শ্রাবণ কিংবা ফাগুন একটুখানি বর্ষণ পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0
449

#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৩৭]

নন্দিনী ঘাসের বুকে পিঠে ঠেকিয়ে শুয়েছে। কাজলবিহীন ক্লান্ত চোখ মেলে ধরেছে আকাশের বুকে। পাশেই অবিন্যস্ত হয়ে বসে আছে অনুভব, টুকটুকি। সকলের মাঝে নিস্তব্ধতা পাক খাচ্ছে। অব্যক্ত হাহাকার মনের কোণে উঁকি দিচ্ছে। দুমাস পেরিয়ে তাদের সিটি শেষ হয়েছে। গ্রেজুয়েশনের চার বছরের প্রাণোচ্ছল যাত্রা শেষ হওয়ার সাইরেন বেজে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। স্মৃতির পল্লব আবেগতাড়িত হয় পূর্বদিনের সোনালি মায়ায়। সোনালি মায়া! বর্তমান যে মুহূর্তটাকে উপভোগ্য করে ঠেলে দেয় সময়ের স্রোতে। সেই অতীত মানপটে বারবার বর্তমান ভ্রমণ করে হয়ে ওঠে মুল্যবান। এই উপভোগ্য বর্তমানটা স্থায়ী হবে তো! ছিঁড়বে না তো মায়ার সুতো!
দিগন্ত এলো মিনিট দুই বাদে। হাতে চারটে কোল্ড ড্রিংক। সবাইকে হেলে ছড়িয়ে বসে থাকতে দেখে ধমকে বলল,
“তোদের ওয়েটারগিরি করেই পুরো গ্রেজুয়েশন কাটল আমার। খেয়ে উদ্ধার কর।”

টুকটুকি, অনুভব হাত বাড়িয়ে নিজেদেরটা নিল। নন্দিনীর ভাবান্তর হলো না। নিষ্পলক দৃষ্টি একটুও নড়ল না।
টুকটুকি আর্ত গলায় বলল,
“সিটি শেষ। গ্রেজুয়েশনের লম্বা পথ সাকসেসফুলি পাড়ি দিয়ে ফেলেছি আমরা। বড়ো হয়ে যাচ্ছি সবাই। আমার না খুব কান্না পাচ্ছে।”

অনুভব বিরক্ত গলায় বলল,
“এখনো ভাইবা বাকি আছে। আন্ডা পেলে এমনিতেও নাকের পানি চোখের পানি এক হয়ে যাবে। কাজেই বাঁচিয়ে রাখ। হালুমের জন্য না হলেও আমাদের দুজনের হয়ে একটু কেঁদে দিবি তখন।”

নন্দিনী তখনো বিকারহীন। দিগন্ত ধমক দিয়ে বলল,
“চিতল মাছের মতো চ্যাপ্টা হয়ে পড়ে আছিস কেন?”

নন্দিনী চোখ সরিয়ে ওদের পানে চায়। আকাশের মতোই নির্নিমেষ দেখে। তিনটে মুখ, প্রিয় তিনটে চেহারা গত চার বছরে তার একান্ত আপন, একান্ত প্রিয়জন হয়ে উঠেছে। বি’ষাক্ত পৃথিবীতে একটুকরো শান্তির নিবাস তারা। যত্ন, আদর, শাসন, দুষ্টুমি, ফাজলামি কিংবা গোপনে অনিষ্ট সাধন সবকিছুর সঙ্গী ওরা। তাকে বাঁচিয়ে রাখার, বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছে। ম’রতে চাইলে একটা কারণই যথেষ্ট। কিন্তু বেঁচে থাকার হাজারটা কারণ আছে। ওরা বোঝাতে চেয়েছে পৃথিবী কতটা সুন্দর। নিশ্চয়ই ওদের কাছে ওদের পৃথিবী সুন্দর। পরিবার, আত্মীয়, সমাজ সবাই ওদের সেটা অনুভব করিয়েছে। আপন মানুষকে ঘিরে ওদের সুখ জড়িয়ে আছে। আপন মানুষগুলোর সুখেও ওরা জড়িত। দিনশেষে ওদের কেয়ার করার মানুষ আছে। কিন্তু সেটা তো ওদের পৃথিবী। নন্দিনীর নয়। সে কী করে পাবে ওদের পৃথিবীর সৌন্দর্যের স্বাদ!

প্রত্যেকে একই পৃথিবীতে জন্ম নিলেও তাদের পরিমন্ডল আলাদা। সেই পরিমন্ডলে পৃথিবীকে চেনার ভাষা আলাদা। সুখের সংজ্ঞা আলাদা। কেউ দিনশেষে দুমুঠো খেতে পেলেই খুশি, কেউ অভাববোধ দূর করতে পারলেই খুশি, কেউ চায় স্টেটাস, মান-মর্যাদা, চায় বেকারত্ব ঘোচাতে, কেউবা প্রেমেতেই সুখী, কেউ ক্ষমতায়। সকলের দুঃখের সংজ্ঞাও আলাদা।
অনুভব তার ভাই-ভাবীর গন্ডি থেকে ছিটকে পড়ে অভাব, দায়িত্ব, বেকারত্ব চিনতে শিখেছে। এই সমাজে টিকে থাকতে তার চাই ভালো চাকরি, সে জন্য দিনরাত খেটে যাচ্ছে।

অন্যদিকে পরিণত বয়স হলেই যে মানুষ ম্যাচিওর হয়ে যায় না তার উদাহরণ টুকটুকি। সে স্পর্শকাতর। যুবতী হয়েও আটকে আছে কৈশোরে। তার কোমল মন ছোটো ছোটো জিনিসে যেমন খুশি তেমনই ছোটো আঘা’তে নড়ে ওঠে। প্রেম নিয়ে ওর নানান ফিলোসোফি থাকা সত্ত্বেও জীবনে একবারই প্রেম তাকে ছুঁয়েছে৷ অবহেলায় আহ’ত হয়ে গভীর ক্ষ’ত তৈরি করেছে। মন দিয়ে পরিচালিত টুকটুকির দুঃখের ভার মনেরই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ওপর।

আর দিগন্ত, অর্থ-বিত্তের মাঝে বড়ো হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও যোগ্যতায় এগিয়ে সবার চেয়ে। প্রতিভার পুরষ্কারে যার ঘর ভর্তি। এত গৌরব পূর্ণ জীবন হওয়া সত্ত্বেও তার জীবনটাকে শূন্য মনে হয়। সে পায়নি পরিবারের সান্নিধ্যে। বাবা-মা উভয়ই ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটেছে। সন্তানের মন বোঝার চেষ্টা করেনি। সময় দিতে পারেনি। দিগন্তের দুঃখ পেটের দায়ে নেই, প্রেমেতেও নয়, সে পায়নি আত্মিক বন্ধনের সুখ। মত প্রকাশের স্বাধীনতাও সেখানে খর্ব। চাবি দেওয়া পুতুলের মতো একটা নির্বিবাদ, নিয়মানুবর্তী জীবন বয়ে গেছে।

ওদের প্রত্যেকের লাইফস্টাইল আলাদা। দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। তিন রকম সমাজের চিত্র ওরা বহন করে। একজনের অবস্থান থেকে অন্যের দুঃখ পরিমাপ করা যাবে না। প্রত্যেকের য’ন্ত্র’ণার স্বাদ এক না হয়েও বেদনার। তবুও দিনশেষে ওদের পৃথিবীতে বেঁচে থাকার, সুখে হাজারটা কারণ আছে। ওদের পৃথিবী ম্লান নয়। কিন্তু এটাও রুঢ় সত্যি সেই পৃথিবী নন্দিনীর না থাকলেও ওদের প্রত্যেকের দুঃখের ভাগ নন্দিনীর পৃথিবীতে আছে। অনুভবের মতো পেটের দায় আছে। টুকটুকির মতো প্রেম ছুঁয়ে পাওয়া বিরহ না থাকলেও, অপ্রেমে তার হৃদয় খরাবেষ্টিত। দিগন্তের মতো পারিবারিক গভীর সান্নিধ্যও তার কোনোকালে ছিল না। ছিল না বোঝার মতো কেউ। সমাজের অনেকগুলো হাহাকারের চিত্র সে একা ধারণ করে নিজের মাঝে। এতসবের মাঝেও নন্দিনী পৃথিবীটাকে সুন্দর মানে এই তিনজন মানুষের জন্যই বোধহয়। বেঁচে থাকার কারণ না হলেও ভালো থাকার এক এবং একমাত্র কারণ ওরা। কিন্তু কয়েক দিন ধরেই নন্দিনীর অস্থির লাগছে। যার শুরু আছে তার শেষও আছে। ইদানীং বারবার মনে হচ্ছে এই পথচলার সমাপ্তি আসতে চলেছে। হারিয়ে যাবে সবাই। কিংবা হারিয়ে ফেলবে!

নন্দিনীর পাণ্ডুর মুখ, বিহ্বল দৃষ্টির ভাষা ওরা কেউই ধরতে পারল না। টুকটুকি গায়ে হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“ইকরি, তুই ঠিক আছিস?”

নন্দিনী হাই তুলে উঠে বসে। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলে,
“ভাবতেছি আজকে তোগো ট্রিট দিমু।”

“কি!” বিস্ময়ে তিন বন্ধু হতবাক। গত চার বছরে এমন আশ্চর্যজনক কথা তারা দ্বিতীয়টি শোনেনি। অনুভব বলল,
“আরে আমরা ভুল শুনছি। ইকরি নিশ্চয়ই শব্দে গুলিয়ে ফেলেছে, তাই নারে?”

নন্দিনী চোখ ছোটো ছোটো করে চেয়ে বলল,
“আমি ঠিকই কইছি, তোরাও ঠিকই হুনছোস।”

তিন বন্ধু চিৎকার করে লাফিয়ে উঠল। অনুভব বলল,
“কই খাওয়াবি মামা? বুফে ছাড়া কথা হবে না।”

“হ বুফেই তো, ক্যান্টিন বুফে।”

“মানে?”

“মানে ক্যান্টিনে যতপ্রকার খাওন আছে তার প্যাকেজই গরিবের ক্যান্টিন বুফে।”

“হা’লা জাত কিপ্টা।”

নন্দিনী খিকখিক করে হাসছে। সকলের বোকা বোকা মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বলল,
“বেশি খাইস না। বিয়া খাওনের লইগ্যা পেট খালি রাখ। অনুর তো হাসুর লগে অলসেট। খালি একটা চাকরি লইব আর বিয়া। অন্যদিকে ব’লদা টুকটুকি নিশীথবাবুর কাছে আত্মসমর্পণ না করলেও বিয়া আটকাবে না। সাংবাদিক তো আছেই। আটকাইব খালি ফই’ন্নির পোলা হালুমের। এর কোনোগতি দেইখ্যা যাইতে পারমু না মনে হয়।”

দিগন্ত স্থিরদৃষ্টি ওর তাম্রোজ্জ্বল ত্বকে নিবদ্ধ করে বলল,
“আর তোর কী গতি হবে শুনি?”

নন্দিনী উত্তর না দিয়ে শুধু হাসল। হাসিটা বড্ড নিষ্প্রাণ!
_________________

পরীক্ষার ঝামেলা শেষ বিধায় টুকটুকির পরিবার এবার উঠেপড়ে লেগেছে বিয়ের আয়োজনে। সেই নিয়ে দুই পরিবারে ঘন ঘন ফোনালাপ, দেখা সাক্ষাৎ লেগেই আছে। রাকিব মিডিয়া নিয়ে আরো দক্ষ হতে ডিগ্রি নিতে লন্ডন যাবে কয়েকদিন বাদেই। বছর দেড়েক লাগবে ফিরতে। তার আগেই আকদ করে ফেলার ইচ্ছে দুই পরিবারের।
মেঘলা দিনের গুমোট দুপুরের মতোই টুকটুকির আজ মন ভালো নেই। মনের সঙ্গে যু দ্ধে মেতে আজ সে ক্লান্ত, পরাজিত। মনের প্রভাব শরীরেও পড়েছে। হাঁটাচলার শক্তিও কেমন কমে যাচ্ছে দুদিন ধরে। বারবার মনে হচ্ছে কিছু হারিয়ে যাচ্ছে। হারানোর আগেই ধরে ফেলা উচিত। আড়ষ্টতা ধরতে দিচ্ছে না।

আজ রাকিবকে সময় দেওয়ার কথা বিকেলে। একদম সাদামাটা রূপে যাবে ঠিক করেও হঠাৎ কি মনে করে আলমারি থেকে বেছে বেছে একটা মেরুন রঙা শাড়ি বের করে গায়ে চড়ায় টুকটুকি। খোলা চুল, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, চোখে কাজল দিতেও ভোলে না। দুই হাত ভরে কাচের দুমুঠো চুড়িও পরে নেয়।

টুকটুকি রাকিবের সঙ্গে দেখা করতে বেরোলো না। পথে নেমেই উল্টো ঘুরে চলে গেল রিতা আন্টির বাড়ি। শুক্রবার বিধায় নিশীথ বাড়িতেই উপস্থিত। কলিংবেলের শব্দ শুনে দরজাও সেই খুলল। মেয়েটির সাজ দেখে যুগপৎ মুগ্ধ ও চমকিত হয়ে বলল,
“আজ কোনো বিশেষ দিন?”

“আমার বিয়ের তারিখ ঠিক হবে। এই সাজে কি পাত্রপক্ষকে মুগ্ধ করতে পারব?”

নিশীথের কণ্ঠদেশ শুষ্ক হয়। কোনোমতে উচ্চারণ করল,
“পারবেন।”

“কী করে বুঝলেন? আপনি কি মুগ্ধ?” বলতে বলতে টুকটুকির চোখ ভিজে উঠল। কাজল লেপ্টে গেল চোখের কিনারায়। নিশীথ বিপন্ন চোখে সেই কান্না দেখে। অশ্রুর ফোঁটা যেন শব্দ হয়ে ধরা দেয় দৃষ্টিতে। দমবন্ধকর, হাঁসফাঁস লাগা মুহূর্তটা ঠিক কতক্ষণ ওদের মাঝে স্থায়ী ছিল ওরা জানে না। শুধু জানে এই কান্না মিথ্যা নয়, এই সময় মিথ্যা নয়। কান্নার আর্জিও নক্ষত্রের মতো ঝলমলে। নিশীথ দুর্দশাপন্ন বোধ করে। কঠোর মনের মানুষ কেন এত সহজে নিজেকে প্রকাশ করতে জানে না? তাহলে সময়টা আরেকটু মহিমান্বিত হতে পারত না কি?

টুকটুকি নতনেত্রে চলে যেতে নিলে নিশীথ ওর পেলব হাতটা সজোরে টেনে ধরে। চলনে অধিকারবোধ ফুটিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যায় গাড়ি বারান্দায়। টুকটুকি নির্বাক চোখে তার হাতের টানে এগিয়ে যায়। নিশীথ গাড়ির ফ্রন্ট সিটের দরজা খুলে ওকে বসিয়ে দিয়ে নিজেও চড়ে বসে ড্রাইভিং সিটে। টুকটুকি জানতে চায়,
“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”

নিশীথ ওর কথার উত্তর না দিয়ে মাকে ফোন করে বলল,
“মা, তোমার ছেলে এবার তোমার প্রিয় বন্ধুটাকে নিয়ে সত্যি সত্যিই পালাচ্ছে।”

টুকটুকি সিটের সঙ্গে লেগে গিয়ে বিস্ময়ে উচ্চারণ করে,
“কী বলছেন?”

নিশীথ কড়া চাহনি দিয়ে বলল,
“আপনার আপত্তি আছে? থাকলে এখনই নেমে যাবেন। নয়তো কখনো নয়।”

ক্ষণকাল আবারো নিস্তব্ধ কাটে দুজনের মাঝে। টুকটুকি সিটবেল্ট লাগাতে লাগাতে বলল,
“কখনো নয়।”

চলবে…

#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৩৮]

“আমি পারব না, ইকরি।”

“থা’বড়া দিয়া চাপার দাঁত লাড়াইয়া দিমু। পারবি না যখন ভালোবাসতে গেলি ক্যান? গেলিই যখন জানাইতে পারবি না ক্যান? কোন গ্রন্থে লেখা আছে যে পুরুষ মানুষই আগে প্রেম নিবেদন করব, মাইয়া মানুষ পারব না? আইচ্ছা সরাসরি প্রেম নিবেদন নাই বা করলি আচরণে প্রকাশ তো করতেই পারবি।”

“কী করে পারব? ওই লোক দেখা হলেই আমার সঙ্গে ঝ’গড়া বাধায়। মানছি ভালো বিতার্কিক তাই বলে আমার সঙ্গেও কম্পিটিশন করতে হয়?”

“কিন্তু এটাও ঠিক নিশীথ অযৌক্তিক কথা কয় না। মাঝখান দিয়া ব’ল’দামিটা তুই-ই কইরা আইছোস প্রতিবার।”

টুকটুকি নিশ্চুপ। বলাইবাহুল্য কেঁদে কেঁদে তার গলা ভেঙে যাওয়ার যোগাড়। একটু পরই রাকিবের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার কথা, বিয়ের জন্য ওর হাতের মাপের আংটি কিনবে। দুর্বল শরীর, ভঙ্গুর মন তাকে ধরে রাখতে অক্ষমতা প্রকাশ করছে প্রতি ক্ষণে। নন্দিনী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আবেগপ্রবণ মানুষ যতই জেদি হোক এদের কোমল মনকে বশ করতে হয় আদর দিয়ে, মমতা দিয়ে৷ নন্দিনী নরম গলায় বলল,

“দেখ টুকি সোনা, ভালোবাসায় ইগো থাকতে নেই। তখন সেইটা ল’ড়াইয়ে পরিণত হয়। ভালোবাসা হতে হবে পানির মতো নিরাকার। প্রিয় মানুষটার জন্য যখন যেই অনুভূতি হবে, সেই অনুভূতির আকারে ভালোবাসাকে প্রকাশ করতে হবে। মনের খেয়ালে হোক কিংবা তীব্র আবেগে, নিশীথের এই ড্যাম কেয়ার ব্যক্তিত্ব দেইখাই কিন্তু তুই প্রেমে পড়ছিলি। পড়ছিলি না? এখন এইটা তো কোনো দৈব বাণী নিশীথরে জানাইয়া দিতে পারব না টুকটুকি নামের একটা মেয়ে তার বিরহে জ্ব’ইলা পুই’ড়া যাইতাছে। যেই ভালোবাসায় ভালো চাওয়া আছে, যেই ভালোবাসায় অন্যের অনিষ্ট নেই সেই ভালোবাসা হতে হবে প্রকাশযোগ্য। প্রকাশটা করতে হইব তোরেই।”

“কিন্তু উনি কী বলেছে সেটা ভুলিস না। খামখেয়ালি মানুষ উনার অপছন্দ। তাহলে আমি কেন নিজেকে আরেকবার ছোটো করার সুযোগ দেব?”

“এইক্ষেত্রেও আমার একটা যুক্তি আছে। কারো পক্ষ সমর্থনে না। শুধু তোর মনকে পজিটিভ সাইড দেখাইতে। জানিস তো রাগ মানুষের সবচেয়ে বড়ো শত্রু। রাগের বহ্নিশিখায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা এক লহমায় বদলায়। একটা স্বাভাবিক শব্দও ভুল আচরণের কবলে অস্বাভাবিক হইয়া যায়৷ প্রিয় মানুষরে অপ্রিয় বানায় দেয়। নিশীথ হুট কইরা বদনামের ধাক্কাটা সামলাইতে পারে নাই। আর এইটা এক্কেবারে নরমাল। উনার জীবনে যা আছে সবই সুনাম। পড়াশোনা, ক্যারিয়ার, ব্যক্তিজীবন কিংবা পারিবারিক সব দিকেই সুনামের দাবিদার একটা মানুষ হুট কইরা বদনামের কবলে পড়লে ধাক্কা সামলাইতে পারব না। নিশীথও পারে নাই। মন মেজাজ বিক্ষিপ্ত ছিল।
মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হইল যার জন্য ক্ষো’ভ জন্মাইছে তার ওপরে ঝেড়ে আত্মতুষ্টি অর্জন করা। নিশীথ তো মহামানব না। সেও তাই করছে। কিন্তু রাগ পড়ে গেলে তখন শুধু আফসোসটাই তাজা থাকে। হয়তো নিশীথের তা হইছিল আবার হয়তো না। তুই সেটা নিশ্চিত না। কারণ ধাক্কাটা তোর মনেও কম লাগে নাই। দূরত্ব বাড়াইতে তিনমাস বাড়ি ছাড়ছিলি। দূরত্ব কিন্তু বাড়ে নাই। উল্টা বুঝতে পারছিস তুই আসলেই তোর অসামাজিক, নাকউঁচু ইঞ্জিনিয়ারকে ভালোবাসিস। এই উপলব্ধিটারও কিন্তু দরকার ছিল। নয়তো কখনো হয়ত ভেবে বসতি তুই হয়তো তার রূপ কিংবা ব্যক্তিত্বের সাময়িক মোহে পড়ছিলি।”

টুকটুকি মন দিয়ে শুনল সব কথা। বুঝলও। এরপরে বলল,
“কিন্তু তাতে তো উনার অভিযোগ মিথ্যা হয় না। আমরা সম্পূর্ণ দুই মেরুর দুইজন মানুষ। আগের গার্লফ্রেন্ডকেও তিনি এমন কিছুর জন্যই ছেড়েছিল।”

“বোকা মেয়ে, তুই-ই না কইছিলি ওইটা ট্রাইং রিলেশনশিপ ছিল। যাকে উনি অনায়াসেই পেয়ে গেছিল, অর্জন করে নাই, অনুভবও করে নাই। জাস্ট একটা সুযোগ দেওয়া জীবনকে যে কিছু হয় কিনা। মানুষ পেয়ে যাওয়া জিনিসের পূর্ণতা যতটা বোঝে, না পাওয়া জিনিসের শূন্যতা তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি বোঝে। সেই প্রসঙ্গে গিয়া আমাগো কাম নাই। সব মানুষ সমান গুরুত্বপূর্ণ হয় না। যাকে আমি ভালোবাসব আর যাকে বাসব না তাদের গুরুত্ব কখনো এক হবে না। তুই নিজের জীবনে ফোকাস কর। তোর লগে নিশীথের আচরণ কেমন, কতটুকু পরিবর্তন হইছে তাতে মন দে।
নিশীথকে কাছ থেকে দেখে চিনেছিস তো তুই। এমন মানুষ নিজের দুর্বলতা জাহির করতে পছন্দ করে না। নয়তো রিতা আন্টির মতো মিশুক মানুষের সঙ্গেও তোর মতো একটা বন্ডিং ওদের মা-ছেলের থাকত না কি? তা কিন্তু নাই। অথচ নিশীথের কোনো বাজে রেকর্ড নাই। এক শব্দে জেন্টেলম্যান। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ততা নাই। মনের খোলস ছেড়ে সহজে বের হইতে পারে না। তবে কেউ টেনে নিশ্চয়ই বের করতে পারে। তোর সেই পদক্ষেপটা নিতে আপত্তি কই? মনের কথা একবার জানাইলি এরপর যদি নিশীথ সাড়া না দেয় তবুও আফসোস থাকব না। বরং মনেরে বুঝ দিতে পারবি যে তুই চেষ্টা করছোস কিন্তু কপালে আছিল না। কোনো চেষ্টা না কইরা দুইজনেই ইগো ধইরা রাখলে অন্যরে বিয়া কইরা সংসার পাইত্তা নিজের লগে সেই পার্টনারের সুখেরও চৌদ্দটা বাজাবি। এরপর খালি আফসোস করবি। সারাজীবনের আফসোসের চেয়ে একবার ফিলিংসটারে ওপেনলি ডিল করা মাচ বেটার অপশন। গ্রো আপ মাই লিটল গার্ল, কিছুক্ষণের জন্য যা হবে তা দেখা যাবে টাইপ এটিটিউড আন। আর খুইল্লা দে মনের দুয়ার। হয় ভ্রমররে মনে ঢুকতে দিবি নয়তো মুখের ওপর এত জোরে দরজার খিল দিবি যেন জিন্দেগীতে আর খুলতে না পারে।”

“যদি খিল দিতে হয়?” টুকটুকির সংশয় কাটে না।

“সম্ভাবনা নাই। আমরা যারে অপছন্দ করি স্বভাবতই চেষ্টা করি তারে এড়িয়ে চলার কিংবা পাত্তা না দেওয়ার। নিশীথ দুইটার একটাও করে না। উল্টো তোরে যেচে পাত্তা দেয়৷ আমার অসুখের সময়গুলাতে সে তোরে টেককেয়ার কইরা আনা-নেওয়া করছে। তা তো আর বইন মনে কইরা না! পুরুষের চোখ আমি তোর চেয়ে ভালো চিনি টুকটুকি। দেখ গিয়ে সেও জাস্ট একটা স্টেপের জন্য লটকে আছে। তুই এক স্টেপ আগাইলেই খপ কইরা ধইরা ফেলব।”

“তবুও যদি ফেরায়…”

নন্দিনী বিরক্ত গলায় বলে,
“তাইলে নেক্সট ইনিংস আমি নিশীথের লগেই খেলমু। হয় আমার দুলাভাই হইব নয়তো আমার এক্স। ওই মামুর ব্যাটা খোলসের ভিত্রে হান্দাইয়া থাকলেও আমারে এড়াইতে পারব না, ইউ নো! আর মাথা খাইস না আমার।”

টুকটুকি মনের জোর পায়। তবুও একটা কথা বলা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করে করতে পারে না।
“যার এত ভালো পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, এত পজিটিভলি সব জিনিস বুঝতে ও বোঝাতে পারে তার জীবনটা কেন প্রেমের খেলায় মত্ত, ইকরি সোনা?”

“অহন আজাইরা প্যাচাল পাইড়া আমারে জীবনদর্শন শিখাইতে আইসো না জান। ওইসব আমার ভাজা ভাজা কইরা সস দিয়া খাওন শ্যাষ। ফোন রাইখ্যা নিজের চিন্তা কর।”

টুকটুকি নিজের চিন্তা করেছে। মনের মতো সেজেছে। রাকিবকে টেক্সট করে জানিয়েছে সে যেতে অপারগ। এরপর ছুটেছে মনের দুয়ার উন্মোচন করতে। নন্দিনীর কথাই থাকুক নাহয়, একবার ব্যক্ত করুক নিজেকে। ফিরিয়ে দিলে মন ভাঙবে, হয়তো ছোটো হয়ে যাবে লোকটার কাছে। কিন্তু আফসোস থাকবে না। অন্তত নিজেকে বোঝাতে পারবে, প্রয়াসবিনা প্রেম ছাড়েনি মোর প্রাণের দুয়ারখানি। নাহয় কাল্পনিক বর্ষণ রাজাই প্রণয় পুরুষ থাকবে। মানবীয় প্রেমগাঁথা তার মলিন আঁচলের তলে তুচ্ছ পরে রবে।

তুচ্ছ কিছু হলো না। যখন গিয়ে দাঁড়ায় নিশীথের সম্মুখে টুকটুকি ভাষা হারায়। কণ্ঠদেশে তালগোল পাকায় শব্দের লহরি। অব্যক্ত শব্দ ব্যক্ত করে নিজের অখ্যাত চোখের বিখ্যাত অশ্রু ধারায়। তাকে চমকিত, পুলকিত করে নিশীথ সুযোগটাকে একদমই ছাড়েনি। কিন্তু এরপর…

ঝাকুনি খেয়ে বাস্তবে ফিরল টুকটুকি। গাড়ি তখন ঢাকা ছেড়ে ছুটছে শীতলক্ষ্যা ব্রিজের ওপর দিয়ে। শেষ বিকেলের কোমল ছটা তীর্যকভাবে আছড়ে পড়ছে টুকটুকির গায়ে। পার্ল ওয়ার্ক করা শাড়িটা ঝলমল করে উঠছে। ও বলল,
“কোথায় যাচ্ছি?”

“যেদিকে দুচোখ যায়।” নিশীথ চলন্ত পথে চোখে রেখে থমথমে মুখে জবাব দেয়।

“গাড়ি থামান।”

“উহুম, নিজের ইচ্ছেয় এসেছেন, নামবেন আমার ইচ্ছেতে।”

“নামব না, কথা বলব। আলোচনা করব আপনার সাথে।”

নিশীথ রোডসাইড এড়িয়াতে নিরাপদ স্থানে ব্রেক কষল। পূর্ণ দৃষ্টি মেলে ধরল টুকটুকির টুকটুকে মুখপানে। টুকটুকি জানতে চাইল,
“এরপর?”

বিকেল তখন মৃ’তপ্রায়। সূর্যটা পশ্চিমে হেলে অস্ত যাওয়ার অপেক্ষায়৷ একে কনে দেখা আলো বলে কিনা নিশীথের জানা নেই। সেই ক্ষয়িষ্ণু রোদ্দুরের পেলব পরশে নিশীথ মন থেকে উপলব্ধি করল এই ঠোঁট ফোলানো অভিমানী মেয়েটিকে তার চাই-ই চাই। যেকোনো মূল্যে চাই। এই চাওয়ায় ভালোবাসা কতটুকু আছে জানা নেই। শুধু জানে তার হাতটা ধরে একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব। অন্যকাউকে সেই হাতের মালিকানা দিতে নারাজ তার হৃদয়। টুকটুকি অন্যকারো জন্য সেজেছে, অন্য কেউ তাকে দখল করে নেবে শুনলেই বুকের ভেতর তুষের আ’গুন ধিকিধিকি করে জ্ব’লে। এমনকি কাল্পনিক প্রণয় পুরুষ বর্ষণ রাজাকেও হিংসে হয়। এই টানাপোড়েন থেকে মুক্তির সময় আসন্ন। নিশীথ সিটে পিঠ এলিয়ে ওর দিকে চেয়ে বলল,
“যা হওয়ার তাই হবে৷ আপনি জেনেবুঝে এসেছেন আমিও জেনেবুঝে ছাড়ব না।”

টুকটুকি ভ্রুকুটি করে। কত্ত বড়ো বদ! আপনি জেনেবুঝে এসেছেন আমিও জেনেবুঝে ছাড়ব না! আর নিজে যে পথ চেয়ে ছিল তার বেলায়! এই লোককে আজ স্বীকার করতেই হবে। মনের দুয়ার যেহেতু খুলেছেই দরকার পড়লে ঝাপিয়ে পড়ে স্বীকার করাবে। টুকটুকি অভিমানী চোখে চেয়ে আর্ত সুরে বলে,
“শুধু আমি এসেছি বলেই?”

নিশীথ ঢোক গিলল। মেয়েটি কী জানতে চায় সে জানে। খুব ভালো করেই জানে। পরিস্থিতি জলের মতো স্বচ্ছ হয়ে এসেছে দুজনের মাঝে। কোনো ঘোলাটে ভাব নেই, পর্দা নেই। আশ্চর্য! একটা সিদ্ধান্তে সবটা এমন সহজ হয়ে যাবে জানলে এতটা ভারাক্রান্ত সময় সে পাড়ি দিতে চাইত? প্রেম যে ছোঁয়াচে রোগের মতো। আশেপাশের মানুষ যখন প্রেমের মা’তাল হাওয়া মেখে ঘুরবে তার স্পর্শ বিপরীত মানুষটার হৃদয় অলিন্দেও লাগবে যদি মন উর্বর হয়। নিশীথের হৃদজমিন উর্বর। শুধু দরকার ছিল কর্ষণের। টুকটুকি নামের হেয়ালি করা মেয়েটির খেয়ালি স্বভাবই লাঙল চালিয়েছিল কঠোর বুকে। নিরব সমর্পণে আজ সেই কর্ষিত বুকে ফুল ফুটেছে। নিশীথ বলল,
“মিস হুমায়রা, আমার মেঘকুমারী হবেন?”

টুকটুকির কানে শীতল বাতাসের শিহরণ খেলে যায়৷ এই মধুর শব্দটা শোনার জন্যই কি এই দীর্ঘ অব্যক্ত বিরহ! চোখ ছাপিয়ে বর্ষা নামতে আকুলিবিকুলি করে। কিন্তু নিশীথের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো সে সিরিয়াস মুডে লেকচার দিচ্ছে। টুকটুকি ঠোঁট উল্টে বলল,
“প্রপোজ করছেন নাকি হুমকি দিচ্ছেন?”

নিশীথ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অভিব্যক্তি আরো দৃঢ় করে বলল,
“দুটোই। মেনে নিলে প্রপোজ, মানতে না চাইলে হুমকি।”

“কি সাংঘাতিক! এমন সিরিয়াস মুড নিয়ে আপনি প্রেম করবেন?”

নিশীথ গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,
“আপনি পছন্দই করেছেন এমন মানুষকে ম্যাডাম। আপনার ভাষায় অসামাজিক, নাকউঁচু, অ-শ্রেণির মানুষ।”

“আপনি না খামখেয়ালি আচরণের মানুষ পছন্দ করেন না!”

“বুঝিনি তো! খামখেয়ালি, বেখেয়ালি, আড্ডাপ্রিয়, ঝগড়ুটে, আবেগপ্রবণ মেয়েটা আসলে একটা হা’না’দার। সন্তর্পণে আমার মনে হানা দিয়ে সব ল’ণ্ডভ’ণ্ড করে দিয়েছে।”

টুকটুকি লজ্জাবনত হয়। গালদুটি তার লালিমায় উদ্ভাসিত। লাভ শেইপের পুরু ঠোঁটদুটি চেপে ধরেছে। নিশীথ তীর্যক চোখে চেয়ে বলল,
“আপনি লজ্জাও পান?”

“তো আপনার আমাকে নির্লজ্জ মনে হয়?” টুকটুকি জ্ব’লে ওঠে।

নিশীথ আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে বলে,
“দেখুন মোটেও ঝগড়া করবেন না আজ। এই পরিস্থিতির সমাধান করতে হবে আগে।”

“সমাধান একটাই, বাড়ি ফিরে চলুন।”

“খুব শখ হয়েছে আপনার সাংবাদিককে বিয়ে করার!”

“তা হতে যাবে কেন?”

“আপনার ফ্যামিলিই মূল সমস্যা। আপনাকে ফিরিয়ে দিয়ে এখন আর আমি কোনো রিস্ক নেব না।”

টুকটুকি হাসি চাপে। তার মা যে নিশীথকে জামাই করতে এক পা বাড়িয়েই আছে সেটা তো আর বেচারা জানে না। এখন শুধু পালে হাওয়া দিয়ে দিক পরিবর্তন করতে হবে। টুকটুকি রহস্যময়ী হাসি দিয়ে ফোন করল ওর বড়ো খালাকে। নিশীথ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। অবাক হয়ে দেখল সেকেন্ড কয়েকের মধ্যেই মেয়েটার চোখ টলমল করতে শুরু করেছে। আর্তনাদ করে বলছে,
“খালামনি, ও খালামনি…”

কন্যাসম বোনজির ভেজা গলা শুনে খালা চিন্তিত হোন,
“কি রে মা, তুই কান্দিস ক্যান?”

“খালামনি, আমার খালামনি গো…”

খালার প্রেশার বাড়ে। কোনো বিপদ হলো না তো! উত্তেজিত হয়ে বলেন,
“মা আমার, তুমি ঠিক আছো? কী কইছে তোমার? আমারে কও না, মা!”

টুকটুকি সত্যি সত্যিই কাঁদছে। অনুযোগের সুরে বলে,
“ও খালামনি, আমি তোমার মেয়ে না বলো?”

“তুমিই আমার মেয়ে, তুমিই আমার মা।”

“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে খালামনি। দমবন্ধ লাগছে। মনে হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি ম রে যাব। আর সেই মৃত্যুর জন্য তোমরা সবাই দায়ী থাকবে। তোমাদের ওপর অভিমান করে আমি তিলে তিলে শেষ হয়ে যাব।”

বড়ো খালা আঁতকে ওঠেন,
“কী কও এগুলা? তুমি ম রবা কেন? শান্ত হও মা আমার। কী হইছে বলো।”

“আমি এই বিয়ে করব না খালামনি। একদম করব না। রাকিবের নাম শুনলেই আমার শ্বাসকষ্ট হয়। সারা গায়ে অদ্ভুত জ্ব’লুনি হয়। আমি ঘুমাতে পারি। মনে হয় কিছু আমার গলা চেপে ধরে। শান্তি পাই না। তুমি তোমার মেয়েকে বুঝবে না খালামনি? তুমি চাও তোমার ওই আত্মীয়কে বিয়ে করে আমি ম রে যাই?”

খালা আতঙ্কিত হোন এই ভেবে আদরের কন্যাটিকে জ্বিনে ধরল কিনা! বিয়ের কথা উঠলে সুন্দরী মেয়েদেরকে জ্বিনে ধরার একটা প্রবণতা আছে। গায়ে জ্ব’লুনি, দমবন্ধ লাগা এসবেরই লক্ষণ। মেয়েদের চিত্তকে ভুলভাল ভাবায়। পানিতে টেনে নিয়ে যায়, গাছে চড়িয়ে দেয়। বিভিন্নভাবে ক্ষতি করার চেষ্টা করে। উনার শ্বাশুড়িকে দেখেছিলেন জ্বিনে ধরলেই জ্ব’লুনি উঠত। জ্ব’লুনিতে গায়ে জন্য গায়ে কাপড় রাখতেন না। উলঙ্গ হয়ে থাকতেন আর গায়ে পানি ঢালতেন। তাকে ঘরে বন্দি করে রাখতে সে কি বিড়ম্বনা! টুকটুকির সঙ্গে যদি এমন কিছু হয়! খালা চিৎকার দিয়ে বললেন,
“টুকটুকি মা আমার, তুমি কোনখানে আছো?”

“আমি নদীর সামনে দাঁড়িয়ে আছি, খালামনি।”

খালা এবার নিশ্বাস নিতে ভুলে যান। সন্দেহই কি সত্যি হলো! মেয়েটার সঙ্গে নিশ্চয়ই এখন জ্বিন আছে। কোনো ক্ষতি না করে দেয়। তিনি আশ্বাস দিয়ে বললেন,
“তুমি এখনি পানির কাছ থেকে সরে যাও মা। কেউ তোমারে বিয়ে দিতে পারবে না। আমি এক্ষণি তোমার মারে ফোন দিয়ে বলতেছি বিয়ে স্থগিত করতে। অত তাড়াহুড়ার কিছু নাই। রাকিব পড়াশোনা শেষ করে বিদেশ থেকে ফিরুক। তুমিও পড়াশোনা করো। বিয়ের কথা পরেও ভাবা যাবে। সোনা মা তুমি বাড়ি যাও।”

“ওয়াদা করো খালামনি। নাহয় আমি যাব না।”

“ওয়াদা ওয়াদা ওয়াদা।”

টুকটুকি নাক টানতে টানতে কলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। নিশীথ নির্বাক হয়ে দেখে কান্ডকারখানা। ওর চাহনি দেখে টুকটুকি বলল,
“টিস্যু এগিয়ে দিচ্ছেন না কেন? আপনি তো প্রথম দিনেই ফেল মা রছেন।”

নিশীথ টিস্যুর বক্স ওর কোলে দিয়ে বলল,
“ড্রামা কুইন! এত দুষ্টু বুদ্ধি কোথা থেকে আসে?”

টুকটুকি আত্মগৌরবের হাসি হেসে বলল,
“আমি খেয়ালি বলেই এমন ভাবতে পারি৷ আপনি বাস্তববাদী বলে পারেন না। এখন গাড়ি ছাড়ুন। ওদিকে কেউ কিছুই জানে না। জলদি বাড়ি ফিরতে হবে।”

নিশীথ দক্ষ হাতে হাইওয়ে ধরে গাড়ি ছোটায়। ঠোঁটের কোণে ঝুলছে এক টুকরো আশকারাপূর্ণ হাসি। ক্রমশ জটিল হতে থাকা সমীকরণ হুট করেই সরল হয়ে গেল। উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা সব মিলিয়ে গেল। এসি বন্ধ করে কাচ নামিয়ে দিতেই ফুরফুরে হাওয়ায় মেতে উঠল দুটি মন। সন্ধ্যার ছায়াসময়ে তাদের হৃদয় অনুভূতিতে কানায় কানায় পূর্ণ। নিশীথ বলল,
“আপনি কিন্তু আমার জবাবটা এখনো দেননি, মিস হুমায়রা।”

টুকটুকির অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
“আপনার মেঘকুমারী হওয়ার আগে আমায় বর্ষণ রাজার অনুমতি নিতে হবে।”

নিশীথের মুখ গম্ভীর হয়। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে,
“আপনার কল্পনার বর্ষণ রাজা কেমন তা জানি না। কিন্তু আমি আপনার কল্পনাকে ছাপিয়ে যাব, প্রমিস।”

“আচ্ছা! প্রমাণ দিন এরপর ভেবে দেখব।”

“ভেবে দেখব মানে? আমাকে দিয়ে মনের কথা স্বীকার করিয়ে এখন নিজের পিঠ বাঁচাচ্ছেন? এটা তো রীতিমতো চিটিং!”

টুকটুকি মিষ্টি হেসে বলে উঠল,
“একটু চালাক না হলে অ-শ্রেণির লোকদের সঙ্গে টেকা খুব কঠিন।”

চলবে…

#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৩৯]

মাথার ওপর ধুসর ছায়াময় ম্লান আকাশ। সন্ধ্যা নামা পিচঢালা পথে প্রিয়া হাঁটছে দ্রুত পায়ে। কাঁধে ঝোলানো চিকন ফিতের ব্যাগটা চেপে ধরেছে শক্ত হাতে। এদিক ওদিকে তাকিয়ে মাথা নত করে চলেছে ও। আজকাল অল্পতেই বুক কাঁপে প্রিয়ার। অচেনা পুরুষ চলার মাঝে চোখ ফেললেও ভীত হয়। হেঁটে যাওয়া আসা করে বলে বাড়ি ফিরতে রোজ সন্ধ্যা পেরোয়। একা একটা মেয়ে রোজ সন্ধ্যার পর ফেরে বিষয়টা অনেকের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। বস্তির গলির মাথার হারুন গরম পানিতে চায়ের কাপ ধুতে ধুতে কেমন একটা বিদঘুটে দৃষ্টিতে তাকায়। চোখ নয় যেন শরীর মাপার ফিতে। প্রিয়ার গা গুলিয়ে ওঠে। দিয়া কিছুদিন আগে একবার কথার ছলে বলেছিল শেষ মাথার ঘরের আবুল চাচা নাকি তাকে দেখলে ডেকে জিজ্ঞেস করে বাবার কথা, পরিবারের কথা। হাত ধরে টানাটানিও করে। শুনে প্রিয়া যারপরনাই চমকে উঠেছে। দিয়া অত বুঝে বলেনি, কিন্তু প্রিয়ার মনে শঙ্কা উঁকি দেয়। মেয়েটা যে বড়ো হচ্ছে!

আজকাল বস্তির পুরুষগুলোর দৃষ্টিও প্রিয়ার নজরে আসছে। শিরশিরে একটা ভয় মেরুদন্ড বেয়ে ঘোরাঘুরি করে সর্বাঙ্গে। এইসব অনিরাপত্তা কি এখনই তৈরি হচ্ছে নাকি আগেও ছিল! প্রিয়াই হয়তো খেয়াল করেনি এতদিন। দিয়াটার গায়ে কৈশোরের ছটা লাগতেই চারিদিকে শুধু অনিরাপত্তাই দেখছে সে। প্রিয়া আরো একটা জিনিস খেয়াল করেছে। মা কেমন চুপসে থাকেন ইদানীং। সেদিন টিউশনি গিয়ে জানতে পারে স্টুডেন্ট অসুস্থ। কাজেই না পড়িয়েই ফিরে আসতে হয়েছিল প্রিয়াকে। বাড়ি ফিরে দেখল মা প্রতিবেশী এক মহিলার সঙ্গে বসে গল্প করছেন। পান খেয়ে রাঙানো ঠোঁটে তিনি বলছেন,
“দেহো দিয়ার মা, তোমার জামাই নাই। মাইয়া একখান ডাঙ্গর, আরেকখানও হইলো বইলা। তুমি পারো না একলা চলতে। আবার মাইয়ারে দিছো ছাইড়া। রাইত-বিরাইতে বাড়িত ফিরে। যদি কেউ কিছু কইরা বয়? কিছু করতে পারবা? পারবা না। সময় থাকতে বিয়াডা দিয়া দেও। মাইয়ার চেহারা সুরুত দেখতে ভালা আছে। দেনাপাওনা লাগব না।”

মুনিরা হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলেছিলেন,
“বিয়ে আল্লাহর হাতে, আপা। তিনি ইশারা করলে আমি আটকানোর কে?”

“আল্লাহর হাতে সব। কিন্তু বান্দার চেষ্টা থাকন লাগে। তোমার মাঝে তো তেমন দেখি না। কতগুলান পাত্র আনছি একটারেও দেখলা না। মাইয়া সংসার চালায়, বিয়া দিলে সংসার চলব না হেই ডরে আগাও না।”

মুনিরা বেগমের তখন মাটিতে মিশে যাওয়ার জোগাড়। প্রিয়া দৃশ্যপটে হাজির হলো তীক্ষ্ণ মেজাজে।
“আমি বিয়ে করে নিলে আমার সংসার আপনি দেখবেন আন্টি?”

“আমি না দেখলেও পয়সাওয়ালা জামাই থাকলে তো দেখবই। আমি কোনো ছুডুমুডু বিয়ার ঘর আনি না।”

“বড়ো বিয়ের ঘর তো অনেকেরই আনেন। সামিরার বিয়েটা তো আপনিই দিলেন। মাস ঘুরতেই স্বামী মা’রধো’র করে রেখে চলে গেল। আর খোঁজও নিল না। নিরাপত্তার কথা ভেবে বিয়ের পিঁড়িতে বসে গেলাম। স্বামীর ঘরে আমি যে নিরাপদে থাকব তার কি নিশ্চয়তা?”

মুনিরা তর্ক করতে বাধা দিচ্ছিলেন বারবার। মহিলা থমথমে মুখে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন,
“বস্তির মাইয়াগো এই আমিই ঘটকালি কইরা পার করছি। আর দুইদিনের মাইয়া আমার ভুল ধরে। মনে রাইখো বিয়া দিতে আমার কাছেই আহন লাগব। আর যদি নাগর জুটাইয়া ভাইগ্যা যায় তাইলে কথাই নাই।”

প্রিয়া মায়ের ওপর ধমকে উঠেছিল,
“কতদিন ধরে এসব হচ্ছে?”

মুনিরা উত্তর দিতে পারেননি। প্রিয়া বুঝেছিল তার আড়ালেও একটা যু দ্ধ মা করে চলেছে বস্তির মানুষগুলোর তেরছা বাক্যের সঙ্গে। ঘরভাড়া দেওয়া হয়নি দুমাসের। বই কিনতে টাকা গিয়েছে। ফলে অল্প টাকায় ভাড়া দিতে সংকুলান হয়নি। বাড়িওয়ালা ঘুরে গেছেন দুবার। প্রিয়ার আজকাল দিশেহারা লাগে। কোনোদিকে আলো নেই। শুধু আঁধারের হাতছানি। আরেকটা টিউশন খুঁজছে প্রাণপনে। চেষ্টা করেও মিলছে না। অন্যমনস্ক হয়ে ভাবতে ভাবতে বাড়ি পৌঁছাল প্রিয়া। চমকে দেখল মামা বসে আছেন মায়ের পাশে। বিছানায় ছড়ানো ছিটানো চিপস, জুস, বিস্কুট, পাউরুটি। মামা তাকে দেখেই কিঞ্চিৎ বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন,
“সন্ধ্যার পর বাড়ি ফেরা কেন?”

“টিউশনি ছিল মামা।”

“দিনে করা যায় না? মেয়েরা আজকাল ঘরেই নিরাপদ না। আর তুমি আসো গোটা কতক বাজার পেরিয়ে!”

প্রিয়া কোনো জবাব দিল না। তার দেরিতে বাড়ি ফেরা নিয়ে সকলের কত চিন্তা। অথচ তারা খেয়েছে কিনা, বাড়িতে বাজারটা ঠিকঠাক হয় কিনা সে নিয়ে চিন্তা তো দূরে থাক জিজ্ঞেস করতেও কুণ্ঠা। প্রিয়া তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। আশেপাশে অভাব দেখলে আপন মানুষগুলোই আগে পিঠ দেখিয়ে বেড়ায়। মামা অবশ্য প্রিয়ার উত্তরের ধার ধারলেন না। বোনকে বললেন,
“শোন মুনিরা, ভালো একজন লইয়্যার আছে হাতে। তুই বললেই আমি এগোবো।”

“কীসের জন্য?” প্রিয়া উৎসুক হয়ে জানতে চায়।

“তোর বাবার ভাগের সম্পত্তি কি ছেড়ে দিবি নাকি? পৈত্রিক সূত্রে তোরা দুবোন যা পাবি তা দিয়ে নিজেদের বাড়িও হবে ভবিষ্যতও নিশ্চিত থাকবে। তুই এখন প্রাপ্তবয়স্ক। দাদার বাড়ির সম্পত্তির দাবিদার। এটা তো মগের মুল্লুক না যে কেড়েকুড়ে তোদের চাচারা সব ভোগ করবে। দেশে আইনকানুন বলে কিছু আছে। আমি লড়ব তোদের হয়ে।”

প্রিয়া দেখল মামার চোখদুটো চকচক করছে। ভাগ্নীদের হয়ে নিজের দায়িত্ববোধ দেখাতে তিনি মড়িয়া। নাকি সম্পত্তির লভ্যাংশ পেতে? মুনিরা বেগম ভাইয়ের বাসনা ধরে ফেলেছেন আরো আগেই৷ ইদানীং প্রায়ই ফোন দিয়ে ভাইজান এইসব কথা বলেন। আজ একেবারে চলেই এসেছেন। স্বার্থ ছাড়া কেউ কেন যে তাদের দিকে তাকায় না! মুনিরা বেগম জ্ব’ল’ন্ত দীর্ঘশ্বাসটা বুকের মাঝে চেপে বললেন,

“ভাইজান, আপনাকে তো আগেও বলেছি আমি আইনের জটিলতায় যাব না।”

“কেন যাবি না? তোর মেয়েদের কি কোনো ভবিষ্যত নাই? তোর ভবিষ্যত নাই? এই স্যাঁতস্যাঁতে টিনের ঘরে পড়ে পড়ে জীবন কাটাবি? তোর জামাই জেল থেকে বেরিয়ে তোদের উদ্ধার করবে সেই আশায় থাকবি কেন? তুই তো হাত পেতে নিতে যাচ্ছিস না। নিজেদের অধিকার নিবি।”

“অধিকার নিতে গিয়ে যদি তারা ক্ষু’ব্ধ হয়ে আমার ফুটফুটে দুই মেয়ের ক্ষতি করতে আসে তখন কে দেখবে, ভাইজান? আইন যেমন আছে আইনের ফাঁক ফোকরও আছে। মনে রাখবেন আইন অন্ধ। যা দেখানো হবে তাই দেখবে। প্রিয়ার চাচারা নিজেদের স্বার্থে ভাস্তিদের চেয়েও দেখবে না। তাদের টাকার মায়ার কাছে সম্পর্কের মায়া তুচ্ছ। আমার দুইটা মেয়েই জীবন। তাদের সুস্থতার চেয়ে বড়ো সম্পদ কিছু নাই।”

প্রিয়া মায়ের পায়ের কাছে এসে চুপচাপ বসে। আলতো হাতে পায়ের অসাড় আঙুলগুলো টিপে দেয়। এই মানুষটা স্বাভাবিক হাঁটাচলা করতে না পারলেও বুদ্ধির হাঁটাচলা সুদূরপ্রসারী। লোভে পড়ে হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেন না। আগে পারিপার্শ্বিক অবস্থাও খেয়াল করেন। প্রিয়া দেখে ফোনটা কাঁপছে। অনুভবের ফোন। নানান মানসিক চাপে আজকাল তার সঙ্গেও কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। ও ফোন উল্টে রেখে রান্নার আয়োজন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
_________________

দিগন্ত হলরুমে মা ও ভাইয়ের সঙ্গে খেতে বসেছে। চামচের খুটখাট শব্দ পুরো টেবিলজুড়ে। আজ একজন নতুন অতিথি আছে সঙ্গে। মিলি, অম্লান ভাইয়ার ফিয়োন্সে। প্রথম দেখায় মুগ্ধ হওয়ার মতো সৌন্দর্য তার। আচরণের নৈপুণ্যতা মন কেড়ে নিতে সক্ষম। বিশিষ্ট শিল্পপতির একমাত্র সুযোগ্য কন্যা সে। ওকালতি পাশ করেছে সবে। অম্লানের জন্য সব দিক থেকে পারফেক্ট বলে মিসেস রুহানি সুযোগ ছাড়েননি।

মিসেস রুহানি তিন পুত্রের মাতা হলেও রূপ তার অসামান্য। চামড়া টানটান, দেহের গাঁথুনি মজবুত। তিনি মাশরুম স্যুপটা মিলির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“তোমাদের দেখাসাক্ষাৎ বাড়ানো উচিত। বিয়ের আগে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলে সম্পর্কটা স্মুথ হবে।”

অম্লান নিশ্চুপ। সায়ও দিচ্ছে না আবার অগ্রাহ্যও করছে না। জগতে তার আগ্রহের জিনিস খুবই কম। মিলি সেই আগ্রহের ভাগে পড়ছে না স্পষ্ট। মিলি মিষ্টি সুরের মূর্ছনায় হলরুম মাতিয়ে বলল,
“অম্লান কাজের মাঝে সময়ই বের করতে পারে না।”

দিগন্ত হেয়ালি করে বলে উঠল,
“জীবনে যার কদর আছে তার জন্য সময় আছে।”

সবার নজর দিগন্তের ওপর থমকাতেই দিগন্ত আবার হেসে বলল,
“জোকিং! ভাইয়া অফিস নিয়ে ভীষণ বিজি। আজকে মায়ের হুকুমে বিজিটা ইজি হয়েছে। মিলি আপু তেমন হুকুম দেওয়ার মানুষ হতে চেষ্টা করুন।”

অম্লান কটমট করে তাকায়। দিগন্ত তাকে পাত্তা বিশেষ দিল না। যে মানুষ বাবা মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে গিয়ে স্বকীয়তা হারায় তাকে কি বলার! মিসেস রুহানি বিরক্ত গলায় বললেন,
“জোয়ান ছেলে, এখনই তো ক্যারিয়ার বিল্ড আপ করবে। তোর গ্রেজুয়েশনও শেষ। মাস্টার্স কোর্সটা বাইরে থেকে করে এসেই বাবার বাকি দায়িত্ব কমিয়ে দিবি।”

দিগন্ত পানি খেয়ে বলল,
“যে কোম্পানি ভাইয়া ও বাবা মজবুত করছে সেটাতে কেন নাক গলাতে যাব? নিজে কিছু করতে চেষ্টা করব।”

“কী করবে? আছে তো ওই ছাপোষা সরকারি চাকরি? সারাজীবন অল্প কয়টা বেতন ও প্যানশন নিয়ে জীবন কাটাবে?”

“যোগ্যতা যদি তাই হয় আপত্তি কোথায়? মিলি আপুও তো নিজ যোগ্যতায় আইনজীবী পেশায় এসেছে।”

মিসেস রুহানি সন্তর্পণে মেজাজ সামলে বললেন,
“বড্ড বাজে কথা বলছিস ইদানীং। এ নিয়ে তর্ক করতে ইচ্ছে হলে বাবার সঙ্গে করিস।”

দিগন্ত চুপচাপ মাথা নুইয়ে খেয়ে উঠে গেল। মিসেস রুহানি ছেলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকেন। বড়ো ছেলেটার মতো উদ্ধত স্বভাব ছোটোটার মাঝেও ইদানীং খেয়াল করেন তিনি। এটা মোটেও ভালো লক্ষণ নয়।
________________

টুকটুকি পড়েছে বিপদে। বড়ো খালাকে ফোন করে বিয়ে ভাঙার জন্য ব্ল্যাকমেইল করার পরেরদিনই তিনি এসে হাজির। সঙ্গে এনেছেন পীর বাবার দেওয়া বিশেষ তাবিজ। যেই তাবিজ পরানোর কতগুলো নিয়মকানুনও আছে। আপাতত সেইসব টুকটুকির ওপর প্রয়োগ করবেন। প্রথম ধাপ হলো একটা শুকনো মরিচ পুড়িয়ে নাকে ধরতে হবে। টুকটুকি সেটা শুনে আঁতকে উঠে ঘরের দরজা দিয়েছে। অস্থির হয়ে পায়চারি করছে আর দাঁতে নখ কাটছে। এখন তার ওপর একপ্রকার জুলুম হবে। এটা রুখতে হবে যেকোনো উপায়ে।

বড়ো খালা নিশ্চিত হয়ে বললেন,
“দেখছোস শারমিন? ভয়ে জ্বিন ঘরে দরজা দিছে। ওরে বের করার চেষ্টা কর। জ্বিন না ভাগিয়ে আমি আজ ছাড়ব না। পীর বাবার ওষুধ বিফলে যাবে না।”

ঝুমঝুমি ড্যাবড্যাব করে সকলের কান্ড দেখছিল। বোনের চালাকি ধরতে পেরে হাসি আর ধরছে না। ও বড়োখালার পাশে বসে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
“খালামনি এই জ্বিন তাবিজে বশ হবে না।”

“তোকে কে বলেছে?”

“জ্বিন রাতের বেলা বিড়বিড় করে বলছিল তাকে তাড়ানোর একমাত্র উপায় আপুকে এলাকার মাঝেই বিয়ে দেওয়া। দূরে বিয়ে দিতে চাইলেই ক্ষতি করে দেবে। কোনো ক্রমেই এলাকা ছাড়া যাবে না। যদি জোর করে দাও তাহলে বরের ক্ষতি করে দেবে।”

“বলিস কি?” বড়ো খালা চোখ বড়ো বড়ো চায়।

শারমিন বেগম তীক্ষ্ণ চোখে মেয়েকে দেখছেন। কোথাও যে কিছু একটা গড়বড় আছে বুঝতে বাকি নেই। তার সেকেলে বড়ো আপাকে পেয়ে দুই বোন ভুজুংভাজুং দিচ্ছে। তিনি টুকটুকির সঙ্গে একান্তে বোঝাপড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

চলবে…