শ্রাবণধারা পর্ব-৬১+৬২+৬৩

0
115

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৬১
(নূর নাফিসা)
.
.
দুশ্চিন্তায় ভালো লাগছে না। কান্তা এটা কী করলো! কেমন অস্থির লাগছে শ্রাবণের মনে। মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেলো! অথচ সে কিছুই করতে পারলো না! বিপুর কী অবস্থা? সে-ও আটকাতে পারলো না। দুই পক্ষের একটা দিক কোনোভাবেই ম্যানেজ হলো না! এই দিন কয়েকের মধ্যে যে এতোকিছু পাল্টে যাবে, তা তো সে একদম ভাবেনি। দুশ্চিন্তা মাথায় চেপে রেখেই পুরাতন ঘরে যায় শ্রাবণ। কিছু কিছু আসবাব এখনো আছে এই ঘরে। যা বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই লক্ষ্য করেছে সে। পরক্ষণে এসে থামে রান্নাঘরের কাছে। পারভীন এখানে রান্না করছে। সাথে কাজে হাত লাগিয়েছে পরী। দরজায় দাঁড়িয়েই সালাম দেয় শ্রাবণ। জিজ্ঞেস করে কেমন আছে৷ কোনো জবাবই আসে না পারভীনের কাছ থেকে। ফিরে তাকায়নি পর্যন্ত তার দিকে। গম্ভীরমুখে ব্যস্ত হয়ে আছে নিজ কাজে। পরী দুয়ের মুখেই ড্যাবডেবে চোখে তাকায়। আম্মার প্রতিক্রিয়ার ভয়ে ভয়ে আছে যেন। তিনি যে অসন্তোষ শ্রাবণের ফেরায়, তা তো সে এসে খবর দেওয়া মাত্রই বুঝে গিয়েছিলো। আর হবেই না কেন! ভাবিজান যা করে গেছে, কোনো শ্বাশুড়িই হয়তো সন্তুষ্ট হতে পারবেন না। ওদিকে শ্রাবণের মুখটায় তাকিয়ে দেখে চিন্তিত হয়ে আছে। কি নিয়ে চিন্তা, কে জানে!
শ্রাবণ বেশিক্ষণ দাঁড়ায়নি এখানে। ফিরে গেছে পায়ের গতি বাড়িয়ে। তবে দালানেও যায়নি। হাতের মুঠোয় শুধুমাত্র ফোনটা চেপে বেরিয়ে গেছে গেইট দিয়ে। কান্তাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য হাঁটছে। কিন্তু কান্তা কি বাড়িতে আছে? তাকে তো বাড়ি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কার সাথে আর কথা বলতে যাবে তবে, তাকেই যদি না পাওয়া যায়? তাছাড়া বাড়ি গিয়ে তো সোজাসাপটা এতো কথা বলার মতোও না পরিবারের সদস্যদের সামনে। তারউপর সে কান্তার কাছেই যাচ্ছে কেন! জবাবদিহিতা তো আগে ইফতেখারকে দিতে হবে। তার কি কোনো দায়িত্ব ছিলো না? সে নাহয় দূরে ছিলো, তিনি কাছে থেকে কীভাবে এতোসব হতে দিতে পারলেন!
এসব ভেবে হাঁটতে হাঁটতেই রাগ জন্মে ইফতেখারের উপর। ডায়াল করে তার নম্বরে। রিসিভ করে না ইফতেখার। আবারও ডায়াল করলে কিঞ্চিৎ দেরি করেই রিসিভ হয়। শ্রাবণ সাথে সাথেই রুক্ষ গলায় জিজ্ঞেস করে,
“কোথায় আপনি?”
ওপাশ থেকে ইফতেখারের পাল্টা প্রশ্ন আসে,
“কেন?”
“আমার জানা প্রয়োজন, আপনি এখন কোথায়? কথা আছে আপনার সাথে।”
“জানি না।”
কল কেটে যায় সাথে সাথেই। শ্রাবণের রাগ বাড়ে তার প্রতি। কান্তার বাড়ি ছেড়ে চলে যায় হাঁটার পথ। পায়ের গতিও গেছে বেড়ে। ধরে নেয় বাজারের সীমানা। সেই সাথে পায়ের গতি কিছুটা কমে আসে বালুর মাঠে তাকিয়ে। অনেক পরিবর্তন। গুছিয়ে নেওয়া পরিবর্তন। ব্যবসায়ের বন্দোবস্ত সুন্দর। শ্রাবণ রাস্তা পাড় হয়ে বালুর মাঠেই যায় ইফতেখারের খোঁজে। প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে তার অস্তিত্ব না পেলে বেরিয়ে আসে সাথে সাথেই।
বাড়ি থেকে হনহন পায়ে বেরিয়ে ক্লাবে এসে তালা খুলে বসেছিলো ইফতেখার। প্রবেশদ্বারের গ্লাস চাপিয়ে রেখে একা একা বিরক্তি হজম করে নিচ্ছে যেন এখানে। শ্রাবণ কল করলে ইচ্ছাকৃতভাবেই রিসিভ করেনি। দ্বিতীয়বার উপেক্ষাও করতে পারেনি মন। তবে কথায় উপেক্ষা ঠিক করে গেছে। কল কাটার পর থেকে মুখ বন্ধ কলমে অযথাই আকিঁবুকিঁ করে যাচ্ছে টেবিলটায়। যেন এই আঁকিবুঁকিই মনের অভিমানজনিত দাগগুলো কেটে নিচ্ছে। পুনরায় সুযোগ দিতে চাইছে নিজেকে সন্তুষ্ট রাখার। এরইমধ্যে সুযোগের সুনিশ্চয়তা হয়ে হাজির হলো যেন শ্রাবণ। শাটার খোলা থাকায় বাইরে থেকেই দেখা যাচ্ছিলো ভেতরের একাকিত্বের পরিবেশ। গ্লাস ঠেলে প্রবেশ করতেই ইফতেখারের ধ্যানভঙ্গ হয় সাথে সাথে। তাকে এখানে প্রত্যাশা করেনি সে। শ্রাবণ যে পথে থেকেই কল করেছে, সময় যেন সেটুকুও নিশ্চিত করে দেয়। এদিকে শ্রাবণের চেহারায়ও একটু গম্ভীরতা স্পষ্ট দেখে ইফতেখার। ভেতরে এসেই গ্লাসটা পুনরায় চাপিয়ে রেখে সুস্পষ্ট গলায় জিজ্ঞেস করে,
“আপনি এমনটা কীভাবে করতে পারলেন? কোনো দায়িত্ববোধ ছিলো না আপনার মধ্যে?”
কথা না বুঝতে পারায় ভ্রু মাঝে সূক্ষ্ম ভাঁজ স্পষ্ট হয় ইফতেখারের। শ্রাবণ একই রকম রুক্ষ গলাতেই পরপর সুস্পষ্ট জিজ্ঞেস করে,
“কান্তার নাকি বিয়ে হয়ে গেছে? আপনি আটকাতে পারলেন না বিয়েটা?”
সাথে সাথেই ইফতেখারের কপালে স্পষ্ট হওয়া সূক্ষ্ম ভাঁজ অস্পষ্টতায় মিলিয়ে যায়। হাতের কলমটা টেবিলে ছেড়ে দিয়ে চেয়ারে হেলে পড়ে সে। অভিমান, অনুরাগ দূরীভূত হয়ে হঠাৎ কেমন একটা প্রশান্তিকর ভাব চলে এসেছে মনের মধ্যে। মুখভঙ্গিতেও স্পষ্ট হয়েছে সরলতা। কিন্তু এই মুহুর্তে তার এই সরলতা নিতে পারছে না শ্রাবণ। ইফতেখার অস্থির শ্রাবণকে উত্তর করে,
“আমার কি ঠেকা, কারো বিয়ে আটকে দেওয়ার!”
“ঠেকা মানে! যে বিপু আপনার জন্য এতো কিছু করলো, তার জন্য কিছু করাটা আপনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না?”
“কি করেছে বিপু আমার জন্য?”
“কিছুই করেনি?”
“দেখছি না তো তেমন কিছুই। কী বলতে চাইছো তবে? আমার বিয়ের ব্যাপারটা? তা না করলেই বা কি হতো!”
বাক্যে প্রকাশ ক্ষোভ। শ্রাবণ মর্মে জাগে ব্যথা। তবুও থামেনি তার কথা।
“ও, সেই শোধের হাওয়া আপনি বিপু ভাইয়ের উপর দিয়ে বইয়ে দিলেন?”
“আমি কারো উপর শোধ নেইনি।”
“কিন্তু কাজের প্রতিদান খুব ভালো দিয়েছেন। আপনার কাছে এমনটা আশা করিনি।”
“আর তুমি?”
“আমি বরাবর কারণ রেখেই কাজ করেছি। তাছাড়া আমার কথা এখানে উঠেনি। বরং আমার প্রতি দেখা অন্যায়ের ফলাফল আপনি অন্যের দিকে ধাবিত করেছেন। একটু ভাবলে হয়তো নিজেই বুঝতে পারবেন, তোতাপাখির প্রতি অবিচার হয়েছে আপনার বেখেয়ালির তরফ হতে।”
এমনি হাতের ফোনটা বেজে উঠে। মায়ের কল। রিল্যাক্সে কথা বলতে ইফতেখারের বিপরীতে থাকা চেয়ারে বসে কল রিসিভ করে শ্রাবণ।
“হ্যাঁ, মা?”
“পৌঁছেছিস?”
“হ্যাঁ। জানাতে ভুলে গিয়েছিলাম।”
“কখন পৌঁছালি?”
“এইতো, প্রায় বিশ মিনিট।”
“ঠিক আছে।”
“শিশির ফিরেছে?”
“হ্যাঁ। এসেই জিজ্ঞেস করছিলো, চলে গেছিস কি না।”
“আচ্ছা৷ পরে কথা বলে নিবো তার সাথে।”
“ব্যাগ ও একটা রেখেই চলে গেলি।”
“ইশ! মনেই ছিলো না আমার। আসার পর মনে পড়েছে। যাক, সমস্যা নেই। তেমন জরুরী না। পরেও নেওয়া যাবে।”
“ঠিক আছে।”
কল কেটে দিয়েছে সুলতানা। শ্রাবণ কিঞ্চিৎ ভারি নিশ্বাস ফেলে যেন ক্লান্তি ঝাড়ে। টেবিলের উপর এক হাতের ভার ফেলে রেখে মনোযোগী হয় ইফতেখারের দিকে। কিছু বলতে যাওয়ার আগেই এক যুবক গ্লাস হালকা খুলে বাইরে থেকেই গলা বাড়িয়ে উঁকি দিয়ে ইফতেখারের উদ্দেশ্যে বলে,
“কী রে, ভাবি নাকি এখানে?”
শ্রাবণও তাকায় সেদিকে। ইফতেখার বলে না কিছুই। মুচকি হাসির সাথে শুধুমাত্র প্রশ্ন করেই পুনরায় গ্লাস চাপিয়ে রেখে চলে যায় ইফতেখারের সমবয়সী ছেলেটি। শ্রাবণ না থাকলে হয়তো চলে আসতো আড্ডা দিতে। সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে শ্রাবণ আবার মনোযোগী হয় তার দিকে। কিছুটা হতাশার সাথেই বলে,
“আমি ভেবেছিলাম কান্তার বিয়েটা আপনি দিয়ে দিবেন তোতাপাখির সাথে।”
“আমি বিয়ে দেওয়া, না দেওয়ার কে?”
“তবুও মানুষ হওয়া সত্ত্বে একটা প্রচেষ্টা রাখবেন না? এই সমাজে আপনার ক্ষমতারও তো কমতি নেই।”
“অনর্থক।”
“কেন?”
“বিয়ে নাহয় জোর করে দিলামই৷ তারপর? সংসারের দায়ভার কে নিবে? সংসারের সুখ ধরে রাখার ক্ষমতা আমার আছে? তাদের বাড়িও চেয়ারম্যান বাড়িকে ঘৃণা করে। আমার আব্বাও চেয়ারম্যান হয়ে কখনো যাবে না তাদের সাথে সুদৃঢ় আত্মীয়তায়। দরকার কি অহেতুক দুইটা জীবন নষ্ট করার?”
“আমি এটা মানতে পারলাম না। আপনার ভাবনাটাই মূলত অনর্থক। তাদের বাড়ির কথা বাদ, আপনার বাড়িতে একটা ব্যবস্থা আপনি নিশ্চয়ই করতে পারতেন। আপনি জেদ করে এমন অনেক কাজই করতে পারেন। সেখানে এই ব্যাপারটাও আহামরি কিছু না। আপনার আব্বা আপনাকে যেহেতু সেদিন বের করে দিতে পারেননি, তোতাপাখিকেও পারতেন না। বরং আপনি স্বার্থপর একটা কাজ যে করেছেন, তা-ই স্বীকার করুন। মাঝ পথে ছেলেটার সাথে হয়েছে যত অন্যায়!”
ইফতেখার ভালোই উপভোগ করছে ক্ষিপ্ত, হতাশিত শ্রাবণকে। মনোযোগে দেখছে তার চোখের ক্ষিপ্ততার আকৃতি, মনোযোগে শুনছে হতাশিত কণ্ঠের সুর। ভাবতেও মজা পাচ্ছে, কে এমন অর্ধেক বানী তার কানে ঢেলে ক্লাবে পাঠিয়ে দিলো? পরী নাকি? বাড়ি থেকেই তো এলো সে। তবে পরী ছাড়া আর কে? উদ্ভট প্রচারণার কাজগুলো একমাত্র পরীর দ্বারাই বেশ সম্ভব। মনে মনে হেসে শ্রাবণকে সে প্রত্যুত্তরে বলে,
“এতোই যখন আফসোস হচ্ছে, তোমার একটা বোনই এনে দাও তোতাপাখির জন্য। সেদিন হসপিটালে দেখলাম, সে-ই বা মন্দ কী!”
রাগ হয় শ্রাবণের। মনে পড়ে অপুকেও। তাদের ভাইদের সমস্যা কী? তার বোনের উপর নজর পড়তে হবে কেন দেখা মাত্রই! অপ্রীতিকর প্রস্তাবে বিরক্ত হয়ে শ্রাবণ বলে,
“আসলে আপনাকে কিছুই বলার নেই আমার।”
“রেগে যাচ্ছো কেন? মন্দ কিছু বললাম? আব্বা তো কান্তাকে পছন্দ করেনি। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তোমার বোনকে এনে দিলে মেনে নিতেন সহজেই। যেমনটা পছন্দ করেছিলেন তোমাকে, তাকে দেখলেও পছন্দের বাইরে রাখবেন না।”
“একটা মেয়ে সেদিকে নিজেকে হ*ত্যা করার চেষ্টা পর্যন্ত করে ফেলেছে, আর আপনি মজা নিচ্ছেন বসে বসে। অন্তত নিজ ভাইয়ের কথা ভেবেই, এতোটা স্বার্থপর না হলেও পারতেন।”
চেয়ার ছেড়ে উঠে হনহনানো পা বাড়িয়েছে শ্রাবণ। ইফতেখার হেলান ছেড়ে বসে পিছু আবদার করে,
“আরে, প্রথমবার এলে। খালি মুখেই চলে যাবে? চা অর্ডার করি। এক কাপ চা খেয়ে যাও অন্তত।”
তার মজাকর কথাগুলো ক্রমশ রাগিয়ে মর্মাহত করছে মনকে। গ্লাস খুলে পিছু ফিরে আহত গলাতেই জবাবটা দিয়ে যায় শ্রাবণ তাকে।
“আসলে, আপনারা ভাইয়েরা সব একই। স্পেশালি আপনার মামাতো ভাইটা।”
বাজার থেকে মনে অনুরাগ নিয়ে সোজা বাড়ি ফিরেছে শ্রাবণ। সন্ধ্যা হয়ে আসায় আর কান্তাদের বাড়ি যাওয়া হলো না। তারউপর বড় সংশয়, কান্তাকে হয়তো বাড়িতেই পাওয়া যাবে না। বিয়ে হয়ে গেছে শুনলো যে! দুয়ের জন্য হতাশা আর ইফতেখারের উপর রাগ নিয়েই বাড়ির গেটে প্রবেশ করলে সামনে পড়ে আফজাল হোসেন। টুপি মাথায় মসজিদের জন্য বের হচ্ছেন তিনি। মাগরিবের আজান পড়ছে যে। শ্রাবণ মনে বিরক্তি চেপে রেখেই তাকে সালাম দেয়। এদিকে হাসিমুখে সালামের জবাব দিয়ে আফজাল হোসেন জিজ্ঞেস করে,
“কেমন আছো?”
শ্রাবণ যেন ক্ষণিকের মধ্যেই ভাবুক হয়ে উঠে তার হাসিমাখা মুখের কারণে। এবং ভাবুক বেশেই ছোট করে জবাব দেয়,
“আলহামদুলিল্লাহ।”
“এখন ফিরলা?”
“না। কিছুক্ষণ আগে।”
“তোমার বাড়ির সবাই ভালোই আছে?”
“জ্বি।”
“যাও, ঘরে যাও।”
স্বাভাবিকভাবেই তিনি বেরিয়ে গেলেন নামাজের জন্য। কিন্তু শ্রাবণের পা দুটো পূর্বের মতো বেগে আর চললো না। কদম জুড়েও যেন ভাবনা ঠাঁই নিয়েছে। এতো প্রত্যক্ষ অপমানের পরেও একটা গণ্যমান্য লোক কীভাবে তাকে এতো স্বাভাবিকভাবে বরণ করে ভালোমন্দের কথা জানতে চায়! কীভাবে তাকে দেখার পর মুখে হাসি স্পষ্ট হয়ে যায়! উনার তো আরও আগে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কথা। শাশুড়ি আম্মার চেয়েও কয়েক গুণ বেশি রাগ জমা থাকার কথা। আর তিনিই কি না এতো স্বাভাবিক, হাস্যোজ্জ্বল! অবিশ্বাস্য!
ঘরে ফিরেই অর্পার সাথে দেখা হয়। শ্রাবণ নিজেই জিজ্ঞেস করে,
“কেমন আছো?”
অর্পা মিনমিনে গলায় জবাব দেয়,
“ভালো। তুমি কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ।”
বিগত দিনগুলোকে মনে রেখে তারও ইচ্ছে হয় না যেন ভাবির সাথে কথা বলতে। আবার প্রত্যক্ষ দেখায় উপেক্ষাও করতে পারে না অর্পা। তাই শুধুমাত্র হালকা করে জবাব দিয়ে গেলো। এসবে শ্রাবণের কোনোরকম আক্ষেপ নেই। পরিস্থিতিটাই মূলত এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার ফলাফল তার অবগত ছিলো। এবং সেটা তার নিকট অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু সমস্যা অন্যত্র। পরবর্তী প্রহর জুড়ে শ্রাবণের মাথায় শুধুমাত্র একটা ব্যাপারই চেপে রইলো। আর তা হলো, আফজাল হোসেনের স্বাভাবিকতা তার কাছে বড়ই অস্বাভাবিক। তার কাছেও একটু অন্যরকম আচরণ প্রত্যাশা করেছিলো।
এই কাজ, সেই কাজ সেরে পরী দ্বিতীয়বার ভাবির কাছ ঘেঁষেছে রাত প্রায় দশটায়। ইফতেখারের রুমেই বসেছিলো শ্রাবণ। কিছুক্ষণ আগে বিপুর সাথে দেখা হয়েছিলো। আফজাল হোসেনের পর এই বিপুই নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে কথা বললো সৌজন্যতার হাসির সাথে। শ্রাবণ তাকে নিয়েও ভাবছে। কান্তাকে নিয়েও ভাবছে। মা বোনকে নিয়েও ভাবছে। একটু অন্যরকম মন খারাপ তার। মোটামুটি টানা অনেকটা সময় কাটিয়ে এলো তাদের মায়াকুটিরে। আজ কেমন নিঃসঙ্গ লাগছে তাদের থেকে দূরে অবস্থান করে। এমনি পরী আসে ঘরে।
“ভাবি, আপনারে তো ডাইকা গেলাম। গেলেন না। ফোনে কথা কইতাছিলেন বইনের সাথে। সবার খাওয়া কিন্তু শেষ। আপনে আর ভাইজান বাদে।”
“তোমার ভাইজান ফেরেনি এখনো?”
“না। কাকায় ফোন করছিলো। আইতাছে কইলো। তবে খাইতো না। বন্ধুর বাড়ি নাকি দাওয়াত খাইলো। আপনে খাইয়া নেন।”
“আম্মা ডেকেছিলো আমাকে?”
“কাকায় ডাকছিলো তখন।”
“আচ্ছা। আমার ইচ্ছে করছে না খেতে। খাবো না এখন। তুমি বরং গুছিয়ে রেখে ঘুমিয়ে পড়ো।”
“গুছাইছিলামই। আপনার খাবারটাও গুছানোতেই আলাদা রাখা আছে। এই ঘরে নিয়া আসি?”
“না বোন। আমি এখন খাবোই না।”
“না খাইলে আর কি করার!”
“মানুষ সব এইঘরে চলে এলো। রান্নাবান্না এখনো ওঘরে কেন?”
“নতুন বিল্ডিং, আঁচ লাগাইতে দিতো না আম্মায়।”
কথা বলেই খিলখিলিয়ে হাসে পরী। পরক্ষণে বলে,
“মজা করলাম। আম্মার নাকি ওই ঘরেই সুবিধা। তাই আসবাব নড়চড় হইতে দেয় নাই। আসল কতা তো আপনারে কই নাই। এখন জানাই।”
হাত-পা গুটিয়ে মশারির ভেতর বিছানার এক কোণে বসে যায় পরী। বিস্তারিত শুরু করে তার জানা কান্তার বিয়ের দিনের ভয়ানক কাহিনী। শুনতে শুনতে ভাবনায় দেবে যায় শ্রাবণও। এক পর্যায়ে যখন বললো বিপুর সাথে বিয়েটা হয়ে গেছে। ধ্যানভঙ্গ হয়ে চমকে যায় শ্রাবণ।
“কার সাথে বললে?”
“আরে ছোড ভাইজান। মানে তোতাপাখি।”
“কীভাবে?”
“ওফ্ফ! তা-ই তো কইতাছি আপনারে।”
“খেয়াল করিনি। আবার বলো।”
“আরে, বড় ভাইজান এই কাজ করছে। কাকারে না জানাইয়া কান্তাবানুরে নাকি হাসপাতাল থেকে ধইরা আইন্না কাজী অফিসে বিয়া পরায় দিছে।”
“তোমার বড় ভাইজান এই কাজ করেছে?”
“ভাবি, পরিষ্কার জানান তো আমারে। আপনের কি মনে হইতাছে আমি মিছা কথা কইতাছি?”
“না, না। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি তোমার ভাইজানের কীর্তি শুনে।”
“আমরাও টাস্কি খাইয়া বইছিলাম। আম্মা দিছে মরা কান্নার শুরু কইরা!”
“আব্বা জানে না?”
“জানবো না ক্যা! কাকায়ই তো আরও জানাইলো সবাইরে।”
“বলেনি কিছু?”
“হো, বকাঝকা করছে। করলেই কি! বড়ভাইজান তো মানুষই একখান। ডরভয় কিচ্ছু আছে নাকি! যা মন চায়, কইরা চুপচাপ বইসা থাকে।”
“হ্যাঁ। বুঝলাম। এইবার তবে তোমার বিয়ের দায়িত্বটাও তোমার বড় ভাইজানের উপর অর্পণ করতে হয়।”
“এহ!”
লজ্জা পেয়ে উঠেই চলে যায় পরী। ওই ঘরটা তালা দিয়ে আসতে হবে তার। কেউই যখন আর খাবে না, অপেক্ষা করে লাভ নেই। এদিকে শ্রাবণের মনে বিরাজ করতে থাকে অন্যরকম আনন্দ! তোতাপাখির বিয়ে কান্তার সাথে হয়ে গেলো! ওফ্ফ! লোকটা তবে ইচ্ছে করে তাকে রাগিয়ে দিলো তখন? ইচ্ছাকৃত মজা নিলো এমন কাণ্ড ঘটিয়ে? আসুক না আজ!
অপেক্ষা করতে করতে কখন যে চোখ দুটো ক্লান্তিতে বুজে এলো, টেরই পেলো না। শেষ রাতে ঘুম ভাঙতেই ক্ষণিকের জন্য ভরকে যায় রুমে একা থাকায়। ইফতেখার কোথায়? সে কি গত রাতে বাড়ি ফেরেনি? নাকি বিপুর ঘরে আছে? নাকি ফেরেইনি!

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৬২
(নূর নাফিসা)
.
.
শেষ রাতের ঘুমটুকু আর হলোই না ইফতেখারের চিন্তায়। কল দিবে দিবে ভেবেও দেয়নি, যদি বিপুর ঘরেই ঘুমিয়ে থাকে সেই ভাবনায়। রিংটোনে বিপুর ঘুম ভাঙলে লজ্জায় পড়তে হবে তখন আরও। তাই সকাল হওয়ার অপেক্ষায় পাড় করলো যেন দীর্ঘ প্রহর। আজান হলো, নামাজ আদায় হলো। ফের হলো ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টা। ভোরের আলো স্পষ্ট হলেই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে রইলো একা একা। ভোরের নির্জনতা তার ভীষণ পছন্দের। সেই সাথে পাখিদের গুঞ্জন সৃষ্টি করেছে মুগ্ধকর মোহতান। তাতেই কাটিয়ে দিয়েছে শ্রাবণ এই সুবর্ণ প্রহরটা।
পরপরই পারভীনকে দেখতে পায় পুরাতন ঘরের দিকে যেতে। বারান্দার গেটের কাছে গিয়ে আটকে যান ভেতর থেকে তালা দেওয়া থাকায়। ভেতর থেকে তালা দেওয়া হবে কেন, সেই সংশয় দূর করতে পরীকে ডাকতে থাকেন সেখান থেকেই। পরী হাতে কয়লা নিয়ে বসেছিলো নতুন ঘরের প্রবেশদ্বারে। পুচ করে কুচকুচে থুতু ফেলে গলা উঁচিয়ে জবাবে বলে,
“আমি রাইতে তালা দিতে যাওয়ার পরে বড় ভাইজান হাত থেইকা চাবি রাইক্ষা দিছে। ডাক দেন। ভাইজানই আবার এইঘরে ঘুমায় রইছে কি না, দেখেন।”
যেখানে সেখানে কয়লার থুতু ফেলে পরিবেশ নষ্ট করছে, তাই ধমক দেয় পারভীন। পরক্ষণেই ইফতেখারের রুমের বরাবর দাঁড়িয়ে একাধারে ডাকতে থাকলে সদ্য ঘুম ভাঙা চোখে বেরিয়ে আসে সে। শ্রাবণ বিরক্ত দৃষ্টিতে এখান থেকে দেখে ইফতেখারকে। জেদ নিয়ে তবে নিজের ঘর ছাড়লো? আর তাকে যে সন্ধ্যায় ক্ষেপিয়ে দিলো, সেজন্য এই লোককে শাস্তি দিলে এখন কেমন হবে তবে?
ঘরের তালা খুলে দিয়ে পুনরায় ঘুমাতে চলে গেছে ইফতেখার। পারভীন কী কী যেন জিজ্ঞেস করতে করতে রান্নাঘরে গেলো। ইফতেখার কিছু না বলেই চলে গেলো। পরপরই শ্রাবণ এসেছে এই ঘরে। ঘুমাতে ব্যস্ত না হয়ে তখন ফোনে কথা বলছিলো ইফতেখার। মালামালের অর্ডার আসছে। ঘুম আর হবে না। কাজে যেতে হবে। শ্রাবণ দুহাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করে তার ফোনকল শেষ হওয়ার৷ আর শেষ হতেই প্রশ্ন জুড়ে দেয়,
“এই ঘরে ঘুমালেন কেন? মেহমানের জন্য নিজের ঘর ছেড়ে দিয়েছেন?”
জবাব দেয় না ইফতেখার। দুহাতে চোখ কচলে বসা থেকে উঠে যায় তাকে উপেক্ষা করে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। শ্রাবণের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় শ্রাবণ বলে,
“ঠিক আছে। আপনার মেহমান আজই চলে যাবে ঘরের দখলদারি ছেড়ে দিয়ে। আপনাকে আর অন্য ঘর খুঁজে নিতে হবে না নিজেকে কষ্ট দিয়ে।”
পথচলা থামিয়ে ইফতেখার আকষ্মিক পিছু ফিরে খিটখিটে মেজাজে। শ্রাবণের দুই বাহু চেপে ধরে দুই কদম পিছিয়ে নেয় ঠেলে। শ্রাবণ যেন একদমই অপ্রস্তুত হয়ে থাকে এমন অদ্ভুত আচরণে! ইফতেখার চোখে চোখ রেখে দাঁত চাপা নিচু কণ্ঠে বলে,
“কী মিল দেখেছো আমার তার সাথে?”
আগুন চোখের ভাষাতেও যেন ভাবুক হয়ে পড়ে শ্রাবণ। আকস্মিক কিছু বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকে প্রত্যুত্তরে প্রশ্ন তুলে,
“কীসের মিল? আর কার সাথে? কিছুই তো বুঝলাম না!”
“গত সন্ধ্যায় কী বলেছো, ভুলে গেছো?”
তাৎক্ষণিক নাড়া দেয় মাথায়। যার ফলে ভ্রু জোড়াও কুচকানো রেখা ছেড়ে দেয়। এজন্য তবে জনাব ঘর ছেড়েছেন রেগে! শ্রাবণ মিনমিনে গলায় বলে,
“ও! ভুলেই তো গিয়েছিলাম। আপনি ভুললেন না কেন!”
সে মজাকর ভাবে থাকলেও ইফতেখারের চোখমুখ একইরকম জটিল। তার জবাব চাই-ই। তাই পুনরায় প্রশ্ন করে,
“বলো? কী মিল দেখেছো তার সাথে আমার?”
“আপনি যেমনটা ভাবছেন, আমি তেমন কিছু ভেবে বলিনি।”
“কী ভাবতে চাইছো তবে তুমি?”
“শান্ত হোন। ব্যথা পাচ্ছি আমি।”
“আমাকে শান্ত থাকতে দিচ্ছো তুমি?”
হতাশায় চোখ বুজে নেয় শ্রাবণ একটা মুহুর্তের জন্য। পরক্ষণেই বলে,
“আপনার মামাতো ভাই একসময় যেমন আমার পিছু ঘুরতো। আমার দেখা না পেয়ে পরে আমার বোনকে দেখে তার পিছু নিতে শুরু করে। আর আপনিও এদিকে আমার বোনকে দেখে তাকেই টেনে এনেছেন অন্যের পরিবর্তক উদাহরণ হিসেবে। তারই সাদৃশ বুঝাতে চেয়েছি।”
“তো আমি ঘুরেছিলাম নাকি তোমার পিছু পিছু, রাস্তায় রাস্তায়? ঘুরেছিলাম তোমার বাড়ির আশপাশে ত্যক্ত করতে?”
“অদ্ভুত তো! আপনি সহজ বিষয়কে অহেতুক কঠিন কেন করতে চাইছেন?”
“হ্যাঁ, আমিই তো কঠিন করে ফেলি সব। আমিই অশান্ত হয়ে যাই। তোমার কথাই শুধু যুক্তিযুক্ত। তোমার কাজেই সব কারণ লুকিয়ে থাকে। বাকি সব অহেতুকী!”
শ্রাবণকে ছেড়ে দিয়ে হনহনিয়ে চলে যায় ইফতেখার। শ্রাবণ ত্যক্ত মনে দাঁড়িয়ে থাকে তাকে বুঝাতে অক্ষম হয়ে। একদমই বিশ্বাস করলো না যে কথাটুকু। পুরোটাতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়লো যেন। নিজেরও তো একটু খেয়াল হওয়া উচিত ছিলো, অপুর সাথে উনার একটা ঝামেলা পেকে গেছে। কেন গেলো তবে তুলনা টানাটানি করতে? ধ্যাৎ!
তা ভেবে কিছুটা রাগ নিজের উপরও টেনে নিয়ে এসেছে শ্রাবণ। খাটের কিনারায় বসে পা ঝুলাতে থাকে ত্যক্ত মনে। ততক্ষণে হাতমুখ ধুয়ে এসেছে ইফতেখার। মুখাবয়বের ময়লা দূর হলেও বিরক্তি দূর হয়নি একদমই। আর তা লক্ষ্য করে শ্রাবণ মনে জাগে প্রণয় মোহিনী। হাতমুখ মুছে ঝটপট শার্ট পরতে থাকলে সে জিজ্ঞেস করে,
“কোথায় যাচ্ছেন এখন?”
জবাব না দেওয়ায় উঠে দাঁড়ায় শ্রাবণ। ইফতেখার তাকে উপেক্ষা করে হাঁটতে ধরলেই বুকে হাত ঠেসে বাঁধা হয়ে সামনে দাঁড়ায় সে। শার্টের টপার বোতাম দুটো আর লাগানো হয়ে উঠেনা সেজন্য। সেই কারণেও বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকায় ইফতেখার। সেই পাথর দৃষ্টিতে শান্ত বৃষ্টির শীতল দৃষ্টি স্থির করে শ্রাবণ নরম গলায় বলে,
“অপেক্ষা সইবে। তবে উপেক্ষা নয়। শ্রাবণ ফুরিয়ে গেলেও কিন্তু এখন শ্রাবণেরই দিন। সীমানার বাইরে গেলেই আপনাকে ভিজতে হবে।”
শার্টের বাকি বোতাম দুটো শ্রাবণ নিজেই লাগিয়ে দিতে থাকে। অনুরাগ নাশজনক উক্তিতে ইফতেখারের দৃষ্টি থেকে বিরক্তি শান্ত বেগে ছুটে পালায়। তবুও থমথমে মুখে তাকিয়ে থাকে বোতাম লাগাতে মনোযোগী সেই শ্রাবণ চোখের পাতায়। যার ধারায় ভিজে যাওয়ার হুমকি রয়েছে সীমানা ছাড়ায়! শ্রাবণ কাজ শেষে তার শান্ত চোখে তাকিয়ে বলে,
“বুঝতে পেরেছেন কী বলেছি? সীমানার বাইরে গেলেই ভিজতে হবে শ্রাবণধারায়।”
“তাই?”
“গিয়েই দেখুন শুধু একবার।”
“আর শ্রাবণ যে বছরকে ফাঁকি দিয়ে পালায়? তার প্রাপ্য কী হওয়া উচিত?”
“শ্রাবণ পালিয়েই তো আর হারিয়ে যায় না। নতুন বছরে ফেরার জন্যই পালায়৷”
ইফতেখার হতাশিতভাবে মাথা তুলে এক মুহুর্তের জন্য উপর দিকে তাকায়। পরক্ষণে আবার বলে,
“তবুও পালাবেই!”
শ্রাবণ মুখ টিপে হেসে ফেলে।
“উপেক্ষাকে কারণ হিসেবে রেখে আবার যেতেও পারি।”
“আমি বারবারই তোমার অপেক্ষায় বসে থাকবো ভেবে ভুল করছো না তো?”
“সেই ভুল তো করছি না। কিন্তু আপনার আম্মা তো এক বউকেই মানতে পারছেন না। একাধিক কীভাবে মেনে নিতেন তখন?”
“তুমি গুরুত্বপূর্ণ সময়েও মজা করো, প্রেমের সময়েও মেজাজ খারাপ করে দাও। এসবই বিরক্ত লাগে আমার কাছে। পরিস্থিতির প্রতিকূলে কেন সবসময় চলতে হবে তোমাকে?”
“মেঘ তো শুধু শ্রাবণেই জমে না। সারা বছর জুড়েই মেঘের ঘনঘটা চলে বিস্তীর্ণ আকাশ জুড়ে। আমি একদমই ঠাট্টা করলাম না। বরং সময়োপযোগী কথা বললাম। আম্মাকে গত রাতেও অভিযোগ তুলতে শুনলাম আব্বার নিকট। বড় পুত্রবধূর সঙ্গে তিনি সংসার জমাবেন না।”
“এসব ফালতু কথা রাখো।”
“ঠিক আছে। রাখলাম। ওসব ফালতু হয়ে থাকলে তো আমিও সন্তুষ্ট। কিন্তু আপনি এই দুমড়ানো মুচড়ানো শার্ট পরে কোথায় যাচ্ছেন? এ যুগের মেয়েরা তো আর এভাবে পটবে না। ভালো কিছু পরে বের হোন।”
“সতীন নিয়ে সংসার করতে পারবে?”
“শ্রাবণের জ্বালাতন আপনি সহ্য করতে পারলে শ্রাবণেরও আপত্তি নেই তাতে।”
আরেকটু কাছাকাছি এগিয়ে ইফতেখার এবার আলতো করে বাহুতে হাত রাখে। তার অনুরাগের সমাপন হয়েছে প্রমাণ করতে কপালে চুম্বন করে বলে,
“জ্বালাতন সহ্য করার জন্যই তো একটা শ্রাবণ এনেছিলাম ঘরে। কেন দূরে সরে যাও তবে?”
চোখ বুজে আদরটুকু সাদরে গ্রহণ করলেও প্রত্যুত্তরে জবাব রাখে না শ্রাবণ। ইফতেখারের পেটে আলতো করে ঘুষি মেরে বলে,
“কান্তার বিয়ে যে আপনি দিয়েছেন, বলেননি কেন আগে?”
ইফতেখার মুচকি হেসে চলে যেতে থাকে। শ্রাবণ শার্ট টেনে পিছু আটকে বলে,
“আমার কথা শেষ হয়নি।”
“আমার কাজ আছে।”
“থাকুক আপনার কাজ।”
“পরে শুনবো কথা৷ এখন যেতে হবে। গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।”
“আমিও যাবো সাথে।”
“কোথায়?”
“আপনার সাথে।”
শ্রাবণও সাথে বের হতে থাকলে ইফতেখার আপত্তির সাথে বলে,
“আযব তো! আমি মালামাল উঠাতে যাচ্ছি। তুমি সেখানে কেন যাবে?”
“আমি কখন বললাম, মালামাল উঠাতে যাবো! আমি আপনার সাথে কান্তাদের বাড়ি পর্যন্ত যাবো।”
দুজন একত্রেই বেরিয়ে যায় বাড়ির বাইরে। শ্রাবণ হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করে,
“কান্তাকে বাড়ি আনলেন না কেন?”
“সব হুটহাট টেনেটুনে নিয়ে এলে কেমন হয়! সময় হোক। দেখি, ভালো কিছু হয় কি না। মানসম্মান নিয়ে এতো টানাটানি করলে না আবার আমাকেই ত্যাজ্য হতে হয়।”
“আপনি আসলে শুধু সাহসীই না৷ বুদ্ধিমানও। এটাও আপনাকে ভালো লাগার আমার অন্যতম কারণ।”
“সব জেনেশুনেই এসেছো যেন?”
“উহুম, এসে জানছি। জেনে মুগ্ধ হচ্ছি।”
“অথচ এই একই কারণে আমি বাবামায়ের কাছে অপছন্দের হয়ে আছি।”
“তা-ও সত্য। কিন্তু মানিয়ে নিবে বিশ্বাস। কান্তা তো আর আমার মতো বেয়াদব না।”
নিজেকে বেয়াদব বলায় মুখের দিকে তাকায় ইফতেখার। শ্রাবণ হাসিমুখে বলে,
“কী হলো? ভুল কিছু বললাম? মানুন আর না মানুন, এটা কিন্তু কঠিন সত্য। এই পৃথিবীতে সুস্পষ্টবাদীদের এক প্রকার বেয়াদব হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়। আমি সম্ভবত সেই বেয়াদবদেরই একজন।”

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৬৩
(নূর নাফিসা)
.
.
কান্তাদের বাড়ি এলেই কাইয়ুমের দেখা পাওয়া যায়। শ্রাবণকে দেখে যেন মাথা নিচু করে পশ্চিম প্রান্তে চলে গেলো সে। লজ্জায় আড়াল হয়েছে, নাকি অপরাধী বেশে পালিয়েছে; কে জানে? তবে লজ্জায় হলেই ভালো শ্রাবণের মতে। ন্যায় অন্যায় বুঝে না চললে বিপদ বসে থাকে নাকের ডগায়। সবসময় সুযোগ হয় না নিজেকে বাঁচিয়ে নেওয়ার। বারান্দায় শিরিনকে দেখেই শ্রাবণ উঠুনে চলতি পথে সালাম দেয়। জিজ্ঞেস করে, কান্তা কোথায়? কান্তা পুকুরে গেছে জানলে সে পা বাড়িয়েছে সোজা মজিদার ঘরে৷ কতদিন হয়, দেখা হয় না খালাম্মার সাথে। জানা হয় না, একাকী এই মানুষটা কেমন আছে? একাকীত্বের প্রতিই যেন শ্রাবণের মায়াটা বেশি বেড়ে উঠে। যেমনটা বেড়েছিলো ফাতিহার ক্ষেত্রে। মজিদার সাথে দেখা করেই পুকুরের দিকে যায় শ্রাবণ। কান্তা সবে মাত্র হাঁড়িগুলো ধুয়ে হাতে নিচ্ছিলো বাড়ি ফেরার জন্য। শ্রাবণকে দেখেই থেমে যায় কিছুটা বিস্ময়ের সাথে। শ্রাবণ মুচকি হেসে তৎক্ষনাৎ বলে,
“চেয়ারম্যান বাড়ির ছোট বউ যে…”
লজ্জায় রঙিন হয়ে যায় কান্তা। তবুও উৎফুল্লতার সাথে জিজ্ঞেস করে,
“কেমন আছো, আপু?”
“আলহামদুলিল্লাহ। তোমার খবরটা জেনে আরও বেশি ভালো অনুভব করেছি। আবার ভীষণ রাগও হয়েছি। কী করতে যাচ্ছিলে এসব? চড়িয়ে দাঁত ফেলে দেওয়া উচিত।”
কান্তা লজ্জিত হেসে বিড়বিড় করে,
“দেবর ভাবির একই কথা!”
“বলেছে নাকি বিপু ভাই? দিলো না কেন তবে? অদ্ভুত কাণ্ড! তোমাকে নিয়ে কিন্তু এমনটা ভুলেও কখনো প্রত্যাশা করিনি। জীবনের কোনো পদক্ষেপকে সংগ্রাম হিসেবে নিলে এতো ধৈর্য্যহারা হলে চলে?”
দৃষ্টি নত রেখে কথা শুনে ফিসফিস করে কান্তা,
“একটা গোপন সত্য বলি। কাউকে বলো না যেন৷ ওসব নাটক ছিলো আপু। আমি কিছু করিনি।”
“করোনি মানে? না করলেই এতো কিছু হয়?”
“সত্যি বলছি। একটু ভং ধরেছিলাম। এরপর মনে হলো, জিতে গেছি। ”
“ভারি অদ্ভুত তো! কোনটা সত্য বলে বিশ্বাস করি এখন? আশপাশ জুড়ে যে রটারটি হলো?”
“রটারটি হয়েছে, তা-ও ঠিক। আমি যা বলছি, তা-ও ঠিক। তোমার দেবরকেও এই সত্যটা জানিয়েছি। তুমিও বিশ্বাস করে নাও দয়া করে।”
“তোমার কথা যদি সত্য হয়েও থাকে, তবুও বলবো ঠিক করোনি কাজটা। পিতামাতার মাথা কাটা গেছে কিন্তু এমন রটারটিতে। তারা আর আগের মতো দুচারজনের সাথে স্বাভাবিক কথা বলার মানসিকতা কোনোভাবেই পাবে না। পিতামাতার যেমন সন্তানের উপর দায়িত্ব বর্তায়, সন্তানেরও দায়িত্ব তাদের সম্মানহানিকর পরিস্থিতিতে না ফেলা। উনারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েননি কি তাতে?”
কান্তা মুখ মলিন করে জবাব দেয়,
“যদি ঘটনা সত্যিই হয়ে যেতো, তবুও তো রটারটি হতোই। আমি আসলেই প্রতিদিনকার এতো চাপ নিতে পারছিলাম না, আপু। বিয়ের জন্য আব্বা আম্মা যেভাবে জোরজবরি করছিলো, মনে হচ্ছিলো মরেই যাই।”
“চুপ! এসব বলতে নেই। পিতামাতার পছন্দের বিরুদ্ধে যখন শান্তি খুঁজেছোই, বাঁচার লড়াইয়ের জন্যও প্রস্তুত থাকার দরকার ছিলো। যাক, বাদ দাও। যা হওয়ার, হয়েছে। ভবিষ্যতে আর এমন কিছু করো না আপনদের কষ্ট দিয়ে। আমি এটুকু বলতে পারি, ছেলে কিংবা মেয়ে কোনোদিক হতেই উনারা নিজেদেরকে সুখী মনে করতে পারছেন না। পরবর্তী দিনগুলোতে যেন তারা একটু হাসতে পারে, এমন ভাবেই চলো। প্রয়োজনে কিছুটা স্যাক্রিফাইস করেই। তবুও চেষ্টা করো। তা, বিপু ভাইয়ের কী অবস্থা? চাচা-চাচী মেনেছেন তাকে?”
জবাবে উপর নিচে মাথা হেলায় কান্তা।
“তাহলে তো ভালোই। বাসায় আসে?”
“আসে তো মাঝে মাঝে। দেখা করে যায়।”
“আদর আপ্যায়ন?”
“এখনো তেমন না। আম্মা যা-ই বলে, আব্বা মুখ ফেরাতে পারলেই যেন বাঁচে।”
শ্রাবণ দৃঢ় নিশ্বাস ফেলে বলে,
“যাক। টেনশন নিয়ো না। সময়ের সাথে স্বাভাবিক হয়ে উঠবে আশা রাখি।”
“ও বাড়িতে কী অবস্থা আপু?”
শ্রাবণ মুচকি হেসে বলে,
“অবস্থা এখন শুরুর দিকে। শেষ হতে হয়তোবা অনেক বাকি। নয়তোবা না। নয়তোবা-এর জন্যই দোয়া করো আপাতত।”
“আমার কেমন যেন ভয় হয় তাকে নিয়ে।”
“কাকে? বিপু ভাইকে নিয়ে? তার আবার কি হবে?”
“জনি না। কিন্তু ভয় হয়।”
“ভয় করার কিছুই নেই। তুমি তোমার দিকে ঠিক থাকো। ব্যাস। আসি আমি। পরে সময় পেলে এসে গল্প করবো। এখন দেখা করারই ছিলো।”
কান্তা ঝটপট হাঁড়ি হাতে নিতে নিতে বলে,
“না, না। অনেক দিন পর এসেছো। ঘরে এসো। কিছু মুখে তুলে তারপর যাবে।”
“ইশশ! আমার আপ্যায়ন বাদ দাও। তোতাপাখির যত্ন নাও। দেখা হবে পরে। সময় নেই এখন।”
.
বাড়িতে সারাদিন শ্বাশুড়ি বউয়ের মধ্যে ঝামেলা বেঁধে রইলো। শ্রাবণের সাথে সংসার করতে একদমই অনিচ্ছুক পারভীন। শ্রাবণকে যদি এই বাড়িতে রাখাই হয়, তবে হাঁড়ি আলাদা করতে হবে; নাহয় সংসার হতে নিজের হাত পুরোপুরিভাবে গুটিয়ে নিবে। এমনই প্রস্তাবে কড়া বায়না ধরে রাখে সে চেয়ারম্যানের নিকট। চেয়ারম্যান কথায় ঠাট্টা ঢেলে দিয়ে তার প্রত্যুত্তরে বলে,
“এমন হলে তো ভালোই। হাত গুটিয়েই বসে থাকো। বয়স হয়েছে যখন, শুয়ে বসেই খাওয়ার সময় তোমার। ছেলের বউয়ের হাতে ছেড়ে দাও যত দায়িত্ব।”
পারভীন গলায় ক্ষোভ রেখে বলে,
“হাত গুটিয়ে বসবো মানেই দায়িত্ব দিয়া বসে থাকবো না। যেইদিকে দুচোখ যায়, সেইদিকেই চলে যাবো। খুঁজলেও পাইবেন না।”
কথা বলতে বলতেও গলা কাঁপে পারভীনের। মনের কষ্ট যখন কাছের মানুষের কাছেও পাত্তা পায় না, তখন আর কেমনই বা হবে দেহ মনের হাল? ওদিকে ইফতেখারও রাগারাগি শুরু করেছে। মা এসব কী বলছে? তাকে ত্যাজ্য করতে চাইছে? এ নিয়েও হলো মা ছেলের মধ্যে একরকম কথা কাটাকাটি। পারভীনের এক কথা, এই বউ নিয়ে তিনি সংসার গোছাবেন না। ছেলে যখন এই বউকেই ঘরে রাখবে; তো ঘর, হাঁড়ি আলাদা করে রাখুক। তার সাথে কোনো কাজে সংযোগ থাকার প্রত্যাশা তিনি রাখেন না। জেদি ইফতেখার বাবার সামনে এসে কড়া মন্তব্য রেখে যায়।
“আব্বা, মা এইসব কী শুরু করেছে? আমার ভাল লাগছে না কিন্তু।”
“তোর মায়ের একা হাঁড়িতে খাওয়ার শখ জন্মাইছে।”
“হাঁড়ি, বাড়ির খবর আমি বুঝতে চাই না। মা যদি আমার জন্য অনিয়ম করে ঝামেলা বাড়িয়েই রাখতে চায়, আমি এই বাড়ি ছেড়েই চলে যাবো। তারপর থাকুক যেমন ইচ্ছে তেমন।”
হনহন পায়ে এই সন্ধ্যাতেই বেরিয়ে যায় ইফতেখার। রাগ করলেই উনার বাড়ি থেকে হনহনিয়ে বেরিয়ে যেতে হয় কেন, বুঝে না শ্রাবণ। বাইরের হাওয়া কি মাথা ঠান্ডা করে দেয়? ভেবেই হাসি পায় তার। কিন্তু হাসে না। বিবেচনায় রাখে প্রত্যেকের কথা ও বাক্যালাপ। তার নিকট এযাবৎ সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার আফজাল হোসেন। আম্মা চাইছে আলাদা হতে, কারণ বরাবরই শ্রাবণ কর্তৃক আব্বার অপমান হয়েছে। বারকয়েক অসম্মান জানিয়েছে যেই লোকটাকে, সেই লোকটাই কেন তার প্রতি এতো সরল? আম্মাকে সংসার শান্তিতে ফেরানোর চেষ্টা করছে বারবারই। শ্রাবণের হয়ে কথা বলতে কার্পণ্য করছে না একদমই। অথচ তার চোখেই ক্ষোভ জন্মানোর কথা সবার আগে। আর তিনি হাসেন, মজা করে অর্পা ও পরীকে ডেকে ডেকে পারভীনের রাগ ভাঙার চেষ্টা করেন। তার মুখে উচ্চারিত প্রতিটি কথা সাক্ষী দিচ্ছে, তিনি শ্রাবণ ও পারভীনের সংসার এক রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু কেন?
গোমড়ামুখো পারভীন সারাদিনের রাগারাগি নিয়েও নিজেই রান্না করেছেন ঘরের লোকেদের আহারের জন্য। নিজের মুখে হয়তো দেননি কিছুই। তবুও রান্না করেছেন। এদিকে রান্না সারতে দেরি, শ্রাবণ এসে হাজির। গত রাত থেকে না খেয়ে থাকলেও রাতে নিজ হাতেই হাঁড়ি থেকে ভাত তুলতে আসে শ্রাবণ। পারভীন উপস্থিত থাকাকালেই এসেছে সবার আগে রাতের খাবার খেতে। নিজ হাতে ঢাকনা খুলে খুলে ভাত, তরকারি প্লেটে নিয়ে পারভীনের মুখে তাকিয়ে শুকনো একটা হাসি দেয় সে।
“আপনি হাঁড়ি আলাদা করতে চাইলে, করতে পারেন আম্মা। তবে শ্রাবণ কিন্তু নিয়মিত আপনার হাঁড়ি থেকেই দুই মুঠ ভাত তুলে নিবে নিজের জন্য।”
ক্ষিপ্ততায় ফুসে উঠে পারভীন।
“খাইবাই তো! লজ্জা নাই যে! লজ্জা শরম ধুইয়া আইছো না এই বাড়ির বউ হইতে? বিনা ডাকে নিজ পায়ে ঢ্যাং ঢ্যাং করতে করতে ঠাঁই গাঁড়ছো! তারপরেও যার খাও, তার পিঠেই কুড়াল চালানি দিয়া আবার কাঁধে হাত দেওয়া তো তোমার মতো নির্লজ্জ জাতেরই কাজকর্ম।৷ তোমরা এইসব বেহায়াপনায় অভ্যস্ত।”
শ্রাবণ প্লেট হাতে টুলে বসে মুচকি হেসে বলে,
“তা ঠিক বলেছেন। আসলে, নির্লজ্জ না হলে এতো লজ্জাশীল শ্বশুর, শ্বাশুড়ির সাথে সংসার জমাতে পারবো না। কিন্তু খোটা দেওয়া তো ভালো না আম্মা। আল্লাহ নারাজ হবেন। অধিকার বঞ্চিত করে খোটা দেওয়া একদমই অনুচিত।”
“এই চাপাগিরি আমার কাছে দেখাইয়ো না। দুই চোক্ষে সয় না।”
“জানি তো। না সইলেও একটু সয়ে যান। ছেলের বউ তো। কী আর করবেন নয়তো? দিনশেষে মিলেমিশেই থাকতে হবে। দিনের শুরুতেও একে অপরের মুখ দেখতে হবে।”
“কক্ষণো না! যেই ছেলে মায়ের বেদন বুঝে না, সেই ছেলেরে ত্যাগ করতেও আমার বাঁধতো না।”
“আসলেই? ভুল করছেন কিন্তু, আম্মা। তিনি ইতিমধ্যে যথেষ্ট রেগে গেছেন। তাকে আর রাগিয়েন না। আপনার ছেলে কতটা জিদ্দি, সেটা আপনি আমার চেয়েও ভালো জানেন। সে যদি একবার বেরিয়ে যায়, আর ফেরাতে পারবেন না বলছি। তাই নাখোশ আর রাগ যা-ই জাগিয়েছেন, পুত্রবধূ পর্যন্তই সীমিত রাখুন। ছেলেকে দূরে সরিয়ে ভুল করবেন না যেন। আপনার ছেলের জেদে আমিও ভয় পাই, জানেন তো? সেদিন ফোনে আমাকে শুধু জিজ্ঞেস করেছিলো, আমি আসবো? কি না? আমি কিন্তু ‘না’ বলতে ভয় পেয়েছি। কেন জানেন? কারণ আমি জানতাম, একবার ‘না’ বললে সে তার মতো করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিবে৷ তাই বলেছিলাম ‘একটু সময়ের প্রয়োজন’। আর সময় মোতাবেকই আপনার নাখোশ হয়ে হাজির হলাম। মায়ের কাছে ফিরেছিলাম ঠিক। কিন্তু সংসার ছেড়ে তো আর যাইনি, বলুন। তাই তাকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগটাও উনাকে দেইনি। আপনি এই সুযোগ দিয়ে ভুল করবেন না যেন। সে যদি আমার হাত ধরে এই সীমানা ছাড়ে, আমিও তবে আপনার পক্ষে কথা বলার সামর্থ্য ছেড়ে দিবো।”
“পাকনা পাকনা কথা দিয়া আমারে গুলাইতে চাইয়ো না। মাথা যা খারাপ করার, কইরা দিছো তার। মায়ের বুক খালি করছো।”
বুঝাতে ব্যর্থ শ্রাবণের মুখে তাচ্ছিল্যকর মৃদু হাসি ফুটে।
“আমি আপনার বুক খালি নয়, পূর্ণ রাখতে চাইছি। মাথা আমি খারাপ করিনি। একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন, আমি আসার পর আপনার ছেলে বদলেছে ঠিক। তবে তুলনামূলক শান্তরূপে ফিরে বদলেছে। আপনার বাড়ি ঘনঘন বিচার আসাটা বন্ধ হয়েছে। চেয়ারম্যানের ছেলে উমুককে মেরেছে; কথাটা হয়তো এই কয়েক মাসে একবারও জাগেনি কারো মুখে। বাবার আয়ের উপর নির্ভরটাও ত্যাগ করেছে নিজের দিকে তাকিয়ে। আত্মনির্ভরযোগ্য হয়ে দায়িত্ব নেওয়ার দিকে মনযোগ দিয়েছে। মায়ের কোল ছেড়ে একটা রাতও বাইরে কাটায়নি। এখন বলবেন না যেন বউয়ের আঁচলে মাথা রেখে ঘুমিয়েছে, তাই বাইরের বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরাঘুরির নেশা ছেড়েছে। বউ একদমই বাধ্য করেনি। সময়ের ব্যবধানে মানুষের মাঝে কত রকমের পরিবর্তনই আসে। ভালো মায়ের ভালো ছেলে বলেই হয়তো তার পরিবর্তনটা ভালোর দিকে ছুটে এসেছে। হোক সেটা জীবনে কিছু পাওয়ার সূত্র ধরেই। বিয়ের পরই হয়তো গুরুত্ব বুঝেছে জীবনের। তাই সচেতন হয়েছে। তবুও তো হয়েছে। আপনি তাকে সুযোগ হারা করবেন না।”
পারভীন হনহন পায়ে রান্নাঘর ছাড়ে। কোনোরকম পরামর্শ কিংবা তর্ক করতে তার রুচিতে বাঁধছে যেন। কিন্তু দরজার পাশে চুপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকা পরীর মন বলে অন্যকিছু। পারভীন কথায় পারেনি, তাই হার মেনে চলে গেছে। হার তো মানতেই হবে। ভাবি তো একটা কথাও মিথ্যা বলেনি। এই পরীর দুই চোখ সাক্ষী, বড় ভাইজান অনেক বদলেছে। বদলে দূরে যায়নি, বরং মায়ের কোলেই মাথা পেতে রেখেছে। তাই পারভীন যেতেই কদম দুয়েক এগিয়ে বাহবা দেয় পরী।
“ভাবিজান, আপনে একখান মানুষও! এত্তো ভাল্লাগে আপনারে!”
ভাতের লোকমা মুখে তুলতে বিরতি নিয়ে শ্রাবণ জিজ্ঞেস করে,
“কেন? এখন আবার কেমন সেজেগুজে এলাম?”
“আপনার আলাদা কিছু নিয়া সাজা লাগে না। চেহারা বলেন, আর কথাবার্তা বলেন; আপনে এমনিতেই সেরা। সারাক্ষণ সাজগোজ লাইজ্ঞাই থাকে সবকিছুতে। এত্তো সুন্দর কথা কইলেন না, আম্মায় তো না পাইরা এক্কেরে চুপ! বাবারে বাবা! সাহসের প্রশংসা না কইরাও পারি না! আল্লাহ কত্ত সাহস যে দিছে আপনারে! আম্মার হাঁড়িতে হাত বসাইলেনই এক্কেবারে।”
শ্রাবণ মুচকি হেসে খেতে মনোযোগ দিয়ে জবাবে বলে,
“সংসার জোড়া দিতে তো আঠা লাগাতেই হবে। হাত গুটিয়ে, পেট মারিয়ে বসে থাকলে হবে নাকি?”
“এই না হইলে পুত্রবধূ!”

চলবে।