#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[১৩]
প্রিয়ার আজ দুদিন হলো সর্দি, জ্বর। প্রথমদিন কাজে যেতে পারলেও পরের দিন ফোন করে নিজের অপারগতা জানাল। ভেবেছিল একটা দিন বিশ্রাম নিলেই সুস্থ হয়ে উঠবে। কিন্তু হলো উল্টো। সর্দি-জ্বরের সঙ্গে এবার যুক্ত হলো কাশি। কিন্তু আজ আর বাড়িতে বসে থাকা যাবে না। সে সকাল সকাল উঠে আগে রান্না সেড়ে নিল। মায়ের অসুস্থতা তাকে অল্পবয়সেই অনেকটা সাবলম্বী হতে শিখিয়েছে। তবে রান্না মোটামুটি জানলেও মাটির চুলায় হাত পুড়িয়ে রান্নার অভ্যাস প্রিয়ার ছিল না। গত তিনটে মাসে এমন অনেক অনভ্যস্ত কাজ সে করতে শিখেছে৷ রুটিন করে খাবার খেয়ে অভ্যস্ত দেহের এখন খাওয়ার কথা মনে থাকে না। নিজের বাথরুমে বাইরের মানুষ এলাও না করা মেয়েটা এখন লাইন ধরে গোসল, পানি তোলা সব করে। এদিকে মা হাঁটা-চলা করতে পারেন না। ঘরের কাজ মাকে যেন করতে না হয় সেই চেষ্টাই করে যায় প্রিয়া ও তার দশ বছর বয়সী বোন দিয়া। ঘিঞ্জি, খোপের মতো টিনের ঘরে এখন তাদের বসবাস। একটা চৌকি ঠাঁই দেওয়ার পর যতসামান্য স্থানই অবশিষ্ট আছে হাঁটাচলার জন্য। সেই স্থানেই খাওয়া ও সমস্ত দরকারি জিনিসপত্রের ঠাঁই হয়েছে। আসবাব বলতে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ব্যতীত কিছুই নেই অবশ্য। কাপড় ঝুলিয়ে রাখা টিনের দেয়ালে বাধা রশিতে। হাড়ি-পাতিল কাঠের শক্ত তক্তায় তুলে রাখা। ইঁদুর, তেলাপোকা, ছারপোকা তাদের নিত্য সঙ্গী। বস্তির পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে তিন মা-মেয়ে প্রাণান্ত চেষ্টায় মত্ত।
মুনিরা বেগম মেয়েকে পরিপাটি হতে দেখে বললেন,
“সকাল থেকেই খুকখুক করে কাশছিস। আজ যাওয়ার দরকার নেই। ফোন করে বলে দে।”
প্রিয়া চুলে বিনুনি গাঁথতে গাঁথতে বলল,
“প্রথম মাসেই যদি এত কামাই করি তবে ওরা আমায় রাখবে?”
“না রাখলে না রাখবে।”
“তখন খাবে কী?”
“মেয়ে অসুখ নিয়ে কাজ করবে আর আমি বসে বসে গিলব? তারচেয়ে না খেয়ে ম’রব।”
প্রিয়া করুণ চোখে তাকায়। মা আবার কাঁদতে বসেছে। সে ভেবে পায় না একটা মানুষ কী করে এত কাঁদতে পারে। প্রিয়া মুখে ওড়না চেপে কেশে বলল,
“তোমার মেয়ে না খেতে পেয়ে ম’রছে তুমি সহ্য করতে পারবে। কিন্তু আমার মা-বোন না খেতে পেয়ে ম’রছে আমি মানতে পারব না। তাই আমাকে যেতেই হবে।”
প্রিয়া তার বাটন ফোনটা ব্যাগে ভরে বেরিয়ে যাচ্ছিল। মুনিরা বেগমের কান্না ততক্ষণে আবার থেমে গেছে। পিছু ডেকে বললেন,
“একবার থা’না’য় যাবি? তোর বাবার কোনো খোঁজ আনতে পারিস কি-না…”
প্রিয়া কোনো প্রত্যুত্তর না করে পায়ে জুতো গলিয়ে বেরিয়ে গেল। গলির মোড়ে যথারীতি রঞ্জুকে দেখা যায়। আজ রঞ্জুর বেশভূষা চমকপ্রদ। চোখে লাগার মতো রঙিন শার্ট পরে, বুকের দুটি বোতাম খুলে রেখেছে। পরনের প্যান্ট হাঁটু থেকে ওপরের দিকে প্রায় ছয় ইঞ্চি ছেঁড়া। চোখে রোদচশমা লাগানো, যদিও আজ রোদের দেখা নেই। প্রিয়া পাশ কেটে চলে যাচ্ছিল। রঞ্জু ওকে দেখতে পেয়ে ডাকল,
“এই প্রিয়া!”
প্রিয়া বিরক্তি আড়াল করে দাঁড়ায়। বলে,
“কিছু বলবেন, রঞ্জু ভাই?”
রঞ্জু ছুটে এসে প্রিয়ার সামনে দাঁড়িয়েছে। ঠোঁটে অনাবিল হাসি। বলল,
“মুখ ফিরাইয়ো না। আজকে কোনো গন্ধ পাইবা না। ক্লোজআপ দিয়া দাঁত মাজছি।”
“এটা বলতে ডেকেছেন?”
“আরে না। সব সময় মুখটারে ওইরকম চৈত্র মাসের দুপুরের মতো খরখরে কইরা রাখো ক্যান? হাসতে পারো না?”
“শুধু শুধু হাসব কেন?”
“তোমার টিকটিক আইডি আছে? টিকটক দেখলে মন ভালো থাকে। বেশি বেশি টিকটক দেখবা। আর আমার আইডিতে একটা ফলো দিয়ো।”
প্রিয়া এতক্ষণে বুঝল রঞ্জু ভাই এই বেশভূষায় এখানে টিকটক ভিডিও বানাচ্ছিল। বলল,
“আমার টিকটক আইডি নেই, রঞ্জু ভাই। স্মার্ট ফোনও নেই। আপনাকে ফলো দিতে পারলাম না।”
“তাতে কী? চাইলে আমার ফোনে দেখতে পারবা।”
প্রিয়া সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
“আপনি দিয়াকে আপনার ফোনে টিকটক দেখতে দেন, তাই না?”
রঞ্জু হেসে বলল,
“হ, তোমার বইন তো টিকটক পছন্দ করে। ভালো নাচও পারে। কইছি ওরে একটা আইডি খুইলা দিমু যেন সবাইরে নিজের প্রতিভা দেখাইতে পারে।”
প্রিয়া এতক্ষণে নিশ্চিত হলো দিয়া কেন একটা স্মার্ট ফোনের জন্য আফসোস করে। তার ইচ্ছে হল এই মুহূর্তে রঞ্জুকে কিছু কড়া কথা শোনায়৷ ইচ্ছেটাকে বুকের ভেতর পিষে ফেলল প্রিয়া। একটু নরম স্বরে বলল,
“আপনি আমাদের সিনিয়র, রঞ্জু ভাই। পাড়ার একজন অবিভাবক আপনি। আপনার উচিত পাড়ার উন্নয়ন, অবক্ষয়ের দিকে খেয়াল রাখা। মানুষের উপকার করাই তো আপনার স্বভাব। অথচ আপনিই যদি বাচ্চা ছেলেমেয়েদের টিকটক করতে, টিকটক দেখতে উৎসাহিত করেন তবে ওরা কী শিখবে? সবাই টিকটক নিয়ে হাসিমজায় ডুবে থাকলে উপকার কে করবে? আপনার জৌলুশ তো হারিয়েই যাবে।”
রঞ্জুকে বিভ্রান্তিতে ফেলে প্রিয়া চলে গেল।
_____________
জাইমকে একটা গোটা দিন সামলাতে অন্তরার মায়ের বেশ ধকল গেছে। তিনি এখন কিছুটা সুস্থ। কিন্তু আলসে স্বভাবের জন্য শুধু আরাম খোঁজেন। মুখ অবশ্য আরাম খোঁজে না। উনার খবরদারিতে এ বাড়িতে কাজ করতে এসে কেউ বেশিদিন টিকতে পারে না৷ সে ক্ষেত্রে প্রিয়া আলাদা। দরকারের বাইরে তেমন কথা বলেও না, গায়েও মাখে না। হুট করে গতকাল না আসায় ভাবলেন এও চলে গেল কিনা! মনে মনে আফসোস করলেন বেশ। মেয়েটা ভালো ছিল। এমন শিক্ষিত, নম্র মেয়ে হাতছাড়া হওয়া ঠিক না। যার তার হাতে তো আর একমাত্র নাতিকে ছেড়ে দেওয়া যায় না। এই সময় বাচ্চারা থাকে কাদামাটির ন্যায়। যার সঙ্গে থাকবে তারই বৈশিষ্ট্য সংগ্রহ করবে।
প্রিয়াকে নিয়ে আফসোস করার সময়ই তাকে ঢুকতে দেখা গেল বাড়িতে। সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে বললেন,
“তুমি তাহলে পালাওনি?”
প্রিয়া খুকখুক করে কাশতে কাশতে দরজা আটকে দিল। বৃদ্ধার কথার মানে বুঝতে না পেরে বলল,
“পালাব কেন?”
এতক্ষণ বৃথা আফসোস করেছেন বলে বৃদ্ধা স্বাভাবিক হয়ে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে। বললেন,
“কাশছ কেন? য’ক্ষা টক্ষা বাধিয়েছ নাকি?”
“ভাইরাল ফিভারের প্রভাব আন্টি।”
“সবই কাজে ফাঁকি দেওয়ার ধা’ন্দা। এইসব টেকনিক আমার খুব ভালো করে জানা।”
অনুভব বাড়িতেই ছিল। ভাবীর মায়ের কথা শুনতে পেয়ে সে রুম থেকে গলা বাড়িয়ে মশকরার সুরে বলল,
“জানবেনই তো আন্টি। আপনি আবার এইসব টেকনিকে পিএইচডি-ধারী কিনা।”
বৃদ্ধা কটমট করে তাকালেন। মেয়ের সংসারে বেকার দেবরের উপদ্রব উনার মোটেও পছন্দ না। অন্তরাকে বলেছেন বেশ কয়েকবার। কিন্তু দুই ভাইয়ের বন্ধন দৃঢ়। জাভেদ তার পরিবারহীন একমাত্র ছোটো ভাইয়ের সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছে। সেখানে টাকার চিন্তার চেয়েও ভাইয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়ে তোলাটা মূখ্য।
অনুভব রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। প্রিয়ার মুখটা জ্বরের প্রভাবে শুকিয়ে আছে। সে বলল,
“তোমার জ্বর কী সাড়েনি, হাসু?”
প্রিয়া শুধু আস্তে করে না বোধক মাথা নাড়ল। অনুভব আবার বলল,
“মে’ডি’সিন নিয়েছিলে?”
“নিয়েছি। জ্বর কিছুটা কমেছে কিন্তু ঠান্ডা আর কাশির প্রকোপটা বেড়েছে।”
রোগা পাতলা একটি মেয়ে অসুখ নিয়েও কাজে চলে এসেছে দেখে অনুভবের না চাইতেও একটু মায়া হলো। বলল,
“আজ ছুটি নিতে। আন্টি তো এখন অনেকটাই সুস্থ। জাইমকে রাখতে পারত।”
কথাটা পছন্দ হলো না বৃদ্ধার। তেলেবেগুনে জ্ব’লে উঠে বললেন,
“নিজে কিছু করোনা বলে অন্যকেও বলবে? মাস গেলে বেতনটা তো তুমি দাও না।”
“আপনি দেন বেতন?” প্রশ্নটা করতে গিয়েও নিজেকে সংযত করল সে।
প্রিয়া জাইমকে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে বলল,
“আমার অসুবিধা হবে না আন্টি।”
অনুভব আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেছিল। সেই সুযোগে বৃদ্ধা প্রিয়াকে কাছে ডেকে সতর্ক করে বললেন,
“বাড়ির পুরুষ মানুষদের থেকে দূরে থাকবে। অত কথা বলার দরকার নেই।”
কথাটায় প্রিয়া বিব্রত হলেও বিশেষ কথা বলল না। দুপুর নাগাদ জাভেদ এলো বাড়িতে। জাইম বাবাকে পেয়ে ভূবন ভোলানো হাসি দিয়ে কোলে গেল। জাভেদ পেশায় একজন ডাক্তার। প্রিয়ার কাশি ও নাক টানা শুনে বলল,
“ডাক্তারের বাড়িতে অসুস্থ রোগী! এ তো মানা যায় না। কোনো ডাক্তার দেখিয়েছ?”
“দেখাইনি।”
অতঃপর জাভেদ প্রিয়ার অসুখ বুঝতে বসার ঘরকে চেম্বারে রূপান্তর করলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
“জ্বর, সর্দি কতদিন?”
“আজ নিয়ে তিনদিন।”
“কাশি?”
“সকাল থেকে শুরু হয়েছে।”
“শুকনো নাকি কফওয়ালা?”
“কফ আসে।”
“সর্দি কাঁচা নাকি পাকা?”
প্রিয়া সামনে তাকাল। ডাইনিং টেবিলে বসে অনুভব কলা খাচ্ছিল। প্রিয়া হুট করে বলে ফেলল,
“একদম পাকা কলার মতো রঙ।”
অনুভব বি’স্ফো’রিত দৃষ্টিতে তাকাল। সদ্য কামড় দেওয়া কলাটা হাত ছুটে পড়ে গেল। প্রিয়া একটু ভ্যাবাচেকা খেল অবশ্য৷ কাঁচা-পাকা বলতে গিয়ে তার মুখ দিয়ে এমন উদ্ভট শব্দ বের হবে নিজেও বুঝে উঠতে পারেনি। অনুভব দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“হাসুরে, জন্মের মতো আমার কলা খাওয়ার সাধ মিটিয়ে দিলি!”
চলবে…
এডিট ছাড়া।
#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[১৪]
জাভেদ সাধারণত দুপুরের পর বাড়ি থাকে না। হসপিটালের ডিউটি ও চেম্বার মিলিয়ে সপ্তাহের সাতটা দিনই তাকে ছোটাছুটির ওপর থাকতে হয়। আজ হসপিটালের কাজে গাজিপুর যাওয়ার কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে ক্যান্সেল হওয়ায় ফুরসত পেয়ে বাড়ি ফিরল। ধরাবাঁধা ব্যস্ত জীবনে অনেকদিন পর একটা অনাকাঙ্ক্ষিত অবসর মিলল যেন। সবটুকু সময় জাভেদ একমাত্র চোখের মনি জাইমের পেছনে খরচ করতে চাইল। বিনিময়ে খরিদ করতে চাইল অম্লান ভালোবাসার শুদ্ধতম আনন্দ। তাই প্রিয়ার অসুস্থতা দেখে বলল,
“তুমি আজ বাড়ি চলে যাও। নিয়ম করে মে’ডি’সিন নেবে।”
প্রিয়া খুশি হলো। সত্যিই তার আজ সময় দরকার ছিল। সে তড়িঘড়ি করে বের হতে নিয়ে দরজার সামনে থমকে গেল। চক্ষুদ্বয়ে আচমকা নেমে এলো অন্ধকার। দেহের শক্তি কর্পূরের ন্যায় উবে গেল। প্রিয়া দরজার হাতল ধরে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে নিজেকে পড়ে যাওয়া থেকে সামলায়।
“এই হাসু, তুমি ঠিক আছ?”
অনুভবের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বরে প্রিয়া নিভু নিভু চোখে চাইল। ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জিভ দ্বারা শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“ঠিক আছি, স্যার।
”
“তা তো দেখতেই পাচ্ছি। ভেতরে এসে বসো।”
“আমাকে যেতে হবে।”
“তোমারও কি বাড়িতে বাচ্চা আছে?”
প্রশ্নটা শুনে প্রিয়া অবাক চোখে তাকাল। বুঝতে না পেরে বলল,
“বাচ্চা থাকবে কেন?”
“তাহলে তাড়া কীসের? যাও বসো।”
ধমকটা এমনই আদেশ পরায়ণ ছিল যে প্রিয়া এড়াতে পারল না। সে চুপসানো মুখে গিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিল। অনুভব পাশের সোফায় বসে জহুরীর চোখে পরখ করতে লাগল ওকে। শ্বেত চন্দনের মতো মুখখানায় বিন্দু বিন্দু ঘামের রেশ। নাকের ওপর দৃশ্যমান কুচকুচে কালো তিলটা যেন অবগাহন করছে সেই জলবিন্দুতে। মুখশ্রীর কোমলতায় কেমন অযত্নের ছাপ। অনুভবের কেন জানি মনে হলো মেয়েটা মানসিক চাপের মাঝে থাকে সব সময়। চোখে রাজ্যের বিষন্নতা। এইটুকু বয়সে কীসের এত দুঃখ তার?
অনুভবকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রিয়া একটু অপ্রস্তুত হলো। পরনের জামাকাপড় গুছিয়ে নিল ভালো করে। বলল,
“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”
“দুপুরে খেয়েছিলে?”
“গিয়ে খাব।”
“এ বাড়িতে তোমার দুইবেলা খাবারের ব্যবস্থা করা আছে। সেই বাড়তি খাবার কে খাবে?”
“ইচ্ছে করছে না। তেতো লাগছে।”
অনুভব উঠে গেল। ফিরে এলো সেই কলার ছড়াটা নিয়ে যা সে ইহজীবনের মতো ত্যাজ্য করেছে। প্রিয়ার কোলের ওপর ছুড়ে দিয়ে বলল,
“এমনিতেও এটা আমার গলা দিয়ে আর জীবনে নামবে না। ভাইয়ারও বোধহয় হবে না। আজকে না খেলে পুরোটাই নষ্ট হয়ে ডাস্টবিনে যাবে। সুতরাং সবগুলো তোমাকেই খেতে হবে। অ্যান্ড রাইট নাও।”
প্রিয়া অসহায় চোখে কলাগুলোর দিকে তাকায়। গুনে দেখে সাতটা কলা আছে। এতগুলো সে খেতে পারবে! তারচেয়েও বড়ো কথা দুপুরে মুখ ফসকে যে উদাহরণ দিয়েছে তাতে নিজেরই গা গুলিয়ে উঠছে। অনুভব কঠিন চোখে চেয়ে আছে। চোখ দিয়েই বুঝিয়ে দিচ্ছে না খেয়ে তার নিস্তার নেই। প্রিয়া পাঁচটা কলা গলাধঃকরণ করে হাঁপিয়ে উঠল। অসহায় চোখে চেয়ে বলল,
“আর অর্ধেকও খেলে বমি হয়ে যাবে।”
অনুভব আর জোর করল না। তবে ওকে একা ছেড়েও দিল না। পৌঁছে দিতে নিজেও এলো সঙ্গে। প্রিয়া বারণ করে বলল,
“আপনাকে আসতে হবে না। আমি চলে যেতে পারব।”
“ব্যাপার নাহ, চলো এগিয়ে দেই।”
প্রিয়া পড়ল বিপদে। এই মুহূর্তে সে বাড়িতে যাবে না। তাকে থানায় যেতে হবে একবার। মা নিশ্চয়ই আশায় থাকবে। কিন্তু অনুভবকে কি করে সরায়? এরই মাঝে অনুভব ফার্মেসির সামনে গিয়ে বলল,
“প্রেস্ক্রিপশনটা এনেছ তো? চলো মে’ডি’সিনগুলো নিয়ে নেই।”
প্রিয়া তড়িঘড়ি করে নিষেধ করে,
“পরে কিনে নেব।”
অনুভব ওর জড়তা খেয়াল করে কিছু একটা আন্দাজ করে নিল। এরপর ফার্মেসির দিকে পা বাড়িয়ে কৌতুক করে বলল,
“অসুখ তোমার কর্মচারী নাকি যে তোমার খামখেয়ালির জন্য সেও একটু খামখেয়ালি করে জিড়িয়ে নেবে?”
প্রিয়ার নিষেধ সত্ত্বেও অনুভব সবগুলো মেডিসিন কিনল। দামও নিজেই দিল। সব মিলিয়ে পাঁচশ ত্রিশ টাকা হয়েছে। প্রিয়াকে মাথা নুইয়ে থাকতে দেখে অনুভব তেজের সঙ্গে বলল,
“ভেবো না মা’গনা দিলাম। এ মাসের বেতন পেয়েই শোধ দেবে।”
প্রিয়া শুধু মাথা কাত করল। রাস্তায় উঠে পাশাপাশি হাঁটা শুরু করলে অনুভব জিজ্ঞেস করল,
“তারপর? ভার্সিটি এডমিশনের প্রস্তুতি নিচ্ছ না?”
“লালমাটিয়া মহিলা কলেজে অনার্সে ভর্তি হবো ভাবছি।”
“পাবলিকে এক্সাম দেবে না?”
“বইপত্র নেই, কোচিং করিনি, গাইডলাইন নেই। প্রিপারেশন ছাড়া সাহস করি না। তাছাড়া এক্সামের জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম পূরণ, ফি, যাতায়াত ইত্যাদির বাড়তি খরচ করার ইচ্ছেও নেই।”
“তোমার ব্যাগ্রাউন্ড কী?”
“হিউম্যানিটিস।”
“গ্রেইট, আমি তোমাকে হ্যাল্প করতে পারব।”
প্রিয়া হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
“এইটুকু সময়ে কিছুই হবে না। কয়েকদিন বাদেই রেজাল্ট। তারপরই ইউনিভার্সিটিগুলো ফর্ম ছাড়বে।”
“চেষ্টা করলে কিছুই অসাধ্য না। তোমাকে পরিশ্রম করতে হবে।”
প্রিয়ার এখন অন্য বিষয়ে কথা বলতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করছে না। সে বেখেয়ালে বলল,
“আচ্ছা দেখি। আপনি এবার আসুন। আমি একটু অন্য কোথাও যাব।”
অনুভব ওর মুখের দিকে তাকায়। মেয়েটা সংকোচবোধ করছে। অনুভব চুটকি বাজিয়ে বলল,
“ওহহো! বয়ফ্রেন্ডের সাথে মিট করতে, রাইট? আমার সঙ্গে দেখে ফেললে বয়ফ্রেন্ড মাইন্ড করতে পারে ভেবে ভয় পাচ্ছ?”
প্রিয়া আকাশ থেকে পড়ল। একটু ঝাঝাল গলায় বলল,
“আপনার মাথায় কী এইসব বিষয় ছাড়া অন্যকিছু ঘোরে না?”
অনুভব দুষ্টু হেসে হাতের আঙুল দিয়ে চুল আচড়ে বলে,
“কী করব বলো, মেয়েরা আমাকে যেভাবে চোখ দিয়ে ঘিরে রাখে তাতে অন্যকিছু ভাবার উপায় আছে?”
“মনে হচ্ছে আপনি খোলা মিষ্টি। তাই গায়ে মাছি বসে।” প্রিয়া ঠোঁট টিপে হাসল।
অনুভব অপমানিত বোধ করল। কটমট করে বলল,
“কী বোঝাতে চাইলে তুমি?”
“কিছু না।”
“অবশ্য তোমার মাথায় এরচেয়ে ভালো উদাহরণ আসবেই বা কী করে। স্ট্যান্ডার্ড যেমন ভাবনাও তেমন। যাও যেখানে যাওয়ার।”
অনুভব হনহন করে উলটোপথে চলে গেল।
________________
টুকটুকিকে দেখতে আসার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে পাত্রপক্ষ আর আসেনি। একদিন হলে থেকে পরদিন ক্লাস শেষে সে বাড়ি ফিরছিল ভয়ে ভয়ে। কিন্তু বাড়ির পরিস্থিতি ভাবনার মতো হলো না। মা-বাবা দুজনই বেশ স্বাভাবিক। পরে জানতে পারল পাত্রের মা অসুস্থ থাকায় তারা আর আসেনি। টুকটুকি স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়তে যাবে তখনই মা বললেন,
“ওরা গতকাল না এলেও অন্যদিন নিশ্চয়ই আসবে বলে কথা দিয়েছে। তুই এসব নিয়ে ঝামেলা করবি না। যথেষ্ট বড়ো হয়েছিস। ভালো পাত্র পেলে অকারণে হাতছাড়া করার মানে হয় না।”
টুকটুকির স্বস্তির শ্বাসটা গলায় আটকে গেল। মায়ের ওপর বৃথা চো’টপাট করে সে চলে গেল রিতা আন্টির বাড়ি। রিতা আন্টি ওর মুখ দেখেই বলল,
“মন খারাপ?”
টুকটুকি আহ্লাদে ভেসে গেল। জড়িয়ে ধরে অভিমানী সুরে বলল,
“আমি কি খুব বেশি বড়ো হয়ে গেছি বলো?”
“না তো। তুই এখনো মিষ্টি একটা বাচ্চা মেয়ে।”
“তাহলে বাবা-মা বিয়ের পেছনে কেন পড়েছে বলোতো? ধরে বেঁধে সংসারে না ঢোকালে হচ্ছে না?”
“তাই নাকি?” রিতা আন্টি চমকে উঠলেন। টুকটুকি গাল ফুলিয়ে নিষ্পাপ ভঙ্গিতে চোখ পিটপিট করে। রিতা আন্টি ক্ষণকাল কিছু ভাবলেন ওই মায়া মায়া মুখটার দিকে তাকিয়ে। টুকটুকিকে চেয়ারে বসিয়ে নতুন বানানো পুডিংটা খেতে দিয়ে চলে গেলেন ভেতরের ঘরে। নিশীথের ফোনে কল করে জিজ্ঞেস করলেন,
“আচ্ছা নিশীথ, টুকটুকিকে তোর কেমন লাগে?”
নিশীথের কাজে ব্যস্ত মস্তিষ্কটা প্রশ্নটা ঠিক ধরতে পারল না। হতবুদ্ধি হয়ে বলল,
“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
“আহা বল না মেয়েটাকে কেমন লাগে।”
নিশীথের মনে তখন চট করে যে কথাটা এলো, মুখ দিয়েও তাই উচ্চারিত হলো,
“মাথায় একটু গন্ডগোল আছে সেই মেয়ের। পা’গ’লাটে।”
“কী বলিস? সুস্থ স্বাভাবিক মেয়েটাকে তোর পা’গল মনে হচ্ছে?”
রিতা আন্টি যেন এমন কিছু শুনতে প্রস্তুত ছিলেন না। টুকটুকিকে নিয়ে সদ্য মাথাচাড়া দেওয়া ইচ্ছেটাতেও ধাক্কা লাগল। ধাক্কা খেল দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা টুকটুকিও। অজান্তেই মুখিয়ে উঠেছিল উত্তরটা জানার জন্য। অথচ ওই মিস্তিরি তাকে পা’গ’ল বলেছে! রাগে দুঃখে টুকটুকি দ্রুতবেগে প্রস্থান করল। টের পেল হাঁটার গতির সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর কিছু একটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।
চলবে…
#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[১৫]
পাত্রপক্ষ দেখতে আসার দিন অবশেষে চলেই এলো। আগামীকাল সেই বরিশালের পাত্রই আসছে, যারা সপ্তাহখানেও আগে অপারগতা জানিয়েছিল। অথচ টুকটুকির ভেতরটা অস্থির লাগছে। বিয়ে সে করবে না এমনটা তো নয়। কিন্তু মনটা এই কয়দিনে প্রস্তুত হওয়ার বদলে আরো ঘেটে গেছে। এ মুহূর্তে তার মন খুলে কথা বলা দরকার। বন্ধুরা এই সময় সব অফলাইনে চলে গেছে। সুতরাং রিতা আন্টির নামটাই স্মরণে এলো। টুকটুকি দুলকি চালে গেল সে বাড়িতে। শেষ বিকেলের ম্লান রোদ ঝিকমিক করছে আন্টির বাড়ির লনে।
দরজা খুলে দিল নিশীথ। টুকটুকি তাকে মোটেও আশা করেনি। ফলে মুখোমুখি সাক্ষাতে কিছুটা চমকে গেল। পরমুহূর্তেই ভেতরে কেউ একজন বিদ্রো’হ করে বলে উঠল,
“এই মিস্তিরি তোকে পা’গল বলেছে টুকি। ক্যান ইউ ইম্যাজিন! হোল লাইফে কেউ এ কথা বলার সাহস পায়নি।”
সঙ্গে সঙ্গে আবার অন্যকেউ বলে উঠল,
“টুকটুকিও তো হোল লাইফে এমন উদ্ভট আচরণ করেনি। এখানে টুকটুকির দো’ষ আছে বৈকি!”
“শুরুটা যদি ওই অসামাজিক, নাক উঁচু লোকটা না করত তবে এসব কিছুই হতো না। টুকিও উদ্ভট আচরণ করত না। সুতরাং দোষটা নিশীথের।”
অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে অবশেষে অহমিকা জয়ী হলো। ফলশ্রুতিতে টুকটুকির চোখে ক্রো’ধ খেলে গেল। নিশীথ সেই সুক্ষ্ম পরিবর্তন ধরতে পারল কিনা বোঝা গেল না। দরজা থেকে ততক্ষণে সে সরে দাঁড়িয়েছে।
“মা ওপরে আছেন।”
সৌজন্যের সঙ্গে জানাল নিশীথ। টুকটুকি শুধু মাথা নাড়ল। চলে গেল দোতলায়। রিতা আন্টিকে ঘুমন্ত অবস্থায় পেয়ে মনটা একটু খারাপ হলো। আবার নিচে নেমে এলে নিশীথ ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল,
“চলে এলেন যে?”
“আন্টি ঘুমাচ্ছে। আপনি এই সময় বাড়িতে? আজ তো হলিডে নয়।” প্রশ্নটা করবে না করবে না করেও নিজেকে দমাতে পারল না টুকটুকি।
নিশীথ সোফার পিঠে বসে আছে। বলল,
“এবার থেকে হলিডে ছাড়াও বাড়িতে দেখতে পাবেন। নতুন অফিসে জয়েন করেছি দুদিন হলো।”
“ওহহ! ভালোই হলো আন্টির জন্য।”
উপেক্ষার স্বরে কথাটা বলে টুকটুকি চলে যাচ্ছিল।নিশীথ পিছু ডাকল বলল,
“মিস হুমায়রা, চা চলবে?”
টুকটুকি এমন প্রস্তাবের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। নিশীথ সঙ্গে যোগ করল,
“মা আপনাকে খালি মুখে ফেরায় না। এখন যেহেতু মা ঘুমাচ্ছে। ভাবলাম আমিই অফার করি। ইচ্ছে হলে চলে আসুন।”
“আপনার হাতে চা খেতে কি আমি ম’রে যাচ্ছি?” এমনই উত্তর দিতে ইচ্ছে করছিল টুকটুকির। কথা শেষ না করেই জনাব কিচেনে ঢুকে পড়েছেন। কী অ্যাটিটিউড! টুকটুকির উচিত মুখ ঝামটা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। অথচ সে খেয়াল করল তার চা তেষ্টা পাচ্ছে। কী সাং’ঘা’তিক! অথচ এই মনই একটু আগে তাকে অহমিকায় ডুবিয়ে দিচ্ছিল!
“মীরজাফর! আমার ভেতরে থেকে আমাকেই মিসগাইড করছিস? সিরাজউদ্দৌলা মীরজাফরকে বারবার ক্ষমা করলেও, তোকে আমি শূ’লে চড়াব।”
প্ররোচিত মনের টানে টুকটুকি রান্নাঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নিশীথ ইতিমধ্যে গ্যাস জালিয়ে পাত্র বসিয়েছে চুলায়। তবে তাতে পানি নয়, ফুটছে দুধ। তাতে এলাচ, লবঙ্গ ও দারুচিনি ও জাফরানের পাপড়ি দিতেই সুমিষ্ট গন্ধে ভরে গেল চারিদিক। নিশীথ টুকটুকির উপস্থিতি খেয়াল করে স্মিত হাসল। মা সেদিন তাকে ফোন করে যা বলেছে তাতে নিশীথ প্রথমে অবাকই হয়েছিল বটে। টুকটুকিকে কিনা ছেলের বউ হিসেবে কল্পনা করেছেন! নিশীথ সবিনয়ে জানিয়েছে তেমন কিছু সে মোটেও ভাবেনি। মাও যেন ভেবে ভেবে আকাশকুসুম কল্পনা না করে। নিশীথ গলা ঝেড়ে বলল,
“আপনার নাকি বিয়ের কথাবার্তা চলছে?”
টুকটুকি খেয়াল করল নিশীথের ঠোঁটে একটা হাসির রেশ লেগে আছে। রুষ্ট গলায় বলল,
“কেন চলতে পারে না?”
“সেটা মিন করিনি। বয়স হয়েছে, বিয়ে তো করবেনই। সেটা এখনই কিনা জানতে চাওয়া।”
“জি এখনই। তার জন্যই আন্টির কাছে এসেছিলাম যেন ভালো শাড়ি বাছাই করে দেন।”
নিশীথ মাথা নেড়ে বলল,
“দেখতে আসছে?”
“হুম।”
“মা তো সেকেলে মানুষ। বর্তমান প্রজন্মের টেস্ট কি ভালো বুঝবেন? তারচেয়ে আপনার সেই ডাটিয়াল বান্ধবীকে বলতেন। তিনি তো দেখেছি বেশ আধুনিকা। বিয়ে বাড়িতে খোলা কাঁধে চলে আসেন।”
খোঁ’চা দেওয়ার সুযোগটা নিশীথ মিস করল না। টুকটুকিরও বুঝতে অসুবিধা হয় না। সদ্য জল থেকে তোলা মাছের কানকোর মতো নাকের পাটা ফুলে ওঠে তার।
“ইকরির টেস্ট অবশ্যই অসাধারণ। সেটা আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। আন্টিকে আমি ভালোবাসি বলেই এসেছিলাম। বন্ধুকে ছোটো করতে নয়।”
“ওয়েট, ওয়েট, আপনার নাম টুকটুকি আর বান্ধবীর নাম ইকরি? দারুণ তো! বাকি দুজনের নাম কী হালুম আর শিকু?”
“জিইই… আপনার সমস্যা?”
“সিরিয়াসলি?” নিশীথ আশা করেনি উত্তরটা। পুনরায় বলল, “চার মূর্তি এক হলেন কীভাবে? নাকি সিসিমপুর থেকে পালিয়ে এসেছেন?”
টুকটুকি মুখ ভার করে বলল,
“কারণ নামগুলো আমিই রেখেছি।”
নিশীথ মিটিমিটি হাসতে হাসতে ফুটন্ত দুধে চা পাতা দিল। জাফরানি দুধের হলদেটে আভা ছড়ানো রঙটা ক্রমশ গাঢ় বাদামী রঙ ধারণ করল। নিশীথ দুটো কাপে চা ছেকে নিয়ে তাতে মধু দিল। এরপর বাড়িয়ে ধরল টুকটুকির দিকে। টুকটুকি মুখ ভার করেই কাপটা হাতে নিল। খেয়াল করল হাসলে লোকটাকে মন্দ লাগে না। ঝকঝকে একপাটি দাঁতের ঝিলিকে মুখশ্রীর দ্যুতিও বদলে যায়।
“আপনার নাম টুকটুকি তাই বাকি তিনজনের নামও মিলিয়ে রেখেছেন, রাইট?”
“রাইট!”
নিশীথের ঠোঁটে আবারো সেই শীতল, সুক্ষ্ণ অর্ধচন্দ্রাকার হাসি খেলে যায়। বলে,
“আপনাকে শুরুতে পা’গ’লাটে ভেবেছিলাম। এখন দেখি আপনি একদমই ছেলেমানুষ। তাই তো বলি আমার অবুঝ মায়ের সাথে বন্ধুত্ব হলো কীভাবে। দুই ছেলেমানুষ একসাথে হয়েছে।”
টুকটুকি কেন জানি রাগ করতে পারল না। বরং অপমানের অহংভরা খোলস থেকে একটা উজ্জ্বল রশ্নি উঁকি দিচ্ছে। টুকটুকি খেয়াল করছে তার এই সঙ্গটা ভালো লাগছে। পরক্ষণে এটাও ভাবল এতে কী সে নিজেকে সস্তা করে ফেলছে? খোঁচা খেয়েও কেন মুখ ফেরাতে পারছে না? সে কী আসলেই ছেলে মানুষ নাকি এসব মন নামক মীরজাফরের কঠিনতম কোনো ষ’ড়য’ন্ত্র? নন্দিনীকে জানাতে হবে সরাসরি। পক্ষপাত না করেই ঠিক-বেঠিক বলতে পারবে। ম্যাডাম এইসব বিষয়ে অলি-আউলিয়া পর্যায়ে কি-না। ভাবনার দোদুল্যমান দশায় টুকটুকি চায়ে চুমুক দিল।
“চা-টা অসাধারণ হয়েছে!” টুকটুকি স্বীকার করতে বাধ্য হলো। জাফরানের সুগন্ধটা যেন স্বাদের তৃপ্তিটা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
“আমি চা বানালে এভাবেই বানাই। ভীষণ প্রিয়। আসুন বসি।”
নিশীথের এই স্বতঃস্ফূর্ততা টুকটুকিকে মনের দ্বিধা কাটিয়ে বর্তমান সময়টা নিয়ে ব্যস্ত হতে সাহায্য করল। তারা চায়ের কাপ হাতে এসে বসল লিভিংরুমে। জানালার থাই গ্লাসে তখন রাতের আগমনী বার্তা। নিশীথ বলল,
“তারপর? আপনার দেওয়া নামে বন্ধুরা ইউসড টু হতে পেরেছে?”
“আলবৎ! ইভেন ওদের বৈশিষ্ট্য শুনলে তো মনে হবে এমন নামই ওদের মানায়।”
টুকটুকি ধীরে ধীরে সহজ হয়ে উঠছিল। নিশীথ খেয়াল করল বন্ধুদের নিয়ে কথা বলতে গিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছে। উচ্ছ্বাস দমাতে ইচ্ছে হলো না।
“শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে তাদের বৈশিষ্ট্য।”
টুকটুকি আগ্রহ নিয়ে বলতে শুরু করল,
“অনুভব অর্থাৎ শিকুকে দিয়ে শুরু করি। ওর সাথে আমার ছোটোবেলা থেকে বন্ধুত্ব। একসাথে পড়াশোনা করেছি। বন্ধুদের মধ্যে শিকু সবচেয়ে হ্যান্ডসাম, স্মার্ট, দুষ্টুমিপ্রবণ আর ভীষণ কেয়ারিং। যদিও একটু খুঁতখুঁতে, তবে সব বিষয়ে নয়, শুধু অনুভূতির ক্ষেত্রে। সেই ইন্টারমিডিয়েট থেকে একটা প্রেম করতে চায় বেচারা। কিছুতেই হচ্ছে না। প্রতিটা মেয়েতেই খুঁত পেয়ে যায়। যুক্তি দিয়ে প্রেম হয় না এটা দীর্ঘ ছয় বছরেও আমি ওকে বুঝিয়ে উঠতে পারলাম না।”
নিশীথ নাক গলায় কথার মাঝে,
“তাহলে প্রেম কীভাবে হয়?”
টুকটুকি চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে কল্পনায় ডুবে যাওয়া চোখে বাইরে তাকিয়ে বলল,
“প্রেম হয় বৃষ্টিদিনে সিক্ত ভূমিতে পিছলে পড়ার মতো। বুঝে ওঠার আগেই হয়ে যাবে। সামলানোর সুযোগ পাবে না।”
“আপনি কখনো পড়েছেন?”
“কী?”
“পিছলে?”
টুকটুকি একটু থমকায়। নিশীথের শান্ত, সুগভীর দৃষ্টি তার চোখেই। যেন ভেতরটা পড়ে ফেলতে চাইছে। ও বলল,
“না। আপনি পড়েছেন কখনো? পিছলে?”
নিশীথ শ্রাগ করে ঠান্ডা চায়ে শেষ চুমুকটা দেয়,
“স্টিল না। ভবিষ্যতেরটা বলা যায় না। আপনি পরের বন্ধুটির কথা বলুন।”
টুকটুকি কেন জানি উত্তরটায় প্রফুল্ল বোধ করল। আবার সোৎসাহে বলতে শুরু করল,
“এবার বলি আমাদের গ্রুপের নীতিবান, স্বচ্ছ চরিত্রের দিগন্ত তথা হালুমের কথা। ওর সাথে পরিচয় ভার্সিটির অরিয়েন্টেশন ক্লাসে। এক মেয়ের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া বাধিয়ে বেচারা প্রায় পর্যদুস্ত হওয়ার পথে। সেই জয়ী মেয়ে অবশ্য ইকরি। আমি ভালোমানুষি করে ওদের মাঝে মধ্যস্থতা করতে গিয়ে ফেঁ’সে গেলাম। দিনে দশবার ঝগড়া লাগে আর আমাকেই শান্তির পতাকা উত্তোলন করতে হতো। যেন তেন ঝগড়া ভাববেন না, মানসম্মান ডুবিয়ে দেওয়ার মতো ঝগড়া। সেখান থেকেই কীভাবে যেন বন্ধুত্বে সূচনা হয়ে গেছে। আমরা কেউ কখনো ছোটোবেলার মতো বলিনি, যে আজ থেকে আমরা বন্ধু হলাম। জাস্ট হয়ে গেছি একসময়। হালুম সিসিমপুরের হালুমের মতোই খেতে ভীষণ ভালোবাসে। ওর মাঝে কূটিলতা বিন্দুমাত্র নেই। ধীরস্থির, ভালো পরামর্শ দিতে জুড়ি নেই। বন্ধুদের প্রেম ভালোবাসায় উৎসাহ থাকলেও নিজে সে পথে পা বাড়ায়নি।”
একসাথে হড়বড় করে অনেকগুলো কথা বলে টুকটুকি হাঁপিয়ে উঠেছে। নিশীথ বলল,
“পানি খাবেন?”
“উহুম।”
“তাহলে কন্টিনিউ।”
“আমাদের গ্রুপের সবচেয়ে আনপ্রেডিক্টেবল হলো নন্দিনী তথা ইকরি। ওকে রিড করার সাধ্যি কারো নেই। সিরিয়াসনেস জিনিসটা জানেই না। নেই ভয়-ডর, শঙ্কা কিংবা কান্না। অর্থাৎ মানব স্বভাবের দুর্বল দিকগুলো ওকে ছেড়ে পালিয়েছে ওর ড্যাম কেয়ারনেস-এর জন্য। জিভে লাগাম বলে কোনো জিনিসের বালাই নেই। একটু উ’গ্র চলাফেরা। তবে আমার মনে হয় উ’গ্র বলেই ওর মাঝে আলাদা একটা চার্মিং আছে যা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আপনি ওর পাত্তা না পেলেও ওকে পাত্তা না দিয়ে পারবেন না। তবে ইকরির একটা হবি কিংবা নেশা বলতে পারেন, সেটা হলো বয়ফ্রেন্ড বানানো আর ছ্যাঁকা দেওয়া। প্রেমের কোনো ব্যাপার তাতে থাকুক বা না থাকুক। এই কথাটা শুনে যে কেউ ওকে শুরুতেই বাজে ভেবে বসতে পারে। কিন্তু বিশ্বাস করুন এত এত বাজে স্বভাব থাকার পরেও মেয়েটাকে আমরা ভালোবাসি। সামান্যতম ক্লেশ আমাদের মনে উঁকি দেয় না। কারণ আমরা জানি ইকরির ভেতরে একটা আদুরে মন আছে যা দিয়ে আমাদের ভীষণ ভালোবাসে। এই হচ্ছে ক্ষুদ্র পরিসরে আমার বন্ধুসমাচার। যদিও বলে শেষ করার মতো নয়।”
“আর আপনি? আপনার ব্যাপারে বলার নেই?”
নিশীথের প্রশ্নে টুকটুকি ভাবের সঙ্গে বলল,
“নিজের ঢোল নিজে পে’টাব না। রিতা আন্টি আমাকে খুব ভালো চেনে।”
“বিগত দিনগুলোতে কিছুটা চিনেছি বৈকি!” নিশীথ ক্ষীণ কণ্ঠে বিড়বিড় করে। টুকটুকি সরু চোখে তাকালে প্রসঙ্গ বদলে বলল,
“আপনাদের ফ্রেন্ডশিপটা সুন্দর, মজবুত। প্রশংসা করতেই হয়। কারণ দেখা যায় ভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারে তুমুল বন্ধুত্ব গড়ে উঠলেও চারটা ইয়ারে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়।”
“আমাদের বন্ডিংটাই এমন যে দিনশেষে একে অপরকে পেটের সব কথা না জানালে ঘুম হয় না। অনেকটা নিত্য প্রয়োজনীয় অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছি। চেনা পৃথিবীর মাঝে আরেকটা ছোটো পৃথিবী আমাদের।”
রিতা আন্টি ঘুম থেকে উঠে দুজনকে আলাপরত দেখে অবাক হলেন। নিশীথ আলাপ স্থগিত করে উঠে যায় মায়ের কাছে। বলে,
“তোমার হয়ে তোমার বন্ধুকে আমিই আপ্যায়ন করে দিয়েছি।”
টুকটুকি উঠে এলো কেমন জড়তার সঙ্গে। আন্টির অগোচরে তার ছেলের সঙ্গে কথা বলে সংকোচ বোধ করছে। আন্টি আবার কিছু ভেবে বসে কিনা! তবে রিতা আন্টি সেসবের দিকে গেলেন না। সন্ধ্যা হয়েছে, কাজেই হালকা নাশতার নামে ভারী খাবার না খেয়ে টুকটুকির নিস্তার হলো না। নিশীথের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবার টুকটুকিকে থমথমে মুখ নিয়ে বেরিয়ে যেতে হতো। এই প্রথম বেশ ফুরফুরে মেজাজে বাড়ি ফিরল সে।
চলবে…