#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ৪০
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন
জমিদার বাড়ি ফিরে সোজা দোতলার বাম পাশের করিডোরের শেষ ঘরটায় চলে আসে অরণ্য।
নিজ ঘরে এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।
প্রচন্ড রকমের অস্বস্তি হচ্ছে তার।
ওই মেয়েটির বিধ্বস্ত অবয়ব,সেই মায়াবী চোখের দৃষ্টি,তার করুণ কন্ঠের ডাক,তার ভালোবাসাময় স্পর্শ সব বারবার মনে পড়ছে তার। কোনোমতে মেয়েটাকে মাথা থেকে সরাতে পারছেনা।
এই অজানা অনুভূতিগুলো তার রাগ প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে তুলছে।
নাহ,এভাবে হবেনা। কালই এই মেয়ের একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
তার ভাবনার মাঝেই দড়জায় টোকা দিলো কেউ। অরণ্য বিরক্তিমাখা কন্ঠে জবাব দেয়,
“কে?! কোনো জরুরি বিষয় না হলে এখন আমাকে বিরক্ত করবেনা। ছোটো খাটো বিষয় অন্য কাউকে দেখতে বলো!”
দড়জার প্রহরী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠে,
“জমিদার বাবু, রিচার্ড সাহেব ও তার মেয়ে এসেছেন। বড় মালিক বলেছেন আপনার সাথেই তাদের সাক্ষাৎ করার কথা,আপনাকে যেনো ডেকে আনি।”
অরণ্য বিরক্তিমাখা অভিব্যক্তি নিয়ে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকায়। সন্ধ্যা ছয়টা পার হয়েছে। আজকে রিচার্ড সাহেবের আমের পেটিগুলো নিতে নিজে আসার কথা ছিলো সেটা এতোক্ষণ ওই মেয়েটির চক্করে মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল।
এখন রিচার্ড সাহেবকে কি জবাব দিবে?যে আমের ব্যবস্থা হয়নি? এক ভিন্ন জগতের মহিলা আর এক পা’গল বুড়ো মিলে চুরি করে নিয়েছে আম?
ভাবতে ভাবতে আবার ওই মেয়েটার মুখ ভেসে উঠে চোখের সামনে,মেয়েটির উপর রাগ আরও খানিকটা বেড়ে যায়।
তার উপর রিচার্ড সাহেব একা আসেন নি,তার ইঁচড়েপাকা মেয়ে ইলিয়ানা কে সাথে নিয়ে এসেছেন। প্রচন্ড রকমের নি’র্লজ্জ মেয়েটা। সে সবসময় তাকে বিদ্রুপ করে প্রত্যাখ্যান করে তবুও মেয়েটা পিছু ছাড়ছে না তার।
ওর বাবার সাথে সম্পর্কের খাতিরে মেয়েটাকে কঠোর কিছু বলতে পারছেনা,আর এই সুযোগটাই নিচ্ছে মেয়েটা। সুযোগ পেলেই বাবার সাথে চলে আসে মেয়েটা তার সাথে দেখা করার জন্য।
‘উফ বিরক্তিকর! সবগুলো উটকো ঝামেলার সাথে আজকেই দেখা হওয়ার কথা আমার। আজকের দিনটাই খারাপ।’ মনে মনে ভাবে সে।
তারপর প্রহরীকে বলে,
“ওদের বসিয়ে আপ্যায়ন করতে বলো,আমি আসছি একটু পর।”
প্রহরী জবাব নিয়ে চলে যেতে নিলে অরণ্য তাকে থামিয়ে দিয়ে ইতস্তত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“ওই….ওই মেয়েটি কোথায় এখন?”
প্রহরী বুঝতে না পেরে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“আজ্ঞে কোন মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করছেন জমিদার বাবু?”
অরণ্য এবার রেগে ধমক দিয়ে উঠে,
“কিছুক্ষণ আগে যেই মেয়েটিকে বেধে আনা হয়েছে?কোথায় এখন সে?!”
প্রহরী একটি শুকনো ঢুক গিলে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,
“আজ্ঞে জমিদার বাবু, বড় মালকিন মেয়েটাকে সাথে নিয়ে গেছেন। আমরা যখন আপনার আদেশের কথা বলি তাকে তখন উনি বলেছেন,তার এই মেয়েটিকে লাগবে,এই নিয়ে আপনার কোনো আপত্তি থাকলে উনার সাথে কথা বলতে বলেছেন। আমরা সামান্য চাকর, বড় মালকিনের কথার খেলাপ করতে পারিনি আমরা।”
চমকে উঠে অরণ্য। মায়ের হঠাৎ এই মেয়েটির সাথে কি প্রয়োজন থাকতে পারে?
________________________
এদিকে শ্যামা এই মুহুর্তে দোতলার ডান দিকের করিডোরের দুই দড়জা পেরিয়ে তৃতীয় ঘরটায় বসে আছে চারুলতার সামনে। এই ঘরটাতেই তার অরণ্যের হাত ধরে আসার কথা।
এই ঘরটা এই মুহুর্তে চারুলতার কক্ষ।
চারুলতা মেয়েটির এমন অসহায় অনুরোধ ফেলতে পারেন নি তখন। আর মেয়েটির শাড়ী আর বালা নিয়ে জানার আগ্রহ তারও ছিলো। তাই নিজের জোর খাটিয়ে মেয়েটিকে মুক্ত করে নিয়ে এসেছেন তিনি। একবার তার কথা শোনার অনুরোধ করেছে মেয়েটি,একবার শুনতে তো ক্ষতি নেই।
কিন্তু মেয়েটির সব কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে যান যেনো তিনি।
অশ্রুসিক্ত নয়নে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে শ্যামাকে,
“এমন ভয়ংকর অবস্থা হয়েছে আমার ছেলের,বউমা?”
চমকে উঠে শ্যামা চারুলতার মুখে ‘বউমা’ ডাক শুনে। উনি এক কথায় তাকে বিশ্বাস করে ফেলবেন কল্পনাতীত ছিলো তার। অবশেষে কাউকে তার কথাগুলো বিশ্বাস করাতে পেরে আশার আলো দেখতে পায় শ্যামা।
আনন্দে চারুলতার কাঁধে মাথা রেখে কেঁদে ফেলে শ্যামা,
“আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেছেন মা? আমার যে কি শান্তি লাগছে বলে বোঝাতে পারবোনা। এতোদিন এতো কিছু হয়েছে আমার আর অরণ্যের জীবনে,কাউকে নিজের কষ্টটা বলে তার কাধে মাথা রেখে কাঁদবো সেই সৌভাগ্য টুকুও হয়নি আমার।”
চারুলতাও শ্যামাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে,
“কি করে অবিশ্বাস করি তোকে মা? এই শাড়ী চুড়ির কথা নাহয় নকল বলে ফেলে দেওয়া যায়। কিন্তু সেই বৃদ্ধ জ্বিন আমার অনেক চেনা,তোর বর্ণনার সাথে হুবহু মিলে যায় সব যাকে আমি চিনি। আমার অরণ্য তো তার ই বরদান।”
চমকে উঠে তাকায় শ্যামা চারুলতার দিকে,
“আপনি সেই জ্বিনকে চিনেন?অরণ্য তার বরদান মানে?”
চারুলতা চোখের পানি মুছে বলতে থাকেন,
“সে অনেক কথা রে মা। আমি একজন যাযাবর গোষ্ঠীর কাছে মানুষ হয়েছি ছোট থেকে। আমার মা বাবা বা কোনো বংশ পরিচয় নেই। আমাকে আমার গোষ্ঠীর লোকেরা রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছিলো। হয়তো মেয়ে হওয়ার কারণে বা কালো মেয়ের যৌতুক দেওয়ার চিন্তায় বা দারিদ্র্যের কারণে, এমনি কোনো অজানা কারণে আমার আপন মা বাবা আমাকে ত্যাগ করেছিলেন।
তবে এই নিয়ে আমার কোনো আফসোস ছিলোনা। আমরা যাযাবর গোষ্ঠীর মানুষরা সবাই প্রায় এমন অনাথ ছিলাম বা স্বর্বহারা। তাই আমরা নিজেরাই নিজেদের পরিবার ছিলাম।
এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ভ্রমণ করতাম,খেলা দেখাতাম,দিন শেষে যেটুকু খাবার যোগাড় হতো তা সবাই ভাগ করে খেতাম।
আমার জীবনে তখন কোনো অপূর্ণতা ছিলোনা। যার জীবনে ভালোবাসা আছে,পরিবার না থেকেও পরিবার আছে,যে কোনো সোনার পিঞ্জিরায় বন্দী পাখি নয়,মুক্ত আকাশে নিজ ইচ্ছামতো উড়ে বেড়াতে পারে,তার থেকে বেশি সুখী আর পরিপূর্ণ মানুষ আর কেউ হতে পারে নাকি?
কিন্তু তখন ছোট ছিলাম,অবুঝ ছিলাম,বুঝতাম না আমার সৌভাগ্য। তাইতো খোলা আকাশের মুক্ত পাখি হয়ে সোনার পিঞ্জিরার স্বপ্ন দেখতাম।
প্রায়ই মজার ছলে সবাইকে বলে উঠতাম,একদিন দেখিস আমারও অনেক বড় ঘরে বিবাহ হবে,এতো টাকা হবে যে কেউ অভুক্ত থাকবেনা, আমার সন্তান সুদর্শন হবে,দিগ্বিজয়ী হবে। এসব ভাবতে তো কারো মানা নেই,স্বপ্ন সকলেই দেখতে পারে। কিন্তু এই স্বপ্ন যে সত্যি হয়ে যাবে কে জানতো?
এই গ্রামে আসার পথে আমাদের গোষ্ঠী ভ্রমণের মাঝে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য একটা পাহাড়ি এলাকায় তাবু ফেলে। পাহাড় থেকে গ্রাম অনেক দূর আর এখানে খাওয়ার পানির কোনো ব্যবস্থা নেই,আশেপাশে জলাশয় আছে কিনা কেউ জানেনা। সংগ্রহে যা পানি আছে তা বেশি টিকবেনা।
তাই যে যেদিক পারে পানি খুঁজতে বেরিয়ে যায়। আমি তখন ১৪বছরের একজন কিশোরী,দুরন্তপনা রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আমিও বেড়িয়ে পড়ি পানি খোঁজার উদ্দেশ্যে পাহাড়ি জঙ্গলের মাঝে।
যেতে যেতে আমি অনেক গভীরে চলে যাই। সেই গভীর জঙ্গলেই আমি একটা পাহাড়ি ছোটো ঝর্ণা খুঁজে পাই।
আমি খুশিমনে মটকায় পানি ভরে সবাইকে জানাতে যাই যে আমি পানির খোঁজ পেয়েছি। সেখানেই আসার পথে সেই জ্বিনের সাথে দেখা হয় আমার।
বেশ তৃষ্ণার্ত আর দুর্বল ছিলেন তিনি,আমার কাছে তিনি কিছু খাবার চান।
আমার অনেক মায়া হয়েছিলো তার উপর,বৃদ্ধ মানুষ এই রকম জঙ্গলের মাঝে অনাহারে মা’রা যাবেন।
তাই আমি তাকে পানি খাইয়ে নিজের সাথেই নিয়ে আসি। আমাদের গোষ্ঠীর মানুষরা কাউকে হেয় চোখে দেখেনা।
তারাও বেশ সাচ্ছন্দের সাথে গ্রহণ করে তাকে।
তিনি দুর্বল হওয়ায় সেই ভ্রমণে তাকে আমি আমার সাথেই রেখে দিই,তাকে সেবা করে সুস্থ করার জন্য। বুড়ো বাবা ডাকতাম আমি তাকে,তিনিও আমাকে ‘চারু মা’ বলে ডাকতেন,বাবার মতো স্নেহ করতেন।
তিনিই পরে আমাদের বলেছিলেন তিনি জ্বিন। দীর্ঘদিন কোনো মানুষের দয়া না পাওয়ায় দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন তিনি। আমার সেবায় তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেন। সেই ভ্রমণকালীন সময়ে আমার মজার ছলে বলা ইচ্ছাগুলো শুনে তিনি যাওয়ার আগে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বরদান দিয়েছিলেন যে আমার অনেক বড় ঘরে বিয়ে হবে,আর আমার সন্তান অতি সুদর্শন ও দিগ্বিজয়ী হবে।
কিন্তু উনার সৌভাগ্যের আশায় দেওয়া এই বর আমার জীবনে এতো দূর্ভাগ্য বয়ে আনবে কে জানতো?
উনার কথা একেবারেই অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছিলো।
আমরা এই গ্রামে আসার পর জমিদার বাবু আমাদের খেলা দেখানোর জন্য জমিদার বাড়িতে ডাক পাঠান,সেখানে যেতেই তিনি আমাদের কবিরাজ চাচার থেকে কালো যাদুবিদ্যা সম্পর্কে জানতে আগ্রহ দেখান। তার মাধ্যমে কথায় কথায় আমার জ্বিন দ্বারা বরপ্রাপ্ত হওয়ার কথা জেনে ফেলেন তিনি।
টগবগে সুদর্শন যুবক তিনি তখন,আমাকে যখন তিনি বিয়ের প্রস্তাব দেন সবাই অবাক হয়ে যান। আমি তখন এসবের কিছুই বুঝিনা। বড়রা শুধু বুঝিয়েছিলো যে আমার ভাগ্য ফলে গেছে,জমিদারের বউ হবো আমি,আমার আর কোনো অভাব থাকবেনা।
সবার থেকে আলাদা হতে হবে বলে আমার প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও পরে আমাকে বোঝানোর পর আমি অনেক আনন্দিত হয়ে সায় দিয়ে দিই। আমি ভেবেছিলাম আমি সত্যিই অনেক ভালো থাকবো। আমার নিজের ঘর,নিজের সংসার,নিজের স্বামী,একটা বড় পরিবার হবে আমার।
কিন্তু সেদিন প্রকৃতপক্ষে আমি এই সোনার পিঞ্জিরায় বন্দী হয়েছিলাম চিরতরে।
আমার এখানে আমার পরিচয় সম্পর্কে বলার পর্যন্ত অধিকার ছিলোনা,এতে নাকি আমার স্বামীর সম্মানে দাগ লাগবে,আমার স্বামী শুধুমাত্র আমার সন্তানের জন্য আমার কাছে এসেছিলেন,আমাকে কখনো স্ত্রী হিসেবে মনে ধরেনি তার,এখানের কেউ আমাকে মানুষ হিসেবে পর্যন্ত মেনে নেয়নি,পরিবার ভাবা তো দূরের কথা। আমি প্রচন্ড একা এখানে। মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে আমার সেই যাযাবর পরিবারের কাছে ফিরে যেতে,কিন্তু তাদের তো কোনো ঠিকানা নেই। ওরা এখন কোথায় আছে আমি সেটাও জানিনা। আর জানলেও হয়তো,দ্বায়িত্ববোধের কারণে কখনো ফিরে যেতে পারতাম না। সব ছাড়তে পারলেও,আমার সন্তানকে ছাড়তে পারবোনা আমি।
বউমা, তুইতো আমার ছেলেকে দেখেছিস। ও হৃদয়হীন নয়। হীরের টুকরো ছেলে আমার,মনটা ওর একটা সাদা পাতার মতো। সেই খালি পাতা যে রঙে রাঙিয়ে তোলা হবে সেই রঙ ধারণ করবে সেটা। ও খারাপ নয়,ওর মনকে ছোট থেকে একটু একটু করে কলুষিত করা হয়েছে। আমার ব্যর্থতা এটা।
একজন মায়ের দ্বায়িত্ব এটা যে তার সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার, ওর জন্মের পরই অসুস্থ হয়ে পড়ি আমি,বছরের পর বছর বিছানাবন্দী ছিলাম আমি।
ছেলেটা আমার এর কোলে ওর কোলে চড়ে চড়ে বড় হয়েছে। ওকে হাতে ধরে হাঁটতে শেখানোর সৌভাগ্যটুকুও হয়নি আমার।
তাই হয়তো ছেলে আমার মায়ের থেকে বেশি বাইরের মানুষ থেকে বেশি শিখেছে,আর ওর আপন বাবা ওকে প্রতিনিয়ত নিজের সম্রাজ্য বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করে চলেছে।
আমি অনেক চেষ্টা করেছি ওকে বোঝানোর,কিন্তু ছেলে আমার মা থেকে বেশি বাবার আদর পেয়েছে। তাই তার কথাকেই বেশি বিশ্বাস করে সে। কিন্তু ওর এই অভ্যাসগুলো ওর জীবন এভাবে শেষ করে দিবে কে জানতো? আমার ছেলেকে বাঁচাতে হবে বউমা,ওর কিছু হলে আমার বেঁচে থাকার কোনো কারণ অবশিষ্ট থাকবেনা।”
“আমিতো সেটাই চাইছি মা।আমার অরণ্য এই মুহুর্তে ঠিক এই খাটটার উপর অচেতন পড়ে আছে একা একা। আমার সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই ফিরতে হবে আমার তার কাছে। আপনি অরণ্যকে একবার রাজি করান আমার কথা বসে একবার শুনতে। উনি আপনার এটুকু কথা ফেলবেন না।”
চারুলতার মনটা বিষিয়ে যায় মুহুর্তেই,তিক্ততার সাথে বলে উঠেন তিনি,
“আমি অবশ্যই বলবো তাকে তোর কথা শুনতে। কিন্তু আমাদের সম্পর্ক এখন আগের থেকেও অনেক খারাপ। জানিনা ও আমার এটুকু কথা রাখবে কিনা।”
“উনি রাখবেন মা। আপনি হয়তো জানেন না উনি আপনাকে অনেক ভালোবাসেন, শুধু প্রকাশ করতে পারেন না কারণ হয়তো এই অনুভূতিগুলো তার নিজের কাছেই অজানা এখনো। উনার উপর অভিমান করে থাকবেন না মা। আমার অরণ্য ১০৪বছর ধরে আপনার সমাধির সামনে চোখের জল ফেলেছে,ও নিজের ব্যবহারের জন্য অনুতপ্ত। আর হয়তো এই অরণ্যও অনেক জলদি সেটা বুঝতে পারবে যে আপনি কি উনার জন্য। আমি বোঝাবো উনাকে। আপনাকে আমি এই অবস্থায় রেখে যাবোনা।”
চারুলতা সামনের মেয়েটির মায়াবী মুখটার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। শেষবার কবে কারো সাথে এভাবে মন খুলে কথা বলতে পেরেছেন মনেও নেই তার। তিনি শ্যামার কপালে চুমু খেয়ে বলেন,
“তোকে দেখে কি শান্তি লাগছে রে বউমা বলে বোঝাতে পারবোনা। আমার অনেক স্বপ্ন ছিলো আমার পুত্রবধূকে দেখার। কিন্তু অরণ্য এমন নারী বিদ্বেষী যে আমি আশা ই ছেড়ে দিয়েছিলাম ওর সংসার দেখে ম’রতে পারবো আমি।
আমার অপদার্থ ছেলেটা এতো মিষ্টি একটা মেয়েকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছে ভাবতেই শান্তি লাগছে আমার। ওকে সারাজীবন এভাবেই আগলে রাখিস ফিরে যাওয়ার পর। আর তাকে বলে দিস,আমি ওকে ক্ষমা করে দিয়েছি। অতীতের সব ভুলে নতুন করে জীবন সাজাতে বলবি,ও হাসিখুশি থাকলে আমি যেখানেই আছি ভালো থাকবো।
সে যাক অনেক কথা হলো। সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। চল অরণ্যের কাছে। ওকে বোঝাতেও তো তোর সময়ের প্রয়োজন হবে।”
শ্যামা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মৃদু হেসে সায় দেয় তার কথায়।
চারুলতা বাইরে দাঁড়ানো দাসী ডেকে তাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে অরণ্য এই মুহুর্তে খাবারঘরে অতিথিদের সাথে বসে আছে। চারুলতা শ্যামাকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে অরণ্যের কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
চারুলতা শরীরের দুর্বলতার জন্য বেশ আস্তেধীরে হাঁটেন,তাই শ্যামাকেও আস্তেধীরে নামতে হয় সিঁড়ি বেয়ে। নামতে নামতে শুনতে পায় তারা খাবারঘর থেকে ভেসে আসা কথাবার্তাগুলো।
(চলবে)
#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ৪১
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন
শত অনীহার স্বত্তেও অরণ্যকে নিজে নীচে আসতে হলো রিচার্ড সাহেবের সাথে কথা বলতে। হাজার হোক,ব্যবসায়িক সম্পর্কটা তৈরি হয় বিশ্বাসের উপর। আজ সে প্রথমবার তার পক্ষের চুক্তি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। সেটার ক্ষমা চাওয়ার জন্য সে বাবা বা অন্য কাউকে পাঠাতে পারেনা।
তবে বসার ঘরে এসে রিচার্ড সাহেবের সাথে আনা উটকো ঝামেলা মানে তার মেয়ে ইলিয়ানাকে আশেপাশে না দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। যেখানেই গিয়ে ম’রুক,তার কাছে না আসলেই হলো।
রিচার্ড সাহেব তাকে দেখেই এক গাল হেসে দাঁড়িয়ে মাথার টুপি নামিয়ে সাহেবি ভঙ্গিতে করমর্দন করলেন যেটা তিনি সবসময়ই করেন। কিন্তু আজকে হঠাৎ এগিয়ে এসে আলিঙ্গনও করলেন। ব্যপারটা খানিকটা খটকা লাগলেও তেমন গুরুত্ব দিলোনা অরণ্য।
কথাবার্তা না ঘুরিয়ে সোজাসুজি বলে দিলো এইবারের আমের চালান কিছু সমস্যার কারণে দিতে পারছেনা। অরণ্য ভেবেছিলো রিচার্ড সাহেব রেগে যাবেন বা অন্তত কিছুটা আফসোস করবেন যে এতোদূর এসে উনাকে খালি হাতে ফিরে যেতে হবে।
তবে আশ্চর্যজনকভাবে রিচার্ড সাহেব যেনো গায়েও মাখলেন না ব্যপারটা,তার ভাঙা ভাঙা বাংলায় একগাল হেসে বলে উঠলেন তিনি,
“আরেহ জমিদার সাহেব, আপনি অহেতুক চিন্তা করিতিছেন। এমনটা মাঝেমধ্যে হওয়া ভ্যারি নরমাল। তাছাড়া আমরা এতো সময় ধরে বিজনেস করিতেছি,আমরা এখন ফ্যামিলি।
তাই আপনার স্যরি বলার কোনো প্রয়োজন নাই।”
অরণ্যের খানিকটা আজিব লাগলেও ব্যাপারটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামালোনা সে। রিচার্ড সাহেব শান্ত আছেন তাহলে তার অশান্ত হয়ে লাভ কি। সেও মুখে সৌজন্যতামূলক হাসি বজায় রেখে রিচার্ড সাহেবের কথায় সুর মেলাতে থাকে। তবে আজ রিচার্ড সাহেবের ব্যবহার যেনো একটু বেশিই অমায়িক,ব্যপারটা তাকে রীতিমতো অবাক করছে। তাকে আরও খানিকটা অবাক করে দিয়ে তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন,
“চলুন জমিদার সাহেব, আপনাদের ডায়নিং রুমে চলুন। আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ এবং একটা উত্তম প্রস্তাব আছে আমার কাছে।”
অরণ্য এমন অপ্রত্যাশিত কথা শুনে বেশ চমকে যায়। রিচার্ড সাহেবের আপ্যায়নের জন্য যথেষ্ট আয়োজন করা হয়েছে এখানে,তবু ঘরের অতিথি হয়ে নিজ থেকে তিনি বলছেন খাবারঘরে যাওয়ার জন্য। ব্যপারটা বেশ অপ্রত্যাশিত। তবু সৌজন্যতার খাতিরে বলে উঠে সে,
“ঠিক বলেছেন রিচার্ড সাহেব। আমারও দুপুরের পর আর খাওয়া হয়নি। খাবারঘরে রাতের খাবার খেতে খেতেই নাহয় আপনার প্রস্তাব শোনা যাবে।”
আপ্যায়নরত চাকরকে ইশারায় খাবারের ব্যবস্থা করতে বলে তারা গল্প করতে করতে চলে যায় খাবারঘরে। সেখানে গিয়ে বসার কিছুক্ষণ পর খাবারের বাটি নিয়ে আসতে লাগলো চাকররা,আর তাদের মধ্যমণি হিসেবে পথ দেখিয়ে আনছে ইলিয়ানা। স্বর্ণকেশী ইংরেজ সুন্দরী আজ নিজের আধুনিক পোশাক ছেড়ে বাঙালি তাতের শাড়ি পড়েছে,সাথে হাতে চুড়ি,কানে দুল,কপালে টিপ,এমনকি চুলগুলোও খোপা করে বেধে সেজেছে। এর এমন বেশভূষা এবং এসব আয়োজন দেখে অরণ্যের বুঝতে আর বাকি রইলো না কি চলছে এখানে বা এরপর কি হতে চলেছে। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে যায় তার।
রিচার্ড সাহেব এদিকে তার অমায়িক হাসি আরও খানিকটা প্রসারিত করে বলে উঠেন,
“আমার প্রিন্সেস আজকে নিজ হাতে রান্না করিয়া নিয়ে আসিয়াছে আপনাদের জন্য জমিদার সাহেব,এগুলো আবার নিজ হাতে গরম করিয়া আনতে গিয়াছিলো। ও অনেকদিন ধরে বাঙালি আদব কায়দা শিখিবার চেষ্টা করিতাছে। এসব রান্নাও অনেক পরিশ্রম করিয়া শিখিয়াছে সে। টেস্ট করিয়া বলুন কেমন হইয়াছে।”
অরণ্য এবার তার সুরে সুর মেলাতে পারলোনা, তার সৌজন্যতামূলক হাসিটাও মিলিয়ে গেছে অনেক আগে। সে তাকে চোখ মুখ গম্ভীর করে জিজ্ঞেস করে,
“রিচার্ড সাহেব,আপনি জানেন আমি বোকা না যে বুঝতে পারবোনা আপনার অন্য কোনো মতলব আছে,আর সেটা আপনিও ভালো করেই জানেন। আমাদের সম্পর্ক সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক।আমাদের সম্পর্ক এতটা গভীরও নয় যে আপনার মেয়ে সেজেগুজে আমার জন্য রান্না করে আনবে,আবার আমারই ঘরের রান্নাঘরে গিয়ে খাবার গরম করে এনে আমাকে নিজ হাতে পরিবেশন করবে।
আপনারা ঠিক কি করতে চাইছেন ঝেড়ে কাশুন তো?”
রিচার্ড সাহেব অরণ্যের শীতল কন্ঠস্বর শুনে খানিকটা দমে গেলেও মেয়ের আশাবাদী চাহনির দিকে তাকিয়ে তার অমায়িক হাসি বজায় রেখে বলেন তিনি,
“জমিদার বাবু, আমার শুধু একটাই সন্তান আছে। আর সেটা হলো মাই ডটার মাই প্রিন্সেস ইলিয়ানা। আমার যাহা কিছুই আছে সব ওর আর ওর ভবিষ্যৎ পার্টনারের জন্যই। ওর মা মা’রা যাওয়ার পর আমি ওকে ছোট থেকে একাই মানুষ করিয়াছি। ওর কোনো ইচ্ছা অপূর্ণ রাখিনি। আমি সোজা কথা বলিব, আমার মেয়ের আপনাকে অনেক পছন্দ হইয়াছে এবং সে আপনাকে বিবাহ করিতে চায়। আমারও আপনাকে পছন্দ তাই আমি সম্মতি দিয়া দিয়েছি,আপনার বাবার সাথেও এই নিয়ে কথা হয়েছে আমার। তিনিও এই সম্পর্কে সন্তুষ্ট। আমি এখানে আজ নিজে এসেছি আপনার মতামত জানিতে। আমার প্রিন্সেস এর মধ্যে কিন্তু কমতি নেই, অসম্ভব সুন্দরী সে,এডুকেটেড,আর তার গুণ তো দেখলেনই আপনি। এতোগুলো বাঙালি রান্না সে একা নিজ হাতে করিয়াছে,অল্প সময়েই সে আপনাদের বাঙালি আদব কায়দা আয়ত্ব করিয়া নিয়াছে।”
অরণ্য রাগে বিরক্তিতে বাকরুদ্ধ হয়ে যায় এসব শুনে,সবচেয়ে বড় কথা,তার বাবা এই সম্পর্কে তাকে কিছুই বলেনি আগে। এতো বড় সিদ্ধান্ত তার কোনো মত ছাড়া কিভাবে নিতে পারেন উনি?
তার ভাবনার মাঝেই ইলিয়ানা তার প্লেটে ভাত বেরে ইলিশ মাছ তুলে দিতে দিতে লাজুক কন্ঠে বলে উঠে,
“অরণ্য, ফিশ নাকি বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় খাবার, তাই আমি আজকে নিজ হাতে আপনার জন্য ইলিশ মাছ রান্না করিয়াছি…”
অরণ্য বিরক্ত হয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই শ্যামা ইলিয়ানার মাছ এগিয়ে দেওয়া হাতটা ধরে ফেলে।
প্রচন্ড রেগে আছে সে এই মুহুর্তে,তার উপস্থিতিতে অরণ্যের অন্য নারীর সাথে বিয়ের কথা সে কোনোমতে সহ্য করতে পারছিলো না। তাই মায়ের আগেই দ্রুতকদমে চলে আসে সে এই ঘরে।
এদিকে হঠাৎ তার উপস্তিতিতে চমকে উঠে সবাই,অরণ্য সবচেয়ে বেশি চমকালো শ্যামার পরবর্তী কথাগুলো শুনে।
ইলিয়ানাকে উদ্দেশ্য করে চোখ মুখ শক্ত করে বাঁকা হেসে বলে উঠে শ্যামা,
“আহারে আফা, এতো কষ্ট করে মাছ রাঁধলেন উনার জন্য,কিন্তু আফসোস উনি এই মাছ খেতে পারবেন না। আমার উনি চিংড়ি মাছ ছাড়া কোনো মাছই খান না। ছোটোবেলায় একবার উনার গলায় মাছের কাঁটা বিধে গিয়েছিলো,অনেকদিন কষ্ট দিয়েছিলো সেই কাঁটা উনাকে। এখন আমার উনি হচ্ছেন বিদ্রোহী মানুষ,উনাকে কেউ কষ্ট দিলে তাকে দু চার ঘা ফেরত না দিলে শান্তি নেই উনার। কিন্তু হাজার হোক গলার কাঁটাকে দু চার ঘা দেওয়া তো দূরের কথা,উপড়েও ফেলতে পারেন নি। সেই রাগ থেকেই তিনি আর কখনো কাঁটাযুক্ত মাছ খান নি। একমাত্র চিংড়ি মাছ খান কারণ সেটা ভদ্র মাছ,ভেতরে কোনো শয়তানি নেই। আর আপনার হাতের এই ইলিশ মাছ হলো কাঁটার রাজা,পেটে পেটে শয়তানি এই মাছের। এই মাছ উনি খাবেন না,আশা করি বোঝাতে পেরেছি?”
অরণ্য তব্দা খেয়ে বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে থাকে মেয়েটির পানে। এমন গোপন কথা সে জানলো কি করে?সে তো সবাইকে শুধু বলেছিলো সে মাছ পছন্দ করেনা। এভাবে একঘর চাকর আর অতিথির সামনে এই কথা ফাঁস হওয়ায় মনে মনে লজ্জায় পড়ে যায় সে।
এদিকে ইলিয়ানা ও তার বাবাও কম অবাক হয়নি।
ইলিয়ানা ভ্রু কুঁচকে সামনের মেয়েটিকে উপর নীচ পর্যবেক্ষণ করতে করতে অরণ্যকে উদ্দেশ্যে করে বলে উঠে,
“হোয়াট?! হু ইজ সি অরণ্য?”
শ্যামা সাথে সাথে বলে উঠে,
“ইউ স্পিক ইংলিশ? আই এম হিজ ওয়াইফ। ওয়াইফ অফ অরণ্য তালুকদার, শ্যামা তালুকদার ইজ মাই নেম। এম আই ক্লিয়ার?
আর বারবার অরণ্য অরণ্য করতেছেন কেনো আফা?আমার উনিকে উনার মা-বাবা ছাড়া নাম ধরে ডাকার অধিকার শুধু আমার রয়েছে। আপনি উনাকে শুধু ‘জমিদার সাহেব,মালিক,মনিব’ এগুলো ডাকতে পারেন,এগুলো সহ্য নাহলে দুলাভাই বা ভাইয়া ডাকবেন,আমি অনুমতি দিলাম যান”
রিচার্ড সাহেব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে অরণ্যকে,
“হোয়াট?! জমিদার বাবু,আপনি ম্যারিড?এই মেয়ে আপনার ওয়াইফ?এই সম্পর্কে তো আমাকে কখনো বলা হয়নি।”
অরণ্য এক ধ্যানে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে তখন শ্যামাকে, রিচার্ড সাহেবের কথায় সম্বিৎ ফিরে তার।সে রিচার্ড সাহেবের কথার কোনো জবাব না দিয়ে শ্যামাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি এখানে কি করছো?”
শ্যামা চরম অভিমান নিয়ে বলে,
“কেনো?আমার এখানে আসাতে আপনার প্রায় পাকা হয়ে যাওয়া বিয়ের সম্মন্ধ হাতছাড়া হয়ে যাবে বলে কষ্ট হচ্ছে? আপনাকে আমি কি বলেছিলাম?আমি যতক্ষণ এই দুনিয়ায় আছি ততক্ষণ আপনিও আমার অরণ্য,আমি যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা হলোনা? আমি থাকা অবস্থায় আপনি এভাবে অন্য মেয়েদের আপনার কাছে আসতে দিবেন আর আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখবো নাকি?অসম্ভব এটা! আর ও আপনাকে অরণ্য বলে ডাকলো আপনি ওকে কিছু বললেন না যে?আমাকে তো তখন কত কথা শুনিয়ে দিলেন। নাকি ও আমার থেকে বেশি সুন্দর তাই আপনার মন গলে গেছে?আপনি না বলেছিলেন আপনি আপনার বাবার মতো সুন্দরের পূজারি মানুষদের ঘৃ’ণা করেন?তাহলে ওকে কাছে আসতে দিচ্ছেন কেনো?”
“চুপ করবে তুমি?!” রেগে জোরে ধমক দেয় অরণ্য। ধমকে কাজ হলো হয়তো,শ্যামা চুপ করে ঠোঁট উল্টে চোখের পানি ফেলতে শুরু করে তখন।
অরণ্য উঠে দাঁড়িয়ে শ্যামার হাত ধরে রিচার্ড সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
“রিচার্ড সাহেব,আমার মনেহয় আমাদের ব্যবসায়িক সম্পর্কের এখানেই ইতি টানতে হবে। আমার দ্বারা আপনার প্রস্তাব গ্রহণ করা সম্ভব নয়। আমার বাবা আমাকে না জানিয়ে আপনাকে কথা দিয়েছেন,এই জন্য ক্ষমাপ্রার্থী আমি।”
বলেই চলে যেতে উদ্ধত হয় সে,কান্নারত ইলিয়ানা তাকে থামানোর চেষ্টা করতে চেয়েও অরণ্যের রাগী চোখ দেখে পারলোনা। শ্যামা অরণ্যের জবাব শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
চারুলতাও অনেকক্ষণ আগে উপস্থিত হয়েছেন এই ঘরে,নীরবে সব পর্যবেক্ষণ করছিলেন তিনি একপাশে দাঁড়িয়ে। অরণ্য শ্যামার হাত টেনে তাকে নিয়ে যেতে উদ্ধত হলে তিনি গম্ভীর সুরে ডেকে উঠেন,
“অরণ্য….”
সাথে সাথে সব রাগ পানি হয়ে যায় তার,চকিতে ফিরে তাকায় মায়ের দিকে। তারপর শান্ত কন্ঠে জবাব দেয়,
“জ্বি মা?”
চারুলতা অরণ্যের চোখের দিকে না তাকিয়ে অন্যদিকে দৃষ্টি রেখে শান্ত গলায় বলে উঠে,
“গত পাঁচ বছর ধরে আমি তোমার কোনো কাজেই বাঁধা দিতে আসিনি,কখনো কোনো আবদার করিনি আমি। আজ সামান্য একটা জিনিস চাইলে দিবে?কথা দিচ্ছি এটাই শেষ,এরপর আর কিছু চাইবোনা।”
অরণ্য আহত গলায় বলে উঠে,
“মা, তুমি আমার থেকে একটা কেনো হাজারটা জিনিস চাইতে পারো। আমার সাধ্যের মধ্যে হলে সব দিতে রাজি আমি।”
“হাজারটা জিনিস চাইনা অরণ্য। একটা জিনিসই চাই,আর এই জিনিসটা তোমার সাধ্যের বাইরে কিছুও নয়। এই মেয়েটার তোমাকে কিছু কথা বলার আছে, ওর কথাগুলো একবার শুনে নাও,তারপর সে তোমার কাছে একটা ক্ষুদ্র সাহায্য চাইবে। ওকে সাহায্য করো।
এটুকুই বলার ছিলো আমার,তুমি যেতে পারো।”
শ্যামা অরণ্যের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে,
‘এতোই কথা বলতে ইচ্ছে করে যখন মায়ের সাথে,তাহলে এই অভিমান তোমরা দুজনেই কেনো পুষে চলেছো,যা দিন শেষে তোমাদের দুজনকেই কষ্ট দিচ্ছে?’
অরণ্য মায়ের কথায় মাথা নীচু করে সম্মতি দিয়ে শ্যামাকে নিয়ে চলে যায় তার ঘরের উদ্দেশ্যে। অরণ্য তখনও নীরবে মাথা নীচু করে হাঁটছে।
দোতলার করিডোর ধরে যাওয়ার সময় শ্যামা বলেই ফেলে তার মনের কথা,
“আপনাদের মনে হয়না অনেক হয়েছে?মা ছেলে দুজনেই একজন আরেকজনকে ভালোবাসেন, অথচ ঠুনকো অভিমান আর নিজেদের জিদের কারণে একজন আরেকজনকে দূরে ঠেলে দিচ্ছেন। দিন শেষে দুজনেই কষ্ট পাচ্ছেন। তাহলে এই জিদ টা ধরে রাখা কি খুব বেশি জরুরি?”
অরণ্যের হঠাৎ যেনো মনে হলো মেয়েটা তার অন্তরটাই পড়ে ফেলতে পারছে কোনোভাবে,এই ভাবনাটা প্রচন্ড অস্বস্তিকর তার জন্য,থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো সে মাঝপথে।
শ্যামার দুই বাহু খামছে ধরে তাকে কাছে টেনে এনে চোখে চোখ রেখে শীতল গলায় প্রশ্ন করে তাকে,
“তুমিতো এভাবে কথা বলো যেনো আমার সম্পর্কে সব জানো তুমি। কতটা জানো তুমি আমার সম্পর্কে?”
শ্যামা দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথাটা হজম করে, পাল্টা অরণ্যের চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায় বলে উঠে,
“বিশ্বাস করুন অরণ্য,আপনার সম্পর্কে আমি যতটা জানি ততটা আপনিও নিজ সম্পর্কে জানেন না। এই দেখুন না, আপনি আপনার মাকে এতো ভালোবাসেন।আমি জানি,দেখতে পাচ্ছি,বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনি নিজেই বুঝতে পারছেন না আপনার অনুভূতিগুলো,মা চিরতরে হারিয়ে না গেলে হয়তো বুঝতেও পারবেন না। ভেবে দেখুন একবার, আপনার সামনে যদি আপনার মাকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মা’রা হয় সহ্য করতে পারবেন….”
অরণ্যের হাতের জোর আরও খানিকটা বেড়ে গেলো,ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো শ্যামা,তারপর শোনা যায় অরণ্যের বজ্রকন্ঠ,
“মুখ সামলে কথা বলো মেয়ে! আমার মায়ের নামে এমন বাজে কথা বলার সাহস হয় কি করে তোমার?!”
শ্যামা পাল্টা জবাব দেয়,
“চিল্লাবেন না একদম! আমার মাত্র মুখে বলা কথা কল্পনা করা সহ্য হয়নি তো আপনার? আমার অরণ্য এগুলো বাস্তবে সহ্য করেছে,ওর কি অবস্থা হয়েছে আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। তাই বলছি, সময় থাকতে শুধরে যান জমিদার অরণ্য তালুকদার!”
শ্যামার বলা কথাগুলো শুনে এক অজানা কারণে বুক ধ্বক করে উঠলো অরণ্যের, যেনো চিরন্তন সত্য কথা বলছে এই মেয়েটা।
তার ভাবনার মাঝেই শ্যামা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গটগট পায়ে হেঁটে চলে যায় অরণ্যের কক্ষে।
অরণ্য তখনো বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে আছে তার গমনরত পিঠের দিকে।
এতোক্ষণে সে বুঝে গিয়েছে মেয়েটার মধ্যে কিছু তো রহস্য রয়েছে। নয়তো সে তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে এতো কিছু জানে কিভাবে? আর তার এই অকল্পনীয় কথাবার্তার রহস্য কি?এখন তার নিজেরই জানতে ইচ্ছে হচ্ছে।
নিজেকে ধাতস্থ করেই সে এগিয়ে যায় তার কক্ষের দিকে,যেখানে মেয়েটা অনেক আগেই ঢুকে গেছে,যেনো এই ঘরটি তার অনেক চেনা,এখানে আসা তার নিত্যদিনের কাজ।
অথচ সে তাকে বলেও দেয়নি এদিকের কোন ঘরটি তার, এই মেয়েটা জানলো কি করে?
(চলবে)