“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৩৪
(নূর নাফিসা)
.
.
“কেন? আমার সুখের নাগর। যার কাছে আমাকে সুখের রানি হয়ে থাকতে বলতেন।”
মুখটা যেন মলিন হয়ে আসে ফাতিহার। ব্যথিত চোখে তাকায় ইফতেখারের দিকে। ইফতেখার অস্বস্তিতে পড়ে যায় তার দৃষ্টিভঙ্গি দেখে। ফাতিহা কাঁপানো গলায় জিজ্ঞেস করে,
“তুমি ভালোই আছো?”
“জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ।”
“বাড়ির সবাই?”
“জ্বি, ভালো।”
আরও একটু নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকে ফাতিহা। চোখ ভিজে আসে তার। আঁচল টেনে আঙুল টিপে চোখের ভেজাভাব দূর করে। পরক্ষণে চোখে মায়া বেঁধে আবার তাকায় একটু দূরত্বে বসে থাকা এই যুবকের মুখে। বলে,
“এইটা কিন্তু আমার মাইয়া। অনেক ভালো মাইয়া। এত যত্নশীল মাইয়া শ’য়ে একটা হয়। দেইখ্যা রাইখ্যো।”
“জ্বি, দোয়া করবেন।”
“হো, করি। অনেক সুখে থাকো তোমরা। কোনো অসুখী ছায়া না পড়ুক তোমাগো সুখের উপরে।”
বলতে বলতে নিজের হাতটা তুলে নেন শ্রাবণের মাথায়। শ্রাবণ কমলার খোসা ছাড়িয়ে নিতে নিতে মুচকি হাসে তার কথার সৌজন্যতায়। ইফতেখারকে জিজ্ঞেস করে, খাবে কি না? মাথা দু’দিকে নেড়ে নিষেধ করে সে। আশপাশে তাকিয়ে দেখে আরও লোকজনের দিকে। একই রুমে তিন চারজনের থাকার ব্যবস্থা। কেউ আসছে, কেউ যাচ্ছে। বাইরে হাঁটাহাঁটি করছে, কেউ দরজার বাইরে ফাঁকা জায়গায় মেঝেতে বসে গল্প করছে। একেক লোকের একেক রকম বেশ, একেক রুচির অধিকারী। কিন্তু দুঃখের দিক থেকে এখানে সবাই-ই সমদুঃখী। অবহেলিত দুনিয়ার নীড় হারা পাখি। ইফতেখার দেখতে থাকে একেকটা পাখীকে। কিছুটা সময় এখানে বসে থেকে বিদায় নেয় শ্রাবণ। ফাতিহা বিদায় দিতে গিয়ে ইফতেখারকে কাছে ডাকেন। ইফতেখার তার ইচ্ছায় এগিয়ে যায়। তাকে নীচু হতে বলে মাথায় হাত রাখেন ফাতিহা। চোখের পানি গালে গড়ায় সাথে সাথেই। মাথায় হাত বুলিয়ে আপন মনে দোয়া করে দেন তিনি। ইফতেখার মৃদু হেসে নিজেও তার মাথায় হাত রেখে আশ্বাস দিয়ে আসে তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন শীঘ্রই। ঠিকমতো যেন খাওয়াদাওয়া করে। শ্রাবণ সন্তুষ্টচিত্তে পাশে দাঁড়িয়ে থেকেই তাদের প্রত্যক্ষতা করে। এরপর রুম থেকে বেরিয়েই শিখাকে খোঁজে। ইফতেখারকে জিজ্ঞেস করে,
“টাকা এনেছেন?”
“হুম।”
জবাব দিয়ে সাথে সাথেই সে ওয়ালেট থেকে টাকা বের করে শ্রাবণের হাতে দেয়। শ্রাবণ জানতে চায়,
“কত?”
“যত বলেছো।”
পুনরায় গুণে নেয় টাকা। শিখাকে পেয়ে যেতেই দশ হাজার টাকা সে শিখার হাতে তুলে দেয় ইফতেখারের সামনেই।
“আপু, এটা রাখো। আম্মার জন্য খরচ করবে। উনি যা খেতে চায়, বা পেতে চায় এইটুকুর সাধ্যে তা করবে।”
“হুম। কে উনি? ভাইয়া নাকি?”
“জ্বি।”
সালাম দিয়ে শিখা জিজ্ঞেস করে ইফতেখারকে, কেমন আছে। ইফতেখার সৌজন্যতার সাথে জবাব দেয় তার। অতঃপর বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসে। বের হতে হতেই ইফতেখার জিজ্ঞেস করে,
“তিনি তোমার কেমন আম্মা?”
“এই দেয়ালের ভেতরে এই আম্মা আমার খুবই প্রিয় একজন ব্যক্তি। খুবই আপন একজন মানুষ মনে হয় উনার মুখটা দেখলে। কিছু কিছু মায়ার সুঁতো বিনা সম্পর্কেই টেনে নেয় মনকে। তিনিও মেয়ের সম্পর্কে আমাকে টেনে নিয়েছেন। এই নারীর জন্য আমার কষ্টও হয় ভীষণ, জানেন? কর্মরত অবস্থায় প্রায় প্রত্যেক ব্যক্তির পরিবারের সাক্ষাতে গিয়ে পরিত্যাজ্য ফুলগুলোকে পরিগ্রহণের জন্য আবদার করতে পেরেছি আমরা। শুধুমাত্র এই মানুষটার নির্দিষ্ট একটা পরিবারের সন্ধানই পাইনি। পারিনি পরিবার থেকে দুজন লোক ডেকে আনতে তার ব্যাথাতুর জীবনের প্রত্যক্ষতা দেখাতে। এখানে আমার কর্মজীবনের প্রথম মেহমানই ছিলেন তিনি। আমার কুড়িয়ে আনা প্রথম ফুল। এমন আরও কত ফুল আমরা কুড়িয়ে এনেছি কোনো বাড়ি কিংবা পথের ধার থেকেও। আশ্রয় দিতে চেয়েছি স্বপ্ন নিকেতনের ছাদের নিচে। কত জীবনের কত ডায়েরির সাথে পরিচিত হয়েছি। কিন্তু উনার ডায়েরিটা একটু অন্যরকম। একটু আলাদা তার এই জীবন যাত্রা। এবং তার এই জীবনের যাত্রা শুরুটা আপনাদের এলাকাতেই।”
শ্রাবণের মুখের দিকে তাকায় ইফতেখার। শ্রাবণ মৃদু হাসির সাথে পলক ফেলে বলে,
“উনার জন্যই বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে আমার ওই গ্রামে যাওয়া।”
এমনি এক এম্বুল্যান্স আসে ভবনের সামনে। তারা একপাশে চেপে ভবন থেকে বেরিয়ে আসে। ইফতেখার জিজ্ঞেস করে,
“কোথায় যাবে এখন?”
“যাবো বাসায়ই। তবে আপনার কিন্তুর জবাব দেওয়া বাকি। চলুন, এদিকেই একটু হাঁটি।”
“ফুচকা খাবে?”
“উহুম, অন্য একদিন। আজ উপভোগ করার মুড নেই।”
আশ্রমের এক অংশে এখানকার সদস্যদের হাঁটাহাঁটি ও বসে গল্প করার জন্য সুব্যবস্থা রাখা আছে। সেদিক পথেই হাঁটতে থাকে শ্রাবণ। ইফতেখারকে বলে,
“আপনাদের পরিবারের মতোই দুই ভাইয়ের একমাত্র বোন ছিলেন এই আম্মা। উনার জমিজমা এখনো আছে ভাইদের দখলে।”
“উনাকে তো আমি কখনোই দেখিনি মনে হচ্ছে। কোনদিকে উনার বাড়িটা?”
“হুম, বলছি। আর আপনি হয়তো কখনোই দেখেননি তাকে। হয়তোবা আপনার জন্মেরও আগে উনার গ্রাম ছাড়া। এর কারণ হচ্ছে, কিশোরী বয়সে তিনি একটা ভুল করেছেন। আর ভুলটা হচ্ছে মূলত প্রেম। তিনি এক যুবকের প্রেমে পড়েছিলেন, স্থায়ীও ছিল মোটামুটি অনেক দিন। পরিবারের দিক থেকেও জানাজানি হয়। এই যেমন, আমাদের তোতাপাখি আর কান্তা। এমনই কিছু চলছিলো তাদের পরিবারেও। হুট করে একদিন তারা পালিয়ে বিয়ে করে নেয়। সবকিছু গ্রামে ফেলে রেখে শুধু ওই যুবকের হাতটা ধরে তিনি গ্রাম ছেড়ে চলে আসেন শহরে। উনার স্বামী রাজনৈতিক দলে যুক্ত ছিলেন। শহরে চেনাজানা ছিল অনেক। বউ নিয়ে থাকার কোনো একটা ব্যবস্থা তিনি করে নিয়েছেন। পরিবার থেকে দূরে একক সংসার সাজিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন নিজেদের ইচ্ছায়। আম্মা ভয় পেতেন, তার বাবা ভাইয়েরা না এসে আবার তাকে মারধর করে। ধরে নিয়ে যায়। যেহেতু বাড়ি থাকতেই খুব মার খেয়েছিলেন, এবার তো পালিয়েই এসেছে। তাই প্রাণ হারানোর ভয়ই তাকে পেয়ে বসেছে। ধীরে ধীরে এই ভয় কাটতে থাকে ঠিকই, কিন্তু উনার স্বামীর যেই সম্বলটুকু সাথে নিয়ে এসেছিলেন তাতে তাদের খুব বেশিদিন চলেনি। ইনিয়েবিনিয়ে মাসখানেক মাত্র কাটে। এরপর অভাব হয়ে যায় নিত্য সঙ্গী। লোকটার মাথা ঠিক নেই, বাকি চলবে কিভাবে? স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে, সাথে কিছু এনেছিল কি না? বিয়ের আগে প্রেমিকের কাছ থেকে পাওয়া পায়ে এক জোড়া নূপুর ও বিয়ের দিন বরের কাছে পাওয়া এক বেনারসিই ছিল তার মূল্যবান সম্পদ। এছাড়া তিনি কিছুই দেখাতে পারেননি। এই মূল্যবান সম্পদ গুলোই তুলে দিতে চায়। কিন্তু মহৎ সেই প্রেমিক তার উপহারটুকু নিঃশেষ করতে চায় না। কাজও জোগাতে পারেন না। অহংকার ছিল তার আরেক সম্বল। উচ্চ বংশের পুত্র তিনি। রাজনৈতিক দিকেও ভালো সম্মান আছে। যেমন তেমন কাজ তো আর করতে পারেন না। চলার মতো ভালো কিছু খুঁজছিলেন। অথচ ঘরে পড়া শুকনো হাড়ি! তিনি কাজ খুঁজেন, মনের মতো পান না। স্ত্রী কিছু পরামর্শ দিতে গেলে মাথায় নেন না। ধমক দিয়ে বসিয়ে রাখেন। বাধ্য হয়ে স্ত্রীই বেরিয়ে পড়ে কিছু একটা করতে। অন্যের বাড়িতে ভৃত্যের কাজ ছাড়া যেন আর কোনো অফার পাচ্ছিলেন না। কিন্তু ভৃত্যের কাজ তো তিনি করতে পারবেন না৷ স্বামীর সম্মান ধুয়ে যাবে তবে। তেমন যোগ্যতা না থাকায় দেহের বলে কোনো দোকানে কিংবা কারখানায় নিম্নপদের কাজই খুঁজতে থাকেন। স্বামীর পছন্দসই যেন মানিয়ে চলা যায় কোনোমতে। তবুও উনার এই চেষ্টার উপরই স্বামী নারাজ। অথচ দেখুন, তিনি কিন্তু স্ত্রীর খাবারের যোগানটুকুই দিতে পারছিলেন না। তার এক কথা, সে বাইরে কেন যাবে? কারণস্বরূপ, পেটের ক্ষুধার তাড়নাকে স্পষ্ট করলেও ছোটবড় ঝগড়া বেঁধে যেতো। আবারও তিনি রাজনৈতিক দলের লোক, মাথা এমনিতেই গরম থাকতো। দোষারোপ করতো আম্মাকে যে, তার জন্যই তিনি সম্ভ্রান্ত পরিবার ছেড়ে চলে এসেছেন। আম্মা চুপ থাকতেন। তবে বসে থাকেননি। কোনো একটা ব্যবস্থার জন্য নিরুপায় হয়েই বের হতেন। ঝগড়াঝাঁটি মনোমালিন্যে তারপর তাকে দুশ্চরিত্রার অপবাদ দিয়েই সাজানো সংসার ফেলে চলে যায় স্বামী। তিনি চাকরি নয়, যেন টাকা ওয়ালা পুরুষ খুঁজতে বেরিয়ে যান! একজন নারীর মূল সত্তায় আঘাত করে যান এই সুমহান পুরুষ। চরিত্রের চেয়ে বড় কিছু থাকে মানুষের? অপরিচিত এক শহরে একা হয়ে যান এই নারী। চলে যাওয়ার সময়ও ধরে রাখতে পারেননি, যোগাযোগ করতে গিয়ে নতুন সংসার গড়ার খবর পেয়ে আসেন। এক সমুদ্র স্বপ্নবোনা নারীর অধিকার বন্টন হয়ে যায় স্বপ্ন ছোঁয়ার আগেই। শখের পুরুষও অন্যের হয়ে যায়। তিনি ব্যাথায় কাতরাতে থাকেন নিঃস্ব ভুবনে। তবুও অপেক্ষার হাল ছাড়েন না। ভাবেন, সংসার গড়লেও কখনো তাকে মনে পড়বে। স্বামী খোঁজ নিতে ছুটে আসবে। একটু দেখতে আসবে, তার কেমন চলছে। তবুও আসেন না। নিজেও গিয়ে নিজেকে স্মরণ করাতে পারেন না অপরাধবোধের তাড়নায়। শ্বশুরালয়ের দুয়ারে দাঁড়ানোরও সাহস হয়নি, বাপের ভিটাতে ছায়া ফেলারও দুঃসাহস হয়নি। তবে নিজের আহার ব্যবস্থাটুকু করে নিয়েছিলেন গার্মেন্টসের শ্রমিক হয়ে। অপেক্ষায় অপেক্ষায় বছরের পর বছর কাটিয়েছেন, স্বামী ফিরবে। বাসা ভাড়া দিতে পারছিলো না, তাই প্রায় বছরটা কাটিয়ে সেই বাসা পরিবর্তন করে একই এরিয়ায় নিম্নমানের বাসা খুঁজে নিয়েছে। এরপরও কিছুদিন এদিকে, কিছুদিন ওদিকে করে এই শহরের আশ্রয়েই বছরগুলো কাটিয়েছে। এদিক ওদিক করতে করতে রাস্তায় পর্যন্ত নেমে গেছে। কারণ, দেহের কর্মক্ষমতা হারিয়ে গেছে ততদিনে। অসুস্থ হলে ওষুধের ব্যবস্থা করতে পারেনি। দুই বেলা খাওয়ার অনিয়ম তো হয়েছেই! পথে নেমেও আহার যোগাতে অক্ষম। চাইতেও পারেনি, খেতেও পায়নি। সুযোগ হলে খেয়েছে, নাহয় অনাহারেই কাটিয়েছে। এই অবস্থায় নামার পরপরই এই শ্রাবণ মেয়েটার সাথে উনার পরিচয় হয়েছে। আচ্ছা, পুরুষ কি এতোই খারাপ যে তার শখের নারীকে অচেনা জায়গায় ফেলে এভাবে চলে যাবে? তবে এ তার কেমন শখ ছিলো?”
প্রশ্ন করে সিক্ত চোখে তাকায় শ্রাবণ। ইফতেখার একবার তার চোখে দেখে চিন্তিত বেশে দৃষ্টি ঘাসের দিকে নামিয়ে হেঁটে চলেছে। শ্রাবণ কম্পিত নিশ্বাসের সাথে নিজের স্বাভাবিকতা বজায় রাখার চেষ্টা করে। আঙুলের কোণে চোখের সিক্ততা দূর করে। এইটুকু সময় ইফতেখার পায়ের ডগায় চোখ রেখেই হাঁটতে থাকে। শ্রাবণের জিজ্ঞাসার উত্তর না করে সে জানতে চায়,
“তারপর কি তুমি গ্রামে গিয়ে তার পরিবারকে পেলে?”
“আমি গ্রামে গেলাম তো অনেক পরে। উনি চাইছিলেন না, আমি তার পরিবার পর্যন্ত পৌঁছাই। আর শুরুতেই আমাকে সব জানায়নি। পরিবারের সন্ধান দিয়েছে খুব বেশি সময় হয়নি। আমি যাবো শুনেই তিনি কেমন ভয় পেতে লাগলেন। যদি ভাইদের কাছে যাই, নিশ্চিত ঘৃণা প্রকাশ করে তাকে অভিশপ্ত করবে। পালিয়ে ঘৃণ্য অপরাধই তো করেছেন। বাবা, ভাইদের দুর্নাম করে এসেছেন। আর যদি স্বামীর কাছে যাই, রেগে যাবেন। হয়তোবা তার সুখের সংসারে বাঁধা সৃষ্টি করায় ক্ষেপে আসবেন তার উপর ক্রোধ নিংড়াতে। নাহয় অস্বীকার করবেন। অধিকার দেওয়ার হলে তো থেকেই যেতেন। অপবাদ দিতেন না, বঞ্চিত করতেন না তার সুখরাজ্য থেকে। তিনি ফেরার হলে কি আর ফেলে রেখে চলে গেছেন? যে যার মতো ভালো আছে, ভালোই থাকুক। দুঃখগুলো নাহয় তারই হয়ে থাকুক। এগুলোই ভেবে রেখেছেন তিনি। আর আমি সেখানে গিয়ে কি দেখলাম, জানেন? মহান সেই পুরুষটি সত্যিই সুখে আছেন। ভুলে আছেন। বাবা তো নেই-ই, ভাইয়েরাও ভুলে আছে। জমিজমা নিজেদের ভোগে বন্টন করে নিয়েছেন। ফাতিহার কোনো অস্তিত্ব নেই কোনো কূলেই!”
“বলোনি তার ব্যাপারে?”
“উহুম।”
“উনার চিকিৎসার জন্যও তো কিছু পাঠাতে পারতেন তবে। উনার জমিজমাতে উনার হাক, স্বামীর ঘরেও পড়ে আছে অধিকার। আব্বাকে বললেও তো কিছু ব্যবস্থা করে দিতেন উনার পরিবারের সাথে আলাপ করে।”
তাচ্ছিল্যের সাথে নিশ্বাসে এক টুকরো হাসি স্পষ্ট করে শ্রাবণ। বলে,
“যাদের মুখে মনে তার অস্তিত্বই নেই, তাদের কাছে যাবো চিকিৎসার জন্য সাহায্য চাইতে? আরে চিকিৎসার অর্থ তো রাস্তায় সাহায্যের আবেদন পত্র নিয়ে দাঁড়ালেই উঠে আসবে। আমি তো প্রত্যাশা নিয়ে গিয়েছিলাম, তাদের মনে একটু ফাতিহার গুনগুন শুনবো। তারপর সন্ধান দিবো। তারা অন্তত শেষকালে তার সম্মুখে দাঁড়াতে ছুটে আসবেন। নির্ভয় দিয়ে এক টুকরো হাসি ঝরাতে চাইবেন।”
বিরতি নিয়ে হতাশার সাথে কম্পিত নিশ্বাস ছাড়ে শ্রাবণ। পরক্ষণেই বলে,
“চিকিৎসা এই প্রতিষ্ঠানই করাচ্ছে বিভিন্ন উৎসের সহযোগিতায় প্রতিটি সদস্যদের। আম্মার ফুসফুস ক্যান্সার। আবার শ্বাসকষ্ট, কোমড়ের হাড় কিঞ্চিৎ ক্ষয়। ওষুধের উপর নিয়ন্ত্রণে আছেন। লাইফ ড্যামেজের পথে। আল্লাহই ভালো জানেন, কার জোর কতদূর! আর লাইফটা ড্যামেজ করার সেই মানুষটা কে, আন্দাজ করতে পারছেন? তিনি আপনাদের এলাকার বর্তমান চেয়ারম্যান জনাব আফজাল হোসেন।”
বিস্ময়ের সাথে তাৎক্ষণিক ঘাড় ঘুরিয়ে শ্রাবণের চোখে কঠিন দৃষ্টিতে তাকায় ইফতেখার। শ্রাবণ অদম্যভাবে পরপরই বলে,
“হুম। আপনার অকল্পনীয় সত্য, আমার শ্বশুর মশাই ছিলেন সেই মহান যুবক। ফাতিহা নামক ভদ্রমহিলাকে আমি আগে খালাম্মা ডাকতাম। এখন কিছুদিন যাবত আম্মা ডাকি আপনার জন্য। আপনার আম্মাকে যে সম্পর্কে আম্মা ডাকা, উনাকেও একই সম্পর্কে আম্মা ডাকি।”
“মাথা নষ্ট তোমার? কার সম্পর্কে কি বলছো, জেনে বলছো?”
“যার সম্পর্কে আপনার এমন সব ধারণা অকল্পনীয়, অন্ধবিশ্বাস স্থির, তার সম্পর্কেই বলছি। আমি স্বল্প জেনেই চেয়ারম্যানের পুত্রবধূ হতে যাইনি। আর চেয়ারম্যানের পুত্রবধূ হওয়ায় আমি চেয়ারম্যান বাড়িতে এখন অব্দি বিশেষ কোনো উপহার না পেলেও, সেই পরিবারের এই সদস্য আমায় তার মূল্যবান সম্পদ উপহার দিয়েছেন। ওই বেনারসি, এই নূপুরজোড়া তার যত্নে তুলে রাখা বহুদিনের স্মৃতি। এই মূল্যবান সম্পদের শুরুটা যেদিক থেকে হয়েছে, শেষটাও সেদিকেই স্থির রাখতে তিনি পুত্রবধূর হাতে তুলে দিলেন। আপনার পরিচয় জেনে উনার রিয়েকশানটা কেমন হয়েছে, লক্ষ্য করেছিলেন?”
ইফতেখারের চোখের স্তব্ধতা যেন কাটতে চাইছে না। নিষ্পলক অসহায়ত্বের ন্যায় সে তাকিয়েই আছে শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণের ব্যথা অনুভব হয় তার এই প্রতিক্রিয়ায়। সে গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলে যায়,
“আপনার বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে জানি। কিন্তু এই সত্যটা আপনার বাবার অতি পরিচিত সত্য। সেদিন আমাকে বেনারসি পরতে দেখে বাড়ির প্রায় সবার মুখেই আমার সৌন্দর্যের প্রশংসা চলছিল। আপনার মুখেও। কিন্তু আপনার আব্বা আমাকে দেখে আমার প্রশংসা না করে কি বলেছিল, জানেন? শাড়ি চিনে উঠতে উনার বোধহয় এক মুহুর্তও সময় লাগেনি। গম্ভীর মুখে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন, “ফাতিহা কোথায়? আমি তার কে হই?” চিন্তা করুন একবার, সবকিছু উনার স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু বঞ্চিত অধিকার যে তার প্রাপ্য, সেটা বোধহয় ভুলেই বসে আছেন। তিনি চেয়ারম্যান। এই শহরের রাস্তাঘাট কিংবা যোগাযোগ পন্থা উনার অজানা নয় কোনোটাই। খুঁজতে চাইলে খুঁজে পাওয়াটাও আহামরি ছিল না। এক বিজ্ঞাপন ছাপলেই সারাদেশ জেনে যায়। এটা তো নির্দিষ্ট একটা শহরই ছিল! পরিচিত শহর!”
“শ্রাবণ, চুপ করো!”
অসহনীয়ভাবে নিজের চোখ বন্ধ করে নেয় সে শ্রাবণকে থামিয়ে। হনহন পায়ে একটু এগিয়ে গিয়ে বেঞ্চে বসে যায় একা একা। ফ্যাকাসে, অস্থির মুখখানা তার। এমন সত্যের প্রত্যাশা তো সে করেনি! শ্রাবণ ধীর পায়ে এগিয়ে যায় তার দিকে। থামিয়ে দেওয়ার প্রেক্ষিতে বলে,
“শ্রাবণ তো চুপই ছিল। অথচ আপনার সত্য জানার ছিল।”
“আমি এমনটা শুনতে চাইনি।”
“না চাইলেও এমন অনেক কিছুরই প্রত্যক্ষতা করতে হয় জীবনে। শ্রাবণ থেমে গেলেই আপনি আরও অজানায় পড়ে থাকবেন। কান্তাদের সাথে আপনাদের কেমন শত্রুতা, আপনি জানেন না। প্রতিবেশী যখন, জমিজমা নিয়ে তো কিছু থাকতেই পারে স্বাভাবিক। আপনাদের পাশের বাড়ির সাথেও আপনাদের এমন কিছু না কিছু আছে। তারপরও আগে পরে একটা মিল মহব্বত এসে যায়। কিন্তু কান্তাদের সাথে উভয় পক্ষের এমন অটুট শত্রুতার কারণ মূলত আপনার আব্বা আর এই আম্মাই। উনার প্রাথমিক পরিচয়, তিনি কান্তার একমাত্র ফুপু।”
“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৩৫
(নূর নাফিসা)
.
.
“আমি এমনটা শুনতে চাইনি।”
“না চাইলেও এমন অনেক কিছুরই প্রত্যক্ষতা করতে হয় জীবনে। শ্রাবণ থেমে গেলেই আপনি আরও অজানায় পড়ে থাকবেন। কান্তাদের সাথে আপনাদের কেমন শত্রুতা, আপনি জানেন না। প্রতিবেশী যখন, জমিজমা নিয়ে তো কিছু থাকতেই পারে স্বাভাবিক। আপনাদের পাশের বাড়ির সাথেও আপনাদের এমন কিছু না কিছু আছে। তারপরও আগে পরে একটা মিল মহব্বত এসে যায়। কিন্তু কান্তাদের সাথে উভয় পক্ষের এমন অটুট শত্রুতার কারণ মূলত আপনার আব্বা আর এই আম্মাই। উনার প্রাথমিক পরিচয়, তিনি কান্তার একমাত্র ফুপু।”
ইফতেখার আরও কিছু বিস্ময় জাগিয়ে তাকায় তার দিকে। শ্রাবণ থামে না। পাশে বসে বলতেই থাকে,
“অথচ ওই বাড়ির বাচ্চারাও আপনাদের মতোই এমন ধোঁয়াশার মধ্যে বড় হয়েছে। জানেই না, আদৌও তাদের কোনো ফুপু আছে কি না! যেই মজিদা খালাম্মার কাছে আমি উঠেছিলাম, আম্মার পরিচয়েই উঠেছিলাম। উনারা বাল্যকালের বন্ধু ছিল। এরপর ননদ ভাবি হলো। দুয়ের মুখেই দুজনের সেকালের কত গল্প শুনলাম। কিন্তু দেখুন, কি পরিমাণ ভয় পান ওই মজিদা খালাম্মাও। একবারও বলেননি চেয়ারম্যানের সাথে তার ননদ পালিয়েছিল বা কোনো রকম সম্পর্ক জড়িয়েছিল। আমি যখন পরিচয় দিয়ে বললাম, তার সই নতুন জায়গায় নতুন সংসারে আছেন। তিনিও নিশ্চিন্তে তাদের সুদিনের গল্প গুলোও আমাকে শুনিয়ে গেছেন। আর ভাইদের সাথে নাকি ঝগড়া করে আর বাড়ি বেড়াতে যান না। পরিস্থিতি বুঝি সব মানুষকেই বানিয়ে গল্প বলা শিখিয়ে দেয়!”
ইফতেখার ব্যথিত দৃষ্টি ফিরিয়ে আবার মাটিতে তাকিয়ে থাকে। শ্রাবণ তার কাঁধে হাত রাখে।
“আমিও আপনাকে বেশ কিছু মিথ্যে বলেছি আপনার কিছু সত্য লুকিয়ে যেতে। আপনার কাছে নেওয়া প্রথম টাকাটা আমি উনাকে দিয়ে গেছি। ভার্সিটির জন্য নেইনি। আপনি সেদিন পাঁচশো দেওয়ার পরও আমি মজিদা খালাম্মার কাছে সারাদিন কাটাইনি। এসেছিলাম এই খালাম্মার কাছে।”
ইফতেখার এতে কোনোই অতিরঞ্জিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে না। সে তো আগেই সন্দেহ এনেছিল তার উপর। তাই এসব তার কাছে নতুন কিছু নয়। সব নতুনত্বের মূলে বসে আছে জন্মদাতা পিতা। এই যন্ত্রণার চাপই নিতে পারছে না যেন! শ্রাবণ কি মিথ্যে বলছে এসব? কোথায়, মনে হচ্ছে না কেন? আবার বিশ্বাসও হতে চায় না। শ্রাবণ আরও বলে,
“অর্পার চেইনও আমি বিক্রি করতাম না। ইচ্ছাকৃত একটা অপরাধ করেছি, কে কি রকম আচরণ করে আমার উপর। তা দেখার জন্য। সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা ছিল আব্বার কাছে। উনি তো সেদিন শাড়ি আর নুপুর দেখেই স্পষ্ট জেনে গিয়েছিলেন আমার উদ্দেশ্য। তাই ভেবেছি, তিনি হয় ক্রুদ্ধ হয়ে কড়া শাসাবেন আমাকে নাহয় মরিয়া হবেন নিখোঁজ স্ত্রীর জন্য। কোনোটাই হননি। কেমন একটা চাপা দিয়ে নিজেকে আড়াল করে রাখতে চান পরিবারের কাছে। একটু অতিরঞ্জিত হলেই বুঝি সুখের সংসারে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ার ভয় উনার।”
ইফতেখার নিস্তব্ধতার সাথে স্থির তাকিয়ে থাকে মাটিতে। শ্রাবণ তার মুখাবয়বে ব্যথাহত রাশি দেখতে পায়। কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে নেয়। তার মুখটাও ভার হয়ে আছে। একটা মুহুর্ত বিরতি নিয়ে বলে,
“কিন্তু আমি দুর্গন্ধ ছড়াতে যাইনি আপনাদের সংসারে। একটা প্রত্যাশা নিয়ে গেছি। এক পরিচয়হীনার পরিচয় সুস্পষ্ট করতে গেছি৷ এক ভয়ার্ত মনের ভয়টুকু কাটানোর চেষ্টায় গেছি। এই মানুষটার বুকে সংসার নিয়ে বিশাল স্বপ্ন বাঁধা। দেখতে গেছি, স্বপ্ন মুক্ত হওয়ার জন্য আকাশ খালি আছে কি না। আমায় একটা জবাব দিবেন?”
ধীর ধারায় ঘাড় ঘুরিয়ে শ্রাবণ পানে তাকায় ইফতেখার। শ্রাবণ বলে,
“আপনারা যদি আরও আগেই জানতেন, তবে কি উনাকে আপনাদের আঙিনায় আশ্রয় দেওয়ার জন্য ভাবতেন?”
ইফতেখার ধীর ধারাতেই আবার দৃষ্টি নামিয়ে আনে নিরুত্তর বেশে। শ্রাবণ ততটাও হতাশ হয় না উত্তর না পাওয়ায়। বলে,
“আপনার আব্বার ভয় তো ঠিক এখানেই, উনার সুশৃঙ্খল পরিবার বিশৃঙ্খল হয়ে পড়বে৷ সন্তানরা বুঝি মুখ ফিরিয়ে নিবে। আর বর্তমান সহধর্মিণী জানেই নাকি, কে জানে! হয়তোবা জেনে শান্তির প্রত্যাশায় চুপ আছেন৷ নয়তোবা জানলে ঘৃণা করতে থাকবেন, আব্বা সেই ভয়ও পেয়ে যাচ্ছেন। আশপাশ জুড়ে সম্মান নিয়ে দ্বিতীয়বার কাড়াকাড়ি চলবে চেয়ারম্যানের।”
ইফতেখার বসা থেকে উঠে যায়। আর শুনতে ইচ্ছে করছে না তার। বিরক্ত লাগছে সব। হনহন পায়ে তাই হাঁটতে ধরে বলে,
“বাড়ি যাবো। চলো।”
শ্রাবণ তার হনহন হেঁটে চলার দিকেই তাকিয়ে থাকে। পরক্ষণে একটা ধীর নিশ্বাস ফেলে সে-ও উঠে যায়। যেতে থাকে ইফতেখারের চলার পথেই। ইফতেখার মোটরসাইকেলে উঠে বসেছে৷ চাবিও লাগিয়েছে। শ্রাবণ এসে উঠে বসলেই চলতে শুরু করবে। কিন্তু শ্রাবণ এগিয়ে তার নিকটে এলেও উঠে বসলো না। বরং চাবিটা তুলে নিলো হাতে। বলল,
“বাড়ি যাবো। তবে এখনই যাবো না।”
ইফতেখার কিঞ্চিৎ বিরক্তির সাথে বলে,
“শ্রাবণ ভালো লাগছে না আমার, কথা শুনতে। চাবি দাও।”
“কথা বলবো না। আপনার সাথে সময় কাটাবো শুধু। একদম চুপ থাকবো।”
“সময় নষ্ট করার কোনোই প্রয়োজন নেই। বাড়ি যেতে হবে সন্ধ্যা নামার আগে।”
“সন্ধ্যা নেমে আসুক৷ তবুও মাথা গরম রেখে মোটরসাইকেল চালানোর কোনো প্রয়োজন নেই।”
“আমি সাবধানে চালিয়ে যাবো।”
“আপনাকে আমি বিশ্বাস করি, আপনি নিজের আগে আমার খেয়াল রাখবেন। কিন্তু পরিস্থিতিকে বিশ্বাস করি না। আপনি এখন পরিস্থিতির চালক। নিজে সাবধান থাকতে চাইলেও পরিস্থিতি হয়তো দিবে না। নেমে আসুন। প্রাণের ভয় আছে আমার। আমি বসতে পারবো না এমন চালকের পিছু।”
ইফতেখার হতাশাগ্রস্ত চোখে তাকায়। শ্রাবণ চোখের পলকে আবার ইশারা করে তাকে নেমে আসতে। নিজেও সরে যেতে থাকে গেটের বাইরে। ইফতেখার বাধ্য হয় নামতে। শ্রাবণের সাথে যায়। শ্রাবণ ধীর গতিতে হাঁটে আশ্রমের দেয়াল ঘেঁষা ফুটপাতে। অল্প পরিসরের কিছু পথকেই গন্তব্য হিসেবে চিহ্নিত করে নিয়েছে। সময় কাটানোর জন্য ধীর পায়ে যাবে আবার একই ধীরতায় ফিরে আসবে। এই ধীরতার সঙ্গী হয়ে রয়েছে ইফতেখার। প্যান্টের পকেটে দুহাত গুজে রেখে সামনে দৃষ্টি গেঁথে চিন্তিতবেশে হেঁটে চলেছে সে। শ্রাবণ নিশ্চুপই আছে। বলেছে কথা বলবে না, তো বলবেই না। কিছুটা এগিয়ে ইফতেখারই জিজ্ঞেস করে,
“উনি কি যাবেন, নিয়ে গেলে?”
শ্রাবণ মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তাকায় একবার ইফতেখারের মুখে। বলে,
“জানি না। তবে আশা ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন। আর উনার যা অবস্থা, প্রতিনিয়ত ডাক্তার দেখাতে হচ্ছে।”
“সুস্থ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা প্রকাশ করেননি?”
“না। ক্যান্সার মানুষকে তিলে তিলে শেষ করে। আবার কখনো কখনো ভিন্ন কিছুও দেখা যায় সৃষ্টিকর্তার নেয়ামতে। তবে এমন গল্প খুব কমই জানা।”
ইফতেখার নিশ্চুপ হাঁটতে থাকে আবারও। শ্রাবণ নিজ থেকেই বলে,
“উনি আপনাদের খোঁজ খবর রাখতে দারুণ আগ্রহবোধ করেন আমাকে দেখলেই। আপনাদের ভাইবোনদের সম্পর্কে জানতে চান, আমার সাথে আপনাদের আচরণ কেমন যাচ্ছে, আমি সেখানে ভালো আছি কি না। সবার সাথে মানিয়ে নিতে পারছি কি না। এসব গল্পে জমে উঠেন। যে ভিটায় উনার রাঙা চরণে ধুলো উড়েনি, সেই ভিটায় যেন আমি ধুলো উড়িয়ে যাই এমনটা সবসময় বলে দেন যখনই আসি কিংবা ফোনে কথা বলি।”
“উনার ফোন আছে?”
“না, শিখা আপুর সাথে কথা বললে উনার সাথেও বলা হয়।”
ইফতেখার আবারও চুপ থাকে। দোকান থেকে এক বোতল পানি নিয়ে দুই ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে তোলে। শ্রাবণকে জিজ্ঞেস করে,
“কিছু খাবে?”
দু’দিকে মাথা নাড়ে শ্রাবণ। পানির বিল দিয়ে বোতল হাতে বেরিয়ে আসে সে। শ্রাবণ তার হাত থেকে বোতল নিয়ে নিজেও গলা ভেজায়। ইফতেখার বললো,
“বাড়ি ফিরতে তো দেরি হবে। দুপুরের খাবারটা খেয়ে নাও এখানে কিছু।”
“চলুন তবে হোটেলে।”
ইফতেখার সামনের এক হোটেলে যেতে চাইলে শ্রাবণ তাকে পেছনে ফেলে আসা হোটেলে নিয়ে যায়। এখানকার খাবার শ্রাবণের কাছে তুলনামূলক রুচিসম্মত মনে হয়। ইফতেখার তার ইচ্ছানুযায়ী যায়। দুপুরের খাবারটা সেরে নিতে বসে দুজনেই। এইটুকু সময়ে ফাতিহাকে জানার চাপটা ইফতেখারের মাথায় হালকা করতে শ্রাবণ নিজের গল্প শুরু করে দেয়। কীভাবে তার এই চাকরিতে নিযুক্ত হয়, এর আগে কী করতো, কোথায় পড়াশোনা করতো, এদিকের রাস্তাঘাটে চলাচলে তার কোন কোন জায়গাগুলো অভ্যস্ততার আওতায় এসবই জানাতে থাকে। এই হোটেলও তার অভ্যস্ততার এক অংশ। পরপরই আবার আশ্রমে ফিরে এসে এবার মোটরসাইকেলে যাত্রা করে বাড়ির দিকে।
আজ পুত্র এবং পুত্রবধূকে একত্রেই বাড়ি ফিরতে দেখে পারভীন কারো কাছেই কিছু বললেন না শ্রাবণের বাড়ি না থাকা নিয়ে। ছেলেকেও জিজ্ঞেস করেননি কোথায় গিয়েছিল। গোমড়ামুখো বেশে নিজের মধ্যেই এক রকম ক্রোধ চাপিয়ে রাখলেন। শ্রাবণ নিতান্তই তার অপছন্দের হয়ে উঠছে। বিরক্ত হয়ে পড়েন চেহারা দেখলেই। ছেলের বউ নিয়ে তো এমন প্রত্যাশা ছিল না তার। শ্রাবণও কিছু বলেনি। নিজের মতো ঘরে বাইরে প্রয়োজনে আসা যাওয়া করছে। ইফতেখারের মুখটা থমথমে। ঘরে এসে পোশাক বদলালো। হাতমুখ ধুয়ে নিলো। কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা না থাকায় কপালের উপর হাতের পিঠ রেখে নিশ্চুপ শুয়ে রইলো। মাথায় একরকম বোঝা চেপে আছে। ভাবনার কূলকিনারা পাচ্ছে না খুঁজে। সত্য কি ঠিক সত্য, না মিথ্যা? সত্য এমন অকল্পনীয় কেন হতে হবে? কান্তাদের বাড়ির সাথে নিজেদের বাড়ির বিপরীত সম্পর্ক নিয়েও ভেবে যাচ্ছে খুব। মা-ও তো তাদের দেখতে পারে না। তবে কি উনি জানেন সব? নাকি কোনোভাবে অজানায় পড়ে আছে উনারও? নাকি জেনেশুনেই এসেছিল! আর যদি তা না হয়, আব্বা তো এই মায়ের সাথেও অবিচার করলো। দুজন নারীকে ধোকার আড়ালে রাখলো। শ্রাবণ যা জানালো, সব ঠিক তো! নাকি জন্মদাতা পিতাকে যেমনটা জানতো, তা-ই ঠিক?
মাগরিবের নামাজে দাঁড়িয়েই পরীর হৈ-হুল্লোড় শুনছিল বাইরে। নামাজ শেষ করে বেরিয়ে আসে শ্রাবণ। মুরগিকে বকাঝকা করছে পরী, তাকে কেন এতো বিরক্ত করছে। অন্ধকার হয়ে এসেছে চারদিক, এখনো কেন খোয়াড়ে যাচ্ছে না? রঙঢঙ কেন শুরু করেছে? শ্রাবণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে, পরী?”
“যা জ্বালান জ্বালাইতাছে বাচ্চাগুলা! আধ ঘণ্টা ধইরা ছুটতে ছুটতে আমার পা দুইটা বিষিয়ে যাইতাছে। ভাবি, আসেন তো একটু ধরি। একটা আছাড় যদি না দিছি, আমার নাম পরী না।”
শ্রাবণ মৃদু হাসির সাথে নেমে আসে বারান্দা ছেড়ে। বড় মুরগির ভয়ে বাচ্চাগুলো উঠতে চায় না খোয়াড়ে। তাকে সাহায্য করতে শ্রাবণ এক পাশে দাঁড়ালে অন্যপাশে পরী ঘেরাও করে ধরে নেয়। কিছু ছোটাছুটি শ্রাবণকেও করতে হয়েছে। সবগুলো খোয়াড়ে তুলে দিয়েই শ্রাবণ বলে,
“আসলেই, ভারি দুষ্ট!”
“এক্কেরে আমগো বিপু ভাই।”
মৃদু হেসে শ্রাবণ বলে,
“সব দুষ্টুমি কি শুধু বিপু ভাই ই করে? পরী তো তার চেয়েও এগিয়ে।”
“এহ! কইলেন একটা কথা! আমি এত্ত দুষ্টামি করি না। আপনের সামনে ভালা সাইজ্জা থাকে দেইখাই ভালা কন তারে। অবশ্য মাস্টার হইয়া একটু ভদ্রবেশ তারে পাইয়া লইছে আজকাল।”
“সে যাইহোক, পরীর নাম আজ থেকে পরীনা। কারণ, পরী মুরগির বাচ্চা ধরে আছাড় দেয়নি। নিজেই নামটা বদলাতে চেয়েছিলো।”
লজ্জা পেয়ে হাসে পরী। শ্রাবণ বাইরের বাথরুম পর্যন্ত গিয়ে হাত ধুয়ে আসে। পুনরায় ফেরার পথে গেটের দিকে কারো গলা শুনতে পায়। সেদিকে চোখ রেখেই সে ঘর পর্যন্ত আসে ধীর পায়ে। গেটের প্রায় ভেতরে আছেন আফজাল হোসেন। লাইটের আলোয় দেখা যাচ্ছে তাকে। মসজিদ থেকে এলেন। ওপাশের মানুষটা পর্যন্ত আলো পৌঁছেনি বিধায় দেখা হলো না। তবে কণ্ঠ ও আঁধার অবয়বে বুঝে নেওয়া হয়েছে, সে খালিদ ভাই। যদিও কথা বলছে স্বাভাবিকের তুলনায় নিম্ন স্বরে। শ্রাবণ মৃদু হেসে রান্নাঘরে চলে আসে। আফজাল হোসেনও গেটের ধার ছেড়ে এসেছে পরপরই। পরীকে ডেকে চা চাইলো। শ্রাবণও চা নিতেই এসেছিলো, নিজের জন্য। কিছুক্ষণ আগে বানিয়ে রাখার কারণে ঠান্ডা হয়ে ছিলো। গরম বসিয়েছে সে। পরী চাল নিচ্ছিলো ড্রাম থেকে। সাড়া দেয় আফজাল হোসেনের ডাকের। শ্রাবণ পরপরই বলে,
“তুমি ভাত বসাও। আমি নিয়ে যাই চা।”
গরম হয়ে এলেই দুই কাপ চা হাতে বেরিয়ে আসে শ্রাবণ। যাওয়ার পথে একটা অর্পার টেবিলে রেখে অন্যটা নিয়ে যায় শ্বশুরের জন্য। ঘরে প্রবেশ করতে করতে সালাম দেয়। বিড়বিড়িয়ে উত্তর দেয় আফজাল হোসেন। টুলে চা রাখতেই তিনি হাত বাড়ান, কাপ নিতে। শ্রাবণ যাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করে,
“টোস্ট দিবো, আব্বা?”
“না। কই গেছিলা তুমি আজ?”
“কেন, আব্বা? কোনো দরকার ছিলো?”
“না, তেমন কিছু না। বাড়ি দেখলাম না যে, তাই জিগাই। গেছিলা কোথাও?”
“গিয়েছিলাম তো ঠিক। কিন্তু, ছেলে আর ছেলের বউয়ের কথার দিকে এত কান পেতে রাখলে চলে আব্বা? খালিদ ভাই ঠিকঠাক খবর দিতে পেরেছিলো তো?”
থমথমে চোখে শ্রাবণের চোখে তাকায় আফজাল হোসেন। ঠোঁটের বাঁকে হাসি স্পষ্ট রেখেই কথা জিজ্ঞেস করে তাকিয়ে আছে শ্রাবণ ওই মুখে। তার ধারণা, সকালে যখন ইফতেখারের সাথে সে বারান্দায় কথা বলছিল তিনি সব শুনেছেন। আর খালিদ ভাইকে লেলিয়ে দিয়েছেন। আফজাল হোসেন সেকেন্ড পাঁচেক তাকিয়ে থেকে থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করে,
“তুমি তার কাছেই গেছো?”
ঠোঁট টেনে মুচকি হাসে শ্রাবণ। পরোক্ষভাবে উত্তর দেয়,
“আমি একা কোথাও যাইনি, আব্বা। আপনার ছেলেও গিয়েছিল আমার সাথে। কিন্তু, খালিদ ভাই তাকে দেখেনি।”
কথার পরপরই চলে যায় শ্রাবণ। আফজাল হোসেন কটাক্ষ চোখে তাকিয়ে থাকে তার যাওয়ার পানে। এই স্পর্ধা, উপেক্ষা বরাবরই ক্রুদ্ধ করে তোলে তাকে ভেতর থেকে। এখনও তুলছে। সাথে ভাবাচ্ছেও। ইফতেখার গেছে!
“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৩৬
(নূর নাফিসা)
.
.
সকালে রান্নাঘরে এসে মাকে দেখতে পায় ইফতেখার। সাথে আছে পরী। পরীর উদ্দেশ্যে সে বলে,
“গোয়ালা এসেছে৷ দুধ নিয়ে আয়, পরী।”
“যাইতাছি।”
হাঁড়ি নিয়ে সাথে সাথেই বেরিয়ে যায় পরী গোয়ালের দিকে। ইফতেখার দাঁড়িয়েই থাকে। মাকে বলে,
“মা, জরুরী কিছু জিজ্ঞেস করার ছিল।”
রান্নায় ব্যস্ত থেকেই পারভীন জানতে চায়,
“কী?”
“কান্তাদের সাথে আমাদের কীসের সম্পর্ক?”
ঘাড় ঘুরিয়ে ভ্রু কুচকে পিছু তাকায় পারভীন। খেমটা গলায় বলে,
“দুইটা ভাই মিলা পাগল কইরা ফেলছিস৷ চাস কী তোরা? এতোই যদি আহ্লাদ থাকে, তোর বাপের কাছে যা। তোর বাপকে গিয়ে বল, কী দরকার তোদের। সন্তান নিয়া কোনোরকম আশা করা ছাইড়া দিছি আমি। তুই যেমন নিজের জীবন বুঝে নিছোস, ওইটাও নেক। আমার মাথার পেছনে ঘ্যানঘ্যান করতে আসবি না একটাও।”
“আমি বিপুর ব্যাপারে কিছু বলতে আসিনি। আব্বার ব্যাপারে জানতে আসছি। আব্বার সাথে ওই বাড়ির কী সম্পর্ক?”
“তোর আব্বার সাথে ওই বাড়ির কোনো সম্পর্ক নেই।”
“না থাকলে, তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক এতো খারাপ কেন?”
“তারা আমাদের দেখতে পারে না।”
“কেন দেখতে পারে না?”
“ভালো মানুষের শত্রুর অভাব থাকে না।”
“যে কোনো চেয়ারম্যানকেই তার ইউনিয়নের অনেকেই দেখতে পারে না। আব্বাকেও পারে না। তাই বলে সম্পর্ক এতোটাও খারাপ না অন্যান্যদের সাথে। অথচ জন্ম থেকেই দেখছি, সাত্তার কাকাদের সাথে আমাদের কোনোরকম যায় না। কিন্তু কেন?”
“আমি জানি না।”
“আব্বা যে আরেকটা বিয়ে করছিলো, সেটাও তুমি জানো না?”
থমকে তাকায় পারভীন। মুখে কোনো কথা উচ্চারিত হয় না তার। ছেলে এসব কী বলে! কেন বলে! সুস্পষ্ট কণ্ঠে জিজ্ঞাসা ছুঁড়ে মায়ের চোখমুখ দেখে যায় ইফতেখার। জবাবের প্রত্যাশায় থাকে, কিন্তু মা জবাব দেয় না। ইফতেখার আবারও বলে,
“মা, তুমি জানো না?”
“কে বলছে তোকে এসব?”
“যে-ই বলুক, কথা সত্য কি না তা আমার জানা দরকার।”
“মিথ্যে কথা।”
“তবে তুমি জানো না?”
“কী জানবো? বললাম না, মিথ্যে কথা। কে শুনিয়েছে তোকে এসব আজগুবি কথা?”
“যদি বলি ওই নারীর কাছেই শুনে এসেছি, তবে বিশ্বাস করবে?”
চুলো বন্ধ করে দেয় পারভীনের হাত। কিন্তু চোখ সরে না ইফতেখার হতে। কেমন ব্যথা আর ক্রোধ জন্মাচ্ছে ওই চোখের কোটরে। বিস্ময় তো আগে থেকেই জেগে আছে। থমথমে গলায়ই পারভীন জিজ্ঞেস করে,
“কোন নারী?”
“যার সাথে আব্বার বিয়ে হয়েছে, জানা গেছে।”
“আমার সংসার তছনছ করার জন্য কী মানুষ চারদিক থেকে উঠে পড়ে লাগছে? কার কী ক্ষতি করছি আমি?”
“তুমি কারো ক্ষতি করোনি। কিন্তু যার সাথে আব্বা প্রতারণা করেছে, তার খুব ক্ষতি হয়েছে।”
“ইফতি!”
বাবাকে প্রতারক ইঙ্গিত করায় ধমক দেন পারভীন। এমনটা বলতে ইফতেখারেরও খারাপ লাগে। কিন্তু ধমকে দমে না সে। কণ্ঠ একইরকম স্বাভাবিক ও সুস্পষ্ট রেখে বলে,
“কথাটা তিনি নিজে জানাননি আমাকে। কিন্তু, আমি সম্ভবত ভুল জানিনি মা। ওই বাড়ির সাথে আমাদের সম্পর্ক এজন্যই খারাপ, কারণ কান্তার ফুপু আব্বার প্রথম স্ত্রী ছিলো।”
“ছিলো না।”
“ছিলো না?”
“না। সম্পর্ক ছিলো ঠিক। স্ত্রী ছিলো না।”
“আমি তো শুনলাম…”
“কী শুনলি? তোর আব্বার থেকে তুই বেশি জানিস সত্যতা?”
“তাই তো তোমার কাছে জানতে এলাম।”
“সম্পর্ক ছিলো একসময়। তার ভাইদের পছন্দ ছিলো না। মেনে নেয়নি। সেখানেই ডিশমিশ হয়ে গেছে সব। এতোদিন পরে এইসব কথা উঠছে কেন?”
“কারণ, আব্বা উনাকে দূরে নিয়ে গেছে তার পরিবার থেকে। এবং ফেলে চলে এসেছে। আর এতোদিন পরই হঠাৎ আমি জেনে উঠলাম।”
“মিথ্যা। গুজব ছড়ায় এইসব শত্রুরা।”
“এলাকার মানুষ জানেই না হয়তো, জানলেও ভুলে গেছে। গুজব আর কে ছড়াবে, মা? হতেও তো পারে, তুমি জানো না সেসব।”
“ইফতি, কথা বাড়াস না। যা সত্য, জানালাম। আর এইসবে কান দিস না।”
“কান নাহয় না-ই দিলাম। চোখের সামনে দেখে আসা একটা দুর্দশাগ্রস্ত নারীকেও দেখবো না, মা? যাকে অধিকার বঞ্চিত করা হলো একটা সম্পর্ক থেকে?”
“একটা কথা কয়বার বলতে হয়? বললাম না, উনি বিয়ে করেননি? বিশ্বাস করতে এতো আপত্তি কীসের তোর? তবে তো তুই-ই ভালা জানোস। আমার কাছে জিজ্ঞেস করার কী দরকার ছিলো?”
“নিশ্চিত হতে জিজ্ঞেস করেছি যে, তুমি কতটা জানো। নিজের পিতার সম্পর্কে এতো লুকানো সত্য নিশ্চয়ই কোনো সন্তানেরই প্রত্যাশার নয়। এমন কিছু শুনতেও প্রত্যাশা রাখে না কোনো সন্তান।”
“কেন, মানুষের বিয়ের আগে পছন্দ থাকতে পারে না কাউকে? তুই বিয়ে করিসনি নিজে পছন্দ করে? পছন্দ করলেই সে প্রতারক হয়ে যায়?”
“পছন্দ করাটা কোনো সমস্যা না মা। একাধিক বিয়ে করেছে, তা জানাও আমার কোনো সমস্যা না। কিন্তু, অধিকার বঞ্চিত করে কাউকে ঠকানোটাই বড় সমস্যার। এমনতো না যে, বিয়ে করেছিলো। তারপর তালাক হয়ে গেছে। দুই পক্ষই দুদিকে নিজেদের মতো করে ভালো আছে। সমস্যাটা এই জায়গায় যে, একজনের ভালো থাকার জন্য অন্যজন দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে আছে।”
“পাগল হয়ে গেছিস? চোখের সামনে থেকে যা, বলছি! দিনদিন বাবা মায়ের সাথেও শত্রুতা শুরু করছিস, সন্তান হয়ে। খুব বড় হয়ে গেছিস? ঝামেলা পাকাতে শিখেছিস, কীভাবে দুরত্ব বাড়িয়ে সংসার আলাদা করবি? কি, তোর বউ ভিন্ন হতে চায় সংসার থেকে? কেন করছিস এমন? আমি শান্তি চাই, আর কিছু চাই না। ভিন্ন চাইলে, হয়ে যা। ইনকামের রাস্তাও নাকি খুঁজে নিছিস। যেভাবে ইচ্ছা, চল। তবুও বউয়ের কথায় বাবামাকে দোষী করিস না। শেষকালে কষ্ট দিয়ে মারিস না। আমি চাই না, আমার কোনো বাচ্চার উপর অভিশাপ লাগুক।”
কথার সাথে কান্না জড়ো হচ্ছে চোখের কোটরে ও কণ্ঠে। ইফতেখার তার মায়ের ভুলটা ভাঙাতে প্রত্যুত্তরে বলে,
“কথায় কথায় শ্রাবণকে টেনো না, মা। কান্তাদের কিংবা আমাদের কোনো আপন আত্মীয় ছিলো না শ্রাবণ, আর না ছিলো শত্রু। এখানে সে নিরপেক্ষ ব্যক্তি ছাড়া কিছুই না।”
“তা না হলে চাল পাকিয়ে ঘরেই ঢুকলো কেন? কাল তুই তার সাথে যাসনি? আর আজ আমায় এসব জিজ্ঞেস করতে শুরু করছিস? সে তো ওই বাড়ি থেকেই আসছে। আর কি বিশ্বাস করাতে চাস আমায়? ওই মেয়ে তোর আব্বার সাথে, আমার সাথে কেমন আচরণ করে; তা দেখি না আমি? তুই কি দেখিস? রূপে অন্ধ হয়ে গেছিস। দেখবি না কিছুই। বড় হইছিস, সংসারের হাল ধরতে শিখছিস। এখন বাপ মা না হলেও তোর চলবো।”
কথা একদিন থেকে অন্যদিকে গড়িয়ে যাওয়ায় বড্ড হতাশ হয় ইফতেখার। ধীর নিশ্বাসের সাথে হতাশাগ্রস্ত চোখের পলক ফেলে সে বলে,
“মা, তুমি ভুল বুঝছো শ্রাবণকে। সে চাইছে না এমন কিছু। আমিও চাইছি না। কিন্তু যে সত্য দেখলাম, তা তো আর না দেখার ভান করে এড়িয়ে যেতে পারি না।”
পারভীন হাত জোড় করে বলে,
“যা তো বাবা, যা। বউ ঠিক, এই মা’ই ভুল। তোরা সবাই সুস্থ, এই মা পাগল। আর পাগল বানিয়ে যন্ত্রণা দিস না আমাকে।”
হতাশার সাথে বিরক্ত হয়ে উঠে ইফতেখার। প্রত্যাশার কিছুই হলো না। হনহন পায়ে তাই রান্নাঘর ছেড়ে গেছে। কারণ, মা কিছুই শুনতে চাইছে না। পারভীন একদম শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চুলোর কাছে। গম্ভীর বেশে একটু থেমে থেকে চুলোর চাবিটা আবার চালু করে দেয়। শক্ত মেজাজেই রান্নায় মনযোগ বসানোর চেষ্টা করে। শ্রাবণ কিছু কথা শুনেছে বিপুর ঘরে থেকে। এসেছিলো, বিছানাপত্র গুছাতে। তাদের মা ছেলের কথা কানে ধাক্কা খেতেই কাজ থামিয়ে মনযোগ পড়ে গেছে সেদিকে। এখন শেষ হতেই ধীর নিশ্বাস ফেলে পুনরায় কাথা বালিশ ঠিক করতে ব্যস্ত হয়েছে। ইফতেখার চলে গেলো, এদিক পথেই। বেরিয়েই গেছে সম্ভবত। নাশতা করবে না? শ্রাবণ দরজায় এসে তার দেখা পায়নি দৃষ্টি গোচরে। ভাবুক বেশে অর্পার ঘরে পৌঁছেছে। পা ঝুলিয়ে বসে আছে খাটে। অশান্তি ঠিকই হচ্ছে ঘরে। শান্তির একটা পথ ডেকে আনা জরুরী। কিন্তু কীভাবে? মানুষের চিন্তন ও মননশক্তি যে এক নয় সবার। তবে তো সমস্যার সৃষ্টিও হতো না কোনো। আর না আসতো অশান্তি!
ইফতেখার বাজারে এসে বাবাকে দেখতে পেয়েছে, মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে এক মুরব্বির সাথে। বাবার দিকে তাকিয়েই হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলো তার ক্লাবে। মা তো তার প্রত্যাশার জবাব দিলোই না। বাবাকে কী করে জিজ্ঞেস করবে বাবারই লুকানো অতীত? ভাবতেই লজ্জা পায় ইফতেখার। এমন লজ্জাকর সত্যের সাথে তার পরিচয় না হলে কী হতো? একটা মুহুর্তের জন্য ভেবে নিতে ইচ্ছে হয়, যা জেনেছে সব মিথ্যে হয়ে যাক! এমন কিছু সত্য বলে উদঘাটিত না হোক। সব তথ্য ভুল হোক। তবুও হয় না যেন! চিন্তিত বেশে কিছুক্ষণ চেয়ারে হেলে একাকী বসে থাকে হাতলে কনুই ভর করে। মিনিট পাঁচেক যেতেই বেরিয়ে আবার তালাবদ্ধ করে দেয় ক্লাবের কপাট। বাড়ি ফিরে আসে হনহন পায়ে। মোটরসাইকেলটা নিয়েই আবার সাথে সাথে বেরিয়ে আসে বাড়ির সীমানা ছেড়ে।
চলবে।