শ্রাবণ কিংবা ফাগুন একটুখানি বর্ষণ পর্ব-৩১+৩২+৩৩

0
440

#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৩১]

অলস দুপুরের সোনালি রোদ আজ একটু বেশিই কড়া। বেশিক্ষণ চোখ মেলে রাখা দায়। গাছপালা, আকাশ, বাতাস সব কেমন থমথমে মুখে আছে। যেন শৈত্যের হিম ঝরানো দিনে সূর্যের এহেন তেজে সকলে ত্যক্তবিরক্ত। কিন্তু প্রতিবার করার ভাষা কারো নেই। যেই সূর্যের সংস্পর্শে তারা টিকে আছে তাকে চটানো মানে জলে নেমে কুমিরকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো। প্রকৃতি সেই স্পর্ধা না করলেও প্রকৃতির চরম অবহেলিত প্রাণী, একটি শ্রান্ত কাক ঠিকই আওয়াজ তুলেছে। ইলেক্ট্রিক থামের ওপর বসে আকাশের দিকে মুখ তুলে সমানে কা কা করে ডেকে চলেছে। দিগন্তের মাঝে মাঝে ওই কাকটার মতো হতে ইচ্ছে করে। পছন্দের, অপছন্দের জিনিসগুলো নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে বলতে ইচ্ছে করে। পেরে ওঠে না। তাকে সূর্যের কাছে কৃতজ্ঞ থেকে নতি স্বীকার করতে হয়ে।
ডং করে শব্দ তুলে বড়ো ঘড়িটা জানান দিল দুপুর একটা বাজে। আজ দিগন্তের বাবার সঙ্গে লাঞ্চ করার কথা। ভাইয়াও থাকবে। দিগন্তকে স্পেশালি উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। নিশ্চয়ই খটোমটো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলাপ করবেন। কিংবা জানতে চাইবেন গ্রেজুয়েশনের পর ছেলের প্ল্যানিং কী? ফ্যামিলি লাঞ্চ মোমেন্ট সচরাচর দেখা যায় এ বাড়িতে। সকলে যে যার কাজে ব্যস্ত থাকে সারাদিন। কোনোদিন লাঞ্চ হলেও তাতে হাসি-তামাশা যে মোটেও হবে না এটুকু নিশ্চিত। তাদের বাড়িতে সব কিছুই ডিসিপ্লিন মেইনটেইন করে চলে। হাসি-মজাও। সর্বদা সিরিয়াস মুডে থাকা বাবার সঙ্গে দিগন্ত কখনোই হাসিমুখে কথা বলতে পারে না। মায়ের সঙ্গেই বা কতটুকু পারে? অদৃশ্য সীমারেখা টেনে দেওয়া আছে সকলের মাঝে।

দিগন্ত পরিপাটি হয়ে নেমে এলো। হলরুম আজ বিরিয়ানির সুগন্ধে মৌ মৌ করছে। দুজন সার্ভেন্ট ব্যস্ত হাতে টেবিল সাজিয়ে সরে পড়ল। খাওয়ার সময় পরিবারের সদস্য ছাড়া অন্যকেউ উপস্থিত থাকা বারন আছে তার মায়ের। মা নিজ হাতে তাদের খাবার এগিয়ে দেন। দিগন্ত একটা চেয়ার টেনে বসল। ঘড়িতে একটা বেজে চার মিনিট। সে-ই সবার আগে এসে পৌঁছেছে। বাবা, মা কিংবা অম্লান ভাইয়া কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। দিগন্ত গ্লাস ভরে পানি পান করল। সহাস্যে কেউ বলে উঠল,

“পানি খেয়ে পেট ভরাবি? বিরিয়ানি খাবে কে?”

দিগন্ত অম্লানের দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল,
“বাবা-আম্মু আসতে আসতে পানি চালান হয়ে যাবে।”

অম্লান দিগন্তের মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসল। চার বছরের বড়ো ভাইয়ের সঙ্গে দিগন্ত হাসি টেনে কথা বলতে পারে। স্বভাবে বাবার মতো কিছুটা গম্ভীর হলেও অম্লানের মুখটা তার নামেরই মতো। অবশ্য আরো একজন আছে যার সঙ্গে দিগন্ত হাসি মুখে কথা বলে। মনের কথা নির্বিঘ্নে বলতে পারে কোনোরূপ ভাবনা চিন্তা ছাড়াই। অম্লান ভাইয়ার থেকেও যার সঙ্গে বেশি সখ্যতা। ওদের বড়ো ভাই ফারহান। যে কিনা অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমিয়েছে আরো বছর পাঁচেক আগেই৷ অম্লান বলল,
“সরি রে, বাবা আটকে গেছে। নারায়ণগঞ্জে আমাদের ফ্যাক্টরির এড়িয়ার রাস্তাটা নিয়ে সেখানকার পৌর মেয়রের সঙ্গে মিটিং আছে। এরপর বিকেলে স্থানীয় কালচালার প্রোগ্রাম এটেন্ড করতে যাবেন এমপি মহোদয়ের সঙ্গে।”

দিগন্ত খানিক ভ্রু কুচকে বলল,
“বাবাকে ইদানীং মেয়র, এমপি ইত্যাদি রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করতে দেখা যাচ্ছে। ভবিষ্যতে রাজনীতিতে নাম লেখানোর শখ জাগছে নাকি?”

“ফ্যাক্টরির দায়িত্ব আমার ওপরে ছেড়ে দিয়েছেন অর্ধেকটা। বাকি অর্ধেকটা তোর ওপর ছেড়ে দিলে করার মতো উনার কাছে ওই একটা কাজই আছে।”

“দায়িত্ব ছেড়ে দিলেই আমায় নিতে হবে?” কথাটা বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল দিগন্ত। ফারহানের মতো সাহসী তার দুই ভাই হয়ে উঠতে পারেনি। কে জানে পারবে কিনা। দিগন্ত নিরুদ্বেগ স্বরে জানতে চাইল,
“আম্মু কোথায়? উনারও এই মুহূর্তে সমাজসেবামূলক কাজে ছুটতে হয়েছে?”

অম্লানের মুখটা এবার সত্যি সত্যিই ম্লান হলো। স্তিমিত সুরে বলল,
“তেজগাঁও-এর একটা প্রতিষ্ঠানে নারী কর্মচারীর যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। নারী কর্মচারীদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রেসক্লাবে মানববন্ধন কর্মসূচি ডাক দিয়েছেন। আম্মুকে সেখানে উপস্থিত থাকতে হবে।”

দিগন্ত সামান্যতম অবাক হলো না। মুখখানা একই রকম নিরুদ্বেগ। যেন এমনটাই হওয়ার ছিল। না হলেই বরং অবাক হতো। অম্লান প্লেটে খাবার বাড়ছিল। দিগন্ত উঠে গিয়ে বলল,
“পানি খেয়েই পেট ভরে গেছে, ভাইয়া। তুমি খেয়ে নাও।”

অম্লান কিছু বলার আগেই বড়ো বড়ো পা ফেলে চলে গেল ও। রুমে ফিরে শেলফে নজর যেতেই চার বন্ধুর কুয়াকাটা ট্রিপের হাস্যজ্জ্বল ছবিটা নজর কাড়ে। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে গিয়েছিল ওরা। ছবিতে চার বন্ধু চারটে আলাদা আলাদা পোজ নিয়ে দাঁত বের করে হাসছে। প্যান্ট গুটিয়ে পায়ের পাতা ডোবানো পানিতে দাঁড়িয়ে থাকা নন্দিনীর ঝকঝকে হাসিটা নজর কাড়ে বেশ। নন্দিনীর কথা মনে পড়তেই খেয়াল হলো মেয়েটা বিরিয়ানি, কাচ্চি বলতে পা’গল। দুদিন আগেই সেমিস্টার ফি ভরেছে। পকেট একদমই খালি হওয়ার কথা। কী খাচ্ছে কে জানে? দিগন্ত নন্দিনীকে কল করে।

নন্দিনী লেকের পাড়ে পা ছড়িয়ে বসে আছে। শীতকালে ক্যাম্পাসটা অতিথি পাখিদের কলতানে মুখোরিত হয়ে থাকে। বিশেষ করে ওর প্রীতিলতা হলের কাছের জলাশয়গুলো নানান পাখিদের পদচারণায় দৃষ্টিনন্দন হয়ে থাকে। পাশ দিয়ে হাঁটার সময় অজান্তেই মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়। এই সময় ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের আনাগোনাও বাড়ে। প্রেমিকযুগল হাতে হাত মিলিয়ে সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, নেপাল থেকে উড়ে আসা পাখিদের জলকেলি দেখে৷ সিন্ধু ঈগল, খঞ্জনা, পানকৌড়ি, ধলাবুক ডাহুকসহ আরো কতশত পাখিরা ঘুরে বেড়ায়!

ফোন বাজছে। নন্দিনীর রিসিভ করতে ইচ্ছে হলো না। বিরক্তির অলক্ষ্যে স্ক্রিনে তাকাতে দেখল দিগন্তের ফোন। বেজে বেজে কেটে গিয়ে পুনরায় বেজে উঠলে ফোন কানে তুলল নন্দিনী। অলস গলায় বলল,
“কীরে ফইন্নি পোলা, ভর দুপুরে আমারে মনে পড়ল ক্যান?”

দিগন্তের মেজাজ খিটখিটে এমনিতেই। এই কথায় আরো একদফা মেজাজ বিগড়াল। বলল,
“বাপ তুলে গা’লি দিবি না।”

“ফইন্নি একটা সুন্দর স্বাভাবিক শব্দ। আমি আদর কইরা ডাকি। এই শব্দটারে গা’লির উপাধি দিয়া তুই একটা বিরাট জনগোষ্ঠীরে গা’লির আওতায় আনতাছোস। তোরে তো রি’মা’ন্ডে নেওয়া উচিত।”

“এ্যা?”

“বুঝলি না তো? প্র’তি’বন্ধী একটা স্বাভাবিক শব্দ। কিছু বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষকে বোঝাতে এই শব্দটা ব্যবহার করে। কিন্তু ভালা মাইনষের জাতেরা এই শব্দটারে আরেক ভালা মাইনষেরে গা’লি হিসাবে দিয়া শব্দটারে বিকৃত করে। কিন্তু আসলে এইটা কোনো নোংরা শব্দ না। এইখানে বিষয়টা হইতাছে শব্দটা তুমি কেমনে কইলা আর কেমনে নিলা। পজিটিভ অর নেগেটিভ। আমার দিল সব সময় ফকফকা তাই আমি পজিটিভ কই। তয় গা’লির কথা যেহেতু উঠলই, আমার সুন্দর শব্দটারে গা’লির নামে কলুষিত করার দায়ে তোর একটা গা’লি প্রাপ্য। শা’লা! এইটা কিন্তু গালি দিছি৷ হি হি!”

দিগন্ত বিরক্ত হয়ে বলল,
“চুপ ব’দ’মাশ। কথার খেলা ভালোই জানিস। এবার ভুজুংভাজুং রাখ। তুই বল সারাদিন কী খেয়েছিস?”

“সকালে এক্সের মাথা খাইছি। আপাতত লেকের বাতাস খাই। পরে কী খাওয়া যায় ভাইবা দেখুমনে।”

এই মেয়েটা জীবনেও সিরিয়াস হবে না! দিগন্ত দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল,
“বিরিয়ানি খাবি, ইকরি?”

“কইত্তে?”

দিগন্ত বিরক্ত হয়ে বলল,
“আমাদের এলাকার মসজিদে বিলাচ্ছে।”

নন্দিনীর উত্তেজিত গলা শোনা যায়,
“আরে দোস্ত, বাড়িত্তে ডেকচি লইয়া লাইনে খাঁড়া গিয়া। লাগলে একটা পলিথিনও নিস।”

“চুপ একদম। আমি আসছি ক্যাম্পাসে। দুপুরে খাইনি। একসাথে খাব।”
________________

আজ ছুটির দিন। টুকটুকি আলস্য আঁকড়ে শুয়ে ছিল বিছানায়। ঝুমঝুমির পরীক্ষা চলছে। তাই নাকে-মুখে রিভাইস দিচ্ছে। সারাঘরে গুনগুন শব্দ ভাসছে। হুট করে মা এসে ফোন এগিয়ে দিলেন টুকটুকির দিকে। চাপা স্বরে বললেন,
“রাকিব ফোন করেছে। তোর সঙ্গে কথা বলতে চায়৷ নে ধর।”

টুকটুকির মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। মায়ের চোখের গরমে ফোন কানে ধরতেই তিনি প্রস্থান করলেন। ওদিকে ঝুমঝুমি পড়া থামিয়ে কান পেতেছে এদিকে। টুকটুকি বলল,
“আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছেন?”

রাকিব সালাম নিল। বলল,
“ভালো আছি। তুমি আমার ফোন ধরছিলে না। তাই আন্টির ফোনে দেওয়া।”

টুকটুকির বলতে ইচ্ছে হলো, “বুঝলেনই যখন ধরছি না তখন কথা বলতে চাইছেন কেন?”
কিন্তু মুখে বলল,
“আসলে সেইভ করা নেই তো। আমি আবার আননোন নম্বর ধরি না।”

“ওহহ আচ্ছা আচ্ছা। আসলে যেটা বলতে চাইছিলাম, কাল তোমাদের ক্যাম্পাসে যাচ্ছি মাইগ্রেটরি বার্ড নিয়ে একটা প্রতিবেদন তৈরি করতে। তুমি কাল ক্যাম্পাসে থাকবে?”

“হুম।”

“দেখা হচ্ছে তাহলে। সামনাসামনি কথা হবে। ফোনে কথা বলায় আমি কম্ফোর্টেবল নই। আই গেস তুমিও?”

টুকটুকি আবারো ছোটো করে বলল, “হুম।”

ফোন রেখে অস্থিরচিত্তে শুয়ে রইল টুকটুকি। তার কেমন কান্না কান্না পাচ্ছে। জীবনটা একেবারে জগা খিচুরি হয়ে গেছে। ঝুমঝুমি পড়া রেখে উৎসুক চোখে চেয়ে বলল,
“আপু তোমার কি অস্থির লাগছে?”

“হ্যাঁ রে। মনে হচ্ছে বিরাট কোনো অসুখ করেছে। বেশি দিন আর বাঁচব না মনে হয়। মাকে বলিস ভালোমন্দ খাইয়ে দিতে।”

ঝুমঝুমি মুচকি হেসে বিজ্ঞের ন্যায় মাথা নেড়ে বলল,
“এ অসুখ দেহের নয়রে আপু, এ অসুখ মনের। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তোমাদের ইগোর মাত্রাটা একটু বেশি। এটাকে হ্যান্ডেল করতে হবে। কাউকে তো হাত বাড়াতেই হবে। নয়তো ফাগুন ছোঁয়ার আগেই শ্রাবণ মেঘে ভেসে যাবে।”

টুকটুকি অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে কপট ধমকের সুরে বলল,
“একদম পাকা পাকা কথা বলবি না, ঝুম। মে’রে তক্তা করে দেব।”

“আমিও নিশীথ ভাইকে বলে দেব তুমি উনার গাড়িতে ময়লা ফেলেছো।”

ঝুমঝুমি মুখ ভেংচি কে’টে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। টুকটুকি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে। সেদিন ওর গায়ে কাদা ছিঁটিয়ে দেওয়ার বিপরীতে টুকটুকিও গতকাল সন্ধ্যার পর চুপিচুপি মিস্তিরির গাড়িতে আবর্জনা ফেলে নোংরা করে দিয়ে এসেছে। এই ব’জ্জাত মেয়েটা কি করে জেনে গেল!

চলবে…

#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৩২]

রাকিবের সঙ্গে বিয়ের কথা এগোনোয় টুকটুকি ধীরে ধীরে নিজেকে গুছিয়ে নিতে চাইছে। ভালোবাসলেই পেতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। সব সময় চাওয়া মাত্র সব পেয়ে না পাওয়ার কষ্টটা টুকটুকির কমই অনুভূত হয়েছে। যার ফলে এই যে দীর্ঘদিন ধরে কাউকে বুকের ভেতর পুষে রাখা, প্রকাশ্যে রাগ দেখিয়ে আড়ালে চোখ মোছা, প্রতিনিয়ত মনকে আড়াল করার অভিনয় করা ওর জন্য সীমাহীন য’ন্ত্র’ণার। প্রতিটা দিন নিজের সঙ্গে নিজের যু’দ্ধ চলে। বিষন্নতা পেয়ে বসে। বয়সটা খুব একটা কম নয় যৌবনের কাছে আবার বেশিও নয় ওর প্রাপ্ত জীবনবোধের কাছে। বোকাসোকা মন, খামখেয়ালিপনা আচরণে ভেসে ভেসে প্রেমের সত্যিকারের অনুভূতি তাকে পেয়েছে পূর্ণ যৌবনে। রিতা আন্টি যখন প্রথম প্রথম প্রতিবেশী হয়ে এলেন টুকটুকি তখন দ্বিতীয় বর্ষে। পুরোনো বাড়িতে কোনো বিকেলে আলাপের ফাঁকে, কথার ভাজে একবার চোখ ঘুরিয়ে দেয়ালে টানানো গম্ভীর রাজপুত্রের ছবিতে নজর বুলানো, রিতা আন্টির মুখে ছেলের নালিশ, প্রশংসা উদগ্রীব হয়ে শোনা ইত্যাদির মাঝে তৈরি হয়েছিল মুগ্ধতা। সামনাসামনি দেখা পেতে কত প্রতিক্ষা করেছে। কিন্তু গোমড়ামুখো রাজপুত্র বাড়িতেই আসে না, আসলেও তার দেখা মেলে না। লোকটা যেন ভূতের বাড়ির অতিথি ভূত। তুচ্ছ মানবীর কি সাধ্য তাকে দেখার! টুকটুকি নামে কেউ যে তাকে দেখতে উদগ্রীব, কথা বলতে ছটফট করে সেটা তার ব্যস্ত দৃষ্টির আড়ালেই রয়ে যায়। টুকটুকির ভালো লাগাটা ছবিতেই হয়ে গেছিল। ভালোবাসাটা শুধু সময়ের অপেক্ষা তখন। যৌবনে এসে কৈশোরের মিষ্টি মিষ্টি আবেশে ডুবে থাকা টুকটুকির ভাবনা একশ আশি ডিগ্রি ঘুরে গেল নিপার বিয়েতে। দূর থেকে দেখে যে মুগ্ধতা তাকে পেয়ে বসেছিল তা সজোরে ধাক্কা খেয়ে ভূপতিত হয়েছিল লোকটির উপেক্ষা ও কটাক্ষে। টুকটুকিও নিজেকে ছোটো করতে চায়নি। ফলে কল্পনায় যা ছিল মিষ্টি কল্পনা বাস্তবে তাতে টক ও ঝালের আধিক্য বেশি হলো। টুকটুকি এতসবের পরেও নিজেকে দমাতে পারেনি। নিজের অগোচরেই মনটা দুর্বল হয়েছে। নিজেকে ভেঙেচুরে গোমড়ামুখো বিতার্কিকের পানে অনুভূতির জোয়ার ছুটেছে। কোনো বাঁধ আটকাতে পারেনি।

একপাক্ষিক অনুভূতি গন্তব্যহীন হয়। বিপরীতের নিস্পৃহতায় তারা স্থিরতা পায় না। উদ্দেশ্যহীনভাবে মানুষটার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুরে বেড়ায়। পুড়িয়ে দেয় মন, তৈরি করে গভীর ক্ষত। আচ্ছা, মন পোড়ার গন্ধ কি ওই গোমড়ামুখো রাজপুত্রের নাকে যায়নি? দেখেনি চোখের আকুলতা? ওহহ, সে তো বুঝিয়েই দিয়েছিল সে বাস্তববাদী মানুষ। টুকটুকির মতো খামখেয়ালি মেয়েদের পছন্দ করে না। সেদিনটায় টুকটুকি এক ধাক্কায় মাটিতে পড়েছিল। সামলেছিল কী করে নিজেকে! টুকটুকি প্রলম্বিত শ্বাস ফেলল। আর ভাবতে চায় না এসব।

রাতের তখন প্রথম ভাগ। পৃথিবী তার রহস্যময় কালো চাদরে নিজেকে আচ্ছাদিত করে নিয়েছে। থাই গ্লাসের বাইরে ব্যস্ত শহরের প্রতিচ্ছবিটা তখন খোপ খোপ কৃত্রিম আলোর সমান। টুকটুকি অন্তরের সকল উষ্ণ, শীতল অনুভূতিকে মনের সিন্দুকে তালাবদ্ধ করে পড়াশোনায় ডুবে গেছে। অন্যপাশে পড়ছে ঝুমঝুমি। কখনো ঢুলে ঢুলে পড়ছে, কখনো গলা চড়িয়ে আবার বোনের ধমক খেয়ে গুনগুনিয়ে। মনে মনে পড়া রিভাইস করতে পারে না মেয়েটি। টুকটুকি ভেবে পায় না এমন ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে এই মেয়ে হোস্টেলে কী করে টিকে ছিল! হঠাৎ টুকটুকির মাথায় একটা প্রশ্ন খেলে গেল। পড়া থামিয়ে বলল,
“এই শোন।”

ঝুমঝুমি বই থেকে মুখ তুলে বলল, “বলো।”

“তুই ওই অসামাজিক লোককে দুলাভাই ডাকিস কেন?”

ঝুমঝুমি হাসল। টুকটুকি ধমক দিয়ে বলল,
“দাঁত দেখাবি না একদম। পিছা মে’রে সব কয়টা দাঁত ভেঙে দেব। ভণিতা না করে যা বলছি সরাসরি উত্তর দিবি।”

“কারণ উনি আমার দুলাভাই হওয়ার কথা ছিল।”

“কথা থাকলেই ডাকতে হবে? রাকিবের সঙ্গেও বিয়ের কথা হচ্ছে। ওকে দুলাভাই ডাকিস না কেন?”

“রাকিব ভাই দেখতে ভালো বাট ভাইয়ের বেশি কিছু ফিল হয় না। নিশীথ ভাইকে দেখলে ভাইয়ের চেয়েও বেশি কিছু মনে হয়। আই জাস্ট লাভ হিজ পারসোনালিটি।”

টুকটুকি হতভম্ব গলায় বলল,
“তারমানে?”

ঝুমঝুমি নিষ্পাপ মুখ করে বলল,
“এখন আমার মনটা সরল। যদি ভাইয়ের চেয়েও বেশি কিছু ভেবে ফেলি! পরে ভেবে দেখলাম এইজ ডিফারেন্সটা একটু বেশি। এগারো-বারো বছরের ডিফারেন্স নিয়ে প্রেমটা ঠিক জমবে না। তাই এমন কিছু ভাবা দরকার যাতে দুষ্টু চিন্তা মাথায় না ঢোকে। পরে বোনের বিয়ে না দিয়েই দুলাভাই বানিয়ে দিলাম। নিশীথ ভাই যাকেই বউ করবে অটোমেটিক সে আমার বোন হয়ে যাবে।”

“ওই লোক মানা করেনি ডাকতে?”

“না তো। যখন দুলাভাই ডাকার কারণ বললাম হেসে কুটিকুটি হয়ে বললেন, ‘তুমি ইঁচড়েপাকা মেয়ে। বেশ, তবে দুলাভাই-ই ডেকো।’ আমিও তাই ডাকলাম।”

টুকটুকি ভ্রুকুটি করে। তার ভাবখানা এই যে,
“আমার বেলাতেই তার যত সমস্যা, অন্যদের সঙ্গে বেশ ভাব জমিয়ে চলতে পারে। আস্ত অসামাজিক।”

টুকটুকি ঝুমঝুমিকে বকা দিল না। ওই লোকের কথা ভাববে না বলেও এতক্ষণ ভেবে ফেলায় মনে মনে নিজেকে তিরস্কার করে আবারো পড়ায় ডুব দেয়। আজ সারারাত পড়ার ইচ্ছে আছে ওর। সেমিস্টারের পড়া কভার করতে হবে এর মধ্যেই। দিনে যতই তিড়িংবিড়িং করুক রাতটা নষ্ট করা যাবে না। যখন সবটুকু মনোযোগ বইতে দিয়ে ও ডুবে গেছে তখনই ফোনটা বাজল। টুকটুকি বেজায় বিরক্ত হলো। চেয়ার ছেড়ে উঠে বিছানা থেকে ফোন এনে দেখল রিতা আন্টি ফোন করেছে। অগত্যা রিসিভ করতে হলো।
“এই টুকটুকি, খুব ব্যস্ত মানুষ হয়ে গেছিস আজকাল?” ফোন কানে রিতা আন্টির ধমক।

টুকটুকি থতমত খেয়ে গেল। বুঝতে না পেরে বলল,
“কেন আন্টি? কী করেছি?”

“কী করেছিস সেটা সামনাসামনি বলব। তোর ব্যস্ততা কমলে পায়ের ধুলো দিয়ে যাস।”

ফোন কেটে গেল। টুকিটুকি পড়ার কথা ভুলে থম ধরে বসে ভাবতে লাগল সে কী করেছে। কিছুই মনে করতে পারল না। যথারীতি পরেরদিন সকাল সকাল সে গিয়ে হাজির হলো রিতা আন্টির বাড়িতে। নিশীথ বিরস মুখে টেবিলে বসে জরির হাতের স্পেশাল অখাদ্য গিলছিল। টুকটুকির পদচারণায় তার চওড়া মসৃণ কপালে ক্ষীণ ভাজের রেখা উদিত হয়েও মিলিয়ে গেল।

দরজা দিয়ে ঢুকতেই পামকিনকে পেয়ে টুকটুকি ওকে কোলে তুলে আদর করতে করতে ভেতরে এলো। নিশীথের সঙ্গে চোখাচোখি হলো, উভয়েই দৃষ্টি সরিয়ে নিল। টুকটুকির পা দুটি থমকে গেল সোফায় গা এলিয়ে দেওয়া রমনীকে দেখেই। রিতা আন্টি চোখের ওপর শসার স্লাইস দিয়ে রিল্যাক্স করছেন। জরি মাথায় সুগন্ধি তেল দিয়ে মালিশ করে দিচ্ছে। ও বলল,
“খালা, টুকটুকি আফা আইছে।”

রিতা আন্টি নড়লেন না। এক চোখের ওপর থেকে শসার স্লাইস সরিয়ে টুকটুকিকে ভালোমতো দেখে নিয়ে বললেন,
“চোখ লাল কেন? রাতে ঘুমাসনি?”

জরি কথাটা কেড়ে নিয়ে মিটিমিটি হেসে বলল,
“আফার নাকি বিয়ার কথা চলে। রাইত জাইগা কথা কয় মনে হয়।”

টুকটুকি আঁড়চোখে একবার নিশীথকে দেখে।
নিশীথ খাওয়া থামিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে। রিতা আন্টি হেসে বললেন,
“কেন রে? বর্ষণ রাজার সঙ্গে ব্রেকাপ হয়ে গেছে?”

“বর্ষণ রাজা?” নিশীথ কৌতুহলী হয়ে বলল।

রিতা আন্টি বললেন,
“হুম, টুকটুকির প্রেমিক সে। বাল্যপ্রেম ওদের। বর্ষণ রাজা ওকে মেঘকুমারী বলে ডাকে।”

টুকটুকি লজ্জা পেয়ে তড়িঘড়ি করে রিতা আন্টির পাশে বসে হাত চেপে ধরে। বলে,
“তেমন কিছুই নয় আন্টি। অনেকদিন বাদে একটু বেশি রাত করে পড়েছিলাম। তুমি বলো আমি কি করেছি যে কাল ধমক দিলে?”

রিতা আন্টি অভিমান করে বললেন,
“আশ্বিনের মেঘ হয়ে গেছিস আজকাল। বুড়ো বন্ধুকে মনেই পড়ে না।”

“আসলে আন্টি লাস্ট সেমিস্টার তো তাই পড়াশোনায় একটু বেশি সময় যাচ্ছে।” টুকটুকি কৈফিয়ত দিতে চাইল।

“হুম হুম বুঝি, ব্যস্ততা সবারই হবে, বুড়োটা একাই রবে।”

টুকটুকি জরিকে সরিয়ে নিজে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“প্লিজ রাগ কোরো না। তোমার ফলোয়ার কত হলো সেটা বলো?”

“একশ প্লাস। ফরেনার ফ্রেন্ড হয়েছে কতগুলো। গতকাল রাতে একজন প্রপোজও করে বসেছে। আমার ছেলে আছে শুনেও। আমি হ্যাঁ বা না বলিনি। ঝুলিয়ে রেখেছি।”

হতবিহ্বল চোখে নিশীথ ও টুকটুকি একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে রিতা আন্টির মুখের দিকে চাইল। তিনি বেশ খুশি। আবার বললেন,
“টুকি, তোর বিয়েটা খেয়ে ভাবছি বিদেশে চলে যাব।”

মায়ের পা’গ’লামিতে ইদানীং নিশীথের মাথা হ্যাং হয়ে যায়। বোঝানোর ভাষা খুঁজে পায় না। টুকটুকির বিয়ের প্রসঙ্গ আসায় ক্ষীণ তাচ্ছিল্য করে বলল,
“বর্ষণ রাজা যেহেতু আছেই তবে অন্যত্র বিয়ে কেন? প্রেমিক বেকার?”

টুকটুকি ভ্রুকুটি করে চাইল। রিতা আন্টি হা হা করে হেসে উঠে বললেন,
“এ প্রেম মানুষে মানুষে নয়রে বোকা। এই প্রেম শরীরের উর্ধ্বে।”

“মানে?”

“মানে এই প্রেম মানুষ আর বৃষ্টির মাঝে। শুনেছিস এমন আজব কথা! আমাদের টুকটুকি বৃষ্টি-বাদলকে তার প্রেমিক পুরুষ হিসেবে মেনে এসেছে। আর নিজেকে তার মেঘকুমারী। একদিন কোনো বাস্তব মানব সেই বর্ষণ রাজার স্থান অর্জন করে টুকটুকির মনটা জিতে নেবে।”

টুকটুকি লজ্জায় আড়ষ্ট। এই প্রেমের কথা সে গোপন রাখতে ভালোবাসে। নিশীথ খেয়াল করল টুকটুকির রাঙা গাল। অনেকদিন আগে এক ঘন সন্ধ্যায় বৃষ্টির মাঝে পাশের বাড়ির ছাদে সে কাউকে বাধনহারা হয়ে নাচতে দেখেছিল। টুকটুকিই সেই মেয়েটি। আর নাচটা ছিল কল্পিত প্রেমিকের সঙ্গে উল্লাস!

টুকটুকি রিতা আন্টির বাড়িতে বেশিক্ষণ বসল না। বেরিয়ে যাওয়ার সময় দরজার কাছে নিশীথের দ্বারা পাকড়াও হলো। নিশীথ উৎকর্ণ হয়ে বলল,
“মিস হুমায়রা, আপনার বর্ষণ রাজার স্থান কী কোনো মানব অর্জন করে নিয়েছে?”

টুকটুকি অবহেলায় চাইল। উদাসী গলায় বলে গেল,
“কোনো মানবের এতটা আবেগ হলো কই?”
_____________

প্রিয়ার টিউশনি জুটেছে ঝিগাতলায়। মাস গেলে ছয় হাজার টাকা বেতন। দুই ঘন্টা পড়াতে হয়। প্রিয়া রোজ বিকেলে পড়িয়ে আসে। স্টুডেন্ট-এর বাবা একজন সেনা কর্মকর্তা। মা হাউজ ওয়াইফ। প্রিয়াকে কোনো নাশতা দেন না ওরা। ভাড়া বাঁচাতে রোজ হেঁটে হেঁটে পড়াতে গিয়ে প্রিয়া বেশ ক্লান্ত হয়ে যায়। প্রথম দুদিন চেয়ে নিয়ে পানি খেয়েছিল। পরে চক্ষুলজ্জায় সেটুকুও হয়ে ওঠেনি বলে ব্যাগে করে পানি নিয়ে যায়। আজ বিপত্তি ঘটে গেল। ফেরার পথে জুতোর তলি ছুটে গেছে। ফেলে দিয়ে চলে যেতে চাইল না ও। এমনিতেই টাকার সংকট। ছয় হাজারে বাড়ি ভাড়া দিয়ে খাওয়ার টাকাই মিলবে না। নতুন জুতো সেখানে অলিক কল্পনা। বরং অল্প টাকায় সেলাই করে পরা যাবে আরো কিছুদিন। প্রিয়া আরেকটা টিউশনি খুঁজছে। নয়তো খেয়ে বাঁচা কষ্টের হয়ে যাবে। অনুভবও যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। এদিকে অনুভবের নিজেরই টিউশনি করিয়ে চলতে হবে চাকরি না পাওয়া অবধি। তবে সে স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং অভিজ্ঞ হওয়ায় টাকার অংকটা একটু বেশি। সে হিসেবে প্রিয়ার যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা দুই-ই কম। এলোমেলো ভাবতে ভাবতে পা ঘষটে ঘষটে হাঁটছিল প্রিয়া। হুট করে কেউ বাহু ধরে টান দিল। প্রিয়া ছিটকে গিয়ে কারো বুকে ধাক্কা খেল। আকস্মিক ভড়কে গেলেও গন্ধটা পরিচিত ঠেকল। অনুভব শক্ত গলায় বলল,

“এই মেয়ে, চোখ কি পকেটে নিয়ে ঘোরো? রাস্তায় হাঁটার সময় সামনে-পেছনে গাড়ি আছে কিনা খেয়াল করবে না?”

প্রিয়া ধাতস্থ হয়ে সরে দাঁড়ায়। একে তো হেঁটে অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়া, তারওপর জুতো ছিঁড়ে সকলের সামনে ছ্যাঁচড়ে হাঁটা। প্রিয়ার মনটা এমনিতেই খারাপ ছিল। অনুভবের ধমক শুনে ওর রাগ হলো। ইদানীং তার অল্পতেই রাগ হচ্ছে। বলল,
“খেয়াল করলে কি এখানে দাঁড়িয়ে আপনার বকা শুনি?”

“আমি তোমাকে বকেছি?”

“তো কী রাস্তা ভর্তি লোকের সামনে আদর করছেন?”

মুখ ফসকে বলে প্রিয়া ঠোঁট টিপে থেমে যায়। রাগটা উবে গিয়ে ধরা দেয় সংকোচ। অনুভব চোখ ছোটো করে তাকায়। উচ্চতায় প্রিয়া তার কাঁধসম। একটু ঝুকে এসে অদ্ভুত হেসে বলে উঠল,
“তুমি কি রাস্তা ভর্তি লোকের সামনে আদর চাইছিলে?”

প্রিয়া সেই দৃষ্টির প্রগাঢ়তার সামনে বিমূঢ় হয়ে যায়। যেন জ্ব’লন্ত আ’গুনে পানি পড়েছে এমন ভাবে চুপসে যায়। গালের রঙে পরিবর্তন খেলেছে। অনুভব সেদিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকায়। ঠোঁটের কোণের উষ্ণ হাসিটা আরেকটু চওড়া হয়েছে। ক্ষীণ গলায় বলল,
“লজ্জা পাচ্ছ কেন?”

প্রিয়া এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে আমতাআমতা করে বলল,
“ধুর, আপনি ভালো না।”

অনুভব অবাক হওয়ার ভাণ করে বলল,
“দুষ্টুমি তোমার মনে আর আমি ভালো না?”

প্রিয়া উত্তর না দিয়ে পাশ কাটাতে চাইল। অনুভব হাত টেনে ধরে কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলল,
“তুমি চাইলে কিন্তু রাস্তার মাঝে সেটাও পারব।”

চলবে…

#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৩৩]

ব্যস্ত রাস্তা ধরে ছুটে চলেছে একের পর যান। গাড়ির হর্ন, হকারদের ডাক, রিক্সার ক্রিং ক্রিং কিংবা পথচারীদের হইচই কোনোটাই প্রিয়ার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারছে না। একটু আগের গাঢ় স্বরের শব্দতরঙ্গ প্রিয়ার সর্বাঙ্গে শিহরণের ঢল নামিয়েছে। গা ঘেঁষে দাঁড়ানো সুন্দর পুরুষটির স্পৃহা জাগানো দৃষ্টিতে চোখ রেখে প্রিয়ার বুকটা ধ্বক করে ওঠে। অষ্টাদশী হৃদয়ে ছড়ায় নতুন বার্তা। ব্যস্ত রাস্তার বিরক্তিকর পরিবেশে মুখোমুখি, কাছাকাছি দাঁড়িয়ে যা হওয়ার কথা ছিল না, যা কল্পনাতেও ঠাঁই পায়নি ঠিক তাই হয়ে গেছে। ধুলো ওড়ানো গরম, অস্বস্তিকর, কোলাহলময় পরিবেশে সবচেয়ে সুন্দরতম দৃষ্টিবদল ঘটে গেছে। পরিবারের চিন্তা, অর্থের ভাবনা, সম্মান বাঁচিয়ে চলা তটস্থ মস্তিষ্কের এক ফাঁকে উঁকি দিয়েছে সাতরঙা কিরণ। যাতে লেগে আছে নতুন অনুভূতির আবেশ। সেই প্রথম প্রিয়ার উপলব্ধি হলো পুরুষের প্রেম ছোঁয়া দৃষ্টি ছু’রির চেয়েও ধাঁ’রালো হয়। যা হৃদয়কে এফোঁ’ড়’ওফোঁ’ড় করে দিতে সক্ষম। এটাকে যে প্রেম ছোঁয়া দৃষ্টি বলে তা ওকে কেউ বলে দেয়নি, শিখিয়ে দেয়নি। তবুও প্রিয়ার মন বুঝে গেল। কি অবাক করা কান্ড! তার অগোচরেই মনটা সব শিখে গেছে! প্রিয়া চোখ নামিয়ে নেয়। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে হাত টান দেয়। কণ্ঠে শব্দ জুগিয়ে বলে,
“ছাড়ুন।”

প্রিয়ার কাজ করে খসখসে হয়ে যাওয়া সরু আঙুলগুলো তখনো অনুভবের মোটা আঙুলের ভাজে বন্দী। মেয়েটির হাত অস্বাভাবিক ঘামছে। অনুভব হাত ছাড়ল না। বরং শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। আগের মতোই গাঢ় স্বরে বলল,
“ছাড়ার জন্য ধরেছি নাকি!”

প্রিয়া জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে আশেপাশে তাকায়। মুখাবয়ব যথেষ্ট শান্ত হলেও ভেতরে যে তোলপাড় বয়ে যাচ্ছে সেই খবর অনুভবকে দিতে না চাইলেও অনুভব বুঝে গেল। আজ বোধহয় মনের ভাষা বোঝার দিন। কেউ কাউকে গভীরভাবে না চিনেও একে অপরের মনের কথা বুঝে যাচ্ছে। লুকানো যাচ্ছে না সুপ্ত বাসনাটুকুও। নিশ্বাসের প্রগাঢ়তা জানান দিচ্ছে দুটি হৃদয় একই সাথে কম্পিত, সংকিত, উচ্ছ্বসিত।

হুট করে একজন রিকশাওয়ালা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তেরছা স্বরে বলে উঠল,
“রাস্তাও আজকাল পার্ক হইয়া গেছে!”

প্রিয়া লজ্জায় সরে যেতে চায়। কিন্তু বলশালী হাতের ভাজ থেকে নিস্তার মেলে না। অনুভব রিকশাওয়ালার কথাটা লুফে নিয়ে সহাস্য উত্তর দিল,
“শোনেন মামা, প্রেম যু’দ্ধক্ষেত্রকেও নন্দনকানন বানাতে পারে। আর এটা তো সামান্য রাস্তা। প্রেমিকের চোখে গুলিস্তানও গুলশান।”

উচ্চস্বরের রসিকতার ফলেই আশেপাশের উৎসুক মানুষ নজর ঘুরিয়ে দেখল ওদের। কেউ ঠোঁট টিপে হাসল, কেউ বিরক্ত হলো যুব সমাজের অবক্ষয়ে, কারো আবার কিছুই এলো গেল না। প্রিয়া ঠোঁট চেপেও হাসিটা লুকাতে পারল না। ঠিক তখনই অনুভবের খেয়াল হলো ওর পায়ের দিকে। ঘন সুন্দর দুটি ভ্রুর মাঝে ভাজ ফেলে বলল,
“আচ্ছা! এই কারণে পা ছ্যাচড়ে হাঁটছিলে!”

অনুভবের দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের পায়ের দিকে তাকাতেই প্রিয়ার হাসি মুছে গেল। ইতস্তত করে বলল,
“হুট করে ছুটে গেল। আপনি এখানে হঠাৎ?” কথা ঘোরানোর চেষ্টা।

অনুভব বলল,
“সাইন্সল্যাব এসেছিলাম। এই সময় তোমার টিউশন শেষ হওয়ার কথা তাই ভাবলাম দেখা করে যাই। এসে দেখি গাড়ির নিচে চাপা পড়তে মহানন্দে রাস্তা ধরে হাঁটছো। মানে দুনিয়ার সমস্ত দুশ্চিন্তা রাস্তায় বের হলেই কেন করতে হবে? বাসায় একটু ফেলে আসা যায় না?”

প্রিয়া ধমক খেয়ে গোমড়া মুখে বলল, “দুশ্চিন্তা যদি ধরার মতো কিংবা ছাড়ানোর মতো বস্তু হতো তাহলে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসতাম।”

অনুভব হেসে ফেলল, “ধরা, ছোঁড়া না গেলেও কন্ট্রোল করা যায়। ইউ নিড সামথিং স্পেশাল ফর থিংক।”

“মানে?”

অনুভব জাদরেল হাসিটা ঠোঁটে এঁটে নিচু গলায় বলল,
“নতুন কিছু ভাবো, নতুন অনুভূতিকে ভাবো। সবচেয়ে সুন্দর পুরুষকে মনে ঢুকতে দাও। দেখবে সুন্দর পুরুষটা মন থেকে সব দুশ্চিন্তাদের ঝেটিয়ে বিদায় করে দিয়েছে।”

প্রিয়া মুখ কুচকে ফেলল, “ফালতু কথা।”

“আরে একবার এপ্লাই তো করে দেখ। কার্যকর না হলে সুন্দর পুরুষটাকে তুমিও ঝেটিয়ে বিদায় করবে। যে প্রেমিকার মন দখল করতে পারে না তার কোনো অধিকার নেই সেই মনে থাকার।”

“এখন সুন্দর পুরুষ কোথায় পাই?”

“ফকফকা আলোতে দাঁড়িয়ে তুমি সুন্দর পুরুষ দেখতে পাও না? চোখটা গেছে, চশমা লাগবে মনে হচ্ছে।”

“আলোও ফকফকা, আমার চোখও ঠিক আছে।”

“তাহলে কি বলতে চাও আমি সুন্দর নই তোমার চোখে?” অনুভব আহ’ত চোখে চায়।

“ওহহ আচ্ছা, আপনি তাহলে এতক্ষণ নিজের জন্য বলছিলেন!”

প্রিয়ার ঠোঁটে চাপা হাসি। অনুভব চোখ ছোটো করে তাকায়। কতটা বদ এই মেয়ে! মুখ থেকে কথা স্বীকার করিয়ে নিল! অনুভবের একটা হাত প্রিয়ার হাতে ধরা। অপর হাত ওর কপালে আলতো ঠুকে দিয়ে বলল,
“বুঝেছি, আমাকেই নতি স্বীকার করতে হবে। এখন এই স্লিপার ফেলে দাও। চলো নতুন কিনি।”

প্রিয়া এবার নিজের স্বভাবসুলভ গম্ভীরতায় ফিরে গেল। এই ভয়টাই করছিল এতক্ষণ। স্পষ্ট গলায় বলল,
“নতুন কেনার ইচ্ছে নেই। এটাকে সেলাই করে নেব। আপনি বরং আমাকে মুচি মামার কাছে নিয়ে চলুন।”

ইচ্ছে নেই কথাটার অর্থ যে কেনার অপারগতা অনুভবের বুঝতে অসুবিধা হয় না। জোর করে কিনে দেওয়া যায়, তবে এতে আত্মসম্মানী প্রিয়া তার সামনে সংকুচিত হয়ে পড়বে। সমস্যার কথা খুলে বলতে পারবে না। তার চেয়ে প্রিয়ার মতো এগোলে মেয়েটা সহজ হবে। অনুভব ওর কথা মেনে মুচির খোঁজে এগোয়।
অবশ্য আরেকটা গোপন সত্যি হলো ভাইয়ার সাহায্য থেকে বেরিয়ে আসার পর অনুভবের পকেটের অবস্থাও আহামরি ভালো নয়। ভাবীর মাকে অপমান করার দায়ে ভাবী তার ওপর নারাজ হয়েছে। পিতা-মাতাহীন বখে যাওয়া সন্তান রূপে তাকে চরম ভর্ৎসনা করা হয়েছে। ভাইয়া সামনাসামনি কথা বলতে চেয়েছিল কিন্তু অনুভবের কেন জানি রুচি হয়নি। সে টের পেয়েছে ভাইয়ার গলাতেও অসন্তোষের ছায়া। অনুভবকে বোঝানোর সময় ভাইয়া বারংবার মনে করাতে ভোলে না ছোটো ভাইকে সব ভরনপোষণ দিচ্ছে কতটা পরিশ্রম আছে সেই ভরনপোষণ জোগাড়ে। তাই ছোটো ভাইয়ের উচিত কৃতজ্ঞ থাকা। অকৃতজ্ঞ অনুভব হয়নি। ভাইয়া-ভাবীর সংসারে মাথা নত করে থেকে তাদের মন জুগিয়ে চলে, বাড়ির কাজ যতটা সম্ভব কমিয়ে নিজের তরফ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশে সে কার্পণ্য করেনি। সব ভুলে পারিবারিক, সাংসারিক ছেলেটা এক লহমায় বখে গেল! কারণ অ’প’রাধীর মেয়ের জন্য ভাবীর মাকে খোঁটা দিয়ে বাজে কথা শুনিয়েছে।

অনুভব বুঝে গেছে, অনেক তো হলো অন্যের ছায়ায় বাঁচা। এবার নিজের জন্য ছায়া তৈরি করতে হবে। পথ মসৃণ নয়। কিন্তু হাল ছাড়া যাবে বা। ছায়া তৈরি হোক বা না হোক অনুভব ভাইয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখাতে কখনোই ভুলবে না। সত্যিই তো বাবা-মায়ের পরলোক গমনের পর ভাই না দেখলে সে ভেসে যেত। কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা তার আত্মার কাছে দায়বদ্ধতা। ভবিষ্যতে তাদের কোনো সাহায্যে লাগতে পারলে অনুভব হাসিমুখেই তা করবে।

ভাইয়ার ছায়া থেকে বেরিয়ে অনুভব যে শুধু নিজের ছায়া গড়তে চাইছে বিষয়টা একমাত্র তাই নয়। সে উপলব্ধি করছে অধিকার নিয়ে আরেকজনের ছায়াও হতে হবে। সেটা যত দ্রুত হয় ততই মঙ্গল।
__________________

দুই দিন পরের কথা। বসন্তের ছোয়ায় শীতের আধিপত্য ক্ষয়ে গেছে অনেক আগেই। সেই সঙ্গে গরমের প্রভাব বিস্তার বাড়ছে৷ ঝুমঝুমির এসএসসি এক্সাম শেষ হলো আজ। সেই সুবাদে মায়ের বদলে টুকটুকি সেন্টার থেকে বোনকে নিয়ে আসছিল। গাড়ি ধরতে এগোলে হুট করে সেখানে নিশীথের আবির্ভাব হলো। গাড়ির দরজা দরজা খুলে বেরিয়ে আসতে টুকটুকি ভূত দেখার মতো চমকায়। ঝুমঝুমি কিন্তু চমকালো না। হাসি মুখে হাত নাড়ল। নিশীথ এগিয়ে এসে জানতে চাইল,
“পরীক্ষা কেমন দিলে, ঝুনঝুনি?”

ঝুমঝুমি মুখ কুচকে বলল,
“ছি! আমার নাম ঝুমঝুমি, নট ঝুনঝুনি। কত্ত সুন্দর একটা নাম। আপনি আমার মন খারাপ করে দিচ্ছেন, দুলাভাই।”

নিশীথ হেসে আঁড়চোখে টুকটুকির ঠোঁটের দিকে তাকায়। আবারো চোখ আটকে দেওয়া লাল লিপস্টিক! নাম টুকটুকি বলেই কি এই মেয়ে সব সময় টুকটুকে সেজে থাকতে পছন্দ করে! নিশীথ বলল,
“আমার কী দোষ বলো? তোমাদের নামগুলোই এমন যে ঝুমঝুমি বলতে গিয়ে ঝুনঝুনি আর টুকটুকি বলতে গিয়ে টিকটিকি বেরিয়ে যায়।”

টুকটুকি কটমট করে তাকায়। রাঙা ঠোঁটের মাঝে ঝকঝকে সুন্দর দাঁতগুলো দেখিয়ে বলে,
“আপনি কি ঝগড়া করার জন্য এসেছেন নাকি? সরি আমার মুড নেই।”

“আমারও মুড নেই। ঝুমের শেষ এক্সামের দিন আমায় এক্সপেক্ট করেছিল বলেই দেখা করতে আসা।”

টুকটুকি এবার কটমট করে বোনের দিকে তাকায়। কোন আন্দাজে এই মেয়ে আজ নিশীথকে ডেকেছে! ডাকলেই বা এই লোক আসতে গেল কেন? ঝুমঝুমি বড়ো বোনের থেকে মুখ লুকিয়ে নিশীথকে বলল,
“পরীক্ষা ভালো হয়েছে।”

“তাহলে একটা আইসক্রিম পাওনা।”

নিশীথ ঝুমঝুমিকে আইসক্রিম কিনে দিল। দুইটা আইসক্রিম হাতে দিয়ে ইশারা করল টুকটুকির হাতে অন্যটা দিতে। টুকটুকি নিল না। ঝুমকে দুটোই খেয়ে নিতে বলল। বেশ থমথমে থাকার চেষ্টা করছেন ম্যাডাম। কিন্তু যার স্বভাব ছটফট করা সে কি শান্ত থাকতে পারে! মেকি ভাবটা বুঝে নিশীথও আড়ালে ব্যাঙ্গাত্মক হাসে। ঝুমকে বলে,
“চলো বাসায় পৌঁছে দেই।”

টুকটুকি প্রতিবাদ করে বলল,
“আমরা চলে যেতে পারব। আপনি ব্যস্ত হবেন না।”

নিশীথ ঝুমঝুমিকে বলল,
“প্রচন্ড চড়া রোদ, গরমও পড়েছে। ভিড় বাসে না গিয়ে তোমার বোনকে বলো অন্তত তোমার কথা চিন্তা করে যেন মানা না করে।”

ঝুমঝুমিও নিশীথের সঙ্গে যেতে বায়না ধরল। টুকটুকি দাঁতে দাঁত চিপে বলল,
“তুই কিন্তু জ্বা’লাচ্ছিস।”

“এটাই লাস্ট, প্লিজ!”

অগত্যা টুকটুকি নিশীথের গাড়িতে উঠতে রাজি হলো। পেছনের ডোর খুলে বসতে গেলে নিশীথ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলে,
“সবাই পেছনে বসলে নিজেকে ড্রাইভার মনে হবে।”

“তো মিস্তিরির কাজ ছেড়ে এসে কে বলেছিল সেধে ড্রাইভার হতে?” উত্তরটা জিভের আগায় সুড়সুড়ি দিলেও টুকটুকি কোনো কথা বলল না৷ ঝগড়া হোক বা যাই হোক এই লোকের সঙ্গে সে বাচালামি করা বন্ধ করবে। ঝুমঝুমি ওকে সামনে ঠেলে দিয়ে বলল,
“তোমরা সিনিয়র দুজন সামনে বসো। আমি পরীক্ষার চাপ কাটিয়ে হালকা হয়েছি। পেছনে হাত-পা ছড়িয়ে বসব।”

টুকটুকি শুধু সাপের দৃষ্টিতে বোনের স্পর্ধা ও চালাকি দেখছে। পারলে এখনই অজগরের মতো গিলে ফেলে। টুকটুকি সামনে বসেই বাড়ি ফিরল। নিশীথের সঙ্গে কোনো কথাই বলল না। নিশীথও সেধে কথা বলতে আসেনি। যা আলাপ সব ঝুমের সঙ্গেই। গাড়িটা যখন বাড়ির সামনে এসেছে টুকটুকির ফোন বেজে উঠল। অবাক হয়ে খেয়াল করল নন্দিনীর রুমমেট পালক ফোন করেছে। রিসিভ করতেই আতঙ্কিত, বিভ্রান্ত গলায় বলল,
“হ্যালো টুকটুকি আপু!”

“কীরে পালক, সব ঠিকঠাক?”

পালক কান্না সামলে বলল,
“নন্দিনী আপু আবারো সু’ই’সাইড এটাম্পট করেছে।”

“কীসব আজেবাজে বকছিস? তোরা কোথায় ছিলি?”

“এই সময় কেউ রুমে থাকে না, সবাই ক্লাসে। রুমে নন্দিনী আপু একাই ছিল। আমি ফিরে এসে দেখি ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। বারান্দার জানালা দিয়ে দেখলাম র’ক্তে ফ্লোর ভেসে যাচ্ছে। আমি কি করব বুঝতে পারছি না। তুমি জলদি আসো।”

টুকটুকির শরীরটা কেমন ঝিমঝিম করে ওঠে। কল্পনায় ভেসে ওঠে গত বছরের একটি করুণ দৃশ্য। খাটের বাইরে হাত ঝুলিয়ে নিথর পড়ে আছে তাদের ইকরি। র’ক্তের ধারায় ফ্লোর রঞ্জিত। আবারো সেই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি! টুকটুকি প্রেশার নেমে গিয়ে শরীর ছেড়ে দিল সিটে৷ নিশীথ ফ্যাকাসে মুখটা খেয়াল করেছে কথা বলার সময়ই। বলল,
“আপনি ঠিক আছেন? কার ফোন ছিল? সব ঠিক আছে?”

টুকটুকি বলহীন কণ্ঠে বলল,
“আমাকে ক্যাম্পাসে যেতে হবে। ইকরিকে বাঁচাতে হবে। ও এভাবে নিজেকে শেষ করতে পারে না। আমাকে যেতে হবে।”

টুকটুকির এতটুকু বাক্যেই নিশীথ বিপদের আভাস পেল। তড়িঘড়ি করে বলল,
“আমি নিয়ে যাচ্ছি। আপনি শান্ত হোন।”

টুকটুকি দৃঢ় গলায় মানা করল,
“আপনার সঙ্গে যাব না। গতবার গিয়েছিলাম বলে একজন খামখেয়ালি মেয়ের জন্য আপনার বাস্তববাদী জীবনে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছিল। এবার আর হতে দেব না।”

নিশীথ বাকরুদ্ধ হয়ে তাকায়। এরপর অসন্তুষ্ট চোখ ফেরায় ঝুমঝুমির দিকে। ঝুম অ’প’রাধীর মতো চোখ নামায়। বলে,
“আমি বাড়িতে জানিয়ে দেব। তোমরা যাও।”

টুকটুকি কথা না শুনে নেমে যেতে নেয়। নিশীথ শক্ত করে ওর হাত চেপে ধরে। ঘাড় ঘুরিয়ে ঝুমকে নেমে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। এরপর মায়ের ফোনে কল করে বলে,
“তোমার বন্ধুকে তার বন্ধুর কাছে নিয়ে যাচ্ছি। ফিরে এসে সব বলব। দয়া করে দেখো যেন কোনো কথা না ওঠে।”

নিশীথ ফোন কেটে গাড়ি স্টার্ট দেয়। টুকটুকি সিটে গা এলিয়েছে। আতঙ্কে তার মুখ র’ক্তশূন্য। হৃৎপিণ্ডটা ঘোড়ার বেগে ছুটছে। অশ্রুসিক্ত গলায় বারবার বিড়বিড় করে,
“তুই এভাবে হাল ছাড়তে পারিস না, ইকরি।”

চলবে…