শ্রাবণ কিংবা ফাগুন একটুখানি বর্ষণ পর্ব-৩৪+৩৫+৩৬

0
430

#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৩৪]

টুকটুকি যে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে ক্যাম্পাসে ছুটে এসেছিল দেখা গেল পরিস্থিতি তার উল্টো। যাকে নিয়ে এত চিন্তা, এত কান্না, আবেগের অবারিত ঢল সেই মহা মানবী বটতলায় বেঞ্চিতে দু-পা তুলে আসন করে বসে চায়ে বিস্কুট চুবিয়ে খাচ্ছে। চোখদুটো ঢুলুঢুলু, মনে হচ্ছে সদ্য ঘুম থেকে উঠে এসেছে। ঈষৎ কোকড়া চুলগুলো চওড়া করে পনিটেইল বাধা। পরনে ডেনিম প্যান্ট এবং সেমিলং ডার্ক ব্লু শার্ট। বাঁ হাতের কব্জিতে এঁটে থাকা সাদা ব্যান্ডেজটা যেন আহামরি কোনো বিষয়ই নয়। টুকটুকি হতবিহ্বল চোখে দেখে নির্বিকার নন্দিনীর কান্ডকারখানা। ভারী নিশ্বাসটা হালকা হয়ে এলে মনে রাগ জমতে শুরু করে। ওকে খেয়াল করে নন্দিনী খাওয়া থামিয়ে বলল,
“ওমা! কোইত্তে উদয় হইলি? লগে আবার জানেমান নিয়া আইছো!”

টুকটুকি দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে হিসহিসিয়ে উঠতে নিলে নন্দিনী অদ্ভুত ভঙ্গিতে চেয়ে বলল,
“দিনে দুপুরে ঠোঁট কা’মড়া’কা’মড়ি কইরা এমন আবেদনময়ী লুক দিতাছস ক্যান? লক্ষণ তো ডে’ঞ্জা’রাস।”

টুকটুকি ওর লাগামহীন কথায় রাগ দেখাতে গিয়ে কেঁদে ফেলল। বেঞ্চিতে বসে দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরে বলে উঠল,
“কেন এমনটা করলি? যদি কিছু হয়ে যেত।”

নন্দিনী বিরক্ত গলায় বলল, “গরমের মধ্যে চিপকাচিপকি করবি না। দম বন্ধ হইয়া গেল। ছাড় আমারে।”

টুকটুকির হাতের বাধন আরো শক্ত হয়। নন্দিনী কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা নিশীথকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আপনার কপালে অশেষ দুঃখ আছে, ভাই। এই মাইয়ার কান্দন সামলাইতে সামলাইতে অর্ধেক জীবন পার কইরা ফেলবেন।”

নিশীথের অভিব্যক্তি বোঝা গেল না। পকেটে দুহাত গুজে সে এক দৃষ্টে টুকটুকির কান্না দেখছে। বুঝতে পারছে নন্দিনীর পরিস্থিতিটা জটিল। বন্ধুদের বোঝাপড়ার উপযোগী পরিবেশ দরকার। নিশীথের উপস্থিতি যেমন তাদের জন্য বিব্রতকর তেমনই ওর জন্যও। নিশীথ ফোন হাতে ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল,
“অফিস থেকে এসেছি, গুরুত্বপূর্ণ কিছু ফোনকল রয়ে গেছে। আপনারা কথা বলুন। আমি গাড়িতে আছি।”

নিশীথ যেতে যেতেই অনুভব এসে হাজির। তার হাতে ওষুধ, বেদানা ফল, একটা স্যালাইনও আছে। ডাক্তার ভাইয়ের কাছ থেকে রোগীকে স্যালাইন দেওয়াটা সে শিখেছে। এখন নন্দিনীকে দেবার জন্য এনেছে। যে পরিমাণ র’ক্তক্ষ’রণ হলো! এখনো যে সোজা হয়ে বসে আছে তা ওর ভাগ্য।
অনুভব মীর মোশাররফ হলে উঠেছে কিছুদিন আগে। পালক ফোন করার পরই টুকটুকি ওকে জানিয়ে দেয়। মেয়েদের হলে ঢুকতে পারবে না বলে অনুভব ইমিডিয়েটলি দুজন মেয়ে ব্যাচমেটকে পাঠায় ভেতরে। দরজা খুলতে ধাক্কাধাক্কি করতে হয়নি। নন্দিনী একাই বেরিয়ে এসেছিল। হাত গড়িয়ে তখন র’ক্তের ধারা বইছে। পালকের দিকে চেয়ে ঠান্ডা স্বরে হুকুম জারি করেছিল,
“কেউ রুমে ঢোকার আগে ফ্লোর ক্লিন করবি। কাউরে এ ব্যাপারে কিছু বলবি না, কোনো কৈফিয়ত দিবি না। বাকিটা আমি বুইঝা লমু।”

নিচে নেমে আসার পর অনুভব ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে ছুটেছে। সবকিছু এতটা শান্তভাবে ঘটেছে যে মনেই হয়নি বিরাট কোনো কান্ড। অথচ ভেতরটা কি অস্বাভাবিক কেঁপেছে তা বাইরে থেকে অনুধাবন করা মুশকিল। অনুভব টুকটুকিকে দেখেই বলল,
“এ্যাই টুকটুকি, এই তারছ্যাঁড়া মাইয়ার গালে ঠাস ঠাস করে চ’ড় লাগা। সাইকো হয়ে গেছে। নাহলে নিজের হাতে ব্লে’ড চালিয়ে কেউ নির্বিকার থাকে? হল থেকে নেমে এসে কী বলে জানিস?”

“কী?”

“বলে, ‘শিকু, আমার না মা’তাল মা’তাল লাগতাছে। মনে হইতাছে আকাশে উড়তাছি। উড়তে উড়তে পাখিগো মতোন এক্সগো মাথায় পটি ফেলতেছি।’ চিন্তা কর কত্ত বড়ো ফা’জিল! ম’রতে বসে এক্সদের অনিষ্ট ভাবে। নেহাৎ আমি মাইয়াগো গায়ে হাত তুলি না। নয়তো পি’টিয়ে এতক্ষণে লেকের পানিতে ছুঁড়ে ফেলতাম।”

নন্দিনী চায়ের কাপে আরেকটা বিস্কুট ডিপ করেছে। এই কাজটা সে অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে করছে। একটু কম ভিজলে মচমচে থাকবে যা ওর পছন্দ নয়। আবার বেশি ভিজলে ভেঙে পড়ে যাবে। তাই পারফেক্ট টাইমে তুলে মুখে পুড়তে হবে। অনুভবের বকাবকি, টুকটুকির কান্না ওর কানে লাগছে না যেন।
টুকটুকি ধাক্কা দিয়ে বলল,
“এই মেয়ে তুই কি এবার দয়া করে একটু সিরিয়াস হবি?”

বিস্কুটটা ভেঙে চায়ে ডুবে গেছে। নন্দিনী বিরক্ত গলায় বলল,
“ক্যান? আমরা কি অপারেশন থিয়েটারে আছি নাকি সিটি দিতাছি যে সিরিয়াস হওন লাগব?”

অনুভব নিজের হাঁটুতে ঘু সি মে রে বলল, “দেখ এখনো কেমন ত্যাড়া কথা কয়।”

টুকটুকি স্বাভাবিক হয়ে বলল,
“তুই কী নিজেকে একটুও ভালোবাসিস না?”

নন্দিনী গা ছাড়াভাবে একটা দার্শনিক ভঙ্গি টেনে বলল,
“মাই ডিয়ারেস্ট টুকি সোনা, ভালোবাসা হইতাছে একটা জাল। একবার জড়াইলে সারাজীবনেও সেই জাল কেটে বের হওয়া মুশকিল। আমি বন্যপাখি। নিজের মায়ার জালে ধরা দিলে বন্য ডানা দুইখান হইয়া যাবে সামাজিক ডানা। আর সম্পর্কের জালে ধরা দিলে ডানা কাটা যাবে। যাহা আমি মোটেও চাহিনে। না না, কদাপি নহে। আমার জন্য মুক্ত আকাশ। সমাজটা তোদের থাক।”

টুকটুকি অধৈর্য হয়। কিন্তু এখন মাথা ঠান্ডা রাখা গুরুত্বপূর্ণ। সে কোনো সুস্থ মানুষের সঙ্গে কথা বলছে না। সাথের মানুষটার মেন্টাল হেলথ্ ব্রেকডাউন করেছে। আসলে দোষটা ওদেরই। নন্দিনী দুটো দিন কারো সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। ইদানীং প্রায়ই ওর কাছে সিগারেটের গন্ধ পাওয়া যেত। অবস্থা যে খারাপের দিকে এগোচ্ছে টুকটুকিদের বোঝা উচিত ছিল। দম নিয়ে বলল,
“কিন্তু পাখি, মুক্ত আকাশে ওড়ার ইচ্ছেটাই কিন্তু তোর ভালো থাকতে চাওয়া। না হলে এই সমাজেই থাকতে পারতি। ভালো থাকতে চাস বলেই সমাজ ছাড়তে চাস। তার জন্য কি সুস্থতা জরুরী নয়? তাহলে কেন নিজেকে কষ্ট দিস? এই নিয়ে কয়বার এমন কান্ড ঘটালি? আমার জানামতে ছয়বার। অজানায় কতবার ভাবতে চাই না। আমার তো মনে হয় তুই ভালো থাকতে নয়, আসলে উড়তে চাস পালিয়ে যেতে। কিন্তু পালিয়ে যাওয়া কি সমাধান? তুই-ই না আমাকে বুঝিয়েছিলি পরিস্থিতি থেকে না পালিয়ে মোকাবিলা করতে হয়। তাহলে নিজের বেলাতে কেন এই বৈরিতা? ডিপ্রেশন পুষে রাখলে তুই বাঁচবি আদৌ! এই পৃথিবীতে ভালোবাসার হাজারটা কারণ আছে। খারাপ থাকাটা ভুলে যা না। একটু নিজের কথা ভাব, প্লিজ!”

নন্দিনী চুপ রইল। যখন সে ঢাকায় পা রাখল কতই বা বয়স? এসএসসি এক্সাম দেওয়ার পর বাবা-মা বিয়ে ঠিক করল। তাও একজন বাজে মানুষের সঙ্গে, যে কিনা সম্পর্কে নন্দিনীরই কাজিন, রাজনীতিতে এক্টিভ। কিশোরকোমল নন্দিনীর কথা কেউ ভাবল না, মতামত চাইল না। খারাপ লোকের হাতে পড়ার থেকে বাঁচতে সব চেষ্টা যখন বিফলে উপায়ান্তর না পেয়ে বিয়ের আসর ছেড়ে পালালো সে। দুদিন লুকিয়ে থেকে এরপর যখন বাড়ি ফিরল তাকে আর কেউ গ্রহণ করল না। বাড়ি থেকে পালানো মেয়ে, আবার বাইরে দুরাত কাটিয়ে এসেছে। বাড়ির সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার অ’প’রাধে নন্দিনীর কোমলতাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হলো। খুলনা থেকে ঢাকা এসে একা একটা মেয়ে কলেজে ভর্তি হলো, নিজেকে নিজেই বাঁচিয়ে রাখতে লড়ে গেল নিষ্ঠুর শহরে। আজও সে একাই টিকে আছে। স্ট্রাগলিং একটা জীবন সে বহন করেছে একা। কেউ তাকে সাহায্য করেনি, কেউ না। একদিন না খেয়ে থাকলে কেউ জিজ্ঞেস করার ছিল না। একাকিত্বের য’ন্ত্রণায় থেকে বিনোদন হিসেবেই সে প্রেম ভাঙা গড়ার খেলায় মেতেছিল কিনা জানা নেই। তবে এতটা লড়াকু প্রাণশক্তি যার সে কেন মাঝে মাঝে অন্ধকারে তলিয়ে যেতে চায়? ওর ব্যক্তিজীবনটা সকলের কাছেই ধোয়াশা।

নন্দিনীর মৌনতা টুকটুকি ও অনুভবকে একটু স্বস্তি দিল এই ভেবে যে মেয়েটাকে ভাবনায় ফেলা গেছে। নিজেকে নিয়ে ওর ভাবনাটা দরকার। কিন্তু সেই আশায় জল ঢেলে নন্দিনী বলল,
“হাতে ব্লে’ড চালাইয়া মনে পড়ল আমার তো এহনো মিস্তিরি আর টিকটিকি, অনু আপা আর হাসুর বিয়া খাওন হয় নাই। বন্ধুর বিয়াতে নাচতে না পারলে কি করলাম জীবনে। লগে লগে দরজা খুইল্যা বাইর হইলাম। টেনশন নিস না। তোগো বিয়া না খাইয়া আমি কোত্থাও যামু না। আরেক পোলার তো এহনো কিছু হইল না। আমার যে কত চিন্তা! নিজেরে নিয়া ভাবার টাইম আছে!”

পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গেল দিগন্তের আগমনে। উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এসে নন্দিনীকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে। পিষে ফেলতে চায় বুকের মাঝে। অনুভব পাশে বসেও স্পষ্ট টের পেল দিগন্তের বুকের কম্পন। নন্দিনীর বর্তমান অবস্থা ওকে জানানো হয়নি। টুকটুকি সেই গাড়িতে থাকাবস্থায় কল করেছিল এরপর কারোই আপডেট জানাতে খেয়াল ছিল না। নন্দিনী চিড়বিড় করে উঠে বলল,
“এই ফ’ইন্নির পোলা, ছাড় আমারে। সবডি চিপকাচিপকি করা শুরু করছে। আমার কিন্তু এইসব একদম পছন্দ না, হালুইম্মা।”

দিগন্ত ছাড়ল বটে কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে নন্দিনীর গালে সপাটে দুটো চ’ড় ক’ষালো। আশেপাশের খাবারের হোটেলগুলোর লোকজন ঘটনা না বুঝলেও এতক্ষণ ওদের কান্ডকারখানা উঁকি ঝুকি দিয়ে দেখছিল। একটা ছেলেকে চড় মা’রতে দেখে তাদের আগ্রহের সীমা রইল না। নন্দিনী গালে হাত দিয়ে বজ্রাহ’তের ন্যায় চেয়ে থাকে। টুকটুকি বিস্ময়ে নির্বাক। অনুভব রেগে গিয়ে বলল,
“অসুস্থ মেয়েটার গায়ে হাত তুললি কোন আন্দাজে? মাথা কি গেছে?”

“যে ম’রতে চায় তাকে হাজার খানেক চ’ড় মা’রতেও আমার কোনো অনুশোচনা নেই।”

“হালুম, ইকরি নিজের জীবনে যা খুশি করতে পারে। আমরা ওকে বোঝাতে পারি বড়োজোর। তাই বলে তুই ওর গায়ে এভাবে হাত তোলার অধিকার রাখিস না।”

টুকটুকির কথায় দিগন্ত আরো বেশি ক্ষে’পে উঠল। নন্দিনীর সামনের চায়ের কাপ ছুড়ে ফেলে, র’ক্তনেত্রে চেঁচিয়ে বলল,
“ওর এক্সিডেন্ট-এর পর হসপিটালে রেখে আমি দিনরাত সেবা করে গেছি। নিজের যত্ন নিইনি। আমার ডিসিপ্লিনড বাবা-আম্মুকে পর্যন্ত তোয়াক্কা করিনি। ডাক্তার যা বলেছে, যেখানে বলেছে ছোটাছুটি করেছি। কোনো খেয়াল আছে কতটা প্রেশারে ছিলাম? তবুও নিরসল পাশে থেকেছি। কারণ ওকে সুস্থ দেখতে চেয়েছি। প্রতিবার অসুস্থ হলে ধরেবেধে ডাক্তার দেখিয়েছি। সব ফেলনা? উনার মন চাইবে আর হাত পা কে’টে নখরা করবে? আর আমরা তার দাস হয়ে সেবা করব?”

অনুভব বলল,
“আস্তে কথা বল। রাস্তায় সিনক্রিয়েট করিস না। তুই ভুলে যাচ্ছিস নন্দিনীর মানসিক প্রবলেম এটা। ও ডিপ্রেশনে ভুগে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এমনটা করে।”

দিগন্ত মেজাজ হারিয়েছে। কারো কথাই মাথায় ঢুকছে না। বলল,
“ওসব আমার চুলের ডিপ্রেশন। সবই এটেনশন পাওয়ার ধান্দা। বয়ফ্রেন্ড চড়িয়ে জীবন পার করা মেয়ে কিনা। পুরো জীবনটাই ওর নাটকে ভরা।”

নন্দিনী এতক্ষণ একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। বিস্ময়টা সামলাতে গিয়ে নিজেরই বেগ পেতে হয়েছে। ও নিরবে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুই অনেক দয়াবান। বাপের অর্থ আছে বলে আমার মতো ফকির-মিসকিনের পেছনে খরচ করে ঋণী করছিস। মায়ের মতোন সমাজ সেবা করছিস। আর না ভাই। আমার নাটুকে জীবনে তোরা কেউ আর জড়াস না। মাফ কর এবার। আর রইল তোর টাকা খরচের ব্যাপার তো? কড়ায় গন্ডায় শোধ না করে ম’রব না।”

নন্দিনী টান মেরে ব্যান্ডেজ খুলে ফেলে। ফিনকি দিয়ে ছোটে র’ক্তের ধারা। টুকটুকি দুর্বল মনের মেয়ে। সেই দৃশ্য দেখে আবারো শরীর ঝিমঝিম করে প্রেশার নেমে গিয়ে অনুভবের বাহুতে গা ছেড়ে দেয়। অনুভব নন্দিনীকে সামলাবে নাকি টুকটুকিকে বুঝে ওঠার আগেই নন্দিনী ছুটে চলে যায়। তবে নন্দিনী এবার আর কুলোতে পারল না। কিছুদূর যাওয়ার পরই পুরো দুনিয়া আঁধার হয়ে চোখের কবাট নেমে গেল।

চলবে…

#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৩৫]

নন্দিনীকে স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত র’ক্তক্ষ’রণেই কিনা ফ্যাকাসে হয়ে তার গায়ের রঙটা ফরসা লাগছে। বিছানায় চোখ বুজে পড়ে থাকা রুগ্ন অবয়বটিকে দেখে মনে হচ্ছে সব খুইয়ে সে আজ নিঃস্ব, অসহায়, ভঙ্গুর। তার আর পাওয়ার নেই, কোনোকিছু দেওয়ার নেই। শ্বাসটাকে পুঁজি করে দেহটিকে টিকিয়ে রেখেছে বহুকষ্টে। যখন সেটাও বোঝা মনে হয়, দেহ থেকে মুক্তির জন্য ছটফটিয়ে ওঠে। রুম জুড়ে নিগূঢ় নিস্তব্ধতা। থেকে থেকে নাক টানার শব্দ আসছে। নন্দিনী চোখ বুজে থেকেই বিরক্ত গলায় বলল,
“এই কান্দুনি, তোর চোক্ষের পানি কী আটলান্টিক মহাসাগর সাপ্লাই দেয়? একটা মানুষ এত কেমনে কান্দেরে ভাই! মাথা ধরে না? হুইন্যা হুইন্যা আমারই মাথা ধইরা গেল।”

টুকটুকির গলার স্কার্ফ ভিজে গেছে নোনা পানিতে। চোখ দুটি স্ফিত, লালিত। ও রুমালে নাক মুছে অভিযোগের সুরে বলল,
“তুই কী বুঝবি রে পাষাণ! জীবনেও তো আমাদের জন্য এক ফোঁটা চোখের পানি খরচ করিসনি।”

“তুই ম’রছিস? ম’রলে কানমু নাকি ভাইবা দেখা যাইব।”

“তখন কী আমি দেখতে পারব তুই কেঁদেছিস কিনা?”

“ওহহ তাও তো কথা। এক কাম করা যায়। ছিঁড়া কাপড় পিন্দা ফ্লাইওভারের নিচে গামছা বিছাইয়া বইয়া আমি বুক চাপড়াইয়া কানমু, তুই ম’রবি ম’রবি ভাব কইরা হুইয়া থাকবি। আমার কান্দাও হইব, তোর কান্দা দেখনের শখও মিটব। উপরি বিজনেসও হইব।”

“কান্না লেনাদেনার বিষয় নয় ইকরি। কান্না আমাদের আবেগের বহিঃপ্রকাশ। দুঃখ সহন করার মাধ্যম। মনের ব্যথা মনে চেপে শক্ত হয়ে থাকলে ব্যথা বাড়ে। কাঁদলে, কান্না ভাগ করে নিলে সেই ব্যথা প্রশমিত হয়। তুই একবার কেঁদে দেখ মনটা হালকা লাগবে।”

নন্দিনী ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
“কান্দুনি বিশারদ আইছে আমার। দুপুরে খাইছিলি? মনে তো হয় না। কানের কাছে প্যানপ্যান না কইরা খাইতে যা। পরে দেখা যাইব তোরে নিয়ে ছোটাছুটি করা লাগতাছে। যেই মোমের শরীর…”

টুকটুকির তখন স্মরণে আসে নিশীথের খোঁজ নেওয়া হয়নি। চলে গেছে নাকি রয়ে গেছে জানা নেই। ফোন করে খবর নেওয়ার কথা মাথায় আসতে মনে হলো নিশীথের ফোন নম্বর তার কাছে নেই। একটা মানুষ সঙ্গে করে নিয়ে এলো, সে গেল কিনা জানাটা ওর দায়িত্ব। কিন্তু পরিস্থিতি এমন বিগড়ে গেল যে অন্যদিকে খেয়ালই দিতে পারল না। নন্দিনীকে পালকের দৃষ্টিতে বন্দি করে টুকটুকি হল ছেড়ে বেরোয়।

সন্ধ্যা গড়িয়েছে সবে। পাখপাখালির ঘরে ফেরার নিনাদে মুখোরিত পরিবেশ। টুকিটুকি হাঁটতে হাঁটতে বটতলার দিকে এগোয়। নিশীথকে পাওয়া গেল তার গাড়ির ভেতর। একাগ্র মনে সে ল্যাপটপে আঙুলের ঝড় তুলেছে। টুকটুকি কাচে টোকা দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করল। নিশীথ দরজা খুলে বেরিয়ে বলল,
“নন্দিনী ভালো আছে?”

“খুব একটা না। শরীর দুর্বল। আপনি এখনো যাননি! সরি! আমি ওদিকে ব্যস্ত হয়ে খোঁজ নিতে পারিনি।”

নিশীথ ক্লান্ত আঙুলগুলো মুচড়ে বলল,
“ইটস ওকে। মা ফোন করেছিল। নন্দিনীকে দেখতে আসতে চাইল। আমি মানা করে বললাম কাল নিয়ে আসব। তখনই বলল সন্ধ্যা হচ্ছে, আপনাকে নিয়ে যেন ফিরি। তাই আপনি ফেরা অবধি কাজগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিলাম।”

টুকটুকির মুখ ভোঁতা হলো। মা বলেছে বলে রয়ে গেছে, নিজে থেকে নয়! তার বেহায়া মন কেন যে অন্যরকম কিছু আশা করে বসে! টুকটুকি বলল,
“আপনাকে একাই ফিরতে হবে। এই অবস্থায় নন্দিনীকে একা ছেড়ে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না। ওর দেখাশোনার জন্য কাউকে দরকার।”

নিশীথ মাথা নেড়ে বলল,
“যদি কিছু মনে না করেন, নন্দিনী কি ডিপ্রেশনে ভুগছে?”

টুকটুকি মাথা নেড়ে বলে, “আমাদের তাই ধারণা। ও মানসিকভাবে কঠিন কোনো ব্যধিতে আক্রান্ত। আমরা কেউই ওকে ভেদ করতে পারছি না।”

“সাইকিয়াট্রিস্টের স্মরণাপন্ন হননি?”

“গতবছর ধরে বেধে তিনজন নিয়ে গেছিলাম কাউন্সিলিং-এর জন্য। কিন্তু তিনি যে কোন জাদুময়ী নারী…”

“কাজ হয়নি?”

“হয়েছে, তবে অন্যখানে। সেই সাইকিয়াট্রিস্ট পরের সপ্তাহে সোজা ক্যাম্পাসে হানা দিয়েছিল। ইকরির প্রেমে অনেকদিন হাবুডুবু খেয়েছে বেচারা। নিজের সমস্যা কাটাতে গিয়ে ইকরি সাইকিয়াট্রিস্টকেই প্রেমের ডিপ্রেশনে ফেলে দিয়েছে। আপনি ভাবতে পারছেন কোন লেভেলের ধড়িবাজ! একে আর কোন উপায়ে চিকিৎসা দিতে পারি?”

নিশীথের ঠোঁট মৃদু হাসি দেখা গেল। টুকটুকি বলল,
“আরেকটা গোপন কথা শুনবেন?”
“বলুন।”
“ইকরি আপনাকেও লাইন মা রতে চেয়েছিল।”
“বলেন কি? তাহলে এগোলো না কেন?”

টুকটুকি ঈষৎ কপাল কুঞ্চিত করে বলল, “আপনার দেখি খুব শখ ওর এক্স হওয়ার!”

নিশীথ আত্মবিশ্বাসী হাসি দিয়ে বলল,
“আমি যাকে ভালোবাসব তার এক্স হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই রাখব না।”

“আপনার কিন্তু একজন এক্স ছিল। তুবা…” টুকটুকি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে মনে করিয়ে দেয়। নিশীথ দুহাত পেছনে গুজে দাঁড়ায়। টুকটুকির কান্নাভেজা, ফোলা চোখদুটি কেন জানি একটু বেশিই নজরকাড়া লাগছে। লাল লিপস্টিকের রেশ অল্পবিস্তর তখনো ঠোঁটে রয়ে গেছে। তাতে আকর্ষণ কিছু কমেনি। নিশীথ ওর চোখে চোখ রেখে দৃঢ় গলায় উচ্চারণ করে,

“আই রিপিট, আমি যাকে ভালোবাসব তার এক্স হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই রাখব না। তুবা আর আমি একে অপরকে পছন্দ করে একটা সুযোগ নিয়েছিলাম। পছন্দটা গ্রো করেনি বলেই পরিনতি টানতে ব্রেকাপ করতে হয়েছে। সম্পূর্ণটাই ছিল ফর্মাল, ইমোশোনাল এটাচমেন্ট ছিল না। ভালোবাসা হলে তুবা আমাকে ছাড়তে চাইলেও আমি ছাড়তাম না। বোঝা গেছে?”

টুকটুকি চুপ রইল। শ্লেষের সুরে নিজেকে বলল,
“আর আমার ভালোবাসা… কিছু অনুভূতি বোধহয় তৈরিই হয় অগোচরেই ঝরে যেতে।”
_________________

অনুভব উদাসীন হয়ে শান বাধানো বেঞ্চিতে বসে আছে। ক্ষণিক আগের অবস্থাটা ছোটোখাটো ধাক্কাই ছিল বটে। নন্দিনী ও দিগন্ত ডিপার্টমেন্টে টম এন্ড জেরি খ্যাত। সবসময় ঝগড়া, মা’র’পি’ট লেগেই থাকত তাদের। বাজেভাবে একজন আরেকজনকে হেনস্থা করেছে। চুল টানা, চি’মটি কা’টা, খা’মচি দেওয়া, কা’ম’ড়ানো কিংবা চ’ড়-থা’প্প’ড় সবই ছিল কিন্তু পরিস্থিতি হাতের নাগালে রেখে। সবটাই বন্ধুর সঙ্গে খুঁনসুটির পর্যায়ে থাকত। এবারের ঘটনা সম্পূর্ণই আকস্মিক ও কল্পনাতীত।
দিগন্তকে এক শব্দে ব্যাখ্যা করা যায় জেন্টেলম্যান। ভালো ছাত্র, ভালো বন্ধু এবং সর্বোপরি ভালো মানুষ। তার স্বভাববর্জিত আচরণে সকলেই স্তব্ধ। অসুস্থ নন্দিনীর গায়ে হাত তোলাটা অনুভবের কাছেও ভালো লাগেনি। বলিষ্ঠ হাতের আ’ঘা’ত মেয়েটির দুর্বল শরীর সহ্য করতে পারেনি। জ্ঞানহীন লুটিয়ে পড়তেই অনুভব নন্দিনীকে কোলে তুলে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিয়েছে দিগন্তকে। বাদ যায়নি টুকটুকিও। নিজেকে আহ’ত করা পাপ এই বোধটাই যার নেই তাকে সেই কাজের জন্য বোঝানোর বদলে শাসন করাটা বোকামি ব্যতীত কিছুই নয়। নন্দিনীর জ্ঞান ফিরেছিল কিছু সময় বাদেই। তৎক্ষনাৎ হলে ঢুকে গিয়ে কারো সঙ্গে আর কথা বলেনি সে। অনুভব ফোনের পর ফোন দিয়ে অনুনয় বিনয় করে বলেছে,

“আমার কষ্টের টাকায় কেনা ফল, ওষুধপত্র। কারো বাপের টাকায় না। দয়া করে এগুলো নষ্ট করিস না। আমি মোটেও তোর ওপর দয়া করছি না। আমার বোন অসুস্থ হলেও এটুকু করতাম, বউ অসুস্থ হলেও করতাম। দরকার পড়লে আরো এক ডজন পোলা জোগাড় করে দিমু তাও রাগ করিস না বাপ।”

অনুভবের আকুতির সঙ্গে টুকটুকি বুকফাটা কান্নায় ত্যক্তবিরক্ত হয়েই নন্দিনী স্যালাইন লাগাতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু দিগন্তের সঙ্গে যেই মনমালিন্য ঘটে গেল সেটা কিছুইতেও হজম হচ্ছে না। এই ঘটনার রেশ কতদূর বয়ে চলে কে জানে? অনুভব তপ্ত শ্বাস ত্যাগ করে। ভালো লাগছে না কিছুই। এলোমেলো ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটুকরো প্রশান্তির কথা মনে হলো। অনুভব ঝটপট ফোন দিল তাকে। ফোন রিসিভ করে আকাঙ্ক্ষিত রমনী প্রথমেই বিরস গলায় বলল,
“বলুন”

“কী ব্যাপার? কণ্ঠে এতটা নিস্পৃহ কেন? আমার ফোনে তুমি বিরক্ত?”

“এত ঘন ঘন ফোন করার জন্য কি উচ্ছ্বসিত হওয়ার কথা?” প্রিয়া সোজাসাপটা জবাব দিল।

অনুভব আহ’ত হয়। বলে,
“ঘন ঘন মানে? সেই সকালে একবার ফোন দিয়েছিলাম, আর মাত্র দিলাম।”

“অকাজের ফোন আমার কাছে ঘন ঘনই মনে হয়।”

“এত নিরামিষ কেন তুমি? তোমার তো উল্লাসে ফেটে পড়া উচিৎ যে সবচেয়ে সুন্দর ছেলেটা এত এত সুন্দরীদের পাত্তা না দিয়ে তোমায় যেচে ফোন করছে।”

“রূপ নিয়ে খুব গর্ব আপনার?”

“প্রতিপক্ষ যখন নিজেকে মুরুব্বি হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করে তখন আমারও জাহির করার মতো কিছু থাকা উচিত। ঠিক কিনা?”

প্রিয়া ঠোঁট টিপে হাসে। অনুভব আবার বলল,
“খেয়েছ হাসু?”

“খেয়েছি অনু ভাইয়া?”

“হোয়াট ননসেন্স! অনু ভাইয়া আবার কী?”

“আমারও একই প্রশ্ন, হাসু আবার কী?”

অনুভব দুষ্টু হাসে,
“আচ্ছা! শোধ নিচ্ছেন আপনি! কান খুলে শুনুন, আপনি আমার হাসমার্কা হাসু হয়েই থাকবেন চিরজীবন।”

“চিরজীবন?” প্রিয়ার কর্ণকুহর বিহ্বল হয়।

“দ্যা মোস্ট হ্যান্ডসাম গায় ইউ হ্যাভ এভার সিন, সে তোমায় হাসু বলে ডাকবে তার অন্তিম শ্বাস অবধি। তোমার তো গর্ব হওয়া উচিত।”

“গর্বে বুক ফেটে যাচ্ছে আমার। এখন রাখি।”

“আরেকটা কথা…”

“আবার কী?”

“প্রিয়া জানলে হিংসে করবে যে, হাসু ইজ দ্যা মোস্ট বিউটিফুল লেডি আই হ্যাভ এভার সিন ইন মাই লাইফ।”

কিছুক্ষণ শব্দের নিরবতা৷ নৈশব্দ তাদের নিশ্বাসে আগ্রা’সী প্রণয়ের নিনাদে মেতেছে৷ ছড়িয়েছে মা’দ’কতা। ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যার মৃদু দখিনা হাওয়ায় মন এলিয়ে অনুভব ফিসফিস করে বলল,
“হাসু লজ্জা পাচ্ছে? নাকি প্রিয়া হিংসে করছে?”

প্রিয়া তড়িঘড়ি করে ফোন কাটে। অনুভব স্ক্রিনে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসে। মনটা ভালো হয়ে গেছে তার। এবার দিগন্ত হা’রা’মীর একটা বিহিত করতে হবে।

চলবে…

#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৩৬]

রঙচটা দেয়ালঘেরা কেবিনের জীর্ণ বেডে চোখ বুজে শুয়ে আছে নন্দিনী। সর্বদা সাজিয়ে রাখা মুখটাতে আজ অযত্নের মলিন ছাপ। টুকটুকির জোরাজুরিতে গতকাল হসপিটালে চেকাপে আসতে হয়েছিল। ব্লা’ড টেস্ট করে জানা গেছিল তার হিমোগ্লোবিন লেভেল ছয়ে নেমে এসেছে। মাথা তুলে দাঁড়ানোর ক্ষমতাটাও নেই। ডাক্তার পরামর্শ দিলেন যত দ্রুত সম্ভব ওকে র’ক্ত দিতে হবে। নন্দিনীর ব্লা’ড গ্রুপ এ বি নেগেটিভ। ব্লা’ড ব্যাংক থেকে র’ক্ত নিতে কেউই আগ্রহী নয়। ডোনার খুঁজতে গিয়ে একটু সমস্যা হলো। ব্লাড গ্রুপ রেয়ার। নাগালে কাউকে পাওয়া গেল না। ফেইসবুকে হেল্প সিকিং গ্রুপে পোস্ট দিয়ে দূরান্তের কয়েকজন পাওয়া গেল বটে। কিন্তু মুশকিল আসান করে দিলেন স্বয়ং রিতা আন্টি। উনার মাধ্যমে জানা গেল নিশীথের ব্লা’ড গ্রুপও সেইম। নিশীথই নিজ উদ্যোগে ডোনেট করতে এগিয়ে এলো। ছুটির দিন হওয়ায় কেউ আর দেরি না করে আজকের মধ্যেই যাবতীয় কাজ মিটিয়ে নিতে চাইল। দুটো দিন বাদেই সিটি। নন্দিনী এখন আর ড্রপ দিতে চাইছে না। ভালো রেজাল্টের আশা ছেড়ে অন্তত এক্সাম এটেন্ড করতে হবে।

র’ক্ত দেওয়া শেষে নিশীথকে আধঘন্টা শুয়ে থাকতে বলা হয়েছে। সেই সময়টায় টুকটুকি তার জন্য একটা জুস কিনে এনেছে। সঙ্গে ফলের ডালি। নিশীথের বেডের পাশে নিঃশব্দে এসে দাঁড়ায় সে। নিশীথ দুচোখ বোজা অবস্থাতেই সে টের পেল পাশে কেউ দাঁড়িয়েছে। ফিনাইলের গন্ধ ছাপিয়ে গেল কারো দেহ নিসৃত আধিপত্যের সুবাস। মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল অজান্তেই।
টুকটুকি নরম সুরে বলল,
“আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব…”

“কী বলে দিতে চান?” নিশীথ চোখ মেলল। তার দৃষ্টি উৎসুক। যেন টুকটুকি কি বলে ধন্যবাদ দেবে জানতে তার আগ্রহের শেষ নেই।

টুকটুকি ক্ষণিকের জন্য ভড়কে গেল। কী বলে ধন্যবাদ দেবে এটা তো কথার কথা হিসেবে ব্যবহার হয়। সেও তাই করেছে। এই লোক সত্যি সত্যি চেয়ে বসবে কে জানত! চোখ পিটপিট করে বলল,
“না মানে দ্রুততম সময়ে এগিয়ে এসে অনেক উপকার করেছেন। ধন্যবাদের মতো শুকনো সৌজন্য দেখিয়ে ছোটো করলাম না। তারচেয়ে গলা ভেজান। ডাক্তার বলেছে জুস খেতে।”

নিশীথের রুক্ষ ঠোঁটের কোণে এক চিলতে দ্যুতি স্পর্শ করে। চোখের ইশারা করে বলে,
“দাঁড়িয়ে কেন? বসুন। নিচ থেকে আপনাকে তালগাছ দেখাচ্ছে। আর চুলগুলো তালগাছে ঝোলানো বাবুই পাখির বাসা।”

টুকটুকি রাগ করতে গিয়ে সংবরণ করে নেয়। মুখ ভোঁতা করে বসল নিশীথের বেডেই। কিঞ্চিৎ দূরত্ব তাদের মাঝে। নিশীথ ঠোঁট টিপে হাসে। আজ টুকটুকি তার ওপর রাগ দেখাবে না। পুনরায় বলল,
“আপনার ব্যস্ত হওয়া অনাবশ্যক। আমার অভ্যাস আছে।”

“আগেও দিয়েছেন?”

“ভার্সিটিতে থাকতে নিয়ম র’ক্ত করে দেওয়া হতো। অন্যরকম আনন্দ ছিল তাতে। গত তিন বছরে কাজে ডুবে আর হয়ে ওঠেনি। ভাবছি আজ থেকে আবার ভালো অভ্যাসটা গড়ে তুলব।”

টুকটুকির ভালো লাগল শুনে। মনে পড়তেই বলল,
“রিতা আন্টি আসতে চেয়েছেন আজ। নন্দিনীকে সঙ্গ দিতে চান। যদি মাতৃস্নেহে মেয়েটা একটু আরামবোধ করে। আমি কি আন্টিকে আনতে যাব? আপনার ঘন জার্নি করা উচিত হবে না আজ।”

কথাটায় সুক্ষ্ম করে যত্নের আভাস লুকিয়ে ছিল কি? নিশীথ সম্মতি দিল,
“আনতে পারেন।”

টুকটুকি চলে যাচ্ছিল। তখনই ফোন বাজল ওর। নিশীথ খেয়াল করল টুকটুকির মুখের পরিবর্তন। ফোন রিসিভ করে হু হা করে রেখে দিল সঙ্গে সঙ্গে। চোরা চোখে নিশীথকে দেখে চোখও নামিয়ে নিল। নিশীথ যেন বুঝে গেল সঙ্গে। গম্ভীর গলায় বলল,
“আপনার ফিয়োন্সে?”

“ওই আরকি…”

“সেই কি আপনার কল্পনার বর্ষণ রাজা?”

টুকটুকি ক্ষীণ হেসে বলল,
“হতে কতক্ষণ?”

নিশীথ চোয়াল শক্ত করে চেয়ে রইল। হুট করে সবকিছুতে বিতৃষ্ণা চলে আসছে। বুকের ভেতরটা কোনো এক অব্যক্ত অনলে জ্ব’লে ওঠে !
_______________

দিগন্ত চো রের মতো কেবিনের দরজায় উঁকি দিল। নন্দিনীকে র ক্ত দেওয়া হচ্ছে। শুকনো, নির্জীব পাতার মতো অনাদরে চোখ বুজে পড়ে আছে যেন। অনুভব পেছন থেকে দিগন্তের পিঠে ঘু’ষি দিয়ে বলল,
“হসপিটালে চু রি করতে এসেছেন?”

দিগন্ত সোজা হয়ে দাঁড়ালেও মুখটা চুপসে গেছে। অনুভবের একটা হাত আঁকড়ে ধরে মিনমিনে গলায় বলল,
“দোস্ত…দোস্ত…”

“হ্যাঁ বলেন, আমার কান পরিষ্কার। ভিক্ষা চাইতে আসলে দুঃখিত। আমরা বড়োলোকদের ভিক্ষা দেই না।”

“দোস্ত… তুই আমার দোস্ত।”

“নন্দিনীর বলা একটা ছড়া মনে পড়ল। দোস্তো দোস্তো, তুমি খাও গোস্তো, আমি খাই শুটকি, তুমি খাও বিলাইর…”

কথাটা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে দিগন্ত অনুভবকে শক্ত হাতে জাপটে করে। অনুভব হাত-পা ছোড়াছুড়ি করেও ওর থেকে ছুটতে পারল না। দিগন্ত ততক্ষণে তাকে দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরেছে। করিডোর মোটামুটি শান্ত নিঝুম হলেও যারা একটু বাদে বাদে আসা যাওয়া করছে, দুটো ছেলেকে জড়াজড়ি করতে দেখে অদ্ভুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে যাচ্ছে। অনুভব দিগন্তের পিঠে দুম দুম করে মা’রতে মা’রতে বলল,

“আব্বে হা’রামী, আমি কী তোর গার্লফ্রেন্ড লাগি যে দেয়ালে চেপে ধরে রোমান্স করতে আসছিস? কোনোভাবে ইকরির কথা সত্যি না তো? তুই পোলাগো উপরে… নাউজুবিল্লাহ!”

দিগন্ত চেপে ধরা অবস্থাতেই অনুভবের মাথায় নিজের মাথা দিয়ে ঠুকে দিল। চিড়বিড় করে বলে উঠল,
“শিকুর বাচ্চা… ইমোশনাল মোমেন্টে বাজে কথা বলবি না।”

“বাজে কাজ করলে বাজে কথাই বলব। তোর চোখ লাল কেন? নেশাপানি করে এসেছিস? মাই গড…”
অনুভব দুহাতে নিজেকে ঢাকার চেষ্টা করে মৃদু আর্তনাদে আওড়ায়,
“ছেড়ে দে শ’য়’তান। দেহ পাবি মন পাবি না।”

দিগন্ত অনুভবকে ছেড়ে দিল। বিমর্ষ গলায় উচ্চারণ করল,
“মাই হার্ট ফিল সো ব্যাড”

অনুভব শার্টের কলার ঠিক করতে করতে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“আজ গরীব বলে আমাগো হার্ট ফার্ট নাই।”

দিগন্ত আবারো ঝাপিয়ে পড়ে বলল,
“ঝোকের মাথায় কি যে করে বসেছি, আমার হাতদুটোর গ’র্দান নে, প্লিজ!”

“গর্দান যার কাছে চাওয়ার তারে গিয়া বল। আমারে বললে কোনো কাজ হবে না।”

“সুপারিশ তো করতে পারিস।”

“উহুম, কোনো স্বজনপ্রীতি চলবে না। নিজ যোগ্যতায় এগোও।”

দিগন্ত ভয়ে ভয়ে আবারো উঁকি দেয় কেবিনে। নন্দিনী চোখ বুজেই আছে। পিঁপড়ার মতো পিলপিল পায়ে কেবিনে ঢুকে বেডের পাশে আলগোছে বসল ও। নন্দিনী চোখ খুলেছে সঙ্গে সঙ্গে। কাউকে দেখেইনি এমন ভঙ্গিতে পুনরায় চোখ বুজতেই দিগন্ত নিজের বুকে থুতু দিয়ে কপাল কুচকে বলল,
“কে তুই পি’শা’চিনী? এখানে তো ইকরি-মিকরির থাকার কথা।”

নন্দিনী নিরুত্তর। প্রতিক্রিয়া দেখানোর প্রয়োজন অনুভব করল না। দিগন্ত আবারো বলল
“আচ্ছা… তুই-ই তাহলে ইকরি-মিকরি? মেকআপ করিসনি বলে চিনতেই পারছি না।”

নন্দিনী এবারও নিরুত্তর। দিগন্ত বলতে লাগল,
“অনেক ভেবে দেখলাম ফ’ইন্নির পোলা খুব কিউট একটা শব্দ। তোর মুখে এমন রুচিশীল শব্দ শুনতেও ভালো লাগে। একবার বলবি প্লিজ!”

সব আশা ছেড়ে দিগন্ত খপ করে ওর ক্যানোলামুক্ত হাত চেপে ধরে ভাষণ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
“হে মানবদরদী, দয়াবতী, মায়াবতী, ময়দাসুন্দরী, প্রেমবিলাসী, এক্সমোহন নন্দিনী, আপনার অশেষ দয়ার সিকিভাগ এই অধমকে দিয়ে কৃতার্থ করুন।”

নন্দিনী মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাতটা সরিয়ে নিল। গলা উঁচিয়ে অনুভবকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“কেবিনে বড্ড বেশি মাছির উপদ্রব। কানের কাছে ভনভন করতাছে।”

অনুভব শুনল বটে কিন্তু দুজনের মাঝে ঢুকল না। দিগন্ত বলল,
“ছিহ! তোর ঘেন্না লাগেনি একটা মাছিকে কা’মড়ে, খা’মচে দিতে?”

নন্দিনী এবার চোখ মেলে তাকায় ওর দিকে। দৃষ্টিজোড়া তীক্ষ্ণ। দিগন্ত চোখের ভাষা বুঝতে পেরে শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে কনুই পর্যন্ত তুলে গতসপ্তাহে নন্দিনীর দেওয়া খা’মচির দাগ দেখায়। কাতর গলায় বলে,
“তোর পুরুষ নি’র্যা’তন সহ্য করে টিকে আছি এতগুলো দিন। আর তুই আমার সামান্য দুটি ফুলের টোকা ভুলতে পারছিস না? তুই আমার ইকরি-মিকরি না।”

নন্দিনী নিরুদ্বেগে আবারো চোখ ফেরায়। মাথার ওপরের ফ্যানটা অলস ভঙ্গিতে ঘুরছে। সেদিকে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে দিগন্তকে দৃষ্টিসীমার বাইরে ছুঁড়ে দেয়। দিগন্ত হাল ছেড়ে ওর হাতের ওপর ঝুকে মাথা ঠেকায়। আজ পর্যন্ত ওরা কেউ ঝগড়া লাগলে সরি বলেনি। মা’রামা’রি, গা’লাগা’লির পরমুহূর্তেই প্ল্যান করেছে কোথায় ভালো বুফে খাওয়া যায়৷ কিংবা পকেটে টান পড়লে সবচেয়ে কম টাকায় কীভাবে নাশতা সাড়া যায়। সরি তাদের জন্য বন্ধু বহির্ভূত একটা শব্দ। আজ সেই বন্ধুবহির্ভূত শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে দিগন্তের জিভ আড়ষ্ট। তারচেয়েও বড়ো কথা মেয়েটির অবস্থা সে নিতে পারছে না। দিগন্ত ওর ইগো হার্ট করেছে। তাই কোনো যত্ন দেখাতে গেলেও নন্দিনী হজম করবে না। নিজের চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে এখন। ও সহজ স্বীকারোক্তি দিয়ে বলল,
“এই ব’দমা’শ মহিলা, তোর জ্বা’লায় আমি পড়াশোনা করতে পারছি না। সিটিতে এবার টপ লিস্ট থেকে ছিঁটকে যাব মনে হচ্ছে। এ কি অধঃপতন আমার! যে হাত দিয়ে মে’রেছি সেই হাতে ঠিকমতো খেতেও পারছি না। জীবনে একটা সাহসী কাজ করার বদৌলতে হাতটাকে কেটে সোনার ফ্রেমে বাধিয়ে রাখতে মন চাইছে। তুই কি একটু সাহায্য করবি?”

নন্দিনী দাঁতে দাঁত চেপে আবারো অনুভবকে বলল,
“হাতের ওপর আফ্রিকান হাতি উঠছে মনে হইতাছে। আমার কিন্তু বিরক্ত লাগতাছে, শিকু। উইঠ্যা যামুগা!”

দিগন্ত আহ’ত চোখে তাকায়, “আমার মতো নিট এন্ড ক্লিন মানুষকে কীট-পতঙ্গ, হাতি ছাড়া আর কোনো ভালো শব্দ বলতে পারিস না?”

অনুভব দূরে দাঁড়িয়েই খিকখিক করে হাসছে। এমন সময় রিতা আন্টি এসে উপস্থিত হলেন। পরিবেশটা হালকা হয়ে গেল মুহূর্তেই। তিনি কুশল বিনিময় করে নন্দিনীর পাশে বসে বললেন,
“আমি কি একটু একা কথা বলতে পারি?”

দিগন্ত ও অনুভব বেরিয়ে গেল কেবিন ছেড়ে। টুকটুকিই মূলত উনাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে এনেছে নন্দিনীকে নরম করে যদি ভেতরের কথা কিছু বের করে আনা যায়। নন্দিনী প্রশ্নোক্ত চোখে তাকালে রিতা আন্টি ওর মাথার হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
“অসুখ হলে মনে হয় না কেউ যদি একটু আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিত, যত্ন করে খাইয়ে দিত, পাশে বসে রাত পার করে দিত?”

“টুকটুকি সবই করে।”

“করে। মন থেকেই করে। কিন্তু তোমার মন কি তাতে পুরোনো কোনো মমতা খোঁজে না?”

নন্দিনী বিভ্রান্ত চোখে চায়। খোঁজে কী? রিতা আন্টি বললেন,
“বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ে?”

নন্দিনীর চোখমুখ ক্রমশ শক্ত হয়ে আসে। মুখশ্রীতে খেলে যায় রক্তিম উত্তাপ। বিতৃষ্ণা ভরে উচ্চারণ করে,
“আমি তাদের ঘৃণা করি।”

মেয়েটির গলার কাঠিন্য এতটাই দৃঢ় শোনায় যে রিতা আন্টি চমকে ওঠেন।

চলবে…