শ্রাবণ কিংবা ফাগুন একটুখানি বর্ষণ পর্ব-৫১

0
496

#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৫১-ক]

নন্দিনী অস্বাভাবিক ঘামছে। আমিন সাহেব তা খেয়াল করে এসি চালু করলেন। পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“গলা ভিজিয়ে নাও।”

নন্দিনী বিনাবাক্য বোতলের সবটুকু পানি নিঃশেষ করে ফেলল। অল্প পানি ঠোঁটের কোল গড়িয়ে গলা বেয়ে নামল। তাতে ভ্রুক্ষেপহীন নন্দিনী। ক্লান্ত পথিকের মতো শ্রান্ত গা এলিয়ে দিল সিটে। অবশ্য খালি পায়ে পথ হারানো পথিকের মতোই ঘুরছিল সে এতক্ষণ। হয়তো হাঁটতে হবে বাকিটা জীবন। তাতেও কোনোরকম আফসোস হচ্ছে কেন জানি। শুধু সুক্ষ্ম একটা যন্ত্রণা ক্ষণে ক্ষণে উঁকি দেয়। তার ভালো থাকার একমাত্র স্থান ছিল যে বন্ধুত্ব তা ফিকে হয়ে গেছে। নন্দিনী চোখ বোজে। বুকের ভেতর আর্তধ্বনি বেজে ওঠে,
“হালুম, হালুম, এ তুই কী করলি? কেন করলি এমনটা?”

আমিন সাহেব গাড়ি চালাতে চালাতে আঁড়চোখে চাইলেন। একটু আগে দেখা ঘটনার ব্যাপারে কৌতুহল হলেও প্রসঙ্গ তুললেন না। বোঝাই যাচ্ছে নন্দিনী বিক্ষিপ্ত। তিনি হালকা গলায় বললেন,
“মন্টুকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছি, শুনেছিলে তো? নতুন ম্যানেজার এপোয়েন্ট করছি নতুন মাস থেকে৷ তোমার জন্য কিন্তু এখনো সুযোগ আছে।”

বাইরে মধ্যদুপুর। মেঘ ও রোদের কাটাকাটিতে আষাঢ়ি দুপুর চঞ্চল। অচঞ্চল নন্দিনী আলতো ঘাড় ঘুরিয়ে বসের দিকে তাকায়। রোদচশমা চোখে মধ্যবয়সী আমিন সাহেব দক্ষতার সাথে স্টিয়ারিং সামলাচ্ছেন। দৃষ্টি নিবদ্ধ ব্যস্ত রাস্তায়। নন্দিনী বলল,
“সেদিনের ঘটনায় আপনি মন্টু ভাইকে ছাড়িয়ে দিলেন। আমাকে কিছু বললেন না কেন? আমার প্রতি আপনার এই পক্ষপাতিত্ব যে সকলের চোখে বাজে তা কী আপনি জানেন না?”

“মন্টুকে আমি বের করেছি। তোমাকে কিছু বললে কী হতো? তুমি নিজেই বের হয়ে যেতে। তাতে আমার লস বৈ লাভ তো হতো না। তারচেয়েও বড়ো কথা, সকলের কথায় তোমার কিছু যায় আসে?”

“কোনোকালেই না। যে সমাজের ভয় মানুষকে ন্যায় বিমুখ করে সেই সমাজের প্রতি আমার কোনো দায় নেই।”

আমিন সাহেব তাকালেন ওর দিকে। কথাটার সুক্ষ্ম অর্থ ধরতে ব্যর্থ হলেও কিছু একটা ভাবলেন। নন্দিনী বলে চলেছে,
“কিন্তু আমায় এতটা ছাড় কেন দেন সেটার কারণও সবার কাছে স্পষ্ট না। রিউমার বাড়তে দিচ্ছেন কেন? চরিত্রে তো সমস্যা দেখি না।”

ঠোঁটকাটা মেয়েটির অকপট উচ্চারণে আমিন সাহেব স্মিত হাসি লুকাতে পারলেন না। নন্দিনী স্থির চোখে চেয়ে আছে। হাসিতে সে বিরক্ত। আমিন সাহেব বললেন,
“চোখ জুড়ানো বউ আছে ঘরে। চরিত্রে সমস্যা হওয়ার কথা না।”

“পুত্রবধূ বানাতে চান? কিন্তু আপনার তো ছেলে-টেলে নেই। আমার হিস্ট্রিও জানেন। কাজেই সেই চান্সেস নেই।”

“আমার কয়টা সন্তান জানো?”

“শুনছিলাম কচিকাঁচা আছে দুইজন মেয়ে।”

“হ্যাঁ কিন্তু ছিল তিনজন।” আমিন সাহেবের কণ্ঠ মলিন। চোখ ঢেকে যায় বিষাদে। নন্দিনী সপ্রশ্নে তাকাল৷ আমিন সাহেব সেই দৃষ্টি পড়তে পেরে পুনরায় বললেন,
“আমার ছেলে তালহা বেঁচে থাকলে তোমার মতোই হতো।”

“কী হয়েছিল ওর?”

“ওর গল্প বলি, মন দিয়ে শোনো। তালহা জন্মানোর পর আমি ওকে এতটাই ভালোবেসেছি যে ঠিক করেছিলাম আর কোনো সন্তান নেব না৷ যদি ওকে ভালোবাসায় কমতি দেখা দেয়! ও থাকাকালীন আর সন্তান আসেনি আমাদের কোলে। ভেবেছিলাম একটা ছেলেকেই গড়েপিঠে মনের মতো করে নেব। তালহা ছোটোবেলায় খুবই শান্ত ছিল। আমার বাধ্যগত পুত্র। পায়ে পায়ে ঘুরত, আমার মতো পোশাক পরতে চাইত। ওর নিষ্পাপ হাসিটা দেখলে মন জুড়িয়ে যেত। সমস্ত ক্লান্তি এক লহমায় উবে যেত। পিতৃত্বের সুখ বোধহয় সেটাকেই বলত। ওর মায়ের থেকেও বেশি আদর যত্ন আমিই করতাম। এরপর যতই সময় যেতে থাকে তালহার ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমি কাজের মধ্যে সময় দেওয়া বাড়িয়ে দেই। তখন আমার শেয়ারে বিজনেস ছিল। ছোট্টো তালহার সঙ্গে আমার দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। তালহা বড়ো হওয়ার সাথে সাথে ধীরে ধীরে এরোগেন্ট হওয়া শুরু করে। বিশেষ করে টিনেজ টাইমে ও আমাদের বোধগম্যতার বাইরে চলে যায়। আচরণে অসংগতি দেখা যায়৷ মিথ্যা কথা বলে, দেরি করে বাড়ি ফেরে। শাসন করতে গেলে মায়ের সঙ্গে তর্ক করে। প্রচন্ড জেদি স্বভাবের হয়ে যাচ্ছিল। পড়াশোনাও ঠিকমতো হচ্ছিল না। ছেলের সঙ্গে আমার বন্ডিং ক্রমশ ভেঙে গেছিল বলে ওকে আর বুঝতেও পারতাম না। সত্যি বলতে আমিও এই ব্যাপারে খুব একটা মনোযোগ দেইনি তখন। ভেবেছিলাম ও মন্দ সঙ্গ পেয়ে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ফলে অধঃপতনে শাসন করতাম সীমাহীন। মা’রধোরও করেছি। তাতে আমাদের সম্পর্কেরও চরম অধঃপতন হয়। তালহার কাছে আমরা খারাপ বাবা-মা হই, আমাদের কাছেও ও খারাপ সন্তান হয়। যেই আমি চার বছরের তালহা বাবা বলে ডাকলে স্বর্গসুখ লাভ করতাম সেই আমিই ষোলো বছরের সদ্য গোফ গজানো কিশোর তালহা বাবা বলে ডাকলে কি বিরক্তই না হতাম। ধমক ছাড়া কথাই বলতে পারতাম না। ভুল করলে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করতাম না৷ রাগারাগি করতাম বেশি। ওর বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেই একপর্যায়ে৷ পড়াশোনার জন্য প্রেশার দেই। তালহা ধীরে ধীরে নিজের ভেতর গুটিয়ে যেতে থাকে। রুম থেকে বের হতো না। কখনো মনে হতো ও সারারাত ঘুমায় না। সব সময় কিছু নিয়ে অস্থির হয়ে থাকত। ওর শান্ত হয়ে যাওয়া দেখে ভেবেছিলাম ছেলেটা ঠিক হচ্ছে। তখনই আমাদের চরম ধাক্কা দিয়ে তালহা হঠাৎ সুই’সা’ইড করে।”

গাড়ি থেমেছে পথের ধারে। আমিন সাহেব যেন সব চোখের সামনে দেখছেন। বর্তমানে বসে অতীতে পরিভ্রমণ করছেন। মানুষের স্মৃতিশক্তি টাইম ট্রাভেলের মতো তাকে অতীতের ঘটনায় টেনে নিতে পারে। যা কখনো সুখের কখনো বেদনার। নন্দিনী মনোযোগী স্রোতা। কোনো কথা বলল না ও। কিছুটা সময় চুপ থেকে আমিন সাহেব নিজেই পুনরায় বলতে লাগলেন,
“সেদিন তুমুল বৃষ্টি ছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠছিল না তালহা। দরজাও খুলছিল না। ওর মা ভেবেছিল রাগ করে বসে আছে। আগেও এমন করত। তাই কয়েকবার ডেকে আর বিশেষ পাত্তা দিল না। বেলা দশটা নাগাদ যখন দরজা খুলল না তখন আমাকে ফোন করে জানাল। আমি ছুটে এসে দারোয়ানকে সঙ্গে নিয়ে দরজা ভেঙে দেখলাম আমার ছেলেটা… সিলিংয়ের সঙ্গে…”

আমিন সাহেব কাঁপছেন মৃদু। কণ্ঠ আর্দ্র। নন্দিনী চোখ বুজে ফেলল। এমন চিন্তা সেও কি করেনি অগণিত বার! বুকের ভেতরটা তপ্ত হচ্ছে ধীরে ধীরে। আমিন সাহেব নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
“তুমি জানো আমি সাইকোলজি নিয়ে পড়াশোনা করেছি৷ অথচ নিজের ছেলের মানসিক অবস্থা আমি ধরতে পারিনি৷ আসলে বোঝার চেষ্টাই করিনি। শেষের দিনগুলোতে তালহা কেন গুটিয়ে গিয়েছিল, কী ছিল ওর মনোব্যথা তা আমার অজানা। উদঘাটন করতে পারিনি ওর বিক্ষিপ্ত আচরণের সুস্পষ্ট কারণ। তালহা প্রমাণ করে দিয়ে গেছিল আমি এক ব্যর্থ পিতা৷ তালহার চলে যাওয়ার পর আমার দুটো মেয়ে এসেছে পৃথিবীতে। ওদের কাছে আমি শ্রেষ্ঠ পিতা। বাবা ওদের সবচেয়ে ভালো বোঝে, ভালো বন্ধু। তালহার সময় আমি ওকে ভালোবাসলেও এমনটা ছিলাম না। আজকের এই আমিটাকে তালহার অভিমানী বিদায়-ই তৈরি করেছে। তালহার মৃ’ত্যুর তিন বছর পর হঠাৎ আমার একটি কিশোরী মেয়ের সঙ্গে দেখা হলো। হাতে কাটা দাগ, চোখে ধিকিধিকি আগুন। কথা বলে উগ্রতার সাথে, চলাফেরা পরোয়াহীন। সেই মেয়েটা কে জানো? তুমি। আই গেস আমি এবার তোমাকে বুঝতে পেরেছি।”

নন্দিনী চমকে তাকায়৷ উজ্জ্বল আলোয় ওর হাতের কাটা দাগের খতগুলো জ্বলজ্বল করছে। আমিন সাহেব কী সত্যিই ওকে বুঝে ফেলেছেন। নন্দিনীর অস্থির হতে থাকে। বারবার শুকনো ঠোঁট সিক্ত করে জিহ্বা দ্বারা। আমিন সাহেব এবার কণ্ঠের আর্দ্রতা সরিয়ে স্বাভাবিক হলেন। বুদ্ধিদীপ্ত চোখে চেয়ে বলেন,
“একটা সিগারেট ধরাও নন্দিনী। তোমার ভালো লাগবে বোধহয়। আই ডোন্ট মাইন্ড।”

আমিন সাহেব নিজেই সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটার এগিয়ে দিল। নন্দিনী দেরি করল না। তৃষ্ণার্তের মতো লুফে নিল। বারকয়েক লম্বা টান দিয়ে মুখ ভর্তি ধোঁয়া ছেড়ে ও যেন হাল ছেড়ে দিল। নিকোটিনেও স্বাদ পাচ্ছে না। আমিন সাহেব ওকে পরখ করতে করতে বললেন,
“তালহার মৃ’ত্যুর পর আমি জগতটাকে নতুন করে দেখতে শিখেছি। মানুষের আচরণের প্রতি লক্ষ্য করা শুরু করেছি। সেই লক্ষ্যের মাঝেই তুমি এসে পড়লে। অল্পবয়সী, বেপরোয়া মেয়েটিকে আমার তালহারই নারীরূপ মনে হলো। কিংবা আরো মারাত্মক কোনো পরিস্থিতিতে আছ। তোমাকে জানতে আমি উদগ্রীব হলাম। আমার বারবার মনে হচ্ছিল তালহাকে বাঁচাতে পারিনি কিন্তু অন্যকাউকে চোখের সামনে আমি একই পরিনতিতে যেতে দেব না। সেই জন্যই একেবারে কম বয়সী, অভিজ্ঞানহীন, পরিবার ছাড়া মেয়েটাকে আমি জবে নিলাম। উদ্ধত আচরণকেও মেনে নিলাম। তোমাকে জানা, তোমার সাইকোলজিক্যাল কন্ডিশন বোঝাই ছিল আমার মূল লক্ষ্য। বাট আই মাস্ট সে, তুমি আমার প্রেডিকশনের বাইরে। সহসাই যা ভেবে বসি পরক্ষণেই তা ভুল প্রমাণিত করে দাও। এর অন্যতম কারণ তুমি নিজে যা তা প্রকাশ করো না। নিজের চারপাশে একটা মেকি চাদর তুলে রেখেছ। সব সময় ফানলাভিং একটা ক্যারেক্টার প্লে করো। আসলে কি তুমি তাই? আমার তো মনে হয় না।”

“কী মনে হয় তাহলে?” নন্দিনী ধীর কণ্ঠে উচ্চারণ করে।

আমিন সাহেব বললেন,
“আমার ধারণা তুমি মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার বা ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডারে ভুগছ। নিজের অজান্তেই একাধিক সত্ত্বা তুমি বানিয়ে ফেলেছ। যেটা তুমি নও কিন্তু সেই হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করো। আবার, যেটা প্রকৃত তুমি সেটাকে ঢেকে রাখতে চাও। সবার থেকে নিজের প্রকৃত সত্ত্বাকে লুকিয়ে রাখতে চাও। তোমার সঙ্গে এই মানসিক রোগের অনেকগুলো মিল আমি খেয়াল করেছি। যেমন সারাক্ষণ মন খারাপ থাকা, কোনোকিছুতে আগ্রহ নেই। এমন রোগীরা সামাজিক নিয়মের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চায় না বা পারে না বলেই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আর সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হলো অবিশ্বাস। প্রেম নিয়ে বোধহয় তোমার তীব্র অবিশ্বাস আছে। যার ফলে তুমি তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ডকে আজ পর্যন্ত বিশ্বাস করোনি। তোমার ধারণা তারা তোমার জীবনে আসেই খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে। হ্যাঁ, অবশ্যই খারাপ উদ্দেশ্য নিয়েই অনেকে আসে। ভালোও আসে। কিন্তু তুমি কাউকেই বিশ্বাস করতে পারো না। আর মোস্ট ডে’ঞ্জা’রাস পার্ট হলো নিজের ক্ষতিসাধন করা। নিজেকে কষ্ট দেওয়া৷ তোমার একাধিক সত্ত্বার মাঝে যখন বিভ্রান্তি ঘটে, তখন তুমি অপ্রকৃতস্থ হয়ে যাও। আ’ত্ম’হ’ননের চেষ্টা করো। কিংবা নিজেকে অ’ত্যা’চার করো। সবটাই ঘটে অনেকটা ঘোরের মধ্যে। তোমার বাস্তবজ্ঞান তখন লোপ পায়।”

নন্দিনী মূর্তির ন্যায় বসে আছে। হাতে ধরা সিগারেট শেষ হয়ে ফিল্টার ছুঁয়েছে। আগুনের ফুলকি হাতে লাগতেই ও সম্বিত ফিরে পেল। ছুঁড়ে ফেলল বাইরে। নিভু নিভু চোখে চেয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল,
“আমি কি পা’গল?”

আমিন সাহেব সস্নেহে হাত রাখলেন ওর মাথায়। মায়ায় বুকটা ভরে উঠল। নিজের ছেলেটাকে যদি একটু বোঝার চেষ্টা করতেন তাহলে এমনই বড়ো হতো আজ। হয়তো সুস্থ একটা জীবন পেত। কিংবা তালহার উছিলায় তিনি আরেকটা মেয়েকে আগলে নিতে পারছেন। আমিন সাহেব বললেন,
“মাই ডিয়ার নন্দিনী, তুমি যথেষ্ট শক্ত মনের মেয়ে। তোমার জীবনীশক্তি অনেক। এমনটা ঘটে সাধারণত চাইল্ডহুড ট্রমা থেকে। তোমার চাইল্ডহুড কেমন ছিল আমি জানি না। হয়তোবা আমারই মতো কোনো অবুঝ প্যারেন্ট ছিল তোমার। কিংবা আরো বেশি এবিউসিভ। যা তোমার মনটা বিষিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে এ’গ্রে’সিভ করে তুলেছে। অথবা অন্য কোনো কারণ। আমি শুধু নিজের প্রেডিকশন বললাম। সবগুলো হয়তো তোমার সাথে মিলবে না। কিন্তু তুমি ভালো নেই এটুকু আমি জানি। শুধু বিয়ে ভাঙার কারণে এতগুলো বছর তুমি পরিবার থেকে দূরে থাকতে না। পালানোর ভুলটা যেহেতু তোমার কাজেই তোমার মাঝে অ’প’রাধবোধ থাকার কথা, যা তোমার মাঝে মোটেও নেই। বাবা-মায়ের ওপর রাগ করে কেন সুন্দর জীবনটাকে নষ্ট করবে? আমি তোমার সুস্থতা কামনা করি সবসময়। তালহা হয়তো ফিরবে না। কিন্তু ওর মতো আর কাউকে চলে যেতে দেখতে আমি সত্যিই পারব না। নিজেকে ভালোবাসো, দেখতে জগতকে ভালোবাসতে শিখে গেছ। আই অ্যাম অলওয়েজ উইথ ইউ, ডিয়ার।”

নন্দিনী কোনো জবাব দিল না। বিবশ হয়ে বসে রইল। নিজেকে চিনে ফেলার যেই ভয় তাকে তাড়া করে বেড়িয়েছে, আজ তা নতুন করে চোখের সামনে। মনে পড়ে মায়ের মেরুদণ্ডহীনতা, বাবার দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, সংসার, সন্তানের প্রতি অনিহা৷ চরম এবি’উ’সিভ একটা পরিবারে বেড়ে ওঠা। যৌথ পরিবারের বড়োদের অ’ত্যা’চার, শাসন। তার ওপর সকলের চাপ। জোর করে বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লাগা। কিশোরী নন্দিনী পারে না কাউকে বুঝতে৷ তাকেও কেউ বোঝে না। বাড়িটা প্রতিনিয়ত তাকে কোনঠাসা করছিল। শ্বাস নিতে পারছিল না। মুক্তির আশায় সে ছটফট করছিল। মুক্তি কি মিলল? না কি মিলল চিরস্থায়ী অদৃশ্য কারাগার?

চলবে…

#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৫১-খ]

গোধূলির আকাশ নববধূর সাজে রঙিন হয়ে উঠেছে। রক্তিম সূর্যটা যেন বধূর কপালের টিপ। শুভ্র মেঘের গায়ে লেপ্টে যাওয়া লালিত আভা যেন বধূর লজ্জারুণ গাল। টুকটুকি আয়নার সামনে বসে নিজেকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। জলপাই রঙা শাড়িতে তার দিক থেকে চোখ ফেরানো দায়৷ ইচ্ছে করেই লাল লিপস্টিকে অধর রাঙিয়েছে সে। মনে মনে বুনছে কল্পনা৷ অস্থির ভঙ্গিতে বারবার ঘড়ি দেখছে। কখন আসবে ওরা? কখন? মনে খানিক শঙ্কা জাগে বাবা-মা প্রস্তাব নাকচ করবে না তো! উহু, সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। শারমিন বেগম মেয়েকে বুঝে ফেলেছেন। সুই এক জায়গাতেই আটকে ছিল শুরু থেকে। সুতোর গিটে মনোযোগ দিতে গিয়ে সেদিকে আর খেয়াল করেননি। নিশীথকে পাত্র হিসেবে শুরু থেকেই পছন্দ ছিল উনাদের। রিতা আন্টি নির্ঝঞ্ঝাট ভালো মানুষ। কাজেই এমন বাড়িতে মেয়ে দিতে আপত্তি থাকার কথা না। তবুও মাঝের সময়গুলো এতভাবে বদলালো যে বিয়ের কথা পুনরায় মসৃণভাবে এগোবে কিনা আশঙ্কা জাগছে। মা অবশ্য তীক্ষ্ণ চোখে মেয়েকে দেখছেন কিন্তু অতিথি আপ্যায়নের আয়োজনে ত্রুটি রাখছেন না। টুকটুকি শাড়ির কুচি ঠিকঠাক করে নিচ্ছিল। মনে হচ্ছে জীবনে প্রথমবার পাত্রপক্ষের সামনে বসতে চলেছে। বুকের ভেতর দুরুদুরু কাঁপন। শিরশিরে অনুভূতি তাকে গুটিয়ে দিচ্ছে ভেতরে ভেতরে। পেটের মধ্যে কিছু একটা পাক খাচ্ছে। কল্পনার জগতে যার বাস তাকে বাস্তবে কয়জনই বা পায়! এতবার কাছেদূরে করেও তো তারা আলাদা হতে পারল না। টুকটুকির মনের জোর তাকে দূরে ঠেলতে দিল না।

রক্তিম আভার বিকীর্ণতায় বিবশ টুকটুকি যখন সুখ ও দ্বিধার দোলাচলে দুলছে তখন এক অত্যাশ্চর্য দৃশ্য ওকে বিমূঢ় করে দিল। টুকটুকির ঘরের জানালা দিয়ে রিতা আন্টির বাড়ির সামনের রাস্তা দেখা যায় পরিষ্কার। সেই রাস্তায় নিশীথের গাড়িটা দাঁড় করানো। রিতা আন্টিকে ধরাধরি করে গাড়িতে তুলছে নিশীথ ও জরি। টুকটুকির বুকটা ধক করে ওঠে। ঝুমঝুমি ততক্ষণে ছুটে এসে জানান দিয়েছে রিতা আন্টি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। জ্ঞান হারিয়েছেন একটু আগে। এখন হসপিটালে নেওয়া হচ্ছে। মুহূর্তেই উৎসবমুখর বাড়িটা স্তব্ধ হয়ে গেল। টুকটুকি ছুটল রিতা আন্টির কাছে। নিশীথ মানিব্যাগ ও গাড়ির চাবিটা এনে ড্রাইভিং সিটে বসতে যাচ্ছিল। টুকটুকি উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে আসতেই সে স্বল্পবাক্যে বলল,
“তুমি মায়ের মাথার পাশে বসো, প্লিজ!”

শাড়িতে সজ্জিত রূপবতী তরুণী ও পাঞ্জাবী পরুয়া তরুণকে দেখে কোনোমতেই তাদের হাসপাতালের পরিবেশের সঙ্গে মানানসই মনে হচ্ছে না। আকর্ষণ বা কৌতুহলেই কিনা অন্য রোগীদের সঙ্গে আগত সদস্যরা টুকটুকিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে। সেদিকে টুকটুকির বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। সে করিডোরে বসে নাক টেনে টেনে কাঁদছে৷ খোলা দিঘল চুল যেন পিঠে হেলে সান্ত্বনা দিতে ব্যস্ত। শাড়ির আঁচল অনাদরে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। নিশীথ তা খেয়াল করে তুলে নিয়ে ওর পিঠে জড়িয়ে দিল। মুখে কিছুই বলল না। মায়ের অবস্থা দেখে সে নিজেই ভয় পেয়ে গেছে। জগতে তার আপন বলতে আছেই ওই মানুষটা। উহু, ভুল হলো, আরেকজন আছে। এই বোকা, পাগলাটে মেয়েটা। তার মায়ের জন্য বুক ভাসিয়ে কাঁদছে। নিশীথের সেই কান্না দেখে আফসোস হচ্ছে। কান্না অনেক বড়ো নেয়ামত। কেঁদে বুকের ব্যথা ঝরিয়ে দেওয়া যায়, হালকা হওয়া যায়। টুকটুকি তা অনায়াসে পারে। নিশীথ পারে না। এমনকি মায়ের জন্য তার বুকের ভেতরটা কতটা অস্থির সেটার কিঞ্চিৎও মুখে ফুটে উঠছে না। উত্তাল সমুদ্র বুকে নিয়ে সে পাহাড়ের মতোই শান্ত, স্থির। তার আপন দুটো নিজের মানুষই যে পাগলাটে স্বভাবের। দুজনকে তাকেই সামলাতে হবে।

নিশীথ ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে টিস্যু পেপার কিনে আনল। টুকটুকির হাতে দিয়ে বলল,
“শান্ত হও। মা ঠিক আছে এখন।”

“কী হয়েছে আন্টির? ডাক্তার কী বলেছে?”

“কয়েকদিন ধরে ঠান্ডা লেগে ছিল। ঠান্ডা থেকেই এজমার প্রকোপ বেড়েছে। সেই সঙ্গে প্রেশার উর্ধ্বমুখী। সব মিলিয়ে ব্ল্যাকআউট হয়ে গেছে৷ কিছু টেস্ট করাতে হবে। তবে ডাক্তার বলেছেন ভয়ের কিছু নেই। রেস্টে থাকতে হবে। আর ঠান্ডা যেন না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।”

“দেখা করতে পারব না?”

“পারবে। অক্সিজেন চলছে এখন। আজ রাতেই মাকে বাড়ি নিয়ে যাব।”

“আচ্ছা।”

টুকটুকি আচ্ছা বলে চুপ করে বসে রইল। নিশীথ নিজেই টিস্যু পেপার নিয়ে ওর চোখ মুছিয়ে দিল। বলল,
“এত চোখের জল কই পাও?”

“পৃথিবীতে তিন ভাগ জল৷ একভাগ স্থল। তিন ভাগ জল আমার দখলে। স্থলের ভাগ তোমার। তাই আমি তরল তুমি কঠিন।”

“তাহলে মনে রেখো, এই যে চোখের জল মুছে দিলাম। আজ থেকে এই অশ্রু মোছার অধিকার একমাত্র আমার।”

টুকটুকি মাথা নত করে৷ নত হয় দৃষ্টি। নিশীথ খেয়াল করে মেয়েটির মুখে প্রসাধনীর অল্পবিস্তর ছাপ রয়ে গেছে এখনো। নিশ্চয়ই খুব শখ করে সেজেছিল, তাকে দেখাবে বলে। অথচ পরিস্থিতি কেমন বদলে গেল! সে টুকটুকির ঘনিষ্ঠ হয়ে ছিল। চুলগুলো কানের কাছে গুজে দিয়ে বলল,
“গরম লাগছে না? চুলে খোপা করে নাও।”

টুকটুকি তার সান্নিধ্যে, যত্নের পেলব স্পর্শে লজ্জাবতী লতার মতো হয়ে গেছিল। স্বাভাবিক হতেই কিনা একটি সরে চুলে খোপা বাধতে গেল। নিশীথের চোখ কয়েক সেকেন্ডের জন্য নিষিদ্ধ স্থানে আটকে গেল। হাত উঁচিয়ে খোপা করায় শাড়ির আঁচল উঁচু হয়ে ফরসা উদর দৃশ্যমান হয়েছে। যদিও তা সামান্যই। সুক্ষ্ম নজরে খেয়াল করছিল বলেই কিনা নিশীথের চোখে পড়ে গেল। ও কেশে, গলা খাকারি টেনে টুকটুকিকে নিজের সৌষ্ঠব দেহের আড়াল করে নেয়। এদিকটায় কেউ নেই, তবুও মনে হলো দেয়ালের চোখ আছে। টুকটুকি কাশির কারণ বুঝতে না পেরে বলল,
“পানি খাবে?”

“আপাতত খোপাটা জলদি করো ম্যাডাম। আর বাঁ হাত উঁচু করবে না।”

কয়েক সেকেন্ড লাগল বুঝতে। টুকটুকি আরক্ত হয়ে দ্রুত হাত নামিয়ে নিল। ঠিক তখনই টুকটুকির বাড়ির লোকেরা এসে উপস্থিত। নিশীথ দূরে সরে গেল। রিতা আন্টির অক্সিজেন খুলে নেওয়া হয়েছে তখন। টুকটুকি ছুটে গিয়ে উনার বুকে হামলে পড়ল। পেছনে এসেছে তার বাড়ির লোক। রিতা আন্টি চোখ মেলে ভালোমতো দেখলেন ছোটো বন্ধুটিকে। মুখে হাত বুলিয়ে বললেন,
“কী কপাল আমার দেখেছিস? ভেবেছিলাম পাত্রীর বাড়ি গিয়ে সাজুগুজু করা মেয়েটাকে দেখব। দাঁত দেখব, চুল দেখব, হাঁটতে বলব, তারপর কবজি ডুবিয়ে খেয়ে বিয়ের জন্য কথা এগোবো। অথচ পাত্রীসহ চলে এলাম হাসপাতালে!”

টুকটুকি বুক থেকে উঠে বলল,
“দুঃখ পেয়ো না। তোমাকে এখানেই পাত্রী দেখাচ্ছি আমি। এই দেখো দাঁত, এই দেখো চুল, এইযে হাঁটছি।”

টুকটুকি সত্যি সত্যিই করে দেখাল। সবাই হেসে ফেলল। নিশীথ মুঠ করে হাতটা ঠোঁটের ওপর রেখে গুরুজনের সামনে সুক্ষ্ম হাসিটা আড়াল করেছে। রিতা আন্টি শারমিন বেগমকে বললেন,
“মাশাআল্লাহ! মেয়ে আমার পছন্দ হয়েছে, আপা। আপনাদের অনুমতি থাকলে আমি এবার তাকে ঘরে তুলতে চাই। আমার বন্ধুটাকে এবার আমাকে দিয়ে দিন।”

শারমিন বেগম মেয়ের উদ্ভট আচরণের ওপর চরম হতাশ হয়ে বললেন,
“সে তো আপনারই ছিল আপা। আমরাই বুঝিনি।”

রিতা আন্টি টুকটুকিকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“এবার আমার ঘরে আয় মা। মরার আগে তোদের দুটিতে সাজানো একটা সংসার দেখে সাধ মেটাই।”
__________________

পায়ে স্যাভলনের ছোঁয়া লাগতেই কপালে যন্ত্রণার ভাজ পড়ল নন্দিনীর। তা নজরে আসতেই টুকটুকি ক্ষতে ফু দিল। তুলো দিয়ে আলতো হাতে ক্ষত পরিষ্কার করতে করতে রাগে গজগজ করল ও,
“তোকে জুতো দিয়ে মা’রা উচিত। এটা গ্রামের মেঠোপথ পেয়েছিস যে খালি পায়ে হাঁটবি? পেরেক ফুটে কী হয়েছে অবস্থা? কিচ্ছু লাগাসনি। আমি যদি না আসতাম তাহলে এভাবেই ফেলে রাখতি! পেকে, ঘা হয়ে একটা পা পঁচে যেত, ভাল্লাগতো? তারওপর লোহায় কেটেছে। এটিএস নিতে হবে জলদি।”

নন্দিনী কোনো জবাব দিল না। সে যে গতকাল খালি পায়ে বেরিয়েছিল সেটাও খেয়াল করতে পারে না৷ শুধু মনে হচ্ছিল বের হতে হবে। কোথায় যাবে, কী করবে কিচ্ছু ছিল না মাথায়। মনে হচ্ছিল মাথার ভেতরটা সম্পূর্ণ ফাঁকা। দেহটাও হালকা। জাগতিক অনুভূতি তাকে আকর্ষণ করতে ব্যর্থ। ঘোর ভেঙেছিল বাইকের প্রচন্ড ব্রেকে। মনে হচ্ছিল ঘুম ভেঙে উঠেছে। নন্দিনী ফ্যালফ্যাল করে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে। টুকটুকি ধমক দিয়ে বলল,
“এই মেয়ে কথা শুনছিস তুই?”

নন্দিনী বিরক্ত গলায় বলল,
“চিল্লাস ক্যান?”

“তুই কথা শুনছিস না ক্যান?”

“তুলু তুলু করা বাদে কিছু কওয়ার থাকলে ক।”

“ওহহ! ভালো করাকে তুলু তুলু করা বলে? তাহলে দেই একটা লাত্থি? বের হোক র ক্ত, সেটা ভালো হবে?”

নন্দিনী বিরক্ত, আচরণ নিয়ন্ত্রণ হারা হচ্ছে। টুকটুকির কোল থেকে পা নামিয়ে নিল। টুকটুকি মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করে। এখন মাথা গরম হওয়া মানেই একটা ঝগড়া হয়ে যাবে। পুনরায় পা কোলে তুলে চুপচাপ পরিষ্কার করে দিল। ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে চুপচাপ চলে গেল খাবার আনতে। ভাত, ডিম ভুনা ও ডাল কিনে এনে থালায় সাজিয়ে নিজের হাতে মাখিয়ে বলল,

“মুখ দেখলে মনে হবে দেশে আকাল পড়েছে। খাবার জুটছে না। চুপচাপ হা করবি।”

খাবার দেখেই হুট করে খিদেয় পেট চনমন করে ওঠে। নন্দিনী বিনাবাক্যে হা করে। টুকটুকি সবগুলো ভাত খায়িয়ে দিয়ে টের পেল নন্দিনীর খিদে মেটেনি। বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল। কে জানে কখন থেকে অনাহারে৷ নিজে না গিয়ে রুমের এক জুনিয়রকে পাঠাল ভাত আনতে। এরপর জিজ্ঞেস করল,
“গতকাল রাতে খেয়েছিস?”

“কী জানি! খেয়াল নাই।”

টুকটুকি আশাহত চোখে চায়। মেয়েটাকে ইদানীং অচেনা মনে হয়। আচরণের যে প্রখরতা ছিল তা বড্ড নড়বড়ে দেখায়। যেন ধাক্কা খেলেই ভেঙে পড়বে। পুনরায় ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দেওয়ার সময় নন্দিনী জিজ্ঞেস করল,
“তারপর? বিয়ার কথা কতদূর?”

টুকটুকি অপ্রতিভ হলো গতকালের ঘটনা মনে করে। রয়েসয়ে বলে,
“বলেছে মাসের শেষে তারিখ ফেলবে। যেন ধীরেসুস্থে আয়োজন করতে পারে।”

“আর কত ধীরেসুস্থে। বিয়াটা খাইতে পারমু তো নাকি?”

“পারবি না কেন? তুই তো আর হালুমের মতো চলে যাচ্ছিস না। ও থাকলে আরো ভালো হতো রে।”

দিগন্তের কথা উঠতে নন্দিনী চুপ করে গেল। খাওয়া শেষে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। চোখ বুজে বাঁ হাতটা চোখের ওপর মেলে দিল, ডান হাত পেটের ওপর। টুকটুকি পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“আমার সঙ্গে চল, ইকরি। বিয়ে পর্যন্ত আমাদের বাড়িতে থাকবি। ভালো লাগবে।”

“তুই যা। আমারে ঘুমাইতে দে এখন।”

“এভাবে কতদিন পালিয়ে বেড়াবি?”

নন্দিনী জবাব দিল না। তার ভারী নিশ্বাস শুনতে পেয়ে টুকটুকি হতাশ হলো। রৌদ্রজ্জ্বল সকালে ধীরে বইছে পূবালী হাওয়া। আকাশের গায়ে পাল তুলে ঘুরছে শুভ্র মেঘের নৌকা। দিগন্ত ক্যাম্পাসেই ছিল। টুকটুকিকে সেই সঙ্গে করে এনেছে। টুকটুকির নিরাশ চেহারা নিয়ে ফিরতেই জানতে চাইল,
“কী অবস্থা?”
“এখন ঘুমাচ্ছে। পায়ে পেরেক ফুটেছে। এটিএস নেওয়াতে হবে।”

এরপর দুজনই কোনো কথা খুঁজে পেল না বলার মতো। ক্যান্টিনে চুপচাপ চা নড়াচড়া করে চুমুক দিয়ে নিরবতা পালন করল। চারপাশে জুনিয়রদের আড্ডামুখর হৈচৈ দেখে স্মৃতির পাতা উজ্জীবিত হয়। টুকটুকি শেষ চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কী করবি হালুম?”

দিগন্ত উর্ধ্বমুখী হয়ে স্তিমিত সুরে বলল,
“জানি নারে। তবে জোর আর করব না। আমার হাতে এগারো দিন আছে, জাস্ট এগারোটা দিন। ও যদি এগারোতম দিনে প্লেনে ওঠার এক মিনিট আগেও আমাকে স্বীকার করে আমি ওকে ছেড়ে যাব না।”

চলবে…