#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৪০]
টুকটুকি নিজেকে অত্যন্ত সুস্থ স্বাভাবিক একজন মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করতে গোসল করে অল্পবিস্তর সেজেগুজে পরিপাটি হয়ে নিচে নেমেছে। উদ্দেশ্য প্রমাণ করা যে তার সঙ্গে জ্বিন নেই। এইসকল অ’ত্যা’চার যেন না করা হয়। কিন্তু বড়ো খালা সেসব শুনতে নারাজ। কে জানে, হয়তো ভয়েই দুষ্টু জ্বিন তার সরল মেয়েটাকে দিয়ে এসব বলাচ্ছে! তিনি যেই না শুকনো মরিচ পোড়াতে যাবেন তক্ষুনি টুকটুকির ফোন বেজে উঠল। রাকিবের কল। রিসিভ করতেই রাকিব ব্যথিত গলায় বলল,
“আপনাকে নাকি জ্বিনে ধরেছে?”
প্রশ্নটা শুনে টুকটুকি একটু অস্বস্তিতে পড়ল। যদিও ফোনের ওপাশ থেকে রাকিবের তা বোঝার উপায় নেই। সে বেশ কয়েকদিন ধরেই টুকটুকিকে দেখা করতে বলছে। আর প্রতিবারই বাহানা করে দূরে সরে থাকছে মেয়েটা। অনিহা যে শুরু থেকেই সেটা ধরতে পারছিল বেশ। কিন্তু গতকালের ঘটনা শুনে রাকিব যারপরনাই তাজ্জব। জ্বিনকে সে অবশ্যই বিশ্বাস করে। দাদিকে দেখে সেই বিশ্বাস ছোটো থেকেই মনে আসন গেড়ে আছে। কিন্তু তাই বলে টুকটুকির সঙ্গে এমন কিছু সত্যিই ঘটবে ওর কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছে না। উত্তর না পেয়ে রাকিব আবার বলল,
“সেই জ্বিনের নাকি আমার সঙ্গে বিয়ে হওয়া নিয়ে সমস্যা?”
টুকটুকির মাথায় চট করে নতুন ফন্দি খেলে গেল। ফোন কানে ধরেই ও চোখ বড়ো করে টলমলে চোখে তাকায় খালার দিকে। লম্বা লম্বা শ্বাস নিতে শুরু করে তৎক্ষণাৎ। বড়ো খালা ব্যস্তসমস্ত হয়ে ওকে আগলে ধরেন,
“টুকটুকি মা, কী হইল আবার?”
টুকটুকি ফোন কানের কাছ থেকে সরিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে নিচু স্বরে বলল,
“রাকিবের গলা শুনলেও দমবন্ধ লাগছে।”
তিনি ফোন কেড়ে নিয়ে রাকিবকে বললেন,
“তোর সঙ্গে পরে কথা বলবনে। আগে মেয়েটারে সুস্থ করে নেই।”
বড়ো খালা ফোন কাটতেই টুকটুকি ধীরে ধীরে দম স্বাভাবিক করে বলল,
“আমার কী মনে হয় জানো খালামনি?”
“কী?”
“জ্বিন আসলে আমাকে ধরেনি। কারণ সর্বক্ষণ আমি স্বাভাবিক। শুধু রাকিব সম্পর্কিত বিষয়েই তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কাজেই হতে পারে রাকিবের সঙ্গেই কোনো পরী আছে। যে অন্য মেয়েদের তার লাইফে এন্ট্রি দিতে চায় না বলেই আমার ওপর রেগে গিয়ে কষ্ট দিচ্ছে। এমনটা হতে পারে না?”
বড়ো খালা এবার বেশ চিন্তায় পড়লেন। চোখেমুখে রাজ্যের বিভ্রান্তি। ঝুমঝুমি লাফিয়ে পড়ে কথার মাঝে। আগের বক্তব্য ভুলে দুই ঝুটি দুলিয়ে সায় দিয়ে বলল,
“রাকিব ভাইয়া তো আপুর চেয়েও বেশি সুন্দর। দিন নেই রাত নেই বন, জঙ্গল, মাঠ, ঘাট, কবরস্থান, শ্মশানসহ আর কত জায়গায় ঘোরাঘুরি করে নিউজ কালেক্ট করে। আপু তো ভার্সিটি, বাড়ি আর সুযোগ পেলে পাশের বাড়ি ছাড়া কোত্থাও যায় না। কাজেই রাকিব ভাইয়ার চান্স বেশি। হয়তো সেই পরীর কোনো এসিস্টেন্টই আপুর আশেপাশে ঘুরছে। আমাদের উচিত এই বিয়ে এক্ষুণি নাকচ করা। নয়তো রেগেমেগে সেই পরী রাকিব ভাইয়ার ক্ষতি তো করবেই আপুকেও ছাড়বে না।”
টুকটুকি এই প্রথম ছোটো বোনের পিঠ চাপড়ে দিয়ে আড়ালে বলল,
“সাব্বাস বাপের বেটি আব্বাস!”
ঝুমঝুমি গাল ফুলাতে নিলে নিজের বাক্য সংশোধন করে আবার বলল,
“থুক্কু সাব্বাস বোনের বোন ঝুমসোনা! তোকে বেশি বেশি উপন্যাসের বই কিনে দেব। পড়বি আর পাকামো করবি।”
ঝুমঝুমি বই কিনে দেওয়ার নাম শুনে গদগদ হয়ে পড়ে। টুকটুকি বড়ো খালার হাত আঁকড়ে ধরে বলে,
“তোমার শ্বশুর বাড়ির গোষ্ঠীতে তো এইসব আগেও ঘটেছে। আমাদের গোষ্ঠীতে কস্মিনকালেও এইসবের দেখা নেই। তোমার উচিত আগে রাকিবকে গিয়ে তাবিজ পরানো। তাহলেই অর্ধেক প্রবলেম সলভড। যত তাড়াতাড়ি পারো তাকে বিদেশ পাঠিয়ে দাও।”
বড়ো খালা ভেবে দেখলেন কথাটা যুক্তিযুক্ত। তার শ্বশুরবাড়িতে এইসব ইতিপূর্বে ঘটেছে। কাজেই চিকিৎসা নিজ পরিবারে আগে করা উচিত। না হলো বিয়ে-টিয়ে। বাচ্চাদের জীবনের আগে বিয়ে নাকি! শারমিন বেগম নিরবে সবার কান্ডকারখানা দেখছিলেন। রাম ধমক দিয়ে বললেন,
“ফাজলামো হচ্ছে? জ্বিন-পরীদের খেয়েদেয়ে কাজ নেই যে তোদের বিয়ে নিয়ে গবেষণা করবে! চা’পকে পিঠের ছাল তুলে নেব দুটোর…”
কথা সম্পূর্ণ করার আগেই দেখা গেল বাড়ির সামনে নিশীথের গাড়িটা ব্রেক করেছে। টুকটুকি চমকে ওঠে। তার গাড়ি হঠাৎ এখানে! গাড়ি থেকে নামল টুকটুকির বাবা তোফায়েল হক। বলিরেখাযুক্ত মুখশ্রীতে সীমাহীন ক্লান্তির ছাপ। নিশীথ তোফায়েল হককে গাড়ি থেকে নামতে সাহায্য করে এগিয়ে নিয়ে আসে। শারমিন বেগম চিন্তিত মুখে ছুটে গিয়ে জানতে চাইলেন,
“কী হয়েছে তোমার? কোথা থেকে ফিরছো দুজনে?”
নিশীথ বিনয়ের সঙ্গে বলল,
“ব্যাংকের জটিলতায় মতিঝিল গিয়েছিলাম আন্টি। ফেরার পথে আঙ্কেলকে পেলাম। গরমে হিটস্ট্রোক হয়েছিল।”
“সেকি! বাবা তুমি ঠিক আছো?” টুকটুকি বাবার হাত ধরে উৎকণ্ঠায়।
নিশীথ টুকটুকির দিকে না তাকিয়ে মাটির দিকে চেয়ে আশ্বাস দিল,
“ক্লিনিক ঘুরে এসেছি, চিন্তা করবেন না। বেশি বেশি তরল খাবার ও পানীয় খাওয়াবেন আঙ্কেলকে। খুব দরকার না পড়লে রোদে একদমই বের হতে দেবেন না। বের হলেও ছাতাটা রাখবেন সাথে। আমি আসছি।”
শারমিন বেগম কৃতজ্ঞতাতেই বললেন,
“ভেতরে এসে বসো একটু।”
“আজ থাক আন্টি। পরে আসব একসময়।”
নিশীথ মাথা নত করে চলে গেল৷ তার ভদ্র ব্যবহারে তোফায়েল হক সন্তুষ্ট। ছেলেটাকে এতদিন তেমন দেখেনইনি তিনি। তোফায়েল হক পেশায় ব্যাংকার। মতিঝিল মূল ব্রাঞ্চের উর্ধতন কর্মকর্তা। অতিরিক্ত গরমের ফলেই রাস্তায় বেরিয়ে হিটস্ট্রোক করেছিলেন। নিশীথ দেখতে পেয়ে নিজে থেকেই এগিয়ে এসেছিল বলে রক্ষা।
টুকটুকি বরফ দিয়ে শরবত বানাতে ছুটেছে। তোফায়েল হক সোফায় গা এলিয়ে স্ত্রীকে শুনিয়ে বললেন,
“ছেলেটা ভীষণ দায়িত্বশীল। পুরো রাস্তা টেককেয়ার করে নিয়ে এলো। আসার পথে ক্লিনিকে ব্লাড প্রেশার, ডায়বেটিস সব মাপিয়ে দিল। এত ভালো ছেলেটা… তোমার মেয়েটাই আস্ত বোকা।”
শারমিন বেগম তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন,
“বাহ! ভালো কোনো কৃতিত্ব অর্জন করলেই সে তোমার মেয়ে। আর বোকামি করলেই আমার মেয়ে!”
“আলবৎ! আমাদের বংশে বোকামি নেই। তোমার বংশে সেটা আছে।”
শারমিন বেগম ক্রোধ সামলে নিয়ে তাচ্ছিল্য করে বললেন,
“আমার মধ্যে বোকামি ছিল বলেই তোমার মতো একজনকে বিয়ে করেছি। আমি বোকা বলেই তোমার সংসার টেনে চলেছি। অন্যকেউ হলে কবেই সব ছেড়েছুড়ে চলে যেত।”
“শুরু হলো জাতীয় বউ ফেডারেশনের সংগ্রামী ডায়লগ, ‘আমি বলেই তোমার সংসর করছি।’
তুমি কি জানো আমি এই বয়সে এসেও বিয়ের প্রস্তাব পাই। নেহাৎ আমি ভদ্রলোক। তাই আশেপাশে জীবনেও তাকাইনি।”
টুকটুকি ডাইনিং থেকে বাবার কথাটা স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে। নিশীথকে নিয়ে বলা ইঙ্গিতপূর্ণ কথাটায় তার মনে খুশির ঢেউ উথলে উঠল। ও শরবতের পর্ব চুকিয়ে বাবা-মায়ের তর্কের আড়ালেই ম্যাসেজ করল,
“বাবাকে তো পটিয়ে ফেলেছেন দেখছি।”
পাল্টা ম্যাসেজ এলো সঙ্গে সঙ্গে,
“জলকন্যাকে নির্বিঘ্নে পেতে চাইলে আগে সমুদ্রের কাছে নিজেকে যোগ্য বলে প্রমাণ করতে হবে তো। অবশ্য জলকন্যার মনটা আগেই পেয়ে গেছি।”
“শুনুন পাষাণ, সেই কোমল মনটা যেন সিক্ততার অভাবে শুকিয়ে না যায়। যত্ন নিতে শিখুন।”
“আপনি শিখিয়ে দিলে বেশি ভালো হয় ম্যাডাম। আমি কিন্তু ছাত্র হিসেবে খুবই ভালো।”
ম্যাসেজটা পড়েই টুকটুকির গালজোড়া গোধূলির আকাশের মতো রাঙা হয়ে ওঠে।
_______________
‘খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি’ কথাটার যথার্থতা দিগন্ত খুঁজে পেল মাথার ওপর ঘূর্ণায়মান ফ্যানটা দেখে। বাতাস যতটা না ধীর শব্দ ততটাই উচ্চ। তবে ফ্যানের চেয়েও দিগন্তের কৌতুহল অন্যদিকে। চাকরির পড়াশোনায় ডুবে অনুভবের অবস্থাটা এমন হয়েছে যে দাড়ি-গোঁফ গজিয়ে চেনা যাচ্ছে না। পরিশ্রম তার চোখেমুখে উপচে পড়ছে। দিগন্তের বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বের হয়। ভাগ্য বদলে মানুষের কতই না প্রচেষ্টা। দিগন্ত যদি অনুভবের অবস্থানে থাকত নিশ্চয়ই তার অবস্থাও এমন হতো! কিংবা আরো শোচনীয়। কিন্তু তাতেও মানসিক তৃপ্তি আছে। অনুভব নিজের টিউশনের টাকায় এক কাপ চা খাওয়ানোর সময় ওর মুখটা জ্বলজ্বল করে। অন্যদিকে দিগন্ত নামীদামী রেস্টুরেন্টে গিয়ে কোনো বিদেশি আইটেম ট্রিট দিলেও কোনোরূপ আত্মতৃপ্তি পায় না। যেন গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ই নয়। ওর শারীরিক মানসিক পরিশ্রম ভালো রেজাল্ট কিংবা কোনো প্রতিযোগিতায় জেতার লক্ষ্যেই হতো। সৌভাগ্যক্রমে থাকা-খাওয়ার চিন্তাটা করতে হয়নি। তবুও কেন জানি আত্মতুষ্টির স্থানটা ফাঁকা। ইদানীং সব কেমন ফ্যাকাশে, নির্জীব লাগে। কোথাও একটু স্বস্তির ছোঁয়া মেলে না। ও বুঝতে পারছে জীবনটা ক্রমশ স্বস্তির গণ্ডি পেরিয়ে যাচ্ছে।
বিকেলের কোমল ছঁটা এসে খেলা করছে জানালায়। দিগন্ত পা ঝুলিয়ে শুয়ে আছে অনুভবের বিছানায়। অনুভব দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে। বলল,
“তুই সত্যিই ইউএস চলে যাবি?”
দিগন্ত বিরস গলায় উত্তর দেয়,
“একদমই যেতে চাই না।”
“সুযোগ আছে, যাবি না কেন?”
“তুইও চল। আমি একলা বনবাসে যাব কেন? তোকে নিয়ে যাই।”
অনুভব হেসে ফেলল,
“আমার সুযোগও নেই, ইচ্ছেও নেই। কারণ আমার পিছুটান আছে। শুধু একটা চাকরি দরকার। তাহলেই পত্নীনিষ্ঠ সংসারী হয়ে যাব। কিন্তু তোর সুযোগ আছে। পিছুটানও নেই। বোকামো করে কেন হারাবি?”
দিগন্ত উঠে বসে অনুভবের হাঁটুতে ঘু ষি দেয়।
“এখনই পর করে দিয়েছিস? তোরা আমার পিছুটান নয়?”
অনুভব ব্যথায় কুঁকড়ে যায়। দিগন্তের বাহুতে পাল্টা আঘা’ত করে বলে,
“হা’রা’মী হালুম, এটা পিছুটানের নমুনা ছিল?”
“বেশ করেছি। তুই আছিস পড়ায় ডুবে, ইকরির কোনো খবর নেই। টুকটুকি বোকাটার কথা তো বাদই দিলাম। আমার মনে হচ্ছে সবাই এক সমুদ্র দূরে দূরে অবস্থান করছি। আমি চলে গেলে তোরা কেউ মনে রাখবি না।”
দিগন্তকে দেখাচ্ছে গাল ফোলানো বাচ্চাদের মতো। অনুভব হেসে ওর গালে টেনে দিয়ে বলল,
“তুই কিন্তু ন্যাকা হয়ে যাচ্ছিস হালুম, কার সঙ্গে মিশতেছিস আল্লাহ মালুম।”
“ওইসব ছাড়। যতই ব্যস্ততা থাকুক না কেন সামনের সপ্তাহের একটা দিন আমার বাড়িতে কাটাবি তোরা। ভাইয়ার অ্যাঙ্গেজমেন্ট ফাইনাল। তোরা যাচ্ছিস সেটাও ফাইনাল।”
অনুভব মেনে নিল। দিগন্ত সন্দেহি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
“তুই কি কোনো কারণে আপসেট?”
অনুভব দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পায়েলের উপদ্রব বেড়েছে। সুযোগ পেলেই হলের সামনে চলে আসছে। অনুভব ভদ্র ভাষায় প্রেমে হতে পারে না বোঝানোর পরও পায়েল ভাবছে সে একার ভালোবাসা দিয়ে অনুভবের মন জয় করে নিজের জন্য প্রেম জাগাতে পারবে। বিষয়টা বিরক্তির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এদিকে তার হৃদয়ের রানী বেশ কয়েকদিন হলো তাকে একপ্রকার এড়িয়ে চলছে। নিজের দোষটা কোথায় অনুভব খুঁজে পাচ্ছে না। কিন্তু সমস্যা যে জটিল তা নিয়ে সংশয় নেই। উদাসী গলায় বলল,
“প্রেমানল বুঝিস বন্ধু? তুষের আগুনের চেয়েও দুর্বার জ্বা’লাময়ী যার শিখা। অন্তর পু’ড়ে খাঁক করে দেওয়ার বিনিময়ে এক আনা প্রেম মেলে।”
দিগন্ত মৌন থাকে। প্রেমানলের শিখার উত্তাপ সে বোঝে না। সে বোঝে নিঃসীম শূন্যতা, অপূর্ণতা। ভালোবাসার রঙ, রূপ, রেখা সবার জীবনে এক হয় না।
_________________
আলো যখন আঁধারিয়া অম্বরের দ্বারপ্রান্তে অনুভব প্রিয়ার এলাকায় গিয়ে হাজির হলো। প্রিয়ার বাড়িটা কোথায় নির্দিষ্টভাবে সে জানে না। কাজেই গলির মাথায় দাঁড়িয়ে কল করল ওকে। প্রথমবার বেজে বেজে কেটে গেল। অনুভব ধৈর্য ধরে আরো দুবার কল করল। প্রতিটা রিং হওয়ার সাথে সাথে ওর মাথা দপদপ করছিল রাগে৷ কত্ত বড়ো সাহস! সেদিনের মেয়ে তাকে ইগনোর করা শেখায়! তৃতীয়বার বেজে বেজে কেটে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে কল তুলল প্রিয়া। অনুভব কিছু জিজ্ঞেস করল না, কুশল বিনিময়ের ধারও ধারল না। রোষাগ্নি স্বরে বলল,
“এক্ষুণি যদি গলির মাথায় না আসো আমি তোমার বাড়ি ঢুকে যাব। এরপর যা হবে দেখা যাবে।”
অনুভব উত্তরের অপেক্ষা না করেই কল কাটে। প্রিয়া এলো ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায়। মাথায় ওড়না জড়িয়ে জুবুথুবু চলনে সে হাঁটছে। একটি দর্শনেই অনুভবের চৈত্রদগ্ধ হৃদয়ের আঙিনা দক্ষিণা হাওয়ায় দুলে উঠল। কিন্তু অভিব্যক্তিতে গোপন রাখল। আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ফিরবে। প্রিয়া কাছাকাছি এসে সাবধানী গলায় বলল,
“সন্ধ্যাবেলা এখানে কেন আসতে গেলেন?”
“তোমায় কি’ডন্যা’প করতে।”
প্রিয়া কথাটা বুঝে ওঠার আগেই অনুভব ওর হাত চেপে ধরে রিকশায় তুলে নিল।
চলবে…
#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৪১]
রাতের সঙ্গী আঁধার। আর সেই আঁধারের অঘোষিত নিয়ম নিঝুম নিস্তব্ধতা। রাতের দুটো নিয়মই ভেঙে প্রজ্জ্বলিত হয়েছে চোখ ধাধানো কৃত্রিম আলো। কোলাহলে মুখোরিত চারপাশ। তেমনই এক আলোকোজ্জ্বল শব্দমুখর স্থানে মুখোমুখি বসে আছে অনুভব ও প্রিয়া। গুমোট অনুভূতি চক্রাকারে পাক দিচ্ছে উভয়কে। মুখে নেই কোনো শব্দ। অনুভবের চোখে বেদনা, প্রশ্ন, রাগ। প্রিয়া নির্লিপ্ত। নিরবতা ভেঙে বলল,
“এখানে কেন এনেছেন?”
“রেস্টুরেন্টে মানুষ কেন আসে? নিশ্চয়ই সিনেমা দেখতে নয়।”
“আমি খাব না।”
“ফাইন, আমার খাওয়া দেখো।”
“আপনার খাওয়া বুঝি এতটাই দর্শনীয় কিছু?”
“তোমার উপেক্ষাও বুঝি এতটাই সহনীয় কিছু?”
অনুভব স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটির নত মুখশ্রীতে। প্রিয়া ক্ষীণ গলায় উত্তর দেয়,
“আমার কাজ আছে, ফিরতে হবে।”
অনুভব সবল হাতে প্রিয়ার হাত চেপে ধরে। শক্ত মুখে বলে,
“ড্যাম! সমস্যা কী তোমার? দুদিনের মেয়ে আমাকে ভাব দেখাও।”
প্রিয়া ঝারা দিয়ে হাত সরিয়ে নেয়। নিজেকে শান্ত রেখে শক্ত গলায় বলে,
“আপনি দেখতে কেন আসছেন?”
“হাসু… নাও ইউ আর রিয়েলি হার্টিং মি। আমি কী এতটা ডিজার্ভ করি?”
প্রিয়া দুহাতে মুখ ঢাকল। অস্থির লাগছে। কী ধরনের আচরণ করা উচিত আসলেই বুঝতে পারছে না। অনুভব বোধহয় মেয়েটির মনের অবস্থা টের পেল। ওর মুখ থেকে জোর করে হাত সরিয়ে আশ্বাসে আঁকড়ে ধরল। রুক্ষতাকে ভেঙে কোমল গলায় বলল,
“আমাকে একটুও ভরসা করো না তুমি? আমি এতটাই অবিশ্বাসের মানুষ?”
প্রিয়া চোখ তুলে তাকায়। বলে,
“বিশ্বাস করি তো।”
“তাহলে কি মনের কথা শোনার মতো মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি? আমি তাহলে সব দিক দিয়েই ব্যর্থ বলো? না পাচ্ছি ভালো একটা চাকরি, না হতে পারছি কারো মনের মানুষ। আই এম টোটালি আ লুজার।”
প্রিয়া এবার শক্ত করে ধরল অনুভবের হাত। কী বলবে ও? এই লোকটা তার জন্য ন্যায় চাইতে গিয়ে পরিবার হারিয়েছে। ক্রমাগত স্ট্রাগল করে চলেছে জীবনের সঙ্গে। প্রিয়ার জীবনের জটিলতা কেন তাকে শুনিয়ে উদ্বিগ্ন করবে? বরং মানুষটাকে দেখলে প্রিয়ার অন্তরে খারাপ লাগা বাড়ে। নিজেকে সর্বদা সেরা হিসেবে উপস্থাপন করা নিখুঁত মানুষটার দিকে তাকানো যায় না। দাড়ি-গোঁফে মুখ ঢেকে গেছে। মাথার চুলগুলোও বোধহয় কাটেনি মাসকয়েক। কপালে অবিন্যস্ত পড়ে আছে তা। চোখের নিচে ক্লান্তির ছাপ। কি বেহাল দশা! প্রিয়ার বুকটা হু হু করে ওঠে। মুখে বলল,
“আমার জন্য নিজেকে কেন ভুল বুঝছেন?”
অনুভব ক্ষণকাল বিলম্ব না করে উত্তর দেয়,
“কারণ আমার গন্তব্যটাই তুমি।”
প্রিয়ার অন্তরে শীতল বাতাস বয়। দীর্ঘদিন কান্না, অভিযোগ, ধিক্কার, পরিহাস শোনা কান যেন ব্যতিক্রম কিছু শুনতে পেয়ে আরামবোধ করছে। অনুভব বলল,
“আমার দোষটা কোথায়? এই অবহেলার কারণ? এটা নিশ্চয়ই বলবে না যে আমার মনের কথা তুমি বোঝো না।”
“বুঝি, বুঝি বলেই ভয় করে।”
“নির্ভয়ে একবার মনের কথাগুলো বলা যায় না? নিজেকে যতটা গুটিয়ে রাখবে ততটাই কষ্ট পাবে। মনের ওপর এত চাপ দেওয়ার কোনো দরকার আছে? কাউকে বলো, নিজেকে হালকা করো একটু। এই বয়সে আমি বন্ধুদের সঙ্গে হেসে খেলে বেরিয়েছি। জীবন সম্বন্ধে কোনো ভাবনাই ছিল না। আর তুমি কতটা মানসিক য’ন্ত্র’ণা বয়ে বেড়াও। এমন করে থাকলে পা’গল হয়ে যাবে একদিন। একজন সৎ পরামর্শদাতা হিসেবে তো তোমার কথাগুলো শুনতেই পারি। পারি না?”
প্রিয়া সঙ্গে সঙ্গে কোনো উত্তর দিল না। অনুভব ওর হাত ছেড়ে দিয়ে খাবার অর্ডার করল দুজনের জন্য। অনেকটা সময় পর প্রিয়া কথা বলল,
“জানেন, জীবনেরও যে একটা ভার আছে সেটা কখনো উপলব্ধি করিনি। গত একটা বছরে বুঝেছি জীবনের চেয়ে ভারী বস্তু পৃথিবীতে কিছু নেই। অর্থ-সম্পদ যত কমে জীবনের ভার তত বাড়ে। আমার জীবনটা এখন টিকে থাকার মাঝেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। দিনরাত মা-বোনকে নিয়ে চিন্তা। মাকে নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শে রাখতে পারলে পায়ের অবস্থার উন্নতি হতো। তা সম্ভব নয়। দিয়া বড়ো হচ্ছে। এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ায়। আমি তো সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতে পারি না। মাও পারে না। আশেপাশে বহু মুখোশ পরা মানুষ দেখি আজকাল। আমাদের দুর্বলতা বুঝে গেলেই তাদের নোংরা মুখোশ খসে যাবে। সুরক্ষা নিশ্চিত করাটা এখন আমার এক ও প্রধান লক্ষ্য। তারওপর অন্যান্য ঝামেলা তো আছেই।”
“যেমন?”
প্রিয়া ছোটো করে শ্বাস ফেলে বলল,
“বাড়ি ভাড়া জমে গেছে। বাড়িওয়ালা বলে দিয়েছেন এই মাসে ভাড়া না দিতে পারলে যেন বাড়ি ছেড়ে দেই। আমার টিউশনিতে তিন জনের খাওয়ার খরচই কুলোচ্ছে না। সঙ্গে দিয়ার পড়াশোনার খরচ বাড়ছে। আমি পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে পারব না। ভাবছি ফুলটাইম কোনো জবে ঢুকব। কিন্তু সেটাও খুঁজে পেতে সময় লাগবে। আচ্ছা… আপনি আমায় একটা সোনার চেইন বিক্রির ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন? বাইশ ক্যারেট আছে, মাত্র পাঁচ আনা। ওটা দিয়ে ভাড়াসহ খরচটা একটু গুছিয়ে নিতে পারতাম।”
প্রিয়ার চোখ ছলছল করছে। কণ্ঠস্বর কাঁপে। অনুভব বেদনাহত চোখে চেয়ে থাকে। অনেকক্ষণ কোনো উত্তর দিতে পারল না। প্রিয়ার দিকে খাবার এগিয়ে দিয়ে বলল,
“খেয়ে নাও। পরে কথা বলি।”
প্রিয়া নিঃশব্দে খেতে শুরু করে। সত্যিই খুদার্থ ছিল সে। দুজন খাওয়া-দাওয়া শেষে রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করে। অনুভব প্রিয়ার আঙুলের ভাজে আঙুল ডোবায়। প্রিয়া কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখাল না। রাতের আকাশে অগণিত তারকারাজি ফুটে আছে। কা’চির মতো সরু একফালি চাঁদ বুঝি ওদের দেখে মিটিমিটি হাসছে। অনুভব নির্জন স্থানে প্রিয়ার হাত টেনে ধরে পায়ের গতি রোধ করে। প্রিয়া প্রশ্নোক্ত চোখে তাকাতেই দুর্বোধ্য হেসে অতি নিকটে চলে আসে। প্রিয়া ভড়কে যায়। পিছিয়ে যেতে চাইলে অনুভব সরু চোখে চায়। যেন দৃষ্টি দিয়ে বোঝাতে চাইল,
“আমাকে ভয়!”
প্রিয়া অজান্তেই থেমে গেল। দৃষ্টি নিবদ্ধ করল অনুভবের সম্মোহিত চোখে। অনুভব গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। চন্দ্রালোকিত আকাশ ও গোপনীয়তা রক্ষাকারী রাতকে সাক্ষী রেখে প্রিয়তমার কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলল,
“ম্যারি মি হাসু।”
প্রিয়া ঝটকায় দূরে সরে গেল। বিস্ময়বিমূঢ় চোখে চেয়ে দেখল সোডিয়ামের হলদেটে আলোয় অনুভবের মুখের পেশি দৃঢ়। কৌতুকের হাসি সেখানে অনুপস্থিত। প্রিয়া কম্পিত গলায় বলল,
“মজা করছেন?”
“আমি মজা করার মুডে নেই, হাসু।”
“এ হয় না।”
“কেন? আমাকে তোমার স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে আপত্তি?”
“তা নয়, আমাকে আমার মা-বোনদের জন্য বাঁচতে হবে। ওদের আমি ছাড়া পৃথিবীতে কেউ নেই। বিয়ে করার কথা ভাবতেই পারি না।”
অনুভব ওর দুই কাঁধে হাত রেখে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল,
“সবদিক চিন্তা করেই বলছি আমি। মা আর দিয়াকে বাদ দিয়ে তো ভাবছি না। তুমি একটু আগে যা বললে এখন তোমার সেফটি নিয়েই আমার চিন্তা হচ্ছে। ছোটো বোনের সুরক্ষা নিয়েও তো ভাববে। ওই পরিবেশটা থেকে বেরিয়ে এসে একটা সেইফ বাড়ি দরকার। আমরা বিয়ে করে একটা ভালো দেখে বাড়ি ভাড়া করে নেব। চাকরি না হওয়া অবধি আরো দুটো টিউশন বাড়িয়ে নেব।”
প্রিয়ার আত্মসম্মানবোধ ঝুকতে রাজি নয়। সে বলল,
“তা হয় না। আমার মা-বোনের দায়িত্ব আমারই। আপনি নিজেই কত স্ট্রাগল করছেন। আমার বাড়তি বোঝা চাপানোর কথা ভাবতেও পারি না।”
অনুভব অসহায় কণ্ঠে বলে,
“আমার মা গত হয়েছেন আজ প্রায় আট বছর। বাবাও তার একবছর বাদে ছেড়ে চলে গেলেন। এরপর আর কেউ স্নেহের হাত রাখেনি মাথায়। আমারও একটা মা প্রয়োজন, হাসু। একটা ফ্যামিলি প্রয়োজন। আমি ফ্যামিলি পারসোন। ব্যাচেলর লাইফ আমার কাছে অসহনীয়। আমি বুঝতে পারছি তোমার অসুবিধা। তোমাকে টিউশনি কিংবা পড়াশোনা কিছুই ছাড়তে হবে না। আমরা নাহয় মিলেমিশে ঘর বাধব। পারবে না এই নিঃস্ব মানুষটার হাত ধরতে? একটা শূন্য সংসারকে ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণ করতে? প্লিইজ!”
অনুভব হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রিয়া শূন্য দৃষ্টিতে সেই হাতের দিকে চেয়ে থাকে। শক্ত খোলসের ভারে ন্যুব্জ আবেগী মনটা কেঁদে বলে রেখেই দেখ না হাতটা। দিনশেষে প্রিয় মানুষটার সান্নিধ্যও কম কি?
_________________
“দোস্ত, বিয়েটা করেই ফেলব এবার।” অনুভব উদাসী গলায় বলল।
তাল মেলালো টুকটুকি,
“দোস্ত আমিও বিয়ে করতে চাই।”
দিগন্ত দুজনের মাঝে ঢুকে বলে,
“তোদের কথা শুনে আমারও বিয়ে বিয়ে পাচ্ছে।”
নন্দিনী আলস্য ভেঙে আসন করে বসে। হাঁটুতে দুই হাতে তবজা বাজানোর ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
“আর আমি তোগো ঘটকালি করমু।”
ওরা বসে আছে চায়ের স্টলের বেঞ্চিতে। সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা গরম চা। দুপুরের কঠোর সূর্যটি রূপ বদলে কোমল হচ্ছে ধীরে ধীরে। দিগন্ত মুখ ভেঙিয়ে বলল,
“পারবি তো তাই। যেই হারে নিরুদ্দেশ থাকিস তাতে সংসার তো করতে পারবি না। যদিও বিয়ে করতে যায় দেখা যাবে নিজের বিয়েতে নিজেই ছেলেদের ওপর টপাটপ ক্রাশ খেয়ে বসে আছে। জামাই এক্সের সংখ্যা শুনলেই বাসর ঘরে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। বিয়ের পরদিনই শ্বশুর বাড়িতে লাল কার্ড দেখিয়ে দেবে।”
নন্দিনী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে কিছু বলতে যাচ্ছিল। অনুভব থামিয়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসে। সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে,
“দোস্ত আমি সিরিয়াস। হাসু খুবই স্ট্রাগল করছে। আমি ওর কাঁধে কাঁধ মেলাতে চাই। বিয়ে করব ফাইনাল। দরকার পড়লেই এই মাসেই, এই সপ্তাহেই।”
সকলে এবার সিরিয়াস হয়ে বসল। নন্দিনী বলল,
“থাকবি কই? ভার্সিটিতে মাইয়াগো হল আছে, পোলাগো হল আছে। কাপল হল নাই ক্যান? অবশ্যই থাকা উচিত। বেকার ছাত্র হলে থাকতে দেয় তইলে সেই বেকার পোলাপাইন ছাত্র বয়সে বিয়া করলে যাইব কই? প্রেম করা পছন্দ করো না তো বিয়া করতে দেও। বিয়ার পথ সহজ কইরা দেও। কাপল হল দেও। আমাগো উচিত মানববন্ধন করা।”
দিগন্ত নন্দিনীর মাথায় চাটি মা’রে। টুকটুকি হেসে বলল,
“হাসু কী রাজি?”
“সে কি রাজি হতে চায়? কথায় আছে না ছোটো মরিচের ঝাল বেশি। ঝালের জ্বা’লায় জীবন জ্ব’লবে আমার। আন্টির কাছে গিয়ে সরাসরি হাত চাইব। ভাইয়াকে বলে দেখি। ভাইয়া বললে ওদের একটা ভরসা হবে। নয়তো আন্টি ভেবে বসতে পারে চালচুলোহীন কে না কে।”
নন্দিনী দুহাত একসঙ্গে ঘষে বলে ওঠে,
“বিয়া খামু মামা। ফাইনালি কোনো বন্ধুর বিয়া খাওন কপালে জুটব।”
“বিয়ের আয়োজন তোদেরই করতে হবে মামা।”
অনুভবের চিন্তাকে তুড়ি মে’রে ঝেরে ফেলে সবাই বিয়ের আমেজে ডুবে গেল। সেই আমেজমুখর আড্ডা ভেঙে গেল বিকেলের আগেই। অনুভবের টিউশন আছে। টুকটুকির সন্ধ্যার আগে ফেরার তাড়া। নন্দিনী উঠে চলে যাওয়ার সময় দিগন্ত হাত ধরে থামিয়ে বলল,
“তোর কাজ আছে?”
“কত্ত কাজ? তোর কী দরকার সেইটা কইয়া ফেল।”
দিগন্ত অনুনয় করে বলল,
“থাক না কিছুক্ষণ। ভালো লাগছে না।”
নন্দিনী পাশে বসে উৎসাহী হয়ে বলল,
“তুই নাকি ধলাগো দ্যাশে যাবি? আমার লইগ্যা কয়ডা সুন্দর মুন্দর পোলা বাও কইরা দিস। বাংলাদেশের পোলারা বোরিং হইয়া গেছে।”
দিগন্ত রেগে উঠে পড়ল। কটমট করে বলল,
“যাচ্ছি না ইউএস। তোরও থাকা লাগবে না। কোন চুলোয় যাবি যা।”
__________________
টুকটুকি ইদানীং রিতা আন্টিকে এড়িয়ে চলছে। মূলত নিশীথ মাকে ফোন করে পালিয়ে যাওয়ার কথা বলার দিন থেকেই সে আন্টির মুখোমুখি হচ্ছে না লজ্জায়। বাড়িমুখো হওয়া তো দূরে থাক। তা নিয়ে রিতা আন্টি টুকটুকির ওপর বেজায় চটেছেন। বাড়ি থেকে ধরে এনে ধমক দিয়ে বললেন,
“এঞ্জেল রিতাকে ইগনোর করার মতো বুকের পাটা কোনো ফলোয়ারের নেই। আর তুই আমাকে পাত্তা দিচ্ছিস না? কত্ত বড়ো সাহস!”
টুকটুকি হেসে ফেলে বলল,
“আইডি এখনো আছে?”
“অবশ্যই। তুই কিন্তু আমার পোস্টে রিয়েক্ট দিচ্ছিস না খেয়াল করছি।”
“এখন থেকে দেব। লাইক, কমেন্ট, শেয়ার সব।”
রিতা আন্টি টুকটুকির বাহু ধরে কাছে টেনে ফিসফিস করে বলল,
“পালিয়ে গিয়ে বিয়ে-টিয়ে করে ফেলেছিস।”
টুকটুকি আরক্ত হয়ে ওঠে। মনে পড়ে গতবার আন্টি এই কথা জিজ্ঞেস করেছিল কান্নাকাটি করতে করতে। আর এবার ভাবলেশহীন গলায়। টুকটুকি একই ভঙ্গিতে ফিসফিস করে ওঠে,
“না।”
রিতা আন্টি সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। হাত থেকে ময়লা ঝারার ভঙ্গিতে বললেন,
“সো বোরিং! তুই থাক, আমি খাবার আনছি। অনেকদিন বাদে নিজের হাতে ভালোমন্দ রেঁধেছি। খাওয়াতেই ডাকলাম তোকে।”
রিতা আন্টি প্রস্থান করলেন বসার ঘর থেকে। নিশীথ এখনো অফিস থেকে ফেরেনি। টুকটুকি এদিক ওদিক চোখ বুলাতে বুলাতে দেয়ালে ঝোলানো লম্বা একটি ছবির দিকে নজর গেল। কনভোকেশনের দিন গাউন, ক্যাপ পরে হাতে সার্টিফিকেট নিয়ে তোলা গোমড়ামুখো রাজপুত্রের অতিশয় সুদর্শন এক ছবি। যেই ছবি দেখেই টুকটুকি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়েছিল লোকটার প্রতি। ও ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বেখেয়ালি গলায় স্বগোতক্তি করে,
“বর্ষণ রাজা,
তুমি কী দূর আকাশের মেঘ হয়েই থাকবে
ক্ষণিকের বৃষ্টি হয়ে মন খারাপে ভাসবে
মেঘকুমারী যে বিরহ বেদনার ভারে ক্লান্ত
তোমার স্পর্শে মেতে বাঁচতে চায় অনন্ত।”
ছবির কাচের ফ্রেমে টুকটুকির প্রতিবিম্ব পড়েছে। ক্ষণকাল বাদেই কাচে আরেকটি লম্বা মানবের প্রতিবিম্ব উদয় হলো। অতি নিকটে কেউ ভারী স্বরে বলল,
“মেঘকুমারী,
শ্রাবণের মেঘ কেটে বেরিয়ে দেখো
আমি ফাগুন বুকে নিয়ে তোমার অপেক্ষায়
একটুখানি বর্ষণ হয়ে সুখ ঝরাতে চাই।”
চলবে…
#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৪২]
টুকটুকি স্থবির। কানের কাছে উষ্ণ শ্বাসের ধাক্কা তাকে জমিয়ে দিচ্ছে বরফের মতো। হুট করে আতশবাজি ফোটানোর মতো টুকটুকির সারা মুখে আরক্ততা ছড়ায়। কণ্ঠস্বরে শব্দেরা তালগোল পাকায়। মাথা নুইয়ে আসে বুকের কাছে। মেঘকুমারী শব্দটা ওই রুক্ষ গলায় এতটা মনোরম শোনায়! এতটা হৃদয়গ্রাহী শব্দ দুটো আছে নাকি পৃথিবীতে! টুকটুকি এই শব্দটা শোনার জন্য বোধহয় দীর্ঘ তপস্যা করতে প্রস্তুত। ও বুঝতে পারছে লোকটা তার অতি নিকটে। পিছু ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এই ক্ষণ, এই নৈকট্য, এই উষ্ণতা জানান দিচ্ছে না ছুঁয়েও কাউকে নিবিড়ভাবে ছুঁয়ে দেওয়া যায়। নড়লেই যদি মুহূর্তটা উবে যায়! দেহের জড়তাকে ধিক্কার দিয়ে মনের ভেতর থেকে কেউ সুখোধ্বনি করে বলছে, এক জনমে এই তো আকাঙ্খা ছিল। কারো বুকে একটুকরো জমিনের মালিক হওয়া। পৃথিবীতে তার চেয়ে সম্পদশালী আর কে? কারো সুখের কারণ হয়ে নিজে সুখী হওয়া। ভয় কিসের! মানুষটা একান্তই যে নিজস্ব সম্পত্তি।
টুকটুকি মাথা তুলে সামনের দিকে চাইল। কাচের ফ্রেমে তার ঠিক পেছনেই লম্বা মূর্তিটা অপলক চেয়ে আছে। গম্ভীরমুখো লোকটার চোখে আজ আশকারার হাতছানি। ঠোঁটের ভাজে ক্ষীণ একটি হাস্যরেখা নিভু নিভু করছে। যেন গম্ভীরতাকে অস্বীকার করতে নারাজ আবার আঁকড়েও রাখেনি।
নিশীথ ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলল,
“কাকে যেন বর্ষণ রাজা সম্বোধন করলেন শুনলাম? তিনি কি এখানেই? কিংবা ওই ছবিতে?”
টুকটুকি আরো বিমূঢ় হয়। কানের কাছে নিশ্বাসের স্পর্শটা আরো জোরাল, আরো স্পষ্ট হচ্ছে। নিশীথ ঝুকে মুখটা দেখার চেষ্টা করে বলল,
“আপনি কী লজ্জা পাচ্ছেন, ম্যাডাম?”
টুকটুকি বুঝল সে নিজেকে যতটা গুটিয়ে নেবে এই লোক ততই পেয়ে বসবে। নিজের অবস্থান খেয়াল করতেই আড়ষ্টতা ঝেরে স্বাভাবিক হতে চাইল। রিতা আন্টি যেকোনো সময় এসে পড়বে। পা’জি জরিটা যদি দেখে তাহলে সারা রাষ্ট্র করবে। ও ঘুরে দাঁড়ায় চকিতে। ভেবেছিল নিশীথ সরে দাঁড়াবে। কিন্তু সে এক চুলও নড়ল না। ফলে কোনঠাসা হয়ে টুকটুকি ঠেকে গেল ছবির ফ্রেমের সঙ্গে। নিশীথের দুহাত পকেটে গুজে রাখা। দাড়ানোর ভঙ্গি বলছে অবস্থান নিয়ে সে ভাবলেশহীন। টুকটুকি গলা ঝেরে কিছুই হয়নি এমন ভাব করে বলল,
“এখানে কি করছেন?”
“প্রশ্নটা আমার করার কথা ছিল।” নিশীথের রুক্ষ ঠোঁটের নিভু নিভু হাসিটা প্রাণ ফিরে পাচ্ছে।
টুকটুকি অপ্রতিভ স্বরে বলল,
“আন্টি ধরে আনলেন। আজ আপনাদের বাড়িতে দাওয়াত আমার।”
“আই সী! তাই হুট করে এই গোধূলি লগ্নে ভূতের বাড়িতে সূর্যোদয় হলো।”
সুযোগটা ছাড়ল না টুকটুকি। চোখে চোখ রেখে মিষ্টি হেসে বলল,
“এতক্ষণ বুঝি রাত ছিল?”
“তা নিশ্চিত বলতে পারব না। আমি আপনার মতো হৃদয় বিশেষজ্ঞ নই। শুধু জেনে রাখুন, জীবনে প্রথম এক মেঘ দেখলাম যে আকাশ ঢেকে আঁধার নামায় না, বরং আলো ছড়ায়। আপনি চেনেন তাকে? তার নাম মেঘকুমারী।”
“চিনি না তো।” বলে টুকটুকি হাসি লুকাতে মাথা নত করে।
“গালদুটো পাকা আমের মতো হয়ে আছে যে! টসটস করছে।” নিশীথ আকস্মিক টুকটুকির গাল টিপে দিল আলতো আঙুলের স্পর্শে। ভ্রু কুচকে পুনরায় বলল,
“আপনি এত লজ্জা পান জানতাম না তো।”
টুকটুকি কপট রাগের ভঙ্গিতে চায়। তাদের পূর্বদিনগুলোর সাক্ষাৎ মোটেও এতটা সাবলীল ছিল না যে টুকটুকি লজ্জা পাবে। বরং কে কাকে কথায় হারাবে তা নিয়েই যু’দ্ধ করে গেছে। এখন পরিস্থিতি বদলেছে। মনের কাছে বাকিসব নতি স্বীকার করেছে। যু’দ্ধের এখানে কোনো ঠাঁই নেই। আছে শুধু নির্মল আনন্দ। সেই আপাদমস্তক সুখী মেয়েটি আবারো নিজেকে খুঁজে পাচ্ছে প্রতিক্ষণে। টুকটুকি উত্তর দিল,
“লজ্জা নারীর অতিব মূল্যবান বস্তু। অতিব মূল্যবান মানুষটার জন্যই সংরক্ষিত। সবার দেখার জন্য নয়।”
নিশীথের হাসি চওড়া হয়েছে। সব বুঝে ফেলেছে এমন ভঙ্গিতে মাথা ঝাকিয়ে বলল,
“আমি তাহলে ‘সবার’ তালিকা থেকে স্বতন্ত্র। জেনে ভালো লাগল।”
দুটি মনে আজ একই সুর, একই ছন্দ স্পন্দিত হচ্ছে। একজন লজ্জার ভারে ন্যুব্জ, অন্যজন লজ্জার নতুন রূপে মুগ্ধ। নারী, সে তো করবেই বিচিত্র অনুভূতিকে ধারণ। পুরুষের রুক্ষ হৃদয়কে নাহয় কী করে করবে কর্ষণ!
দৃশ্যপটে রিতা আন্টি উপস্থিত হলেন তখনই। অবাক গলায় বললেন,
“তোরা ওখানে কী করছিস?”
দুজনে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে ছিটকে দুদিকে সরে গেল। টুকটুকির মাথায় সঙ্গে সঙ্গে যা এলো তাই করতে লাগল,
“পামকিনকে খুঁজছিলাম আন্টি। এদিকেই তো ছুটে এলো।”
টুকটুকি নজর লুকিয়ে এদিকওদিক খুঁজতে লেগেছে।
রিতা আন্টি ছেলের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বললেন,
“তুইও পামকিনকে খুঁজছিস?”
নিশীথ পড়ল বেকায়দায়। এই ড্রামা কুইন রমনীর মতো নাটক সে পারবে না। গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
“ফ্রেস হবো, সিড়ির দিকে যাচ্ছিলাম।”
রিতা আন্টি অদ্ভুত হেসে উল্টোদিকে নির্দেশ করে বললেন,
“ওপরের যাওয়ার সিড়িটা এদিকে বাবা। ওদিকে যাওয়ার সিড়িটা তুমি এখনো অর্জন করতে পারোনি।”
নিশীথ কোনো কথা না বলে লম্বা কদম ফেলে স্থান ত্যাগ করে। টুকটুকি কাচুমাচু হয়ে ছিল। রিতা আন্টি ওকে উদ্দেশ্য করে গজগজ করে বললেন,
“ছেলেটা একদম বাপের মতোই হয়েছে। খুব বেশি পাত্তা দিবি না বুঝলি। পাত্তা পেলেই মাথায় চড়বে। টাইট দিয়ে রাখবি সব সময়। ওর বাপকে আমি সিধা করতে পারিনি। ছেলেকে তুই করে দিবি।”
“এ্যা?” টুকটুকি হতভম্ব।
“এ্যা নয় হ্যাঁ।”
________________
অনুভব নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে বসার ঘরে। অনেকদিন পর ভাইয়ার ফ্ল্যাটে পা রাখল সে। চেনা চেনা গন্ধে মনটা আকুল হয়ে উঠল। তিনটে মাস পর স্বাচ্ছন্দ্যের গন্ডিতে পা পড়ল ওর। এই বাড়ি, দেয়াল, মানুষগুলোই একটা সময় ওর কত আপন ছিল। আর এখন শুধুই দূরত্ব আর অস্বস্তি। জাইম হামাগুড়ি দিয়ে পুরো বাড়ি ছুটে বেড়ায়। দাঁড়াতেও পারে সোজা হয়ে। সামনের গুটিকয়েক দাঁত বের করে কতসব নতুন শব্দ আবিষ্কার করে চলেছে। অনুভবকে দেখে প্রথমে সে কাছে আসতে চায়নি। তিন মাসেই চাচাকে ভুলে বসেছে একদম। অনুভবের বেশ খানিকটা সময় লেগেছে ওর সঙ্গে মিশতে। এরপর তাকে বুকে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দলাইমলাই করল।
অন্তরা আপার মা বসে আছেন সম্মুখে। ভাবখানা এমন যে বাইরের লোকের কোলে নাতিকে ছেড়ে দিয়েছেন। চোখের আড়াল করলেই বিপদ। বৃদ্ধার কুচকানো চামড়ার মধ্যে স্থাপিত হলদেটে চোখ অনুভবের ওপর থেকে সরছেই না। যেন বুঝে নিতে চাইছেন বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর কি কি উন্নতি অবনতি ঘটেছে। পর্যবেক্ষণ শেষে অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন,
“দম শেষ? খুব তো বেরিয়ে গিয়েছিলে নিজের দায়িত্ব নিজে নিয়ে। তেল মজেছে?”
অনুভব মেকি হেসে বলল,
“আমার জোয়ান বয়স, এত সহজে দম শেষ হওয়ার নয়। আপনার তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে। দম কখন না শেষ হয়। তাছাড়া তেল স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। আমি তেল দেইও না, নেইও না। আপনিই নাহয় তা গায়ের মধ্যে জমা করুন। তেলের এখন মেলা দাম। বাই দ্যা ওয়ে, মেহমানকে শরবত-পানীয় কিছু দেন না নাকি?”
বৃদ্ধা ফুঁসে উঠলেন। আগে যতটা সমীহ করে কথাবার্তা বলত এখন সেটার লক্ষণও নেই ছেলেটার মাঝে। বস্তির মেয়েটার পাল্লায় পড়ে ব’খে গেছে একদম! বৃদ্ধা কটমট করে বললেন,
“তোমার ব্যবহার অত্যন্ত অসংলগ্ন হয়ে গেছে ইদানীং। হবেই তো। না আছে লাগাম আর না শাসন। চেহারার অবস্থা দেখি বাজে হচ্ছে দিন দিন। নে’শাপানিও করো নাকি?”
“হ্যাঁ, আপনি করবেন? খুব মজা কিন্তু। একেবারে এই দুনিয়া ছেড়ে অন্য দুনিয়ায় চলে যাওয়ার ফিলিং পাবেন।”
বৃদ্ধা হতচকিত হয়ে গেলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
“ব’খা’টেপনা শুরু করেছ? ওই বস্তির মেয়েটা এইসব শিখিয়ে ছেড়েছে! এখন কি এখানে টাকা চাইতে এসেছ?”
অনুভব বিরক্তি লুকিয়ে বাঁকা হাসে। এদিক ওদিক তাকিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে বলল,
“আপনি তো বাড়িতে একা আছেন, তাইনা?”
“তো?”
“ধরুন আপনাকে যদি গুম করে দেই, এরপর ডাকাতি করে চলে যাই, কেমন হবে বিষয়টা? খুব ইন্টারেস্টিং না? নে’শাপানির টাকা জুটছে না তো। শেষে এই পথটাই খোলা আছে।”
বৃদ্ধা ভয়ে লাফিয়ে উঠলেন। অশ্রাব্য গা’লাগা’ল দিতে দিতে ছুটে গেলেন বেডরুমের দিকে। দরজা আটকে দিয়ে ফোন করলেন মেয়ের কাছে। অনুভব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বুড়ি ভয়ে দৌড়ে তো গেল, ছোট্টো নাতিটাকে নিতে ভুলে গেল। অনুভব জাইমের কানে কানে বলল,
“শোন বাচ্চা, বড়ো হয়ে চাচার মতো হবি। ভুলেও নানির মতো হবি না। বুড়ি বিপদে নিজেকে ছাড়া সবাইকে ভুলে যায়। যখন কান্নাকাটি করবি হাত-পা ছুঁড়ে বুড়ির নাক ফাটিয়ে দিবি। চিকিৎসার জন্য তোর বাপ তো আছেই। একদম ভয় পাবি না।”
জাইম কিছু না বুঝে দুই হাতে অনুভবের চুল নিয়ে খেলতে লাগল। অন্তরা এলো সন্ধ্যা নাগাদ। অনুভবকে বসার ঘরে ভাবলেশহীন বসে থাকতে দেখে বলল,
“মাকে ভয় দেখিয়েছ কেন?”
অনুভব হেসে বলল,
“মজা করেছি ভাবী। আন্টি বলছিলেন আমাকে নাকি ব’খাটে দেখায়, নে’শাপানি করি, তাই আমিও মজা করলাম।”
অন্তরা অসন্তুষ্ট হয়ে বলল,
“মোটেও ঠিক করোনি। বুড়ো মানুষ, প্যানিক এ্যাটাক হয়ে গেলে? যাইহোক, এতদিন পর হঠাৎ?”
“ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলার ছিল।”
“কোন বিষয়ে?”
অনুভব একটু সময়ক্ষেপণ করে বলল,
“বিয়ের ব্যাপারে। ভাইয়া-ই তো আমার একমাত্র অবিভাবক। তাই…”
“তুমি বিয়ে করছ? কাকে? বলো না যে সেই ক্রি’মি’নালের মেয়েটিকে!”
অনুভব ফোস করে একটা নিশ্বাস ত্যাগ করে। কেন জানি মনে হচ্ছে আসাটাই বৃথা। উল্টো প্রিয়াকে অপমানিত হতে হবে। ভাবী ও তার মা ভাইয়াকে সমীহ করে অনুভবের সঙ্গে যে নরম ব্যবহার করত, ভাইয়ার উষ্ণ আচরণে তা উবে গিয়ে আসল মনোভাব বেরিয়ে এসেছে। ইদানীং ওর মনে হয়, পৃথিবীতে সবচেয়ে জটিল কর্ম হলো মানুষ চেনা। এমনকি এক জীবনে মানুষ নিজেকেও চিনে উঠতে পারে না।
___________________
অলস ভঙ্গিতে নন্দিনী যখন বসের রুমে ঢুকল তখন রাত গড়িয়েছে। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের এই জবটায় আজ সে পাঁচ বছর হলো ভলান্টিয়ার হিসেবে যুক্ত আছে। সব সময় সব প্রোগ্রাম এটেন্ড করতে পারে না সে। ইচ্ছে, সময় ও সুযোগ বুঝে আসা-যাওয়া করে। সেই অনুযায়ী পেমেন্ট পায়। নন্দিনীকে অনেকবার রিকুয়েষ্ট করা হয়েছে কোম্পানিতে ভলান্টিয়ার পদ ছেড়ে পার্মানেন্ট জব নিতে। তার প্রেজেন্টেশন, আইডিয়া সবই ইউনিক। যেকোনো অকেশন অনুযায়ী দারুণ সব থটস এন্ড প্ল্যান দিতে পারে যা ক্লায়েন্টকে মুগ্ধ করে।
আমিন সাহেব এমন রুচিশীল, বুদ্ধিমতি ও পরিশ্রমী কর্মী হাতছাড়া করতে নারাজ। সমস্যাটা হলো মেয়েটি নিজের মর্জির মালিক। কারো হুকুম শুনতে নারাজ। যখন কাজ করবে শেষ না করে থামবে না। আর যখন করবে না জোর করেও করানো যাবে না। এমন আত্মভোলা ও স্বাধীনচেতা মেয়ে তিনি কমই দেখেছেন। স্রোতের বিপরীতে চলতে চাওয়া মানুষগুলোর মাঝে প্রতিবাদী, সোসাইটি চেঞ্জার, ট্যাবু ব্রেকার টাইপ মানসিকতা থাকে। এই মেয়েটি তেমনও নয়। নির্বিবাদে চলে। মানুষকে গুরুত্বও দেয় নিজের মর্জি অনুযায়ী, অন্যের যোগ্যতা অনুযায়ী নয়। এই যেমন মধ্যবয়স্ক আমিন সাহেবের সামনে যুবতী তরুণী পায়ের ওপর পা তুলে নির্বিকার চিত্তে বসে আছে। অফিসের দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি সাহসটা দেখাবে না। এই নিরুত্তাপ আচরণটাই আমিন সাহেবকে আকর্ষণ করে অত্যাধিক। আমিন সাহেব মানুষের সাইকোলজি ভালো বোঝেন। আচরণগত বৈশিষ্ট্য দিয়েও মনের অবস্থা বুঝে ফেলেন। বহুবার নন্দিনীর মাইন্ড রিড করতে চেয়েছেন। কিন্তু প্রতিবারই তিনি ব্যর্থ। মেয়েটিকে বোঝার সাধ্য উনার অভিজ্ঞ চোখেও হয়ে উঠছে না।
নন্দিনী দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ানো শেষে দেয়াল ঘড়ি থেকে চোখ ফিরিয়ে বলল,
“বস, পাঁচ মিনিট হলো অযথা বসে আছি।”
আমিন সাহেব সময় দেখলেন। তিনি পানচুয়াল মানুষ। এই রহস্যময় মেয়েটি এলেই সময়ের হেরফের হয়। তিনি গলা ঝেরে বললেন,
“যেটা বলতে ডাকলাম। আমি চাই শুক্রবারের ইভেন্টটা তুমি এটেন্ড করবে, নন্দিনী। বিশাল প্রোগ্রাম। মন্ত্রীদের আনাগোনা থাকবে। সবকিছু চোখ ধাঁধানো হওয়া চাই। সমস্ত প্ল্যানিং করা আছে তবুও চাইছি একটা ফাইনাল টাচ তোমার থাকুক। এতগুলো বছর তোমায় সহ্য করে আসছি, সেই সুবাদে আমার আবদার তুমি রাখবে।”
নন্দিনী শব্দ করে হাসল। আমিন সাহেব এই এক ডায়লগ দিয়ে তাকে সব সময় কাজে টানতে চান। ও বলল,
“যদি আবদার না রাখি বস?”
“চাকরি নট করে দেব। ভলান্টিয়ার হিসেবেও ডাকব না।”
নন্দিনী আবার হাসল। গত পাঁচ বছরে এই বিজনেসের কাজে যুক্ত থেকে নন্দিনী সব কিছুতে এতটাই পারদর্শী যে এখন বসের ছায়াতল থেকে বেরিয়ে নিজেই বিজনেস স্টার্ট করতে পারবে। দরকার শুধু অর্থায়ন। কিন্তু নন্দিনীর কোনোটাতেই আগ্রহ দেখায় না। ও ভাবে কোনোকিছুতে আগ্রহ তৈরি হলেই সেটা অপছন্দের জিনিসে পরিনত হবে। যেমনটা ওর বয়ফ্রেন্ডগুলো। শুরুতে আগ্রহ পায় বলেই অপছন্দের তালিকায় উঠে যায় অনায়াসে। নন্দিনী জানে এই স্বভাবটার জন্যই তার কোনোদিন স্থায়ী রিলেশনশিপ হবে না। কোনো বন্ধন তাকে জড়াতে পারবে না।
চলবে…