#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৪৩]
নিস্তব্ধ রাতের বুকে একাকী হেঁটে চলেছে অনুভব। চারপাশ সুনসান৷ থেকে থেকে ভেসে আসছে নিশীপোকাদের কলরব। গাছপালায় ঘেরা ক্যাম্পাসে রাত নামতেই নামে শীতলতা। কোমল হাওয়ার তালে দোলে মন, জুড়ায় অঙ্গ। অনুভব কিছুদূর এগিয়ে বসে পড়ল লেকের পাশে। জলের বুকে তারকাদের ঝিলিমিলি অস্ফুট প্রতিচ্ছবি। সেদিকে তাকিয়ে অনুভবের চোখে ভেসে ওঠে সন্ধ্যার ঘটনা। ভাইয়া হসপিটালের ডিউটি শেষে বাড়ি এসে অনুভবকে দেখে প্রথমে ভেবেছিল সে নতমস্তকে আবারো ঠাঁই চাইতে এসেছে। কিন্তু যখন জানল প্রিয়াকে বিয়ে করতে এই আগমন ভাইয়া সঙ্গে সঙ্গে ক্ষে’পে গেল। অনুভবকে জীবন সম্পর্কে নানান উপদেশ, পরামর্শ দিল। কিন্তু কোনোটাই অনুভবকে সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারল না। উল্টে ভাবী জানাল তার হাতে একজন ভালো পাত্রী আছে। অন্তরার মামাতো বোন। বংশ ভালো, মেয়ের কোনো বাজে রেকর্ড নেই। সংসারীও। তাকে বিয়ে করে এনে একই বাড়িতে আবার আগের মতো সবাই একত্রে থাকবে। অনুভব ভাবীর মনের কথা বুঝে ফেলেছিল চট করে। তার বউ আনার সঙ্গে সঙ্গে ভাবী চাইছিল বৃদ্ধা মা ও শিশু জাইমের একজন পার্মানেন্ট দেখাশোনার লোক। দেবরের বউ ও নিজের আত্মীয় সম্পর্কের বোন সংসারে এলে তা আরো সহজ হয়ে যেত। বিতৃষ্ণায় অনুভবের মনটা ছেয়ে গেছিল। সকলে নিজের স্বার্থটাই দেখে চলেছে। সেই স্বার্থে অন্যের মনঃক্ষুণ্ন হবে কিনা তা দেখছে না।
অনুভব হাল ছেড়ে ফিরে এসেছে। বুঝে গেছে সম্পর্কটা আরেকদফা বিগড়ে গেল। ভাইয়া আরো দূরের মানুষ হয়ে গেল। এখন মনে মনে সে প্রিয়াকে ধন্যবাদ দেয়। মাথার ছাদ সরে গেলেও তার উছিলায় মানুষ চেনা গেল। বুকের ভেতর অসহ্য য’ন্ত্র’ণা উদ্বেলিত হয়। ভাইয়াকে, ভাইয়ার পরিবারকে সে ভালোবেসেছে। সেই ভালোবাসায় স্বার্থ নেই, নির্ভেজাল। তারাও কি একই রকম বেসেছিল?
অনুভব মাটির দলা হাতরে নিয়ে জলে ছুঁড়ে দেয়। টুপ করে একটা শব্দ হয়ে তা জলের বুকে তরঙ্গ তুলে মিলিয়ে যায়৷ অনুভব বন্ধ ফোন চালু করে সময় দেখে আবার বন্ধ করে দেয়। রাত বারোটা বাজে। প্রিয়া কি ঘুমিয়ে গেছে এখন? হয়তো। কোনোদিন যদি সেও এভাবে ভাইয়ার মতো মুখ ফিরিয়ে নেয়? অনুভবের এই পৃথিবীতে আর কে থাকবে ভালোবাসার? সেদিন সে পৃথিবীকে নিষ্ঠুর আখ্যা দিতে দুবার ভাববে না। ও এখনো পর্যন্ত প্রিয়াকে বিব্রত করতে চায়নি বলে অতীতের কোনো বিষয়ে প্রশ্ন তোলে না। প্রিয়া নিজেই অস্বস্তি কাটিয়ে মাঝেমাঝে টুকটাক সব বলে। প্রিয়ার ভয়টাও তারই মতোন। যদি বাবার সত্যিটা না মানতে পেরে অনুভব ভুল বুঝে চলে যায়! অনুভব অবশ্য তাকে আশ্বাস দিয়েছে। যে হাত সে একবার ধরেছে তার দখল আমৃ’ত্যু ছাড়বে না। তাহলে প্রিয়া কেন সরে যাচ্ছে! সমগ্র পৃথিবী একজোট হয়ে তার বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে, নাকি সেই পৃথিবীর নিয়মের বাইরে চলে যাচ্ছে সেই হিসেব করতে গিয়ে মস্তিষ্ক উত্তপ্ত হয়ে আছে। নির্জন রাতের মমতাময়ী বুকে আশ্রয় চেয়ে ঘাসের ওপর গা এলিয়ে দিল অনুভব। মশার কামড় তার ঘোরগ্রস্ত মনের সীমাহীন ক্লান্তির কাছে পাত্তা পেল না।
পরদিন ভোরে নন্দিনী তাকে খুঁজে বের করল। হাতের ওপর মাথা দিয়ে মাটিতে শুয়ে থাকতে দেখে প্রথমে ভেবেই বসল অজ্ঞান হয়ে গেছে কিনা। ছুটে এসে পাশে বসে শুনল মৃদু নাক ডাকার শব্দ। সারা গায়ে মশাদের রক্তিম চুম্বনের ছাপ। ফর্সা ত্বকে তা অস্বাভাবিক প্রকটিত। ভোরের সূর্যটি তখনও উঁকি দেয়নি। সদ্য আলো ফোটা প্রকৃতি এখনো ঝিমিয়ে। পথে লোক চলাচল শুরু হয়নি। নন্দিনী আচম্বিতে অনুভবকে ঝাকি দিয়ে উচ্চস্বরে বলে,
“মই’রা গেছোত হা’রা’মীর ছাও।”
শব্দটা যেন লেকের জলে হাবুডুবু খেয়ে বিকট হয়ে ওঠে। অনুভব লাফিয়ে উঠল,
“আল্লাহ ভূমিকম্প…”
“মোর দ্যান আর্থকুয়েক, দিস ইজ ইকরি-মিকরি।”
অনুভব ধাতস্থ হয়ে বুকে থুতু দেয়। কঠিন গলায় বলে,
“বজ্জাত মাইয়া, সকাল সকাল আমারেই পাইছিস জ্বা’লাতন করতে?”
“আর তুই কী করছিস? কোনো খবর নাই, রাইতে হলে ফিরোছ নাই, ফোন বন্ধ। এদিকে আমরা হগলে খুঁইজ্জা ম রি।”
অনুভব চোখ রগড়ে ভাবলেশহীন গলায় বলল,
“হলে ফিরিনি বলল কে?”
“হালুম গেছিল তোর কাছে। দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা কইরা খবর না পাইয়া আমারে জ্বা’লানো শুরু করছে। আমি গেছিলাম ইভেন্টের অফিসে। কোনোমতে দৌড়ায় আইছি। এদিকে তুমি লাপাত্তা। ভাবলাম হাসুর প্রত্যাখান পাইয়া টপকায় গেলি নাকি। তোরা যেই সেন্টিমেন্টাল বাবা… আর ওইদিকে হাবা টুকটুকি কাইন্দা রাইন্ধা আন্ধা হওনের জোগাড়।”
ফোনটা বন্ধ রাখায় অনুভবের অনুশোচনা হলো। টুকটুকি মাত্রাতিরিক্ত আবেগী। কেঁদেকুটে নাজেহাল হয়ে গেছে বোধহয়। বলল,
“ওই হাবারে ফোন লাগা। বল ম’রি নাই।”
“তোমার কওয়ার অপেক্ষাই বইসা রই নাই। মাডিত লেটকি মা’ইরা পইড়া থাকতে দেইখাই ছবিসহ গ্রুপে ম্যাসেজ কইরা দিছি।”
“ভালো করছিস।”
অনুভব নির্বিকার চিত্তে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে যেতে নেয়। নন্দিনী ওর বুকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
“ভাব লও আমাগো লগে? দেবদাস হইয়া গেছো? ম’দ আইন্যা দিমু? সিগারেট টানবি?”
“খাব, মা’তাল হয়ে দুনিয়া ভুলে থাকব। হু’ইস্কি, টা’কিলা কিছু জোগাড় করে দে।”
“সমস্যা কি? ভাইয়ের বাড়িত মানে নাই?”
অনুভব নতমুখে ঘাসের দিকে চেয়ে থাকে। তার দেহের ভারে সবুজ ঘাসগুলো নেতিয়ে পড়েছে। নন্দিনী মৌনতাকে সম্মতির লক্ষণ বুঝে বলল,
“না মানলে না মানব। তার লইগ্যা বিয়া আটকাইব? আমরা আছি না। সব ব্যবস্থা কইরা লামু। তুই খালি ডেট ফালা।”
“মিয়া কাজি থাকলে তো হবে না। বিবিকেও রাজি হতে হবে।”
নন্দিনী অবাক হয়ে তাকায়,
“হাসু মানে না ক্যান? তুই আবার উল্টাপাল্টা কিছু করোছ নাই তো?”
“আরে নাহ। ওইটুকুনি মেয়ে মা-বোনদের জন্য জান দিয়ে খাটছে। তুই জানিস বস্তিতে ওরা কতটা অনিরাপদ! আন্টি হাঁটতে পারেন না। হাসুর একটা টিউশনির ওপর পরিবারটা টিকে আছে। আমি কিচ্ছু করতে পারছি না। আত্মসম্মান এতটাই বেশি যে না খেয়ে মরবে তাও সাহায্য নেবে না। ওর ধারণা আমি ওদ ওপর দয়া করছি, ওর জন্যই আমি পরিবার ছাড়া, হ্যানত্যান অনেককিছু।”
নন্দিনী ঠোঁট টিপে চুপ রইল। দুটি ছেলে-মেয়েকে সাত-সকালে লেকের পাশে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় বসে থাকতে দেখে ক্যাম্পাসের জুনিয়র ছেলে-মেয়েরা কৌতুহলে দৃষ্টি দিচ্ছে। নন্দিনী একটু ভেবে বলল,
“তোর হাসুরে আমার লগে যোগাযোগ করা। আমার ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের অফিসে নিয়োগ দেই। প্রথমে ভলান্টিয়ার হোক, হাত পাকলেই পার্মানেন্ট নিব। শুধু রাইতে বাড়ি ফিরতে লেইট হইব এই যা। তার জন্য তো তুই আছিস। প্রেমের উপরে একটা জোর আছে না? ডিরেক্ট বাড়িত গিয়া ক হাসু দ্য ফাসু, তুমি আমারে বিয়া না করলেও আমি তোমারে বিয়া করমু। তুমি সংসার না করলেও আমি সংসার করমু, তুমি বাচ্চা পয়দা না করলেও আমি… নাহ, ব্যাটা মানুষ সেইটা পারবি না। যাইহোক, হেরপরেও কাম না হইলে আমরা আছি তো তুইল্লা আইন্যা মা’মলা ডিসমিস কইরা দিমু। বুকে দম রাখ।”
অনুভব হেসে ফেলল। উঠতে গিয়ে সারা গা টনটন করে উঠল ব্যথায়। কি আশ্চর্য! রাতে তার মনে হচ্ছিল পৃথিবীতে সে একা। কেউ নেই তার জন্য দুঃখ করার। অথচ সকালটা সেই আক্ষেপের জবাব দিয়ে দিল। এই বিচিত্র, পা’গ’লাটে মানুষগুলোর সঙ্গে মানসিক বন্ধনের জোর তার র’ক্তের বন্ধনকেও হারিয়ে দিল।
বেলা বারোটা নাগাদ অনুভব প্রিয়াকে ফোন করে বলল,
“ভাত রেঁধেছো?”
প্রিয়া হুট করে এমন প্রশ্নের মানে বুঝতে না পেরে বলল,
“এই সবে বসাব। কেন?”
“দুই মুঠ চাল বেশি দিয়ো। মেহমান আসবে।”
অনুভব প্রিয়ার কোনো কথা না শুনেই ফোন রেখে দিল। প্রিয়া পড়ল মহা চিন্তায়। কে আসবে, কেন আসবে কিছুই না বলে এই টেনশন দেওয়ার মানে কী? একবার ভাবল রাঁধবে না বেশি। কী মনে করে আবার বেশি চাল দিল। মুনিরা বেগম খেয়াল করে বললেন,
“রাতের সহ রাঁধবি?”
প্রিয়া সে কথার জবাব দিল না। কেউ আসবে কিনা সে জানে না, এলেও কেমন পরিস্থিতি তৈরি হবে তাও অজানা। অথবা ফা’জ’লামিও করতে পারে। লোকটা যে কী য’ন্ত্র’ণা দেয় মাঝে মাঝে! জোহরের নামাজের পর পাঞ্জাবী-পাজামা পরে, হাতে মিষ্টি, চিপস, জুস ও ফলমূল নিয়ে অত্যন্ত সুপুরুষ যুবক পা দিল দরজায়।
“আসসালামু আলাইকুম আন্টি, আসতে পারি?”
অনুভবকে মিষ্টি হেসে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রিয়ার চোয়াল ঝুলে যাওয়ার অবস্থা। পেছনে আবার বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়ে আছে রঞ্জু। সেই পথ চিনিয়ে এনেছে অনুভবকে। মুনিরা বেগম ভ্রু কুচকে গম্ভীর গলায় বললেন,
“তোমার পরিচয়?”
অনুভব ভেতরে ভেতরে চূড়ান্ত ভড়কে আছে। প্রেমিকার মায়ের সামনে নিজেকে ঠিক কেমন করে উপস্থাপন করা উচিত বুঝতে পারছে না। কিন্তু বাইরে সেসব জড়তা প্রদর্শিত না করে বলল,
“আমি অনুভব হাসান। হাসু না মানে প্রিয়া আপনাকে আমার কথা কিছু জানায়নি?”
অনুভব সরল চোখে প্রিয়ার দিকে চায়৷ প্রিয়া কটমট করে তাকায়। এখন তার কাঁধে বন্দুক দেওয়া হচ্ছে! রঞ্জু গলা বাড়িয়ে বলল,
“অনুভব ভাইয়াগো বাড়িতেই প্রিয়া প্রথম কাজ নিছিল, চাচি। ভাইয়ার ভাইস্তারে টেককেয়ার করছে।”
মুনিরা বেগম দুজনের দিকে চাইলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে গম্ভীর গলায় বললেন,
“এখানে আসার কারণ?”
অনুভব হুট করে উনার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে একটা হাত ধরে বাচ্চাদের মতো আহ্লাদী ও আর্ত স্বরে বলে উঠল,
“আমি একটা মা চাইতে এসেছি। একটা পরিবার চাইতে এসেছি আপনার কাছে। এই ছেলেটিকে নিরাশ করবেন না, মা।”
চলবে…
#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৪৪]
চারতলা বাড়িটা সম্পূর্ণ সাদা রঙ করা। জনবহুল, বাড়িঘর, দোকানপাটে ঠাঁসা এই এলাকায় এমন এক ধবধবে সাদা বাড়ি বিস্ময়ের বটে৷ একদম রাস্তা সংলগ্ন হওয়ায় বাড়ির চারপাশে আলাদা করে কোনো পাচিল নেই। ঢুকতেই কলাপসিবল গেইট। তার পাশের দেয়ালে বিরাট করে লেখা ‘দেয়ালে পোস্টার লাগানো নিষেধ’। সেই নিষেধাজ্ঞা আদৌ বিজ্ঞাপনদাতারা মানেনি। বিজ্ঞাপনদাতাদের ধর্মই তারা ঘাড়ত্যাড়ামি করবে। যেখানে সেখানে পোস্টার সেঁটে দেবে। এখানেও সেই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি। সাদা দেয়ালের গায়ে টিউশনি নিয়োগ থেকে শুরু করে কলিকাতা হারবালের পোস্টার চোখে লাগার মতো করে আটকে দেওয়া হয়েছে। ফলে ওপরের তিনটে তলা দেখতে রুচিসম্মত মনে হলেও নিচতলা সেই যোগ্যতা হারিয়েছে।
নন্দিনী, দিগন্ত এবং অনুভবের গন্তব্য দোতলায় বাড়িওয়ালার ফ্ল্যাটে। বাড়িওয়ালা লোকটা টেকো মাথার বেটেখাটো একজন লোক। গায়ের রঙ ধবধবে ফরসা। নন্দিনীর মনে হলো এই লোক সাদা বলেই বোধহয় বাড়ির রঙটাও সাদা। সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে একটা বাড়ি নির্মান করে তিনটে তলা ভাড়া দিয়ে সম্পূর্ণ দোতলা জুড়ে তিনি পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখা গেল লোকটার ঘরের প্রায় সব জিনিসই সাদা। ভদ্রলোক তিনটে যুবক-যুবতীকে চশমার ভারী কাচে নিরীক্ষণ করে নিলেন। ম্যাড়মেড়ে স্বরে বললেন,
“তোমরাই বাসা দেখতে এসেছ?”
অনুভব নম্র গলায় বলল,
“জি আঙ্কেল।”
নন্দিনী চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বলল,
“আপনার নাম কী সাদা মিয়া বা এই টাইপ কিছু?”
ভদ্রলোক কপালে লম্বা ভাজ ফেলে বললেন,
“না। হঠাৎ এমন মনে হওয়ার কারণ কী?”
“আপনার বাড়ির সবই সাদা। আপনিও দেখতে অস্ট্রেলিয়ান সাদা চামড়ার লোকদের মতো। যদিও লম্বায় ফেল মে’রেছেন। তাই মনে হলো।”
ভদ্রলোক বিরক্ত হলেন। ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের এই সবজান্তা ভাব আর অতিরিক্ত কৌতুহল উনার একদমই পছন্দ নয় মনে হচ্ছে। বললেন,
“কার জন্য বাসা দেখছো? কে থাকবে? আমি কিন্তু আগেই বলেছি ভার্সিটির স্টুডেন্টদের বাড়ি ভাড়া দেব না। সাবলেটও নয়।”
“কেন? আপনার কি চঞ্চল কিশোরী বা যুবতী মেয়ে আছে?”
নন্দিনীর প্রশ্নে ভদ্রলোকের কপালে এবার আরেকটি ভাজের রেখা বৃদ্ধি পায়। যা স্পষ্ট বলে মেয়েটিকে তিনি পছন্দ করছেন না। বিরক্ত গলায় বললেন,
“থাকলে কী সমস্যা আর না থাকলেই বা কী সমস্যা?”
“না থাকলে সমস্যা নাই, থাকলেও সমস্যা নাই। কারণ আমার এক বন্ধু বর হতে চলেছে। আরেকজনের বিশ্বভদ্র। মাইয়াগো দিকে চায় না। কাজেই আপনার চিন্তার কারণ নাই।”
একটু থেকে আবার উৎসাহী হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“মেয়ে না থাকুক। আপনার আনম্যারিড ছেলে নাই তো? তাহলে চিন্তার কারণ আছে। আপনারও, আমারও।”
“আমার ছেলের সঙ্গে তোমার চিন্তার কী কারণ থাকতে পারে? তোমাদের কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।”
নন্দিনী মুখ খুলতে যাচ্ছিল। দিগন্ত সপাটে ওর মুখ চেপে ধরে সরল ও দুঃখী ভাব করে বলল,
“কিছু মনে করবেন না আঙ্কেল। আসলে খুব ছোটোবেলায় ও পুকুরে পড়ে গেছিল। প্রায় পাঁচ মিনিট ডুবে ছিল। এরপর থেকে ওর মেন্টাল কন্ডিশন নড়বড়ে হয়ে গেছে। কখন কী বলে আর কী করে ঠিক নেই।”
বাড়িওয়ালার চোখমুখ থেকে বিরক্তি সরে গেছে। তিনি করুণার দৃষ্টিতে নন্দিনীকে দেখছেন। অনুভব বলে উঠল,
“আমার জন্য বাসা দেখতে এসেছি আঙ্কেল। এখন আমার ফ্যামিলির মেয়েরা উঠবে। আমি কয়েকদিন পরে উঠব।”
“কেন? পরে কেন?”
“বিয়ের পর একেবারে উঠবে। এটা তো কাজিন বিয়ে নয়। তাই বিয়ের আগে হবু বউ-শ্বাশুড়ির সঙ্গে এক বাড়িতে থাকাটা স্বস্তিজনক নয়।” উত্তরটা দিগন্ত দিল। নন্দিনীকে ইশারায় অনুনয় করে করে চুপ থাকতে বলছে।
ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন,
“তুমি তাহলে হবু শ্বশুর বাড়ির লোকেদের জন্য বাসা ঠিক করতে এসেছ?”
“ঠিক তাই।”
“বিয়ের পর তাদের সঙ্গে থাকবে, মানে ঘর জামাই থাকবে?”
“জি না, বউয়ের পরিবার আমার সঙ্গে থাকবে।”
“কেন? তোমার বাবা-মা কই?”
“কেউ নেই।”
“স্যাড! কিন্তু শুধু মেয়েরা কেন থাকবে? শ্বশুর বা তার ছেলে পেলে নেই?”
ভদ্রলোকের চশমা ঠাসা চোখের কোটরে প্রশ্নেরা ভিড় করছে দলে দলে। সকলেই এবার বিরক্ত হলো। নন্দিনী উষ্ণ গলায় বলল,
“থাকল কি না থাকল তাতে সমস্যা কই সাদা কাক্কু? আমরা কী এইখানে ওর জীবনকাহিনীর পো’স্ট’ম’র্টে’ম করতে বইছি?”
ভদ্রলোক যেন এতক্ষণে সম্বিত ফিরে পেলেন। গম্ভীর গলায় বললেন,
“কাকে বাড়ি ভাড়া দিচ্ছি জেনে নেওয়া আমার কর্তব্য। যাইহোক, চলো বাসা দেখাই।”
ফ্ল্যাটটা তিন তলায়। এখানেও সবকিছুর রঙ সাদা। দুটো বেডরুম ও ডাইনিং স্পেস নিয়ে ছোটো একটা ফ্ল্যাট। অনুভবের সামর্থ্যে এই ছোটো ফ্ল্যাটটাও অনেক দামী। হন্য হয়ে আরেকটা টিউশনি খুঁজছে ও। চাকরির চেষ্টাও অব্যাহত। তার নিজের সংসার হতে চলেছে যে। প্রিয়ার মাকে সে একপ্রকার নিজের দিকে টেনে ফেলেছে। মুনিরা বেগম জীবনের ঘা’ত-প্রতিঘা’তের সঙ্গে লড়ে যাওয়া অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নারী। মানুষ চেনার ক্ষমতা উনার আছে। অনুভবের কথা তিনি মন দিয়ে শুনেছেন, বুঝেছেন। কিন্তু ডিসিশন জানাননি। অনুভব অবশ্য বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে। একটা আত্মীয়হীন একলা ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে যে কারো সাহস হওয়ার কথা না। এখন একমাত্র তুরুপের তাস প্রিয়া। সে মুখ ফুটে বললেই সবটা সহজতর হয়ে উঠবে। অনুভব আসার আগে এও বলে এসেছে বিয়ে না হোক, তাদের সেফটি ও স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য একটা নিরাপদ, ঝামেলাবিহীন বাড়ি দরকার। সেই সূত্রেই আজ বাড়ি দেখতে আসা।
বাড়িওয়ালা বললেন,
“আমার র’ক্ত জল করা টাকার বাড়ি। খুবই যত্নের। ভাড়াটিয়াদের কাছে আমার একটাই চাওয়া, দেয়ালে যেন দাগ না লাগে।”
নন্দিনী লোকটার ওপর যারপরনাই বিরক্ত। ডানে-বামে, উপর-নিচ সাদায় মুড়িয়ে দিয়ে বলে যেন দাগ না ফেলে! আরে ভাই বাড়িতে একটু ফেলে ছড়িয়ে না থাকলে সেটা বাড়ি হলো? মনে হচ্ছে ভাড়াটিয়া হয়ে নয়, টাকা দিয়ে মেহমান হিসেবে আসবে। এতই যখন মায়া তো ভাড়া দেওয়া কেন? বুকে আগলে রাখুক না। ও বিড়বিড় করে গজগজ করতে লাগলে ভদ্রলোক বললেন,
“কিছু বলছ?”
দিগন্ত বাড়িওয়ালার নিকটে গিয়ে ফিসফিস করে উত্তর দিল,
“এটা ওর স্বভাব আঙ্কেল। একা একা কথা বলা। ওই যে একটু আগে বললাম না মেন্টালি…”
ভদ্রলোক মাথা নেড়ে আবারো দয়ার চোখে তাকালেন। আহা কি সুন্দর মেয়েটার কি অবস্থা! তিনি নন্দিনীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“অসুস্থ হলেও তুমি বুদ্ধিমতি। আমার নাম সাদা না হলেও একই অর্থের। আমার নাম সফেদ মোল্লা।”
সব কথাবার্তা ফাইনাল করে সাদামহল থেকে রঙিন দুনিয়াতে পা রেখে অনুভব প্রিয়াকে ফোন দিল। প্রিয়া ফোন রিসিভ করে উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
“আপনার গায়ে ওগুলো কীসের দাগ ছিল কাল? গুটি গুটি লাল লাল।”
“লাভ সাইন।”
“মানে?”
“রাতের বেলা একলা পেয়ে দুষ্টু মেয়েরা আমায় ভীষণ জ্বা’লাতন করেছে।”
“কোথাকার মেয়ে? কী বলছেন এসব?” প্রিয়া হতবুদ্ধি হয়ে যায়।
“বলব না কিছু। পারলে এসে দেখে ইনভেস্টিগেট করে যাও। আগের কথা ছেড়ে এবার আমার বর্তমান কথা শোনো। আমাদের সংসার গড়ার বাড়িটা ঠিক করে ফেলেছি। তিন তলায় ফ্ল্যাট। দক্ষিণমুখী একটা ঘর পাওয়া গেছে। ভাবছি মা আর ছোটোবোনকে পশ্চিমদিকের ঘরটা দিয়ে তুমি আর আমি দক্ষিণের ঘরটায় থাকব। ফুরফুরে হাওয়ায় প্রেমটা ভালো জমবে।”
অনুভব হাসছে। প্রিয়ার কণ্ঠ জমে আসে। বিয়ের নিশ্চয়তা নেই আর এই লোক কোন ঘরে থাকবে সেটাও কল্পনা করে সেড়েছে! বলল,
“লজ্জাশরম সব গুলে খেয়েছেন? আমাদের বিয়েটা যে হচ্ছে আপনি এত নিশ্চিত কী করে?”
“তাহলে তুমি আমার জায়গায় অন্য পুরুষকে স্বামী হিসেবে কল্পনা করছ? অন্যকেউ তোমার হাত ধরবে, তোমায় জড়িয়ে ধরবে।”
“ছি! তা কেন হবে?”
“তারমানে আমাকেই কল্পনা করো তাই তো? কী কী কল্পনা করো?”
“আপনি বাজে কথা বলতে শুরু করেছেন। আমি ফোন রাখছি…”
অনুভব হুমকির স্বরে বলল,
“দেখো হাসু, ভালোয় ভালোয় রাজি হয়ে যাও। নয়তো তোমাকে সারাজীবন আইবুড়ো থাকতে হবে। আমি দশ-বারোটা বিয়ে করলেও তোমাকে বিয়ে করতে দেব না।”
“দশ-বারোটা! কম হয়ে গেল না?” প্রিয়ার কণ্ঠে ঝাঝ খেলে যায়
অনুভব দুষ্টু হেসে বলে,
“হু, কমই হলো। যদি তুমি আগেভাগে রাজি হও তবে সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কারণ তুমি আমার ফুলস্টপ। তবে চিন্তা নেই সতীনের সংসার করতে হবে না। তুমি এলে বাকি সবাই লাইফ থেকে ডিসকোয়ালিফাইড। আমার বাবুর আম্মু তুমিই হবে। হাসুর পেট থেকে অনেকগুলো বাচ্চা হাসু আসবে। সারাক্ষণ প্যাকপ্যাক করে ডাকবে। হ্যাপি হাসমার্কা সংসার।”
“ধুর আপনি ভালো না।”
প্রিয়া ফোন রেখে দিল সঙ্গে সঙ্গে। অনুভব ফোন হাতে নিয়ে হাসছে। তৃপ্তির হাসি। তাকে স্পেস দিয়ে দূরের এক চায়ের দোকানে বসেছিল দিগন্ত, নন্দিনী। অনুভবের হাসি দেখে দিগন্ত মুচকি হেসে বলল,
“শিকু খুব সুখী হবে হাসুকে পেলে।”
নন্দিনী চায়ে লম্বা চুমুক দিয়ে বলল,
“মনের মানুষ পাইলে সবাই সুখী হয়রে পা’গলা। কিন্তু তুই সুখী হবি না। আমার বদদোয়া আছে লগে।”
“শকুনের দোয়ায় গরু ম রে না।”
“রাইট! তুই একটা গরু। হাম্বা…হাম্বা!”
দিগন্ত রাগী রাগী চোখে ফিরে তাকায়। বেঞ্চিতে ঝুকে বসে আছে নন্দিনী। গালের ওপর দুগাছি চুল ঝুলে মুখটাকে কিছুটা আড়াল করে দিয়েছে। কঠিন কিছু বলতে উদ্যত হয়েও দিগন্ত চুপসে গেল। আজকাল সে আগের মতো ঝগড়া করতে পারছে না। অনুভব ওদের নিকটে৷ দুজনের ঝগড়া শুনে দিগন্তের কানে কানে বলল,
“শকুনের দোয়ায় গরু ম রে না। কিন্তু আমি তো দেখি শকুনের জন্য গরুটা ম রে যাচ্ছে!”
__________________
দিগন্তের ভাইয়ের এঙ্গেজমেন্ট পার্টি শুক্রবারে। যথারীতি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে টুকটুকি একটা অফ হোয়াইট শাড়ি পরে সেজেগুজে নিল। ঝুমঝুমি দেখেই বলল,
“দুলাভাই দেখলে আজকে ফিট হয়ে যাবে।”
টুকটুকি হাসল। নিশীথকে সাজটা দেখানোর ইচ্ছে থেকে নিজেকে নিবারণ করতে পারল না। যদি তার ভালো লাগে! ম্যাসেজ করে বলল,
“বিজি?”
“আজ ছুটির দিন।”
“আমাকে একটু পৌঁছে দিতে পারবেন?”
“কোথায়?”
“বলেছিলাম না, দিগন্তের ভাইয়ের এঙ্গেজমেন্ট প্রোগ্রামে যাব আজ। এখনই বেরোবো।”
এবার আর সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই এলো না। টুকটুকি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মুখ গোমড়া করে ফেলল। ক্ষণকাল বাদেই ম্যাসেজ টিউন বেজে উঠল,
“আসুন ম্যাডাম।”
টুকটুকি জানালা গলে দেখল চিরচেনা গাড়িটা রাস্তায় উঠেছে। সে উচ্ছ্বসিত মনে নেমে যায়। ফ্রন্ট সিটে চড়ে বসতেই নিশীথের সঙ্গে চোখাচোখি হলো। চোখ থেকে দৃষ্টি পতিত হলো ঠোঁটে। আবারো টকটকে লাল লিপস্টিক। লাভ শেইপের পুরু ঠোঁটজোড়া নজরকে উত্যক্ত করতে বাধ্য। টুকটুকি খেয়াল করল নিশীথ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেছে। কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইল,
“এভ্রিথিং অলরাইট?”
“হু।”
ছোটো করে উত্তর দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিল নিশীথ। দ্বিতীয়বার পাশে বসা সুন্দরী রমণীকে দেখার চেষ্টা করল না। টুকটুকির উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়ল। এই শীতলতার কারণ কী বুঝে উঠতে পারল না। সারাটা রাস্তা বাহানা করে নিজেই টুকটাক কথা চালিয়ে গেল ও। নিশীথ জবাব দিল স্বাভাবিক গলায় কিন্তু তাকাল না মোটেও। মাঝপথে টুকটুকি আর চুপ থাকতে পারল না।
“আমি কি কিছু করেছি?”
“না তো।”
“তাহলে এই মৌনতার কারণ।”
“কোনো কারণ নেই।”
“আমাকে কেমন লাগছে বললেন না যে?”
“ভালো লাগছে।”
“কিন্তু আপনি আমার দিকে তাকাচ্ছেন না।”
“আপনি আমায় সিডিউস করছেন ম্যাডাম। তাকালে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এমনিতেই আমি ‘অ’ শ্রেণিভুক্ত। এরপর আরো ডিমোশোন হয়ে যাবে। নিজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে একদমই ইচ্ছুক নই আমি।”
চলবে..
#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৪৫]
দুপুর গড়াতে চলেছে। বিশাল কমিউনিটি সেন্টারে পুরোদমে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। দুপুরের পর থেকেই অতিথিদের আনাগোনা শুরু হবে। দেশের মান্যগণ্য ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকবে বলে আয়োজনটাও বিশাল। নন্দিনীর দম ফেলবার ফুরসত নেই। এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে সবকিছুতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। বসের কড়া হুকুম তাকেই তদারকি করতে হবে। ভুল হলে দায়ও নন্দিনীর। সেই দায়িত্ব মাথায় নিয়ে গতকাল থেকে সুস্থির হওয়ার সুযোগ নেই। ভাবছে এবার ম্যানেজার পদটা চেয়ে নেবে। পরক্ষণেই বেচারা ম্যানেজারের মুখটা মনে পড়ে। সে ম্যানেজার পদ চাইলে বর্তমান ম্যানেজারের কী হবে? এমনিতেই নন্দিনীর সঙ্গে তার সাপে-নেউলে সম্পর্ক। মধ্যবয়সী বসের এক যুবতী মেয়ের ওপর কীসের এত আস্থা, কেন এই মেয়ের স্বেচ্ছাচারিতা মেনে নেয়, সেই সমীকরণ সমাধান করতে না পেরে নানান রটনা সাজাচ্ছে মনে মনে। আবার স্বীকারও করে, নন্দিনীর মাঝে এক অমোঘ আকর্ষণ আছে। নিজেকে উপস্থাপন করার ক্ষমতা ও মোহনীয়তায় সবার মনোযোগ কেড়ে নিতে সক্ষম। যার ফলে তার প্রতি ঈ’র্ষায় অনেকের চোখ জ্ব’লে যায়।
এদিকে সূর্যমামা রূপের ঝলক দেখিয়ে পৃথিবীবাসীর মাথা ঘুরিয়ে দিতে ব্যস্ত। নন্দিনীর পরনে রিপ প্যান্ট, হাঁটু ছুঁই ছুঁই একটা কামিজের ওপর ইভেন্ট কোম্পানির লোগো বসানো সাদা টিশার্ট। ক্যাপেও সেইম লোগোর ছাপ। ঘামে জবজব করছে দেহ। মাথার ক্যাপটা খুলে গায়ে বাতাস করতে লাগল সে।
পার্শ্ববর্তী ক্যাটারিং এড়িয়া থেকে খাবারের গন্ধ উড়ে এসে নাকে লাগতেই পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল। ঠাহর করতে পারল না শেষ কখন খাবার খেয়েছে এবং কী খেয়েছে। ইদানীং সমস্যাটা বেশি বেশি হচ্ছে। খিদেয় যখন শরীর দুর্বল হয়ে আসে তখন খাওয়ার কথা মনে পড়ে। কিন্তু আগে কখন খেয়েছে সেটা মনে করতে পারে না। কখনো মনে হয় সম্পূর্ণ একদিন কিছুই খায়নি, আবার কখনো মনে হয় দুইদিন খাওয়া হয়নি। এমনটা হলে ভালোই হয়। দুইদিন পর পর খেলে খরচটাও কমে, খাদ্যহীন শরীরে একটা ঝিমুনি ভাব থাকে। অনুভূতিগুলো সব ভোঁতা মনে হয়। বিষয়টা উপভোগ্য লাগে। একসময় সব ইন্দ্রিয় অনুভূতিকে বশ করে ফেলতে পারলেই সে মুনিঋষি টাইপ কিছু একটা হয়ে যাবে, যারা বছরের পর বছর ধ্যানমগ্ন থাকতে পারে না খেয়ে কিংবা স্বল্পাহার করে। হিমালয়ের কোলে কোনো এক গুহায় গিয়ে আত্মগোপন করতে পারলে আরো ভালো হতো। নিজের ভাবনায় সে নিজেই বেশ বিরক্ত। হয়তো খিদেয় এসব ভাবনা মাথায় উঁকিঝুকি দিচ্ছে। কিংবা কে জানে! সে আসলেই নিজেকে লুকোতে চাইছে, চেনা জগত থেকে। হুট করে ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে ‘হালুম’ নামটা। সঙ্গে টাইগার প্রিন্টের বিড়ালের ছবি। নন্দিনী কল রিসিভ করে বিরস মুখে বলল,
“কইয়া ফেল।”
“কই তুই? আমি কিন্তু দুপুরের মধ্যে তোদের উপস্থিত থাকতে বলেছি।”
“পিছনে ফিরা দেখ।”
দিগন্ত পেছনে ফিরে ক্লান্ত নন্দিনীকে দেখে চমকে উঠল। ফোন কেটে অবাক গলায় বলল,
“তুই! তোদেরকেই ইভেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে! আগে বলিস নাই কেন?”
“কইলে কী হইত? এক্সট্রা পেমেন্ট দিতি?”
“মোটেও না। উল্টে ডিস্কাউন্ট নিতাম।”
“ব্যবসা তো আমার খালুর না যে বন্ধু বইলা ডিস্কাউন্ট দিব। তয় টেকা তোর বাপের।”
ম্যানেজার একটু দূরেই উপস্থিত ছিলেন। সেরের ওপর সোয়া সের হয়ে তার ঘাড়ের ওপর ঝুলে থাকা মেয়েটির কথা শুনে তিনি ভ্রুকুটি করে তাকায়। দিগন্তকে দেখে সাতপাঁচ কিছু ভেবে বলে উঠল,
“ব্যবসা তোমার খালুর না হলেও কাছের মানুষেরই তো। আমার তো মনে হয় তুমি চাইলে বস অর্ধেক পেমেন্টেও কাজ করে দিতে রাজি।”
নন্দিনীর খোঁ’চাটা ধরতে অসুবিধা হয় না মোটেও। ভাবান্তরও হয় না। মিষ্টি হেসে বলল,
“মন্টু ভাই, তাহলে তো ম্যানেজার পদের জন্য একটা সুপারিশ করতে পারি। পারি না?”
ম্যানেজার মন্টুর চোখ দুটি ফঁস করে জ্ব’লে উঠে আবার নিভে যায়। আয়ের একমাত্র উৎস এই চাকরিটা। এই বে’য়া’দব মেয়ে চাইলে হয়তো চাকরি নট হয়ে যেতে পারে। ব্যস্ততা দেখিয়ে চলে যেতে যেতে বলল,
“তা তুমি পারো। তোমার বিবেকে চাইলে আমার আর কী বলার আছে।”
দিগন্ত ভ্রু কুচকে বলল,
“এই বসের কেসটা কী? লোকটা তোকে ঠেস দিল কেন?”
নন্দিনী জবাব দেয় না। দিগন্ত তার মধ্যে আলস্য দেখতে পায়। চোখ দেখে মনে হচ্ছে কাজের চাপে ঘুমায়নি। দিগন্ত ওকে টেনে নিয়ে এককোনায় পাতা সোফায় বসিয়ে দেয়। নন্দিনী তাড়া দিয়ে বলল,
“সর, আড্ডা দেওনের টাইম নাই। তোর মায় আইসা সব ঠিকঠাক না পাইলে আবার ক্যাচাল বাধাইব। এমনেই কালকে সন্ধ্যায় আইসা নাকি এক গাদা ভুল ধইরা দিয়া গেছে। ওডি করতে গিয়া জান শেষ সবডির। আমি তখন আছিলাম না দেইখা। নইলে কইতাম এতই যখন অপছন্দ, আপনেও কোমড়ে আঁচল গুইজা আমাগো লগে কামে লাইগ্যা পড়েন আন্টি।”
দিগন্ত রাগ করল না। হেসে বলল,
“মা সকাল সকাল মিলি আপুকে নিয়ে বিউটি পার্লারে গেছে। দুপুর কেন, বিকেলের আগে দেখা পাবি না।”
নন্দিনী গা ছেড়ে বসে হাঁপ ছেড়ে বলল,
“বাঁচা গেল। উনি আসার আগেই দৌড় দিমু। ভুল ধরার টাইম পাইব না।”
“কীসের দৌড়? প্রোগ্রাম শেষ হওয়া পর্যন্ত থাকবি। তার আগে একজনও গেইটের বাইরে পা দিবি না।”
নন্দিনী নিশ্চুপ। পেটে দানাপানই নেই, শরীর ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসছে। বাড়তি কথা বলতে গিয়ে শক্তি ক্ষয় করতে ইচ্ছে করছে না। দিগন্ত ওর মাথাটা কাঁধে তুলে নিল সযত্নে। আলতো হাতের স্পর্শে ঘামে ভেজা চুলে বার দুয়েক হাত ঘুরিয়ে বলল,
“মাথায় এত ভার রাখার দরকার নাই। কাঁধ পেতে দিলাম, বোঝা হালকা করে একটু জিড়িয়ে নে তো।”
অনুভব গেইট থেকে টুকটুকিকে রিসিভ করে ভেতরে ঢুকল একেবারে। এসে যা দেখল তাতে চোখে খেলে গেল চঞ্চলতা। দিগন্ত এককোণে প্রায় লোক চক্ষুর আড়ালে বসে আছে। তার কাঁধে মাথা হেলিয়ে নন্দিনীর চোখ লেগে গেছে ততক্ষণে। আধো জাগরণের ঘোরে বিচরণ করছে সে। টুকটুকি কিছু বলতে উদ্যত হতেই দিগন্ত ঠোঁটে আঙুল চেপে চুপ থাকার নির্দেশ দেয়। নন্দিনীর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে মায়া হচ্ছে তার। কিন্তু ঘুম নন্দিনীর ছুটে গেল। চোখ ডলে মাথা চেপে ধরল ও। এখন মনে হচ্ছে এইটুকু আরামের কোনো দরকার ছিল না। শরীর একটু আলস্য পেয়ে বসলে সহজে ত্যাগ করা মুশকিল।
অনুভবের মিটিমিটি হাসির সামনে দিগন্ত অপ্রস্তুত। ছেলেটা গতকাল থেকে কি যে ইশারা ইঙ্গিত শুরু করেছে! টুকটুকি, নন্দিনী শুনে ফেললে একটা বিতিকিচ্ছিরি কান্ড হবে।
দিগন্ত ব্যস্ততা দেখিয়ে অনুভবের হাত টেনে ধরে সেখান থেকে প্রস্থান করে। গেইটের বাইরে গিয়ে কলার চেপে ধরে বলে,
“কী শুরু করেছিস এসব?”
অনুভব কলার ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল,
“আগে বল তুই কী শুরু করেছিস? চোখের ভাষা আর মুখের ভাষায় এত ফারাক দেখছি যে! কবে থেকে এসব চলে? আমি কী তোর পর যে লুকিয়ে গেলি?”
“কী আজেবাজে বকছিস!” দিগন্ত অপ্রস্তুত।
অনুভব হেসে স্বগোতক্তি করল,
“তুমি যে নদীতে সবে পা ভিজিয়েছ, আমি সেই নদীতে হাবুডুবু খেয়ে সাঁতার শেখা পাবলিক। এইসব রাখঢাক আমার সামনে কইরো না। কবে থেকে?”
দিগন্ত ঝুকে দুহাতে মুখ ঢাকে। অসহায় গলায় বিড়বিড় করে,
“জানি না, জানি না। শুধু জানি এটা ঠিক হচ্ছে না। আমাদের এত সুন্দর বন্ধুত্বটা নষ্ট হোক আমি চাই না। কিন্তু নিজেকে দমাতেও পারছি না। এ কোন সর্বগ্রাসী অনুভূতি ঘিরে ধরছে আমাকে!”
_________________
এঙ্গেজমেন্ট পার্টি জমজমাট হয়ে উঠল সন্ধ্যা নাগাদ। অম্লান ও মিলিকে ঘিরে ধরেছে লাইট, ক্যামেরা ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা। সাদা বার্বি গাউনে মিলিকে মোমের পুতুলের মতো দেখাচ্ছে। একহাতে আঁকড়ে ধরে আছে অম্লানের বাহু। রাঙা, পাতলা ঠোঁট থেকে হাসি তার সরছেই না। মিসের রুহানি সফল ব্যবসায়ী পুত্র এবং উকিল হবু পুত্রবধূকে নিয়ে গর্বিত। ছেলেদের সঠিকভাবে মানুষ করতে পারার দম্ভে প্রজ্জ্বলিত আভা প্রসাধন সজ্জিত আস্তরণকে ছাপিয়ে ফুটে উঠেছে।
ভারী চশমা পরিহিত বদরুল সাহেব আজ অন্যদিনের তুলনায় হাসিখুশি। গাম্ভীর্য সরিয়ে হেসে হেসে কথা বলছেন আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে। পার্টিতে এমপিকন্যা জুহিতাও আজ আমন্ত্রিত। বদরুল সাহেবের একান্ত ইচ্ছে ছোটো ছেলের মাধ্যমে এমপি পরিবারের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলা। দুজন একই সাথে বাইরে পড়তে যাবে। ফিরে এলে চারহাত এক করে দেওয়া যাবে। ব্যবসায়ের প্রগতিশীলতা ও ফ্যামিলি স্টেটাস, উভয় দিক দিয়ে মেজো ছেলে অম্লানের জন্য পারফেক্ট হলো মিলি। অন্যদিকে রাজনৈতিক অঙ্গন প্রসারের ক্ষেত্রে এমপি কন্যা জুহিতার বিকল্প নেই। পাত্রপক্ষের যেমন এতে সুবিধা দেখছে, সুবিধা কন্যাপক্ষও দেখছে বৈকি! বদরুল সাহেব এবার ব্যবসার সকল ভার দুই ছেলেকে দিয়ে পুরোদমে রাজনীতিতে মনোনিবেশ করবেন। সেই পরিকল্পনায় ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পর্কটা জোরালো করার পাশাপাশি নিজ এলাকার উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করছেন তিনি।
স্বামীর ইচ্ছেটা শুনে মিসেস রুহানি সঙ্কিত মনে জানান তিনি কী সবক্ষেত্রে নিজের স্বার্থটাই বড়ো করে দেখছেন না? বদরুল সাহেবের উত্তর, অবশ্যই না। মিলি, জুহিতা দুজনই সুন্দরী, উচ্চ শিক্ষিত, উচ্চ বংশীয় এবং তাদের সামাজিক অবস্থান দেশের প্রথম সারিতে। এমন মেয়েদের পুত্রবধূ করতে চাইলে ছেলেদেরও আপত্তির কারণ নেই। উনার কাছে জীবন একটা প্রকল্পের মতো। একে সঠিক পরিকল্পনায় চালনা করতে পারলেই সফল হবে। সামনে এগোতে হলে, উচ্চতায় আরোহণ করতে হলে সবদিকে নজর থাকতে হবে। সো কল্ড মনের আবেগ দিয়ে জীবন চলবে না। আবেগ একটা বয়সের পর আর থাকবে না। তখন শুধু আফসোস আর হতাশা থাকবে। বড়ো ছেলেটা তা বুঝল না। বাবার অঢেল সম্পদ ও সুবিধা রেখে এখন দূর দেশে খেটে ম’রছে না? তা দেখে বাকি দুইজনের শিক্ষা নেওয়া উচিত।
মিসেস রুহানি জুহিতার সঙ্গে দিগন্তের আলাপ করাতে গিয়ে ছেলেকে পেলেন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। রাগটা সন্তর্পণে গোপন করলেন তিনি। উনার সহজ সরল ছেলের মাঝে সুক্ষ্ম পরিবর্তনগুলোর জন্য এই ছেলে-মেয়েগুলোই দায়ী। তিনি ছেলেকে ডাকলেন। দিগন্ত আড্ডা ভেঙে আসায় মহা বিরক্ত। মায়ের পাশে এক অতি রূপবতী বিদেশিনীদের মতো নারীকে দেখে বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। মিসেস রুহানি চাপা শাসনে বললেন,
“শুধু একদিকে বসে থাকলেই হবে? সকলের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করো, আলাপ করো।”
এরপর জুহিতার দিকে ফিরে বললেন,
“ছেলেটা খুবই ঘরকুনো স্বভাবের বুঝলে।”
দিগন্ত ভ্রু কুচকায়। সে কেমন স্বভাবের তা ফর্মালিটি করে অন্যকে জানানো কেন? রূপসী মেয়েটি সহাস্যে হাত বাড়িয়ে বলল,
“হাই, আমি জুহিতা খান।”
“ইট’স রায়হান দিগন্ত, নাইস টু মিট ইউ!” দিগন্ত করমর্দন করল।
মিসেস রুহানি দিগন্তের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“মিটিংকে নাইস থেকে ওয়ান্ডারফুল করে তোলো। খুব সম্ভবত তোমরা একসঙ্গে এব্রোডে পড়তে যাচ্ছ। নিজেরা যত স্বাচ্ছন্দ্যে মিশতে পারবে ততই ভালো সখ্যতা হবে।”
মিসেস রুহানি ছেলের কাঁধে আলতো চাপ দিয়ে প্রস্থান করলেন। দিগন্ত ধাঁধায় পড়ে। মায়ের হাতের ওই আলতো চাপে ভিন্ন দ্যোতনা ছিল কী! সে পূর্ণ মনোযোগ দেয় সম্মুখের মেয়েটির দিকে। গায়ের রঙ ধবধবে ফরসা, চোখের মনির রঙ ধূসর, উচ্চতায় পাঁচ ফিট সাত হবে। তবে চুলগুলো কালো, মুখের গড়নে বাঙালি ভাব আছে। যেন বাঙালি ও বিদেশির পারফেক্ট মিশ্রণ। দিগন্ত বলল,
“আপনি এব্রোড যাচ্ছেন মাস্টার্সের জন্য?”
জুহিতা বোধহয় সব সময়ই হাসে। ঠোঁটে কোণা সংকুচিত হয় না। সেভাবেই বলল,
“আমি এব্রোডেই ছিলাম। নিউইয়র্ক থেকে আন্ডারগ্রেজুয়েট কমপ্লিট করে ফিরেছি। সেখানেই মাস্টার্স করব। জানলাম আপনিও আছেন সঙ্গে।”
দিগন্ত খেয়াল করল মেয়েটি স্পষ্ট বাংলা বললেও বিদেশি টোন চলে আসছে। কৌতুহলে বলল,
“আপনি সম্পূর্ণ বাংলাদেশী নন?”
“বাবা বাংলাদেশী, মা আমেরিকান। আমি দুই দেশ মিলিয়েই বড়ো হয়েছি। যখন যেখানে থাকি সেই সংস্কৃতি মেনে চলতে চেষ্টা করি। যদিও এলোমেলো হয়ে যায়।”
“ইন্টারেস্টিং!”
জুহিতা আবারো হাসল। আচরণে সে যথেষ্ট আন্তরিক। মেকি ভাব নেই। দিগন্ত পিছু ফিরে তাকায়। বন্ধুরা হা করে দুজনকে দেখছিল। দিগন্ত পিছু ফিরতেই নন্দিনী থামস আপ দিয়ে ইশারা করল। যেন বোঝাতে চাইল,
“দুজনকে হেব্বি মানিয়েছে।”
দিগন্ত হতাশ চোখে অনুভবের পানে চায়৷ অনুভব ঠোঁট উল্টায়। ঠিক তখনই দিগন্তের ফোন বেজে ওঠে। সে এক্সকিউজ চেয়ে জুহিতার সামনে থেকে প্রস্থান করে।
অম্লান ও মিলির ফটোশুটের মাঝখান থেকে দিগন্ত ভাইকে প্রায় তুলে নিয়ে এলো। মিলি এতে অসন্তুষ্ট হলেও পাত্তা দিল না। ভিড় এড়িয়ে ফাঁকা স্থানে টেনে নিয়ে যেতেই অম্লান বিরস গলায় বলল,
“কী ব্যাপার? বাচ্চাদের মতো টানাটানি করছিস কেন?”
“দিঘী আপু ফোন করেছে ভাইয়া।”
অম্লান চমকে ওঠে। বিস্ময়াহত চোখে চায় ছোটো ভাইয়ের দিকে। দিগন্তের মুখভঙ্গি কঠিন। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,
“আপুকে কী বলব? বলব যে তিনি ভুল করে একজন পুতুলের সঙ্গে প্রেম করেছিল? যে বাবা-মায়ের কথার বাইরে শ্বাসটাও নিতে পারে না! প্রেমিকার হাত ধরা তো দূরে থাক। নাকি বলব দিঘী আপু তার আবেগকে ভুল মানুষকে সমর্পণ করেছে? যার কাছে বাবার মতোই আবেগ অনুভূতির কোনো মূল্য নেই। তার জীবনে বিয়ে, ভালোবাসা আসবে কোনো না কোনো লাভের উদ্দেশ্যে! তুমি কোনটা ভাইয়া? আমার কিন্তু দুটোর একটাও বলতে ইচ্ছে করছে না। বলতে ইচ্ছে করছে যে, তুমি পথের ধারে অপেক্ষা করো আপু। একজন রাজপুত্র তোমাকে পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়ে নিতে আসছে।”
অম্লান গম্ভীর গলায় বলল,
“তোর এখনো জীবন চেনা বাকি, দিগন্ত। বাবা-মা কখনো আমাদের খারাপ চায়নি। বড়ো ভাইয়াকে তুই একটু বেশিই ভালোবাসিস বলে ভাইয়ার ইমোশনটাকে বড়ো করে দেখেছিস সব সময়। যার জন্য মনের ভেতর বিরূপভাব পুষে রেখেছিস পরিবারের প্রতি। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না বাবা-মা আমাদের জন্য সেরাটাই চেয়েছেন সব সময়। বাবা-মায়ের জন্যই এতটা ভালো আছিস, এতটা স্বাচ্ছন্দ্যে গা বাঁচিয়ে চলছিস। দিঘীর সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়ে গেছে। আর কিছু বলার নেই৷ তাকে বলে দিস জীবন কখনো থেমে থাকে না। সেও এগিয়ে যাবে। আমার শুভকামনা আছে তার সঙ্গে।”
অম্লান দিগন্তের আহ’ত দৃষ্টির সামনে থেকে সরে হাঁটতে লাগল স্টেজের দিকে। মিলি সেখানে অধীর হয়ে তার অপেক্ষা করছে। চলতে চলতে হঠাৎ বুকের বা পাশে চিনচিন করে ওঠে। অনুভূতি মে রে ফেলতে চাইলেই কী মা রা যায়! তা যে অদৃশ্য, বাধনহারা, অবাধ্য।
________________
প্রোগ্রামে যখন গানের আসর মেতে উঠেছে পুরোদমে তখন টুকটুকির ফোন কেঁপে ওঠে। স্ক্রিনের নামটা দেখে আরক্ত হলো সে। আওয়াজ থেকে দূরে গিয়ে ফোন রিসিভ করতেই নিশীথের শান্ত কণ্ঠ ভেসে এলো,
“আপনি ফিরবেন কয়টায়?”
টুকটুকি ঘড়ি দেখল। দশটা বাজে। বলল,
“এই তো বেরোবো।”
“আমি বাইরেই আছি। না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।”
ফোন কেটে গেল কোনো প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করেই। টুকটুকি বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটা যে ভয়ানক লজ্জা দুপুরবেলা তাকে দিয়েছে এরপর আর চোখ তুলে তাকায়নি টুকটুকি। আর না কথা বলেছে পুরো রাস্তা। মনে মনে বর্ষণ রাজাকে ডেকে সাড়া পাওয়া গেল না। নিশীথ যেদিন ওর হাত ধরল সেদিন থেকে তার কল্পনার প্রেমিক আর আসছে না। তার স্থানে আসছে নিশীথ। এমন গোমড়ামুখো প্রেমিকের সঙ্গে মনে মনেও বোকা বোকা আলাপ করা যাচ্ছে না। জিভ লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ কি বিড়ম্বনা!
নিশীথ আসার পর সবার থেকে বিদায় নিল টুকটুকি। নন্দিনী আর অনুভব একসাথে ফিরবে। দিগন্তের কপালে এসে জুটেছে জুহিতা। মেয়েটার সঙ্গ মন্দ নয় কিন্তু বন্ধুদের চেয়ে বেশি তো নয়। এদিকে মায়ের হুকুমে তাকে টাইম দিতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে। নাহলে নাকি অতিথিকে অসম্মান করা হবে। দিগন্ত ভারাক্রান্ত মনে বন্ধুদের বিদায় দিল।
টুকটুকি প্রতিক্রিয়াহীন মুখে নিশীথের পাশে বসল। নিশীথ খেয়াল করল তার ঠোঁটে লিপস্টিক নেই এখন। সুক্ষ্ম ইঙ্গিতের সুরেই বলল,
“খাবারের সঙ্গে লিপস্টিকও খেয়ে ফেলেছেন? নাকি আমার সামনে এই ব্যবস্থা?”
টুকটুকি ঠোঁট ভেঙায়। সামনে দৃষ্টি রেখে বলে,
“একটু বোকা হলেও আমি যথেষ্ট ভদ্র মেয়ে। কাউকে সিডিউস করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।”
“আচ্ছা! পুরো প্রোগ্রামে যে কটকটে লিপস্টিক লাগিয়ে ঘুরেছেন তখন কেউ সিডিউস হয়নি আপনি নিশ্চিত?”
টুকটুকি ফিরে তাকায়। নিশীথের দৃষ্টি চলন্ত পথে। টুকটুকি চোরা হেসে বলল,
“আপনার অন্তরে বোধহয় জ্ব’লুনি হচ্ছে মিস্টার মাহমুদ?”
“আমার মন যথেষ্ট শান্ত ও শীতল, মিস হুমায়রা। আমার তো মনে হয় আমার আশেপাশে এলে আপনি আ’গুন হয়ে যান। আর সেই আ’গুনে আশেপাশের মানুষকে জ্বা’লিয়ে দেন।”
“বলতে চাইছেন আপনার প্রতিক্রিয়া আমার দ্বারাই সংঘটিত?”
“উমম… পরোক্ষভাবে।”
টুকটুকির চোরা হাসি মুছে গেছে। গাড়ির ভেতরের আলোটা নিভিয়ে দিয়েছে নিশীথ। এসির প্রভাবে ঠান্ডা লাগছে৷ হেডলাইট জ্বেলে ব্যস্ত নগরীর বুকে ছুটে চলেছে তারা। সিটে পিঠ এলিয়ে নিশীথের কথাটাকে মনোযোগ দিয়ে চিন্তা করতেই হঠাৎ টুকটুকির মনে কতগুলো অপ্রতিরোধ্য ভাবনা ঠোকর দিল। এই সম্পর্কটা টুকটুকির ইচ্ছেতেই শুরু হয়েছে। তার সচেষ্ট ইচ্ছেতেই চলমান। নিশীথ প্রথমে তার প্রেমে পড়েনি, আকর্ষণবোধও করেনি। টুকটুকি তাকে পছন্দ করেছে, আকর্ষণবোধ করেছে বোঝার পরই ধীরে ধীরে দুর্বল হয়েছে। সম্পর্ক শুরুর পদক্ষেপটাও টুকটুকিরই ছিল। এমনকি টুকটুকিই নিজ থেকে ফোন করে, ম্যাসেজ করে কথা বলে। নিশীথ নিজে থেকে অদরকারে ফোন, ম্যাসজে কিংবা দেখা করা কোনোটাই করে না। ছুটির দিনেও নয়। এই নিস্পৃহতা কি শুধুই গম্ভীর স্বভাবের জন্য? নিশীথ তো বলেই দিল টুকটুকি পরোক্ষভাবে তাকে দিয়ে সব করিয়ে নেয়। তাহলে এই সম্পর্কে নিশীথের সচেষ্ট ভূমিকা কোথায়? শুধু টুকটুকির ইচ্ছেকে মেনে নিলে তাতে হৃদয়ের আকুতি থাকে! নিশীথ তাকে মন থেকে গ্রহণ করতে পেরেছে তো আদৌ! টুকটুকির হৃদয় থমকে গেল। শীতল আবহাওয়াতেও গরম লাগছে ভীষণ।
পুরো রাস্তা দুজনের মাঝে কোনো বাক্যালাপ হলো না। বলা চলে, টুকটুকি ইচ্ছে করেই বলল না। দেখতে চাইল নিশীথ নিজ থেকে যদি বলে। তেমন কিছু হলো না। বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামতে টুকটুকি ক্ষীণ শব্দে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে গেল। এরপরের একটা সপ্তাহ সে নিশীথের সঙ্গে কোনোরূপ যোগাযোগ কিংবা দেখা করার চেষ্টা করল না। ও বাড়ির দিকে পা-ও বাড়াল না। আশ্চর্যজনকভাবে নিশীথের পক্ষ থেকেও যোগাযোগের কোনো চেষ্টাই দেখা গেল না। না কোনো ফোন, ম্যাসেজ বা কিছু। রিতা আন্টিকে ফোন করে জানা গেল তার প্রাত্যহিক জীবন নিয়ম মেনে ঝঞ্ঝাটহীনই যাচ্ছে। তাহলে টুকটুকির ভাবনাই কি সঠিক! সেই সম্পর্কটা চাপিয়ে দিয়েছিল নিশীথের ওপর! অসহ্য য’ন্ত্র’ণায় টুকটুকির সর্বাঙ্গ বিবশ হয়ে আসে। অনুভূতির কাছে স্বপ্নগুলো মুখ থুবড়ে পড়লেও এই প্রথম টুকটুকি কাঁদল না।
চলবে…