
“কোথাও যাবেনা তুমি সামশের। এই বাড়িটা আমি তোমাকে দিয়ে গেলাম,তুমি এখানেই থাকবে। পাতালঘরে তোমার জন্য কিছু সম্পদ আমি রেখে দিয়েছি। আমি না থাকলেও তোমরা দুজনের জন্য সব ভেবে রেখেছি আমি।”
আলিঙ্গন ভঙ্গ করে মুখোমুখি দাঁড়ায় অরণ্য,অশ্রুসিক্ত নয়নে সামশেরের দুই হাত ধরে বলে,
“শেষ একটা অনুরোধ করছি শুধু সামশের,আমার শ্যামাকে দেখে রেখো আমি যাওয়ার পর।”
শ্যামা মুখ চেপে কেঁদে চলেছে তখন। আজকের রাতটা অনেক বিষন্ন হতে চলেছে,এই রাত তাদের জীবনকে চিরকালের জন্য অন্ধকার করার বার্তা নিয়ে এসেছে।
এই অন্ধকার কি কাটবে কখনো?
সামশের চলে যেতেই অরণ্য বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে ডাক দেয় শ্যামাকে,
“এই সোনা বউ আমার,কাঁদছো কেনো?আমি এখনো এখানেই আছি। দেখি এদিকে এসো।”
অরণ্য তার দুই বাহু প্রসারিত করে ডাকে শ্যামাকে। শ্যামা অরণ্যের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে,
“কেনো এই রাতটা এলো আমাদের জীবনে অরণ্য?আমার ভাগ্যে আপনি নেই কেনো?কেনো এভাবে নিজ হাতে বিদায় দিতে হবে আপনাকে আমার?এতো নিষ্ঠুর ভাগ্য কেনো লিখেছেন বিধাতা আমার?আমার ২৫বছরের জীবনে এক ফালি সুখ হয়ে এসেছিলেন আপনি,কিন্তু সেই সুখও ক্ষণিকের মরিচীকার মতো মিলিয়ে যাবে। আমি কি করবো এরপর?”
অরণ্য অশ্রুসিক্ত নয়নে শ্যামার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
“কি করবে এরপর সেটাও ভাগ্যের উপর ছেড়ে দাও শ্যামা। তবে এখন এই মুহুর্তে,তুমি আমার আর আমি তোমার কাছে রয়েছি।
শেষ মুহুর্তগুলো এভাবে ভেঙ্গে পড়ে নষ্ট করতে নেই।
যাওয়ার আগে আমি আমার বউয়ের হাসিমুখ দেখতে চাই শুধু।”
শ্যামা উঠে বসে চোখ মুছে ফেলে,চোখ মুখ লাল হয়ে গিয়েছে তার,ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে সে,
“ঠিক বলেছেন অরণ্য,আর কয়েকটা ঘন্টা আছে মাঝে। কেঁদে সময় নষ্ট করতে চাইনা আমিও।
চুলুন শেষবারের মতো একজন আরেকজনকে খাইয়ে দিবো,নিজ হাতে ঘুম পাড়াবো আপনাকে আজকে আবার।”
অরণ্য তার কপালে একটা আলতো চুমু খেয়ে চোখ মুছিয়ে দেয় তার।
————————————-
অরণ্যকে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার পর বেশ খানিকক্ষণ বসে থাকে শ্যামা। ঘড়িতে এগারোটা বাজতেই তাকে রেখে বেড়িয়ে আসে শ্যামা। ফিরে আসে তার আগের ঘরে।
অরণ্যের সত্যিটা জানার পর থেকে সারাদিন রাত এখন অরণ্যের ঘরেই থাকা হয়। ভোরবেলা গোসলের কাপড় আনার জন্য ছাড়া এই ঘরে আসা হয়না আর।
কিন্তু আজকের রাতটা আলাদা। আলমারি খুলে অরণ্যের মায়ের লাল বেনারসিটা বের করে শ্যামা। সেটার দিকে তাকিয়ে একবার হাত বুলোয় তাতে।
অরণ্য ও তার বিয়েটা বেশ সাধারণ ছিলো,তাদের প্রথম রাতটা নিয়েও তেমন কোনো আয়োজন ছিলোনা,মনে তখন অজানা শঙ্কা ছিলো শুধু। তাই সেদিনও সে ভালোভাবে সাজেনি অরণ্যের জন্য। ধরতে গেলে কখনোই ভালোভাবে অরণ্যের বধু সাজা হয়নি তার।
ইচ্ছে ছিলো অরণ্য যখন তার ব্যপারে সবকিছু তাকে খুলে বলবে তখন মা বাবাকে জানিয়ে পূর্ণাঙ্গ বধু সেজে আরেকবার বিয়ে করবে তাকে।
কিন্তু আর সেটা হবেনা। তাই বলেকি এই ইচ্ছেটা অপূর্ণ থাকবে নাকি?আজকে সে পূর্ণাঙ্গ বধু সেজেই বিদায় জানাবে তার স্বামীকে।
সে শাড়ীর সাথে তুলে নিলো তার কখনো না ছোঁয়া গয়নার বাক্স গুলো,কখনো না পড়া লাল রঙের কাঁচের চুড়ি গুলো।
তৈরি হওয়ার সময়ও থেকে থেকে অবাধ্য অশ্রুগুলো গড়াতে থাকে শুধু।
শাড়ী,চুড়ি,গয়না গুলো পরে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে আয়নার দিকে তাকায় শ্যামা।
তাকে এবার পূর্ণাঙ্গ বধু লাগছে অনেকটা। কাঁজলটা দেওয়া বাকি শুধু।
কিন্তু এভাবে অশ্রু গড়াতে থাকলে কিভাবে দিবে কাঁজল?
কয়েকবার আপ্রাণ চেষ্টা করেও কান্না বন্ধ করতে না পেরে একপাশে ছুড়ে ফেলে কাজলটা। আজ সবকিছুতে ব্যর্থ সে। জীবনের কাছে পুরোপুরি হেরে গিয়েছে।
অরণ্য এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়া শ্যামাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। রাত বারোটা বাজে এখন। চন্দ্রগ্রহণ অনেক আগেই শুরু হয়ে গিয়েছে। রাতের প্রথম প্রহরের মধ্যেই অন্ধকার পুরোপুরি গ্রাস করবে চন্দ্রকে। শেষ মুহুর্তে ভেঙ্গে পড়া যাবেনা একটুও। বুক ফেটে কান্না অরণ্যেরও আসছে। কিন্তু সেও ভেঙ্গে পড়লে শ্যামাকে কে সামলাবে?
সে কোলে তুলে নিয়ে যায় শ্যামাকে তাদের বিছানায়। শ্যামা এখনো ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে শুধু,কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গিয়েছে তার।
অরণ্য শ্যামাকে কোলে নিয়ে বসে খাটে হেলান দিয়ে,শ্যামাকে খানিকটা উঁচু করে বসিয়ে তার মুখোমুখি করে সে। তার চোখের পানিগুলো মুছে দিতে দিতে বলে,
“আমার বউটাকে পূর্ণাঙ্গ বধুর সাজে কি সুন্দর লাগছে। কিন্তু এই অশ্রুগুলো তো আমার আগেই তোমার সাজটা নষ্ট করে দিচ্ছে মায়াবিনী। থামাও এগুলোকে।”
শ্যামার অরণ্যের কোনো কথা ই কানে যাচ্ছেনা। সে তার দুই গালে হাত রেখে অসহায় কন্ঠে মিনতি করে শুধু,
“আমাকে ছেড়ে যাবেন না প্লিজ,সত্যিই ম’রে যাবো আমি। থেকে যান না অরণ্য। প্লিজ…”
অরণ্য অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শুধু শ্যামার মুখশ্রীর দিকে। কান্না করতে করতে চোখমুখ লালচে হয়ে গিয়েছে তার। গালের কাছের চুলগুলো অশ্রুতে ভিজে গালের সাথে লেপ্টে আছে। এই অবস্থাও বধু বেশে এক অন্য রকম স্নিগ্ধ লাগছে মেয়েটাকে।
হঠাৎ করে তার তীব্র বাসনা জাগে মনে, মেয়েটাকে শুধু তার করে রাখতে,ও যেনো আমরণ তার হয়ে বাঁচে।
স্বার্থপর ভাবনাগুলো আর লুকিয়ে রাখতে পারলোনা সে,শ্যামার ঘাড়ের চুলে হাত গলিয়ে একদম কাছাকাছি নিয়ে আসে তার মুখটা নিজের মুখের,চোখে চোখ রেখে বলে অরণ্য,
“আমার পর অন্য কোনো পুরুষকে এভাবে ভালোবেসো না শ্যামা। বাসলে একটু কম বাসবে,একেবারে না বাসলে আরো ভালো। পারলে সারাজীবন আমার বধু হয়েই থেকো। আর কারো জন্য এভাবে বউ সেজো না। সাজলেও এতো মন দিয়ে সেজো না। আর এভাবে অশ্রু শুধু আমার জন্যই বিসর্জন দিও,অন্য কোনো পুরুষের জন্য কক্ষনো কেঁদোনা কেমন?”
“আপনার পর অন্য কোনো পুরুষ আসবেনা অরণ্য,আমার আর কাউকে ভালোবাসা হবেনা,কারো জন্য বউ সাজা হবেনা। আমার অশ্রুগুলো শুধু একজন পুরুষের জন্য গড়াবে,আর সেটা শুধু আপনি।
শ্যামা আমরণ শুধু অরণ্যের থাকবে।”
অরণ্য অশ্রুসিক্ত নয়নে স্মিত হেসে বলে,
“হুম…তুমি আমরণ শুধু আমার থাকবে”
বলেই অরণ্য শ্যামার কপাল চোখে মুখে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দেয়,শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে। আরেকটু সময় বাকি শুধু। অনেকক্ষণ এভাবে শক্ত করে আলিঙ্গন করে থাকে তারা।
অবশেষে মুখ তুলে শেষবারের মতো দুজন দুজনকে অধর মিলিয়ে গভীরভাবে চুম্বন করে।
সেই চুম্বনের মাঝেই হঠাৎ দৃশ্যমান হতে থাকে সেই অভিশপ্ত শেকল।
দুজনেই স্তব্দ হয়ে যায়,সময় শেষ। বিদায় জানানোর সময় এসেছে একে অপরকে।
দুজন দুজনের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
শ্যামার পুরো শরীর আতঙ্কে কাঁপতে শুরু করে। সে এই মুহুর্তের জন্য গত ১৫টা দিন দিনে রাতে নিজেকে প্রস্তুত করেছে।
কিন্তু এখন যখন সেই মুহুর্ত উপস্থিত হয়েছে তার নিজেকে দেওয়া সকল প্রবোধ যেনো নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে।সে পারবেনা এটা করতে,সে নিজ হাতে অরণ্যের প্রাণ কিভাবে নিতে পারে?
অরণ্য বুঝলো শ্যামার মনের অবস্থা,কিন্তু এখন আর পিছিয়ে যাওয়া চলবেনা। অরণ্য শ্যামার কাঁপা কাঁপা হাত দুটো নিজ হাতে নিয়ে শেকলের দু’প্রান্তে চেপে ধরে।
শ্যামা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে তাকিয়ে অনবরত অসম্মতিতে মাথা ঝাঁকাতে থাকে, হাত সরিয়ে নিতে চায় কিন্তু অরণ্য শক্ত করে চেপে ধরে রাখে তার হাতের মুঠো দুটি। শ্যামা মিনতি করে আবার,
“যেওনা অরণ্য,প্লিজ যেওনা”
অরণ্য স্মিত হেসে তার কপালে আলতো চুমু খেয়ে বলে,
“ভালোবাসি শ্যামা”
তারপর শ্যামার দুই হাত ধরে টান দেয় অরণ্য,তার বুক থেকে ছিন্ন হয়ে যায় শেকল,একটা বড় শ্বাস টেনেই থেমে যায় মানুষটার শরীর।
অরণ্যের নিথর দেহের মাথাটা ঢলে পড়ে শ্যামার কাধের উপর।
শ্যামা ঘটনার আকস্মিকতায় বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। কয়েক মুহুর্ত লাগে তার বোধগম্য হতে যে সে তার প্রিয় মানুষটাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলেছে।
কথাটা মাথায় বারি খেতেই বুক চিরে আর্তনাদ বেরিয়ে আসে তার,অরণ্যের নিথর শরীরটা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে শ্যামা।
আশেপাশের আকাশ বাতাস যেনো ভারী হয়ে উঠলো নিস্তব্ধ পরিবেশে সেই কান্নার আওয়াজ শুনে।
(চলবে)