#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ৪২ (প্রথমাংশ)
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন
রাত দশটা পার হয়েছে। অরণ্যের ঘরের গোল টেবিলের দুই পাশের দুই চেয়ারে মুখোমুখি বসে আছে শ্যামা আর অরণ্য। শ্যামা মাত্রই তার সব কথা বিস্তারিত বলা শেষ করে আশাবাদী চাহনিতে তাকিয়ে আছে অরণ্যের দিকে,জানতে চাইছে তার প্রতিক্রিয়া।
অরণ্য পুরোটা সময় এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিলো চুপচাপ,কোনো কথা বলেনি। সে আসলেই সবকিছু বুঝতে পেরেছে কিনা এই নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হতে থাকে শ্যামার মনে।
অরণ্যের নীরবতা আর সহ্য করতে না পেরে শ্যামা বিচলিত কন্ঠে বলে উঠে,
“আপনি কি আমার কথাগুলো বুঝতে পেরেছেন অরণ্য?”
অরণ্য তার দৃষ্টি না সরিয়েই শান্তকন্ঠে জবাব দেয়,
“হুম বুঝতে পেরেছি। তোমার কথা অনুযায়ী,অন্য একটি দুনিয়ায় আজকে আমবাগানে আমি জ্বিন দ্বারা অভিশপ্ত হয়েছিলাম,সেই অভিশাপের কারণে আমার মা ছাড়া সবাই আমার থেকে দূর হয়ে যায়,তারপর আমার শত্রুরা বিদ্রোহ করে এক সন্ধ্যায়,তাদের হাতে আমি ছাড়া জমিদার বাড়ির সবার মৃ’ত্যু হয়,আমার মাকে আমার সামনে জ্যান্ত পুড়িয়ে মা’রা হয়, আবার আমার ক্ষমতাবলে তাদের মৃ’ত্যুও আমার হাতেই হয়,কিন্তু এই ঘটনায় আমার মানুষ সত্ত্বা জ্বিন সত্ত্বার দখলে চলে যাওয়ায় আমার স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়,আবার মায়ের মৃ’ত্যুর পর আমাকে অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি দেওয়ার মানুষও আর অবশিষ্ট থাকেনা,আমি সেই অবস্থায় অনেক বছর কাটানোর পর অন্য একটি জ্বিনের সাথে বন্ধুত্ব হয় আমার। সে আমাকে অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি দেওয়ার মানুষ খুঁজে বের করতে সাহায্য করে,১০৪বছর পর অবশেষে তোমার সাথে কিছু শর্ত মেনে বিবাহ হয় আমার,তোমার মাধ্যমে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা খুঁজে পেতে সফল হই আমি এবং চন্দ্রগ্রহণের রাতে আমার অভিশাপ ভঙ্গ ও হয়, কিন্তু সেই জ্বিন তোমার উপর খুশি হয়ে ভাগ্যসুতো দিয়েছিলো,যার কারণে তুমি তোমার স্বামীকে ফিরে পাওয়ার একটা সুযোগ পেয়েছো, আর এই সুযোগটা হলো তুমি পুরো ভিন্ন একটি জগতে প্রবেশ করেছো যেখানে আমি এখনো অভিশপ্ত হইনি,আমাকে তোমার হাত ধরে মায়ের ঘরে প্রবেশ করতে হবে, তখন তোমার অরণ্যের সাথে আমার আত্মার একটি সাময়িক সংযোগ সৃষ্টি হবে,তোমার অরণ্য আমার মানুষ সত্ত্বা থেকে শক্তি লাভ করবে যার ফলে সেই অভিশপ্ত জ্বিন তাকে নিয়ে যেতে পারবেনা তার সাথে। তারপর তুমি তোমার অরণ্যকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে ফিরে পাবে তাইতো?”
শ্যামা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো,যাক উনি তাহলে শুনেছেন সবকিছু,
“জ্বি,ঠিক তাই। এবার আপনাকে আমার হাত ধরে মায়ের ঘরে যেতে হবে শুধু,তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।”
অরণ্য এক দৃষ্টিতে মেয়েটির ক্লান্ত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে অল্প সময়ে অনেক বড় ঝড় বয়ে গেছে তার উপর। তবুও তার কথাবার্তার মধ্যে কোনো জড়তা নেই,এতোগুলো অবিশ্বাস্য কথা এক নাগাড়ে এভাবে বলে গেছে যে শুনতে মিথ্যে মনে হলেও অবিশ্বাস করতেও মন চাইছেনা তার।
সে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে এবার,
“একটা কথা বলো আমাকে। তোমার সামনে যদি অপরিচিত কেউ গিয়ে হঠাৎ এই রকম কোনোকিছু বলতো,তুমি কি তাকে বিশ্বাস করতে?”
“প্রমাণের উপর নির্ভর করে সেটা। আমি জানি আমার কথাগুলো ঠিক কতটা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে আপনার কাছে,সেটাই স্বাভাবিক। তবে আমি খুব সহজেই প্রমাণ করে দিতে পারি যে আমি সত্যি বলছি।”
অরণ্য কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“প্রমাণ করে দিতে পারো?সেটা কিভাবে?”
শ্যামা উৎসাহী গলায় বলে উঠে,
“খুব সহজ। আপনি আমার হাত ধরে মায়ের ঘরে নিয়ে চলুন। সেখানে প্রবেশের সাথে সাথে আমি মিলিয়ে যাবো এই দুনিয়া থেকে। আমার সাথে মায়ের ঘরে যাওয়া তো তেমন কোনো বড় কাজ না,খুব সহজে প্রমাণ হয়ে যাবে সব।”
অরণ্যের বুকের বাম পাশটায় হঠাৎ চিনচিনে ব্যথা অনুভব হলো তার। মেয়েটা মিলিয়ে যাবে তার চোখের সামনে থেকে, এই ভাবনাটা কোনো এক অজ্ঞাত কারণে পছন্দ হলোনা তার।
শ্যামা অরণ্যকে এভাবে নীরবে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তাড়া দিয়ে বলে,
“কি হলো?চলুন মায়ের ঘরে।”
অরণ্য চোখ সরিয়ে নিয়ে গম্ভীর গলায় বলে উঠে,
“এতো তাড়া কিসের?সবে রাত দশটা পার হলো। তোমার কাছে রাত তিনটা পর্যন্ত সময় আছে।”
শ্যামা আশ্চর্য হয়ে বলে,
“কিন্তু শুধু শুধু দেরি করবো কেনো?আমার অরণ্য ওই দুনিয়ায় পুরো একা এই মুহুর্তে,আমি ওর কাছে যত দ্রুত সম্ভব ফিরে যেতে চাই।”
অরণ্য হঠাৎ রেগে বলে উঠলো,
“কিন্তু আমি তা চাইনা!”
চমকে উঠে শ্যামা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
“মানে?”
অরণ্যের সম্বিৎ ফিরে হঠাৎ,এমন কেনো করছে সে নিজেও জানেনা। সে তার কন্ঠের গাম্ভীর্য বজায় রেখে আমতা আমতা করে জবাব দেয়,
“দুপুরের পর আমার খাওয়া হয়নি,তোমারও নিশ্চয় হয়নি। আমি খাবার দিতে বলছি,ক্ষিধে পেয়েছে আমার।”
শ্যামা ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠে,
“আমার ক্ষিধে পায়নি,আপনি জলদি জলদি খেয়ে নিন। তারপর আমাকে নিয়ে চলুন।”
“আমি কিন্তু তোমার কথা মানতে বাধ্য নই শ্যামা। শুধু মা বলেছেন বলে আমি তোমার সাথে শান্তভাবে কথা বলছি। তিনিও চাইবেন না তুমি না খেয়ে থাকো। আশা করি আমার কথার অবাধ্য হয়ে আমার রাগ তুলবেনা,আমার রাগ উঠলে কিন্তু আমিও অবাধ্য হবো।”
শ্যামা চুপ করে যায় এবার,সে রাগিয়ে দিতে চায়না এই অরণ্যকে। অনেক কষ্টে মায়ের সাহায্যে এটুকু রাজি করিয়েছে। পরে না সব বৃথা হয়ে যায়।
অরণ্য শ্যামাকে চুপ হয়ে যেতে দেখে মনের অজান্তেই মুচকি হাসে। সে বাইরে অপেক্ষারত চাকরকে নির্দেশ দিতেই কিছুক্ষণের মধ্যে খাবার পরিবেশণ করা হয় টেবিলে।
শ্যামা তখনও নীরবে মাথা নীচু করে বসে থাকে।
চাকরটি খাবার সাজিয়ে চলে যেতেই অরণ্য আদেশ করে শ্যামাকে,
“নাও এবার নিজের হাতে খাইয়ে দাও আমাকে”
হঠাৎ এমন অপ্রত্যাশিত কথা শুনে চমকে উঠে তাকায় শ্যামা অরণ্যের দিকে। অরণ্য চেয়ার টেনে শ্যামার পাশে বসতে বসতে বাঁকা হেসে বলে উঠে,
“চমকালে মনে হলো যে? তুমিই তো বলেছিলে,এই দুনিয়ায় তুমি যতক্ষণ আছো,আমিও তোমার অরণ্য,তাইনা?এই কথার জোরেই তো তুমি আমাকে নাম ধরে ডাকছো,জড়িয়ে ধরেছো আমাকে,চুমু পর্যন্ত খেয়েছো,আমার বিয়ে ভাঙ্গার চেষ্টা করেছো। আমার উপর তোমার অরণ্যের মতো অধিকার খাটাতে পেরেছো, তাহলে তোমার অরণ্যের মতো নিজ হাতে খাইয়ে দেওয়ার কথায় এতো চমকে উঠছো কেনো?”
শ্যামা বেশ লজ্জায় পড়ে যায় মনে পড়ে যাওয়ায় যে সে এখানে আসার পর কি কি করেছে। কোনো জবাব দেওয়ার মুখ নেই তার আর। সে চোখ সরিয়ে নেয় অরণ্যের দুষ্টু চোখের চাহনি থেকে। চুপচাপ হাত ধুয়ে ভাত বেড়ে মাখাতে লাগলো।
অরণ্য তখনও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শ্যামার দিকে।
শ্যামা যখন হাত বাড়িয়ে ভাতের লোকমা তুলে ধরে তার দিকে,হঠাৎ হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানিটা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগলো তার,ভাতের লোকমা মুখে নিতে গিয়ে লজ্জায় কানের লতি লালচে বরণ ধারণ করলো। এভাবে শুধু মা খাইয়ে দিতো ছোটোবেলায়, এভাবে হঠাৎ পরিচয় হওয়া মেয়ের হাতে খেতে সংকোচ তো হবেই,তবে এই অনুভূতিটা ভীষণ পরিচিত ঠেকলো তার কাছে। অনেক ভালো লাগছে হঠাৎ,এই অনুভূতিটা সত্যি অনেক সুন্দর।
কিন্তু সাথে ভীষণ রাগও হলো মেয়েটার প্রতি। এইযে তার বুকের মাঝে উথাল-পাতাল শুরু হয়ে গিয়েছে,কিন্তু সেই তান্ডবের সৃষ্টিকারী রমণীটির মাঝে কোনো পরিবর্তন নেই।তার অভিব্যক্তি এমন যেনো এই কাজ তার নিত্যদিনের কাজ,অবশ্য তার কথা অনুযায়ী এটা তার নিত্যদিনেরই কাজ বটে। হঠাৎ এক অজানা হিংসা এসে মনে ভর করলো তার,জানতে ভীষণ ইচ্ছে হলো প্রথমবার যখন সে অরণ্যকে খাইয়ে দিয়েছিলো তার অভিব্যক্তি কেমন ছিলো?
অরণ্যও তার হাত ধুয়ে ভাত মাখিয়ে মেয়েটির সামনে সামনে তুলে ধরলো,যা সে বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করলো। তার মনের ঝড় আরোও খানিকটা তীব্র হলো। কিন্তু সামনের রমণীটি তখনও স্বাভাবিক। ভীষণ অভিমান হলো জমিদার অরণ্য তালুকদারের।
তাকে এক নজর দেখার জন্য রমণীরা মুখিয়ে থাকে,আর এই মেয়ে তার এতোটা সান্নিধ্যে আসার পরেও এতোটা ভাবলেশহীন কিভাবে থাকতে পারে?
এই একপাক্ষিক মনের দ্বন্ধের মাঝেই শেষ হলো খাওয়ার পর্ব। চাকররা এসে টেবিল পরিষ্কার করে দিয়ে চলে যায়।
শ্যামা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সাড়ে এগারোটা ছুঁই ছুঁই। সে এবার আশাবাদী কন্ঠে অরণ্যকে জিজ্ঞেস করে,
“আমি আপনার কথা শুনেছি। এবার যাবেন তো?”
অরণ্য হাত মুছে শ্যামার কাছে টানা সেই চেয়ারে বসতে বসতে বলে,
“মাত্র খাবার খেয়েছি,আমার একটু বিশ্রামও তো প্রয়োজন। এতো তাড়া কিসের তোমার?তোমার কাছে এখনো তিন ঘন্টা থেকেও বেশি সময় আছে।”
খানিকটা আশাহত হয় শ্যামা অরণ্যের কথা শুনে,তবু পাল্টা কোনো প্রতিবাদ করলোনা। উনি রেগে গিয়ে যদি আবার একেবারেই মানা করে দেয় যাওয়ার জন্য সেই ভয়ে।
অরণ্য শ্যামার পাশ ঘেঁষে বসে পর্যবেক্ষণ করে তাকে। উৎকন্ঠা মেয়েটির চোখে মুখে ফুটে উঠেছে। তার মায়াবী চোখ গুলো বারবার শুধু দেওয়ালের ঘড়ির দিকে লক্ষ্য করছে। টেবিলের উপর রাখা হাতগুলো মনের অজান্তেই মোচড়ামুচড়ি করছে মেয়েটা। তার দিকে তাকাচ্ছেও না একবার। হাবভাবে এই ইশারা স্পষ্ট যে সে এখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব চলে যেতে চায়।
মনের অভিমান গাঢ় হয় অরণ্যের, এতো কিসের তাড়া ওর তাকে ছেড়ে যাওয়ার? সে কি ওর অরণ্য থেকে ভিন্ন নাকি?
অরণ্য টেবিলে এক হাত ভাঁজ করে মাথা রেখে শুয়ে,অন্য হাতে শ্যামার একটি হাত টেনে রাখে তার মাথার উপর।
চমকে উঠে শ্যামা এবার পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তাকায় অরণ্যের দিকে। অরণ্য শান্ত কন্ঠে বলে উঠে তাকে,
“মাথায় হাত বুলিয়ে দাও,মাথা ব্যথা করছে।”
শ্যামা কিছুক্ষণ ইতস্তত করে ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে মাথায়,অরণ্যের এলোমেলো চুলে হাত গলিয়ে আলতো হাতে চুল টেনে দিতে থাকে। আবেশে চোখ বুঁজে আসে অরণ্যের।
এভাবেই রাত বারোটা পেরিয়ে যায়, অধৈর্য হয়ে উঠে এবার শ্যামা। অরণ্য এখনো চুপচাপ চোখ বন্ধ করে রেখেছেন। তিনি জেগে আছেন কি-না সেটাও বুঝতে পারছেনা। সে এবার অরণ্যের মাথায় হাত চালানো বন্ধ করে মৃদু কন্ঠে ডাক দেয় অরণ্যকে,
“অরণ্য…আপনি জেগে আছেন?রাত বারোটা পার হয়ে গেছে।”
অরণ্য সাথে সাথে চোখ মেলে তাকায়,রাগমিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠে সে,
“হাত বুলানো বন্ধ করলে কেনো?তোমাকে তো বলেছিই আমার মাথা ব্যথা করছে। আর রাত বারোটা বেজেছে তো কি হয়েছে?তোমার কাছে রাত তিনটা পর্যন্ত সময় আছে। মায়ের ঘরে হেটে যেতে দুই মিনিট সময় যথেষ্ট। তিনটা বাজার কিছু সময় আগে আমাকে ডেকে দিও। তার আগে আমার বিশ্রামের ব্যাঘাত সৃষ্টি করবেনা,চুপচাপ মাথায় হাত বুলাতে থাকো।”
কলিজা কেঁপে উঠে শ্যামার অরণ্যের রাগী কন্ঠ শুনে। আরও বেশি রাগিয়ে দিবে সেই ভয়ে সে চুপচাপ অরণ্যের কথা মতো তার মাথায় হাত বুলাতে থাকে। অরণ্য এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শ্যামার দিকে,এবার চোখ বন্ধ করলোনা আর।
কেনো এমন করছে সে নিজেও বুঝতে পারছেনা,ওকে একেবারে মায়ের ঘরে দিয়ে আসলেই তো ঝামেলা শেষ হয়ে যায়।
সে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শ্যামার আতঙ্কগ্রস্থ মুখের দিকে। মেয়েটির সাথে যথেষ্ট ভালো ব্যবহার করছে সে,তাকে এভাবে ভয় পাওয়ার কি আছে? এতোই ভালোবাসে সে সেই অরণ্যকে? তাকে হারানোর ভয় এতোই তীব্র যে তার সামনের অরণ্যকে তার মনে ধরছেনা? ওর মাঝে এমন কি আছে যা তার মধ্যে নেই?
এসব ভাবনার মাঝে সে বুঝতেও পারেনি কখন সে কোনো প্রমাণ ছাড়াই সামনের মেয়েটিকে বিশ্বাস করা শুরু করে দিয়েছে।
দুই পক্ষের অনুভূতির দন্ধের মাঝেই সময় তার গতিতে পার হতে থাকে। শ্যামার কাছে মনে হলো আজ সময়টা বেশ আস্তে কাটছে,আর অরণ্যের কাছে মনে হলো সময়ের কাটায় যেনো পাখা গজিয়েছে আজ। কিন্তু সময় অবশ্য তার গতিতেই পার হয়েছে এবং সময়ের কাটা জানান দিচ্ছে,এখন রাত আড়াইটা পার হয়েছে।
শ্যামা এবার আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারলোনা,চরম উৎকন্ঠা নিয়ে বললো,
“অরণ্য… সময় হয়ে গেছে,আর দেরি করা ঠিক হবেনা।”
অরণ্য অবশেষে মাথা তুলে ভাবলেশহীনভাবে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
“সবে আড়াইটা বেজেছে, এতো ব্যস্ত হচ্ছো কেনো?তোমাকে তো বলেছিই মায়ের ঘরে যেতে শুধু দুই মিনিট সময় লাগবে।”
শ্যামা এবার কেঁদে ফেলে ভয়ে,চেয়ার থেকে নেমে ফ্লোরে বসে পড়ে অরণ্যের পায়ের কাছে,কাঁপা কাঁপা হাতে অরণ্যের পা জড়িয়ে ধরে বলে শ্যামা,
“অরণ্য আমার সাথে এমন কেনো করছেন?আপনি কি রেগে আছেন আমার সাথে?আমার অবাধ্য আচরণের কারণে রেগে আছেন? আমি সত্যি দুঃখিত তার জন্য, আমার মাথা ঠিক ছিলোনা। কখন কি করেছি,কি বলেছি বুঝতে পারিনি। আমাকে এতো বড় শাস্তি দিবেন না প্লিজ। আমাকে আমার অরণ্যের কাছে যেতে দিন,ওকে আমি হারাতে পারবো না।”
অরণ্য হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে টেনে তুলে শ্যামাকে নীচ থেকে। তারপর দুই হাতে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে চোখে চোখ রেখে শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“আমি কে তাহলে?”
শ্যামা অরণ্যের এমন কাজে অবাক হয়ে যায়,সে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করে,
“মানে?”
অরণ্য একিভাবে জবাব দেয়,
“আমি কে তোমার জন্য জানতে চাইছি। তোমাকে সেই জ্বিন বলেছিলো,সেই অরণ্য আর আমি একই মানুষ। তুমি চাইলেই আমার সাথে একেবারে থেকে যেতে পারো,নতুনভাবে সম্পর্ক সৃষ্টি করতে পারো আমার সাথে,এটাই বলেছিলো তো?
তাহলে তো আমার আর সেই অরণ্যের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই,তাইনা?
আমি তোমাকে বিশ্বাস করছি শ্যামা,আমার কোনো প্রমাণের দরকার নেই। থেকে যাও আমার কাছে একেবারে,আমি তোমাকে বিয়ে করবো,আমার জমিদারনি হবে তুমি?”
(চলবে)
#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ৪২ (বর্ধিতাংশ)
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন
শ্যামা আশ্চর্য হয়ে যায় অরণ্যের এমন কথা শুনে,সে কস্মিনকালেও তার মুখ থেকে এমন কথা শুনবে কল্পনা করেনি,সে মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানিয়ে বললো,
“আপনি এসব কি বলছেন?এটা অসম্ভব!”
“কেনো অসম্ভব এটা?আমি কি অরণ্য নই?তুমিতো আমাকে মানুষ হিসেবেই চেয়েছিলে। তাহলে আমাকে গ্রহণ করতে আপত্তি কিসের তোমার? তোমার যদি এটা নিয়ে চিন্তা থাকে যে আমি এখনো খারাপ কাজে লিপ্ত থাকবো,তাহলে কথা দিচ্ছি পুরোপুরি শুধরে যাবো। তোমার কথা যখন বিশ্বাস করেছি পুরোপুরি শুধরে যাবো,সব ভুল শুধরে নিবো।”
“সমস্যা সেটা নয় অরণ্য। আপনি আমার অরণ্য না,এটাই সবচেয়ে বড় পার্থক্য আপনার সাথে উনার।”
“তাহলে করে নাও আমাকে নিজের। সেই জ্বিনের কথামতো নিজের মতো সাজিয়ে নাও আমাকে। তুমি যেমন চাইবে তেমনটাই হয়ে দেখাবো আমি।”
“এমনটা হয়না। আমি শুধুই আমার অরণ্যের, উনি অপেক্ষা করছেন আমার জন্য।”
“তাহলে আমার শ্যামা কোথায়? শ্যামা যদি শুধু অরণ্যের হয়ে থাকে,তাহলে আমার ভাগ্যে শ্যামা নেই কেনো?”, প্রচন্ড আবেগের বশে মনের অজান্তেই এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে অরণ্যের চোখ থেকে।
স্তব্ধ হয়ে যায় শ্যামা। এই প্রশ্নের কি জবাব দিবে এবার?এর জবাব তো তার নিজের কাছেও নেই। সে আমতা আমতা করে নিজের অজান্তেই বলে ফেলে,
” হয়তো…হয়তো এই দুনিয়ায় আপনার ভাগ্যের শ্যামাও বরাদ্ধ রয়েছে। এই জগতে যখন এতো পরিবর্তন এসেছে,তাহলে এই জগতে এই সময়ে একটা শ্যামা থাকা অসম্ভব কিছুনা,তাইনা?আপনার শুধু তাকে খুঁজে নিয়ে তার মন জয় করে নিতে হবে।”
চমকে উঠে অরণ্য এমন কথায়,পরক্ষণেই বেদনামিশ্রিত হেসে বলে উঠে,
“শান্তনা দিচ্ছো? দিওনা,কাজ হবেনা। আমার প্রচন্ড হিংসা হচ্ছে তোমার অরণ্যের উপর,তোমার শান্তনা এই হিংসা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে শুধু,এই শান্তনার মানে তো এটাই যে আমি শত অনুরোধ করলেও তুমি থাকবেনা আমার কাছে।
তবে চিন্তা করোনা,আমি জোর করে তোমাকে এই দুনিয়ায় আটকে রাখবোনা,এরকম কাপুরুষও আমি নই যে একজন নারীকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিজের করে নিবো। তুমি যখন এতো বলার পরেও থাকবে না বলছো,তখন আমার তোমাকে যেতে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”
শ্যামা অনেকটা স্বস্তি পেলো অরণ্যের কথা শুনে,সে স্মিত হেসে বললো,
“শান্তনা দিচ্ছিনা। আনমনেই বলে ফেলেছি কথাটা,কিন্তু বলার পর এখন আমার সত্যিই মনে হচ্ছে এই দুনিয়ায় সত্যি একটা শ্যামা আছে। আপনার ভাগ্য আপনাকে শ্যামার কাছে নিয়ে যাবে একদিন।”
“বিশ্বাস করতে বলছো এই কথা?” অরণ্য এক পাশের ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে।
“নিঃসন্দেহে করতে পারেন। আমার জীবনে এতোকিছু অবিশ্বাস্য ঘটেছে যে আমার এখন কোনো কিছুই আর অসম্ভব মনে হয়না। আমার বিশ্বাস,আপনি আপনার শ্যামাকে ঠিক খুঁজে পাবেন। ততদিন শুধু নিজের মধ্যে কিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টা করুন। আপনার বাবার দেখানো পথটা ছেড়ে দিন। অন্তত আমি এমন অরণ্যকে কখনো ভালোবাসবো না। তাই শ্যামাকে পেতে হলে নিজেকে বদলাতে হবে।”
অরণ্য নিশ্চুপ হয়ে শুনতে থাকে শুধু,কোনো জবাব দেয়না। মনটা হঠাৎ বিষাদে ছেয়ে গিয়েছে তার।
শ্যামা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে। তিনটা বাজতে আর মাত্র দশ মিনিট বাকি আছে।
সে আবার অরণ্যকে তাড়া দেয়,
“চলুন চলুন, সময় হয়ে গিয়েছে,আর দেরি করা ঠিক হবেনা।”
বলেই অরণ্যের হাত ধরে হাঁটা ধরে। অরণ্য আর বাঁধা দেয়না,অনিচ্ছা স্বত্তেও চুপচাপ হাঁটতে থাকে শ্যামার হাত ধরে। একটু শক্ত করেই ধরেছে হাতটা।
মনে মনে আশা করছে,মেয়েটা মিথ্যা বলছে।
দড়জা খুলে ভেতরে পা রাখলেই সে মিলিয়ে যাবেনা এই দুনিয়া থেকে।
চলতে চলতে এসে থামে তারা চারুলতার কক্ষের সামনে। শ্যামা হঠাৎ অরণ্যের দিকে ফিরে তাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
“মা হয়তো এখনো জেগে আছেন,আপনি আমাকে এখানে নিয়ে আসেন কি না সেই চিন্তায়। এই দড়জা খুলে ভেতরে ঢুকলে,আমি মিলিয়ে গেলেও মা কিন্তু থাকবেন সেখানে।
একটা কথা রাখবেন আমার?মায়ের অবাধ্য আর হবেন না। আমি যাওয়ার পর আজ মা থেকে ক্ষমা চেয়ে নিবেন। কাল ভোরের আলোর সাথে নতুনভাবে শুরু করবেন সবকিছু।”
অরণ্য এবার এদিক ওদিক তাকিয়ে ইতস্ততভাবে জিজ্ঞেস করে,
“তোমার মনে হয় মা আমাকে ক্ষমা করবে? উনি ঘৃ’ণা করেন আমাকে।’
শ্যামা হালকা হেসে জবাব দেয়,
” সোজা গিয়ে মাকে একবার জড়িয়ে ধরবেন। আপনার এই প্রশ্নের জবাব নিজ থেকে পেয়ে যাবেন।”
বলেই হাতের ধাক্কায় দড়জা খুলে ফেলে শ্যামা সাথে সাথে সোনালী আলো চোখ ধাঁধিয়ে দেয় দুজনের। অবাক হয়ে যায় অরণ্য এমন দৃশ্য দেখে।
শ্যামা কোনো বিলম্ব না করেই অরণ্যের হাত ধরে পা দেয় সেই সোনালী আলোর মাঝে,
অরণ্যও মনের অজান্তেই শ্যামার হাতের ইশারায় সাড়া দিয়ে পা বাড়ায় সামনে।
সেখানে পা দেওয়ার সাথে সাথে এক তীব্র রকমের অস্বস্তি হতে থাকে তার শরীরে। হঠাৎ মাথায় প্রচন্ড ব্যথা হতে থাকে তার,একে একে সেই জগতের অরণ্যের স্মৃতিগুলো ভেসে উঠতে থাকে যেনো তার সামনে,তীব্র আতঙ্ক গ্রাস করে তাকে। ভয়ংকর সেই স্মৃতিগুলো তার ভেতর পর্যন্ত নাড়িয়ে দেয় যেনো।
কিছুক্ষণ পর সেই তীব্র সোনালী আলো মিলিয়ে গেলো হঠাৎ।
শ্যামার হাত ধরে রাখা হাতটা শূন্য,নেই মেয়েটা আর সেখানে।
সে সামনে তাকিয়ে দেখে মা চিন্তিত মুখে উঠে দাঁড়িয়েছেন তাকে দেখে,তিনি আসলেই জেগে ছিলেন এতক্ষণ।
সেই ভয়ানক স্মৃতিগুলো মনে পড়তেই তীব্র আতঙ্ক গ্রাস করে তাকে,অঝোরে অশ্রু গড়াতে থাকে অরণ্যের চোখ বেয়ে।
সে এক দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে তার মাকে,তারপর ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠে,
“মা…আমাকে ক্ষমা করে দাও। আর কক্ষণো অবাধ্য হবোনা তোমার,তুমি আমার থেকে দূরে চলে যেওনা শুধু। তোমার ছেলে তোমার মনের মতো হয়ে দেখাবে।”
চারুলতার মন যেনো হঠাৎ প্রশান্তিতে ছেয়ে গেলো ছেলের এমন কথা শুনে। তার ছেলেকে অবশেষে সে ফিরে পেয়েছে,সেই খুশিতে অশ্রু বিসর্জন দিতে থাকে সে। এই অশ্রু বিষাদের নয়। এই অশ্রু আনন্দের। সে মনের আনন্দে পরম মমতায় তার ছেলেকে বুকে আগলে নেয়। অবশেষে তার জীবনের অন্ধকারের সমাপ্তি ঘটেছে।
সকালের সূর্য নতুন দিনের সাথে তার জীবনের এক নতুন সূচনা নিয়ে আসতে চলেছে। আজ ভীষণ খুশি সে।
————————-
সোনালী আলো মিলিয়ে গিয়ে চোখ সয়ে আসতেই চোখ পিটপিট করে তাকায় শ্যামা তার সামনে।
অরণ্য ঘুমু ঘুমু চোখে উঠে বসেছে খাটের উপর,তাকে দেখে মনে হচ্ছে এখনি একটা গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠেছে সে,এমন ঘোর লাগা চোখে তাকে আরও বেশি মায়াবী মনে হলো শ্যামার।
অরণ্য উঠে বসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে যেনো সে বুঝতে পারছেনা কি হচ্ছে,দড়জার দিকে তার চোখ পড়তেই চোখাচোখি হয়ে যায় তাদের। প্রশ্নবোধক চাহনিতে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শ্যামার দিকে অরণ্য।
শ্যামার আনন্দে চোখে জল চলে আসে। এক দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে সে তার অরণ্যকে। চোখ মুখ ভরিয়ে দেয় অজস্র চুমুতে। তারপর মিশিয়ে নেয় তাকে তার বুকে।
অরণ্য এখনো কিছু বুঝে উঠতে পারছেনা সে কি স্বপ্ন দেখছে নাকি আসলেই শ্যামা তার সামনে আছে।
সে আস্তে আস্তে হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে,তারপর ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে শ্যামাকে,
“এটা কি কোনো স্বপ্ন শ্যামা?”
শ্যামা আহ্লাদী কন্ঠে বলে উঠে,
“একদম না। এটা আমাদের স্বপ্নপূরণের সূচনা মাত্র অরণ্য।”
(চলবে)