শ্রাবণধারা পর্ব-৬৭+৬৮+৬৯

0
177

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৬৭
(নূর নাফিসা)
.
.
শ্রাবণ সত্যিই চলে গেছে? তার উপর অভিমান করেই? গতকাল থেকেই তো প্রায় কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলো তার সাথে। গত রাতেও কথায় মনোমালিন্য হলো দুজনার। শ্রাবণ বললো, চলেই যাবে। তা-ই কী গেলো সত্যি সত্যি? দিয়ে গেলো তাদের অশান্তি থেকে মুক্তি?

ক্ষিপ্ততায় মাথায় হাত বুলিয়ে উঠে যায় ইফতেখার। নাশতা করা আর হয়ে উঠে না তার। রুচি উড়ে গেছে মনে অশান্তি ছেয়ে যাওয়ায়। রুমে এসে হাত মুঠিবদ্ধ করে বসে থাকে কয়েক মিনিট। পরক্ষণে ফোন হাতে তুলে ডায়াল করে শ্রাবণের নম্বরে।
এদিকে সুলতানা কিছুটা বিস্মিত হয় মেয়েকে সকাল বেলা হাজির হতে দেখে।
“এসময় হঠাৎ!”
শ্রাবণ মুচকি হেসে বলে,
“কেন, অসময়ে এসে পড়লাম?”
“না। আসবি, তা বলিসনি যে আগে। তাই বলছি।”
“হুট করেই একটা ভাবনা মাথায় এলো। মনে হলো, এ-ই সময়। তাছাড়া একটু প্রয়োজনও ছিলো। কাপড়ের ব্যাগটা রেখে চলে গিয়েছিলাম যে। ওটার দরকার আছে। আরও একটা কারণও আছে।”
“আবার কী?”
“স্বাস্থ্যসেবা সংস্থায় আবেদন করেছিলাম না? প্রায় বছর ঘুরে মেসেজ এলো গত সকালে। শীঘ্রই জয়েনিংয়ের জন্য ডাকবে।”
“তুই না বললি, এটা হবেই না?”
“এতো দেরি হচ্ছিলো যে, তাই ভেবেছিলাম হবেই না বুঝি। এখন দেখি হয়ে গেলো। ভাবলাম, আসতেই যখন হবে এসেই জানাই তোমাকে।”
“যাক, ভালোই। খুশির খবর। ভালো কিছুর প্রত্যাশায়।”
“কিন্তু আমি তো দুশ্চিন্তায়।”
“কেন?”
“আমি তো ইফতিকে জানাইনি এখনো। চাকরি করতে আমাকে আগেই নিষেধ করেছিলো। এটাতেও দিবে কি দিবে না তাও জানা নেই।”
“তো বল। সরকারি চাকরি, ভালো পদ৷ তবে দিবে না কেন? সুযোগ সবসময় আসে?”
“তবুও, বাইরে কাজ করার ব্যাপারটা পছন্দ করে না। আচ্ছা, বাদ দাও। আগে জানিয়ে তো দেখি, সে কী বলে। যদি একটু চেঞ্জ হয় মতিগতি।”
“এ-ই নিজেই দুশ্চিন্তায় পড়ে যাচ্ছিস, আবার নিজেই নিজেকে বুঝ দিচ্ছিস।”
শ্রাবণ যাতায়াতে ক্লান্ত মুখে হাসি বাকিয়ে বলে,
“হয়ে যায় মাঝে মাঝে। শিশির কোথায়?”
“নিচে গেছে একটু। শাক খেতে মন চেয়েছে তার। এখন এতো বেলা করে খুঁজতে গেছে। বস তুই। পানি পান কর। ক্লান্ত দেখাচ্ছে মুখটা।”
শ্রাবণ কাঁধের ব্যাগটা বিছানায় রেখে পানির বোতল হাতে নেয়। মাকে পিছু ডেকে বলে,
“আম্মাজান, উনার কিন্তু জামাই আদর হয়নি এখনো। বেচারা বিয়ে করেছে আজ কতদিন! লজ্জায় মুখ ফুটে একদিন বলেও না, দাওয়াত করি না কেন।”
“একা এলি কেন তবে?”
“আমাকে নিয়ে যেতে পারে যেন এসে, তাই একাই চলে এসেছি না জানিয়ে।”
“বল আসতে।”
“তুমিই বলো?”
“তুই বললে আসবে না কেন?”
শ্রাবণ জবাব দেয় না৷ পানি পান করে বোতলটা রেখে এগিয়ে যায়। মাকে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে চুলোর কাছেই। মায়ের হাঁড়িতে দৃষ্টি রেখে আবেগঘন মনের কথা বলে,
“মানুষটা অন্যরকম ভালো, মা। সামনে থেকেই দেখে নিয়ো, এ যে কেমন সত্য কথা। মন থেকে ডাকো তুমি। সে চলে আসবে। আমি কিন্তু এজন্যই এসেছি আজ। ওবাড়ির প্রতিটি মানুষকে আমি আলাদা করে চিনে নিয়েছি, মা। আফজাল হোসেনের সাথে কারোই হুবহু মিলে না।”
“চুপ থাক তো। ওসব শুনতে ইচ্ছে করে না। শুধু এইটুকু বলবো, যে বাবার ঘরে জন্মেছিস। যে বাবার কাছে ন্যায় অন্যায় শিখেছিস। সেই বাবার অমর্যাদা করিস না।”
“ইনশাআল্লাহ। কখনো এমন পরিস্থিতি আমার সামনেই না আসুক, যেখানে তোমাদের অমর্যাদা হয়।”
“ফোন দে, ইফতেখারকে। কথা বলি।”
শ্রাবণ মুচকি হেসে মাকে ছেড়ে যায় ফোন আনতে। ফোনের কাছাকাছি গিয়ে শুনে রিংটোন বেজে চলেছে। হাতে নিয়ে দেখে ইফতেখারই কল করে যাচ্ছে। এটি দ্বিতীয় বার। ঘুম ভেঙেছে তবে? মুচকি হেসে ফোন রিসিভ করে শ্রাবণ। কিন্তু সে কণ্ঠ জাগানোর আগে ইফতেখারের সোজা প্রশ্ন,
“কোথায় তুমি?”
কণ্ঠধ্বনিতে মনের প্রতিক্রিয়া আন্দাজ করে নেয় শ্রাবণ। জবাবে বলে,
“মায়ের কাছে।”
“কেন?”
“এলাম একটু, মনকে শান্তি দিতে। আমার দূরত্বে যদি এবার আরও কারো অশান্তি দূর হয়ে আসে।”
কথা বলে ইচ্ছাকৃত নিশ্বাস ছাড়ে শ্রাবণ। ওদিকে ইফতেখার উত্তেজিত শ্রাবণ দূরে চলে যাওয়ায়।
“দুদিন পরপর এইসব ঝামেলা একদম ভালো লাগে না, শ্রাবণ। আমি কী তোমায় চলে যেতে বলেছিলাম?”
“বলেননি। তবে ইঙ্গিত করেছেন।”
“আমি ইঙ্গিতও করিনি। তোমার মনটাই সবসময় ঝামেলা পাকাতে ওস্তাদ।”
মুখ টিপে কিঞ্চিৎ হাসে শ্রাবণ। প্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া পাচ্ছে, তাই হাসি আসছে। তারচেয়ে বড় ব্যাপার, তার মন এখন ভালো আছে। ইফতেখারের প্রতি তো কোনো ক্ষোভ জন্মেনি তার মাঝে। আফজাল হোসেনের কারণে যতটুকু মন ভার ছিলো, ধীরে ধীরে তার রেশ কমে এসেছে সকাল নেমে আসার সাথে। তারউপর মায়ের কাছে এলেই মনে বিরাজ করে অন্যরকম শান্তি। মুখে গড়া হাসি সংযত করে শ্রাবণ স্পষ্ট গলায় প্রত্যুত্তরে বলে,
“বেশ তো। তা-ই চলে এলাম। শ্রাবণ নেই, আপনাদের ঝামেলাও নেই।”
“বেশি কথা বলো না। মেজাজ খারাপ হচ্ছে। বাড়ি আসো জলদি।”
“উহুম। সেদিন এই ভুলটা আমি করেছি। একা একা বাড়ি চলে যাওয়াটাই আমার চরম ভুল হয়েছে, স্ত্রীর মর্যাদার খুন হয়েছে। দারুণ শিক্ষাও পেয়েছি। তাই দ্বিতীয়বার শুধরে নিতে চাইছি। এবার নেওয়ার হলে আপনি এসে নিয়ে যান৷ নয়তো, আমি আর ফিরছি না।”
শ্রাবণ তো চলে যায়নি তবে! ফেরার জন্যই গেছে বুঝতে পেরে মনের সাথে কণ্ঠের উত্তেজনাও কিছুটা কমে আসে এবার।
“কী অদ্ভুত মর্জি তোমার। কী যে চাইছো, বুঝি না কিছুই। ঝটপট বাড়ি আসো বলছি।”
“হ্যাঁ, শ্রাবণ আসবে সেই অপেক্ষায় আপনিও বসে থাকুন। রাখছি। ফোনের ব্যালেন্স শেষ হচ্ছে আপনার।”
কল কেটে দিয়ে মৃদু হাসে শ্রাবণ। ইফতেখারকে মায়ের সাথে সাক্ষাতে আনার জন্যই এমন হুট করে তার চলে আসা। কোনোরকম বন্দোবস্ত ছাড়াই যদি ইফতেখার তাকে নিয়ে যেতে হাজির হয়, তাতেই সে সার্থক। ইফতেখার আবারও কল করে পরপরই।
“কল কেটে দিলে কেন?”
“আপনি তো একই কথা বারবার বলবেন এখন। তাই একবার শুনে ও বলেই আপনার ব্যালেন্স বাঁচিয়ে দিলাম।”
“তুমি আসবে না?”
“আবারও একই কথা! বললাম তো, আপনি আসুন আগে।”
“আমি চিনি না। তোমার চেনা আছে পথঘাট, যেভাবে গিয়েছো সেভাবেই ফিরে আসো।”
“মা কথা বলবে আপনার সাথে। পথঘাট চিনে নিয়েন এবার।”
“কীসের কথা। কেন?”
এদিকে শ্রাবণ জবাব না দিয়ে মুচকি হাসি সমেত ফোন দিয়ে দেয় সুলতানার কাছে। সুলতানা সালাম দিতেই চুপ হয়ে যায় ইফতেখার। ইতস্ততভাবে সালামের জবাব দেয়। ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে জামাইকে প্রথমবারের মতো দাওয়াত করেন আজ তাদের বাড়ি আসার জন্য। ‘না’ বলার সুযোগ নেই ইফতেখারের মাঝে। শাশুড়ির সাথে প্রথম কথা বলছে তা-ও আবার ফোনকলে, এমনিতেই বিব্রত হয়ে আছে তাই। শান্ত, ভদ্র ছেলের মতো জবাব দিয়ে দিলো,
“ঠিক আছে।”
সুলতানা ফোন ফেরাতেই শ্রাবণ দূরে চলে গেলো কথা বলতে বলতে।
“কী, মা বলতেই সব ঠিক হয়ে গেলো?”
“এসবও মাকে শুনিয়ে শুনিয়েই বলছো?”
কিঞ্চিৎ শব্দযোগে খিলখিলিয়ে হাসে শ্রাবণ। জবাব দেয়,
“না। দূরেই আছি। আপনার থেকেও দূরে, মায়ের থেকেও দূরে।”
“তুমি আসলে দূরে গিয়েও শান্তি দেওয়ার মানুষ না।”
“কেন, আপনি না শ্রাবণের জ্বালাতন সহ্য করতে সদা প্রস্তুত?”
“ওসব রাখো এখন। কখন আসবে?”
“আপনি যখন নিয়ে যাবেন।”
“কখন আসবো?”
“এখন হলে এখনই আসতে পারেন।”
“নাশতাও করিনি। উঠে চলে এসেছি।”
“কেন? নাশতা তৈরি হয়নি? আমি পরীকে বলে এসেছিলাম আম্মাকে নাশতার কথা বলতে। জ্যামের ভয়ে দ্রুত বেরিয়ে এসেছি। নাশতা তৈরির সময় হয়নি।”
“না, তেমন কিছু না। নাশতা বানিয়েছে মা। তোমার জন্যই খাইনি৷ রাখি।”
ইফতেখার আবার যায় নাশতা করতে। মনের ভেতর এখনো কেমন হাসফাস লাগছে শাশুড়ির সাথে কথা বলার কারণে। অদ্ভুত রকমের ভয় যেন কাজ করছিলো মুহুর্তটায়। সামনাসামনি হলে তখনও কী এমনটাই লাগবে নাকি, ভাবছে খেতে খেতেই। এমন লাগার কারণ কী? লুকিয়ে লুকিয়ে শ্রাবণকে রেখে দিয়েছে বলেই কী ধরা পড়ার ভয় কাজ করছে মনে? তা ভেবেই নিজের উপর নিজে হাসে। তবে অস্বস্তি কাটে না। খাওয়া শেষে একবার ভাবে মাকে বলে যাবে। কিন্তু মায়ের গম্ভীর মুখ দেখে আর বলে না। এই অবস্থায় শাশুড়ির দাওয়াতের কথা বললে মোটেও সন্তুষ্ট হবেন না তিনি, তা বেশ ভালোই জানা। তাই আর বলেও না। ভাবে বাবাকে নিয়ে। বাবার গত রাতের প্রস্তাব নিয়েও। শ্রাবণের কৃতকর্মের উপর তার চোখে সন্দেহের জন্ম সেই শুরু থেকেই। একের পর এক ধোঁয়াশা কেটে গেলেও পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় আবারও মনে হয়, আরও রহস্য। আরও কারণ! আম্মার মৃত্যুর পরও আব্বার সাথে তার আচরণ ভালো না দেখাতেও এই সন্দেহ আবার স্থির ইফতেখারের চোখে। কারণ হিসেবে সামনে পড়লো কান্তাকে। এখন কান্তাও বিবাহিত। তার পরেও এমন আচরণ কী কান্তাকে ঘরে তোলার লক্ষ্যে? নাকি অন্যকিছু? এসব ভাবনায় সময়ে অসময়ে ইফতেখারও ডুবে যায় ক্ষণে ক্ষণে। গোসল সেরেই আবার কল করে শ্রাবণের ফোনে। শ্বশুর বাড়ি যাওয়া নিয়েও একটা বিব্রতকর চাপ সৃষ্টি হয়েছে তার মাঝে। জিজ্ঞেস করে,
“কী নিয়ে আসবো?”
“কী নিয়ে আসবেন মানে?”
“শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি, কী নিয়ে আসবো? মানে তোমাদের কী খেতে পছন্দ? মায়ের, বোনের কী পছন্দ?”
“বিশেষ কোনো পছন্দ নেই। আনতে ইচ্ছে হলে আপনার ইচ্ছানুযায়ীই আনবেন।”
“তোমার কাছে ইচ্ছা নয়, সমাধান চেয়েছি।”
“দুঃখিত। অন্যকোথাও হলে দিতাম। এখানে কোনো সমাধান আমি দিতে পারছি না।”
“আসলেই ভেজাল!”
কল কেটে দেয় ইফতেখার। নিজে নিজেই ভাবতে থাকে কী নিয়ে যাবে। পরক্ষণে আবার কল করে,
“জ্বি, বলুন?”
“পোশাক কোনটা পরবো?”
শ্রাবণ আশ্চর্যই হয় তার প্রশ্নে। অনুমানও করতে পারে, সমস্যাটা কোথায়। জবাবে বলে,
“শেরওয়ানি পরে আসেন। চার বেয়ারা ভাড়া করে পালকি নিয়ে আসেন।”
“মস্করা করো না। প্যারায় আছি।”
“এখনই আসছেন?”
“হ্যাঁ। কাজ আছে বিকেলের দিকে।”
“আচ্ছা।”
“আচ্ছা মানে কী? এর সমাধানও নেই তোমার কাছে?”
শ্রাবণ হাসে। ইফতেখার আবার জিজ্ঞেস করে,
“শার্ট পরবো নাকি টিশার্ট?”
“শার্ট।”
“কোনটা?”
“সাদা রঙেরটাই পরুন।”
“ওকে।”
“আরও বলে দেই, আবার না কল করেন?”
এবার ইফতেখারও মুচকি হাসে। কাঁধে ফোন চেপে সাদা শার্ট গায়ে জড়াতে জড়াতে বলে,
“বলো তবে…”
“কালো জিন্স, সাদা শো, কালো ওয়ালেট আর হাতঘড়ি যেটা ইচ্ছে।”
“তোমার গিফটের টা।”
“উম্মম…ওকে। আর তো কিছু নেই নাকি।”
“পারফিউম বাকি আছে।”
শ্রাবণ হেসে উঠে।
“বেচারা বিপুর পারফিউমগুলো সব আপনি শেষ করে বসে থাকেন। আর কত অত্যাচার? এখন তো ঘরও আলাদা হয়েছে। বউ এলে সংসারও আলাদা। এবার তো অন্তত নিজের সামগ্রী নিজে গুছান!”
“আমি গুছাচ্ছি না যখন, তুমি গুছিয়ে দিয়ো।”
তৈরি হয়ে বেরিয়ে যায় ইফতেখার। বেশ কিছুক্ষণ পর আবারও কল করে শ্রাবণের কাছে। শ্রাবণ কাজে বিরতি নিয়ে কল রিসিভ করেই বলে,
“আবার কী?”
“ঠিকানা।”
“ওহ্! ভুলেই গিয়েছিলাম।”
“অথচ একটু আগে আমাকে অগুছালো বললে।”
“আপনি তো ইচ্ছাকৃত। আর আমি অনিচ্ছাকৃত। কোণাপাড়ায় আসুন আগে। তারপর বাড়ির রাস্তা বলছি।”
“আমি কোণাপাড়া বাজার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি।”
“এতো তাড়াতাড়ি! জ্যাম পড়েনি রাস্তায়? দাঁড়ান, আমি শিশিরকে বলে দিচ্ছি। সে ওদিকেই আছে।”
ঝটপট শিশিরকে কল করে দেয় শ্রাবণ। শাক নিয়ে আসার পর মামাবাড়ি গিয়েছিলো প্রয়োজনে। বাড়ি পথে রওনা হয়ে গিয়েছিলো ততক্ষণে। বোনের কল পেয়ে আবার বাজারের কাছে যায় ইফতেখারকে খুঁজতে। ততক্ষণে কিছু মিষ্টান্ন কিনে নিয়ে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলো ইফতেখার। দেখা পেতেই শিশির হাস্যোজ্জ্বল মুখে এতোটা আন্তরিকতার সাথে কথা বলছিলো যে, পরিচয়ের অস্বস্তি কেটে গেছে ইফতেখারের। পথের স্বল্পতায় মোটরসাইকেল টেনে হেঁটেই বাকিটুকু আসে শিশরের সাথে। অস্বস্তির শেষ প্রান্তে আসে সুলতানার মুখোমুখি হওয়ার পর। সুলতানাও বড্ড স্বাভাবিক আচরণ করে গেলেন। রান্নায় ভারি ব্যস্ত শ্রাবণ ও সুলতানা৷ তার আগমনের পরপরই এই গরমে এক গ্লাস ঠান্ডা লেবুর শরবত নিয়ে হাজির হয় শ্রাবণ। ইফতেখার গ্লাস নিতে নিতে বিড়বিড় করে বলে,
“যা লজ্জায় ফেললে আমায়!”
“শ্বশুরবাড়ি এলে জামাইদের লজ্জা রাখতেই হয়।”
মুচকি হেসে শ্রাবণ প্রত্যুত্তর করে পাশেই হেলমেট দেখে বলে,
“মোটরসাইকেলে এসেছেন?”
“হুম্ম। রেডি হও। চলো তবে এবার?”
“এই শুরু হয়ে গেছে আসতে না আসতেই। বাবাও এমন ছিলেন। এতো কাছে আমার মামা বাড়ি; অথচ গেলেই তাড়া দেখাতেন, চলো এবার!”
“তুমি না মামা বাড়িই থাকতে?”
“হুম, আমি তো নানুর সাথেই থাকতাম নানু বেঁচে থাকা পর্যন্ত। মাকে তাড়া দেখাতেন। আর যখন থাকতাম না, তখন সবাইকেই।”
“না বলে চলে এলে কেন তুমি?”
শ্রাবণ মৃদু হেসে জবাব দেয়,
“কোথায়? পরীর কাছে বলে এলাম না?”
“আমার কাছে বলেছো?”
“ঘুমাচ্ছিলেন, তাই ঘুম নষ্ট করিনি।”
“আমি তো ভেবেছি…”
“কী?”
“কিছু না।”
“রাগ করে এসেছি?”
নিজ মুখে স্বীকার করায় ইফতেখার তাকায় আবার তার দিকে। শ্রাবণ বলে,
“আমার কাপড়চোপড়ের ব্যাগ আছে একটা। আগেরবার ভুলে রেখে গিয়েছিলাম। এটা নিতেই এলাম। আপনাকে মায়ের সাথে পরিচয় করানোর জন্যও এলাম। কিন্তু ব্যাগটা নিবো কীভাবে? মোটরসাইকেলে এলেন যে?”
“দেখা যাবে। আমাকে দ্রুত যেতে হবে কিন্তু। কাজ ফেলে এসেছি।”
“শুনলাম তো একবার। বসুন আয়েসে। তাড়া দেখালেও খুব একটা লাভ হবে না।”
জামাই আপ্যায়ন সেরে রওনা হতে হতেই তাদের বিকেল। আসার পথে যতটাই অস্বস্তি, যাওয়ার পথে ততটাই স্বাভাবিক। তবে এ-ও লক্ষ্য করে ইফতেখার, বহুদিন পর শ্রাবণকে নিয়ে আবার মোটরসাইকেলে। আর যখনই তাকে নিয়ে মোটরসাইকেলে চড়ে, মনে পড়ে প্রথম দিনের কথা। শ্রাবণ না ছুঁয়ে ঝুঁকি নিয়ে চড়েছে তার সাথে। অথচ আজ দ্বিধাহীন ছুঁয়ে চড়ে যায় মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিতে। সম্পর্কের মায়াজালই বুঝি বিস্তর মায়া ছড়িয়েছে এই দীর্ঘ পথ জুড়ে?

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৬৮
(নূর নাফিসা)
.
.
বাড়ি ফিরেই তাড়া নিয়ে বেরিয়ে গেছে ইফতেখার। তার কাজ আছে। পুরো সন্ধ্যা বাইরে কাটিয়ে রাতে ফিরেছে বাড়িতে। শ্রাবণ এসময় ছাদে ছিলো পরী ও অর্পার সাথে। যোগ দিয়েছিলো বিপুও। আশপাশে কোথাও হয়তো বৃষ্টি হচ্ছে, তাই বাইরে ঠান্ডা বাতাস বইছে। দেহ ও মন জুড়ানো বাতাস। তারউপর তাদের হাসিঠাট্টার শব্দ নিচ থেকেই প্রাণে শিহরণ জাগিয়েছে ইফতেখারের মনে। মনে হলো, বাড়িতে আজ কতদিন পর হাসাহাসির তান বেজেছে। বাবা মায়ের ব্যাপারটা স্বাভাবিক হয়ে এলে হয়তো নিত্যদিনই এমন হাসাহাসির শব্দ ভেসে থাকতো এই সীমানাজুড়ে। দোষটা আসলে কোন দিকে ধাবিত করবে, তা আসলে ভেবে পায় না। ক্ষণে মনে হয়, সকল অশান্তির মূলে শ্রাবণ। ক্ষণে মনে হয় পিতা মাতা। তবে ঢাল যেদিকেই থাকুক, কেন তা দূর হয়ে যায় না? নিজের দিকে এই প্রশ্নটা ছুড়লেই কেবল বুক ভরা হতাশার নিশ্বাস ভেসে উঠে এই ভুবন বাতাসে।
হাসি ঠাট্টার আমেজটা নষ্ট করতে ইচ্ছে হয় না, তাই শ্রাবণকে ডাকে না ইফতেখার। বাবা মা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বকুল কাকার সাথে হিসাবনিকেশ নিয়ে কথা বলছেন উঠুনের এক কোণে দাঁড়িয়ে। সে তাই মাকেও ডাকে না খাবার দিতে। নিজ হাতেই প্লেট নিতে যায়। পারভীন হয়তো লক্ষ্য করেছিলেন বাইরে থেকে, তাই তিনিই এগিয়ে যান। তরকারির বাটি এগিয়ে দেন। সাথে বিড়বিড়ও করেন,
“সেই কখন থেকে ছাদে! খেয়াল আছে কোনো, বর আসছে যে বাড়িতে!”
ইফতেখার খেতে মনোযোগ দিয়ে বলে,
“থাক না, মা। এতো ছোট ছোট বিষয়েও খুঁত রাখলে হয়? আমি ইচ্ছে করেই ডাকিনি।”
গম্ভীরমুখে চুপ করে থাকেন পারভীন। ঘরের জানালাটা খুলে দেয় ঠান্ডা বাতাস প্রবাহের জন্য। আশপাশেই হাঁটাহাঁটি করেন ছেলের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত। শেষ হতেই প্লেট গুছিয়ে রাখেন। ওদিকে বকুল চলে গেলেও ঘরে যায়নি আফজাল হোসেন৷ উঠুনের এপ্রান্ত হতে ওপ্রান্ত হেঁটে ঠান্ডা হাওয়া গায়ে মেখে হিসাব মেলাচ্ছেন মনে মনে। ইফতেখারকে বের হতে দেখেই ডাকেন উঠুনের পশ্চিম প্রান্তে। এগিয়ে যায় ইফতেখার। জিজ্ঞেস করেন,
“কই গেছিলি? সকাল থেকে দেখলাম না যে? শ্রাবণও বাড়ি ছিলো না।”
“শ্রাবণদের বাড়িতেই গিয়েছিলাম৷ সন্ধ্যার আগে তাকে বাড়ি নামিয়ে দিয়ে আবার বাজারে গেলাম কাজে। কেন, কোনো দরকার ছিলো?”
“হুম। কথা বলতাম। সারাদিন ভাবলাম। ভেবে দেখলাম শ্রাবণই ঠিক। সাত্তারের বাড়িই দাওয়াত পাঠানো দরকার। বিপুর বিয়ের আয়োজনটা এদিকেই সেরে নেই। কী বলিস?”
ইফতেখার এই আবছা আঁধারেই তাকিয়ে থাকে পিতার মুখের দিকে। হঠাৎ বিপুর বিয়ের আয়োজন! ভাবনায় সাড়া দেয়, আব্বা এতো শ্রাবণের দিকে ঘুরে থাকেন কেন? শ্রাবণ অবাধ্য হয়ে কথা বললেও তার উপর রাগ হোন না কেন? তবুও প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে সে বলে,
“আপনার ইচ্ছা।”
“সাত্তারের কাছে যা তুই সময় করে। কথা বইলা দ্যাখ কী বলে।”
“কবে আয়োজন করবেন?”
“আগামী শুক্রবারের পরের শুক্রবার দ্যাখ।”
“কাকা যদি আয়োজন করতে না চান?”
“সেইটা তার ইচ্ছা। আমার আয়োজন আমার দিকে হইবো। সে ক্যামনে মেয়ে পাঠাইবো, তা জিজ্ঞেস করে জেনে আসবি। আয়োজন না করতে চাইলে বউ দুয়েকদিন আগেই ঘরে তুইলা একদিনে এই বাড়ির আয়োজন সারমু।”
“ঠিক আছে। আপনি যেভাবে ভালো মনে করেন।”
“কবে যাবি?”
“দেখি, কাল সময় পেলে কালই।”
“খালিদরে নিয়া যাইছ। একেবারে দাওয়াত কইরা আইছ পরের শুক্রবারের জন্য।”
“আচ্ছা। কিন্তু তার আগে আমারও কিছু কথা বলার আছে, আব্বা। শ্রাবণের ব্যাপারে।”
এরচেয়ে ভালো সময়ই যেন হলো না ইফতেখারের। এবার আফজাল হোসেন তাকিয়ে থাকেন ছেলের মুখের দিকে!
গল্পগুজব শেষ করে সব নেমে এসেছে ছাদ থেকে। ঠিক গল্প গুজব শেষ নয়, পরীর হাতে তাড়া খেয়ে বিপু পালিয়েছে। তাতেই তাদের আসর ভেঙেছে। পরী বড় গলায় হুমকি দিতে দিতে সিঁড়ির ধাপগুলো অতিক্রম করে। বিয়ে করেছে, চাকরি পেয়েছে; অথচ এখন পর্যন্ত তাদের পাঁচ টাকার বাদাম এনে খাওয়ায়নি। তাদের খাওয়াদাওয়া আটকে আছে বলেই নাকি কান্তার এবাড়ি আসাও আটকে আছে! এমন কথা শুনে বিপু কতক্ষণ মুখপুরী বলে ক্ষেপিয়ে গেলো। কবে নাকি অর্পা আর পরীকে ঈদের সালামি দিবে বলে কী কাজ করিয়েছে, সেই সালামির পাওনা এখনো পরিশোধ করেনি; তা নিয়েও দুইবোন ইচ্ছেমতো ঝেকে ধরলো। তাদের ঝগড়া দেখতে দেখতে হাসিতে লুটোপুটো শ্রাবণ। বিচারক হয়ে বসেছিলো। বিচার কী করবে, পক্ষ বিপক্ষের কাহিনী আর অতীতের খোটা খামচা শুনেই তাদের যত হাসাহাসি। সর্বশেষ বিপু পালিয়ে এলে হুমকির গলা ছাড়ে পরী। আগামীকালের মধ্যে যদি পাওনা পরিশোধ না করে এবং তাদেরকে চটপটি খাওয়াতে নিয়ে না যায়, তবে স্কুলের বাচ্চাকাচ্চা রাস্তা দিয়ে যতগুলো যেতে দেখবে; সবার কাছে বদনাম রটিয়ে দিবে। যেন স্কুলের সীমানা জুড়ে হাসি তামাশা চলে তার কাহিনী নিয়ে। কান্তাবানুর কানেও উল্টাপাল্টা ঢেলে গিরিঙ্গি লাগিয়ে দিয়ে আসবে। কান্তার কথা মুখে তুলে সারতে পারে না, সামনে দেখে পারভীনকে! সাথে সাথেই মুখে তালা দিয়ে অর্পার ঘরে ঢুকে যায় পরী এক দৌড়ে। শ্রাবণ মুখ টিপে হাসে তার কান্ড দেখে। আর যা-ই হোক, বাইরের পরিবেশ ও দুষ্টুদের দুষ্টুমি বড্ড ভালোই লেগেছে তার কাছে। খুশি মনে রুমে এসেই দেখতে পায় ইফতেখারকে। ঘুমানোর জন্য বিছানা ঠিক করছে নিজ হাতে। মুখটা কেমন গম্ভীর হয়ে আছে! শ্রাবণ জিজ্ঞেস করে,
“খাবেন না?”
“খেয়েছি।”
“সে কি! কখন এলেন?”
“অনেক্ক্ষণ আগে।”
এতোক্ষণ যাবত উপরে ছিলো, অনেক্ক্ষণ আগে এসেও দেখা পায়নি; সেজন্য তার উপরই রেগে আছে কি না সন্দেহ শ্রাবণের। নাকি বাইরেই কোনো ঝামেলা করে এসেছে কারো সাথে? নয়তো এমন কেন মুখটা? মশারি টানিয়ে দিতে দিতে শ্রাবন দুশ্চিন্তা নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কিছু কি হয়েছে?”
“কী হবে?”
“মন খারাপ মনে হচ্ছে। বাইরে কোনো ঝামেলা বাঁধেনি তো?”
“না।”
কাজে মনোযোগ রেখেই একের পর এক প্রত্যুত্তর করে গেলো ইফতেখার। শুয়ে পড়লো কপালের উপর হাত রেখে৷ শ্রাবণের সন্দেহ স্থির হলো নিজের এতোক্ষণ যাবত ঘরে না থাকার দিকেই। নয়তো বিকেলেও গেলো, মন তার ভালো ছিলো। বাইরে কিছু না হয়ে থাকলে তার কারণটা ছাড়া আর কী-ই বা হতে পারে কারণ? তাই বিড়বিড়িয়ে বললো,
“আবহাওয়াটা ভালো লাগছিলো, তাই উপরেই তো গিয়েছিলাম একটু। ডাকলেই হতো।”
কোনোরকম জবাব দিলো না ইফতেখার। ভেবেছিলো চাকরির কথাটা তুলবে। মন খারাপ থাকায় তা-ও আর বলতে সুযোগ পেলো না শ্রাবণ।
সকালে নাশতা সেরেই স্কুলের জন্য বেরিয়েছে বিপু। পথমধ্যে কান্তার সাথে দেখা করে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করে কান্তাদের বাড়ি আসে। বারান্দায় তখন মাদুরে বসে ছিলো সাত্তার। শুরুতে তড়িঘড়ি করে প্রবেশ করলেও তাকে নজরে পড়তেই পায়ের গতি কমিয়ে নিয়েছে বিপু। সাত্তারের সামনে পড়ার জড়তা তার আদৌও কমবে নাকি জানা নেই। যখনই বাড়ি আসে, মনে হয় উনার সাথে দেখা না হলেও বাঁচে। অস্বস্তিতে পড়তে হবে না। তবুও পড়েই যায়! বিপু হাঁটতে হাঁটতেই সালাম দেয়। বিড়বিড় শব্দে আজ সালামের জবাব কান পর্যন্ত পৌঁছেছে। বিপুর গলা শুনে ওদিকে ঘাড় বাঁকিয়ে উঁকি দিয়েছে শিরিন। বারান্দায় উঠে রান্নাঘরে তাকাতেই বিপুও দেখে তাকে৷ সালাম দিলে হাসিমুখেই জবাব দিয়েছে শিরিন। জিজ্ঞেস করে,
“ভালোই আছো?”
“জ্বি আলহামদুলিল্লাহ। আপনারা কেমন আছেন?”
“আছি ভালোই।”
“কান্তা কোথায়, কাকি?”
“ঘরেই৷ যাও।”
বিপু ঘরে প্রবেশ করেই কান্তার রুমে যায়। মায়ের রান্নার কাজে এতোক্ষণ যাবত সাহায্য করে এখন ঘরে এসে বিছানাপত্র গুছিয়ে নিচ্ছিলো। বিপুর গলা শুনেছে পিতাকে সালাম দেওয়ার সময়ই। ভেতরে আসবেই জেনে আর বের হয়নি তবুও। এখন দেখা পেতেই মুচকি হেসে সালাম দেয়। বিয়ের পর থেকে যখনই দেখা করতে আসে, তার মুখাবয়বে লজ্জারুণ উপস্থিতি দেখতে পায় বিপু। আজও ব্যতিক্রম নয়। সালামের জবাব দিয়েই বিপু বিড়বিড় করে বলে,
“দিনদিন চেহারা বদলে যাচ্ছে।”
“আপনার চোখ বদলাচ্ছে।”
বিড়বিড়িয়ে উত্তর দিয়ে কাঁথা সরিয়ে বসার জায়গা করে দেয় আগে। জবাবে মুচকি হেসে পকেট হতে টাকা নিয়ে গুনতে থাকে বিপু। পরক্ষণে কান্তার হাতটি তুলে নিয়ে মুঠো করা টাকা গুজে দিতে দিতে কথার প্রত্যুত্তরে বলে,
“প্রত্যাশা পূরণ হলে বদলাতেও পারে চোখদুটো।”
টাকা গুজে দিলেও হাতটা ছাড়তে দেয়নি কান্তা। বরং টাকা না সামলে বিপুর হাত মুঠোয় সামলে নেয় সাথে সাথেই। চেহারায় আশ্চর্যান্বিত ভাব রেখে জিজ্ঞেস করে,
“এসব কীজন্য!”
“আমার দায়িত্ব।”
“আপনার নিজের গোছগাছই তো শুরু হলো না এখনো। আমার টাকার দরকার নাই। নিজের প্রয়োজনগুলো মেটাতে থাকেন আগে।”
“আমার প্রয়োজনেই তো দিলাম। কলেজের ফি পরিশোধ করো। পড়া শুরু করো।”
“পড়বো না তো আর।”
“এক কথা বারবার শুনতেও ইচ্ছা করে না। যা বললাম, তা-ই করো। সময় চলে যায় কিন্তু।”
“পড়লেই কী আর না পড়লেই কী! চাকরি বাকরি কি আর করা হবে?”
“না হলেও পড়ো। কলেজটা অন্তত শেষ করো। আমি মোশাররফ স্যারের সাথে কথা বলছিলাম। পরীক্ষা না দেওয়ায় তেমন সমস্যা নাই। কলেজ যেতে বলছে। স্যারের সাথে দেখা করলেই হবে।”
মুঠোয় টাকা ধরিয়ে হাত ছাড়ে বিপু। মুখ মলিন করে রাখে কান্তা। বিপুকে বসতে বলে।
“বসেন।”
“না। স্কুলে যাচ্ছি। দেরি হয়ে যাবে।”
“নাশতা করে যান?”
“উহুম। করে আসছি।”
চালের গুঁড়োতে চাপটি পিঠার আয়োজন করেছিলো শিরিন আজ সকালের নাশতার জন্য। সাত্তার ভ্যান নিয়ে বের হবে। বসেছিলো নাশতার অপেক্ষায়। তার নাশতাটা শিরিন দিতে এলেই সে নিষেধ করে বলে,
“বিপুরে দে।”
“আপনে খান। চুলায় হইতাছে।”
“তারে দে আগে। যাইবো গা।”
কথাটা ঘরের বেড়া ভেদ করে কান্তা ও বিপুর কানেও যায়। কান্তা তাকায় বিপুর মুখে, বিপুও চোখ তুলে কান্তার চোখে তাকিয়ে সন্তুষ্ট চিত্তে বিদায় নেয়। দরজার কাছে যেতেই শিরিন ফিরে তাকায় তার উপস্থিতিতে। সে গিয়েছিলো কাঁচের প্লেটে পিঠাগুলো তুলে তার জন্য আনার জন্য। বিপুকে বের হয়ে যাচ্ছে দেখেই বলে,
“এই, বিপু। নাশতা কইরা যাও।”
“আমি মাত্র নাশতা করে এসেছি, কাকি।”
“করছো দেইখ্যা কী হইছে! আবার করো।”
“নাহ, এখন আর করবো না। স্কুলে যাবো।”
“আরে, দেরি করো একটু। খালি মুখে যাইয়ো না। চাপটি বানাইছি। দুইটা খাইয়া যাও। বেশিক্ষণ লাগবো না।”
বলতে বলতে ঝটপট প্লেটে তুলে এগোয় শিরিন। বিপু হাতঘড়িতে তাকিয়ে দেখে সময় হয়েই এসেছে। এদিকে পেটও ভরো ভরো। এতো করে বলছেই যখন, সে না বসে একটা চাপটি হাতে তুলেই প্যাচিয়ে নেয়।
“চাপটি যখন, নিলামই নাহয়। আসি তবে।”
“বইসা একটু ধীরেসুস্থে খাইয়া না যাইবা!”
“সময় নেই, কাকি।”
খেতে খেতে চলে যাওয়ার জন্যই বারান্দা ছেড়ে ব্যস্ত পায়ে নামে বিপু। দরজায় দাঁড়িয়ে তার কাণ্ডে মুচকি হাসে কান্তা। ওদিকে পাশের ঘর থেকে মজিদা বলে,
“দৌড়ায় দৌড়ায় শ্বশুর বাড়ি আইলে গেলে চলবোনি গো? হু?”
বিপু মুচকি হেসে সালাম দেয়। জিজ্ঞেস করে কেমন আছে? মজিদা সন্তুষ্ট মনে উত্তর করে তার।
“হো বাবা, ভালাই আছি।”
চাপটিতে কামড় দিয়ে উঠুন পুরোপুরি পেরোনোর আগেই থমকে যায় বিপু। খালিদ আর ইফতেখার প্রবেশ করছে বাড়িতে! সঙ্গে সঙ্গেই চাপটি নামিয়ে ফেলেছে সে মুখের কাছ থেকে। শ্বশুর বাড়িতে চুপিচুপি আসায় হঠাৎ ভাইদের সামনে পড়ে ইতস্তত হয়ে যায়। সাথে বিস্মিতও। দুই ভাই একসাথে এখানে! ব্যাপার কী? ওদিকে হাত নামিয়ে নিতে দেখেই খালিদের চোখ স্থির হয়েছে হাতের চাপটি পিঠায়। শ্বশুর বাড়ি এসে এভাবে চাপটি খাচ্ছে, তা দেখে কি না কি ভাবতে শুরু করেছে এই খালিদ ভাই; তা নিয়ে বিপু আরও বেশি বিব্রত! কপাল! স্বাদের জিনিস আর স্বাদ নিয়ে খাওয়া হলো না। তাদের এখনই আসতে হলো!

চলবে।

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৬৯
(নূর নাফিসা)
.
.
সকাল কিংবা রাত ব্যতীত কাকার সাথে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা কম বলেই জানে ইফতেখার। তাই সকালেই আসে কান্তাদের বাড়ি। বিপুর অনুপস্থিতিতে কথা বলে কান্তার বাবামায়ের সাথে। স্কুলের সময় হয়ে গেছে, তাই কারণ জানতে অপেক্ষা করেনি বিপু। প্রয়োজন না থাকায় ইফতেখারও তাকে ধরে রাখেনি অপেক্ষায়। খালিদকে নিয়েই কথা সেরে যায় শিরিনের হাতের চাপটি পিঠার স্বাদ উপভোগ করতে করতে। সাত্তার আয়োজন রাখবে কি রাখবে না, তা জানাতে দুটো দিন সময় নিয়েছে। সাধ্যে কূলালে আয়োজন করেই ঘরে পাঠাবে, এমন উক্তি প্রকাশ করেছে শিরিন। সাত্তার ভেবে দেখার জন্য সময় নেওয়া ব্যতীত কোনো পাকা কথা দিতে পারেনি। তবুও অগ্রিম দাওয়াত করে গেছে ইফতেখার। আগামী শুক্রবারের পরের শুক্রবারই তাদের বাড়িতে হচ্ছে আয়োজন। দাওয়াতের শুরুটা মূল পরিবার দিয়েই করলো। সাত্তার সিদ্ধান্ত জানানোর পর তারা উক্ত দিনের আগের আয়োজন নিয়ে ভাববে। সাত্তার যদি আয়োজন করতে চায়, তবে তা বুধ কিংবা বৃহস্পতিবার সম্পন্ন করে নিতে পারে। আর যদি আয়োজন না-ও করে, তারা দুয়েকদিন আগেই বউ নিয়ে চলে যাবে৷ এবং উল্লেখিত দিনে নিজেদের বাড়িতে আয়োজন রাখবে।
সাত্তারের মতামত পিতাকে জানাতে স্বয়ং উপস্থিত হয়নি ইফতেখার। গত রাতে পিতার বিপক্ষে রাগ জন্মানোর কারণে তার ইচ্ছে করছে না সম্মুখীন হতে। তবুও মেজাজ শান্ত রেখে সে কাঁধে নেওয়া দায়িত্ব পালন করে এলো। আফজাল হোসেনের কানে মতামত পৌঁছে দেওয়ার জন্য পাঠালো খালিদকে। ওদিকে বিপুর মনে হাসফাস লেগে থাকে সকাল থেকেই৷ স্কুলের ক্লাস চলাকালেও মাথায় প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছিলো, বড় ভাইয়েরা কীজন্য হঠাৎ একত্রে তার শ্বশুর বাড়ি গেলো? শুধুমাত্র খালিদ ভাই গেলে নাহয় একটা কারণ চোখের সামনে সুস্পষ্ট হতো যে, এখনো বুঝি তার উপর নজর রাখে। কিন্তু ইফতেখার যাওয়াতে মন সুনিশ্চিত বলে, কারণ কিছু একটা অবশ্যই আছে৷ তাই দুপুরে ফেরার পথে এক প্যাকেট বাদাম হাতে আবার যায় কান্তার সাথে দেখা করতে। জেনে আসে ভাইদের যাওয়ার কারণ। কান্তা লজ্জামাখা গলায় কারণ জানালেও বিপুর মাথায় বাজ! আব্বা নিয়েছে এই সিদ্ধান্ত! নাকি ভাই জোড়াজুড়ি করে বাধ্য করেছে? এমন যদি হয়, বাড়িতে তো কোনোরকম গুঞ্জনও শুনলো না। অথচ হঠাৎ আয়োজনের নিমন্ত্রণ এসে পৌঁছে কি না তার শ্বশুর বাড়ি! আনন্দে এবার ভাবি, অর্পা আর পরীর জন্যও বাড়িতে বাদাম কিনে নিয়ে যায় তাদের পাওনা পরিশোধ করতে।
এদিকে দুপুরে খাওয়ার পর যখন ঘরে একটু বিশ্রাম নিতে আসে ইফতেখার, তখন শ্রাবণকে জানায় আয়োজনের কথা।
“কান্তাকে ঘরে আনার আয়োজন করছে আব্বা। শুনেছো?”
শ্রাবণ তার দিকে ফিরে তাকাতেই ইফতেখার বলে,
“আগামী শুক্রবারের পরের শুক্রবার বৌভাত হবে।”
শ্রাবণ সুঁই সুতো নিয়ে বিছানার এক কোণে বসেছিলো ইফতেখারের শার্ট নিয়ে। সকালে ধুয়ে দিতে গিয়ে আজ সে নিজেই বোতাম খসিয়ে ফেলেছিলো। তৈরিকৃত কেনা শার্টগুলোর বোতাম যেন দুদিন পরপরই ছিঁড়ে যায়। তাই ধরেছে যখন, পুরো শার্টের বোতামগুলোই মজবুত সেলাই করার উদ্যোগ নিয়েছে। পুনরায় কাজে মনোযোগ দিয়ে ইফতেখারের কথায় সাড়াও দিয়েছে।
“বেশ ভালো। তা সিদ্ধান্তটা কি আব্বা একা নিয়েছেন, নাকি কান্তার বাবার সাথে কথা বলেই নিয়েছেন?”
“গত রাতে আমাকে সিদ্ধান্ত জানিয়ে, আজ আমাকে আর খালিদ ভাইকে পাঠালেন কাকার সাথে কথা বলে দাওয়াত করে আসতে।”
“আব্বা নিজে গেলে কী এমন ক্ষতিটা হয়ে যেতো?”
“সম্পর্কটা যেহেতু আগে থেকে স্বাভাবিক না, প্রত্যক্ষ কথাবার্তাও সহজ হবে না কারো জন্য। আয়োজনের দায়িত্বটা আমার উপরই দিয়েছেন। খুশি হওনি যেন, আমি যাওয়াতে?”
শ্রাবণ আড়চোখে একবার তাকিয়ে আবার কাজে মনোযোগ দেয় মুখে মৃদু হাসির রেশ স্পষ্ট রেখে। প্রত্যুত্তরে বলে,
“আমি কান্তা আর তোতাপাখির খুশি দেখে খুশি হবো এই ব্যাপারে। আয়োজন উৎসটা তাদের। তারা খুশি হলেই আয়োজন সার্থকতা পাবে।”
কথায় মৃদু হাসি টানে ইফতেখারও। তাকিয়ে থাকে শ্রাবণের মুখে। মন ভালো আছে ভেবে শ্রাবণ তার কথাটাও তুলতে চায়।
“আমার কিছু কথা বলার ছিলো আপনার সাথে।”
“কী?”
“আমি বছর খানেক আগে স্বাস্থ্যসেবা সংস্থায় আবেদন করেছিলাম চাকরির জন্য। গত পরশু মেসেজ পেলাম। জয়েনের জন্য ডাকবে শীঘ্রই। আমার তো যাওয়ার ইচ্ছে। আপনি কী বলেন?”
“বছর খানেক আগে যখন আবেদন করেছিলে, তখন দরকার ছিলো হয়তো। কিন্তু এখন কী দরকার তোমার চাকরির?”
“দরকার আছে বিধায়ই তো একটা চাকরিতে নিযুক্ত হতে চাইছি। কিন্তু আপনি উৎসাহই দিচ্ছেন না কোনোরকম!”
“দরকারগুলো তুমি আমাকে বললেই কি পারো না? শুধু শুধু চাকরি করার তো কোনো বিশেষ কারণ দেখি না।”
শ্রাবণ সেলাইয়ে বিরতি নিয়ে তার দিকে ঘুরে বসে।
“শুধু শুধু না। সব দরকারের কথা আপনাকে বলাও যাবে না। স্ত্রী হিসেবে আমার উল্লেখযোগ্য প্রয়োজন না থাকলেও মেয়ে হিসেবে আমার একটা দায়িত্ব আছে। আমার বাবা নেই। মা অসুস্থ। মায়ের দায়িত্ব কাঁধে তোলার মতো একটা ভাইও নেই। একমাত্র যে বোনটা এখন মায়ের সাথে আছে, তাকেও হয়তো আমার মতো একটা সংসারে উঠে যেতে হবে। মা একা পড়ে থাকবেন। একাকীত্ব আরও বড় অসুস্থতার জন্ম দেয় দেহমনে। আমরা দুই বোন যদি চাকরি না করি, মায়ের বাকিটা জীবন কাটবে কী করে? উনার কথা কী আমাদের বিশেষভাবে চিন্তা করা প্রয়োজন না? আর কত টানবেন তিনি নিজেকে?”
“চাকরি না করলেই যে উনার পাশে দাঁড়াতে পারবে না, এমনটা ভাবারই কী কারণ? পরিজনদের পাশে দাঁড়াতে চাকরিই শুধু মুখ্য ভূমিকা রাখে?”
ইফতেখার কী বলতে চায়, তা শ্রাবণ অনেকটাই উপলব্ধি করতে পারে। আর তাই একটু কড়া জবাবেই তার বিপরীতে লড়ে।
“আমি জানি না আপনি আর কোন উপায় দেখাতে চাইছেন। কিন্তু আমি এমন কোনো উপায়কে বরণ করবো না, যেখানে কোনোভাবে নিজেকে কিংবা আমার মাকে দায়ে পড়তে হয়। নিজেকে কোনো কাজে নিযুক্ত করতে পারলে শুধুমাত্র সেই পারিশ্রমিক দিয়েই আমি আমার মায়ের ভরণপোষণ করবো। আর তাই আমার জন্য কাজটা গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি উৎস হতে আসা সুযোগটাও হারাতে চাইছি না।”
ইফতেখার ভারি নিশ্বাস ফেলে উঠে যায় বিছানার বিশ্রাম ছেড়ে। বেরিয়ে যাবে কাজের জন্য তাই টিশার্ট নিচ্ছে দেহে জড়াতে। শ্রাবণ মতামত না পেয়ে তার দিকে ঘুরে বলে,
“আমি জানি আপনার পছন্দ না যে, আমি বাইরে গিয়ে কাজ করি। কিন্তু একটা দিক দেখলে তো শুধু হবে না। আপনি আমার দিকটাও একটু ভেবে দেখুন। আপনার মতামতটাও আমার জন্য জরুরী। শরিয়ত হোক, সামাজিক হোক। বিবাহোত্তর নারীর জীবনে প্রধান মানবকর্তা তার স্বামী। সুতরাং, আপনার কাছে আমার একটা দরখাস্ত থাকবে আমাকে চাকরি করতে নিষেধ না করার জন্য। বাবার অনুপস্থিতিতে ঘরে বাইরে মা নিজ জীবনের সাথে সংগ্রাম করে আমাদের দুই বোনকে লালন পালন করেছেন। এখন আমাদের দুই বোনের পালা মাকে লালন পালন করার। দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়ে মাকে একা ফেলে দেওয়া আমাদের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব না। আমি আশা রাখি, আপনি আমায় সাপোর্ট করবেন। সংসারের বাইরেও যদি আমি নিজের জন্য কিছু করতে পারি, এতে আপনার আপত্তি থাকার কথা নয়।”
ইফতেখার চুপ থেকেই টিশার্ট পরে ফোন আর ওয়ালেট তুলে নেয় হাতে। বেরিয়ে যেতে ধরলেই শ্রাবণ আবার বলে,
“কিছু বললেন না যে?”
ইফতেখার পিছু ঘুরে বলে,
“জেনেও যখন বলেছো, আমার আর কী-ই বা বলার থাকে?”
শ্রাবণের মুখখানায় হতাশার ছাপ স্পষ্ট হয় সাথে সাথেই। ইফতেখার তা দেখে একটু থেমেই আবার বলে,
“ভেবে দেখি।”
দরজা ঠেলে চলে গেছে সে। কিন্তু শেষ বাক্য কোনোরকম আশা জাগাতে পারেনি শ্রাবণের মনে। সে যে অনিচ্ছুকতা থেকে পিছ পা হলো না, তাতেই বড় আশাহত হয় শ্রাবণ। মুখাবয়বে মলিনতা পুষে মনোযোগ দেয় কাজে। এই চাকরিটাও বুঝি হাতছানি দিয়ে হাতছাড়া করে গেলো!
সন্ধ্যা হলেই ছাদ থেকে কাপড়চোপড় আনতে যায় শ্রাবণ। বিপুকে দেখতে পায় নেমে আসার সময়। হাতমুখ ভেজা অবস্থায় নিজের গামছার সন্ধানে এসেছে। শ্রাবণের হাতে কাপড়চোপড় দেখে জিজ্ঞেস করে,
“ভাবি, গামছাটা এখানে ছিলো না?”
শ্রাবণ তার গামছা খুঁজে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“সুখবর পেলাম তো। অথচ কোনোরকম মিষ্টান্ন পাইনি!”
বিপু আন্দাজ করতে দেরি করেনি৷ তাই সাথে সাথেই বলে উঠে,
“বাদাম এনে দিলাম। খাননি আপনি? দেয়নি পরী?”
“বাদাম দিয়ে ঋণ পরিশোধ করতে চাইলেন? সুখবরের ঋণ বলেন আর অর্পা ও পরীর পাওনার ঋণ বলেন, কোনোটাই পরিশোধ হয়নি এতে৷ বুঝে নিয়েন।”
“সবর করেন৷ মাস শেষ হতে দিন, বেতন পেয়ে নেই আগে।”
“ও, আচ্ছা৷ বেতনের উপর নিয়ত বেঁধে রেখেছেন তবে?”
“কী আর করার!”
“ঠিক আছে। আমরা নাহয় সবরেই রইলাম। কিন্তু আপনি টিউশনি ধরছেন না কেন? শিক্ষকদের টিউশনি ধরতে না পারলে হয়?”
“স্কুলে যাই, এতেই বুঝি আব্বার সম্মানে লাগে। আবার টিউশনি!”
“শিক্ষকতা মোটেও কোনোরকম অসম্মানের নয়। বরং অন্যান্য পেশার চেয়ে অধিক সম্মানের একটা পদ। চেয়ারম্যানের ছেলে হলেই যে কোনো কাজে গেলে সম্মান কমে আসবে, এসবই আপনাদের ভুল ধারণা। দুদিন পর এই আয় তো নিজের কাছেই ভালো লাগবে না। প্যারা মনে হবে, চাকরির প্রতি অনিহা জন্মাবে। ঘরে বউ আসছে তো শীঘ্রই, সংসার বায়নাও কিন্তু বাড়তে থাকবে দিনের পর দিন। আর তাই এসব ভুল ধারণায় চেপে না থেকে সুযোগকে সময় দিয়ে ফেলুন। কয়েকটা টিউশনি ধরুন।”
“দেখি।”
মাগরিবের নামাজ আদায় করে রান্নাঘরের দিকে যায় শ্রাবণ। ওই ঘরের বারান্দায় বসে চায়ের জন্য পরীকে ডাকছিলেন আফজাল হোসেন। কিন্তু পরী এই ঘর থেকে চেঁচিয়ে পাঁচ মিনিট সময় চাইলো। তাই শ্রাবণ বলে গেলো, সে-ই যাচ্ছে। পারভীন বিকেলেই চা করে রেখেছিলেন৷ এখন নামাজরত আছেন হয়ত, তাই সাড়া নেই। শ্রাবণ এসে গরম করে চায়ের কাপ তুলে দেয় আফজাল হোসেনের হাতে। চুপচাপ চলেই আসছিলো, আফজাল হোসেন আবার দাঁড় করালেন কথা বলার জন্য।
“শুনো, সাত্তারের বাড়ি খবর দিছিলাম৷ আগামী শুক্রবারের পরের শুক্রবার বৌভাতের আয়োজন রাখার ব্যবস্থা করতাছি।”
“হ্যাঁ, তা শুনেছি আপনার ছেলের কাছে।”
“হু, ইফতেখাররে দিয়াই দাওয়াত পাঠাইছিলাম। সামনে হাসপাতালের কাজ ধরমু তো, সময় হইবো না আবার। তাই ভাবলাম, ঘরের আয়োজনটা সাইরাই নেই আগে।”
“ভালো করেছেন।”
“শুনছোই যখন, ক্যামনে বউ আনবা আর কী কী আয়োজন রাখবা তা বুঝ পরামর্শ কইরো ইফতেখারের সঙ্গে; তোমার আম্মার সঙ্গে?”
“দেখা যাবে।”
“হু। যেমনে ভালা মনে হয়, তোমাদের আনন্দ পূর্ণ হয়; তেমনেই কইরো। অর্পার পরীক্ষা নাই তো এরমধ্যে?”
“নেই হয়তো। তবুও জিজ্ঞেস করে নেওয়া যাবে। আরও কিছু বলবেন?”
“আরেকটা কথা বলার আছে।”
একটু থেমে আফজাল হোসেন বলেন,
“তোমাদের জমিটুকু অতি শীঘ্রই তোমাদের নামে দাখিল করে দিমু। বিয়ের আয়োজনটা শেষ হোক, বন্টন ব্যবস্থা হাতে তুলমু।”
ততক্ষণে পারভীনও এই ঘরের বারান্দা ছুঁয়েছে। তাদের কথায় কথা রাখেনি, দাঁড়িয়ে শুনতে থামেওনি৷ যদিও সজাগ ছিলো চোখ কান। ধীর পায়ে এগিয়ে গেছে রান্নাঘরের দরজার কাছে। এদিকে তার দিকে পরোয়া না করে শ্রাবণ ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে তাচ্ছিল্যের নিশ্বাস ফেলে আফজাল হোসেনের প্রতুত্তরে বলে,
“জমি? কোন জমি? আমার বাবার কাছ থেকে যেইটুকু আত্মসাৎ করেছেন, সেইটুকু?”
“ভুল বুঝতাছো। আত্মসাতের কিছু না। বাজান একটা ঝামেলায় পইড়া সময় মতো দিতে পারে নাই।”
“সে যা-ই হোক। সময় যখন হয়নি, আর কখনো সেই সময় না হোক। ওইটুকু নাহয় আমরা আপনাকে দানই করে দিলাম। আমি যেদিন প্রথম এখানে আসি, সেদিনও জমির জন্য আসিনি৷ আজও না। সেদিনের উদ্দেশ্য দুজন মানুষের কথা রাখার জন্য ছিলো। আজকের উদ্দেশ্য আমার সংসার। স্ত্রীর অধিকারে আমি স্বামীর বাড়িতে আছি। বাবার জমির তালাসে না৷”
“তো কী বলতে চাও তুমি? নিবা না?”
“প্রশ্নই আসে না।”
আফজাল হোসেন হয়তো আরও কিছু বলতে চাইছিলেন, শ্রাবণ তাকে তা বলার সুযোগই দিলো না। ইফতেখার চলে এসেছে এসময়। এদিকে তাকিয়েই প্রবেশ করেছে বাড়ির গেটে। শ্রাবণও দেখেছে তাকে লাইটের আলোতে। তাই কথা বাড়তে না দিয়ে বেরিয়ে গেছে ইচ্ছে করেই। ইফতেখার ঘরে যেতে থাকে শ্রাবণের কিঞ্চিৎ আগে আগেই। শ্রাবণ পিছু চলতে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“চা খাবেন? গরম করা আছে।”
“এক কাপ হলে তো ভালোই হয়।”
শ্রাবণ আবার পিছু চলে আসে। ইফতেখারের জন্য চা নিয়ে হাজির হয় রুমে। ইফতেখার চায়ের কাপ হাতে নিয়েই রুমের বারান্দার দিকে এগোয়। এক চুমুক দিয়ে বলে,
“চায়ের আড্ডা দিতে এখানে তো টেবিল বসানো হলো না এখনো। শীঘ্রই বসাতে হবে। কী বলো?”
“ধীরে ধীরে সবই হবে। মাত্র তো জীবন গুছাতে শুরু করলেন।”
“হুম, ঘর গোছানোর জন্য আলাদা একটা সঞ্চয় রাখতে হবে। গোছগাছের আইডিয়া তুমি মাথায় নিয়েছো যখন, তোমার পছন্দেই আসবাব আনতে যাবো এই রুমের জন্য। যাবে নাকি, যখন সময় হবে?”
“তখনকারটা তখন দেখা যাবে। প্রস্তুতি নিতে থাকুন আগে। টোস্ট দিবো সাথে?”
“না। এমনি ভালো লাগছে। আব্বার সাথে কী কথা হচ্ছিলো তোমার?”
শ্রাবণ একটু ভাবনামত্ত হয়ে বলে,
“কোথায় কী কথা হচ্ছিলো?”
“এতোক্ষণ যাবত, ওঘরে দাঁড়িয়ে?”
“ওইতো, বিপু ভাইয়ের বিয়ের আয়োজন নিয়েই বলছিলেন। আপনার সাথে, আম্মার সাথে পরামর্শ করে যেন আয়োজন গুছিয়ে নেই নিজেদের মতো। অর্পার পরীক্ষার কথাও জিজ্ঞেস করছিলেন।”
“আর কিছু না?”
“আবার কী?”
“তোমার বাবার ব্যাপারে কিছু বলছিলেন যেন?”
শ্রাবণ দৃষ্টি সরিয়ে এনে বলে,
“না, কিছু না।”
“এই বাড়িটা তোমাদের, তাই না?”

চলবে।