#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৫০-প্রথম অংশ]
সায়াহ্নের ম্লানতায় বিবশ ধরনী। সূর্য্যি মামা হাই তুলে চোখ বুঝছে ধীরে ধীরে। দিগন্ত ইদানীং ভোর হওয়া ও সন্ধ্যা নামাটা মনোযোগ দিয়ে দেখে। পাখিদের কলকাকলি এই দুটো সময় বেড়ে যায়। নীড় ছাড়া ও নীড়ে ফেরার ধ্বনিতে মুখোরিত থাকে আকাশ, বাতাস। যদিও গাছপালা অপ্রতুলতার শহরে তা কমই উপভোগ করা যায়। শালিক, কাক ও চড়ুই পাখিই দেখা যায় শুধু। বাকিসব কদাচিৎ চোখে পড়ে। দোয়েল পাখিটা শেষ কবে দেখেছে দিগন্তের মনে পড়ল না। সময়টা তার বড্ড ব্যস্ত কাটছে। দিনে ছোটাছুটি, রাতে পড়াশোনা মিলিয়ে শান্তির অবসর মিলছে না মোটেও। অনুভবের বিয়ের আমেজ কাটতেই বন্ধুদের আড্ডাটাও কমে গেছে। অনুভব নতুন সংসার গোছাতে ব্যস্ত, নন্দিনীর হদিস মেলে কালেভদ্রে। টুকটুকি যদিও খোঁজ রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু সবার উপস্থিতি না পেয়ে গ্রুপে আড্ডা জমে না আজকাল। একসঙ্গে দেখা হওয়াটাও কমে গেছে। ফাগুনের তীব্র বর্ষণ শেষে খরা নেমেছে যেন।
দিগন্তের বড্ড হাঁসফাঁস লাগে। চোখের সামনে দিনগুলো সব চলে যাচ্ছে। মাসখানেকও নেই তার ইউএস যাওয়ার। মনে হচ্ছে অনেককিছু করার আছে কিন্তু কিছুই করা হচ্ছে না। এদিকে চলে যাওয়ার সময় নিকটে বলে মা ইদানীং তাকে সময় দিচ্ছে। ভালোমন্দ সবদিক খেয়াল রাখছেন। দিগন্ত সারাটা জীবন বাবা-মায়ের থেকে সময়টাই চেয়ে এসেছে। চেয়েছে যত্ন, ভালোবাসা, আহ্লাদ। দিনশেষে একসঙ্গে বসে একটু উষ্ণতা বিনিময়। কিন্তু ছোটো থেকেই তারা ভাইয়েরা বড়ো হয়েছে কেয়ারটেকার আন্টিদের হাতে। প্রয়োজন ছাড়া বাবা-মায়ের সঙ্গে মন খুলে কথা বলার সাহস তাদের হয়নি। ভুল করলে বাবা-মা শাসন করেছেন, ভালো কিছু করলে গর্ব করেছেন। সফলতা অন্যের কাছে প্রদর্শনে উনারা বেশি সুখ লাভ করতেন। ছোটো থেকেই সন্তানদের ক্যারিয়ার, ফিউচার, সাকসেস নিয়ে ভাবতে শিখিয়েছেন। ছেলেদের ভালোমন্দ নিজেরাই ঠিক করে দিয়েছেন।
দিগন্তের বড়ো ভাই ফারহান চেয়েছিল ফটোগ্রাফার হতে৷ বাবা-মা চাইলেন ইঞ্জিনিয়ার হবে। ফারহান অনিচ্ছায় পড়তে রাজি হলেও ভার্সিটি লাইফ থেকেই নিজের ওপর বাবা-মায়ের নিয়ন্ত্রণ শিথিল করতে শুরু করল। ছোটো থেকেই ফারহান একরোখা, জেদি স্বভাবের। অম্লানের মতো শান্ত, নির্ঝঞ্ঝাট কিংবা দিগন্তের মতো ভীতু নয়। তাই ভার্সিটি লাইফ থেকেই নিজের স্বাধীনতায় পরিবারের অবাধ হস্তক্ষেপ, সন্তানের ইচ্ছে অনিচ্ছে না ভেবে মতামত চাপিয়ে দেওয়া দমন করতে শুরু করল ফারহান। পরিবারের সঙ্গে মনমালিন্যও সেখান থেকেই। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াকালীন ফারহানের গার্লফ্রেন্ড মনিকার সঙ্গে পরিচয় ঘটে। বিয়ে করতে চাইলে তার পরিবার কেরানির মেয়ে মনিকাকে মানল না। তাও আবার মেয়ের গায়ের রঙ কিছুটা চাপা। নানাভাবে ছেলেকে ইমোশনাল ব্ল্যা’ক’মেইল করতে শুরু করলেন উনারা। মনিকার পরিবারকে হেয় করতেও ছাড়ল না। ঠিক তখনই জার্মানিতে স্কলারশিপ পেয়েছিল ফারহান। বাবা-মা শেষে মেনে নিলেন সম্পর্কটা। ফারহান পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরলেই বিয়ে হবে ঠিক হলো। কিন্তু জার্মানি যাওয়ার মাস ছয়েক বাদেই খবর পেল মনিকার অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেছে। পেছনে কার মদদ বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। তীব্র আ’ঘা’ত পেয়ে ফারহান পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেছিল তখন থেকেই। ইঞ্জিনিয়ারিংও ছেড়ে দিয়েছিল। ফটোগ্রাফিকে ধ্যানজ্ঞান করে অস্ট্রেলিয়ায় পড়ে আছে এখন।
বাবা-মা কখনো সন্তানের খারাপ চায় না এই মতবাদ মন মস্তিষ্কে গেঁথে নিয়ে বদরুল-রুহানি দম্পতি সন্তানের মনের চাওয়াটাকে কোনোদিন পাত্তা দেননি। ভাইয়ের সঙ্গে হওয়া অন্যায় দিগন্তের মনেও প্রভাব ফেলেছে তীব্রভাবে। তবে মন্দের ভালো বড়ো ছেলের বিদ্রোহী আচরণের ফলেই বাকি দুজনের ওপর কড়াকড়ি প্রভাব বিস্তার কমিয়েছেন বাবা-মা। তাইতো বুয়েটে চান্স না পেয়ে, এব্রোডে ব্যাচেলর পড়তে না যেয়ে দিগন্ত যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে চাইল বাবা-মা অসন্তুষ্ট হলেও বেশি জোর করলেন না। কিন্তু সামনের সময়টা সহজ হবে না। দিগন্ত যখন নন্দিনীকে চাইবে আবারো একটা ঝড় উঠবে। দিগন্ত সেসব তোয়াক্কা করবে না। নন্দিনী যদি একবার ওকে গ্রহণ করে নেয় দিগন্ত সরাসরি বিয়ে করে নেবে। বড়ো ভাইয়ের মতো ভুল সে করবে না।
দিগন্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইরে তাকায়। দিন ফুরিয়ে রাত নেমেছে। আরো একটা দিন চলে গেল। এক একটা মুহূর্তও এখন অনেকটা মূল্যবান মনে হচ্ছে ওর কাছে। সে নন্দিনীকে কল করল। বেজে বেজে কেটে গেল। এই হয়েছে আরেক জ্বা’লা। ফোনই ধরে না মেয়েটা। দিগন্ত রাগে ফোনটা ছুঁড়ে ফেলতে যাচ্ছিল। তখনই সশব্দে বেজে উঠল ডিভাইস। সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে কল এসেছে।
“রায়হান, কী খবর?”
স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে ত্রিশ বছর বয়সী ঘাড় অবধি লম্বা, কোকড়ানো চুলের অধিকারী ফারহানের দাড়ি-গোফযুক্ত মুখখানা। দিগন্তকে সে আদ্যনামেই সম্বোধন করে। বাবা-মায়ের থেকেও বেশি স্নেহ বড়ো ভাইয়ের কাছ থেকে পেয়েছে বলেই দিগন্ত বরাবর ফারহানের ন্যাওটা। ভাইয়ের নতুন লুক দেখে ভ্রু কুচকে বলল,
“অফিসিয়ালি সন্ন্যাস ধারণ করছ নাকি? কংগ্রাচুলেশনস!”
“হা হা! জঙ্গলে জঙ্গলে ক্যামেরা নিয়ে ঘুরলে এইসবে অভ্যস্ত থাকতে হয়। আমার প্রতি ইঞ্চি দাড়ি-গোঁফ এক একটা স্ট্রাগলের গল্প।”
“সেই গল্পে পশুপাখি না থেকে কয়েকটা সাদা চামড়ার দীর্ঘাঙ্গিনী থাকলে মন্দ হতো না।”
“দুষ্টু! তোর গল্প কতদূর?”
“পথ খুঁজে পাই না, ভাইয়া। দূরত্ব বুঝব কী করে?” দিগন্ত হতাশ গলায় বলে।
“রায়হান, ডোন্ট বি আপসেট। গন্তব্য চিনিস তো। সেই গন্তব্য কাছে হোক বা দূরে তোকে পৌঁছাতেই হবে। আমি আছি তোর পাশে। ওকে জানা মনের কথা। আগে শিওর হ গন্তব্য নিশ্চিত নাকি ধোয়াশা।”
“ভয় হয়। যদি সম্পর্কটা নষ্ট হয়!” দিগন্ত কথাটা বলতে গিয়েও বলল না। ভাইয়ার খাপছাড়া জীবনটায় তার চিন্তা যুক্ত না করলেও চলবে। ও চমকে দিতে বলল,
“মনিকা আপুর ডিভোর্স হয়ে গেছে, জানো?”
“ফাইনালি ডান!” ভাবখানা এমন যেন ফারহান সবই জানে। দিগন্তকে অবাক চোখে চাইতে দেখে ফারহান দুই হাত উঁচিয়ে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে বলল,
“আমার সঙ্গে ওর যোগাযোগ নেই। কাজেই এখানে আমার হাত নেই। স্বামীটা জু’য়ারি ছিল। পলিটিক্সের গ্যারাকলে জেলও খেটেছে দুইবার। মনিকার মতো আদর্শবান মেয়ে এতদিন যে ওই ল’ম্প’টকে সহ্য করে সংসার করেছে সেটাই তো অবাক করার মতো বিষয়। কষ্ট হচ্ছে ওর ছোটো বাচ্চাটার জন্য।”
“তুমি কি কষ্ট দূর করার সুযোগটা নেবে ভাবছ?”
ফারহান কাঁধ ঝাকায়,
“ক্ষতি কি?”
“রিয়েলি!”
দিগন্ত প্রায় লাফিয়ে উঠেছিল। তখনই মিসেস রুহানি রুমে প্রবেশ করলেন। হাতে লন্ড্রি থেকে ফেরা পরিষ্কার, ভাজহীন জামাকাপড়ের স্তুপ। মিসেস রুহানি এক পলকের জন্য স্ক্রিনে বড়ো ছেলের মুখটা দেখে থমকে গেলেন। ফারহান কিছুক্ষণ নিরবে তাকিয়ে থেকে লাইন কেটে দিতেই সম্বিত ফিরে পেলেন। কতদিন বাদে ছেলেটাকে দেখলেন তিনি। ইগো, স্টেটাস, গৌরব যত যাই থাকুক না কেন, মায়ের মন সন্তানের জন্য সর্বদাই কোমল। তিনি জানতে চাইলেন,
“কেমন আছে ফারহান? কী বলছিল ও?”
“ভালো আছে, আম্মু। আমার যাওয়া নিয়ে জানতে চাইছিল।”
মিসেস রুহানি বললেন,
“ও দেশে আসা নিয়ে কিছু বলেছে? আমাদের কথা?”
“আসবে হয়তো এ বছরের শেষে কিংবা পরের বছর।”
দিগন্ত বেশি কিছু বলল না। মনিকার প্রসঙ্গ পুনরায় তাজা হলে সম্পর্কটা যে কোনদিকে এগোবে কে জানে? যেখানে কুমারী মনিকাকেই পরিবার মানল না সেখানে এক বাচ্চার মাকে… রীতিমতো অসম্ভব ব্যাপার!
মিসেস রুহানি এইটুকু শুনেই আশার আলো দেখলেন। একবার এলে কোনো না কোনো উপায়ে বেধে ফেলবেন ছেলেকে। আর যেতে দেবেন না মোটেও। আলমারিতে কাপড় তুলে রাখতে রাখতে বললেন,
“জুহিতার সঙ্গে কথা হয় তোমার?”
“না আম্মু।”
“তুমি বড্ড ঘরকুনো হয়েছ। কারো সঙ্গে মিশতে পারো না। পারার মধ্যে পেরেছ শুধু আজগুবি তিনটে বন্ধু বানাতে।”
দিগন্ত বিড়বিড় করল, “সেটাই আমার সবচেয়ে বড়ো অর্জন, আম্মু।”
“বি ম্যাচিওর মাই সান, সময়ের অপচয় করবে না। তুমি একটাই জীবন পাচ্ছ। জীবনটাকে গৌরবান্বিত করতে না পারলে ব্যর্থদের মতো পরপারে যেতে হবে। তোমার বাবাকে দেখেও তো শিখতে পারো। শুধু মেধা থাকলেই হবে না। সেটার সঠিক ব্যবহার করতে হবে। বিচক্ষণ হতে হবে।”
দিগন্ত কথাটাকে মনে ধারণ করল তীব্রভাবে। জীবন একটাই। সময়ের অপচয় করা অনুচিত। নিজের লক্ষ্য পূরণ না করে ব্যর্থদের মতো ম’রতে চায় না সে। দিগন্ত পরদিন বেলা আটটা বাজতেই ক্যাম্পাসে হাজির হলো। আষাঢ়ের মেঘলা আকাশ তখন সেজে উঠেছে প্রলয়ঙ্কারী ভূষণে। শীতল বায়ুতে দেহটা বড্ড হালকা মনে হচ্ছিল। নন্দিনীকে সে পেল শান বাঁধানো গাছের গুড়িতে বসে থাকা অবস্থায়। বেশভূষা ছন্নছাড়া। মুখখানা শুষ্ক, নির্জীব। দিগন্তকে দেখে ও ভেংচি কেটে মুখ ফেরায়। সফেদ মোল্লার বাড়িতে মি. ক্লিনের সঙ্গে যেটুকু সখ্যতা সে একদিনে গড়ে তুলেছিল সবটা দিগন্ত মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। আষাঢ়ে গল্প ফেঁদে নির্মলের কানে সুন্দরমতো ঢুকিয়ে দিয়েছে নন্দিনীর মাথায় সমস্যা আছে। যার ফলে মুরগীটা হাতছাড়া হয়ে গেল। দিগন্ত ঠোঁট টিপে হেসে পাশে বসতেই হুট করে নাকে ধোঁয়াটে গন্ধ লাগে। হাসি মিলিয়ে গেল মুহূর্তেই। তীক্ষ্ণ মেজাজে বলে উঠল,
“আবারো বাজে জিনিসটা খেয়েছিস?”
নন্দিনী পায়ের কাছে পড়ে থাকা নিঃশেষিত ফিল্টারটাকে দেখতে দেখতে বিরক্ত গলায় বলল,
“একটাই আছিল, তাও শেষ হইয়া গেল। তোর হঠাৎ এত জরুরী তলব ক্যান?”
দিগন্ত রাগে কঠিন হয়। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শক্ত করে ওর হাত ধরে বলে,
“চেইন স্মোকার হয়ে গেছিস? গাঁ জাও টানবি দুদিন বাদে?”
“হুশ! এত পিনিক লাগে না। ট্যাকা হইলে একটা দুইটা সিগারেট টানি না থাকলে টানি না। তবুও পাঁচ-দশ ট্যকার বিড়ি-ফিড়ি অন্তত টানি না। স্বাদের একটা স্ট্যান্ডার্ড আছে না!”
“এতকিছুর স্ট্যান্ডার্ড বুঝিস, স্বাস্থ্যের স্ট্যান্ডার্ড কেন বুঝিস না? তুই কেন এমন করিস, ইকরি-মিকরি। মাঝে মাঝে মনে হয় এই মেয়েটাকে আমি চিনি না। তোর মাঝে অন্যকেউ আছে।”
নন্দিনী চোখের পলক ফেলে বারবার। দৃষ্টি অস্থির, ভেতরটাও অস্থির। জিভ দিয়ে শুষ্ক ঠোঁট ভেজায় একটু পর পর। দিগন্ত সবটা নিরবে পর্যবেক্ষণ করে। ওর দুই কাঁধে হাত রেখে নিজের দিকে ফিরিয়ে নমনীয় স্বরে বলে,
“তোর কষ্টটা কোথায়? বাড়ির কথা মনে পড়ে, বাবা-মায়ের কথা? একবার যাস না কেন বাড়িতে? ছয়টা বছর তো কম সময় না।”
নন্দিনীর আচরণ বদলে গেল সঙ্গে সঙ্গে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বিরক্ত গলায় বলল,
“সকাল সকাল মুড খারাপ করিস না বা*।”
“তোর মুড কবে ভালো থাকে? আবেগ-অনুভূতি কোনোটাই তো কোনোকালে ছিল না৷ না নিজের জন্য আর না অন্যের জন্য। সত্যি করে একটা কথা বল তো।”
“কী?”
“ভালোবাসতে পারিস তুই?”
নন্দিনী কৌতুকপূর্ণ চোখে তাকায়। চোখ টিপে রসাত্মক কণ্ঠে বলে,
“ভালো বাঁশ দিতে পারি।”
“ভালো হয়ে যা ব’দ’মাশ। জীবনটা এভাবে নষ্ট করিস না।”
“আমি তো ভালা না ভালা লইয়াই থাইকো…”
দিগন্ত গানটা অপছন্দ করে। সজোরে মুখ চেপে ধরে দূরত্ব ঘোচায় ও। চোখে চোখ রেখে তেজি গলায় বলে,
“আমার তোকেই লাগবে। হয় তুই বন্যপাখির তপস্যা ভেঙে নীড়ে ফিরবি নয়তো তোর জন্য আমাকেই নীড় ছাড়তে হবে।”
কিছু কিছু সময় মানুষের নাগালে থাকে না। এক লহমায় পরিস্থিতি বদলে যায়। তেমনই এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো দিগন্ত নন্দিনীর মাঝে। দুজনের মাঝে নেমে আসে নিশ্ছিদ্র নিরবতা। নন্দিনী থম মেরে তাকিয়ে আছে দিগন্তের পানে। চেনা চোখে আজ অচেনা ভাষা আকুলিবিকুলি করছে। বোঝাতে চাইছে অব্যক্ত অনুরক্তি। ঘন মেঘের পর্দা সরিয়ে উঁকি দেয় কোমল রোদ। মাথার ওপর চড়ুইপাখিরা কিচিরমিচির করে নিরবতা খন্ডনের চেষ্টায় মত্ত। ঝটকায় মুখের ওপর থেকে হাত সরায় নন্দিনী। তীক্ষ্ণ গলায় বলে,
“মাথামুথা ঠিক আছে?”
“একদম ঠিক আছে।”
দিগন্তের চোয়ালের কাঠিন্য জানান দিচ্ছে সে মজা করছে না। নন্দিনী হঠাৎ স্থির হয়ে গেল। কোনো উচ্চবাচ্য করল না, কোনো উৎকণ্ঠা দেখা গেল না। দিগন্ত অবাক হয়। এমন নিস্পৃহতা সে আশা করেনি। সভয়ে নন্দিনীর হাত ধরল সে। খেয়াল করল মেয়েটির হাত ঠান্ডা, বলহীন। নিচু ও সতর্ক গলায় বলল,
“কিছু তো বল। আমি জানি, তুই আমাকে বুঝিস। বল বুঝিস?”
“তুই ভুলে গেছিস? আমরা ফ্রেন্ড।”
“সো হোয়াট! ফ্রেন্ড ইন ল’ হবো।”
নন্দিনী অচঞ্চল চোখ স্থির হয় দিগন্তের পানে। দিগন্ত সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল,
“বন্ধুত্ব থেকে নতুন সম্পর্ক হতেই পারে, তাই না?”
“শিকুর কথা মাথায় হিট করছে! তাইলে আমিই ক্যান? টুকটুকিও হইতে পারত। ও মিষ্টি, স্বচ্ছ চরিত্রের ভালো একটা মেয়ে।”
“অবশ্যই টুকটুকি ভালো মেয়ে। সেও ভালো একজনকেই পেয়েছে পাশে। কী আর করার, আমার ভদ্র মন এই অভদ্র মেয়েকেই চাইছে। তোর সঙ্গে জুড়ে থাকা সম্পর্কটাকে নতুন একটা নাম দিতে চাইছে।”
নন্দিনী অসহিষ্ণু কণ্ঠে গর্জে ওঠে,
“আমার লাভ লাইফ তোগো সামনেই ছিল। ছিল না? এরপরেও তুই আমারে নিয়া এমন একটা ভাবনা কী কইরা ভাবতে পারোস?”
“তোর লাভ লাইফ চোখের সামনে দেখেছি বলেই আমি হলফ করে বলতে পারি আমার ইকরির মনে কোনো পুরুষ আজ পর্যন্ত ঠাঁই পায়নি। সে কাউকে ভালোবাসেনি। সবাই মনের দরজায় কড়া নেড়েছে। দরজা খোলার চাবিটা স্বয়ং নন্দিনীই কাউকে দেয়নি।”
“তোর মনে হয় তুই দরজা খুলতে পারবি?” নন্দিনী তাচ্ছিল্য করল।
“একটা সুযোগ দিয়েই দেখ।”
নন্দিনী হিমশীতল গলায় বলল,
“বাড়ি যা হালুম। তোরে আমার অচেনা লাগতাছে। বাড়ি গিয়া মাথা ঠান্ডা কর। চেনা মানুষটা হইতে পারলে সামনে আসিস। নয়তো আসার দরকার নাই।”
নন্দিনী মূর্তির মতো উঠে দাঁড়ায়। দিগন্ত ওর পথ রোধ করে ব্যগ্র সুরে জানতে চায়,
“তুই আমাকে রিজেক্ট করছিস?”
“হ্যাঁ।”
“ইকরি প্লিজ! কথা শোন আমার…”
“ভুলে যা সব। অল্প কিছুদিন আছিস দেশে। হাসিমুখে তোরে বিদায় দিতে চাই।”
অবলীলায় বললেও নন্দিনী জানে, ওদের বন্ধুত্বটা আগের মতো থাকবে না। প্রেম অনেকটা নিরাময়হীন অসুখের মতো। একবার যে সম্পর্কে প্রভাব বিস্তার করে তা আর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না। হয় বিপরীত মানুষটাকেও অসুখে জড়াতে হবে নয়তো বিচ্ছেদ। নন্দিনী হৃদয়ঘটিত অসুখে জড়াবে না। বুকের ভেতর হুট করেই ফাঁকা লাগতে শুরু করল ওর। দিগন্তকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই নন্দিনী স্থান ত্যাগ করে।
চলবে…
#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৫০-দ্বিতীয় অংশ]
মেঘবরণ আকাশ হতে ধীর লয়ে গম্ভীর বজ্রধ্বনি ভেসে আসছে। সকাল থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। চারিদিক বারিধারায় সিক্ত। মেঘলা দিনে কর্মব্যস্ত মানুষের মাঝেও আলস্যতা জেঁকে বসে। ঘর ছেড়ে বেরোতে ইচ্ছে করে না। নিশীথকেও আজ আলস্য ধরে বসেছে। বারান্দায় থম মেরে বসে সে একটি অপূর্ণতা অনুভব করছে। চেয়ারের পাশে আরেকটি চেয়ারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে৷ এই শীতলসিক্ত প্রকৃতিতে কারো কোমল হাত ধরে উষ্ণতা বিনিময়ের সাধ জাগছে। কারো আবেগাচ্ছন্ন চোখে নিষ্পলক চেয়ে অনন্ত সময় বইয়ে দিতে চাইছে মন। কানে তার সুমধুর কণ্ঠ নিসৃত রাগ, অভিমান, হাসি কিংবা লাজুক স্বরের মূর্ছনায় ডুবতে ইচ্ছে করছে। নিশীথ নিজের সপ্রতিভ ভাবনার ওপর যারপরনাই বিস্মিত৷ নির্জনতা তাকে কখনো সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করায়নি। নিজেই নিজের শ্রেষ্ঠ সঙ্গ মনে করে এসেছে ও। অথচ আজ সেই সঙ্গটাকেও একলা মনে হচ্ছে। নিশীথ প্রমাদ গুণল মনে মনে। নারী অতি ভয়ংকরী! মনোজগতে ভূমিকম্প সৃষ্টি করে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দেয়। যাকে কল্পনা করে এত সাধ তাকে ফোন করল ও। কিছু বলার আগেই অপরপাশ থেকে ভেসে এলো ঘুম জড়ানো আদুরে স্বর,
“এই, এই পচা রাজা, অসময়ে ডাকবে না তো! একটু ঝরা বন্ধ করো এবার। পরে আবার ঝমঝমিয়ে এসো।”
নিশীথ ভ্রু কুচকায়। কণ্ঠের প্রচ্ছন্নতা জানান দিচ্ছে মহারানী এখনো বিছানা ছাড়েনি। নিশ্চিত হতে সে নমনীয় স্বরে বলে,
“হুমায়রা, তুমি এখনো ঘুমাচ্ছ?”
“হু। রাত দুটোয় শুয়েছি। ঘুম পুরো হয়নি আমার।”
“দুটোয়! আমি তো বারোটায় ফোন রেখেছি। এরপরের দুই ঘন্টা কী করলে? আমার সতীনের সঙ্গে মনে মনে বকবক করেছ?”
“কে তোমার সতীন?”
“কেন, বর্ষণ। তোমার আসমানী রাজা।”
টুকটুকি হেসে ফেলল। ঘুম ছেড়ে গেছে অনেকটা। মনে মনে সে বর্ষণ রাজাকে তুমি বলে সম্বোধন করে আসছে এযাবতকাল। ফোনটা পেয়ে আজ হুট করে এই বাস্তব বর্ষণকেও তুমি করে বলে ফেলেছে সে। বলেই অবশ্য খেয়াল হয়েছে। কিন্তু বিপরীতের মানুষটাও যখন তুমি সম্বোধন করল তখন যেন কোমল পরশ ছুঁয়ে গেল সর্বাঙ্গে। আর আপনিতে ফিরতে ইচ্ছে হলো না। যেন দুজনেই আরেকটু জড়তা ভাঙল, সহজ হলো। টুকটুকি বলল,
“তোমার আরেকটা বৈশিষ্ট্য পেয়েছি বুঝলে। তুমি ভীষণ হিংসুক।”
“একজন আমার চোখের সামনে কল্পনায় সংসার সাজাবে আর আমাকে উদার হতে হবে!”
টুকটুকি কপাল চাপড়ায়। কী করে বলবে কল্পনার সংসারে বাস্তব মানুষটারই নিত্য আনাগোনা। তবে সত্যিটাই বলল ও,
“তোমার সতীনের সঙ্গে নয়। কথা বলেছি রাকিবের সঙ্গে। গুরুত্বপূর্ণ কথা।”
“রাকিব যেন কে? সাংবাদিক লোকটা?”
“হু। বাংলাদেশ সময় রাত একটায় উনার কাজ শেষ হয়। তখনই ফোনে পাওয়া গেল। কথা শেষ করতে করতে দুটো বেজে গেছে।”
নিশীথ হঠাৎ চুপ করে গেল। গম্ভীর গলায় উত্তর করল,
“ফাইন। রাখছি। ঘুমাও তুমি।”
টুকিটুকি বোকা বনে গেল। পুরো কথা না শুনেই ফোন রেখে দিল! আচ্ছা মুশকিল তো এমন হিংসুটে মানুষকে নিয়ে। টুকটুকি আড়মোড়া ভেঙে শোয়া থেকে উঠে বসে। তখনই হুড়মুড় করে ঘরে প্রবেশ করে ঝুমঝুমি। উত্তেজিত, উচ্ছ্বসিত গলায় বলে,
“আপু, আপু, কী খেল দেখালে! রাকিব ভাইয়া তো বিয়ে ভেঙে দিয়েছে।”
টুকটুকি নির্বিকার। এমনটাই তো হওয়ার কথা৷ হবু স্ত্রী অন্য কাউকে ভালোবাসে জানলে কোন পুরুষ গ্রহণ করতে চাইবে? রাকিব বুঝদার মানুষ। জ্বিন নিয়ে বিড়ম্বনার সময়ই বুঝে গেছিল ঘাপলা আছে। সত্যিইটা শুনে তাই বিস্মিত না হলেও ব্যথিত হয়েছে, রাগ করেছে। টুকটুকি ততক্ষণে কেঁদেকেটে অস্থির। মেয়েটির প্রতি দুর্বলতা ছিল বলেই কিনা রাকিব পরিস্থিতি বিগড়ায়নি। টুকটুকি লম্বা হাই তুলে বলল,
“যা তো আমার ভ্রমর৷ এই খবরটা টুক করে পাশের বাড়ি চালান করে দিয়ে আয়। বখশিশ পাবি।”
ঝুমঝুমি যেন সবই বুঝতে পেরেছে এমন একটা মিচকে হাসি দিয়ে ছুট দিল। মিনিট দশেক বাদেই টুকটুকির ফোন কেঁপে উঠল। হোয়াটস্অ্যাপে হৃদয় তোলপাড় করা বার্তা এসেছে,
“রাজা আসছে তোমার দরবারে। রাজরাণী হতে প্রস্তুত হও।”
_________________
স্নিগ্ধ গোধূলি একরাশ ক্লান্তি নিয়ে হাজির হয়েছে নবদম্পতির দুয়ারে। শ্রান্ত অনুভব বাইরে থেকে ফিরেই ফাইলপত্র অবহেলায় ফেলে রেখে খাটে বসল। শার্টের বোতাম খোলার সময় প্রিয়া গুটিগুটি পায়ে পানির গ্লাস নিয়ে হাজির হয়। অনুভব হাসার চেষ্টা করে ওকে দেখে। হাসিটা নিষ্প্রাণ দেখায়। একটা চাকরির জন্য কত চেষ্টাই না করে চলেছে। দিনে এদিক ওদিক ছুটছে, রাতে বইয়ে মুখ ডুবিয়ে রাখছে। কিন্তু আশার আলো কোনোদিকেই জ্ব’লছে না। চারজনের সংসার, বাড়িভাড়া, পড়াশোনার খরচ মিলিয়ে অনুভব প্রিয়া দুজনই সর্বোচ্চ চেষ্টা করে চলেছে। একা হাতে সংসারের কাজ করে প্রিয়া। মেয়েটার কষ্ট যেন কম হয় তাই একটা টিউশনই কন্টিনিউ করতে বলেছে আপাতত। অনুভবের হাতে আছে দুটো টিউশন। তিক্ত অভিজ্ঞতা ওদের দাম্পত্যের মধুর দিনগুলোতে প্রভাব ফেলছে। দুজনই তা বুঝতে পারছে। কিন্তু তীব্র মনের জোর ও ভালোবাসার পবিত্র শক্তিতেই যেন ওরা একাত্ম, অনড়। ক্লান্তিময় দিনগুলো এসে পুনরুজ্জীবিত হয় একে অপরের স্পর্শে। নব উদ্যম জাগে পরবর্তী দিনের লড়াইয়ের জন্য।
অনুভব তিন চুমুকে ঢকঢক করে গ্লাস ফাঁকা করল। ফ্রিজের কনকনে ঠান্ডা পানি খেতে ইচ্ছে করছিল ভীষণ। মনে পড়ল বাড়িতে ফ্রিজ নেই৷ নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাবই এখনো কিনে ওঠা হয়নি। অনুভব ফাঁকা গ্লাস ফিরিয়ে দিয়ে বলল,
“আরেকটু পানি দাও।”
প্রিয়া এনে দিয়ে পাশে বসে। স্বামীর বিক্ষিপ্ত চোখমুখ দেখে বলল,
“শরীর খারাপ লাগছে নাকি মন খারাপ?”
“বউয়ের একটু আদর পেলে শরীর ও মন, সব খারাপই বাপ বাপ করে পালায়।” অনুভব হালকা গলায় মজা করল।
“ফ্রেস হয়ে আসুন। ভালো লাগবে। আমায় এখন রাতের রান্না করতে হবে।” অনুভবকে হতাশ করে প্রিয়া তরাক করে সরে গেল।
বেলা প্রায় ডুবন্ত। দিয়া ছাদে গিয়েছে ঘন্টাখানেক হলো। এখনো না আসায় খোঁজ নেওয়ার জন্য প্রিয়া ছাদে যায়। কিন্তু ছাদে কেউ নেই। এমনিতেই নতুন পরিবেশ। দিয়াকে অচেনা কারো সঙ্গে চট করে মিশতে বারণ করেছে প্রিয়া। সমবয়সী বন্ধু নেই বিল্ডিংয়ে। অনুভব বাড়ি থাকলে হাসি-মজায় মাতিয়ে রাখে ওকে। অথচ আজ অনুভবকে দেখে সে ছুটে এলো না। তাহলে গেল কোথায় মেয়েটা? প্রিয়ার মনে ভয় ঢোকে। বাবার ছায়া থেকে সরে পুরো পৃথিবীটাই তাদের কাছে অচেনা হয়ে উঠেছে। ও রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায় নিচে দেখতে। দিয়াকে দেখা গেল কলাপসিবল গেইটের সামনেই। ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে রঞ্জু ভাই। প্রিয়া অবাক হয়। নেমে আসে দ্রুত পায়ে। রঞ্জুর বোধহয় ইচ্ছে ছিল না প্রিয়াকে দেখা দেওয়ার। তাই মুখোমুখি হতেই সে চমকিত হয়। পরিপাটি পোশাকে আজ তাকে যথেষ্ট মার্জিত দেখাচ্ছে। ফ্যাকাসে ঠোঁটে হাসার চেষ্টা করে বলল,
“প্রিয়ামণি, কেমন আছ?”
“ভালো আছি, রঞ্জু ভাই। এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বাড়িতে আসুন না।”
“না না, আমি এদিকেই আইছিলাম ছোটো ভাই ব্রাদারগো লগে। দিয়ারে দেইখা ডাক দিলাম। শুনছি তোমার বিয়া হইছে অনুভব ভাইয়ের লগে। নতুন সংসার গোছগাছ কইরা লও। তারপরে আইসা দাওয়াত খাইয়া যামু।”
রঞ্জুর কণ্ঠ নিরুত্তাপ। যতটা উৎসাহ সে প্রকাশ করতে চাইছে তার অর্ধেকও পারছে না। চুড়ি পরা হাত, নাকে জ্বলজ্বল করা ছোট্টো নাকফুলটা শেলের মতো বিঁধছে বুকে। তাকিয়ে থাকলে চোখ জ্বালা করে। নারীপ্রিয় রঞ্জু চোখের সামনে কত মেয়ের বিয়ে দেখল, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বস্তির কত মেয়েকে বিয়েও দিল। কিন্তু এই যে এখন, দিনান্তের প্রান্তে এক নববধূকে দেখে যে শূন্যতা তাকে ঘিরে ধরেছে তা বোধহয় কোনো নারীই তৈরি করতে পারেনি। কোনো নারী পূরণও করতে পারবে না। কে জানত, যাকে পাওয়ার সাধ্যি নেই তার প্রতিই রঞ্জু এককালে মনের দিশা হারাবে! অবশ্য ওর মনে কোনো বিদ্বেষ সৃষ্টি হলো না। নারীদের প্রতি ও কখনো বিরূপ আচরণ করেনি, বিরূপ ভাবেনি। সেখানে প্রিয়া নারীদের মধ্যে সদা বিশেষ। তার জন্য অন্তর থেকে আসে অফুরন্ত শুভকামনা। প্রিয়া যেখানেই থাকুক, সুখে থাকুক।
প্রিয়া শান্ত চোখে তাকিয়ে ছিল। রঞ্জু মাথা নত রেখে ইতস্তত করে বলল,
“আজ আসি কেমন? চাচিরে আমার সালাম দিয়ো। এক সময়ের প্রতিবেশী ছিলা, জামাই নিয়া বেড়াইতে আইসো বস্তিতে।”
প্রিয়া ডাকল,
“রঞ্জু ভাই!”
“হু?” রঞ্জু মাথা তুলল না।
“আপনি ভীষণ ভালো মানুষ। বস্তিতে আমাদের অনেক সাহায্য করেছেন। সেই ঋণ শোধ করতে পারব না, তবে আপনার জন্য দোয়া করব। আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দেবেন।”
রঞ্জু প্রস্থান করল। ছুটন্ত পায়ে পেছনে ফেলে গেল এক টুকরো গন্তব্যহীন আবেগ।
প্রিয়া বোনের হাত ধরে তেতলায় ফেরে। দিয়ার জন্য চিপস, জুস, চকলেট দিয়ে গেছে রঞ্জু। মেয়েটা আপাতত তাই নিয়ে ব্যস্ত। প্রিয়া নিজের ঘরে ঢুকে দেখল অনুভব গোমড়া মুখে জানালা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। গোসল করার ফলে ভেজা চুলগুলো সব লেপ্টে রয়েছে। প্রিয়ার দিকে শীতল দৃষ্টি দিয়ে ও বলল,
“দেখা হয়েছে রঞ্জুর সঙ্গে?”
“হয়েছে।”
“বাড়ি এলো না?”
“না। বাইরে থেকেই চলে গেল।”
“ছেলেটা তোমার প্রতি ভয়াবহ দুর্বল কিন্তু।”
প্রিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রঞ্জুর প্রতি তার কোনো অনুভূতি নেই। কৃতজ্ঞতা আছে। কাজেই সে বড়োজোর কামনা করতে পারে যেন রঞ্জু তাকে ভুলে এগিয়ে যায়। অনুভব জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। প্রিয়া এতক্ষণে স্বামীর গোমড়ামুখের কারণ টের পেল। মহাশয় বাড়িতে ঢোকার সময়ই বোধহয় দেখেছে রঞ্জুকে। প্রিয়া পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি অন্যের দুর্বলতায় ব্যথিত নই। আপনি আমায় ভুল বুঝবেন না।”
অনুভব হাত বাড়িয়ে ওকে কাছে টানে। বলে,
“দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা যায়, আসক্তি কাটানো মুশকিল। তুমি আমার আকাঙ্ক্ষিত আসক্তি। তাছাড়া আমি আমার ভালোবাসার ওপর কনফিডেন্ট। কাজেই রঞ্জু টঞ্জুকে নিয়ে ফালতু ভাবনার প্রয়োজন নেই। আমার মতো হ্যান্ডসামের ধারেকাছে কেউ আছে নাকি!”
স্বামীর রূপের গর্বে প্রিয়া হেসে ফেলল, “কেউ নেই।”
__________________
পিচঢালা পথের ধার ঘেঁষে নগ্ন পায়ে হাঁটছে নন্দিনী। মাথার ওপর চড়া রোদ, তবে গতরাতে বৃষ্টি ঝরেছে বলে সোঁদা মাটির স্পর্শে পায়ের তলায় শীতল অনুভূত হচ্ছে। সূর্যের প্রভাবে একদিকে তার গরম লাগছে, কপালে ঘামের বিন্দুকণা ভেসে উঠেছে। আবার কাদামাটির স্পর্শে পা থেকে ঠান্ডাভাব ছড়াচ্ছে দেহে। যুগপৎ উষ্ণ-শীতলের ধাওয়া পালটা ধাওয়ায় দেহ তার অস্থির। মনের ভেতরটা অস্থির অজানা ভাবনায়। বিষয়টা ইদানীং নন্দিনী খেয়াল করেছে। কিছু একটা তাকে অস্থির করছে যা সে জানে না, বুঝতেও পারছে না। অথচ সেই কিছু একটা তাকে শান্তি দিচ্ছে না। নন্দিনীর সঙ্গে কোনো ব্যাগ নেই, টাকাপয়সা নেই, ফোনটাও হলেই ফেলে এসেছে। শূন্য হস্তে, শূন্য মনে রাস্তার ধারে কেন সে হাঁটছে বোধহয় তাও অজানা। কিছু না জেনেই অনেককিছু করা, অবশ্য এ-ও মন্দ কী?
পথের ধার ঘেঁষে ছুটে চলেছে দ্রুতগামী যান। সাঁই করে বাতাস এসে উড়িয়ে দিচ্ছে চুল, জামাকাপড়। নির্বিকার নন্দিনী মাথা নত করে হেঁটেই চলেছে। পায়ের তলায় ভাঙা ইট, পাথরের অমসৃণ কণা ঠোকর কাটছে একটু পর পর। তাতেও সে ভাবলেশহীন। অনুভূতিগুলো কী ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে ওর!
একটা বাইক বেশ হর্ন বাজিয়ে ছুটল পাশ ঘেঁষে। কিছু ছেলে বাইকে উঠে নিজেকে পথের রাজা ভাবে। সবকিছু তুচ্ছ করে স্পিড তোলে, রাস্তার পাশে কোনো রমনীকে চোখে পড়লে বিভিন্ন কায়দায় স্টান্ড দেখাতে চায়। হবে হয়তো তেমনই। নন্দিনী পাত্তা দিল না। তবে এবার বাইক ওর পায়ের ওপর উঠে আসার জোগাড় হয়ে ব্রেক কষল। নন্দিনী লাফিয়ে উঠে সরে যায়। কড়া ভাষায় কিছু বলতে উদ্যত হতেই বাইকারকে চেনা লাগে। হেলমেট খুলে মুখদর্শন দেয় দিগন্ত। চোখ তার টকটকে লাল। চুল উসকোখুসকো। পেছনে বুকে হাত রেখে বসে আছে অনুভব৷ বাইক থামতেই লাফিয়ে নামল ও। বুকে ফু দিয়ে দিগন্তের দিকে চেয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“নতুন বিয়ে করছি। এখনই আমার বউটাকে বিধবা করতে চাইছিস হা’রামী!”
দিগন্ত ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে নন্দিনীর দিকে চেয়ে কাতর স্বরে বলল,
“প্রেম না করেও চরম ছ্যাঁকা খাওয়ার ফিলিং হচ্ছে। আই ওয়ান্ট পিনিক, দোস্ত।”
নন্দিনী তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলল,
“পিনিকেই তো আছোস দেখতাছি। ফুল স্পিডে বাইক চালানো আর জান নিয়া ফুটবল খেলা একই কথা।
“তুই প্লিজ আমার জানটা তোর বুকের মধ্যে রেখে দে। তাহলে আর ভয় নেই।”
অনুভব শিশ বাজিয়ে উঠল বাক্যটা শুনে। নন্দিনী দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
“ছ্যাবলামি করো?”
“কী করব আর? প্রেম তো করতে দিস না।”
দিগন্ত তড়িৎ উত্তর দেয়। ভেবেছিল হালকা মজা করে মেয়েটার সঙ্গে সহজে কথা বলা যাবে। কিন্তু নন্দিনীর মাঝে মজা করার মতো কোনো মানসিকতা দেখা গেল না। হুট করেই সে গম্ভীর হয়ে গেছে। সেদিনের পর একটা সপ্তাহ কতভাবে চেষ্টা করেছে যোগাযোগ করতে, নন্দিনী ফোনটা বন্ধ করে ফেলে রেখেছে। হল থেকেও বেরোয়নি। দিগন্তও হাল ছাড়েনি। তাই আজ নন্দিনী উদ্ভ্রান্তের মতো পথে নামতেই ভাইয়ার শখের বাইকটা নিয়ে ছুটে এসেছে। অনুভব লাইব্রেরি থেকে বই সংগ্রহ করে একই পথে যাচ্ছে বলে লিফট নিয়েছিল৷ কিন্তু দিগন্ত এতটাই মড়িয়া হয়ে বাইক চালিয়েছে যে ভয়ে ছিল কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায় কিনা। দুই বন্ধুর মাঝে মন কষাকষি চলছে তার বুঝতে অসুবিধা নেই৷ আগে ব্যক্তিগত বোঝাপড়া হওয়া প্রয়োজন বুঝে ওদের স্পেস দিতে একটু দূরে সরে গেল অনুভব।
দিগন্তের কথার প্রত্যুত্তরে নন্দিনী থমথমে গলায় বলল,
“প্রেম কর, মানা তো কেউ করে নাই। আজেবাজে চিন্তা ছাইড়া দে।”
প্রকৃতি এখন নবযৌবনা। ভঙ্গুর দুটি মানুষ দাঁড়িয়ে আছে পথের ধারের একটা প্রকান্ড হিজল গাছের তলায়। হিজলের গা বেয়ে নামা লম্বা লম্বা কেশরে ফুটে আছে লাল রঙের ছোটো ছোটো ফুল৷ উল্টো পাশের রাস্তাতেই দেখা যাচ্ছে কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়ার র’ক্তাভ রূপসীদের। যেন প্রকৃতির লজ্জারুণ গাল। সারাবছর যেসকল গাছ দৃষ্টির অগোচরে রয়ে যায়, গ্রীষ্ম ও বর্ষায় সে গাছগুলোই হয়ে ওঠে দৃষ্টিনন্দন। কিন্তু সব ছাপিয়ে দিগন্তের চোখ আটকে দেয় সম্মুখের তরুণীটি। প্রকৃতি প্রতি ঋতুতে রূপ বদলায়। কখনো প্রলংকরী ঝড়, কখনো স্থবির শীত, কখনো মন মাতানো বসন্ত আবার কখনো তপ্ত শরৎ। দিগন্তের কাছে নন্দিনীকে তেমনই মনে হয়। ষড়রূপে অনন্য। ও বাইকটা রোড থেকে নামিয়ে হিজল গাছের তলায় রাখে। নন্দিনীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে,
“কোনটা আজেবাজে চিন্তা? তোকে চাওয়া?”
“কোনো সন্দেহ?”
“একটা সত্যি কথা বলবি? বিয়ে, সংসার, লং টাইম রিলেশনশিপে অবজ্ঞা কেন তোর? প্রেমের নামে প্রহসনে কীসের আনন্দ পাস? একটা বার ইচ্ছে করে না যে একটা নিজের মানুষ হোক?”
“না, করে না। তোকে তো একদমই না।”
মাত্র বারোটা দিন হাতে আছে দিগন্তের। এরপরই প্রিয় মাতৃভূমি ছাড়তে হবে। এইটুকু সময়েই তাকে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্তগুলো নিতে হবে। এদিকে নন্দিনী তার অনুভূতিকে সামান্যতম গুরুত্ব দিচ্ছে না। দিগন্ত ধৈর্য রাখতে পারে না। জীবনে কারো কাছে নিজেকে এতবার নামাতে হয়নি তার৷ দুইহাতে নন্দিনীর বাহু চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বলে,
“কেন? কীসের কমতি আছে আমার? নাকি বাজে ছেলেদের সঙ্গে প্রেম করে রুচি এতটাই নিচে নেমে গেছে যে এখন ভালো কাউকে দিয়ে পোষাচ্ছে না?”
নন্দিনী একই স্বরে জবাব দেয়,
“পোষাচ্ছে না। ক্যান আসছিস তুই? আমি কইছি না আগের হালুম হইতে না পারলে মুখ দেখাবি না আমারে। তারপরেও বেশরমের মতো স্টক করোস ক্যান?”
দুজনকে প্রায় মা’রমুখী হতে দেখে ছুটে আসে অনুভব। দিগন্তকে সরিয়ে নিয়ে বলে,
“মাথা গরম করছিস কেন?”
“আর কী করব ওর সাথে? পাগলের মতো একটু কথা বলতে অপেক্ষা করেছি আর ও বলছে বেশরমের মতো স্টক করছি! কী যোগ্যতা আছে ওর আমার অনুভূতিকে পায়ে ঠেলার? নিজের দিকে তাকিয়ে দেখেছে কখনো? আমার মতো কেউ যে ওকে চেয়েছে তাই তো ওর এক জনমের ভাগ্য।”
নন্দিনী যেন এমন কিছুই শুনবে জানত। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
“যোগ্যতার বিচার করে ফেললি তো। এবার বোঝ ক্যান কইছিলাম আজেবাজে চিন্তা করিস না। আমাদের দুইজনকে সত্যিই মানায় না। না অন্য কোনো সম্পর্কে আর না বন্ধুত্বে৷”
নন্দিনী জোর কদমে দুজনকে অতিক্রম করে চলে যায়। অনুভব বিভ্রান্ত হয়ে দুজনের দিকে চেয়ে আছে৷ বন্ধুত্বের নিশ্চিত ভাঙন যেন চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করছে। দিগন্ত চুলে আঙুল চালিয়ে খা’মচে ধরে। কী হয়ে যাচ্ছে এসব!
পেরেক ফুটে নন্দিনীর পা কেটে গেছে। তবুও পায়ের গতি অপ্রতিরোধ্য ওর। হুট করে রাস্তার অপর পাশে একটি পাজেরো গাড়ি হতে চেনা কণ্ঠ ডেকে উঠল,
“নন্দিনী?”
নন্দিনী থেমে যায়। আমিন সাহেব গাড়ির কাচ নামিয়ে মুখ বাড়িয়েছেন। নন্দিনী দ্রুত ভেবে গলা উঁচিয়ে বলল,
“ওয়েট বস, আসছি।”
রাস্তা পার হতে গেলে দিগন্ত ছুটে এসে হাত চেপে ধরল। অস্থির গলায় বলে,
“কথা শেষ হয়নি আমাদের।”
নন্দিনী হাত ছাড়িয়ে নেয়,
“আর কোনো কথা নেই আমার।”
“বসের সঙ্গে যেতে হবে কেন? এত কীসের সখ্যতা?”
নন্দিনী স্থির চোখে চেয়ে হুমকি দিয়ে বলল,
“অতীতের বন্ধুত্বের খাতিরে ভরা রাস্তায় কিছু কইলাম না। আর একটা শব্দ উচ্চারণ করলে আমি ভুইলা যামু তুই ক্যাডা।”
নন্দিনী রাস্তা পার হয়ে উঠে পড়ল বসের গাড়িতে। আমিন সাহেব সবটা নিরবে পর্যবেক্ষণ করে গাড়ি স্টার্ট দিলেন।
চলবে…